আলফ্রেড সাইমন এর জন্ম কাজাঙ্গা ৪ এ। ছোট্ট এই কৃষিপ্রধান গ্রহটির অবস্থান আর্কটার্স এর কাছেই। এখানেই সাইমনের দিনকাল কাটে। সে দিনের বেলা বিস্তৃত গমের ক্ষেতের পরিচর্যাকারী যন্ত্র চালায় আর সারা বিকেল ধরে পৃথিবী থেকে আনা রেকর্ড করা গান শোনে, ভালবাসার গান। তবে কৃষিকাজে সাইমনের খুব বেশি একটা মন নেই। সে একটু ভাবুক প্রকৃতির। বসবাসের জন্য কাজাঙ্গার মত ভাল জায়গা আর হয় না, এ কথা সবাই একবাক্যে স্বীকার করবে। এই গ্রহের মেয়েরা আবেদনময়ী, খোলামেলা মনের, হাসিখুশী মানুষ। কোন এক তপ্ত দুপুরে ছায়াময় পথে তাদের সাথে ঘুরে বেড়ানো কিংবা লেকের পানিতে একসাথে সাঁতার কাটার জন্য তাদের চেয়ে ভাল সঙ্গী আর হয় না। কিন্তু তারপরও সাইমনের তাদের খুব একটা পছন্দ হয় না। সাইমনের মনে হয়, তাদের মধ্যে কিছু একটা নেই। কোন জিনিসটা নেই সেটা হঠাৎই একদিন সাইমন বুঝতে পারল। অনেক পুরনো ভাঙ্গাচোরা এক স্পেসশিপে করে কাজাঙ্গায় এল এক পুরাতন বই এর ফেরিওয়ালা।
লোকটা দেখতে পাগলের মত, সাদা লম্বা দাড়ি দিয়ে মুখ তার ভরা। তারপরেও অনেকদিন পরে এই এলাকায় মহাকাশ থেকে কেউ আসায় সবাই আনন্দের সাথেই তার জন্য উৎসবের আয়োজন করল। সেই রাতের উৎসবে কাজাঙ্গার মানুষ তাকে ঘিরে ধরে, জানতে চায় গ্যালাক্সির খোঁজ খবর, কোথায় কি হচ্ছে, নতুন কি হল। সেই বুড়ো ফেরিওয়ালা তাদের শোনাল ব্যবসায়িক বিনিময়মুল্য নিয়ে ডেট্রয়েট ২ আর ডেট্রয়েট ৩ এর মধ্যকার মন কষাকষির খবর, আলফায় মাছের বাজার কেমন খারাপ যাচ্ছে, মোরাসিয়ার প্রেসিডেন্টের স্ত্রী কোন পোশাক পড়ার কারণে সমালোচিত হলেন, ডোরান ৫ এর মানুষরা কি অদ্ভূতভাবে কথা বলে; অবশেষে ভীড়ের মধ্য থেকে একজন বলে উঠল, আমাদের পৃথিবীর গল্প শোনান! “পৃথিবীর গল্প শুনবে? মানব সভ্যতার জন্মদাত্রী পৃথিবীর মত আর কোন গ্রহ এই গ্যলাক্সিতেই নেই। এই গ্রহে অসম্ভব বলে কিছু, সবকিছুই সেখানে সম্ভব,” বুড়ো বিদঘুটে ভাবে হেসে বলল। “অসম্ভব বলে কিছুই নেই?” সাইমন জানতে চায়। “তাদের যে একটা আইন আছে, কোন কিছুতেই না বলা যাবে না! আজ পর্যন্ত কেউ সেই আইন ভেঙ্গেছে এমন শোনা যায়নি!” বিদঘুটে হাসিটা আবার ফিরে আসে বুড়োর মুখে। “তোমরা তো কৃষিকাজে দক্ষ, পৃথিবীর মানুষেরা কিসে দক্ষ জানো? যত রকম আজগুবি জিনিস আছে, পাগলামি, নেশা, সৌন্দর্য, যুদ্ধ, আতঙ্ক, ক্রোধ এইসব নিয়ে পৃথিবীর মানুষের কাজ কারবার। আর এসবের স্বাদ নিতে হাজার হাজার আলোকবর্ষদূরের গ্রহ থেকে লোকজন পৃথিবীতে ছুটে আসে।” এবারে থেমে সবার দিকে তাকায় বুড়ো, তার কথায় সবার প্রতিক্রিয়া দেখতে চায়। সবাই চুপ করে তাকিয়ে আছে তার দিকে, “আর ভালবাসা?” জিজ্ঞাসা করল এক মেয়ে খানিক পরে। ”আহা! ভালবাসা! মেয়ে গো! পৃথিবীই একমাত্র জায়গা যেখানে তুমি ভালবাসা খুঁজে পাবে। ডেট্রয়েট ২ আর ৩ এর মনে হয়েছে জিনিসটার জন্য অনেক বেশি মুল্য দিতে হবে, তাই তারা এটার চর্চা করেই না।
আলানা ভালবাসা আমদানী করল না জিনিসটা অস্থিতিশীল আর ঝুকিপুর্ণ বলে। একমাত্র পৃথিবীতেই এইসব আজগুবী জিনিস পাওয়া যায়, আর তারা এর বিনিময়ে টাকা পয়সাও আয় করে”। “টাকা পয়সা আয় করে!” জিজ্ঞাসা করল মোটাসোটা এক কৃষক, হা হয়ে গেছে তার মুখ। “অবশ্যই। পৃথিবীর সমৃদ্ধির সময় শেষ, তার খনিজের পদার্থের মজুদ শুন্য, শস্যক্ষেত্রগুলো শত হাজার বছরের চাষের পর অনুর্বর হয়ে গেছে। তাদের এখন তাই তোমাদের কাছ থেকে খাদ্য আর অন্য সবকিছু কিনতে হয়, আর বিনিময়ে দেবার মত ভালবাসা ছাড়া তাদের যে আর কিছু নেই।” মাথা নাড়িয়ে জানায় বুড়ো। “তুমি কি কখনও পৃথিবীতে গিয়ে প্রেমে পড়েছিলে?” সাইমন জিজ্ঞাসা করেই ফেলল, বেশ খানিকটা সময় ধরে তার মাথায় ঘুরছে প্রশ্নটা। “পড়েছিলাম!” বৃদ্ধ বিক্রেতা সাংঘাতিক রকম গম্ভীরভাবে বলে। ”আর সে যে কি অভিজ্ঞতা! মুখে বলার মত নয়! তবে এরকম অনেক প্রেমের গল্প তোমরা পাবে আমার বই গুলোতে, দাম আসলে বেশি নয়, ভেতরে কি আছে বিবেচনা করে আসলে বলা যায় জলের দরই! কিনতে