গভীর রাত। চারদিকে বিরাজ করছে চরম নিরবতা। কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সারা শহর ঘুমিয়ে আছে।নিজের ল্যাবরেটরীতে বসে আছেন প্রফেসর শিহাব চৌধুরী। রাত্রি সাড়ে তিনটা বাজে। তাঁর সামনে কিছু কাগজপত্র ছড়ানো। বসে বসে সেগুলো বারবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন তিনি। ভাবছেন, যাক, এতদিনে তাহলে কাজটা ভালোয় ভালোয় সম্পূর্ণ হলো।
একটা জটিল বিষয় নিয়ে গবেষনা করছিলেন তিনি গত নয় বছর ধরে। মাত্র কয়েকদিন আগে সফল হয়েছেন তিনি। বিজ্ঞান একাডেমীকে জানিয়েছেন তাঁর সফলতার খবর। সকাল সাড়ে এগারটায় তিনি এ নিয়ে বক্তৃতা দেবেন বিজ্ঞান একাডেমীর কার্যালয়ে। সেখানে বিজ্ঞান একাডেমীর কর্মকর্তারা থাকবেন। থাকবেন পৃথিবীর বিখ্যাত সব বিজ্ঞানী। আর থাকবে বিজ্ঞান সাময়িকীর রিপোর্টাররা। সেখানে তাঁকে সবার সামনে তাঁর গবেষনার বিষয়টা বুঝিয়ে বলতে হবে। সে জন্যই প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি।
হঠাত পেছনে পায়ের শব্দ হল। না তাকিয়েই বুঝতে পারলেন তাঁর সহকারী মাহবুব এসেছে।
প্রফেসর চৌধুরী অবিবাহিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার আর বিজ্ঞান নিয়ে গবেষনার কারনে সব সময় খুবই ব্যস্ত থাকেন। আসলে সংসারের প্রতি কোন টান অনুভব করেননি কখনও। তাই বয়েস তেপ্পান্ন পেরোলেও বিয়ে করার কথা ভাবেননি তিনি। নিজের কাজ আর সহকারী মাহবুবকে ছাড়া আর কোনদিকে কোন টান নেই ওঁর।
মাহবুবকে নিজের ছেলের মতই ভালবাসেন প্রফেসর। তের বছর বয়েস থেকে মাহবুবকে নিজের মত করে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন তিনি। এবং সফল হয়েছেন। যোগ্য গুরুর যোগ্য শিষ্য হিসেবেই গড়ে উঠেছে মাহবুব। প্রফেসরের সব কাজে যেমন প্রাণপণ সাহায্য করে ও, তেমনি প্রফেসরকে নিজের বাবার মত দেখাশোনাও করে। শ্রদ্ধা তো অবশ্যই করে। এতো রাত পর্যন্ত প্রফেসর জেগে আছেন দেখে ও উঠে এসেছে নিজের কামরা ছেড়ে।
একেবারে প্রফেসরের পেছনে এসে দাড়াল মাহবুব। বলল, “স্যর, ঘুমাবেন না? এত রাত জেগে থাকলে সকালে কনফারেন্স করবেন কি করে?”
