লাইকানথ্রোপি

লাইকানথ্রোপি

বাস্তবতা একসময় হার মানে।এমনকি মানুষ অস্তিত্ব হারায় আপন সত্ত্বার অন্তরালে….

সময়টা ১৬৫০ সালের দিকে।বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চল।সেই অঞ্চলেরই প্যারোমা আইল্যান্ড নিকটস্থ গাছপালা ঘেরা ক্ষুদ্র একটি গ্রাম স্যাকরেড ভ্যালি।খুব বেশি মানুষের বাস যে সেখানে তা নয়।মূলত একে পবিত্র বলে মানা হয় এবং বেশিরভাগ ধর্মযাজকেরা এই গ্রামে বাস করেন।গ্রামের পাশেই রয়েছে মাঝারি গোছের এক জঙ্গল।জঙ্গল কোনো ভয়ের কারণ না হলেও এখানকার বাসিন্দা তথা নেকড়েরা যে খুব বন্ধুসুলভ তা নয়।তাই প্রতিরাতেই অনেককে জেগে থেকে পাহারা দিতে দেখা যায়।

সেই গ্রামেরই এক বাসিন্দা রালফ বার্গলার,একজন বড় মাপের ধর্মযাজক এবং দার্শনিক।তাঁর স্ত্রী এলিনা একজন কারু শিল্পী।তাঁদের একমাত্র ছেলে ফাওলান।সবে মাত্র আঠারোতে পা দিয়েছে।টগবগে তেজি ঘোড়ার মতো ক্ষিপ্রতাসম্পন্ন দেহ ও মন,সোনালি রঙের চুল সবসময়ই ঢেকে রাখে চোখ গুলো,দেহের রঙ সাদা মেঘকেও পরোয়া করে না,গাঢ় নীল বর্ণের চোখ,বক্ষ যেমন উঁচু,কাঁধ তেমনই পাহাড়স্বরূপ।সৃষ্টকর্তা এমন ভাবে সৃষ্টি করেছেন যে,যে কেউ মনে ছেলেটির ছবি আঁকতে বাধ্য হবে।কুস্তিগির হিসেবে খুব নাম ডাক আছে ফাওলানের।আজ এ গ্রাম তো কাল ও গ্রামে কুস্তি লড়েই চলেছে।কিন্তু বাবা রালফ যে এসব খুব পছন্দ করেন তা নয়,তাঁর মতে ধর্মীয় দর্শন বুকে গেঁথে আত্নার সার্বিক উন্নতি সাধনই হচ্ছে জীবন।ছেলের এসব কাজ কে অনাচার মনে করেন তিনি।প্রায়ই এসব নিয়ে বাপ ছেলের মাঝে ‘ধর্মযুদ্ধ’ হয়।ফাওলান প্রায়ই বলত বাবার সামনে একটি নেকড়ে শিকার করে সে দেখাবেই।মা এলিনা অবশ্য সবসময়ই ছেলের পক্ষেই থাকতেন।দিন এভাবেই কাটছিল।

গ্রামে এক নতুন ধর্মযাজক এসেছেন পরিবার নিয়ে।ঊনি ক্যাথলিক দের বড় একজন প্রাইস্ট(priest)।ফাওলান বন্ধুদের নিয়ে তাঁর বাড়ি দেখতে গেল।বাসার সামনে যেতেই দেখল এক ভয়ংকর মায়াবী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির সামনে।চেহারা এতোই উজ্জ্বল যে তাঁর চোখ জ্বলছে তাকাতেই,টানা টানা ভ্রূ,গাঢ় বাদামী রঙের চোখ,চুল রেশমি সুতোর মালার মতো,মাটি ছুঁই ছুই করছে।সব মিলিয়ে এতো অপরূপ যে ফাওলানের বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো এমন মানুষ মর্ত্যে থাকতে পারে!হয়ত স্বর্গ থেকেই পালিয়েছে।তাঁর বিভ্রম কাটল মেয়েটির ডাকে,
‘তোমাকে আমার চেনা চেনা মনে হচ্ছে।আগে কি কোথাও দেখা হয়েছিল আমাদের?’