চাইলে…” সাইমন একটা প্রাচীন কবিতার বই কিনল (কাজাঙ্গার হিসেবে অবিশ্বাস্য রকমের চড়া দামে)। রাতে বিছানায় শুয়ে বইটা পড়তে পড়তে কল্পনায় সে দেখল, পূর্ণিমার পাগল করা রাতে সমুদ্রতীরে সে শুয়ে আছে ভালবাসার মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে, পায়ের কাছে আছড়ে পড়ছে অস্থির অশান্ত ঢেউ…… সেই রাতেই সাইমন সিদ্ধান্ত নিল, পৃথিবীতে তাকে যেতেই হবে। বুড়ো গল্প করেছে, বিভিন্ন গ্রহে পৃথিবীর ছড়িয়ে যাওয়া সন্তানেরা জায়গা করে নিয়েছে। অচেনা অজানা গ্রহের মাটিতে হাড়ভাঙ্গা খাটনি করেছে তারা নিজেদের অবস্থান মজবুত করার জন্য। কাজাঙ্গায় তারা গম, বার্লি আর ধান ফলিয়েছে, ডেট্রয়েট দুই আর তিনে তারা বসিয়েছে বিশাল বিশাল কারখানা। আলফায় সমুদ্রপ্রধান গ্রহটিতে তারা যে মাছের খামার বানিয়েছে তা পুরো উত্তরের বলয়ে সুপরিচিত! বিপজ্জনক প্রানী দিয়ে ভরা মোরিকা, ডোরান পাচে এখনও জঙ্গুলে পরিবেশ। সবই ঠিক আছে, কিন্তু এই নতুন গ্রহগুলোতে বসতি করার সময় সবকিছুই নিখুত পরিকল্পনা করে করা হয়েছে। কে জানে, হয়ত সে কারনেই, কিছু একটা হারিয়ে গেছে এই সব বসতিগুলো থেকে, আর তাই এখন কেবলমাত্র পৃথিবীরই জানা আছে ভালবাসা কি জিনিস। পৃথিবীতে যাবার সিদ্ধান্ত নেবার পরে অনেকদিন পার হয়ে গেছে।
এই সময়গুলোতে সাইমন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেছে, ভালবাসার স্বপ্ন দেখেছে, দ্বিগুন পরিশ্রম করেছে, টাকা জমিয়েছে। অবেশেষে তার ২৯তম জন্মদিনে সে তার খামারটা বিক্রি করে দিল প্রতিবেশির কাছে, জামা- কাপড়গুলো গুছিয়ে নিল একটা হ্যান্ডব্যাগে, তারপর তার সবচেয়ে ভাল স্যুটটা গায়ে চড়িয়ে, রওনা দিল পৃথিবীর উদ্দেশ্যে। এবারে তার মনের বাসনা পুর্ণ হবেই। কারন পৃথিবীতে যে রীতিমত আইনই আছে এ বিষয়ে, আর সেটা এখনও কাউকে ভাঙ্গতে দেখা যায়নি! ***** নিউইয়র্ক স্পেসপোর্টে কাস্টমসের ঝামেলা শেষ হতে খানিক সময় লাগল ।
সেটা শেষ হলে আন্ডারগ্রাউন্ড শাটলে চড়ে সে চলে এল টাইমস স্কোয়ারে। সাবধানে বাইরে পা ফেলে সাইমন, এক হাতে শক্ত করে হ্যান্ডব্যাগটা ধরা, পরিচিতরা অসংখ্যবার তাকে সাবধান করে দিয়েছে পৃথিবীর পকেটমারদের ব্যাপারে। অবাক বিশ্বয়ে চারিদিকে তাকায় সে, সবকিছুই অন্যরকম! সবার প্রথমে সে লক্ষ্য করল রাস্তার দুপাশে অসংখ্য মুভি থিয়েটার। কোনটাতে টু ডাইমেনশন মুভি, কোনটাতে থ্রি, কোনটাতে বা ফোর। আর কত ধরনেরই না মুভি। যা দেখতে চাও তাই দেখতে পারবে! আর কি সব আকর্ষনীয় শিরোনামই না তারা দেখাচ্ছে! ডান দিকে একটা থিয়েটার এর মাথায় বড় বিলবোর্ডে লেখা: শুক্রগ্রহের কামকলা! সবুজ নরকের বাসিন্দাদের যৌনক্রীড়ানিয়ে নির্মিত ডকুমেন্টারী! আনসেন্সর্ড! সাইমন একবার ভাবল যাবে কিনা। কিন্তু রাস্তার ওপারের আরেকটা বিলবোর্ড তাকে টানল। সেখানে বড় করে লেখা: সোলজার অব দ্য সান! দু:সাহসী স্পেস মেরিনদের উৎসর্গ করে বানানো এক চলচিত্র! আর একদিকে নজর পড়ল তার, টারজানের লড়াই! টারজান, মনে পড়ল তার, প্রাচীন পৃথিবীর এক মহানায়ক ছিল সে! সবকিছুই এখানে আলো ঝলমলে আর চাকচিক্যময়। আর এত কিছু একসাথে! কোনটা রেখে কোনটার দিকে তাকাবে ভেবে পাচ্ছিল না সে। সাইমন রাস্তার পাশের ছোট্ট খাবার দোকানগুলোর দিকে গেল। সারা গ্যালাক্সির খাবার বিক্রি হচ্ছে এখানে, বিশেষ করে পৃথিবীর বিখ্যাত পদগুলো, যেমন পিজা, হটডগ, স্প্যাগেটি। কয়েক জায়গায় সে দেখল পৃথিবীবাসীর মত জামাকাপড়ও বিক্রি হচ্ছে। পানীয়’র দোকানের সংখ্যাও কম নয়।