মাহবুবের দিকে ফিরলেন প্রফেসর। তাঁর চোখে মাহবুবের জন্য স্নেহ আর ভালবাসা ফুটে উঠল। মুখে বললেন, “এইতো, কাজ শেষ। শেষবারের মত দেখে নিলাম সব কিছু। পরে যদি গুলিয়ে ফেলি, তাই সবকিছু ভালভাবে ঠিক করে নিলাম।”
“কিন্তু” প্রবল আপত্তি ফুটে উঠল মাহবুবের গলায়, “এভাবে রাত জাগলে তো অসুস্থ হয়ে পড়বেন।”
“আজকের রাতটাই শেষ রাত।” ক্ষমা প্রার্থনার সুরে বললেন প্রফেসর। “এরপর আর রাত জাগার কোন কারনই নেই। সবকিছু থেকে কিছুদিন ছুটি নিয়ে দুরে কোথাও বেড়িয়ে আসব দুজন মিলে।”
“ঠিক আছে।” শান্ত কন্ঠে বলল মাহবুব, “এখন ঘুমাতে যান। সকালে তাড়াতাড়ি উঠে আবার বিজ্ঞান একাডেমীর কনফারেন্সে
যেতে হবে আপনাকে।”
প্রফেসরকে তাঁর কামরা পর্যন্ত পৌছে দিল মাহবুব। তারপর মিজের কামরায় গিয়ে ঢুকল।
নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছেন প্রফেসর। কনফারেন্সটা ভালয় ভালয় শেষ করতে পারলে তাঁকে আর পায় কে? সারা দুনিয়ার মানুষ এক নামে চিনবে তাকে। এক অখ্যাত প্রফেসর থেকে রাতারাতি তিনি হয়ে যাবেন বর্তমান কালের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানীদের একজন। হয়ত নোবেল-টোবেলও পেয়ে যেতে পারেন।
সুখস্বপ্নে বিভোর হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন প্রফেসর শিহাব চৌধুরী।
“স্যার”, ডাকটা যেন অনেক দুর থেকে ভেসে আসছে। “স্যার, উঠুন।”
চোখ মেলতে চেষ্টা করলেন প্রফেসর। প্রথম কয়েক মুহূর্ত বুঝতে পারলেন না, কে তিনি, কোথায় তিনি। তারপর হঠাতই সব কিছু মনে হল ওঁর। মাহবুব ডাকছে তাঁকে। আজকে ওঁর বিজ্ঞান একাডেমীর কনফারেন্সে যাওয়ার কথা। তাড়াতাড়ি চোখ মেললেন তিনি।
চোখ খুলতেই বেশ বড় একটা ধাক্কা খেলেন প্রফেসর। এ কোথায় এসেছেন তিনি? এটা তো ওঁর বাড়ি নয়। কি ব্যাপার? ওঁর বাড়ী আর যাই হোক এতটা আলিশান নয়। ওঁর চোখে নিখাদ বিস্ময় আর খানিকটা নগ্ন আতংক খেলা করতে থাকে।
পাশেই দাঁড়িয়ে আছে ওঁর সহকারী মাহবুব। মৃদু হাসছে সে। হাসতে হাসতেই ওঁর দিকে একটু ঝুকে বলল সে, “চলুন স্যর। যাওয়া যাক”।
মাহবুবের দিকে তাকাতেই আরেকটা ধাক্কা খেলেন প্রফেসর। এ কে? মাহবুব কি? কিন্তু এ অবস্থা কেন ওর? সারা শরীর সবুজ হয়ে গেছে কেন? কয়েক ঘন্টার মধ্যে এতোটা পরিবর্তন? কি হয়েছে ওর?
“তোমার কি হয়েছে মাহবুব?” চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করলেন প্রফেসর। “এমন দেখাচ্ছে কেন তোমাকে? পুরো শরীর সবুজ হয়ে গেছে কি করে? আর তাছাড়া আমরা এখন কোথায়? এটা তো আমার বাড়ি নয়।”
কেমন একধরনের হাসি দেখা গেল মাহবুবের মুখে। না, এই মাহবুবকে তো চেনেন না উনি! অন্তত মাহবুবের মুখে এমন অভিব্যক্তি কখনো দেখেন নি। আরো ভয় পেয়ে গেলেন প্রফেসর। মাহবুব বলল, “সবই জানতে পারবেন স্যার। চলুন তো এখন।”
“কোথায়?” ভীত কন্ঠে বললেন প্রফেসর। “কোথায় নিয়ে যাবে তুমি আমাকে?”