ফাওলান একটু ভ্যাবাচেকা খেল।একজন হুর পরীও তাঁর মতো ছেলেকে চিনতে পারে!অস্ফুট স্বরে উত্তর দিল,’আমি ঠিক /জানিনা।’

‘ও হ্যাঁ এবার চিনতে পেরেছি,তুমি ফাওলান বার্গলার না?কুস্তিগির?’
‘হ্যাঁ!আপনি কীভাবে চিনলেন?’
‘হাহা,পাম ভ্যালিতে গত সপ্তাহে গিয়েছিলে,আমি সেখানেই থাকতাম।’
মনে পড়ল ফাওলানের।গত সপ্তাহে সেখানে গিয়ে তিন তিনটে ব্রোঞ্জ কয়েন জিতে এসেছে,কুস্তি লড়ে।
মেয়েটি শীতল কন্ঠে বলল,’আমি নুয়ালা।দেখা হয়ে ভালো লাগল,পালোয়ান।হা

হা।’হাসিটা যেন মনের কাঁচ দরজাগুলো ভেঙে দিচ্ছে ফাওলানের।যাক ঈশ্বর মুখ তুলে চেয়েছেন এই অধমের দিকে।

খুব ভালোই বন্ধুত্ব চলছে দুজনের।যখন যা কিছুই হয় নুয়ালা আর ফাওলান সবাই একে অপরের সাথে আলাপ করে।একজন আরেকজন কে না দেখে একদিনও থাকতে পারেনা।ফাওলানের বন্ধুত্বটা মোটেও সত্য নয়,সে চায় ভালোবাসার কথাটা নুয়ালাকে বলতে।কিন্তু কোনো এক জড়তা সর্বদাই তাঁর মনের দরজা টাকে নিগড় দ্বারা পেঁচিয়ে রাখে।নুয়ালা অবশ্য এই সম্পর্ককে বন্ধুত্বের বাহিরে অন্য কিছুতে ভাবতে চায়না।ইদানীং প্রায়ই ফাওলান বিমর্ষ থাকে।একদিন বাঁধল বিপত্তি,ফাওলানের বাবা রালফ এর সাথে নুয়ালার বাবার প্রচণ্ড বাক বিতন্ডা হলো চার্চে।ধর্মীয় কিছু নীতি প্রবর্তনের ক্ষেত্রে দুজন ভিন্ন নীতি প্রদান করেন।এতেই বাঁধে ঝগড়া।একজনের কাছে অন্যজনের টা

ভিত্তিহীন।শেষে এমন অবস্থা হলো যে তাঁদের মুখ দেখা দেখি পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়।এই অবস্থায় ফাওলান আর নুয়ালার বন্ধুত্ব রাখাটাও বিপদজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে,প্রেম তো অনেক দূরের কথা।তাঁদের পরিবার জানলে খুব বড় ধরনের যে সংঘাত হতে পারে সেটা নিশ্চিত বলা যায়।কী করবে ভেবে পায়না ছেলেটা।ফাওলানের মা ঠিকই বুঝতে পেরেছেন,তিনিও সায়ও দিয়েছিলেন।কিন্তু রালফের এমন কান্ড আর তাকে কিছু বলার সাহস যোগায় নি।ইদানীং ফাওলান এসবের চিন্তায় ঘুমাতে পারেনা।

স্যাকরেড ভ্যালির পাশে যে জঙলটি রয়েছে সেটি এক অপূর্ব জাগরণী ভূমি।জাগরণী বলার কারণ হলো এখানে কোনো মানুষ বেড়াতে গেলে সে প্রকৃতির সৌন্দর্যে এতোই নিমগ্ন হয়ে যায় যে মনে হয় পুনঃ আবির্ভাব হয়েছে প্রাণের।নুয়ালা একদিন ঠিক করল যে তাঁরা সেখানে বেড়াতে যাবে।শুধু সে আর ফাওলান,তাহলে মনের হতাশা গুলো কিছু হলেও কমবে।ফাওলানও মেনে নিল,কারণ এটাই মুখ্য সুযোগ নুয়ালা কে তাঁর ভালোবাসার কথাটা বলার।আর সহ্য করতে পারছেনা সে।সুতরাং নির্দিষ্ট দিনেই লুকিয়ে তাঁরা বনে হাঁটতে চলে গেল।

‘এই বেশি দেরি করা যাবেনা।বনে শুনেছি অনেক নেকড়ে থাকে।’,একটু সতর্ক গলায় বলল নুয়ালা।
‘হাহা,ভয় পাস?কী করবি নেকড়ে আসলে?’,একটু অহংকার নিয়েই বলল ফাওলান।