সাইমন বুঝতে পারছিল না কোথা থেকে সে তার পৃথিবী আস্বাদন শুরু করবে। হঠাৎই গোলাগুলির শব্দে চমকে গিয়ে সে পেছনে ফিরে তাকায়। আওয়াজটা আসছে একটা শুটিং গ্যালারী থেকে। ছোট্ট একটা চিকন খুপরী মত দোকান, উজ্জ্বল রং এ রাঙ্গানো। মোটাসোটা গালফোলানো দোকানদার সাইমন এর দিকে তাকিয়ে উজ্বল হাসি দেয়, “নিজের ভাগ্য পরীক্ষা করতে চাও?” আগ্রহী সাইমন দোকানের ভিতর উঁকি দিল। সাধারণ টার্গেট এর জায়গায় চারজন অতি স্বল্পবসনা মেয়েকে বসিয়ে রাখা হয়েছে, চেয়ারগুলো বুলেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত, প্রত্যেকটা মেয়ের কপাল আর দুই বুকের মাঝখানে বুলস আই আঁকা। সেখানেই লক্ষভেদ করতে হবে। “কিন্তু বুলেট গুলো দেখে তো মনে হচ্ছে আসল!” ভীষণ অবাক হয় সাইমন। “অবশ্যই আসল। কোন ধরনের নকল জিনিসের প্রচার করা পৃথিবীতে নিষিদ্ধ। আসল বুলেট এবং আসল মেয়ে। কথা না বাড়িয়ে এটা হাতে নাও, গুলি করে ভর্তা করে দাও যেটাকে মন চায়!” হাত বাড়ায় না সাইমন, দ্বিধায় ভুগছে সে। এটা আবার কিরকম টার্গেট প্রাকটিস! “এত ভয় পাচ্ছ কেন? ভয় পেও না! তুমি আমার ধারেকাছে লাগাতে পারবে না,” চেয়ারে বসে থাকা একটা মেয়ে যেন টিটকারিই মারে তার উদ্দেশ্যে। “আরেহ! তোমাকে তো দূরের কথা, টার্গেট হিসাবে একটা আস্ত স্পেশসিপ দিলেও এই গাধাটা লাগাতে পারবে না” পাশ থেকে টিপ্পনী কটাল আরেকটা মেয়ে। “আরে পারবে পারবে!!” পাশ থেকে তৃতীয় মেয়েটা সাহস জোগাবার চেষ্টা করে সাইমনকে। “চলে এস! দেখই না চেষ্টা করে!” মাথায় চুলকাতে চুলকাতে চিন্তা করে সাইমন। হচ্ছে কি এসব? সত্য নাকি পুরোটাই একধরনের তামাশা? কিন্তু এটাতো পৃথিবী! বিজ্ঞাপনে যা বলা আছে তাই করার নিয়ম! আইন আছে রীতিমত! সাইমন বলল: “ছেলেদেরও কি এভাবে গুলি করারও ব্যবস্থা আছে?” “অবশ্যই আছে।
কিন্তু তুমি নিশ্চই এরকম পারভার্ট নও! ছেলে হয়ে ছেলেকে গুলি করতে চাও!” যেন অবাক হয়েই উত্তর দেয় চেয়ারে বসে থাকা মেয়েটা। “অবশ্যই না!” থতমত খেয়ে জবাব দেয় সাইমন, কি বোঝাতে চেয়েছে মেয়েটা না বুঝেই। “তুমি কি অন্য গ্রহের নাকি?” জানতে চায় গালফোলা দোকানদার। “হ্যা! কিভাবে বুঝলে?” অবাক হয় সাইমন। “পরনেরস্যুটটা দেখলেই বোঝা যায়।” এবারে লোকটা মাথা দুলিয়ে আবার বলতে শুরু করে, “এখন কথা হল, মেয়েগুলোকে গুলি করো, দেখো কি আরাম লাগে, নিজের ভেতরের যত রাগ, ক্ষোভ আছে সব দেখবে দূর হয়ে গেছে। লোকে এখন আর শরীরে ম্যাসাজ নেয় না, শুটিং গ্যালারিতে আসে। মদ খেয়ে মাতলামি করার চাইতে অনেক ভাল।” “কিন্তু গুলি লাগলে তো তুমি মরে যাবে!” সাইমন একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে। “গাধার মত কথা বল না, মরব কেন! কিন্তু গুলি লাগার সময় যে শকটা লাগে, সেটা মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর।” ব্যাপারটা কল্পনা করেই যেন মেয়েটা শিউরে উঠল। সাইমন একবার ভাবল মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে, মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর কি হতে পারে, তার আগেই তাকে আবার ধরে বসে মোটাসোটা দোকানদার। “কি দিয়ে মারতে চাও?” একটা সাবমেশিনগান বের করে কাউন্টার এর উপর রাখল সে। “আর যদি একটু বেশী খরচ কর তাহলে এই টমি গানটা নিতে পার। আসল জিনিস, চাইলে গুলি করে দেয়ালের পলেস্তারা উঠিয়ে ফেলতে পারবে, এক্কেবারে ম্যাসাকার! সেইরকম ফিলিংস।” সাইমনের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে দেয় সে। “আমি এর একটাও চাই না! বাদ দাও এসব!” “আমার কাছে গ্রেনেডও ছিল,
স্প্লিন্টারগুলো যখন শরীরে ঢোকে….” বলতে বলতে দোকানদারের চোখ চকচক করে উঠল। “কোন দরকার নেই।” সভয়ে মাথা নাড়ে সাইমন। “ঠিক আছে, ওদের যখন পছন্দ হচ্ছেই না, তুমি চাইলে আমাকেও শুট করতে পার! অবশ্যই খরচ বেড়ে যাবে! তবে তোমার যদি ইচ্ছেই করে সেরকম, কি আর করা! তুমি আমার খদ্দের! খদ্দেরের ইচ্ছায় না বলা মানা আছে!” “কি? কখনই না!” “বুঝেছি, তোমার আসলে এখণ মুড নেই। যাই হোক, মনে রেখ, আমরা চব্বিশ ঘন্টাই খোলা থাকি। যখন ইচ্ছে চলে এস!” কোনদিনই না! পাগল নাকি? জোরে হাটতে হাটতে চলে যায় সাইমন। পেছন থেকে এক মেয়েকন্ঠ বলে, “তোমার অপেক্ষায় থাকব প্রিয়তম!!” টিটকারী মারল নাকি কে জানে। পাশে বসা মেয়েটা আবার খিক খিক করে হাসছে তার কথা শুনে। কান লাল করে সরে এল সাইমন। একটু দুরের একটা রেস্তরায় গিয়ে বসে একটা হালকা পানীয়ের অর্ডার