“আসুন আমার সঙ্গে। নিজের চোখেই দেখতে পাবেন।” শান্ত কিন্তু ভরাট গলায় বলল মাহবুব। তারপর দড়জার দিকে হাটতে শুরু করল।
তার পেছনে পেছনে মন্ত্রমুগ্ধের মত হাটতে লাগলেন প্রফেসর। জানেন না কোথায় নিয়ে আসা হয়েছে ওঁকে। জানেন না এখন কোথায়ই বা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। শুধু মাহবুবের পেছনে হাটতে লাগলেন ওঁনি।
হাটার ফাঁকে চারদিকে তাকালেন তিনি। মনে হচ্ছে স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো কোন জিনিস দিয়ে বানানো হয়েছে দেয়ালগুলো। ভাল করে খেয়াল করতেই প্রফেসর দেখলেন, শুধু দেয়ালই নয়, পুরো বাড়িটাই সম্ভবত বানানো হয়েছে একই জিনিসের সাহায্যে। এরপর সামনে হাটতে থাকা মাহবুবের দিকে তাকালেন তিনি। বেশ সাবলীল ভঙ্গীতে হেটে যাচ্ছে ও। যেন এই বাড়ির প্রতিটি জিনিস ওর নখদর্পণে। কিন্তু তা কি করে হয়? মাহবুবকে তিনি নিজের সাথেই রেখেছেন সব সময়। কখনো চোখের আড়াল করেননি। মাহবুব তাই জানে, যা তিনি তাকে জানিয়েছেন। তাহলে? সবচেয়ে বড় কথা, যার সাথে তিনি যাচ্ছেন, সে দেখতে হুবহু মাহবুবের মত হলেও গায়ের রঙ সবুজ। এ কেমন কথা? তবে কি এই ছেলে মাহবুব নয়? কি হয়েছে মাহবুবের?
বেশ কিছুক্ষন হাটার পর একটা বড় কামড়ায় নিয়ে যাওয়া হল ওঁকে। কামরার চার দেয়ালজুড়ে বিভিন্ন জিনিস সোভা পাচ্ছে। বিভিন্ন পেইন্টিং, বিভিন্ন পশুর মাথা, চামড়া। অনেক সুন্দর করে সাজানো ঘরটা। ঠিক যেন স্বপ্নের মতো।
সবুজ চেহারার মাহবুব তাকে একটা সোফার কাছে নিয়ে গিয়ে বসতে বলল। কোন কথা না বলে বসলেন ওঁনি। মাহবুবও ওঁর বামপাশে একটা সোফায় বসে পড়ল।
অস্থির লাগছে নিজেকে ওঁর। কি হচ্ছে এখানে? কোথায় নিয়ে আসা হয়েছে ওঁকে? কার কাছে? কেন? কিভাবে? এভাবেই একগাদা প্রশ্ন এসে ভীর করল ওঁর মনে।
“Hello প্রফেসর,” চমকে উঠলেন ওনি। ওনার পেছন থেকে কে যেন কথা বলে উঠল। হুবহু মাহবুবের গলা। কিন্তু মাহবুব তো ওঁর সামনে বাঁ পাশে বসে আছে। তাহলে? ধীরে ধীরে পেছনে তাকালেন ওনি। ঐসময় আবার বলে উঠল কন্ঠটা। “Welcome to the future.”
পেছনে তাকিয়ে ভুত দেখার মত চমকে উঠলেন ওনি। আরেকটা মাহবুব? একই রকম দেখতে। এর গায়ের রঙও সবুজ। কিন্তু কিভাবে? ভুত না তো? সারাজীবন বিজ্ঞান সাধনা করেছেন প্রফেসর। তাই ভুতে তাঁর বিশ্বাস করতে বাধে। কিন্তু এখন তাঁর ভুত বিশ্বাস করতে খুবই ইচ্ছে হচ্ছে। কে জানে কেন!