‘কী আর করব বিখ্যাত কুস্তিগির এর ঘাড়ে চড়ে বসব।’,বলেই মুচকি হাসল দুজন।কিন্তু এদিকে ফাওলানের মনে তোলপাড় চলছে ভালোবাসার কথাটুকু বলতে।প্রেমের পীড়া এতো গভীর কেন?প্রায় সন্ধ্যা হয়ে চলেছে।
‘ফাল,আমাদের আর দেরি করা উচিত নয়।চল যাই এবার।’,বলল নুয়ালা।

‘নুয়ালা,তোকে একটা কথা বলতে চাই।প্লিজ আমাকে সময় দে একটু।’,অধীর আকুতির স্বরে জানালো ফাওলান।
‘আচ্ছা কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি।’

‘দেখ সেই প্রথম দিন তোকে দেখেই….’,কথাটি আর শেষ করতে পারল না ফাওলান হঠাৎই তাঁরা শুনতে পায় কিছু একটা আসছে তাঁদের দিকে।সাথে সাথেই ফাওলান ঘিরে ধরে নুয়ালাকে।কয়েক মুহূর্ত পরেই ঝোপের আড়াল থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসে বিশাল আকৃতির এক নেকড়ে।হিংস্র চাহনি,মুখ থেকে অনর্গল লালা ঝরছে,এতো ভয়ংকর দৃষ্টি যেন মানবজাতির অস্তিত্বই সে চায়না।গর গর করতে করতে সামনে এগোচ্ছে।এদিকে নুয়ালা এতই ভয় পেয়েছে যে প্রায় অজ্ঞানের মতো হয়ে গিয়েছে।এই সুযোগ,আজকেই তাঁর শেষ পরীক্ষা হবে,ভাবল ফাওলান।নুয়ালা কে ইশারায় দূরে সরে যেতে বলল।আরো এক মুহূর্ত নীরবতা।তারপরই নেকড়ে আর ফাওলান একজন আরেকজন এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।ফাওলানের অস্ত্র ছিল শুধুমাত্রই শুকনো এক টুকরো গাছের ডাল,বিপরীতে নেকড়ের বিষাক্ত দাঁত আর নখ।প্রথমেই ফাওলান কে এক থাবার মাধ্যমে নেকড়ে টি মাটিতে শুইয়ে দিল।সে ডাল টি নেকড়ের মুখে গুজে আপ্রাণ চেষ্টা করছে কামড় থেকে বাঁচার,একদিকে ভারী অপর দিকে এতো হিংস্র নেকড়ে আর আগে সে

দেখেনি।সাথে সাথেই পেটে লাথি দিয়ে সরিয়ে দিল তাঁর উপর থেকে।নেকড়ে টা আবারও পালটা আক্রমণ করল,এবার সেটির প্রকাণ্ড থাবায় দু টুকরো হয়ে গেল ডালটি।সাথে সাথেই মাথা চেপে ধরল ফাওলান প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে।একদিকে ভাঙা টুকরো গুলো দিয়ে বারংবার আঘাত করছে অপর দিকে মাথা চেপে ধরে রেখেছে।এমন সময় নেকড়েটি প্রচন্ড থাবা দিল ফাওলানের মাথায়,এতো জোরে ছিল যে সাথে সাথেই অনেক দূর ছিটকে পড়ল সে।আহত,রক্তাক্ত নেকড়ের এবার শেষ সুযোগ,প্রচন্ড গর্জন করতে করতে মরণ কামড় দিতে সামনে এগিয়ে যায়।এতো জোরে ফাওলান কে ধাক্কা মারে যে গাছের গোড়ায় বাড়ি খেয়ে জ্ঞান হারাবার উপক্রম হয়ে গিয়েছে।