দেয় সে। বসার পরে আবিস্কার করে, তার হাত কাপছে। চেষ্টা করে মনের জোর খাটিয়ে সে হাতগুলোকে শান্ত করে। পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে সে ভাবতে চেষ্টা করে আসলে হচ্ছেটা কি এখানে! এরপরে সে নিজেকে বোঝায়, তার আসলে পৃথিবীকে নিজের মত করে বিচার করা উচিত নয়। এটাতো পৃথিবী, কাজাঙ্গা নয়। সবকিছুই তো ভিন্ন হবার কথা এখানে! যদি পৃথিবীর মানুষ অন্য মানুষকে গুলি করে আনন্দ পায়, আর যে গুলিগুলো খাচ্ছে তার কোন আপত্তি না থাকে তাহলে আমি বলার কে? কয়েকবার করে বলে সে নিজেকে বোঝাবার চেষ্টা করল। নাকি বিষয়টা নিয়ে আসলেই কোনধরনের প্রতিবাদ করা উচিত? “হ্যালো!!” একট উৎফুল্ল গলা শুনে পেছন ফেরে সে। একটা শুকনো চেহারার ছোটখাট লোক লম্বা
রেইনকোট গায়ে দাড়িয়ে তার পেছনে। “কি খবর বন্ধু ? অন্য গ্রহের নাকি ?” “কিভাবে বুঝলেন?” “জুতাটা দেখলেই বোঝা যায়, আমি তাই সবসময় ওটাই নজর করি! তো, কেমন লাগছে পৃথিবী?” “আসলে, আমি যেরকম
ভেবেছিলাম.. তেমনটা…” “এটাই স্বাভাবিক। তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তুমি একজন আদর্শবাদী মানুষ। তুমি এই গ্রহে এই এসেছ একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে, আর তা হচ্ছে এক মহাযুদ্ধে সামিল হওয়া, যেই যুদ্ধে জয়ের মাধ্যমে তুমি পৃথিবীর দরিদ্র, নিপীড়িত মানুষে মুখে হাসি ফোটাতে পারবে। তুমি ঠিক জায়গাতেই এসেছ। এই মূহুর্তে পৃথিবীতে ছয়টি বড় যুদ্ধ চলছে, এবং এর প্রত্যেকটাতেই অন্তত একটা গুরুত্বপুর্ণ পদ খালি আছে, যা একমাত্র তোমার পক্ষেই পূরণ করা সম্ভব এবং সঠিক মুল্যের বিনিময়ে আমি তোমাকে সেই পদের অধিকারী হতে সাহায্য করতে পারি!” “দু:খিত, আসলে…” “ঠিক এই মুহূর্তে…” মানুষটার মধ্যে থামার কোন লক্ষণ দেখা গেল না, “পেরুর শ্রমিকেরা এক মরণপণ লড়াই লড়ছে রাজকীয় শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে, আর একজন যোদ্ধা পেলেই তারা হয়ত বিজয় ছিনিয়ে আনতে পারে। তুমি হতে পার সেই যোদ্ধা, নিশ্চিত করতে পার সমাজতন্ত্রের জয়।” কিন্তু সাইমনের প্রতিক্রিয়া দেখে দ্রুত সে সুর পাল্টে ফেলল, “কিন্তু পেরুর মহান সম্রাট এর কথাও ভুলে গেলে চলবে না। এই শতবর্ষী বৃদ্ধ শাসক; তাকে তো রীতিমত দার্শনিক মানুষই বলা চলে, রীতিমত কবিতাও লেখেন! আর তার অনুগত বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক আর ছোট্ট রাজকীয় সেনাদল আজ বিদেশী শক্তি মদদপুষ্ট কিছু দুষ্কৃতিকারীর কাছে কোনঠাসা হয়ে পড়েছে…” “দু:খিত, আপনি ভুল মানুষকে ধরেছেন..” সাইমন বলা শুরু করল, “চায়নাতে দুষ্কৃতিকারীরা…” “না!”
“তাহলে ওয়েলস এ কমিউনিস্টদের হয়ে লড়তে চাও? অথবা জাপানে ক্যাপিটালিস্টদের হয়ে? অথবা তোমার যদি কোন বিশেষ গোষ্ঠীর ব্যাপারে আগ্রহ থাকে, ফেমিনিস্ট, প্রহিবিশনিস্ট, ফ্রি সিলভারিস্ট…” “আমি যুদ্ধ চাই না!” “আরেহ! এটা আগে বলবেনা? কে যুদ্ধ চায় বল, একদম বাজে জিনিস! যাই হোক, তাহলে তোমার পৃথিবীতে আসার আরেকটা কারণই থাকতে পারে, নিশ্চয়ই তুমি ভালবাসার খোঁজে এসেছ।” “আপনি কিভাবে বুঝলেন?” “যুদ্ধ আর ভালবাসা, এই দুটোই আর আমাদের প্রধান পন্য! আর সময়ের শুরু থেকে দুটিতেই আমাদের বাম্পার ব্যাবসা হচ্ছে।” “ভালবাসা খুঁজে পাওয়া কি খুব কঠিন?” “সোজা দুটা গলি পরে হাতের বামে। বড় করে লেখা আছে। বলবে যে ”শুটকো জনসন” পাঠিয়েছে।” “কি যা তা বলছেন? ভালবাসা এরকম রাস্তার মোড়ে পাওয়া যায় না।” “ভালবাসা সম্পর্কে তুমি কি জানো?” “কিছুই না।” মুখ গোমড়া করে জবাব দেয় সাইমন। “আমরা এ ব্যাপারে এক্সপার্ট।” মাথা দোলায় লোকটা হাসিমুখে। “কিন্তু বইয়ে যে লেখা থাকে, পূর্ণিমা রাতে সমুদ্রতীরে…” “বুঝতে পেরেছি, ভালবাসার মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকা, পায়ের কাছে আছড়ে পড়ছে প্রমত্তা ঢেউ ইত্যাদি ইত্যাদি..” “আপনিও বইটা পড়েছেন?” “ওটা আমাদের ব্রোশিওর, আর সব ব্রোশিওরে ওভাবেই লেখা থাকে। বিজ্ঞাপন। আচ্ছা আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে, হাতের বামে দুই গলি পরে, গেলেই দেখতে পাবে।” বলতে বলতে ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল শুটকো জনসন। কোকটা খাওয়া শেষ করল সাইমন, তারপর হাঁটা শুরু করল। তার ভুরু দুটো কুচকে আছে সাংঘাতিকভাবে, সব উল্টাপাল্টা লাগছে। তবে নিজেকে সে বোঝাল, পুরোটা না দেখে আসলে কোন বিষয়ে ফাইনাল সিদ্ধান্তে আসা উচিত নয়। হাতের বামে তিন নম্বর গলিতে ঢুকেই দেখল সে বিশাল বড় এক নিয়ন সাইন, তাতে লেখা, “লাভ,
ইনকরপোরেটেড! নিচে ছোট অক্ষরে লেখা, আমরা ২৪ ঘন্টাই খোলা। তার নিচে লেখা, পরবর্তী ফ্লাইট একটায়। ভ্রু কুঁচকাল সাইমন, কিছু একটা সন্দেহ হচ্ছে তার, এটাও কি শুটিং গ্যলারির গোলাগুলির মতই আসল? তারপরও সিঁড়ি বেয়ে উঠল, ঢুকে পড়ল রিসেপশনে। ঘরটা সুন্দরভাবে সাজানো, রুচিশীলতার ছাপ স্পষ্ট। সেখান থেকে তাকে পাঠান হল আরেকটা ছোট রুমে। প্রকান্ড এক ডেস্কের পিছনে হ্যান্ডসাম চেহারা, কাঁচাপাকা চুলের অধিকারী একজন মানুষ বসে আছেন, উঠে সাইমনের সাথে হাত মেলালেন হাসিমুখে, ”কাজাঙ্গার কি খবর?” “আপনি কিভাবে জানলেন আমি কাজাঙ্গা থেকে আসছি?” আবারও অবাক হয় সাইমন। “শার্টটা আর টাইটা দেখলেই বোঝা যায়! আমি টেইট, আপনার নামটা?” “সাইমন, আলফ্রেড সাইমন” “প্লিজ বসুন, স্যার। বলুন কি খাবেন, সিগার? চুরুট? ড্রিংকস? আপনি সঠিক জায়গাতেই এসেছেন স্যার। আমরাই গ্যালাক্সির সবচেয়ে পুরনো ভালবাসা বিপণন প্রতিষ্ঠান, নিকট প্রতিদ্বন্দ্বী প্যাশন আনলিমিটেড এর চেয়ে অনেক এগিয়ে। আমরা আপনাকে দিচ্ছি লেটেস্ট প্রডাক্ট এবং সেগুলোও খুবই যুক্তিসঙ্গত মুল্যে। এখন কি বলবেন, আমাদের সম্পর্কে কোথায় জানলেন, গতকালের পত্রিকায় আমাদের ফুল পেজ বিজ্ঞাপন গেছে, সেটা? নাকি…” “শুটকো জনসন আমাকে পাঠিয়েছে।” “আচ্ছা! শুটকো জনসন আমাদের এখানে অনেকদিন ধরে আছে। ঠিক আছে স্যার, তাহলে আসুন শুরু করা যাক…” সাইমন তাকে থামায়। “আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কিভাবে বলব..” “হ্যা, হ্যা.. বলুন কি বলবেন!” তাকে কথা বলতে উৎসাহ
যোগায় টেইট। “আমি এর কিছুই বুঝতে পারছি না!” ফেটে বেরিয়ে আসে যেন সাইমনের সব অস্থিরতা। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তার, এই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরেও। “আমার বার বার মনে হচ্ছে আমি ভুল জায়গায় এসেছি। আমি এতদুর রাস্তা পার হয়ে পৃথিবীতে কেবলমাত্র… আমি কারও সাথে একরাতের শরীর বিনিময় করতে চাই না। আপনারা সতিই কি ভালবাসা বিক্রি করেন? কেমন করে করেন? ভালবাসা কিভাবে বিক্রি করে মানুষ? এটা কিভাবে সত্য হয়!” “পুরোপুরি সত্যি!” উত্তেজনায় টেইট তার চেয়ার থেকে আধেক উঠে এসেছে। “পুরো বিষয়টাই তো তাই! যে কেউ একরাতের জন্য শরীর ভাড়া করতে পারে। মানুষর জীবনের পরে পুরো মহাবিশ্বে ওটাই দ্বিতীয় সস্তা জিনিস! কিন্তু ভালবাসা পবিত্র! প্রচন্ড রকম র্দুলভ! একমাত্র পৃথিবী ছাড়া আর কোথাওই ঐ জিনিস আর পাওয়া যায় না! আপনি কি আমাদের ব্রোশিওর পড়েনি নি?” “অশান্ত বালুকাবেলায় আলোছায়ার খেলা? ভালবাসার সঙ্গীনিকে জড়িয়ে সময় পার করা?” অবাক হয়ে সাইমন জানতে চায়। “হ্যা, হ্যা.. ওটাই। আমারই লেখা। বেশ অনুভুতি জাগায় মনে, তাই না? আপনি এরকম অনুভুতি যার তার কাছ থেকে পাবেন না! কেবলমাত্র এমন একজনই আপনাকে এরকম ভাবে আবেগ দিয়ে ভাসিয়ে দেবে যে আপনাকে সত্যি সত্যি ভালবাসে!” এবারে সাইমন তার সন্দেহ প্রকাশ করে, “এটা কি সত্যিকার ভালবাসা? আপনারা যা দিচ্ছেন?” “অবশ্যই! আমরা যদি কেমিক্যাল দেয়া ভালবাসা, জোর করে তৈরি করা ভালবাসা বিক্রি করতাম, তাহলে আমরা সেটা আমাদের ব্রোশিওরে অবশ্যই উল্লেখ করতাম! পৃথিবীতে বিজ্ঞাপন প্রকাশের আইন খুব কড়া। একটা কথা বলে অন্যটা দেয়া সাংঘাতিক অপরাধ! যে কোন কিছুই বিক্রি করা যেতে পারে, যে কোন কিছু। কিন্তু শর্ত একটাই, সেটার বিষয়ে সঠিক তথ্য দিতে হবে। সেটা বিজ্ঞাপনে হোক আর
ব্রোশিওরে কিংবা আড্ডাখানায়। এটাই আমাদের নীতি, মি: সাইমন!” টেইট এবারে একটু সহজ হয়ে দম নিয়ে শান্ত স্বরে বলতে থাকে, “দেখে নিন, বুঝে নিন। কোন রকম ভুল ভাববেন না, কোন ভুল করবেন না। আমাদের কোন প্রডাক্টে কোন রকম নকল বা জালিয়াতির কাজ নেই। এটা সেই একই অনুভুতি যেটা কবি আর সাহিত্যিকরা হাজার বছর ধরে আবেগ নিয়ে বর্ননা করে আসছেন! আধুনিক বিজ্ঞানের সহায়তায়, আমরা সেই একই জিনিস নিয়ে আসছি আপনার কাছে, একদম প্যাকেজ আকারে, একদম অবিশ্বাস্য রকম কম মুল্যে!” “কিন্তু.. আমি ভেবেছিলাম এটা সর্ম্পুন প্রাকৃতিক, আর স্বতস্ফুর্ত হবে.. আসলও হবে” দ্বিধা এখনও কাটেনি সাইমনের। “আমরা আমাদের গবেষনাগারে এই প্রাকৃতিক ব্যপারটা নিয়ে গবেষনা করছি। এটাও সত্য স্বতস্ফুর্ততার একটা বিশেষ আবেদনও আছে। কিন্তু আসল! হা! হা! হা! মি: সাইমন, আমরা কোন নকল জিনিস বিক্রি করি না।” “পুরো বিষয়টাই আমার কাছে ঘোলাটে লাগছে.. আমি বরং যাই, কোন একটা থ্রিডি বা ফোরডি মুভি দেখলে বরং সময়টা ভাল কাটবে।” উঠতে উদ্যত হয় সাইমন। “দাড়ান! দাড়ান! আপনি কি ভাবছেন আমরা একটা মেয়েকে নিয়ে আসবো যে দেখাবে যে সে আপনাকে অনেক ভালবাসে, কিন্তু আসলে সে অভিনয় করবে!” “সেরকমই তো মনে হচ্ছে।” উত্তর দেয় সাইমন। “এটা একদমই সেরকম কিছু নয়! বিশ্বাস করুন. আর এটা করা একদম ব্যবসার জন্য ভাল নয়। চিন্তা করুন, মেয়েটার নকল কান্না আর ভুয়া আবেগের জন্য আমাদের কি পরিমান খরচ করতে হবে! আরও একটা বিষয় খেয়াল করুন, একটা মেয়ে এরকম গভীর আর জীবন্ত বিষয় নিয়ে মিছে বলার পরে তার উপরে সাইকোলজিকাল এফেক্ট কি পড়বে! সেটার দেখাশোনার ভারও তো কোম্পানীকে নিতে হবে! খরচ করে তো শেষে কোন লাভই আসবে না! সব লোকসান!” “তাহলে আপনারা এটা করছেন কিভাবে?” বিরক্ত হয় এবারে সাইমন। “আধুনিক বিজ্ঞান এবং মানুষের মন বোঝার বিষয়ে আমাদের দক্ষতা, এটা এই দুয়ের সম্মিলন।” সাইমনের কাছে মনে হয় এটা একজন চালাক চতুর বিক্রেতার মত ধোয়াটে কথা, যার উদ্দেশ্য হল সস্তা পন্য গছিয়ে দেয়া। সে দরোজার দিকে রওনা হল। “মি: সাইমন!” টেইট কে একটু মরিয়া দেখায়। “আমাকে একটা জিনিস বলুন। আপনি একজন শিক্ষিত যুবক, আপনার কি মনে হয় না মেয়েটা যদি অভিনয় করে আপনি সেটা ধরে ফেলবেন?” “ সেটা ধরতে পারবো ঠিক, তাহলে আপনারা এটা করছেন কিভাবে?” “বিজ্ঞানের অগ্রগতির এই যুগে এখন সবই সম্ভব। আর তারপরও যদি আপনারা মনে হয় এটা নকল, আপনাকে এক পয়সাও দিতে হবে না।” “আচ্ছা, আমি একটু ভেবে দেখি।” “আর কোন ভাবাভাবি নয় স্যার। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিতহয়েছে যে, প্রেমে পড়াটা কেবলমাত্র যে শুধু মানসিক ভারসান্য ফিরিয়ে আনে তাই নয়, এটা হরমোন ব্যালান্স ঠিক করে, গায়ের রং ফর্সা করে! আমরা যে ভালবাসা আপনাকে ডেলিভার করব, সেটা হবে একদম আসল জিনিস। গভীর অনুভুতি, ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া আবেগ,
পুরোপুরি বিশ্বস্ততা, আর প্রেমের সেই জাদুকরী আকর্ষণ! আর কোন কথা নয় স্যার, প্রস্তুত হন প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ার সেই স্বর্গীয় অনুভূতির সাথে পরিচিত হবার জন্য!” টেইট টেবিলের নিচে একটা বোতাম চাপ দেয়। খানিক পরে একটা দরজা খুলে গেল, ঘরে এসে ঢুকল একটু মেয়ে, আর সাথে সাথেই সাইমনের চিন্তাশক্তি লোপ পেল। মেয়েটা লম্বা, শরীরটা পাখির মত হালকা। তার চুলগুলো ঘন কালো, তার মাঝে লাল রঙ এর একটা দুটা গোছা। সাইমনকে পরে জিঞ্জেস করলে সে মেয়েটার চেহারা নিয়ে কিছুই বলতে পারতো না, কেবল এই কথাটা ছাড়া যে মেয়েটাকে দেখেই তার চোখে পানি চলে এসেছে। “মিস পেনি ব্রাইট,” মি: টেইট বললেন, “উনি মি: সাইমন।” মেয়েটা কিছু বলার চেষ্টা করল, কিন্তু তার কথাগুলো যেন গলায় আটকে গেল। এক মুহুতের্ই সাইমন বুঝে গেল, মেয়েটা সাইমনকে তার সবটুকু দিয়ে ভালবাসে। পরের মুহুর্তে সাইমন আবারো আবিস্কার করল, কোন কিছুই এখন আর কোন ব্যপার নয়, সেও মেয়েটাকে ভালবাসে,সবকিছু দিয়ে। মুহুর্তেই তারা হাতে হাত ধরে সেই অফিস থেকে বিদায় নিল। একটা জেট প্লেনে করে তাদের নিয়ে যাওয়া হল দুর সমুদ্রের ধারে এক ছোট্ট বাসায়। হাত ধরাধরি করে তারা সমুদ্রে নামল। কিছুক্ষণ বাদেই সন্ধ্যা নামল, অস্তগামী সূর্য্যরে আলোয় পেনিকে দেখে সাইমনের মনে হল সে যেন মানবী নয়,
জ্বলন্ত কামনাময়ী কোন দেবী। তারও পরে চাঁদ উঠল, সেই চাঁদের আলোয় বালুকাবেলায় শুয়ে সাইমনের বুকের মুখ গুঁজল পেনি, তার চোখের জল ফোঁটায় ফোঁটায় গড়িয়ে পড়ল সাইমনের বুকে। সাইমনের চোখেও জল, কেন, তা সে নিজেও জানে না। সেই অনেক বছর আগে পূর্ণিমা রাতে সমুদ্রতীরে ভালবাসার মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকার যে স্বপ্ন সে দেখছিল, তা আজ সার্থক হল। দুজনে একে অপরের মাঝে মিলিয়ে গেল সেই বালুকাবেলায়। পরদিন দুপুরে তারা আবার ফিরে এল লাভ, ইনকরপোরেটেড- এর অফিসে। এক মুহুতের্র জন্য পেনি সাইমনের হাতটা ধরল, তারপর দরজা খুলে ভিতরে হারিয়ে গেল। “ভালবাসা আসল ছিল?” মি: টেইট জিজ্ঞাসা করলেন হাসিমুখে। “হুম।” “সবকিছু সন্তোষজনক ছিল তো?” “হ্যা, আসলেই সত্যিকার ভালবাসা ছিল। কিন্তু ও ফিরে আসার জন্য জোর করছিল কেন? আমার তো ইচ্ছে করছিল ওখানেই সারাজীবন কাটিয়ে দিতে!” “পোস্ট হিপনোটিক কমান্ড!” “কি?” বোকা দেখায় সাইমনকে। “আপনি কি আশা করেছিলেন স্যার! সবাই ভালবাসা চায়, কিন্তু খুব কম লোকই এর জন্য মুল্য দিতে প্রস্তুত। এই যে আপনার বিল, স্যার!” টেইট বিলটা এগিয়ে দিল। বিল মেটাতে মেটাতে বলে সাইমন, “অবশ্যই আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য আপনাকে টাকা দেব, আগে পেনিকে ফিরিয়ে আনুন। সে এখন কোথায়? তাকে আপনারা কি করেছেন?” “দয়া করে সংযত হোন” টেইট আস্তে করে বলে। “কিসের সংযম! আমি পেনিকে দেখতে চাই, নিয়ে আসুন ওকে!” চিৎকার করে উঠল সাইমন। “সেটা কোনভাবেই সম্ভব নয়, দয়া করে নিজেকে সামলান” এবার টেইটের কন্ঠস্বরে শীতলতার ছোঁয়া। “আপনি কি আমার কাছ থেকে বেশী টাকা আদায়ের চেষ্টা করছেন? ঠিক আছে, টাকা আমি দেব। কত টাকা লাগবে পেনিকে আপনার হাত থেকে মুক্ত করতে?” নিজের ওয়ালেট বের করে টেবিলের উপর আছড়ে ফেলল সাইমন। টেইট এক আঙ্গুল দিয়ে ওয়ালেটটা সাইমনের দিকে ঠেলে দিলেন। “দয়া করে এটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখুন স্যার!! আমরা একটা ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান, বহু বছর ধরে সুনামের সাথে আমরা এই সার্ভিস দিয়ে আসছি। যদি আপনি আর একবার গলা উঁচু করে কথা বলেন আমি
আপনাকে এখান থেকে বের করে দিতে বাধ্য হব।” সাইমন অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করল। ওয়ালেটটা পকেটে ঢুকিয়ে চেয়ারে বসল। “আমি দু:খিত” আস্তে করে বলল সে। “ঠিক আছে। কেউ আমার উদ্দেশ্যে চিৎকার করলে সেটা আমার পছন্দ হয় না। তবে আপনি যদি ভদ্রভাবে ভাবে কথা বলেন, আমিও আপনার সাথে ভাল আচরণ করব। এখন বলুন, সমস্যাটা কোথায়?” “সমস্যা কোথায় মানে? চিৎকার করতে গিয়ে সাইমন অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাল। “পেনি আমাকে ভালবাসে!” “অবশ্যই।” “আপনি তাহলে আমাদের একসাথে থাকতে দিচ্ছেন না কেন?” “ভালবাসার সাথে একসাথে থাকার কি সম্পর্ক? ভালবাসা একটা চমৎকার জিনিস জিনিস, মন ভাল করে, হরমোনের ব্যালান্স রক্ষা করে, গায়ের রং ফর্সা করে। কিন্তু এটা স্বল্পস্থায়ী একটা ব্যাপার, কেউ ভালবেসে একসাথে থাকতে চায়? কেউই চায় না।” “আমাদের ভালবাসা ওরকম নয়, আমাদের ভালবাসা অনন্য।” গোয়ারের মত করে জানায় সাইমন। “শুধু আপনাদেরটা নয় সব ভালবাসাই ইউনিক, অসাধারন। কারণ সব ভালবাসাই একভাবে তৈরী।” “কি!” হতভম্ব দেখায় সাইমনকে। “আপনি নিশ্চই জানেন ভালবাসা কিভাবে তৈরী হয়।” “না, আমি তো জানতাম, এটা…. এটা …… প্রকৃতির সৃষ্টি!” সাইমন বলে। টেইট মাথা নাড়ে। “প্রকৃতির হাত থেকে ভালবাসা আমরা নিজেদের হাতে নিয়ে