স্বাভাবিকভাবে তাঁর সামনে দিয়ে হেটে এসে ঠিক সামনে রাখা আরেকটি সোফায় বসল দ্বিতীয় মাহবুব। ওঁর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে ফেলল। জিজ্ঞেস করল, “ভাল আছেন স্যর?
কি করবেন বুঝতে পারছেন না উনি। এক নিস্ফল আক্রোশ দানা বাধছে তাঁর ভেতর। উল্টোপাল্টা কিছু একটা করার ইচ্ছেটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে যেন। কিন্তু এখানে তেমন কিছুই করা যাবে না। নিজেকে বোঝালেন তিনি। নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিলেন প্রফেসর।
তারপর ধীরে ধীরে প্রশ্ন করলেন, “এখানে কি হচ্ছে, দয়া করে বলবে কি আমাকে?”
“বলছি প্রফেসর। তাঁর আগে আমি আপনাকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে চাই।” ধীরে ধীরে কথা বলছে মাহবুব। কিছুক্ষন বিরতি নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা প্রফেসর, বলুন তো আপনার গবেষনাটা যেন কি নিয়ে?
অবাক হলেন প্রফেসর। প্রথমত এইভাবে মাহবুব কখনও কথা বলে না ওঁর সাথে। দ্বিতীয়ত, এই লোকটা যদি মাহবুব হয়, তবে তো তার সবই জানার কথা। কারন কোন কিছুই মাহবুবের কাছে অজানা নেই। তাহলে এ কে?
“প্লিজ প্রফেসর,” যেন অনুনয় করছে সামনে থাকা লোকটা। “আপনি বুঝতে চেষ্টা করুন, আপনার ভালোর জন্যই জিজ্ঞেস করছি এসব কথা। এর সব কিছুরই ব্যখ্যা করব আমি আপনাকে। প্লিজ বলুন।”
কিছুক্ষন ভাবলেন প্রফেসর। কি করবেন বুঝতে পারছেন না। সব কি একে বলে দেবেন, নাকি কিছুই বলবেন না? অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। দেখা যাক কি হয়। বললেন, “আমি যে গবেষনাটা করছিলাম এতদিন, সেটা আসলে মানুষের ভালোর জন্য।” শুরু করলেন তিনি।
“আমরা জানি যে প্রত্যেকটা জীবের বাচতে হলে খাবার দরকার। গাছেরা নিজেদের খাদ্য নিজেরা তৈরী করতে পারে। কিন্তু প্রাণীরা তা পারে না। তাই ওদেরকে মুখ্য বা গৌণ, যেভাবেই হোক গাছের ওপর নির্ভর করতে হয়। স্বাভাবিক। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি কি বলছে?
পৃথিবীতে গাছের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। মানুষ অনেক বেশী। যার ফলে দেখা যাচ্ছে যে, খাবারে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যে খাদ্য উৎপাদন করা হচ্ছে, তা মানুষের জন্য যথেষ্ট নয়। তাই আমার মূল গবেষনাটা ছিল এটা নিয়ে।
এটা তো জানা কথা গাছে ক্লোরোফিল থাকে বলেই তারা তাদের নিজেদের খাদ্য তৈরী করতে পারে সূর্যালোক, কার্বন-ডাইঅক্সাইড আর পানি দিয়ে। আমি গবেষনা করে গাছের কোষের এর যে অংশে ক্লোরোফিল তৈরীর জিন থাকে, তা বের করে নিয়ে এসেছি। তারপর তা এক বিশেষ পদ্ধতিতে মানুষের শরীরে ঢুকানোর ব্যবস্থা করেছি। যার ফলে এখন মানুষকে আর খাদ্য নিয়ে দুঃচিন্তা করতে হবে না।
একইসংগে আমি আরেকটা জিনিষ নিয়ে গবেষনা করছিলাম। হাইড্রা নিয়ে। এটি একটি অতিআণুবীক্ষণিক জীব। তাদের একটা মজার বৈশিষ্ট্য আছে। তাদের বৈশিষ্ট হল, তারা কখনো মারা যায় না। মানে এদের স্বাভাবিক মৃত্যু বলে যে ব্যাপারটা, সেটা নেই। তুমি কখনই একটা হাইড্রাকে মারতে পারবে না। বড়জোর কেটে ফেলতে পারবে। কাটা অংশগুলো থেকে নতুন হাইড্রা তৈরী হবে। এভাবেই ওরা সংখ্যায় বাড়তে থাকে।
এখানেও আমি একই কাজ করেছি। হাইড্রার বিশেষ জিনটা আমি মানুষের দেহে প্রবেশ করানোর জন্য একটা পদ্ধতি বের করেছি। যার ফলে মানুষকে আর মারা সম্ভব হবে বলে মনে হয়না।”
এটুকু বলার পর চোপ হয়ে গেলেন প্রফেসর। তাকিয়ে আছেন সামনে বসা দুই মাহবুবের দিকে।
বাম পাশে বসা মাহবুব উঠে দাড়াল। তার পর কামরার বাইরে চলে গেল। সেই প্রফেসরকে এই ঘরে নিয়ে এসেছিল। আর ঠিক সামনে বসা মাহবুব একটু নড়েচড়ে বসল। তারপর বলল, “আমি আপনাকে একটা গল্প শোনাবো প্রফেসর। মাঝখানে কোন কথা বলবেন না আপনি। আমার কথা শেষ হলে আপনি যে কোন প্রশ্ন করতে পারবেন। আমি তখন সব প্রশ্নেরই জবাব দেব। ঠিক আছে?”
মাহবুব কি বলতে চাইছে, তা বুঝতে পারছেন না প্রফেসর। তারপরও আপেক্ষা করলেন তিনি। দেখা যাক ও কি বলে।
শুরু করল মাহবুব,
“আপনি এই আবিষ্কারটা করার পর কি হয়েছিল জানেন প্রফেসর? কনফারেন্সের আগের রাতে যখন আপনি ঘুমাতে গেলেন, তার ঘন্টা খানেক পরই আমি আপনাকে খুন করি। প্লিজ, নাহ। কিছু বলবেন না প্রফেসর। আগে শুনুন ভাল করে।
আপনাকে খুন করার পর আপনার আবিষ্কারের দাবী করার মত আর কেউ থাকল না। আমি অবশ্য এটাকে মানুষের ভালো করার কাজে লাগাইনি। নিজের উপরই প্রয়োগ করলাম।
ধীরে ধীরে পরিবর্তন ঘটতে লাগল আমার মধ্যে। আমার সারা শরীর সবুজ হতে থাকল। ক্ষুধা লাগলে শুধু পানি খেতে লাগলাম আমি। তাতেই চলতো। তারপর কি হল জানেন?