নেকড়েটি একটু থামল,এটি ভেবেছে সে মারা গিয়েছে।ফাওলান আধো চোখ মেলা অবস্থায়ই দেখল হাতের পাশেই ধারালো ভাঙা ডালটি।একটুও অপেক্ষা না করে সেটি বিদ্যুৎ গতিতে নেকড়েটির পেট বরাবর ঢুকিয়ে দিল।সাথে সাথেই একটি ভয়ংকর আর্তনাদ,তারপর আস্তে আস্তে নেকড়ে টি নীরব হয়ে গেল।ফাওলান পেরেছে।দৌড়ে এলো নুয়ালা।কোনোমতে ধরে তাকে টেনে তুলল।ফাওলান রক্তাক্ত,অবশ্য তাঁর বেশির ভাগই নেকড়েটির।বন থেকে একটু বাহিরে এসেই ফাওলান বুঝতে পারল একটি জায়গা থেকে খুব বেশিই রক্ত পড়ছে।সাথে সাথেই হাঁটুর দিকে তাকাতেই দেখল দুটি দাঁতের গভীর ক্ষত।কেমন মোহনীয় রূপ তৈরি করেছে,গলগল করে রক্ত ঝর্ণার মতো বেরুচ্ছে।নুয়ালা তা দেখে চিৎকার করে নিজের পরনে ফ্রক টা ছিঁড়ে জায়গা টি বেঁধে দিল।দাতব্য চিকিৎসালয়ে যাওয়ার কথা বলতেই ফাওলান কানে না দিয়েই বাড়ি চলে গেল।

বাড়ি ফিরেছে ঠিকই,কিন্তু কাউকে বুঝতে দিচ্ছে না কী হয়েছে।লুকিয়ে কিছু ভেষজ ক্ষতস্থানে দিলেও বুঝা যাচ্ছে কোনো কাজ হবেনা।কাউকে বললেও বুঝে যাবে এটা নেকড়ের কামড়,তখন এই যন্ত্রণা থেকেও আরো বড় সমস্যার সৃষ্টি হবে।প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে কাতরাচ্ছে বিছানায়,পায়ে মনে হয় কেউ হাতুড়ি দিয়ে বারবার আঘাত করে তাঁর সব হাড় চুরমার করে দিচ্ছে।মুখ থেকে ফেনা ঝরছে,তবুও কিছুই করার নেই।অদ্ভুত সব চিন্তা মাথায় কিলবিল করছে,বারবার চোখে ভাসছে সেই নেকড়েটির হিংস্র মুখ।কেনই বা এসব করতে গেল এক তুচ্ছ মেয়েটির জন্য সে?এটার নাম ভালোবাসা?আবার এটাও ভাবছে যদি নেকড়ে টিকে না মারত হয়ত নুয়ালা কেও সে হারিয়ে ফেলত।রাতটা কোনোমতে কাটল।

সকাল হতেই একটু ব্যাথা কমলেও জায়গাটিতে মনে হচ্ছে পচন ধরেছে।খাবারের টেবিলে মা জিজ্ঞেস করলেন,’কী রে এমন খুঁড়িয়ে হাঁটছিস কেন?’

‘না মা তেমন কিছুই না,ঐ খেলতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম।ও ঠিক হয়ে যাবে।’,অস্ফুট গলায় বলল সে,চোখের জ্বল আটকাতে পারছেনা,জীবনে প্রথম মাকে মিথ্যে কথাটা বলল।আবার প্রশ্ন করে বসল,’আচ্ছা মা নেকড়ে কামড়ালে কী হয়?’,প্রশ্নটি শুনে এলিনা একটু চমকে গেলেন।’হঠাৎ এই প্রশ্ন?’,’না মা এমনিই।কৌতূহল।’

‘কী আর হবে,আমি নিজ চোখে তো আর দেখিনি তবে তোর বাবা বলেছেন নেকড়ে কামড় দিলে সেই মানুষটি নেকড়ে মানব হয়ে যায়,অর্থাৎ মানুষ আর নেকড়ের সংমিশ্রণ।এটি অভিশপ্ত জীব।নেকড়ে মানবেরা এক ধরনের অভিশাপ।’,শুনেই ফাওলানের মনে পড়ল আজ থেকে ৮ বছর আগের কথা।আংকেল বরিস,বনে কাঠ কাটতে গিয়েছিল তখন কামড় বসিয়েছে নেকড়ে ছানা।কোনোমতে বেঁচে ফিরলেও কয়েকদিন পরেই এক অদ্ভুত আকার ধারণ করে,নিজের পরিবার পর্যন্ত জায়গা দেয়নি।পুরো গ্রামের মানুষ পিটিয়ে মেরেছিল।মনে নেই এখন এতো।কিন্তু যেটুকু মনে পড়েছে সেটি ভাবতেই মেরুদণ্ড বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নামল।শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে,তবে কি এখন তাঁর শেষ পরিণতি একজন নেকড়ে মানব,যাকিনা অভিশপ্ত?মাথা কাজ করছে না তাঁর।

‘কী রে কী হয়েছে?’,মা একটু অবাক কন্ঠে বললেন।’কিছুনা মা আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।’,বলেই রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেল।