নিয়েছি অনেক আগেই। নির্দিষ্ট করে বললে মেকানিকাল এবং টেকনিকাল যে রেনেঁসা ঘটল ৩২০০ সালে, তার কিছুদিন পরেই। আগে ব্যাপারটা অনেক অনেক বেশী ধীরে হত, বাণিজ্যিকভাবেও লাভজনক ছিল না। প্রকৃতির দরকারটা কি, যখন আমরা মস্তিস্কের নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় স্টিমুলেশন দিয়ে ভালবাসার অনুভূতি তৈরী করতে পারি। ফলাফল তো আপনি নিজেই দেখলেন, পেনি আসলেই সম্পুর্ণভাবে আপনার প্রেমে পড়েছিল। তাকে দেখে সেটার প্রতিক্রয়ায় আপনার মধ্যেও কিছু পরিবর্তন চলে আসে। আমার শুধু সমুদ্র, চাঁদ এগুলোর ব্যাবস্থা করেছি প্রভাবক হিসেবে।” “তার মানে তাকে দিয়ে যে কাউকেই ভালবাসানো যেত!” “তাকে যে কাউকে ভালবাসার ব্যবস্থা করে দেয়া যেত।” টেইট সংশোধন করে দেয়। “হায় ঈশ্বর! এই ভয়ংকর কাজে সে কিভাবে নাম লেখাল!” “সে আমাদের সাথে
চুক্তিপত্রে সই করেছে। এই কাজে আয় অনেক বেশী, তাছাড়া চুক্তি শেষে সে আবার নিজের আসল ব্যক্তিসত্তা ফিরে পাবে। এই সময়ের কথা তার কিছুই মনে থাকবে না। আর এই কাজকে ভয়ংকর বলছেন কেন? কাউকে ভালবাসা তো কোন অপরাধ নয়।” “এটা ভালবাসা নয়!” সাইমন চিৎকার করে উঠল। “অবশ্যই এটা আসল ভালবাসা। বিজ্ঞানীরা নানাভাবে পরীক্ষা করে দেখেছেন, প্রাকৃতিক ভালবাসা থেকে এটা অনেক বেশী তীব্র, গভীর।” সাইমন চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বসে থাকল। তারপর চোখ খোলে “অনেক কথা বলেছেন আপনি এবারে আমার কথা শুনুন। আপনাদের বিজ্ঞানীরা কি বের করেছে সে সম্পর্কে আমার কোন আগ্রহ নেই। আমি তাকে ভালবাসি, সে আমাকে ভালবাসে, এটুকু জানাই আমার জন্য যথেষ্ঠ। প্লিজ, আমাকে তার সাথে কথা বলতে দিন। আমি তাকে বিয়ে করতে চাই।” “এইসব কি বলছেন, এই লাইনের মেয়েদের কেউ বিয়ে করে না। যদি আপনি বিয়ে ব্যাপারে আগ্রহী থাকেন তাহলে এই নিয়েও আমরা কাজ করি। আমি আপনাকে আপনার ব্যক্তিত্বের সাথে মেলে এরকম, সরকারীভাবে পরীক্ষিত অবিবাহিতা মেয়ে প্রস্তুত আছে…” “না! আমি পেনিকে ভালবাসি। অন্তত আমাকে তার সাথে কথা বলতে দিন!” “এটা কোনভাবেই সম্ভব নয়।” “কেন?” “ জানতে চান কেন?” টেইট একটা বাটন টিপলেন। “আপনাকে নিয়ে পেনির সব স্মৃতি ইতিমধ্যে মুছে ফেলা হয়েছে। পেনি এখন অন্য কাউকে ভালবাসে।” এবার সাইমন বুঝল। এই মুহূর্তে পেনি শুয়ে অন্য কারো সাথে শুয়ে আছে ব্রোশিওরে বলা সেই বালুকাবেলায়, অন্য কারো চোখের দিকে তাকিয়ে আছে বুকভরা ভালবাসা নিয়ে, যা প্রাকৃতিক ভালবাসার চেয়ে অনেক বেশী তীব্র আর গভীর বলে
বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত! হঠাৎ করেই সাইমন টেইটের গলা টিপে ধরার জন্য এগিয়ে গেল টেবিলের ওপর দিয়ে; দুইজন এ্যটেনডেন্ট, যারা একটু আগে ঘরে ঢুকে দাঁড়িয়েছিল, তাকে ধরে ঘরের বাইরে নিয়ে যেতে লাগল। “তাই বলে মনে করবেন না আপনার হৃদয়ে তার জন্য ভালবাসার যে অনুভূতি ছিল ওটা মিথ্যা ছিল” টেইট দুর থেকে বলল। সাইমন উপলব্ধি করল, দু:খজনক হলেও কথাটা সত্যি। এরপর সাইমন নিজেকে আবিষ্কার করল রাস্তায়। সবার প্রথমে তার মনে হল যত তাড়আতাড়ি সম্ভব এই নষ্ট গ্রহ থেকে পালিয়ে যায়, যেখানে অনুভূতির বেচাকেনাই মানুষের প্রধান জীবিকা। কিন্তু কিভাবে যেন তার পা চুম্বকের মত লেগে রয়েছে লাভ ইনকরপোরেটেড এর আশেপাশেই…। খানিক পরে দেখা গেল পেনি অন্য একজন মানুষের হাত ধরে বার হচ্ছে অফিস থেকে, কি গভীর আবেগ নিয়েই না সে তাকিয়ে আছে মানুষটার চোখের দিকে, কি ভালবাসা নিয়েই না অস্ফুটে কথা বলে চলেছে তার সাথে! সাইমন যে শুটিং গ্যলারিতে আসবে এটা যেন দোকানদার জানতই। বিশেষ করে মেয়েগুলোকে শুট করা যেখানে মদ খেয়ে পাগলামি করার থেকেও বেশি শান্তি দেয় মনে! “ভাগ্য পরীক্ষায় জন্য তৈরী?” দোকানদার একগাল হাসি দিয়ে জানতে চায়। “রেডি করুন মেয়েগুলোকে,” সাইমন বলে। হাত বাড়িয়ে সাবমেশিন-গান তুলে নেয় সে।
**********************************************************************************************