হঠাত করে গোয়েন্দা বিভাগ লাগল আমার পেছনে। তাদের ধারনা, আমিই আপনাকে খুন করেছি। কিভাবে এটা তারা জানল, তা আমার জানা নেই। কিন্তু ওরা জানতে পেরেছে ঠিকই।
তারপর কয়েক বছর আমি পালিয়ে বেড়াই। কি যে দুঃসহ সময় কেটেছে তখন, তা আপনাকে বোঝাতে পারব না। মাঝে মাঝে মারা যেতে ইচ্ছে করতো। মাঝে মাঝে এমন সব খেয়াল মাথায় এসে জড়ো হতো যে কি বলব। একটা সময় আর ভাল লাগল না পালিয়ে বেড়াতে।
ঠিক করলাম, হয় মরব, না হয় লড়ব। একটা একটা করে গোয়েন্দা বিভাগের সব কটাকে ধরে মেরে ফেললাম। কিন্তু এরই মাঝে এক ভয়ংকর জিনিস আবিষ্কার করলাম। সেটা কি শুনবেন? সেটা হচ্ছে এই, আমি কখনই মরব না।”
মাহবুবের কথা শুনে যেন প্রফেসরের নিঃশ্বাস আটকে আসছে। কি করেছে ও? এসব কি সত্যি? যদি সত্যি হয়, তাহলে তো অনেক খারাপ কিছু ঘটে যাওয়ার কথা। মাহবুবের পরবর্তী কথায় যেন প্রফেসরের আশংকারই প্রতিফলন ঘটতে লাগল।
“কয়েকজন পুলিশ মিলে বোমা মেরে আমাকে বিস্ফোরিত করেছিল। আমার ছিন্নভিন্ন দেহ দেখে তারা ভেবেছিল যে আমি মারা গেছি। আমিও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু আমি আসলে মারা যাইনি। আমার শরীরের প্রত্যেকটা কোষ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিল। আর তা থেকেই নতুন করে জন্ম হল আমার। এবার আর আমি একা নই। অসংখ্য। এবং তা কত তাড়াতাড়ি তা আপনি ভাবতেও পারবেন না।
এ ঘটনার পর আমি বুঝতে পারলাম, আমি অমর। আমাকে আর কেউ মারতে পারবে না। এখন আমি যা খুশী তাই করতে পারি।
পুলিশদের উপর জেদ চেপে গেছিল আমার। ইচ্ছে করছিল সব কটাকে মেরে ফেলি। করলামও তাই। মেরে ফেললাম। সব কটাকে। তারপর গোটা দেশ আমার পেছনে লেগে গেল। কি করব বুঝতে পারছিলাম না। তখন একটা জিনিস আমার মাথায় এল। ক্ষমতা দরকার আমার। পৃথিবীর উপর ছড়ি ঘোরানোর ক্ষমতা।
ঠিক তাই করলাম আমি। নিজের দেশের আইনরক্ষাকারী বাহিনী তো আমার পেছনে লেগেই রয়েছে। তখন আমি সারা পৃথিবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করলাম। বড় বড় দেশগুলো আমার এই কথা হেসেই উড়িয়ে দিল। কিন্তু তাতে আমার জেদটা আরো বেড়ে গেল। সত্যি সত্যি ঝাপিয়ে পড়লাম আমি ওদের উপর।
টানা আট বছর যুদ্ধের পর জিতলাম আমি। ততদিনে আমার সংখ্যা হয়ে গেছে বহুগুন। কয়েক কোটি আমি। ভাবা যায়? তখন আমি ঠিক করলাম, এই পৃথিবী শুধু আমার হবে। তাই পাইকারীভাবে মানুষ মারতে লাগলাম। সবাইকে মেরে ফেললাম আমি। তারপর থেকেই আমার আসল দুর্ভাগ্যের শুরু।”
এটুকু শুনেই প্রফেসরের পেটের ভেতর কেমন যেন করতে লাগল। বমি আসছে তাঁর। কিভাবে এসব কাজ করল মাহবুব? ওর মনে কি কোন দয়ামায়া ছিল না? ছিঃ! এখন ওর দিকে তাকাতেও উনার ঘৃণা হচ্ছে।
মাহবুব বলেই চলেছে।
“আমার শরীরে ক্লোরোফিল থাকার ফলে আমি পুরোপুরি অন্য একটা প্রজাতিতে পরিনত হয়েছি। তার উপর আবার হাইড্রার গুনটাও আছে আমার মধ্যে। তাই আমি অমর। আমি এই নতুন প্রজাতির নাম দিলাম ‘ক্লোরোড্রা’। জানি, সাধারনভাবে যে নাম দেয়া হয়, তার কোন নিয়মই মানা হয়নি এতে।
যাই হোক। কাহিনিতে আসি। ঐ যুদ্ধের পর আমি শুধু মানুষ না, প্রায় সব প্রানীকেই মেরে ফেলেছিলাম। শুধু কিছু গাছ ছিল। আমি তাদের বীজ ছড়িয়ে দিলাম বিভিন্নস্থানে। কয়েক’শ বছর পর পুরো পৃথিবী ভরে উঠল বনভুমিতে। সারা পৃথিবীর এমন কোন জায়গা ছিল না, যেখানে বনভুমি না ছিল। খুশী হয়ে উঠেছিলাম আমি। মনে হচ্ছিল যেন স্বর্গে আছি। কিন্তু আমি জানতাম না যে, আমার খুশীর মেয়াদ বেশিদিন নয়। মাত্র এক হাজার বছর।
একটু আগেই বললাম যে, আমার মধ্যে অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছে। আমি নিজেও জানতাম না যে, এই পরিবর্তনের ফলে আমি আসলে কার্বন-ডাইঅক্সাইড গ্রহন করা শুরু করেছি। বুঝতে পারলাম পরবর্তী এক হাজার বছরে। কয়েক কোটি আমি, আর অসংখ্য গাছ, সবাই মিলে পরিবেশে একদিকে অক্সিজেন ছাড়ছি, অন্যদিকে কার্বন-ডাইঅক্সাইড শুষে নিচ্ছিলাম। এর ফলে পরিবেশে বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। অক্সিজেন টেনে নেবার মত আর কার্বন-ডাইঅক্সাইড ছাড়ার মত কোন প্রানী নেই পৃথিবীতে। যার ফলে পৃথিবী শীতল হতে শুরু করল।
তখন আমি বুঝতে পারলাম, কি করেছি আমি। বাধ্য হয়ে সব গাছ কেটে ফেললাম। কিন্তু তারপরও শেষ রক্ষা হওয়ার কোন সুযোগই ছিল না। তখন আমি আবার বিজ্ঞান নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। কিছু জিনিস আবিষ্কার করলাম অনেক খাটাখাটনির পর। তা দিয়ে প্রকৃতি থেকে অক্সিজেন টেনে নিয়ে কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়তে লাগলাম। এই সমস্যার আপাতত একটা সমাধান হয়ে গেল। কিন্তু তারপর আবার একঘেয়েমীতে ভুগতে শুরু করলাম। তাই নতুন কিছু আবিষ্কারে মন দিলাম।
তারপর আমি আবিষ্কার করলাম সময় ভ্রমনের যন্ত্র। টাইম মেশিন। একসময়কার পৃথিবীর মানুষের স্বপ্ন ছিল এটা। এই ছিল আমার গল্প।”
প্রফেসর শিহাব চৌধুরী হা করে এতক্ষন মাহবুবের কথা শুনছিলেন। এসব কি বলল মাহবুব? এও কি সত্যি? কিভাবে? অনেকগুলো প্রশ্ন একযোগে হামলে পড়ল প্রফেসরের মনে।
বেশকিছুক্ষন কিছুই বলতে পারলেন না তিনি। কি বলবেন? কিছুই খুজে পাচ্ছেন না বলার মত। ওদিকে মুখের ভেতরটাও তেতো হয়ে আছে। মাহবুবের হত্যাজজ্ঞের কথা শুনে একপ্রকার বিষিয়ে গেছে মন। আসলে মনের অবস্থা ঠিক কেমন হয়েছে, তা তিনি নিজেই ভালভাবে বুঝতে পারছেন না।
অনেকক্ষন পর মুখ খুললেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন, “এখন আমাকে কি করতে বল?”
একটু অবাক হল মাহবুব। বলল, “আপনি কিছুই জিজ্ঞেস করবেন না?”
“কি লাভ?” ঠান্ডা গলায় বললেন প্রফেসর। “কোন লাভ আছে জিজ্ঞেস করে? যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে। বুঝতে পারছি আমি আর আমার সময়ে নেই। তোমার সময়ে নিয়ে এসেছ তুমি আমাকে। আমি একটা বোকা। আমার আবিস্কারের ফলে এমন কিছু হতে পারে, তা আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল।”
হাসল মাহবুব। ঠান্ডা হাসি। সব কিছুই বুঝে গেছে এই অতি বুদ্ধিমান বিজ্ঞানী। আর কিছুই বলল না ও। অপেক্ষা করতে লাগল।
কিছুক্ষন পর আবার প্রফেসর জিজ্ঞেস করলেন, “সাফ সাফ বলে দাও, কি চাও তুমি।”
মাহবুব বলল, “আমি আমার সময় কিছুই চাই না স্যার। চাই আপনার সময়ে। আমার মৃত্যু।”
চমকে উঠলেন প্রফেসর। এ কি বলছে মাহবুব। যদিও বুঝতে পারছেন, তবুও জিজ্ঞেস করলেন তিনি, “মানে কি?”
“মানে খুবই সহজ” উত্তর দিল মাহবুব। “আমি চাই, আপনি আপনার সময়ে গিয়ে আমাকে হত্যা করুন।”
-“কেন?”
-“আমার আর বাচতে ইচ্ছে করছে না। একঘেয়েমিতে পড়ে গেছি। মরতে চাই আমি। কিন্তু তাও পারছি না। অনেক ভেবে ভেবে একটা জিনিস আবিস্কার করলাম আমি, আমার বর্তমান তখনই বদলাবে, যখন আমি আমার অতীতকে বদলাতে পারব। তাই আপনাকে ধরে এনেছি। আপনি এখন অতীতে গিয়ে আমাকে হত্যা করবেন। এটাই আমার ইচ্ছে।”
বিষয়টা হজম করতে কিছুক্ষন সময় নিলেন প্রফেসর। তারপর বললেন, “কারন কি শুধুই একটাই? মানে একঘেয়েমি?”
“না স্যর” জবাব দিল মাহবুব। “কারন একটাই নয়। মূল কারন ভিন্ন। আসলে আমি যা করেছি, তার জন্য আমি অনুতপ্ত। আমার অতীত আমাকে শান্তি দেয় না। আমি একটু শান্তি চাই।
আমি আর এভাবে থাকতে পারছি না। দয়া করুন স্যার। আমার উপর, আর সারা পৃথিবীর উপর।”
মিনতি ঝরে পরল মাহবুবের কন্ঠে। প্রফেসর মাথা ঝাকালেন। বললেন, “ঠিক আছে। করব আমি তোমাকে খুন। কিন্তু তা তোমার শান্তির জন্য নয়। পৃথিবীর মানুষের জন্য।”
নিঃশব্দে মাথা ঝাকাল মাহবুব। ওর চোখ দিয়ে পানি বেড়িয়ে এল।
এগিয়ে যাচ্ছেন প্রফেসর। তাঁর সময়ের হিসেবে, কিছুক্ষন আগেই তার সহকারী মাহবুব তাঁকে ঘুমাতে যেতে বলেছে। তিনি তার ঘর থেকে তাঁর রিভলভারটা নিয়ে এসেছেন। এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি মাহবুবের কামরার দিকে।
মাহবুব কি যেন করছিল তার টেবিলে বসে। নিঃশব্দে তাঁর পেছনে গিয়ে দাড়ালেন প্রফেসর। মাহবুবের মাথার দিকে রিভলবার তাক করলেন তিনি।
কিছুক্ষন পর সেই কামরা থেকে দুটো গুলির আওয়াজ ভেসে এল। দুটি শব্দের মাঝখানে সময়ের পার্থক্য মাত্র দুই মিনিট।
পরিশিষ্টঃ সকাল বেলা বিজ্ঞান একাডেমীর কয়েকজন সদস্য প্রফেসরকে নিতে এসে দেখল, তিনি খুন হয়েছেন। তাঁর পাশে তাঁর সহকারী মাহবুবের লাশটাও দেখা যাচ্ছে।