আজ প্রায় এক সপ্তাহ হতে চলল।একটি রাতেও ঘুমাতে পারেনা ফাওলান,প্রচণ্ড পায়ে ব্যাথা আর মৃত্যুকষ্টে ধীরে ধীরে নুইয়ে পড়ছে।অথচ টু শব্দটুকু পর্যন্ত করেনা।এটা কি বাবার কথা না শোনার ফল?আর বাঁচতে পারছেনা এভাবে।ওদিকে নুয়ালারও কোনো খোঁজ খবর নেই,না থাকারই কথা।পায়ের বাঁধন টুকু খুলতেই দেখল ছিন্ন ভিন্ন ক্ষত থেকে পুঁজ বেরিয়ে আসছে,কেমন ভয়াবহ সাদা বর্ণের,একটু খেয়াল করতেই দেখল ক্ষুদ্র কয়েকটি লার্ভাও রয়েছে ভেতরে।পচন ধরেছে তাঁর পায়ে।এসব দেখে আর সহ্য করতে পারল না ফাওলান,চিৎকার করে কাঁদতে লাগল।অসহ্য ব্যথা আর মরণ চিৎকার পরিবেশটাকে ভীতিকর করে তুলছে।সাথে সাথেই দৌড়ে এলেন মা।আসতেই ছেলের এই অবস্থা দেখে তিনিও চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন,’কী হয়েছে তোর?তুই কেন বলিস নি?কীভাবে এসব হয়েছে?এই ফাওলান তুই কথা কেন বলছিস না?তোর বাবাকে ডাকছি।’

‘না মা।ভুলেও বাবাকে ডাকতে যেও না।’,তারপর পুরো ঘটনা সে মাকে বলল।এসব শুনে এলিনা প্রায় অচেতন হওয়ার উপক্রম।কী করবেন ভাবতে পারছেন না।ঘরে যা ভেষজ আছে তা পায়ে লাগালেন,কিন্তু যন্ত্রণা আরো প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে।কোনো কবিরাজ কে দেখানো যাবেনা,নেকড়ের কামড় দেখলে এখুনি তাকে মেরে ফেলা হবে।এমন সময় তাঁর মনে পড়ল যে একজন দূর সম্পর্কের খালা এই গ্রাম থেকে প্রায় ৭ মাইল দূরে থাকেন যিনি এসব বিষয়ে পারদর্শী।এলিনা ঠিক করলেন আজ রাতেই লুকিয়ে সেখানে ছেলেকে নিয়ে যাবেন।ভাগ্য ভালো ফাওলানের বাবা তিনদিনের জন্য বাহিরে গিয়েছেন।মায়ের সামনে ছেলের আর্তনাদ বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক পীড়ার চেয়েও প্রখর।

একটি মাত্র রাত।এইতো একটু পরই তাকে তাঁর মা নিয়ে যাবেন,সে সুস্থ হয়ে যাবে।ফাওলানের অবস্থা খুব খারাপ।চোখ উলটে যাচ্ছে বারবার,মুখ থেকে ফেনা ঝরছে,অদ্ভুত শব্দ বেরিয়ে আসছে গলা থেকে।মনে হচ্ছে পা টা কেউ টেনে হিচড়ে শরীর থেকে খুলে নিয়ে যাচ্ছে।মাথার পাশে বসে ফাওলানের মা যতো মন্ত্র জানা আছে সেগুলো পড়ছেন।সাথে সাথেই ফাওলানের দেহ ঠান্ডা হয়ে যায়,আস্তে আস্তে নীরব হয়ে যায় অভিশপ্ত দেহ ঠিক যেন নেকড়েটির মতো।আর বুক উঠানামা করছেনা।শেষ সব কিছু।এলিনা আর সহ্য করতে পারলেন না,সারা গ্রাম ভেদ করে তাঁর আর্তনাদধ্বনি প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।বারবারই ছেলেকে ডাকছেন,আর কোনো সাড়া নেই ফাওলানের।আশেপাশে থেকে মানুষ দ্রুতই আসল।নুয়ালা ফাওলানের মৃত্যুর খবর শোনে পাগলের মতো আচরণ শুরু

করল,বারবারই বলতে লাগল এসব তাঁর জন্য হয়েছে।এখন আর কিছুই করার নেই।ফাওলান কে সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো।হঠাৎ ঘরের সবাই এক অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেলেন।

অনেক জোরে কারো হৃদস্পন্দন এর আওয়াজ।বারবারই হতে লাগল।বুঝা গেল সাদা কাপড়ে ঢাকা মানুষটা থেকেই আসছে।সাথে সাথেই কাপড় তুলতেই লাফ দিয়ে উঠল ফাওলানের দেহ,কাটা মুরগির মতো ছটফট করছে সে।ঘরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে নেকড়ের গলার আওয়াজ।কেউ থামাতে পারছেনা তাকে,এক যেন ঐশ্বরিক শক্তি ভর করে আছে।এক মুহূর্ত পরই মুখ বিকৃত হতে শুরু করল,শরীর আরো প্রকাণ্ড আকার ধারণ করল,দেহের ভেতরের হাড়ের সাথে হাড়ের সংঘর্ষ বাহিরে থেকে শোনা যাচ্ছে।মুখটা লম্বা হয়ে নেকড়ের মতো হয়ে গেল,ভয়ংকর দুটি দাঁত বেরিয়ে আসছে,দেহ থেকে শুধু লম্বা লম্বা লোম বের হয়ে একাকার করে দিচ্ছে।সাথে সাথেই ফাওলান প্রচণ্ড জোরে হুংকার ছাড়ল,সে আর মানুষ নেই,একজন নেকড়ে মানব।উপস্থিত সবাই বুঝে গেল কী হতে চলেছে।প্রাণপণ ছুটে চলছে সবাই।এলিনা ধরতে গেলে এক থাবায় তাকে সরিয়ে পালিয়ে যায় নেকড়ে মানব টি।

পুরো গ্রামের মানুষ ধাওয়া করছে তাঁর পেছনে।সে এখন যাকে খামচি দেবে তাঁরও পরিণতি হবে এরকম।একসময় ক্লান্ত হয়ে গেল নেকড়ে মানবটি।পেছনে ধাওয়া করছে মশাল,অস্ত্র হাতে হাজারো মানুষ।ফাওলান আবারও নিজের রূপে ফিরে আসল,নিজেকে আবিষ্কার করল অপরিমেয় শক্তির আধার হিসেবে।সে নগ্ন,ক্লান্ত এবং অভিশপ্ত।দূরের ভাঙা কুঁড়ে ঘরটায় আশ্রয় নিল বাঁচার জন্য।

হঠাৎ দরজার কড়া নড়ল।

‘ফাওলান তুই কি এখানে আছিস?আমি জানি তুই আছিস,তুই মরতে পারিস না।বেরিয়ে আয়।’,স্পষ্ট শুনতে পেল

নুয়ালার কন্ঠ।খুঁজে পেল কীভাবে তাকে?

‘তুই আসবিনা আমার কাছে,আমি অভিশপ্ত,আমি মানুষ নই।’,রূঢ় কন্ঠে গর্জন করে উঠল ফাওলান।
‘তুই ফাওলান।এই নে।’,বলেই টাওয়াল টা তাঁর দিকে ছুড়ে দিল নুয়ালা।এরপর একটু একটু করে কাছে আসতে লাগল।আজ পূর্ণ চন্দ্র।চাঁদ এর আলোতে ফাওলানের মুখ জ্বলজ্বল করছে,দূরে কোথাও শোনা যাচ্ছে মশাল হাতে মানুষের চিৎকার।ফাওলানের কাছে এসে পায়ে পড়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল নুয়ালা,’আমার কারণে তোর এসব হয়েছে।ক্ষমা করে দে আমাকে।

ফাওলান কোনো কথা বলছে না।

‘আমি জানি তুই আমাকে ভালোবাসিস,সেদিন আমি বুঝেগিয়েছিলাম।কিন্তু তোকে আর বলতে পারিনি।’,আবারো কেঁদে উঠল নুয়ালা।

এবার ফাওলান আস্তে করে জড়িয়ে ধরল,কিন্তু কোনো কথা বলল না।

‘শোন এখানে বেশিক্ষণ নিরাপদ নয়।তোকে নিয়ে এমন একটা জায়গায় পালাবো যেখানে কেউ আমাদের ধরতে পারবেনা।’,বলল নুয়ালা।’কোথায়?’,গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করল ফাওলান।’তুই আমার সাথে আয় এখুনি।’,বলেই হাতে হ্যাঁচকা টান দিয়ে তুলে ফেলল ফাওলান কে।তাঁরা দৌড়াচ্ছে,মধ্যরাত।সারাটি গ্রাম আগুনের আলোতে আলোকিত।আর কিছু ভাবতে পারছেনা ফাওলান নামের জীবটি।একটু পরেই তাঁরা চলে এলো গ্রামটির সীমান্তে।

‘এখানে আমরা কী করছি নুয়ালা?’,প্রশ্ন করল ফাওলান।সাথে সাথেই পেছন থেকে দুজন লোক তাকে জড়িয়ে ধরে সাথে সাথেই শেকল দিয়ে বেঁধে ফেলল।চিৎকার করছে ফাওলান।

‘নুয়ালা এটা কী করলি?ওরা আমাকে বাঁধছে কেন?নুয়ালা তুই কি বিশ্বাসঘাতকতা করলি?’

‘শোন ফাওলান,তুই যখন নেকড়ে তে পরিণত হবি তখন আর বাস্তবতা স্বাভাবিক থাকবেনা।তুই সমাজের জন্য

বিপদজনক।এখন যেখানে যাচ্ছিস সেখানটা তোর জন্য এবং মানুষের জন্য নিরাপদ।স্বর্গ কি কম সুখের?তাছাড়া আমার বাবার অপমানের শোধ আমি নেবনা এটা কী করে হয়?বন্ধুত্বটাই ছিল নাটক।আমি দুঃখিত ফাওলান।’,স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিল নুয়ালা।ফাওলান কে টেনে ঘোড়ার গাড়িতে তোলা হলো।

‘নুয়ালা তুই এটা করতে পারিস না।তুই আমাকে ভালোবাসিস।আমি তোকে ভালোবাসি।এটা করতে পারিস না তুই।নুয়ালা….।

পুরোটা গ্রাম এখন নীরব,ক্লান্ত।ভোর হতে চলেছে,জঙল থেকে ভেসে আসছে নেকড়েদের হুল্লোড় ধ্বনি….

স্যান ফ্রেন্সিস্কো হাসপাতাল।মনোরোগ বিভাগ।কেবিনে শুয়ে আছে ১৮ বছর বয়সী ফাওলান।পাশেই ডাক্তার নুয়ালা ও ডাক্তার এডওয়ার্ড।বিখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।

‘ডক্টর,আমার ছেলে ঠিক হয়ে যাবে তো?কী হয়েছে ওর?’,আকুতির সাথে প্রশ্ন করলেন মা এলিনা।

বাহিরে এসে ডাক্তার নুয়ালা বলতে লাগলেন,’আপনার ছেলে লাইকানথ্রোপিতে আক্রান্ত।এটি ক্লিনিক্যাল সিজোফ্রেনিয়ার একটি রূপ।আগে পাওয়া তথ্য মতে নেকড়ে মানব বা ওয়ারওল্ফ দের প্রতি তাঁর ছিল তীব্র নেশা,সেটা হোক মুভি,বই কিংবা গেইমস থেকে।একসময় এতোই আসক্ত হয়ে পড়ে যে নিজেকেই ভাবতে শুরু করে একজন নেকড়ে মানব।নিজে নিজেই সৃষ্টি করছে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি।খুব প্রখর কল্পনাশক্তি তাঁর।তাকে হাই ডোজ ঔষধ দিয়ে ঘুম পাড়ানো হয়েছে।খুব রেয়ার রোগটি’,বলেই একটি দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লেন নুয়ালা।এলিনা আবারো প্রশ্ন করলেন,’আমার ছেলে ঠিক হয়ে যাবে তো?’।শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে ফাওলানের দিকে তাকালেন নুয়ালা,খুব মায়াবী চেহারা।দেখে মনেই হয়না এতো বড় রোগ বাসা বেঁধেছে মনে।কৃত্তিম ভাবে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন,’হ্যাঁ হয়ে যাবে’।যদিও তিনি জানেন এর কোনো প্রপার ট্রিটমেন্ট নেই।খুব খারাপ লাগছে নিজের।কেন মানুষকে বিধাতা এতো কষ্ট দেন যদিও বা জানেন তাঁরা কোনোদিনই উত্তীর্ণ হতে পারবে না?…..

বাস্তবতা একসময় হার মানে।এমনকি মানুষও অস্তিত্ব হারায় আপন সত্ত্বার অন্তরালে….

……………………………………………………………….সমাপ্ত……………………………………………………………..

গল্পের বিষয়:
সাইন্স-ফিকশন
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত