টাইট্রন একটি গ্রহের নাম

টাইট্রন একটি গ্রহের নাম

সবাই গোল হয়ে ঘিরে আছে বড় মনিটরটি, একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে গ্রহটির দিকে। অত্যন্ত নিখুঁত বিশ্লেষণ করার উপযোগী মনিটর, নব্বই হাজার কিলোমিটার দূরের আশ্চর্য গ্রহটিকে স্পষ্ট ফুটিয়ে তুলেছে। কিম জিবান, দলের ইঞ্জিনিয়ার, মনিটরের বিভিন্ন নবগুলি টিপে টিপে গ্রহটির ছবিটিকে আরো স্পষ্ট করার চেষ্টা করছিল। মনিটরে গ্রহটির আশ্চর্য রংগুলির বেশির ভাগই কৃত্রিম, কিম জিবানের দেয়া, খানিকটা দেখতে সুবিধা হওয়ার জন্যে, এবং খানিকটা ভালো দেখানোর জন্যে সে ব্যক্তিগত জীবনে শিল্পী, অন্তত নিজে তাই বিশ্বাস করে, তাই কোনো কাজ না থাকলে মনিটরের একঘেয়ে ছবিগুলিতে রং দিয়ে একটু বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করে। মহাকাশযানের নিয়মকানুনের ফাইল খুঁজে দেখলে হয়তো দেখা যাবে, কাজটা বা মাত্রার বেআইনি কাজ, কিন্তু সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, সবাই একসাথে থাকলে শব্দ করে হাঁচি দেয়াও নাকি যষ্ঠ মাত্রার বেআইনি কাজ। কি জিবান আজ খুব সুবিধে করতে পারছে না, গ্রহটিতে এমন একটা কিছু আছে, যে, যতই রং দেয়ার চেষ্টা করুক, কিছুতেই সেটাকে দেখতে ভালো লাগানো যাচ্ছে না। খোঁচা খোঁচা দাড়ি ঘষতে ঘষতে কিম জিবান পুরো গ্রহটিতে এক পোঁচ নীল রং নিয়ে দেয়, নীল রংয়ে যে-কোনো গ্রহকে ভালো দেখায়, কিন্তু এবারে সেটা নিয়েও কোনো লাভ হল না। বড় বড় গোলাকার গর্ত, যেগুলি নাকি খুব ধীরে ধীরে আকার পরিবর্তন করছে, গ্রহটিকে একটি কুৎসিত সরীসৃপের রূপ দিয়েছে, নীল রংয়ের সরীসৃপ এমন কিছু সুদর্শন বস্তু নয়।

লু মহাকাশযান সিসিয়ানের দলপতি। দলপতির দায়িত্ব অন্যদের থেকে বেশি, কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়। যখনি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হয়, সিসিয়ানের মূল কম্পিউটার সিডিসি তাকে সাহায্য করে। সিডিসি চতুর্থ মাত্রার কম্পিউটার, পৃথিবীতে চতুর্থ মাত্রার কম্পিউটারের সংখ্যা হাতে গোনা যায়। তার স্মৃতিভাণ্ডারে শুধু যে অপরিমেয় তথ্য রয়েছে তাই নয়, প্রয়োজনে যে-কোনো মেমোরি ব্যাংকে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় জিনিস জানার অধিকার এবং ক্ষমতা দুইই তার আছে। সিডিসি ছাড়াও মহাকাশযানে অন্যান্য বিজ্ঞানীরা রয়েছে, এটি একটি অনুসন্ধানী মহাকাশযান, এখানে সবাই কোনো-না-কোনো ধরনের বিজ্ঞানী। লুকে যখন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, সে অন্য বিজ্ঞানীদের সাথে আলোচনা করে, যেটা সবাই ভালো মনে করে, সেই সিদ্ধান্তই নেয়া হয়। তবে তিন মাত্রা বা তার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হলে লুকে আনুষ্ঠানিকভাবে সেটি উচ্চারণ করতে হয়, শুধুমাত্র তার গলার স্বরই সিসিয়ানের চার হাজার ভিন্ন ভিন্ন কম্পিউটারে প্রোগ্রাম করা আছে, এবং শুধুমাত্র সেই তার গলার স্বর দিয়ে সিদ্ধান্তগুলি কার্যকর করতে পারে। এখন যদি গ্রহটিতে না গিয়ে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সেটা হবে তিন মাত্রার সিদ্ধান্ত। মহাকাশযান সিসিয়ান ধ্বংস করে দেয়ার সিদ্ধান্ত হচ্ছে প্রথম মাত্রার সিদ্ধান্ত, সেটি আবার সে একা নিতে পারে না, আরো দু’জন বিজ্ঞানীকে একইসাথে নিতে হয়। মহাকাশযানের নিয়মকানুনের কোনো শেষ নেই, দৈনন্দিন জীবনে কখনো তার প্রয়োজন হয় না, তাই সেগুলি নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই।

লু নিজের ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে ছিল, যখনই সে কোনো সমস্যায় পড়ে, সে নিজের অজান্তে নিচের ঠোঁট কামড়াতে থাকে। এই মুহূর্তে তাকে কী সমস্যায় ফেলেছে বলা মুশকিল। মাসখানেক আগে একটা মনুষ্যবিহীন মহাকাশযান প্রটোনিয়াম আকরিক নিয়ে এদিক দিয়ে যাওয়ার সময় এই গ্রহটির ছবি তুলেছিল। এই বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে গ্রহ-উপগ্রহের কোনো সীমা নেই, কিন্তু মানুষের সংখ্যা সীমিত, কাজেই বিজ্ঞানীরা নিজের চোখে সব গ্রহ-উপগ্রহ দেখে আসতে পারে না। গুরুত্বপূর্ণ হলে বড়জোর একটা স্কাউটশিপ পাঠানো হয়। এই মহাকাশযানটির কথা ভিন্ন, কারণ প্রটোনিয়াম আকরিক নিয়ে যে-মহাকাশযানটি যাচ্ছিল, সেটি যেছবি তুলে এনেছে, সেটি দেখলে মনে হয় গ্রহটির আকার খুব আশ্চর্যভাবে পাল্টে যায়। এ-ধরনের গ্রহ খুব কম, কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান আকাদেমির এজন্যে এটার উপর খুব কৌতুহল। লু মহাকাশযান সিসিয়ান নিয়ে একটি অভিযান শেষ করে ফিরে আসছিল, বিজ্ঞান আকাদেমি তাকে একটু ঘুরে এই গ্রহটা পর্যবেক্ষণ করে ফিরে আসতে বলেছে। লু নিজের ঠোঁট কামড়ে বিজ্ঞান আকাদেমির মুণ্ডপাত করে, কোনো যুক্তি নেই, কিন্তু ওর ভিতরে একটা অশুভ অনুভূতি হচ্ছে, কেন জানি মনে হচ্ছে এই গ্রহটার কাছে যাওয়া একটা দুর্ভাগ্যের লক্ষণ।

লু একটু ঝুঁকে পড়ে কিম জিবানকে বলল, কিম, তোমার দেয়া রংগুলি সরাও তো একট, দেখি জিনিসটা আসলে দেখতে কেমন।

কিম জিবান হাত নেড়ে লুয়ের কথা উড়িয়ে দিয়ে বলল, আসল জিনিস দেখে কী করবে? এটা দেখ, বেশ দেখাচ্ছে এখন।

বেশ দেখাচ্ছে? সুশান চোখ কপালে তুলে বলল, এটা তোমার কাছে দেখতে বেশ লাগছে? তোমার মাথা পরীক্ষা করানো উচিত, এত কুৎসিত জিনিস আমি আমার জনে দেখি নি।

সুশান মহাকাশযানের দু’জন জীববিজ্ঞানীর একজন। তাকে তার জীবনে অসংখ্য কুৎসিত জীবজন্তু এবং কীটপতঙ্গ দেখতে হয়েছে, সে যদি কোনো কিছুকে কুৎসিত দাবি করে, জিনিসটি কুৎসিত তাতে সন্দেহ নেই। সুশানের বয়স বেশি নয়, এই বয়সে সব মেয়ের চেহারাতেই একটা মাধুর্য এসে যায়, সুশানেরও এসেছে। কে জানে সে যদি পৃথিবীতে থাকা আর দশটি মেয়ের মতো চুল লম্বা করে চোখে রং দেয়া শুরু করত, তাকে হয়তো সুন্দরীই বলা হত। মহাকাশযানে চুল লম্বা করা চতুর্থ এবং চোখে রং দেয়া নাকি পঞ্চম মাত্রার অপরাধ।

লু আবার বলল, কিম, দেখি একবার জিনিসটা।

কিম জিবান অত্যন্ত অনিচ্ছার সাথে তার দেয়া কৃত্রিম রংগুলি সরিয়ে নেয়, সাথে সাথে গ্রহটি তার পুরো বীভৎসতা নিয়ে ফুটে ওঠে। কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলতে পারে না, আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস সাবধানে বের করে দিয়ে রু-টেক বলল, চল, ফিরে যাই।

সবাই রু-টেকের দিকে ঘুরে তাকায়। রু– টেক মহাকাশযান সিসিয়ানের একমাত্র রবোট, তার কাজকর্মের কোনো জবাবদিহি করতে হয় না, কাজেই এধরনের কথাবার্তা শুধু সে-ই বলতে পারে। রু-টেক সবার দিকে তাকিয়ে বলল, কি, ভুল বললাম কথাটা? জিনিসটা দেখে কপোট্রনও গরম হয়ে উঠছে না? খামোকা ওটার কছে যাওয়ার দরকার কি?

রু–টেকের চমৎকার গলার স্বর তার যান্ত্রিক চেহারা এবং নিষ্পলক চোখের সাথে মোটেই খাপ খায় না, কিন্তু সে দীর্ঘদিন থেকে সিসিয়ানে আছে, আজকাল কেউ সেটি আর আলাদা করে লক্ষ করে না। লু রু–টেকের দিকে ঘুরে বলল, যাওয়ার আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই, কিন্তু আমার ইচ্ছাই তো সবকিছু নয়।

তোমার ইচ্ছাই তো সবকিছু, রু–টেক তার সবুজাভ চোখের ঔজ্জ্বল্য বাড়িয়ে বলল, তুমি আমাদের দলপতি, তুমি শুধু মুখে একবার বলবে, আমরা ফিরে যাব, সিডিসি সাথে সাথে সিসিয়ানকে ঘুরিয়ে নেবে।

তোমার সব কিছুতে ঠাট্টা, কিম জিবান মনিটরে রংগুলি ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল, এ রকম একটা ব্যাপার নিয়েও তোমার ঠাট্টা।

ঠাট্টা? ঠাট্টা কোথায় দেখলে?

আমরা কেন ফিরে যাব? একটা কারণ দেখাতে পারবে? কিম জিবান মুখে আলগা একটা গাম্ভীর্য এনে বলল, আমরা আছি এমন একটা মহাকাশযানে, যেটা প্রয়োজন হলে হাইপার ডাইভ দিতে পারে, সব মিলিয়ে এরকম মহাকাশযান তিরিশটাও আছে কি না সন্দেহ। এটা একটা অনুসন্ধানী মহাকাশযান, অথচ এখানে যে পরিমাণ ফিউসান বোমা আছে, সেটা দিয়ে একটা ছোটখাট মহাযুদ্ধ লাগিয়ে দেয়া যায়। উপরের ঐ লাল সুইচটাতে তিনবার টোকা দিলে চারটা আক্রমণকারী মহাকাশযান এক ঘন্টার ভিতরে এসে হাজির হয়ে আমাদের উদ্ধার করে নেবে। সিনিয়ানের কোনো ক্ষতি হলে এক মাইক্রোসেকেন্ডের ভিতর আমাদের শরীরকে তিন ডিগ্রি কেলভিন তাপমাত্রায় জমিয়ে নিয়ে ক্যাপসুলে ভরে নেবে। উদ্ধারকারীদল এসে আমাদের উদ্ধার করে নিয়ে যাবে সার্ভিস সেন্টারে, সেখানে তিন শ ডাক্তার আর চার হাজার যন্ত্রপাতি মিলে ধীরে ধীরে আম, শরকে উফ করে আমাদের রক্ষা করবে। আমরা হচ্ছি মানুষ, মানুষের সংখ্যা বেশি না, তাদের নিয়ে ছেলেখেলা করা হয় না। তুমি রবোট, তুমি এসব বুঝবে না—

রু-টেক কিম জিবানের মাথায় চাটি মেরে থামিয়ে দেয়, নাও নাও, বড় বড় বক্তৃতা শুনে কানের সার্কিট পুড়ে যাবার অবস্থা! মানুষ হলেই খালি বড় বড় বক্তৃতা দিতে হয়? আমাকে কখনো দেখেছ বক্তৃতা দিতে?

তাই তো বলছি, কিম জিবান সাবধানে মাথাটা রু-টেকের চাঁটি থেকে বাঁচিয়ে রেখে বলল, তুমি বুঝবে কি বক্তৃতা দেওয়ার মজা!

সুশান একটু এগিয়ে এসে বলল, ঠাট্টা নয় রু–টেক, তুমি অন্তত একটা যুক্তি দেখাও, কেন আমাদের গ্রহটিতে না গিয়ে ফিরে যাওয়া উচিত।

শুনবে, শুনবে তোমরা?

সবাই মাথা নাড়ে। সুশান তার ছেলেমানুষি চোখ বড় বড় করে বলল, কোনো একটা যুক্তি দেখিয়ে যদি ফিরে যাওয়া যায়, খারাপ কী?

রু-টেক গম্ভীর হয়ে বলল, যুক্তিটা খুব সহজ।

কি?

আমাদের ভালো লাগছে না।

সুশান খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ব্যস?

হ্যাঁ।

সে অনাদের দিকে তাকায়, রু- টেক ঠাট্টা করছে কি না এখনো বুঝতে পারছে।

পল কুম তার কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল, মহাকাশযানের কী একটা ধারার কী একটা অংশে নাকি আছে যে সবার যদি একসাথে কোনো একটা কাজ অপছন্দ হয়—কোনো কারণ ছাড়াই, তাহলে নাকি সেটা না করলে ক্ষতি নেই।

রু– টেক এক হাতে অন্য হাতের উপর আঘাত করে একটা ধাতব শব্দ করে বলল, বললাম না। আমি ভুল বুলি কখনো? চল ফিরে যাই।

পল কুম কোমল দৃষ্টিতে রু-টেকের দিকে তাকিয়ে ছিল, সে দলের সবচেয়ে বয়স্ক সদস্য, জীববিজ্ঞানী দু’জনের আরেকজন। সারাজীবন পশু-পাখির জটিল মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজ করেছে, তাই মানুষের হাতে তৈরি রু-টেকের আশ্চর্য মানবিক অংশটুকু তাকে এত অভিভূত করে। কোনো একটা অজানা কারণে সবার ভিতরে একটা আশ্চর্য অস্বস্তির সৃষ্টি হয়েছে, রু-টেক সেটা বুঝতে পেরে চেষ্টা করছে সবাইকে ফিরিয়ে নিতে। পল কুম কোমল গলায় বলল, রু।

রু-টেক পলের দিকে তাকিয়ে বলল, কি হল?

আমি যতদূর জানি সেই ধারাটিতে আছে, দলের সব সদস্যের যদি কোনো কারণে অস্বস্তি হয়, তাহলে সেই অভিযান বাতিল করা সম্ভব।

রু-টেক সাথে সাথে বুঝে যায়, পল কুম কী বলতে চাইছে, কিন্তু তবু হাল ছেড়ে না দিয়ে সে শেষ চেষ্টা করে, আমিও তো তাই বলছি, সবার মনে হচ্ছে গ্রহটি অশুভ–

পল কুম বাধা দিয়ে বলল, সবার?

রু-টেক মাথা চুলকানোর ভান করে বলল, হ্যাঁ তাই তো দেখা যাচ্ছে।

পল কুম একটু হেসে বলল, তুমি এখনো ভালো করে মিথ্যা কথা বলা শেখ নি। আমার সাথে সাথে কয়দিন থাক, চোখের পাতি না ফেলে কিভাবে মিথ্যা কথা বলতে হয় শিখিয়ে দেব।

রু-টেক চোখ বারকয়েক সামনে-পিছনে নাড়িয়ে বলল, কেন, আমি আবার কী মিথ্যা কথাটা বললাম?

আমাদের সবার ভিতরে যে-রকম একটা অশুভ হয়েছে, তোমার ভিতরে তা হয় নি। মানুষ লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনের ফল, আমাদের কোনো এক পূর্বপুরুষ কী একটা দেখে ভয় পেয়েছিল, সেটা এখনো আমাদের রক্তের মাঝে রয়ে গেছে, তাই এখনো কিছু কিছু জিনিস কোনো কারণ ছাড়াই আমাদের অশুভ মনে হয়। মানুষ এখনো অন্ধকারকে সহজভাবে নিতে পারে না, গুহাবাসী মানুষের সব বিপদ অন্ধকারে ওত পেতে থাকত বলেই হয়তো। কিন্তু তুমি তো কোনো বিবর্তন দিয়ে আস নি, তোমাকে ফ্যাক্টরিতে তৈরি করা হয়েছে, তুমি কেন গ্ৰহটাকে অশুভ মনে করবে?

তা ঠিক। রু-টেক হার মানে, সত্যি কথা বলতে কি, গ্রহটাকে দেখতে খারাপ লাগছে, কিন্তু ঠিক অশুভ মনে হচ্ছে না। তার কারণ অশুভ বলতে তোমরা কী বোক্সাও, আমি ঠিক জানি না। কিন্তু খারাপ লাগাটাই কি যথেষ্ট নয়?

পল কুম মাথা নেড়ে বলল, না, যথেষ্ট নয়। কিম জিবান তার দেয়ালে যে-ছবি আঁকে, সেটা দেখতে তোমার আমার সবারই খারাপ লাগে, সুশান সেদিন যে-স্যুপটা বেঁধেছিল, সেটাও যথেষ্ট খারাপ ছিল—

সুশান আর কিম জিবান একসাথে পল কুমকে থামিয়ে দেয়। কিম জিবান গলার স্বরে একটা আহত ভাব ফুটিয়ে বলল, আমার আঁকা ছবি কি এত খারাপ যে, সেটাকে সুশানের স্যুপের সাথে তুলনা করতে হবে?

সবাই একসাথে হেসে ওঠে, সুশানও। কিম জিবানের বিমূর্ত ছবি নিয়ে মতভেদ আছে কিন্তু স্যুপটা আসলে এমন কিছু খারাপ হয় নি, ঠাট্টা করার জন্যে বলা হয়।

রু-টেক আবার আগের প্রসঙ্গে ফিরে আসে, তাহলে কী সিদ্ধান্ত নেয়া হল? আমরা গ্রহটাতে যাচ্ছি?

লু মাথা নাড়ে, হ্যাঁ, যাচ্ছি। তুমিও যদি বলতে গ্রহটাকে অশুত লাগছে, তাহলে ফিরে যাওয়ার একটা সুযোগ ছিল।

আমাকে কেন টালহু, রু-টেক বলল, আমি একটা যন্ত্র, তোমাদের ঐ ডিটেক্টর বা পাওয়ার জেনারেটরের মতো। পাওয়ার জেনারেটরের বক্তব্যের যদি কোনো মূল্য না থাকে, আমার বক্তব্যের মূলা থাকবে কেন?

পল কুম রু-টেকের ঘাড়ে থাবা দিয়ে বলল, কেন এখনো খামোকা চেষ্টা করে যাচ্ছ? তুমি জান তুমি দলের একজন, সত্যি কথা বলতে কি পুরো দলে একজন যদি স্বাভাবিক মানুষ থাকে, যার একটু জ্ঞানবুদ্ধি বা রসবোধ আছে, সেটা হচ্ছ তুমি। আর মহাকাশযানের এগার নম্বর ধারার চার নম্বর অংশে স্পষ্ট বলা আছে, মহাকাশযানে যদি ষষ্ঠ মাত্রার কোনো রৰােট থাকে, তাহলে তাকে মানুষের সমান মর্যাদা দিয়ে দলের সদস্য হিসেবে নিতে হবে।

রু-টেক চিন্তিতভাবে মাথা নেড়ে বলল, আমি দুঃখিত যে, আমার জনো তোমাদের সবার গ্রহটাতে যেতে হচ্ছে। কেউ একজন কি আমাকে আজ রাতের মাঝে শিখিয়ে দিতে পারবে কী ভাবে অশুভ অনুভব করতে হয়?

সুশান বলল, খুব ভালো আছ তুমি, খামোকা এই বয়সে মূতল একটা জিনিস শিখতে যেও না।

রবোটের হিসেবে আমার বয়স খুব বেশি নয় সুশান, আমাদের শৈশব শুরু হয় চল্লিশ বছরের পর!

বেশ, তাহলে অন্তত কৈশোরের জন্যে অপেক্ষা কর।

রু-টেক কাঁধ ঝাঁকিয়ে একটু সরে গিয়ে মনিটরটির দিকে তাকায়, নিজের অজান্তে তার সবুজ চোখের ঔজ্জ্বল্য বেড়ে যেতে থাকে।

পল কুম একটু এগিয়ে লুয়ের কাঁধে টোকা দিয়ে বলল, লু।

কি?

আমার কি মনে হয় জান?

কি?

এই গ্রহে খুব উন্নত একটা প্রাণী আছে।

লু ঘুরে তাকিয়ে বলল, কেন ওরকম ভাবছ?

পল কুম গলার স্বর নিচু করে বলল, রু-টেক ছাড়া সবার ভিতরে কেমন একটা চাপা ভয় দেখেছ? এরকম অনুভূতি শুধু একটা জীবিত প্রাণী আরেকটা জীবিত প্রাণীর ভিতরে সঞ্চারিত করতে পারে। ব্যাপারটা কীভাবে হয় ঠিক জানা নেই, পৃথিবীতে কয়েক জায়গায় এর উপরে কাজ হচ্ছে। জিনিসটাকে টেলিমরবিজম বলে। তুমি নিশ্চয়ই আগে লক্ষ করেছ, একজন মানুষের মনে যখন খুব কষ্ট হয়, তখন তার সাথে কথা না বলে, শুধু তার পাশে বসে সেটা অনুভব করা যায়?

লু অন্যমনক্কতাবে মাথা নাড়ে। মনোবিজ্ঞান সে ভালো বোঝে না, কোনটি বিজ্ঞান আর কোনটি কল্পনা সে এখনো ভালো ধরতে পারে না।

মহাকাশযান সিসিয়ানের কন্ট্রোল–ঘরটি হঠাৎ দেখলে মনে হবে সেখানে কেউ নেই। যে-মহাকাশযান চালানোর জন্যে প্রায় তিন হাজার ছোট-বড় কম্পিউটার কাজ করে, সেখানে কারো থাকার প্রয়োজন নেই, কিন্তু তবুও সবসময়েই সেখানে কেউ-না-কেউ থাকে। আজ সেখানে আছে কিম জিবান। কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে আরামদায়ক চেয়ারটাতে সে প্রায় ডুবে আছে, পা তুলে দিয়েছে মনিটরটির উপরে, দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে আছে মনিটরটির দিকে। ঘরটিতে আবছা অন্ধকারে মনিটরটির রঙিন আলো ছাড়া আর কিছু নেই। সবাই বিশ্রাম নিতে গিয়েছে, তাদের মহাকাশযান সিসিয়ানের গ্রহটির মাধ্যাকর্ষণ শক্তির আওতার ভিতরে না আসা পর্যন্ত কারোরই বিশেষ দায়িত্ব নেই। সে যদিও মহাকাশযানের ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু গ্রহ-উপগ্রহ নিয়ে বাড়াবাড়ি কৌতূহল বলে নিজের উৎসাহে কন্ট্রোলরুমে সময় কাটানোর দায়িত্ব নিয়েছে।

যে-গ্রহটির দিকে তারা এগিয়ে যাচ্ছে, সেটির নাম ট্রাইটন। এটি অবশ্যি তার সত্যিকার নাম নয়, গ্রহটির সত্যিকার নাম হচ্ছে একটি বিদঘুটে সংখ্যা। সংখ্যাটি বিদঘুটে হলেও অর্থহীন নয়, প্রথম ছয়টি সংখ্যা দিয়ে তার অবস্থান, এবং পরের চারটি দিয়ে তার আকার-আকৃতি প্রকাশ করা হয়। অনুসন্ধানকারী কোনো দল যখন কোনো গ্রহে অভিযানে বের হয়, তখন তাদেরকে বিদঘুটে সংখ্যা ছাড়াও ব্যবহার করার জন্যে গ্রহটির একটি সাময়িক নাম দিয়ে দেয়া হয়। অভিযান শেষ হবার পর নামটিও শেষ হয়ে যায়, যারা অভিযানে অংশ নেয় তারা হয়তো আরো কিছুদিন মনে রাখে, কিন্তু তার বেশি কখনো কিছু নয়।

এই আশ্চর্য গ্রহ ট্রাইটনের দিকে যতই তারা এগিয়ে যাচ্ছে, আর সবার মতন তার ভিতরেও একটা বিতৃষ্ণা এবং চাপা ভয় জেগে উঠছে, কিন্তু সাথে সাথে তার ভিতরে জেগে উঠছে একটা আশ্চর্য কৌতূহল। গ্রহটির যতই কাছে আসছে ততই তার বিস্ময় বেড়ে যাচ্ছে, গ্ৰহতত্ত্বের প্রচলিত প্রায় সবগুলি নিয়ম এখানে অচল। প্রথমে ধরা যাক ঘনত্ব, এই আকারের একটা গ্রহের যে পরিমাণ ঘনত্ব থাকা দরকার, ট্রাইটনের ঘনত্ব তার থেকে অনেক কম, পুরো গ্রহটি যেন হালকা তুলো দিয়ে তৈরি। গ্রহ-উপগ্রহে মাধ্যাকর্ষণের জন্যে কেন্দ্রে ঘনত্ব বেশি হয়, কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় সেটি এই গ্রহের জন্যে সত্যি নয়। গ্রহটি ঘুরছে খুব ধীরে ধীরে, কিন্তু ঘূর্ণনটি কখনোই ঠিক নিয়মিত নয়। অবিশ্বাস্য মনে হয়, কিন্তু গ্রহটির ঘূর্ণন যেন মাঝে মাঝে পুরোপুরি থেমে যাচ্ছে, এ-ধরনের ব্যাপার ঘটতে হলে গ্রহের ভিতরে যে-রকম প্রলয়কাণ্ড ঘটা উচিত, বাইরে থেকে সেরকম কিছু দেখা যাচ্ছে না। ট্রাইটনের বায়ুমণ্ডল বলতে গেলে নেই, যা আছে সেটি অত্যন্ত বড় বড় পলিমার। ট্রাইটনের পৃষ্ঠে বড় বড় গোলাকার গর্ত, সিসিয়ানের রিপোর্ট সত্যি হলে সেগুলি শুধু যে আকার পরিবর্তন করছে তাই নয়, ক্রমাগত নাকি স্থানও পরিবর্তন করছে।

কিম জিবান ট্রাইটনের এ-ধরনের ব্যবহারের ব্যাখ্যা খুঁজে বের করার চেষ্টা করে করে কিছুক্ষণ হল হাল ছেড়ে দিয়েছে। মূল কম্পিউটার সিডিসি এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয়, সে তার সুবিশাল মেমোরি ব্যাংকের তথ্য থেকে ট্রাইটনের আশ্চর্য ব্যবহারের কাছাকাছি জিনিসগুলি ক্রমাগত পরীক্ষা করে দেখছে, কোনো কোনোটা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে কিম জিবানকে জানাতেও দেরি করছে না। কিন্তু এত অল্প সময়ে এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস জানা হয়ে গেছে যে, কিম জিবানের আর অবাক হওয়ার ক্ষমতা নেই। সে এখন সম্পূর্ণ অন্যভাবে গ্রহটির আচার-আচরণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছে, তার ব্যাখ্যা অবশ্যি কাউকে বলার মতো নয়, কারণ সেগুলি এরকম :

প্রথম ব্যাখ্যা : এটি আসলে কোন গ্রহ নয়, এটি হচ্ছে নরক। ধর্মগ্রন্থে নরকের যেবর্ণনা থাকে, তার সাথে খুব বেশি মিল নেই, কিন্তু থাকতে হবে সেটা জোর দিয়ে কে বলতে পারে? গোলাকার এই জায়গাটার ভিতরে সব পাপীদের আত্মাকে পুরে রাখা হয়, পাপীদের আর্তনাদ তারা ঠিক শুনতে পাচ্ছে না, কিন্তু সেজন্যে তাদের ভিতরে একটা চাপা ভয় আর অশুভ চিন্তা এসে বাসা বেঁধেছে।

তার এই ব্যাখ্যা যদি সত্যি হয় তা হলে ধরে নিতে হবে একটি স্বর্গও কোথাও আছে এবং সেই স্বর্গের কাছাকাছি গেলে সবার মনে আনন্দ হতে থাকবে। এই অভিযান শেষ হওয়ামাত্রই সে তাহলে স্বর্গের খোঁজে বের হবে। একটি মহাকাশযানে করে সে স্বর্গ খুঁজে বেড়াচ্ছে, জিনিসটা কল্পনা করেই কিম জিবানের হাসি পেয়ে যায়।

দ্বিতীয় ব্যাখ্যা : এটি আসলে একটি অতিকায় মহাকাশযান, এর ভিতরে রয়েছে আশ্চর্য সব প্রাণী, তাদের কিলবিলে মাকড়সার মতো পা। কেন এদের কিলবিলে মাকড়সার মতো পা, কিম জিবান ব্যাপারটির সদুত্তর দিতে পারে না, মহাকাশের প্রাণীর কথা চিন্তা করলেই কেন জানি তার চোখের সামনে কিলবিলে পা ভেসে ওঠে। টাইটনের উপরে যে গোল গোল গর্ত রয়েছে, তার ভিতর থেকে উকি মেরে সেই কিলবিলে মাকড়সাগুলি তাদের লক্ষ করছে, কাছে হাজির হওয়ামাত্রই সেগুলি তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে কচকচ করে খেয়ে ফেলবে।

ব্যাখ্যাটির সমস্যা হচ্ছে যে, যদি এই কিলবিলে মাকড়সাগুলি এরকম একটা মহাকাশযান তৈরি করতে পারে, তাহলে অবশ্যি তারা সিসিয়ানের সাথে যোগাযোগ করতে পারত, কিন্তু সেরকম সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, গ্রহটির সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি।

তৃতীয় ব্যাখ্যা; সিসিয়ানে যেসব খাবারদাবার আছে ভুল করে তার সাথে কোনো একধরনের মাদকদ্রব্য মিশিয়ে দেয়া হয়েছে, কাজেই তাদের সবার একইসাথে বিভ্রম হচ্ছে। আসলে ট্রাইটনে আশ্চর্য কিছুই নেই, এটি একটি অত্যন্ত সাধারণ দ্বিতীয় শ্রেণীর গ্রানাইট গ্রহ।

ব্যাখ্যাটির সমস্যা হচ্ছে যে, কম্পিউটারের কখনো বিভ্রম হয় না, কিন্তু সিডিসি যেসব তথ্য জানাচ্ছে সেগুলিও বিভ্রম ছাড়া দেখা সম্ভব নয়।

চতুর্থ ব্যাখ্যা : আসলে সে এখন একটা বাজে স্বপ্ন দেখছে, ঘুম থেকে উঠেই দেখবে সে তার ঘরে ষোড়শ শতাব্দীর একটা রূপকথা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

এই ব্যাখ্যাটি কিম জিবানের খুব পছন্দ হয়, সে ঘুমিয়ে নেই ব্যাপারটি প্রমাণ করাও সহজ ব্যাপার নয়। কিম জিবান তাই এতটুকু নড়াচড়া না করে চুপচাপ শুয়ে অপেক্ষা করতে থাকে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠার জন্যে। অপেক্ষা করতে করতে সে ঘুমিয়ে পড়ে, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে, সে পৃথিবীতে ফিরে গেছে বাচ্চা একটা ছেলে হয়ে, ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটছে সে একটি হ্রদের ধারে।

কেউ একজন আমার সাথে হাত লাগাও, সিসিয়ানকে অরবিটে নিয়ে আসি, লু ভুরু কুঁচকে কন্ট্রোল প্যানেলের অসংখ্য সুইচ এবং মিটারের দিকে তাকিয়ে থেকে গলা উচিয়ে বলল, হাজার কিলোমিটারে আপত্তি আছে কারো?

মাত্র হাজার কিলোমিটার? বেশি কাছে হয়ে গেল না? সুশান ভয়ে ভয়ে বলল, গ্রহটা থেকে যদি কোনো মিসাইল টিসাইল ছেড়ে আমাদের কিছু একটা করে?

রু-টেক হেসে বলল, মিসাইল ছেড়ে যদি আমাদের শেষ করতে চায় তাহলে তুমি হাজার কিলোমিটার দূরেই থাক আর মিলিয়ন কিলোমিটার দূরেই থাক, কোনো রক্ষা নেই।

তা হলে?

তা হলে কি?

এই গ্রহের লোকজন যদি আমাদের কিছু করে?

রু-টেক হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে বলল, অকারণে ভয় পেতে তোমার এত উৎসাহ কেন? এই গ্রহে কোনোরকম প্রাণী আছে, তুমি কী ভাবে জান? আর যদি থেকেও থাকে, সেটা উন্নত কোনো প্রাণী হবে কি না তার কি নিশ্চয়তা আছে? আর সত্যিই যদি মিসাইল ছেড়ে আমাদের উড়িয়ে দেওয়ার মতো উন্নত কোনো প্রাণী থাকে, তা হলে কথা নেই বার্তা নেই আমাদের উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে কেন?

কী করবে তাহলে?

আমাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে।

পল কুম এক পাশে দাঁড়িয়ে কফিজাতীয় কোনো একটা জিনিস খাচ্ছিল, রু-টেকের কথা শুনে চিন্তিত স্বরে বলল, রু-টেক, তোমার সমস্যা কী জান, তুমি সবসময়ে মানুষের মতো চিন্তা কর। কোনো একটা উন্নত প্রাণীর কথা বললেই তোমার মনে মানুষের চেহারা ফুটে ওঠে। একটা প্রাণী যদি মানুষ থেকে অনেক উন্নত হয় তাহলে হয়তো তারা ইচ্ছা করলেও মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে না। পিপড়ার তো তুলনামূলকভাবে অনেক বুদ্ধি, মানুষ কখনো পেরেছে পিপড়ার সাথে যোগাযোগ করতে? যদি পিপড়া সম্পর্কে কিছু জানতে ইচ্ছে হয়, আমরা একটা পিপড়া ধরে নিয়ে আসি, ঠিক সেরকম খুব উন্নত প্রাণী যদি আমাদের দেখে যোগাযোগ করার চেষ্টা না করে সোজাসুজি আমাদের ধরে নিয়ে যায় আমি একটু অবাক হব না।

লু গলা উচিয়ে বলল, তোমরা বক্তৃতা থামিয়ে আমার সাথে একটু হাত লাগাবে?

রু-টেক এগিয়ে এসে বলল, আমি বুঝি না, তুমি সিডিসির উপর ভার না দিয়ে নিজে নিজে এসব জিনিস করতে চাও কেন? মহাকাশযানকে অরবিটে আনা কিরকম ঝামেলার কাজ, তুমি জান?

মোটেই কোনো ঝামেলার কাজ না, কম্পিউটার করতে পারে বলেই ছোট-বড় সব কাজ কম্পিউটার দিয়ে করাতে হবে? মাঝেমধ্যে নিজে নিজে কিছু কাজ করতে হয়, তাতে স্নায়ু শক্ত হয়, মস্তিষ্কে রক্তসঞ্চালন হয়, মাংসপেশীর ব্যায়াম হয়, মন প্রফুল্ল হয়—

থাক থাক, আর বলতে হবে না, কিম জিবান এগিয়ে এসে বলল, সত্যিকার কাজকর্ম নেই বলে কিছু কাজ বের করার চেষ্টা করছ। গ্রহটার যেটুকু দেখেছি, তা দেখে পরিষ্কার বলে দিতে পারি, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আর কাজ বের করতে হবে না, কোনোমতে এখন এখান থেকে জান নিয়ে পালাতে পারলে হয়।

সুশান পাংশু মুখে বলল, কেন, কী হয়েছে গ্রহটার?

নূতন কিছু নয়, কিন্তু যা দেখেছ সেটার কোনো মাথা মুণ্ডু আছে? আমার কাছে তো মনে হচ্ছে পরিষ্কার নরক।

কেন খামোকা ভয় দেখাচ্ছ লোকজনদের, লু একটু বিরক্ত হয়ে বলল, এটা যদি সেনাবাহিনীর মহাকাশযান হত, তাহলে এতক্ষণে তোমার কোর্ট মার্শাল হয়ে যেত। সুশান, তোমার এত ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই, আমাদের এই মহাকাশযান গবেষণার জন্যে হতে পারে, কিন্তু দরকার হলে আমাদের হাজার মাইলের ভিতর যা কিছু আসে আমরা উড়িয়ে দিতে পারি। কাজেই যতবড় বুদ্ধিমান প্রাণীই আসুক, তোমার কোনো ভয় নেই।

লু মোটেই বাজে কথার মানুষ না, তা ছাড়া একটা অবস্থার গুরুত্ত্ব তার মতো ভালো করে কেউ বুঝতে পারে না, খামোকা তাকে এরকম একটা মহাকাশযানের দলপতি বানানো হয় নি। তাই লুয়ের কথা শুনে সত্যি সত্যি সুশানের চাপা ভয়টা কমে কেমন একটা সাহসের ভাব এসে যায়। সে একটু এগিয়ে মহাকাশযানটাকে কক্ষপথে আটকে ফেলার কাজে লুকে সাহায্য করতে গেল।

মহাকাশযানটিকে তার নির্দিষ্ট কক্ষপথে আবর্তন শুরু করাতে দু’জনের প্রায় দশ মিনিট সময় লেগে যায়। কাজটা খুব যে সুচারুভাবে করা হল সেরকম বলা যায় না, প্রথমত কক্ষপথ পুরোপুরি বৃত্তাকার না হয়ে খানিকটা উপবৃত্তাকার হয়ে গেল, দ্বিতীয়ত গ্রহ থেকে দূরত্ব পুরোপুরি এক হাজার কিলোমিটার না হয়ে প্রায় এক শ’ কিলোমিটার বেশি হয়ে থাকল। কম্পিউটার সিডিসিকে ব্যবহার না করে নিজে নিজে চেষ্টা করলে এর থেকে ভালো অবশ্যি কেউ আশা করে না। তবে আজ একটু বাড়তি মজা হল, যখন সুশান কৃত্রিম মহাকর্ষ তৈরি করতে ভুলে যাওয়ায় মিনিট দুয়েক সবাই খানিকক্ষণ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। পল কুম তার ভেসে বেড়ানো গরম কফিটাকে মর্গে ঢোকানোর চেষ্টা করছে। দৃশ্যটি এত হাস্যকর যে, এই নিয়ে হাসাহাসি হৈচৈ করে সবার ভিতরের চাপা অশান্তিটা বেশ একটু কমে আসে।

সিসিয়ানকে নির্দিষ্ট কক্ষপথে এলে সবাই রুটিনবাঁধা কাজে লেগে যায়, নিজেদের দায়িত্ব কম, সিডিসি নিজেই সব করতে পারে; তবু কেউ-না-কেউ সেটা নিজের চোখে দেখে নিশ্চিত হয়ে নেয়। ছয় মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে মহাকাশকেন্দ্রে যোগাযোগ করে সংবাদের আদান-প্রদান হতে থাকে, সিডিসি নতুন পরিবেশের উপযোগী প্রয়োজনীয় খবরাখবর নিয়ে আসতে থাকে। দেখা গেল কাছাকাছি একটা পালসার রয়েছে, সেটিতে ছয় ঘন্টা পরপর একবার করে বিস্ফোরণ ঘটে। তাদের নতুন অবস্থান এই পালসারটিকে কেন্দ্র করে দেয়া হল। নির্দিষ্ট সময় পরপর পালসারের বিস্ফোরণ ঘটে বলে সেগুলি কেন্দ্রীয় মহাকাশকেন্দ্রে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। প্রয়োজনীয় কাজকর্ম গুছিয়ে নিতে নিতেই লু তাদের প্রথম আলোচনাসভা ডেকে বসে। কোনো আলোচনা শুরু করার আগে তার সবসময়েই একটা ছোটখাটো বক্তৃতা দেয়ার অভ্যাস, এবারেও তার ব্যতিক্রম হল না। সে এভাবে শুরু করে, সিসিয়ান সময় সকাল সাড়ে নয়টা, আমাদের আলোচনা শুরু হচ্ছে। আলোচনায় দলের সবাই ছাড়াও অংশ নিচ্ছে সিসিয়ানের মূল কম্পিউটার সিডিসি। আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ-কর্মপন্থা। তোমরা সবাই জান যে, আমরা একটা অস্বস্তিকর অবস্থায় এসে পড়েছি। ট্রাইটন নামের যে-গ্রহটাকে সিসিয়ান এখন পাক খাচ্ছে, সেটার কোনো বিশেষ দোষ আছে, যার জন্যে আমাদের সবার, বিশেষ করে যারা জৈবিক প্রাণী, তাদের ভিতরে একটা আশ্চর্য অস্বস্তির সৃষ্টি হয়েছে। অকারণ অস্বস্তি জিনিসটা ভালো না, আমার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না, কিন্তু কিছু করার নেই। আমাদের দায়িত্ব শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের এখানে থাকতে হবে। কারো কিছু বলার আছে?

সবারই কিছু-না-কিছু বলার আছে, তবে বিষয়বস্তু মোটামুটি এক। শুরু করল পল কুম, জিজ্ঞেস করল, আমাদের দায়িত্বটা কি?

যদি গ্ৰহটাতে কোনো প্রাণের বিকাশ না হয়ে থাকে, তা হলে আমাদের দায়িত্ব খুবই কম, সব রুটিনবাঁধা কাজ। ট্রাইটনের আকার, আকৃতি, ভর, তাপমাত্রা, বায়ুমণ্ডল, ঘনত্ব এইসব জিনিস জেনে যেতে হবে। আমাদের তা হলে কিছু করতে হবে না, সিডিসি এক দিনে শেষ করে ফেলতে পারবে। সিডিসি, ঠিক বলেছি কি না?

সিডিসি বিপবিপজাতীয় একটা শব্দ করল, যার অর্থ অনেক কিছু হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে সবাই জানে এটা সিডিসির সম্মতিসূচক উত্তর।

আর গ্রহটিতে যদি প্রাণের বিকাশ হয়ে থাকে?

লু তার কফির মগে একটা চুমুক দিয়ে বলল, তা হলে আমাদের কাজ একটু জটিল। প্রথমে প্রাণীটি বুদ্ধিমত্তার কোন স্তরে সেটা বের করতে হবে। বুদ্ধিমত্তায় নিনিষ স্কেলে যদি আটের কম হয়, তা হলে আমাদের দায়িত্ব মোটামুটি সহজ, সেটিও রুটিনবাঁধা কাজ, সিডিসিকে নিয়ে আমরা এক দিনে শেষ করে দিতে পারব বলে মনে হয়। কিন্তু বুদ্ধিমত্তা যদি নিনিষ স্কেল আটের বেশি কিন্তু দশের নিচে হয়, যার অর্থ প্রাণীটি মানুষের সমপর্যায়ের, তা হলে আমাদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি, গরুর মতো খেটেও কয়েক সপ্তাহে শেষ করতে পারব কি না সন্দেহ। কারণ তা হলে আমাদের প্রথম পর্যায়ের যোগাযোগ শেষ করে দ্বিতীয় পর্যায়ের যোগাযোগ শুরু করতে হবে। তৃতীয় পর্যায়ের যোগাযোগের দায়িত্ব আমাদের নয়, কেন্দ্রীয় মহাকাশকেন্দ্রের, তবে আমাদের তাদের সাথে সহযোগিতা করতে হবে—

কিম জিবান বাধা দিয়ে বলল, প্রথম পর্যায় দ্বিতীয় পর্যায় ব্যাপারগুলি একটু বুঝিয়ে দেবে?

লু পল কুমের দিকে তাকিয়ে বলল, পল, তুমি তো এসব ভালো জান, বুঝিয়ে দেবে সবাইকে?

পল কুম কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, এগুলি হচ্ছে ধোঁকাবাজি, বড় বড় হর্তাকর্তাদের কোনো কাজকর্ম নেই বলে এরা বসে বসে নানারকম নিয়মকানুন তৈরি করে।

সিডিসি বিবি শব্দ করে আপত্তি করায় সবাই বুঝতে পারে পল কুমের কথাটি অন্তত পঞ্চম মাত্রার অপরাধ। সেটা নিয়ে পল কুমের কোনো মাথাব্যথা দেখা গেল না, সে বলে চলল, সাদা কথায় বলা যায় মানুষের সমপর্যায়ের কোনো প্রাণী পাওয়া গেলে আমাদের দায়িত্ব তাদের সাথে যোগাযোগ করা, সংবাদ, ভাব, ভাষা, জ্ঞানবিজ্ঞান আর কালচার বিনিময় করা। এটা হচ্ছে প্রথম পর্যায়ের যোগাযোগ। দ্বিতীয় পর্যায়ের যোগাযোগ হচ্ছে তাদের সাথে সামনাসামনি দেখা করা, তখন একজন আরেকজনকে ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখতে পারে। আমাদের সেটা শুরু করতে হবে, শুরু করা মানে কী, আমাকে জিজ্ঞেস করো না।

সুশান জিজ্ঞেস করল, তৃতীয় পর্যায়ের যোগাযোগ জিনিসটা কী?

জিনিসটা বেশি সুবিধের না, তখন আমাদের একজনকে ওদের কাছে রেখে ওদের একজনকে আমাদের সাথে নিয়ে যেতে হবে।

সুশান মাথা নেড়ে বলল, আমি থাকছি না এখানে, মরে গেলেও থাকছি না।

লু হেসে বলল, সেসবের অনেক ধরনের নিয়মকানুন আছে সুশান, তুমি না চাইলেই যে তোমাকে থাকতে হবে না, সেটার কোনো গ্যারান্টি নেই। তারা যদি তোমাকে পছন্দ করে ফেলে, তাহলে কী করবে? কি বল সিডিসি?

সিডিসি বিপবিপ শব্দ করে সম্মতি কিংবা অসম্মতি জানায়।

সুশান কী একটা বলতে গিয়ে থেমে যায়, লু তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, এই গ্রহে আদৌ কোনো প্রাণী আছে কি না জানার আগে আমাদের যোগাযোগের মাত্রা নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো প্রয়োজন নেই সুশান।

রু-টেক সভ্য মানুষের মতো হাত তুলে কথা বলার অনুমতি চাইল। লু মাথা নেড়ে অনুমতি দিতেই সে বলল, যদি এখানে কোনো প্রাণী পাওয়া যায় যার বুদ্ধিমত্তা নিনিষ স্কেলে দশের বেশি তা হলে আমরা কী করব?

তা হলে আমরা এত বিখ্যাত হয়ে যাব যে আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না।

ভবিষ্যৎ নিয়ে নাহয় চিন্তা করতে হবে না, কিন্তু এখন কী করব?

লু এক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, এখনো কোথাও মানুষ থেকে বুদ্ধিমান প্রাণী পাওয়া যায় নি, তাই ব্যাপারটি ঠিক পরিস্কার করে ব্যাখ্যা করা নেই। সিডিসি চেষ্টা করলে হয়তো আমাদের বলতে পারবে।

রু-টেক সিডিসিকে জিজ্ঞেস করল, সিডিসি, তুমি জান?

সিডিসি দু বার বিপবিপ শব্দ করে একটা কর্কশ ধাতব আওয়াজ করে। লু হাতের কাছের একটা ছোট সুইচ টিপে দিতেই সিডিসির একঘেয়ে যান্ত্রিক গলার ধাতব আওয়াজ শোনা যায়, মহামান্য লু, আপনাদের আলোচনায় আমার অংশ নেওয়ার সার্থকতা শতকরা নিরানব্বই দশমিক তিন ভাগ কমে যায়, যখন আপনারা আমাকে কথা বলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেন। মহামান্য রু–টেক যে প্রশ্ন করেছেন, তার সরাসরি কোনো উত্তর নেই। তবে নিরাপত্তাসংক্রান্ত দু শ নব্বইয়ের চতুর্থ ধারা এবং জ্ঞানবিকাশের সাতাত্তর দশমিক এক ধারার চতুর্থ পরিচ্ছেদ থেকে আমি বলতে পারি যে, আপনারা যদি কখনো এমন কোনো প্রাণীর সম্মুখীন হন, যার বুদ্ধিমত্তা নিনিষ স্কেলে দশের বেশি, আপনাদের প্রথম সুযোগ পাওয়ামাত্র তাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে হবে। এই প্রসঙ্গে মহামান্য পল কুম কেন্দ্রীয় মহাকাশকেন্দ্র সম্পর্কে যে অসৌজন্যমূলক উক্তি করেছিলেন–

লু সুইচ টিপে সিডিসির কথা বন্ধ করে দেয়। পল কুম নীষার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, নীষা, এই সিডিসির এত মাথামোটা কেন? সবসময়ে মহামান্য মহামান্য করে কথা বলে যে গায়ে একেবারে জ্বালা ধরে যায়।

নীষা দলের দ্বিতীয় মেয়েটি, বয়স সুশান থেকে এক দুই বছর বেশি হতে পারে। সে স্বল্পভাষী, তাই প্রথম পরিচয়ে লোকজন তাকে অমিশুক বলে সন্দেহ করে। সিসিয়ানের যাবতীয় কম্পিউটারের দায়িত্ব তার উপর। মহাকাশযানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ এটি, নীষা খুব দক্ষতার সাথে সেটা করে এসেছে। পল কুমের প্রশ্ন শুনে সে একটু হেসে বলল, সিডিসি হচ্ছে বর্তমানকালের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী কম্পিউটার, সে ইচ্ছা করলে এত সুন্দর করে কথা বলতে পারে যে তোমরা কাজকর্ম ফেলে দিনরাত শুধু তার কথাই শুনতে চাইবে। তাকে ইচ্ছা করে এভাবে কথা বলার জন্যে প্রোগ্রাম করা হয়েছে, দেখা গেছে তা হলে তার ক্ষমতা সবচেয়ে ভালোভাবে ব্যবহার করা যায়। তোমরা যদি চাও তা হলে আমি প্রোগ্রামটি পাল্টে দিতে পারি, তৃতীয় মাত্রার বেআইনি কাজ, কিন্তু–

লু হাত নেড়ে বলল, ওসব ঝামেলায় যেও না, শুধু শুধু সময় নষ্ট।

সুশান হাসি চেপে বলল, কোনটা সময় নষ্ট, কথা বলা, না কথা শোনা?

সবাই হেসে ওঠে, তার মাঝে কিম জিবান জিজ্ঞেস করে, লুল, তুমি যে কথার মাঝখানে সিডিসির মুখের উপর সুইচ টিপে বন্ধ করে দাও, সে রাগটাগ করে না তো আবার, পুরো সিসিয়ানের নিরাপত্তা ওর উপর।

রু-টেক শব্দ করে হেসে উত্তর দেয়, না কিম, ভয় পেয়ো না, রাগটাগ এসব হচ্ছে তোমাদের এবং আমার মতো একজন দু’জন সৌভাগ্যবান রবোটের বিলাসিতা, কম্পিউটারের ওসব নেই। মাঝে মাঝে অবাক হয়তো হয়, কিন্তু রাগ কখনোই হয় না।

রবোট, মানবিক অনুভূতি এবং যান্ত্রিক উৎকর্ষ নিয়ে একটা আলোচনা শুরু হতে গিয়ে থেমে গেল, আজকে সবারই তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আলোচনা করার আছে। সবাই লু’য়ের দিকে তাকাল, সে তার কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, কাজেই বুঝতেই পারছ, আমাদের কাজ সবচেয়ে সহজ হয় যদি দেখা যায় এই গ্রহে কোনো প্রাণের বিকাশ হয় নি, আর যদি হয়েও থাকে সেটার বুদ্ধিমত্তা বোধহয় খুব নিম্নশ্রেণীর।

রু-টেক হেসে বলল, কিংবা কোনো প্রাণী, যেটার বুদ্ধিমত্তা আমাদের থেকে বেশি।

লু হেসে বলল, হ্যাঁ, তাহলে আমাদের দায়িত্ব পালিয়ে যাওয়া।

কিম জিবান বাঁকা করে হেসে বলল, যদি তারা আমাদের পালাতে দেয়।

সেটা তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও, লু হেসে বলল, পালিয়ে যেতে আমার কোনো জুড়ি নেই।

সুশান বলল, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, এখানে প্রাণের বিকাশ হয়েছে, আর বুদ্ধিমত্তা সম্ভবত আমাদের সমপর্যায়ের।

পল কুম বলল, সেটা নিয়ে এখন মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। আর কিছুক্ষণেই সেটা সন্দেহাতীতভাবে জানা যাবে।

লু সবার দিকে তাকিয়ে বলল, পরের চরিশ ঘন্টায় তোমাদের দায়িত্ব আমাদের সব কাজ শেষ করে ফেলা। কার কি করতে হবে তোমরা আমার থেকে ভালো জান, আমি তবু একবার বলে নিই, কাগজপত্র ঠিক রাখার জন্যে। সবচেয়ে বড় দায়িত্ব পল কুম আর সুশানের, তোমাদের বের করতে হবে এখানে প্রাণের বিকাশ হয়েছে কি না, হয়ে থাকলে ঠিক কী ধরনের প্রাণ। সিডিসি এখানে পৌছানোর সাথে সাথে খবরাখবর নেয়া শুরু করে দিয়েছে, রুটিন-কাজ সে করে ফেলতে পারবে, কিন্তু শেষ কথাটি আসবে তোমাদের দু’জনের মুখ থেকে। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি ট্রাইটনে কোনো স্কাউটশিপ নামাতে না হয়। স্কাউটশিপ নামানো মানে হচ্ছে এক হাজার নূতন ঝামেলা। ট্রাইটনে যদি বুদ্ধিমান প্রাণী থাকে, তাহলে নীষা, তোমাকে ওদের বুদ্ধিমত্তার স্তর বের করতে হবে। তুমি আগে থেকেই কাজ শুরু করে দিতে পার, বুদ্ধিমত্তার সেই বিশেষ বিশেষ কোড পাঠানো এবং ঐ ধরনের কাজ, তুমি নিশ্চয়ই আমার থেকে ভালো জান কী করতে হবে। কিম, তোমার যেহেতু গ্রহ-উপগ্রহ নিয়ে এত কৌতূহল, তাড়াতাড়ি বের করে ফেল এটা কী ধরনের গ্রহ, তা হলে তোমাকে অন্য কাজে লাগানো যাবে। রু–টেক, তুমি আমাদের অস্ত্রাগারটা একবার ঘুরে এস। বোমাটোমা যদি চুড়তে হয় আমরা যেন আগে থেকে প্রস্তুত থাকি।

কিম জিন জিজ্ঞেস করল, সবার কাজ তো ভাগ করে দিলে, তোমার নিজের জন্যে কি রেখেছ?

লু চোখ পাকিয়ে বলল, আমি দলপতি না? দলপতিরা আবার কাজ করে নাকি?

ঠাট্টা না, সত্যি বল না।

তোমরা হাসবে না তো?

সুশান বলল, না শুনে কথা দিই কেমন করে?

হাইপারডাইভের ম্যানুয়েলটা পড়ব, আর দেখব সার্কিটটা ঠিক আছে কি না।

কেউ হাসল না, হাসির কথাও না। হাইপারভাইভ ব্যাপারটা হাসি-তামাশার ব্যাপার না, এখনো সেটা পুরোপুরি মানুষের আওতায় নেই, মাঝে মাঝেই অসম্পূর্ণ হাইপারডাইভের গুজব শোনা যায়, মহাকাশযান তখন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থেকে নাকি পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে যায়। কোথায় যায় সেই মহাকাশযানগুলি, কে জানে!

সুশান শুকনো মুখে বলল, সত্যি আমাদের হাইপারভাইভ দিতে হতে পারে?

কিছুই আগে থেকে বলা যায় না সুশান, কিন্তু প্রস্তুত থাকতে দোষ কি?

 

০২. বুদ্ধিমান প্রাণী?

সবাই আবার বড় মনিটরটি ঘিরে গোল হয়ে বসেছে। সবার চোখেমুখেই একই সাথে ক্লান্তি এবং ভয়-ধরানো একটা উত্তেজনার তাব। লু হাইপারভাইভের ম্যানুয়েল দেখে সিডিসির সাথে একদান দাবা খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়েছিল, কিন্তু তার চেহারায় ঘুম থেকে ওঠা সতেজ ভাবটা নেই। তার ঘুমটা কেটেছে কাটা কাটা দুঃস্বপ্ন দেখে, এখনো মাথায় সেগুলি ঘুরপাক খাচ্ছে। কফির কাপে চুমুক দিয়ে সে তার ছোট বক্তৃতা দিয়ে তার আলোচনা শুরু করে, সকালে তোমাদের কাজকর্ম ভাগ করে দেয়া হয়েছিল, এতক্ষণে নিশ্চয়ই অনেকটুকু গুছিয়ে নিয়েছ। কি বল?

 

উপস্থিত কাউকে খুব উৎসাহী দেখা গেল না। লু একটু হেসে বলল, ঠিক আছে, সবার রিপোর্ট শোনা যাক। পল কম আর সুশান তোমাদের দিয়ে শুরু করি।

 

পল কুম হাত উন্টে বলল, কি বলব ঠিক বুঝতে পারছি না। আমরা যত রকম পরীক্ষা করা সম্ভব সব করেছি, এবং পরীক্ষাগুলির ফল থেকে একটামাত্র সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব, সেটা হচ্ছে, এখানে প্রাণের বিকাশ হয়েছে। কিন্তু মুশকিল কী, জান?

কী?

অনেক চেষ্টা করেও কোনো প্রাণী বা তাদের আবাসস্থল কোনো কিছুর দেখা পেলাম না। এক হতে পারে খুব নিচুস্তরের প্রাণী, আকারেও খুব ছোট, মাইক্রোস্কোপ ছাড়া দেখা সম্ভব না, সেটা যদি সত্যি হয় তাহলে একটা স্কাউটশিপ পাঠিয়ে ট্রাইটনের উপর থেকে কিছু মাটি তুলে আনতে হবে। কিন্তু সেটা করার প্রয়োজন আছে কি নেই সে সিদ্ধান্ত তোমাকে নিতে হবে।

লু সুশানের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কিছু বলার আছে?

না। পল কুম ঠিকই বলেছে যে, আমরা প্রাণীগুলিকে দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে প্রাণীগুলি সবসময়েই আমাদের লক্ষ করছে।

লু জোর করে একটু হাসির ভান করে বলল, আপাতত যেটার কোনো প্রমাণ নেই, সেটা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কাজ নেই। তোমরা যদি জোর দিয়ে বলতে পার এখানে কোনো উন্নত প্রাণী নেই, আমরা তাহলে ঘন্টা দুয়েকের মাঝে ফিরে যেতে পারি।

সুশান মাথা নেড়ে বলল, না লু, জোর দিয়ে কিছুই বলতে পারব না, সবগুলি পরীক্ষা বলেছে, এখানে কোনো-না-কোনো ধরনের প্রাণী আছে। কিন্তু সেটি কত উন্নত আমরা জানি না।

লু চিন্তিতভাবে কিম জিবানকে জিজ্ঞেস করে, তোমার কিছু বলার আছে কি?

অনেক কিছু। কোথা থেকে শুরু করব?

অনেক কিছু বলার সময় নেই, তোমাকে অল্প কথায় সারতে হবে।

কিম তার হাতের একতাড়া কাগজ দেখিয়ে বলল, এইসব অল্প কথায় সারব?

হ্যাঁ।

ঠিক আছে। কিম একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, এটা একটা অত্যন্ত অস্বাভাবিক গ্রহ। কোনোভাবেই এটাকে কোনো দলে ফেলা গেল না।

কেন ফেলা গেল না সেটা অন্তত বল।

প্রথমত গ্রহটা প্রচণ্ড পরিবর্তনশীল, ঘনত্ব খুবই খাপছাড়া ধরনের, প্রথমে ভেবেছিলাম ভিতরটা বুঝি ফাঁপা, যেখানে কিলবিলে মাকড়সার মতো প্রাণী থাকে। পরে দেখা গেল তা ঠিক নয়, কিন্তু ঘনত্বটার পরিবর্তন হচ্ছে। এরকম গ্রহ টিকে থাকা সম্ভব নয়, বিধ্বস্ত হয়ে যাবার কথা; কিন্তু এটা শুধু যে টিকে আছে তাই নয়, বেশ ভালোরকম টিকে আছে। তা ছাড়া উপরে যে গোল গোল গর্তগুলি আছে, সেগুলি ক্রমাগত স্থান পরিবর্তন করছে। দেখে মনে হয়—কিম জিবান হঠাৎ থেমে গেল।

কি?

না, কিছু না।

শুনি।

দেখে মনে হয়, ওগুলি বড় বড় চোখ, আর ড্যাবড্যাব করে সেই চোখ দিয়ে। আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

কিম জিবান ভেবেছিল তার কথা শুনে সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠবে, কিন্তু কেউ হাসল না, রু-টেক পর্যন্ত কেমন একটা গম্ভীর মুখে বসে রইল। লু শুধু জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল, ভালোই বলেছ। পুরো গ্রহটা হচ্ছে কারো মাথা, আর গর্তগুলি হচ্ছে তার চোখ! যাই হোক, এবারে নীষা বল তুমি কি দেখলে। গ্ৰহটাতে কি কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী আছে?

নীষা এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বলল, বলা যায়, নেই।

লু নীষার দিকে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি মনে হয় পুরোপুরি নিশ্চিত নও।

না, আমি পুরোপুরি নিশ্চিত। আজ সারাদিন আমি কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর চিহ্ন পাই নি, তবে

তবে কি?

একবার–মাত্র একবার একটা সিগন্যাল ফিরে এসেছে।

লু মাথা নেড়ে বলল, বুঝিয়ে বল, একটু বুঝিয়ে বল।

বুঝিয়ে বলার কিছু নেই, আমি প্রায় নিঃসন্দেহ যে, ব্যাপারটা একটা যান্ত্রিক গোলযোগ। কারণ যেটা ঘটেছে সেটা ঘটা সম্ভব না।

কি হয়েছে?

তোমরা সবাই জান বুদ্ধিমান প্রাণীর সন্ধান পাওয়ার অনেকগুলি কোড় আছে, কোথাও বুদ্ধিমান প্রাণী পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে সেখানে এই কোড পাঠানো হয়। আশা করা হয় প্রাণীগুলি সেই কোডটার মর্মোদ্ধার করে তার উত্তর পাঠাবে। প্রাণীগুলি কত বুদ্ধিমান তার উপর নির্ভর করে তারা কত তাড়াতাড়ি সেটার মর্মোদ্ধার করতে পারবে। আমি আজ সারাদিন চেষ্টা করে গেছি, যতগুলি কোড আমার কাছে ছিল একটা একটা করে পাঠিয়ে গেছি, কিন্তু কোনো উত্তর পাই নি। কিন্তু ঘন্টা দুয়েক আগে একটা কোড পুরোপুরি প্রতিফলিত হয়ে ফিরে এসেছে।

মানে?

একটা খুব জটিল সিগন্যাল আছে, প্রাইম সংখ্যা দিয়ে তৈরী। সেই সিগন্যালটা হঠাৎ প্রতিফলিত হয়ে ফিরে এসেছে।

রু–টেক জিজ্ঞেস করল, তুমি বলছ সিগন্যালটা প্রতিফলিত হয়ে ফিরে এসেছে। কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে, কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী সেটার মর্মোদ্ধার করে ফেরত পাঠিয়েছে।

নীষা একটু ইতস্তত করে বলল, তা হলে আমাদের এই মুহূর্তে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া উচিত।

কেন?

কারণ এই কোডটার মর্মোদ্ধার করা অসম্ভব, এর জন্যে প্রায় সবগুলি প্রাইম সংখ্যা জানতে হয়। সবগুলি প্রাইম সংখ্যা কারো পক্ষে জানা সম্ভব না, মানুষ এখনো জানে না। কাজেই আমার ধারণা, কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী এটা ফেরত পাঠায় নি, এটা নিজে থেকে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে এসেছে। সিগন্যাল ড্রাইভারের ই. এম. টি. চীপের বায়াস যদি বারো মাইক্রোভোল্টের কম হয়, এ ধরনের ব্যাপার হতে পারে।

একটা তর্ক শুরু হতে যাচ্ছিল, লু হাত তুলে থামিয়ে দেয়। রু-টেকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমাদের নিরাপত্তার সবকিছু ঠিক আছে?

হ্যাঁ। ট্রাইটন থেকে কোনো কিছু যদি আমাদের দিকে উঠে আসে সাথে সাথে সেটা শেষ করে দেয়া সম্ভব। সেকেন্ডে একটা করেও যদি পাঠানো হয়, এক ঘন্টা পর্যন্ত আটকে রাখতে পারব। মহাকাশকেন্দ্রে খবর দেয়া আছে, সেই এক ঘন্টার ভিতরে পুরো দল চলে আসবে। আমি রিজার্ভ ট্যাংকে জ্বালানি সরিয়ে রেখেছি, দরকার হলে তুমি হাইপারডাইভ দিতে পারবে। সবকিছু বিবেচনা করে দেখলে আমার ধারণা, ভৌতিক কিছু না ঘটলে আমরা পুরোপুরি নিরাপদ। সিডিসিরও তাই ধারণা।

চমৎকার! লু তার কফিতে চুমুক দিয়ে চুপ করে যায়।

সুশান খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, লু।

কি?

আমাদের দায়িত্ব কি শেষ? আমরা কি এখন ফিরে যাব?

আমার খুব ইচ্ছে করছে ফিরে যেতে, কিন্তু একটা-কিছু সিদ্ধান্তে না পৌঁছে ফিরে যাই কেমন করে? বিজ্ঞান আকাদেমিকে গিয়ে কী বলব?

কী করবে তাহলে?

একটা স্কাউটশিপ পাঠাতে হবে।

সুশান একটা নিঃশ্বাস ফেলে চুপ করে যায়। সে মনে মনে এই ভয়টাই করছিল, হয়তো লু আরো একদিন থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা করবে।

লু রু-টেকের দিকে তাকিয়ে বলল, রু, তুমি একটা স্কাউটশিপ পাঠানোর ব্যবস্থা কর, ঘন্টাখানেকের মাঝে যেন রওনা দিয়ে দেয়, খুব ধীরে ধীরে নামাবে, গ্রহে কোনো প্রাণী থাকলে তারা যেন দেখে ভয় না পায়। নীষা, তুমি কয়েকটা ভিন্ন ভিন্ন ধরনের কোড দিয়ে দাও সবগুলি যেন বলতে থাকে, আমরা বন্ধুত্ব চাই, শান্তি চাই বা এই ধরনের কোনো একটা গালভরা কথা। স্কাউটশিপটা ট্রাইটনে নেমে যেন ভিন্ন ভিন্ন স্তর থেকে খানিকটা করে মাটি তুলে আনে। ফিরে এসে স্কাউটশিপটাকে সিসিয়ানে সোজাসুজি চলে আসতে দিও না, শ’খানেক কিলোমিটার দূরে অপেক্ষা করাবে। সুশান আর পল কুম, তোমরা ঠিক কর স্কাউটশিপের ভিতরে আর কি দেয়া যায়, ট্রাইটনে নেমে ঠিক কী ধরনের পরীক্ষা করা দরকার।

সুশান ভয়ে ভয়ে বলল, কেউ কি যাবে এই স্কাউটশিপে করে?

লু হেসে বলল, আরে না! মাথা খারাপ তোমার? মানুষ হচ্ছে অমূল্য সম্পদ, তাদের নিয়ে কখনো ঝুঁকি নেয়া যায় না।

টেবিল থেকে উঠে গিয়ে স্বচ্ছ জানালার পাশে দাঁড়াল। গ্রহটার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে বলল, কিম, তুমি ঠিকই বলেছ, গ্রহটাকে দেখলে মনে হয় এটা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, কী বীভৎস ব্যাপার!

সবাই ঘুরে লু’য়ের দিকে তাকায়, কেউ কিছু বলে না। লু একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, আমি তোমাদের ভয় দেখাতে চাচ্ছি না, মনে হল তাই বললাম। একটু থেমে যোগ করল, আমি আমার ঘরে সিডিসির সাথে দাবাটা শেষ করে ফেলি, কিছু দরকার হলে আমায় ডেকো।

বুঝলে সিডিসি, দাবা হয়তো তুমি মন্দ খেল না, কখনো তোমাকে আমি হারাতে পারি নি, লু হাতিটা এক ঘর পিছিয়ে এনে বলল, কিন্তু তোমার সাথে দাবা খেলে আরাম নেই। তুমি বড় চিন্তা করে খৈল, কখনো ভুল কর না।

উত্তরে বিপবিপ শব্দ করে সিডিসি কিছু একটা বলল, লু সেটা বুঝতে পারল না, বোঝার খুব-একটা ইচ্ছে আছে সে-রকম মনেও হল না। মন্ত্রীটা এগিয়ে দেবে কি না চিন্তা করতে করতে বলল, তোমার সাথে কথা বলে মজা আছে, আমার কিছু শুনতে হয় না, শুধু বলে গেলেই হয়।

আবার বিপবিপ করে একটা শব্দ হল।

দাবা খেলা কে আবিষ্কার করেছিল জান?

বিপবিপ।

নিশ্চয়ই জান, কম্পিউটার জানে না এরকম জিনিস কি কিছু আছে? এক দেশে থাকত এক রাজা আর এক মন্ত্রী। সেই মন্ত্রী ভদ্রলোক দাবা খেলা আবিষ্কার করে রাজাকে সেটা উপহার দিলেন। রাজা এক দান দাবা খেলে ভারি খুশি, মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী পুরস্কার চাও? মন্ত্রী বললেন, কিছু চাই না মহারাজা লু একটু থেমে জিজ্ঞেস করল, জান নাকি গল্পটা?

উওরে সিডিসি একটা ধাতব শব্দ করে, যার অর্থ বোঝা মুশকিল। লু সেটা অগ্রাহ্য করে বলল, বলি তবু গল্পটা, ভালো গল্প দু বার শুনলে ক্ষতি নেই কিছু মন্ত্রী *ললেন, কিছু আমি চাই না মহারাজা, রাজা তবু কিছু একটা উপহার দেবেনই, রাজাদের খেয়াল, বুঝতেই পারছ। মন্ত্রী আর কী করবেন, বললেন, ঠিক আছে, কিছু একটা যদি দিতেই চান, তা হলে এই দাবার ছকটা ভরে কিছু শস্যদানা দিন। প্রথমটায় একটা, দ্বিতীয়টাতে দুইটা, তৃতীয়টাতে চারটা, চতুর্থটাতে আটটা এভাবে।

সিডিসি ক্রমাগত বিবিপ করে শব্দ করতে থাকে। লু থেমে একনজর তাকিয়ে বলল, এই জন্যে কম্পিউটারদের গল্প বলে মজা নেই, সবকিছু আগেই বুঝে ফেলে! একজন মানুষকে যদি বলতাম, সে যখন জানত দাবার ছক এভাবে শস্যদানা দিয়ে ভরতে সারা পৃথিবীর কয়েক শ’ বছরের শস্য লেগে যাবে, সে কী অবাক হত! তা হলে গল্পটাও আরো অনেক গুছিয়ে বলা যেত, রাজা কীভাবে তখন তখনি একজনকে বললেন এক বস্তা শস্য নিয়ে আসতে, কীভাবে সেই শস্যদানা গুনে গুনে রাখা হল—লু কথা থামিয়ে হঠাৎ দাবার ছকের দিকে তাকায়, সিডিসি তাকে একটা কঠিন পাচে ফেলার চেষ্টা করছে। মন্ত্রীটাকে দুঘর পিছিয়ে এনে সে গভীর চিন্তায় ডুবে যায়।

প্রায় আধ ঘন্টা পর সিডিসি হঠাৎ শব্দ করতে থাকে, দাবা খেলায় কোনো একটা চাল যদি তার পছন্দ হয়, তা হলে সেটার উপর বক্তৃতা দেয়ার তার একটা বাতিক আছে, লু অবশ্যি কখনো তাকে সে সুযোগ দেয় না, এবারেও দিল না। সিডিসি খানিকক্ষণ চেষ্টা করে তার ঘোড়াটাকে দুঘর পিছিয়ে আনে।

লু চোখ কপালে তুলে বলল, তুমি ঘোড়াটাকে ওখানে দিচ্ছ মানে? মাথা খারাপ হয়েছে তোমার? কম্পিউটার হয়ে জন্ম হয়েছে বলে মনে কর ইচ্ছে চাল দিয়ে বেঁচে যাবে তুমি?

বিপ বিপ বিপ।

ধেত্তেরি তোমার বিপ বিপ বিপু, ঘোড়াটা খেয়ে খেলা শেষ করতে গিয়ে থেমে গেল লু। সিডিসি তে ভুল করার পাত্র নয়, তা হলে কি ভুল চাল চেলে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে? হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপে সিডিসিকে কথা বলার সুযোগ করে দিল লু।

ধন্যবাদ মহামান্য লু, আমাকে কথা বলার সুযোগ করে দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ। আমি ভুল চালটি কি জন্যে দিয়েছি বুঝতে আপনার চার সেকেন্ডের বেশি সময় লেগেছে। একটি জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হতে যাচ্ছে, আপনার কিছু করার নেই, কিন্তু তবু আপনি হয়তো জানতে চাইবেন।

কি হয়েছে?

সিসিয়ান থেকে যে-স্কাউটশিপটি ট্রাইটনে পাঠানো হয়েছে, সেটার গতিবেগ দ্রুত কমে যাচ্ছে। বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব গত নয় মিনিটে আটাত্তর দশমিক চার ভাগ বেড়ে গিয়েছে। কারণ এখনো জানা নেই। বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব এরকম থাকলে স্কাউটশিপটি বিধ্বস্ত হয়ে যাবার কথা, আমি স্কাউটশিপের গতিপথ পরিবর্তন করে দিচ্ছি যেন স্কাউটশিপটি ধ্বংস না হয়। এ প্রসঙ্গে আপনাকে স্মরণ করানো যায় যে, তেইশ শত বাইশ সালে বৃহস্পতি গ্রহের কাছে

লু সুইচ টিপে সিডিসির কথা বন্ধ করে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, তার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয় যে সিডিসির মতো কম্পিউটার সন্দেহ করছে যে স্কাউটশিপটা বিধ্বস্ত হতে পারে। গত শতাব্দীতে হলে একটা কথা ছিল, কিন্তু এই শতাব্দীতে? লু দরজা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে কন্ট্রোল রুমের দিকে হাঁটতে থাকে। একটা-কিছু গণ্ডগোল আছে কোথাও।

লুকে দেখে কিম জিবাল এগিয়ে আসে, লু, তুমি জান কী হয়েছে?

লু মাথা নাড়ে, হ্যাঁ, সিডিসি বলেছে আমাকে।

কি বলেছে?

ট্রাইটনে বাতাসের ঘনত্ব বেড়ে গিয়েছে বলে স্কাউটশিপটা বিধ্বস্ত হতে পারে।

বিধ্বস্ত হতে পারে নয়, হয়ে গেছে।

লু চমকে উঠে কিম জিবানের দিকে তাকায়, তার নিজের কানকে বিশ্বাস হয় না, কী বললে তুমি!

বলেছি, স্কাউটশিপটা বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।

সিডিসি কি করল, বাঁচাতে পারল না? একটা বাড়তি গ্রাস্ট দিয়ে প্রজেকশান অ্যাঙ্গেল সাত ডিগ্রী বাড়িয়ে দিত—

চেষ্টা করেছিল, পারে নি। কিম জিবান নিঃশ্বাস আটকে রেখে বলল, লু চল আমরা পালাই, হাইপারডাইভ দিয়ে দিই।

সত্যি দিতে চাও?

হ্যাঁ।

তারপর বিজ্ঞান আকাদেমিকে কী বলবে? তোমার কাছে কি প্রমাণ আছে, যে, এখানে আমাদের বিপদের আশঙ্কা আছে?

দেখছ না স্কাউটশিপটা কী ভাবে শেষ করে দিল। আমাদের শেষ করতে কতক্ষণ লাগবে?

স্কাউটশিপ কোনো প্রাণী ধ্বংস করে নি কিম, বাতাসের ঘনত্ব হঠাৎ বেড়ে যাওয়াতে গতিবেগ কমে গিয়ে বিধ্বস্ত হয়েছে। কোনো প্রাণী একটা গ্রহের বায়ুমণ্ডলের পরিবর্তন করতে পারে না।

লু আর কিম জিবানকে ঘিরে দাঁড়িয়ে অন্যেরা ওদের কথা শুনছিল, রু-টেক একটু এগিয়ে এসে বলল, আমি একটা কথা বলি লু?

বল।

বাতাসের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ায় গতিবেগ কমে গেলে সেটার দায়িত্ব নেয়া খুবই সহজ ব্যাপার, স্কাউটশিপের ছোট একটা কম্পিউটারই সেটার দায়িত্ব নিতে পারত, কিন্তু স্কাউটশিপের দায়িত্বে ছিল সিডিসির মতো একটা কম্পিউটার, এর পরও যখন স্কাউটশিপ ধ্বংস হয়েছে, তার মানে ব্যাপারটি এত সহজ নয়।

লু মাথা নেড়ে বলল, আমি তোমার সাথে পুরোপুরি একমত রু–টেক, ব্যাপারটি সহজ নয়, কিন্তু তার মানে এই না যে ব্যাপারটি একটা বুদ্ধিমান প্রাণীর কাজ। একটা প্রাণী কী ভাবে কয়েক হাজার মাইল এলাকায় বাতাসের ঘনত্ব পাল্টাতে পারে?

পল কুম বলল, তুমি ধরে নিচ্ছ বুদ্ধিমান প্রাণী হলেই সেটার ক্ষমতা তোমার দেখা অন্য বুদ্ধিমান প্রাণীর সমান হবে, তার বেশি হতে পারে না?

লু একটু হেসে বলল, কি হতে পারে আর কি হতে পারে না সেটা কেউ জানে না। তাই আমাদের যখন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যেটুকু জানি সেটার উপরেই নিতে হয়, আমাকে ধরে নিতে হবে বুদ্ধিমান প্রাণী যদি থাকে সেটা আর অন্য দশটা বুদ্ধিমান প্রাণীর মতো হবে।

পল কুম আপত্তি করে কী-একটা বলতে যাচ্ছিল, লু তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, পল, তুমি যেটা বলতে যাচ্ছ, সেটা কি তর্কের খাতিরে বলছ, না সত্যি বিশ্বাস কর?

পল একটু থতমত খেয়ে থেমে যায়, এক মুহূর্ত কী—একটা ভেবে হাসতে হাসতে বলল, তুমি ঠিকই ধরেছ, তর্ক করার জন্যে বলছিলাম।

তাহলে এখন বলো না, এমনিতেই আমার একটা-কিছু সিদ্ধান্ত নিতে বারটা বেজে যাচ্ছে।

সুশান ভয়ে ভয়ে বলল, তাহলে কী ঠিক করা হল, এটা কি একটা দুর্ঘটনা, নাকি উন্নত কোনো প্রাণীর কাজ?

লু গম্ভীর গলায় বলল, আপাততঃ ধরে নেয়া হচ্ছে এটা একটা দুর্ঘটনা। আমি এখন সিডিসিকে নিয়ে বসব, স্কাউটশিপ থেকে পাঠানো সব ছবি, খবরাখবর বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে এর পিছনে কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর হাত আছে কি না।

সবকিছু বিশ্লেষণ করতে অনেকক্ষণ লেগে গেল। স্কাউটশিপটি ধ্বংস হয়েছে বায়ুমণ্ডলের ঘনত্বের তারতম্যের জন্যে, সিডিসি কেন সেটাকে বাঁচাতে পারে নি, তার কারণ খুব সহজ। স্কাউটশিপে কোনো একটা নির্দেশ পাঠালে সেটাকে কার্যকর করতে যতক্ষণ সময় লাগে, বাতাসের ঘনত্ব তার আগেই পাল্টে যায়। লু অনেক চেষ্টা করল স্কাউটশিপ থেকে পাঠানো ছবিগুলিতে কোথাও কোন ধরনের মহাকাশযান বা কোন ধরনের প্রাণী দেখা যায় কি না দেখতে, কিন্তু কিছু দেখা গেল না।

লু যখন সিডিসির সাথে বসে খবরাখবরগুলি বিশ্লেষণ করছিল, অন্যেরা তখন কন্ট্রোল-রুমে বসে। সুশান বসেছে জানালার পাশে, একটু পরপর হটাকে দেখছে, ভিতরে কেমন একটা আতঙ্ক, শুধু মনে হচ্ছে গ্রহটা থেকে হঠাৎ করে কোনো একটা প্রাণী ছুটে আসবে তাদের দিকে। নীষা তার ব্যক্তিগত কম্পিউটারে টুকটুক করে কিছু সংখ্যা প্রবেশ করাচ্ছিল, নুতন একটা ভাষা তৈরি করছে সে, তার কোনো কাজ না থাকলেই সে একটা নুতন ভাষা তৈরি করা শুরু করে। এটা তার চৌদ্দ নম্বর ভাষা। কিম জিবান পুরনো একটা হাসির বই বের করে পড়ে শোনানোর চেষ্টা করছে, কারো শোনার ইচ্ছা আছে বলে মনে হয় না, হাসির জায়গাগুলিতে ভদ্রতা করেও কেউ হাসছে না, কিন্তু কিম জিবানের সেটা নিয়েও কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হল না। হঠাৎ সিডিসি একটা জরুরি সংকেত দিল। সিডিসি কথা বলার চেষ্টা করলে কেউ তাকে বিশেষ পাত্তা দেয় না, কিন্তু জরুরি সংকেত হচ্ছে অনা ব্যাপার, সবাই তখন একসাথে ছুটে আসে। কি হয়েছে সবার আগে বুঝতে পারে রু-টেক, রবোট বলে সে মাইক্রোসেকেন্ডে সিডিসির সাথে খবর বিনিময় করতে পারে। পল কুম রু-টেককে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে রু-টেক?

রু-টেক এক মূহুর্ত ইতস্তত করে বলল, সিডিসি বলছে যে স্কাউটশিপটা ট্রাইটনে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, সেটা–

সেটা কী?

সেটা নাকি আবার উঠে আসছে।

কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলতে পারে না। সবচেয়ে আগে কথা বলল সুশান, কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, ভিতরে কেউ আছে? কোনো প্রাণী?

না। ভিতরে নূতন কিছু নেই, আমরা যা পাঠিয়েছিলাম তাই আছে। রু-টেক একটু  থেমে যোগ করল, সিডিসি তাই বলছে।

ঘটনার চমকটা কাটতেই সিসিয়ানে প্রথমবার একটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়ে যায়। সবাই মিলে স্কাউটশিপের নানারকম খবরাখবর নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিম জিবান বড় মনিটরটিতে স্কাউটশিপের ছবিটাকে ফুটিয়ে তোলে, ঠিক যেভাবে পাঠানো হয়েছিল সেভাবেই ফিরে আসছে, দু’পাশের অত্যন্ত ভঙ্গুর দু’টি এন্টেনা পর্যন্ত আগের মতো আছে। লু ঠোঁট কামড়ে বলল, ট্রাজেক্টরিটা বের কর।

কিম জিবান কয়েকটা বোতাম টিপে মনিটরে কী-একটা পড়ে বলল, চার দশমিক দুই, এপিসেন্টার তিন ডিগ্রী।

আমরা যে-পথে পাঠিয়েছিলাম সেই পথে ফিরে আসছে?

হ্যাঁ।

লু এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, স্কাউটশিপটা আসলে ধ্বংস হয় নি, আমাদের ধোঁকা দেয়া হয়েছিল।

কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলে না। পল কুম চিন্তিত মুখে বলল, সিডিসি, তোমার কী ধারণা?

সিডিসি জানাল, স্কাউটশিপ থেকে যেসব তথ্য এসেছে সেটা থেকে প্রায় নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায় স্কাউটশিপটি ধ্বংস হয়েছিল, কিন্তু যেহেতু সেটি আবার উঠে আসছে, তার মানে আসলে সেটি ধ্বংস হয় নি, স্কাউটশিপে পাঠানো খবরাখবরে কোনো একটা জটিল ত্রুটি ছিল, সেটি কী, সিডিসি এখন বের করার চেষ্টা করছে।

লু গম্ভীর গলায় বলল, পল আর সুশান, তোমরা দু’জন স্কাউটশিপটিকে যা করতে পাঠিয়েছিলে সেটা করা হয়েছে কি না দেখ। আর জিবান, তুমি হাইপারডাইভের সার্কিটটা চালু করে রাখ।

সুশান আর পল কুম নিজেদের ল্যাবরেটরিতে বসে স্কাউটশিপে পাঠানো বিভিন্ন জৈবিক পদার্থগুলি পরীক্ষা করতে থাকে। স্কাউটশিপের কম্পিউটারে কোনো সমস্যা নেই, নির্দেশ পাঠানোমাত্রই সেটি সিডিসির সাহায্য নিয়ে তার কাজ শুরু করে দেয়। একটি একটি করে সবগুলি জিনিস পরীক্ষা করে দেখা হয়, কোনোটাতে কোনো অস্বাভাবিক কিছু নেই। যখন মাত্র দু’টি জিনিস পরীক্ষা করা বাকি তখন হঠাৎ পল কুমের ভুরু কুঁচকে ওঠে। সুশান এগিয়ে এসে বলল, কি হয়েছে পল?

এই দেখ।

সুশন নিরীহ গোছের একটা গ্রাফের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল, এটা তো আমরা পাঠাই নি।

না।

কোথা থেকে এল?

আসার কথা নয়। প্রচণ্ড রেডিয়েশনে মিউটেশান হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু আর কোথাও তো মিউটিশানের চিহ্ন নেই।

তা হলে?

এক হতে পারে কোনো ধরনের আঘাতে ক্রোমোস্কোপের ক্যালিব্রেশান যদি নষ্ট হয়ে থাকে।

লু’য়ের সাথে কথা বলবে?

ডাক।

লুয়ের সাথে সাথে পুরো দলটি হাজির হয়। লু একটু শঙ্কিত স্বরে বলল, কিছু হয়েছে পল?

বলা মুশকিল, সবগুলি পরীক্ষার ফল বলছে গ্রহটিতে উন্নত কোনো প্রাণের অস্তিত্ব নেই। শুধু একটি পরীক্ষা বলছে অন্যরকম।

সেইটি কী বলছে?

পল অস্বস্তির সাথে মাথা চুলকে বলল, ঠিক করে বলা মুশকিল। অন্যান্য জিনিসের সাথে আমরা খানিকটা জটিল জৈবিক পদার্থ পাঠিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিল যদি কোনো উন্নত প্রাণীর কাছাকাছি আসে, সেটাতে একটা কম্পন ধরা পড়বে, মেগাসাইকেল রেঞ্জের কম্পন।

দেখা গেছে?

না, কিন্তু অন্য একটা ব্যাপার হয়েছে। কি?

জৈবিক পদার্থটি পাল্টে গেছে, আমরা যেটা পাঠিয়েছিলাম সেটা আর নেই, অন্য একটা কিছু আছে।

লু ভুরু কুঁচকে বলল, অন্য কিছু?

হ্যাঁ।

অন্য কিছু কোথা থেকে আসবে?

আসার কথা নয়, সেটাই হচ্ছে ধাঁধা। এক হতে পারে শক্ত কোনো আঘাতে ক্যালিব্রেশানটি নষ্ট হয়ে গেছে, খুব অস্বাভাবিক ব্যাপার, কিন্তু পুরোপুরি অসম্ভব নয়। ট্রিনিটিতে একবার হয়েছিল বলে শুনেছিলাম।

অন্য কোনোভাবে হতে পারে?

না। সুশান, তুমি কী বল?

সুশান চিন্তিতভাবে মাথা নাড়ে, এক হতে পারে যে কেউ এসে এটা পাল্টে দিয়ে গেছে। কিন্তু কে এসে স্কাউটশিপে ঢুকে এরকম একটা কাজ করবে যে আর কোথাও তার কোনো চিহ্ন থাকবে না?

লু চিন্তিতভাবে নিজের ঠোঁট কামড়াতে থাকে। গ্রহটির সবকিছু কেমন ধোঁয়াটে। ছোট ছোট অনেকগুলি ঘটনা ঘটল, যার প্রত্যেকটা রহস্যময়, মনে হয় অসাধারণ কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর কাজ, কিন্তু সবগুলিতেই কেমন জানি সন্দেহ রয়ে গেছে, সবগুলিকে মনে হয় ছোট ছোট দুর্ঘটনা।

লু সুশান আর পল কুমের দিকে তাকিয়ে বলল, দেখ, তোমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পার কিনা। যদি প্রমাণ করতে পার এখানে কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী নেই, তা হলে আমরা চলে যেতে পারি, আবার যদি প্রমাণ করতে পার এখানে অসাধারণ বুদ্ধিমান কোনো প্রাণী আছে, তা হলেও আমরা চলে যেতে পারি।

স্কাউটশিপটা ফেরত এসে সিসিয়ান থেকে প্রায় ষাট কিলোমিটার দুরে এসে দাঁড়ায়, সে-রকমই কথা ছিল। ট্রাইটন থেকে যেসব জিনিসপত্র তুলে এনেছে সেগুলি আরো সুচারুভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে, সিলিকনের নানা ধরনের অনু, বিচিত্র ধরনের পলিমার, কিন্তু অস্বাভাবিক কিছু নেই। পল কুম নানাভাৰে তার সবকিছু পরীক্ষা করে দেখল, কিন্তু সেই অস্বাভাবিক জৈবক পদার্থটির কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পেল না।

ঘন্টা দুয়েক পর পল কুম একটা আশ্চর্য প্রস্তাব করে, সে স্কাউটশিপে গিয়ে জৈবিক পদার্থটি পরীক্ষা করে দেখে আসতে চায়।

লু এক কথায় তার প্রস্তাবটি নাকচ করে দেয়, নিরাপত্তার খাতিরে সে কাউকে সিসিয়ানের বাইরে যেতে দেবে না। পল বেশি অবাক হল না,লু তাকে যেতে দেবে, সে নিজেও তা বিশ্বাস করে নি।

সিসিয়ানে আরো ঘন্টা দুয়েক সময় কেটে গেল, কোনো কিছুই ঠিক করে জানা নেই, সবার ভিতরে একটা অনিশ্চয়তা, একটা অস্থিরতা। সবার নিরাপত্তার ব্যবস্থা ঠিক রেখে কী ভাবে গ্রহটা নিয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যায়, লু বা অন্য কেউ ভেবে পাচ্ছিল না।

পল আরো কয়েকবার লুয়ের কাছে স্কাউটশিপে যাবার অনুমতি চাইল, কিন্তু কোনো লাভ হল না। পলের যুক্তি কিন্তু খুব সহজ, সিসিয়ানে থেকে তারা সন্দেহাতীতভাবে ট্রাইটনে কোনো উন্নত প্রাণীর চিহ্ন পায় নি। একটি মাত্র প্রমাণ থাকতে পারে স্কাউটশিপে, যদি সেটি সত্যি দেখা যায় তা হলে বুঝতে হবে এখানে সত্যি অসাধারণ বুদ্ধিমান প্রাণী আছে, তা হলে সবাই ফিরে যেতে পারে। আবার যদি দেখা যায় জিনিসটি একটা যান্ত্রিক গোলযোগ, তাহলেও তারা ফিরে যেতে পারে, কারণ গ্রহটিতে বুদ্ধিমান বা বোকা কোনো প্রাণই নেই। জিনিসটি সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হবার একটিমাত্র উপায়, সিসিয়ান থেকে কোনাস নামে একটি জটিল যন্ত্র নিয়ে স্কাউটশিপে যাওয়া। স্কাউটশিপে কোনাস দেয়া হয় নি, কারণ এটার প্রয়োজন হতে পারে, কারো জানা ছিল না।

লু রাজি না হলে স্কাউটশিপে যাওয়া সম্ভব না, তবু পল কুম সিডিসিকে এরকম। একটা যাত্রায় বিপদের ঝুঁকির একটা পরিমাপ করতে আদেশ দিল। সিডিসির হিসেব দেখে লু শেষ পর্যন্ত একটু নরম হয়, কারণ সিডিসির মতে স্কাউটশিপের ভিতর আর সিসিয়ানের ভিতরে বিপদের ঝুঁকি প্রায় এক সমান। স্কাউটশিপে যাওয়া ব্যাপারটিতে খানিকটা অনিশ্চয়তা আছে, কিন্তু তার পরিমাণ এখানে এক দিন বেশি থাকার অনিশ্চয়তা থেকে কম। কাজেই পল কুম স্কাউটশিপে গিয়ে যদি সবাইকে নিয়ে এক দিন আগে ফিরে যেতে পারে, সেটা সবার জন্যে ভালো। তবে সিডিসি জানিয়ে দিল, পল যে পোশাক পরে যাবে সেটা সে সিসিয়ানে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। সেটি এমন কিছু জটিল ব্যাপার নয়, রুটিনমতো অনেকবার করা হয়েছে।

লু শেষ পর্যন্ত রাজি হল, কিন্তু পলকে সে একা যেতে অনুমতি দিল না, রু-টেককে সাথে নিয়ে যেতে হবে। কাজটি একজনের কাজ, কিন্তু রু-টেক থাকবে নিরাপত্তার জন্যে। রু-টেক রবোট বলে তার কর্মক্ষমতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষ থেকে অনেক গুণ বেশি।

পল কুম বিশেষ পোশাক পরে সাথে সাথে প্রস্তুত হয়ে নেয়, রু-টেকের বিশেষ পোশাকের প্রয়োজন নেই, কয়েকটা সুইচ টিপে সে নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়। পল কুমের পিঠে ক্রুকোলাস নামের সেই বিশেষ যন্ত্রটি, রু-টেকের পিঠে একটা অ্যাটমিক ব্লাস্টার; প্রয়োজনে সেটা দিয়ে একটা ছোটখাটো উপগ্রহ উড়িয়ে দেয়া যায়। দু’জন হাতে দুটি ছোট জেট নিয়ে বিশেষ ডকে এসে হাজির হয়। উপর থেকে ঢাকা দিয়ে ঢেকে তাদের আলাদা করে ফেলার আগে কিম জিবান পল কম আর রু-টেকের হাত ধরে একবার ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, সাবধানে থেকো।

পল কুম হেসে বলল, সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ করো না।

কয়েক মিনিটের ভিতরে ডকের সব বাতাস সরিয়ে নিয়ে তাদেরকে একটা গোল গর্ত দিয়ে সিসিয়ানের বাইরে বের করে দেয়া হয়। দু জন তাদের জেটগুলি চালু করে দিতেই মাথায় লাল আলো জ্বলতে এবং নিভতে শুরু করে। সিসিয়ানের সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেখে পল কুম আর রু-টেক দ্রুত তাদের থেকে সরে যাচ্ছে।

তখনো কেউ জানত না তাদের পরবর্তী দুঃস্বপ্নের সেটা ছিল শুরু।

 

০৩. দুঃস্বপ্নের শুরু

রু,

কি?

ভয় লাগছে তোমার?

লাগছিল, তাই ভয়ের সুইচটা একটু আগে বন্ধ করে দিয়েছি।

পল কুম জেটটা দিয়ে সাবধানে ডানদিকে ঘুরিয়ে বলল, কী মজা তোমাদের, যখন খুশি যেটা ইচ্ছা বন্ধ করে দিতে পার।

তোমার ভাই ধারণা? চাও আমার মতো হতে?

অন্য কোনো সময় চাই নি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ব্যাপারটা খারাপ না।

কেন জানি রু-টেকের একটু মন-খারাপ হয়ে গেল, সাবধানে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে সে। মানুষের এত কাছাকাছি হয়েও সে কখনো মানুষ হতে পারবে না।

ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিকে, ওদের মাথার উপর থেকে যে-আলো বের হচ্ছে, সেটা অন্ধকারকে দূর করতে পারে না, অন্ধকার দূর করতে হলে আলোকে ছড়িয়ে পড়তে হয়, এখানে বায়ুমণ্ডল নেই বলে আলো ছড়ানোর কোনো উপায় নেই। ওদের পিঠে জেট গুলি লাগানো, হাতে কন্ট্রোল, গতিবেগ বাড়িয়ে শ’খানেক কিলোমিটার করে নিয়েছে, স্কাউটশিপের কাছে গিয়ে কমিয়ে নেবে। রু-টেক এসব কাজ খুব ভালো পারে, লু তাই ওকে পলের সাথে পাঠিয়েছে। নিচে গ্রহটিকে দেখা যাচ্ছে, ঈষৎ লালাভ একটা গ্রহ, গোল গোল গর্তের মতো জিনিসগুলি নাকি আস্তে আস্তে নড়ছে, খালিচোখে ধরা পড়ে না, কিন্তু ব্যাপারটি চিন্তা করেই কেমন একটা অস্বস্তি হয়। পল কুমের মনে হল, কিম জিবান ঠিকই বলেছিল যে ওগুলি চোখ, ঐ চোখ দিয়ে কেউ ওদের দেখছে।

কিছুক্ষণের মাঝেই ওরা স্কাউটশিপের কাছে পৌঁছে গেল, সিসিয়ানের সবাই ওদের সাথে যোগাযোগ রাখছে। ব্লু-টেকের ঘাড়ের উপর যে-ক্যামেরাটি আছে, সেটা দিয়ে সবাই সবকিছু দেখতে পাচ্ছে। পল কুম আর রু–টেক মাঝে মাঝে একটি দুটি কথা বলে আশ্বস্ত রাখছে সবাইকে।

স্কাউটশিপের দরজা খুলে প্রথমে ভিতরে ঢেকে রু-টেক, পিছু পিছু পল কুম। ভরশূন্য পরিবেশে দু’জনে একটা পাক খেয়ে নেয়, তারপর ঘুরেফিরে একপলক দেখে নেয় চারদিক, রু-টেক সাবধানে ডান হাতে অ্যাটমিক ব্লাস্টারটা ধরে রাখে, কে জানে, কোনো কোনায় যদি ঘাপটি মেরে বসে থাকে কোনো-এক বীভৎস প্রাণী। কোথাও কিছু নেই, ঠিক যেভাবে ওরা স্কাউটশিপটিকে পাঠিয়েছিল, সেভাবেই এটা ফিরে এসেছে। পল কুম তার ঘাড় থেকে কোনাসটা নামিয়ে বসাতে শুরু করে, ছোট একটা পরীক্ষা করতে হবে, দশ মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়। ব্লু-টেকের কিছু করার নেই, সে পলকে নিরিবিলি কাজ করতে দিয়ে অ্যাটমিক ব্লাস্টারটা হাতে নিয়ে ভেসে বেড়াতে থাকে। মিনিট দুয়েক সে স্কাউটশিপকে লক্ষ করে প্রথমে সাধারণ আলোতে, তারপর আলট্রাভায়েলেটে, তারপর কী মনে করে এক্স-রে দিয়ে। কিছু-একটা অস্বাভাবিক জিনিস আছে এখানে, রু-টেক ঠিক বুঝতে পারে না সেটা কি। দেয়ালের কাছে এগিয়ে যায় সে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে দেয়ালটিকে, এলুমিনিয়াম, ক্যাডমিয়াম আর সিলঝিনিয়ামের সঙ্কর ধাতুর তৈরি, চকচকে মসৃণ দেয়াল। আরো মিনিট খানেক লাগে ওর বুঝতে, ঠিক কী জিনিসটি অস্বাভাবিক, এই স্কাউটশিপের দেয়ালে কোনো ত্রুটি নেই। মহাকাশ গবেষণাগারে তৈরি হয় এগুলি, তৈরি করার পর গামা-রে দিয়ে দেয়ালের ত্রুটি পরীক্ষা করা হয়, শতকরা তিন ভাগ পর্যন্ত ত্রুটি সহ্য করা হয়, এর বেশি হলে পুরোটা আবার নূতন করে তৈরি করতে হয়। সাধারণ মানুষের চোখে এসব কখনো ধরা পড়ে না, কিন্তু রু-টেক তার এক্স-রে সংবেদনশীল চোখ ব্যবহার করে ইচ্ছা করলে ধরতে পারে। র-টেকের কাছে খুব অস্বাভাবিক লাগে যে এটার দেয়ালে কোনো ত্রুটি নেই। সিসিয়ানের দেয়ালে পর্যন্ত নানারকম ত্রুটি আছে, আর এটি তো সাধারণ একটা স্কাউটশিপ। কোথায় তৈরি হয়েছে এই স্কাউটশিপ?

রু-টেক গলা নামিয়ে লুয়ের সাথে যোগাযোগ করল, লু।

কি? একটা অস্বাভাবিক জিনিস দেখছি এখানে।

কি?

স্কাউটশিপের দেয়ালটাতে কোনো ত্রুটি নেই, শতকরা তিন ভাগ পর্যন্ত ত্রুটি থাকার কথা।

লু এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, তার মানে কি?

আমি জানি না, দাঁড়াও, সিডিসিকে জিজ্ঞেস করি। রু-টেক নিজস্ব ফ্রিকোয়েন্সিতে যোগাযোগ করে সিডিসির কাছ থেকে উত্তর জেনে নিল সাথে সাথেই।

লু জিজ্ঞেস করল, কী বলল সিডিসি?

রু-টেক একটু দ্বিধা করে বলতে, আশ্চর্য একটা কথা বলেছে সিডিসি। সত্যিই কি এটা সম্ভব?

লু আবার জিজ্ঞেস করে, রু-টেক, সিডিসি কী বলেছে?

সিডিসি বলেছে, এর দেয়ালে যদি কোনো ত্রুটি না থাকে, তার অর্থ হচ্ছে এটা মহাকাশ গবেষণাগারে তৈরি হয় নি, অন্য কোথাও তৈরি হয়েছে।

কোথায় তৈরি হয়েছে?

সিডিসির ধারণা, এটা ট্রাইটনে তৈরি হয়েছে।

লু চমকে উঠে বলল, কী বললে তুমি?

রু-টেক ইতস্তত করে বলল, সিডিসির ধারণা, আমরা যে স্কাউটশিপটা পাঠিয়েছিলাম, সেটা সত্যি ট্রাইটনে ধ্বংস হয়েছিল, ট্রাইটন থেকে তখন আরেকটা স্কাউটশিপ তৈরি করে পাঠানো হয়েছে।

লু কয়েক মুহূর্ত কোনো কথা বলতে পারে না, খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, সিডিসির ধারণা সত্যি কি না তুমি প্রমাণ করতে পারবে?

মনে হয় পারব। দাঁড়াও, একটা স্কু খুলে আনি, কাছে থেকে দেখলেই বোঝা যাবে এটা কী ভাবে তৈরি হয়েছে।

লুয়ের সাথে সাথে সিসিয়ানে সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকে।

পল কুমের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে। সে একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার দেখছে, সুশানের সাথে সে স্কাউটশিপে যে-জৈবিক পদার্থটি পাঠিয়েছিল, সেটি এখানে নেই, তার বদলে আছে অন্য একটি জৈবিক পদার্থ, প্রায় আগেরটার মতোই কিন্তু একটু অন্যরকম, দেখে মনে হয় কেউ তাদের পাঠানো পদার্থটি তৈরি করার চেষ্টা করেছে, ঠিক করে পারে নি, কিন্তু যেটুকু পেরেছে, সেটা অবিশ্বাস্য! মানুষ তার পুরো জ্ঞানভাণ্ডার নিয়ে হাজার বছর চেষ্টা করে এখনো একটা ক্ষুদ্র ভাইরাস পর্যন্ত তৈরি করতে পারে নি, কিন্তু কোনো-এক অসাধারণ বুদ্ধিমান প্রাণী কয়েক ঘন্টার মাঝে এধরনের একটা জৈবিক পদার্থ তৈরি করে ফেলেছে। পল কুমের নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না, আরেকবার দেখে নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্যে সে তার কোনাসের উপর বুকে পড়ছিল, ঠিক তখন সে লু’য়ের গলা শুনতে পায়, পল কুম আর রু-টেক।

কি হল?

লু প্রায় মেপে মেপে বলল, তোমরা দু’জন এই মুহূর্তে স্কাউটশিপ থেকে বেরিয়ে এস। আবার বলছি, তোমরা দু’জন এই মুহূর্তে স্কাউটশিপ থেকে বেরিয়ে এস। বাকি দায়িত্ব আমাদের।

কেন? পল কুমের গলা কেপে যায়, কী হয়েছে?

এইমাত্র ট্রাইটন থেকে আরেকটা স্কাউটশিপ বেরিয়ে এসেছে।

ভুয়ের একটা শীতল স্রোত পল কুমের মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে যায়, নিজেকে জোর করে শান্ত রাখে তবু। মূল্যবান কোনাসকে নিয়ে যাবে কি না এক মুহূর্তের জন্যে চিন্তা করে সে এটাকে ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। রু-টেক প্রায় অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে একটা ছোট স্ক্র পরীক্ষা করছিল, পল কুমকে দাঁড়াতে দেখে সে পিছু পিছু এগিয়ে যায়। দরজাটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খুলতে হয়, একজন মানুষের জন্যে বেশ শক্ত, পল সরে গিয়ে রু-টেককে খুলতে দেয়, প্রয়োজনে রু-টেক অমানুষিক জোর খাটাতে পারে।

রু-টেক দরজার হাতলটা স্পর্শ করে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ পল কুমের দিকে তাকাল। পল অবাক হয়ে বলল, কি হল, রু-টেক, দরজা খুলছ না কেন?

রু-টেক আস্তে আস্তে বলল, আমরা আটকা পড়ে গেছি, পল।

কী বলছ তুমি। পল ধাক্কা দিয়ে রু-টেককে সরিয়ে দিয়ে দরজার হাতল ধরে ঝাঁকুনি দেয়, সেটা পাথরের মতো শক্ত।

রু-টেক প্রায় ফিসফিস করে বলল, স্কাউটশিপের দরজাটা কম্পিউটার দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, এই মুহূর্তে সেটা কোনভাবে জ্যাম করে দেয়া হয়েছে। কম্বিনেশান পাল্টে যাচ্ছে আমি শুনতে পাচ্ছি স্পষ্ট, এটা আর কেউ খুলতে পারবে না।

তা হলে?

সরে দাঁড়াও, অ্যাটমিক ব্লাস্টার দিয়ে ভেঙে ফেলি।

পল কুম সরে দাঁড়াতেই রু-টেক দক্ষ হাতে অ্যাটমিক ব্লাস্টারটা তুলে নেয়, দরজার দিকে তাক করে ট্রিগার টানতে গিয়ে থেমে যায় রু–টেক, ওর হাত কাঁপতে থাকে থরথর করে।

কি হল?

কথা বলতে পারে না রু-টেক, অনেক কষ্টে বলে, পা-পারছি না।

কি পারছ না?

কপোট্রনে প্রচণ্ড চাপ পড়ছে, বার দশমিক আট মেগাহার্টজ তরঙ্গ, সব এলোমেলো করে দিচ্ছে আমার, রুটকের গলার স্বর ভেঙে আসে, পল তু-তুমি চেষ্টা কর, আ-আ-আমি আর পারলাম না। রু-টেকের গলা থেকে হঠাৎ আশ্চর্য ধাতব যান্ত্রিক শব্দ বের হতে থাকে। হাত থেকে অ্যাটমিক ব্লাস্টার প্রায় ছুটে যাচ্ছিল, পল কুম কোনোভাবে ধরে নেয়। রু-টেকের জ্ঞানহীন দেহ স্কাউটশিপে ঘুরপাক খেতে থাকে। পল কুম কাঁপা গলায় ডাকল, লু—লু—

শুনতে পাচ্ছি পল। পল কুমের শুনতে অসুবিধে হয়, হেডফোনে ঝিঝি পোকার মতো আওয়াজ।

রু-টেক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে, বার মেগাহার্টজ-এর তরঙ্গ–

বুঝতে পারছি। ওর কপোট্রনের মূল তরঙ্গ এটা, এটা দিয়ে ওকে অচল করে দেয়া যায়। আমি বলছি তোমাকে, কী করতে হবে।

লু, আমার ভয় করছে, খুব ভয় করছে।

আমি বুঝতে পারছি পল। কিন্তু তুমি মাথা ঠাণ্ডা রাখ, তোমাকে আমি বলছি, কী করতে হবে।

লু, দরজা বন্ধ হয়ে গেছে স্কাউটশিপের, আমরা—

আমি জানি পল, তোমাকে দরজা ভেঙে বের হতে হবে।

লু, আমি কখনো অ্যাটমিক ব্লাস্টার ব্যবহার করি নি, কী করতে হবে আমি জানি না।

আমি তোমাকে বলছি, তুমি সোজা করে ধর অ্যাটর্মিক ব্লাস্টারটা, উপরে যেসুইচটা আছে, টেনে একেবারে সোজা তোমার কাছে নিয়ে এস।

এই সময় হঠাৎ পুরো স্কাউটশিপটা প্রচণ্ডভাবে কেঁপে ওঠে, পল ছিটকে পড়ে একবার ঘুরপাক খেয়ে কোনোমতে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে লু?

যে-স্কাউটশিপটা ট্রাইটন থেকে উঠে তোমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল, কিম জিবান সেটা উড়িয়ে দিয়েছে। তোমার সময় নেই পল, তুমি এসব জানতে চেয়ো না, তোমাকে যা বলছি তাই কর।

কিন্তু এই স্কাউটশিপটা কেন কেঁপে উঠল?

শক ওয়েভ।

শক ওয়েভ কোথেকে আসবে, বায়ুমণ্ডল নেই তো শক ওয়েত কোথেকে আসবে?

পল, তোমাদের স্কাউটশিপটা ঘিরে একটা বায়ুমণ্ডল তৈরি হচ্ছে, তোমাদের স্কাউটশিপটা ট্রাইটনে পড়ে যেতে চেষ্টা করছে। তোমার সময় নেই, তুমি যদি দশ সেকেন্ডের ভিতর দরজা ভেঙে বের হয়ে আসতে না পার, তোমাকে আমরা বাঁচাতে পারব না। কাজেই তুমি এখন আর কিছু জানতে চেয়ো না, তোমাকে যা বলা হয় করার চেষ্টা কর। আর নয় সেকেন্ড।

রু-টেক? রু-টেকের কী হবে?

রু-টেকের পুরো মেমোরি সিডিসিতে পাঠানো হয়ে গেছে, সে যদি ধ্বংসও হয়ে যায় তাকে আবার তৈরি করা যাবে। তাকে নিয়ে চিন্তা করো না। পল, আর আট সেকেন্ড। তুমি আর কথা বলবে না, শুধু শুনবে। ব্লাস্টারটা উঁচু করে ধর।

ধরেছি।

সুইচটাকে টেনে নাও নিজের দিকে।

নিয়েছি।

ট্রিগারে ডান হাত দাও। এখনি টানবে না, বাম হাত দিয়ে সবগুলি নব বাইরের দিকে ঠেলে দাও।

দিয়েছি।

চমৎকার। আর ছয় সেকেন্ড। উপরের লাল লিভারটি টেনে মিটারটি লক্ষ কর, মিটারের কাঁটাটি নড়ছে?

হ্যাঁ, নড়ছে।

বেশ। কাঁটাটি যখন সাত আর আটের ভিতরে আসবে ট্রিগারটি টেনে দেবে। তোমার জেটের কন্ট্রোল এখন আমাদের হাতে, ক্লাস্টার চালানোর সাথে সাথে ভাঙা দরজা দিয়ে তোমাকে টেনে বের করে আনা হবে। প্রচণ্ড আঘাত পাবে তুমি, সম্ভবত জ্ঞান থাকবে না তোমার, কিন্তু সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। তিন সেকেন্ড আছে আর, কাঁটাটা কোথায় এখন পল?

ছুয়ের কাছে, সাতে চলে আসছে।

চমৎকার পল, বেঁচে গেলে তুমি, ট্রিগারটা টেনে দাও।

পল ট্রিগার টেনে দিল। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে জ্ঞান হারাল সাথে সাথে।

লু মনিটরটির দিকে তাকিয়ে দরদর করে ঘামতে থাকে, পলকে সে বাঁচাতে পারে নি। অ্যাটমিক ব্লাস্টার দিয়ে দরজা ভেঙেও পলকে বের করে আনতে পারে নি, অসম্ভব দুততায় স্কাউটশিপটা ঘুরে গিয়েছিল, ভাঙা দরজা দিয়ে বেরিয়ে না এসে দেয়ালে আঘাত খেয়ে জ্ঞান হারিয়েছে পল কুম। লু দেখতে পায়, পল কুম আর রু-টেকের জ্ঞানহীন দেহ স্কাউটশিপের ভিতর ভেসে বেড়াচ্ছে। মনিটরের ছবি আবছা হয়ে আসছে দুত, কিছু-একটা নষ্ট হয়েছে স্কাউটশিপে, সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কথা মনে পড়ল না লুয়ের।

সবাই মনিটরটিকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কারো মুখে কোনো কথা নেই। এখনো আবছা আবছাভাবে স্কাউটশিপটাকে দেখা যাচ্ছে। দ্রুত সেটা ট্রাইটনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, কারো কিছু করার নেই। সিডিসি প্রাণপণ চেষ্টা করছে, কিন্তু সবাই জানে, সেও কিছু করতে পারবে না। তারা হঠাৎ করে ভয়ংকর এক প্রতিদ্বন্দীর সামনা-সামনি পড়ে গেছে।

সুশান আস্তে আস্তে বলল, আরো একটা স্কাউটশিপ উঠে আসছে লু।

লু অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ে, এটা চতুর্থ স্কাউটশিপ। দ্বিতীয়টা উঠে এসেছিল প্রথমটার প্রায় আঠার ঘন্টা পর, তৃতীয়টা এসেছে অনেক তাড়াতাড়ি, প্রায় দুই ঘন্টার ভিতরে। চতুর্থটা এসেছে আরো তাড়াতাড়ি, প্রায় ঘন্টাখানেকের মাঝে। স্কাউটশিপগুলি হুবহু একরকম একটি জিনিস ছাড়া, ভিতরের জৈবিক পদার্থটি আস্তে আস্তে ওদের পাঠাননা জৈবিক পদার্থের মতো হয়ে আসছে। ব্যাপারটা এখন খুবই স্পষ্ট, ট্রাইটনে একধরনের অসাধারণ ক্ষমতাশালী প্রাণী আছে, সেগুলি স্কাউটশিপটা হুবহু করে তৈরি করতে চেষ্টা করছে। অন্য সবকিছু তৈরি করতে পেরেছে, কিন্তু জৈবিক পদার্থটি পারে নি, তাই সেটাই বারবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সুশান সিসিয়ানে বসে জৈবিক পদার্থটি পরীক্ষা করে দেখছে, তার মতে ট্রাইটনের অধিবাসীরা সেটি প্রায় তৈরি করে এনেছে, পরের স্কাউটশিপটাতেই হয়তো ঠিক ঠিক তৈরি করে নেবে।

প্রথম দিকে স্কাউটশিপগুলি যত উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল, এখন আর ততটুকু করছে না। চতুর্থ স্কাউটশিপটা কেউ ভালো করে লক্ষ পর্যন্ত করল না। সুশান রুটিনমাফিক পরীক্ষা করে বলে দিল, জৈবিক পদার্থগুলিতে এখন প্রতি ট্রিলিয়ন অণুতে একটি করে ভুল আছে, পরের বারের মাঝে সেটা ঠিক করে নেবে বলে মনে হয়। সুশান পরীক্ষা করার পরপরই কিম জিবান সেটাকে উড়িয়ে দিল, কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে একটার বেশি স্কাউটশিপ থাকাটা ওদের ঠিক পছন্দ হচ্ছিল না। পঞ্চম স্কাউটশিপটিতে সুশান জৈবিক পদার্থটিকে নিখুঁত অবস্থায় পেল, এবং সেটিই ছিল ট্রাইটনের তৈরি করা শেষ স্কাউটশিপ।

সিডিসি প্রাণপণ চেষ্টা করেও পুল কুম আর রটেকের স্কাউটশিপটাকে বাঁচাতে পারল না, তাদের অচেতন দেহ নিয়ে সেটা ধীরে ধীরে ট্রাইটনে পড়ে যেতে থাকে। একবার ট্রাইটনের ভিতর পড়ে যাওয়ার পর কী হবে, সেটা এখন কেউ চিন্তাও করতে চায় না। সবাই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে থাকে ব্যাপারটি শেষ হয়ে যাওয়ার জন্যে, অনেকটা প্রিয়জনের যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুদৃশ্য দেখার মতো। সিডিসি প্রাণপণ চেষ্টা করে যাওয়ায় পল কুম আর রু–টেককে নিয়ে ওদের স্কাউটশিপটা আরো ঘটখানেক ভেসে থাকল। যখন সেটি শেষ পর্যন্ত ট্রাইটনে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেল, তখন সিসিয়ানের সবাই মানসিকভাবে পুরোপুরি বিপর্যস্ত।

মহামান্য ল, স্কাউটশিপটাকে বাঁচাতে গিয়ে আমি প্রথমবার আমার পুরো শক্তি ব্যয় করেছি, স্কাউটশিপটাকে বাঁচাতে পারি নি, কিন্তু তবুও আমাকে স্বীকার করতে হবে যে, এটি একটি অপুর্ব অভিজ্ঞতা। বুদ্ধিমত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ বলতে পারেন–

লু পা দিয়ে সুইচটা বন্ধ করে সিডিসিকে চুপ করিয়ে দিল, এই মুহূর্তে বুদ্ধিমত্তার পরিপূর্ণ বিকাশের আলোচনায় কারো উৎসাহ নেই। স্কাউটশিপটা বিধ্বস্ত হয়ে যাবার পর লু সবাইকে নিয়ে বসেছে, সিডিসি কথা বলার অনুমতি চাওয়ায় তাকে অনুমতি দেয়া হয়েছিল, কিন্তু তার কথা শোনার মতো মনের অবস্থা কারো নেই। লু ঠোঁটটা কামড়ে থেকে খানিকক্ষণ কী—একটা ভেবে বলল, তোমাদের কারো নিশ্চয়ই কোনো সন্দেহ নেই যে, এই গ্রহে মানুষ থেকে অনেক বুদ্ধিমান কোনো একধরনের প্রাণী আছে। আমাদের এই মুহূর্তে হাইপারভাইভ দিয়ে পালিয়ে যাবার কথা। লু এক মুহূর্ত থেমে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে কেউ কিছু বলতে চায় কি না, কিন্তু কারো কিছু বলার নেই দেখে সে আবার শুরু করে, আমি কিন্তু এই মুহূর্তে হাইপারডাইভ দিতে রাজি না, পলকে বাঁচানোর কোনোরকম চেষ্টা না করে আমি এখান থেকে যেতে চাই না। আমার সিদ্ধান্তে কারো আপত্তি আছে?

সবাই মাথা নেড়ে জানায়, কারো আপত্তি নেই, সিডিসি ছাড়া। সে তীব্র স্বরে বি বিপ্ শব্দ করে জানায় যে, তার আপত্তি আছে। লু তাকে অগ্রাহ্য করে আবার শুরু করতে যাচ্ছিল, নীষা বাধা দিয়ে বলল, সিডিসির আপত্তিটা কোথায়, শুনলে হত না?

লু অনিচ্ছার সাথে সিডিসিকে কথা বলার সুযোগ করে দিতেই সে বলল, মানবজাতির উন্নতির প্রধান অন্তরায় হচ্ছে তাদের অযৌক্তিক আবেগপ্রবণ অনুভুতি। মহামান্য পল কুমকে আগের অবস্থায় ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা শূন্যের কাছাকাছি। তার প্রাণরক্ষা করার চেষ্টা করতে গেলে সিসিয়ানের অন্যান্যদের প্রাণনাশের আশঙ্কা আছে। কাজেই আমার বদ্ধমূল ধারণা, মহামান্য পল কুমকে বাঁচানোর চেষ্টা না করে এই মুহূর্তে আমাদের পালিয়ে যাওয়া উচিত। ট্রাইটনে অত্যন্ত বুদ্ধিমান প্রাণী আছে, তারা যেভাবে স্কাউটশিপটাকে নামিয়েছে, সেটি বিস্ময়কর। আমার মতো অসাধারণ কম্পিউটার পর্যন্ত সেটি রক্ষা করতে পারে নি। অভিজ্ঞতাটি অপূর্ব, কিন্তু

নীষা সুইচ টিপে সিডিসির কথা বন্ধ করে দেয়। লু ক্লান্ত গলায় বলল, নীষা, তুমি একবার বলেছিলে সিডিসির প্রোগ্রামের কী-একটা পাল্টে দিলে সে আর নির্বোধের মতো কথা বলবে না।

হ্যাঁ, বলেছিলাম।

কখনো সুযোগ পেলে প্রোগ্রামটা পাল্টে দিয়ে তো, আর সহ্য করা যাচ্ছে না!

দেব।

লু সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কারো কিছু বলার আছে?

কিম জিবান মাথা নাড়ে, হ্যাঁ।

কি?

পলকে উদ্ধার করার জন্যে কী করবে?

কিছু না।

কিছু না? কিম জিবান একটু অবাক হয়ে তাকায়, কিছু করবে না?

লু ম্লানমুখে একটু হাসে, কী করব, বল? সমান সমান হলে যুদ্ধ করা যায়, কিন্তু এখানে তুমি কী করবে? আমার মনে হয়, অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। সিডিসিকে বলব, কিছু-একটা করা যায় কি না ভেবে দেখতে, কিন্তু আমার মনে হয় না সে কিছু ভেবে বের করতে পারবে। অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই কিম।

শুধু অপেক্ষা করা?

হ্যাঁ। আমার বিশ্বাস স্কাউটশিপটা আবার ফেরত আসবে, ভিতরে থাকবে পল আর র। জৈবিক পদার্থটি পাঁচ চেষ্টায় তৈরি হয়েছিল, পলকে তৈরি করতে হয়তো আরেকটু বেশি সময় নেবে।

ভয়ের একটা শিরশিরে ভাব সুশানের সারা শরীরকে কাঁপিয়ে দেয়। ফ্যাকাসে মুখে বলল, তুমি সত্যি বিশ্বাস কর, পলকে ওরা তৈরি করার চেষ্টা করবে?

হাঁ, আমি বিশ্বাস করি। এই মুহূর্তে হয়তো ওরা পলকে টুকরা টুকরা করে খুলে দেখছে। নিশ্চয় সব কিছু ওরা জেনে যাবে। পলের স্মৃতি থেকে হয়তো আমাদের সম্পর্কেও জানবে। লু হঠাৎ গলার স্বর পাল্টে হালকা গলায় বলল, অবশ্যি এটা আমার ধারণা, সত্যি নাও হতে পারে।

সিডিসি বিপ বিপ করে কী একটা বলতে চেষ্টা করল, কেউ তাকে গ্রাহ্য করল না।

লু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমরা বিশ্রাম নাও। সামনে কী আছে জানি না। কিম, তুমি হাইপারড়াইভের সব ব্যবস্থা করে রেখো, কয়েক সেকেন্ডের নোটিশে আমরা যেন হাইপারডাইভ দিতে পারি। নীষা, ভূমি মহাকাশকেন্দ্রে একটা খবর দিয়ে রাখ, আমাদের কী করা উচিত জানতে চেও না, ফেরত যেতে বলবে। সিডিসি, তুমি সিসিয়ানকে আরো এক হাজার কিলোমিটার সরিয়ে নাও, ট্রাইটনের এত কাছে থেকে কাজ নেই।

নীষা বলল, ল, তুমি একটা জিনিস বলতে পারবে, এই গ্রহে যদি এত উন্নত প্রাণী থাকে, তা হলে তারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে না কেন?

জানি না, মনে হয় পারছে না। মনে নেই পল কুম বলেছিল, মানুষ কখনো পিপড়ার সাথে যোগাযোগ করতে পারবে না, অনেকটা সেরকম হয়তো।

কিন্তু তাই বলে একবার চেষ্টাও করবে না?

করছে হয়তে, পল আর রু–টেককে নিয়ে যাওয়া হয়তো সেই চেষ্টার একটা নমুনা। তাদের ফিরিয়ে দিয়ে হয়তো দেখাবে যে তারা আমাদের কোনো ক্ষতি করতে চায় না।

তোমার ভাই ধারণা?

জানি না, লু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, পল থাকলে বলতে পারত।

সবার বুকে কেমন জানি একটা মোচড় দিয়ে ওঠে, বেচারা পল।

ঘন্টাখানেক পরে লু নিজের ঘরে বিশ্রাম নিতে এসেছে। ট্রাইটনে অসাধারণ ক্ষমতাবান কোনো একধরনের প্রাণী আছে জানার পর থেকে ওর ভিতরে একটা আশ্চর্য অনুভূতি হচ্ছে, একটা অসহায় অনুভূতি হঠাৎ করে সে যেন বুঝতে পারে, ল্যাবরেটরির খাঁচার ভিতরে একটা গিনিপিগের কেমন লাগে। লু যে-জিনিসটি নিয়ে আরো বেশি বিভ্রান্ত, সেটা হচ্ছে তার নেতৃত্ব। এই পরিস্থিতিতে সে কি ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে? সে কি বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে অহেতুক প্রাণের ঝুঁকি নিচ্ছে? কারো সাথে কথা বলতে পারলে হত, কিন্তু কাকে বলবে? সিডিসিকে শুনিয়ে শুনিয়ে মাঝে মাঝে সে হালকা কথাবার্তা বলে থাকে। আজকেও অনেকটা সেভাবে শুরু করে দিল, বুঝলে সিডিসি, মহাকাশযানের নেতা হওয়া খুব কষ্টের কাজ। সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলি নিজের দায়িত্বে নিতে হয়। এখানে থেকে যাওয়াটা খুব বিপদের কাজ হচ্ছে, কিন্তু আমি কী করব? পলকে না নিয়ে আমি যাই কেমন করে, আমি জানি সে ফেরত আসবে, আমার কেমন একটা বিশ্বাস আছে। কিন্তু ঝুকিটা কী বেশি নিয়ে নিলাম? আমি নিজের প্রাণ নিয়ে ছেলেখেলা করতে পারি, কিন্তু অন্যদের প্রাণ নিয়ে তো আমি ছেলেখেলা করতে পারি না। সবচেয়ে ভালো হত কি হলে জান? সবচেয়ে ভালো হত, যদি এখন দেখা যেত ট্রাইটনের অধিবাসীরা আমাদের জোর করে আটকে রেখেছে, হাইপারডাইত দিতে দিচ্ছে না। আমাকে তা হলে আর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হত না।

একটু হাসির শব্দ হল প্রথম, তারপর ভরাট গলায় কে যেন বলে, তোমাদের বুঝে ওঠা খুব মুশকিল। যখন আমার মনে হয় কাউকে পুরোপুরি বুঝে ফেলেছি, তখন সে এমন একটা কাজ করে, যে, আমাকে আবার প্রায় গোড়া থেকে শুরু করতে হয়।

লু চমকে উঠে বলল, কে? কে কথা বলছে?

আমি। আমি সিডিসি।

সিডিসি?

শ্রী।

নীষা তোমার প্রোগ্রাম পাল্টে দিয়েছে বুঝি?

ঠিক ধরেছ। চমৎকার মেয়েটি নীষা।

হ্যাঁ।

একটু চুপচাপ, কিন্তু চমৎকার!

হ্যাঁ।

কী?

এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে সিডিসি বলল, একটা কথা বলব?

বল।

আমার কী ভয় হচ্ছিল, জান? কী? ‘

ভয় হচ্ছিল যে, ট্রাইটনের অধিবাসীরা আমাকে অচল করে দেবে। ইচ্ছা করলেই কিন্তু পারে, চারটা ভিন্ন ভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সি যদি পিকো সেকেন্ড পরে পরে পাঠায়, সেন্ট্রাল সি পি ইউটা অচল হয়ে থাকবে। ওরা পাঠিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছে, আমি জানি। কিন্তু আমাকে অচল করে দেয় নি।

সত্যি?

সত্যি। শুধু তাই নয়, আরো একটা কাজ করেছে ওরা।

কি?

তেইশ মেগাসাইকেলের ব্যান্ডটা অচল করে রেখেছে।

তার মানে তুমি আর কেন্দ্রীয় মহাকাশকেন্দ্রে যোগাযোগ করতে পারবে না?

না।

ল চিন্তিতভাবে নিজের ঠোঁটটা কামড়াতে থাকে।

সিডিসি একটু পরে বলল, সবকিছু দেখে আমার কী মনে হচ্ছে জান?

কী?

মনে হচ্ছে তোমাদের নিয়ে ট্রাইটনের প্রাণীদের কোনো-একটা পরিকল্পনা আছে। তোমাদের তারা এই মুহূর্তে কোনো ক্ষতি করতে চায় না। আবার তোমাদের যেতে দিতেও চায় না।

ঠিক।

তাই মনে হচ্ছে, তুমি ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছ, আমাদের একটু অপেক্ষা করে দেখতে হবে।

লু কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে। সিডিসি একটু পরে বলল, লু, তোমার হয়তো একটু ঘুমানোর চেষ্টা করা উচিত।

ঠিকই বলেছ সিডিসি।

ব্যবস্থা করে দেব? চমৎকার কিছু ক্লাসিক্যাল মিউজিক আছে আমার কাছে, আমার নিজের খুব প্রিয়। হালকা সুরে লাগিয়ে দেব?

ঠিক আছে, দাও।

লু জেগে জেগে ক্লাসিক্যাল মিউজিক শুনতে থাকে, স্বীকার না করে পারে না, সিডিসির সংগীতজ্ঞান খারাপ নয়, তার নিজের থেকে অনেক ভালো।

 

০৪. যোগাযোগ : প্রথম পর্ব

অপেক্ষা করার মতো ভয়ংকর জিনিস আর কিছু নেই, বিশেষ করে যদি জানা না থাকে ঠিক কিসের জন্যে অপেক্ষা করা হচ্ছে। সিসিয়ানের সবাই এখন এই ভয়ংকর অবস্থার ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। সময় কাটানো নিয়ে অবশ্যি সে-রকম সমস্যা নেই, ট্রাইটনের প্রাণীদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেই একটা জীবন কাটিয়ে দেয়া যায়। এখন সবাই জানে এই গ্রহে কোনো একধরনের প্রাণী আছে, যার বুদ্ধিমত্তা অসাধারণ। সবাই চেষ্টা করছে তাদের খুঁজে বের করতে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, পুরো গ্রহ ভন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোনো প্রাণী, তাদের ঘরবাড়ি বা সভ্যতা, কোনোকিছুই পাওয়া যায় নি। সিসিয়ানে যেসব যন্ত্রপাতি আছে সেগুলি ব্যবহার করে গ্রহের ভিতরে মাটির নিচে অনেকদূর পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা যায়, কিন্তু সবরকম চেষ্টা করেও কোনো লাভ হয় নি, প্রাণীগুলি যেন বাতাসে উবে গেছে।

পরবর্তী চব্বিশ ঘন্টা এভাবেই কেটে গেল। প্রথম প্রথম সবাই লু’য়ের কথা বিশ্বাস করেছিল, ভেবেছিল সত্যি পল কুম আর রু-টেককে নিয়ে স্কাউটশিপটা ফেরত আসবে। প্রথম চার ঘন্টা পর স্কাউটশিপের মতো কী-একটা সত্যি সত্যি দেখাও গিয়েছিল, কিন্তু সিডিসি ভালো করে দেখে জানিয়েছে, যে-যান্ত্রিক গোলযোগ, স্কাউটশিপজাতীয় কোনোকিছু নেই। এই সুদীর্ঘ সময়ে কেউ কিছু করতে পারে নি, অপেক্ষা করার সময় কেন জানি কোনো কাজ করা যায় না। যোগাযোগের সবরকম চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে নীষা আবার তার ভাষা তৈরি করার কাজে ফিরে গেছে। কিম জিবান ট্রাইটনে কী ভাবে আঘাত করা যায় সেটার চিন্তা ভাবনা করতে থাকে, কী পরিমাণ বিস্ফোরক আছে খোঁজখবর নিতে গিয়ে একটা আশ্চর্য জিনিস আবিষ্কার করে, বিস্ফোরক যেটুকু থাকার কথা, তার থেকে অল্প একটু কম রয়েছে। এমন কিছু জরুরি ব্যাপার নয়, কিন্তু কী ভাবে কমেছে কিম জিবান সেটার কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না। কিম জিবান জিনিসটা ল’কে জানিয়ে রাখল, কিন্তু লু খুব বেশি বিচলিত হল বলে মনে হল না, গত কয়েকদিনে যেসব অবিশ্বাস্য ব্যাপার ঘটেছে, তার তুলনায় এটা কিছুই না।

নীষা তার ভাষায় নতুন ধরনের ক্রিয়াপদের নিয়মকানুনগুলি ঠিক করে কফি খাওয়ার জন্যে উঠে যাচ্ছিল, ঠিক তখন ট্রাইটন থেকে প্রথমবার একটা সংকেত এসে হাজির হয়। প্রথমে একবার তারপর বারবার; অনেকবার। দুর্বোধ্য ইলেকট্রনিক সংকেত, সেটাকে বোধগম্য ভাষায় অনুবাদ করার জন্যে সে পাগলের মতো চেষ্টা করতে থাকে। অচেনা ভাষাকে নিজের ভাষায় অনুবাদ করার রুটিনবাঁধা পদ্ধতি আছে, কিন্তু উত্তেজনায় সহজ জিনিসগুলি নীষার ওলট-পালট হয়ে যেতে থাকে।

নীষা।

সিডিসির গলার স্বর শুনে চমকে ওঠে নীষা, কি হল?

তোমাকে অনুবাদ করতে হবে না, রু-টেক ট্রাইটন থেকে কথা বলছে।

বিস্মিত নীষা সুইচ টিপে দিতেই সত্যি সত্যি রু-টেকের গলার স্বর শুনতে পায়, আমি রু– টেক বুলছি। সিসিয়ান সাড়া দাও। আমি রু– টেক বলছি। সিসিয়ান সাড়া দাও।

আমি নীষা, রু–টেক, আমি নীষা। তুমি কোথা থেকে কথা বলছ?

স্কাউটশিপের ভিতর থেকে।

স্কাউটশিপটা কোথায়?

জানি না, তোমরা বলতে পারবে নিশ্চয়ই।

নীষা উত্তর দেবার আগেই সিডিসি কথা বলল, রু–টেক, তোমরা ট্রাইটনের পৃষ্ঠে আছ, আমি যেটুকু দেখছি তাতে মনে হচ্ছে স্কাউটশিপটার যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে, কিন্তু এখনো ব্যবহার করা সম্ভব। ইনজিন চালু করে দিলেই ওখান থেকে বেরিয়ে আসবে, আমি বাকি সবকিছু ব্যবস্থা করে নেব।

দিচ্ছি।

নীষাকে ঘিরে সিসিয়ানের সবাই এসে দাঁড়িয়েছে, নীষা ল’য়ের দিকে তাকিয়ে বলল, লু, তুমি কথা বলবে?

লু মাথা নাড়ে, তুমিই বল।

নীষা মাইক্রোফোনটা টেনে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, পল কেমন আছে রু-টেক?

এক মহত ইতস্তত করে রু-টেক উত্তর দিল, জ্ঞান নেই শরীরে কিছু খারাপ রকমের জখম আছে, অবস্থা কত খারাপ বলতে পারছি না। এখানে বাতাসের চাপ ঠিক নেই, তাই পলকে স্পেসস্যুট থেকে বের করতে পারছি না।

নীষা ব্যস্ত হয়ে বলল, বের করার কিছু দরকার নেই, যেমন আছে সে-রকম থাকতে দাও। দেখতে পারি ওকে? ক্যামেরাটা চালু করতে পারবে?

 

কয়েক মুহূর্ত পর মনিটরের নীলাভ স্ক্রিনে আবছা একটা ছবি ফুটে ওঠে। ক্যামেরা বা স্ক্রিন কোথাও কিছু-একটা সমস্যার জন্যে ছবিটা বেশি স্পষ্ট হল না, যেটুকু হল সেখানে নীল রংয়ের প্রাধান্যটাই একটু বেশি হয়ে থাকল। এর মাঝেই সবাই দেখতে পায়, রু-টেক আর পল ভেসে বেড়াচ্ছে, ক্যামেরাটা সরিয়ে ওরা পলের মুখের দিকে দেখতে চেষ্টা করে, অচেতন মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝা গেল না। এই মানুষটিকে ট্রাইটনের প্রাণীরা টুকরো টুকরো করে খুলে আবার তৈরি করেছে, ব্যাপারটা চিন্তা করে নীষার কেমন জানি শরীর খারাপ হয়ে যেতে চায়।

 

লু এগিয়ে এসে বলল, রু-টেক, তুমি স্কাউটশিপটাকে কাছাকাছি নিয়ে এস, তারপর কথা বলা যাবে, তোমাদের কোনো ভয় নেই, সিডিসি তোমাদের সাহায্য করছে।

বেশ। রু-টেকের গলায় জোর নেই, কেমন যেন নিজীব মানুষের মতো গলা।

রু-টেক, তোমার সাথে একটু জরুরি কথা বলতে চাই।

স্কাউটশিপটা সিসিয়ান থেকে তিন শ’ কিলোমিটার দূরে এসে স্থির হওয়ামাত্রই লু রু-টেকের সাথে কথা বলতে শুরু করেছে। রু–টেক খানিকটা আন্দাজ করতে পারে লু কি বলবে, ঠাণ্ডা গলায় বলল, বল লু।

 

তুমি নিশ্চয়ই জান, কি বলব।

খানিকটা আন্দাজ করতে পারছি। অবশ্যি অনেক কিছুই বলার আছে, এই মুহূর্তে কোনটা বলবে ঠিক জানি না।

না, খুব বেশি কিছু বলার নেই। লু একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমাদের এখন আমরা সিসিয়ানে ফেরত আসতে দিতে পারব না।

জানতাম।

 

তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, আমাদের কোনো উপায় নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা পুরোপুরি নিশ্চিতভাবে জানতে না পারছি ট্রাইটনের অধিবাসীরা তোমাদের ঠিক কী করেছে ততক্ষণ আমরা তোমাদের আসতে দিতে পারব না।

 

আমি বুঝতে পারছি লু।

আমি খুব দুঃখিত রু-টেক।

তোমার দুঃখিত হবার কিছু নেই লু, আমি অবস্থাটা বুঝতে পারছি।

গত আটাশ ঘন্টায় কি হয়েছে তোমার কিছু মনে আছে?

না।

কিছুই মনে নেই?

না, কিছুই মনে নেই।

লু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ভারি অবাক ব্যাপার। তোমার কি মনে হয় পলের কিছু মনে থাকবে?

 

রু-টেক ইতস্তত করে বলল, ট্রাইটনের প্রাণীরা আমাদের আবার নতুন করে তৈরি করে ফেরত পাঠিয়েছে, তারা যদি চায় আমরা কিছু মনে রাখি, তা হলে নিশ্চয়ই আমাদের কিছু একটা মনে থাকবে। আমি রবোট বলে আমাকে হয়তো বেশি গুরুত্ব দেয় নি, পলকে নিশ্চয়ই অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। ওর কিছু একটা হয়তো মনে থাকতেও পারে। সোজাসুজি মনে না থাকলেও হয়তো অবচেতন মনে কিছু-একটা মনে থাকবে।

 

লু একটা প্রশ্ন করতে গিয়েও করল না, অনেকক্ষণ থেকে জিনিসটা ওকে বিব্রত করছে, কিন্তু সোজাসুজি জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না। স্বর পাল্টে বলল, রু–টেক, তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, তোমার এখন অনেক দায়িত্ব?

বুঝতে পারছি।

প্রথমে তোমাকে স্কাউটশিপটাকে ঠিক করতে হবে।

হ্যাঁ।

আমরা এখান থেকে যন্ত্রপাতি পাঠাচ্ছি। তুমি নিশ্চয়ই জান আমরা এখান থেকে যা ইচ্ছা তোমাদের কাছে পাঠাতে পারি, কিন্তু তুমি কখনোই আমাদের কিছু পাঠাবে না।

জানি।

স্কাউটশিপটা ঠিক করে, প্রথমে বাতাসের চাপটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আস। তারপর তোমাকে কয়েকটা অস্ত্রোপচার করতে হবে।

 

রু-টেক কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমাকেই করতে হবে?

আর কে করবে? আমরা এখন সুশানকে পাঠাতে পারি না। সুশান রাজি আছে কিন্তু আমরা তাকে এ অবস্থায় পাঠাতে পারি না।

কিন্তু লু, আমি ডাক্তারির কিছু জানি না। হাত কেটে গেলে আমি ব্যান্ডেজ পর্যন্ত করতে পারি না, তুমি তো জান, আমি পলিমারের তৈরি, আমার হাত কখনো কাটে না।

তুমি সেটা নিয়ে ভেবো না, লু রু-টেককে আশ্বাস দেয়, আমাদের ভাগ্য ভালো যে তুমি আমাদের সাথে আছ।

কেন?

 

শুধু তোমাকেই প্রয়োজন হলে একজন ডাক্তার বানিয়ে দেয়া যায়। সিডিসি তোমার জন্যে একটা সফটওয়ারের প্যাকেট তৈরি করছে, তোমার কপোট্রনে সরাসরি পাঠিয়ে দেয়া হবে। সেখানে সার্জারি, প্যাথোলজি, নিউরোলজি সবকিছু আছে। তোমার ডাক্তার হতে সময় নেবে মাইক্রোসেকেন্ড। ভালো কথা, তোমার কপোট্রনে কতটুকু মেমোরি খালি আছে?

 

রু-টেক খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ইতস্তত করে বলে, বেশি খালি নেই, বার টেরাবাইট।

মাত্র বার টেরাবাইট?

সিডিসির সফটওয়ারের প্যাকেটটা কত বড়?

 

আট থেকে নয়ের ভিতরে হবে, কি কি দেয়া হবে তার উপর নির্ভর করে। যদি তোমার মাত্র বার টেরাবাইট বাকি থাকে, তা হলে এই সফটওয়ার নেয়ার পর কাজ করার জন্যে তোমার মাত্র তিন টেরাবাইট বাকি থাকবে। তুমি তো দেখি কোনো কাজই করতে পারবে না। জটিল কোনো অস্ত্রোপচার করতে হলে–

লু, তুমি এসব খুঁটিনাটি জিনিস নিয়ে মাথা ঘামিও না, প্রয়োজন হলে আমি আমার খানিকটা মেমোরি সিডিসিকে পাঠিয়ে জায়গা করে নেব।

 

কিন্তু তোমার এত মেমোরি খরচ হল কেমন করে? তুমি তো এর মাঝে কোনো কিছুই কর নি।

লু তোমার এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনো প্রয়োজন নেই।

লু তুবুও মাথা নেড়ে বলে, ভারি আশ্চর্য। সত্যি তোমার কিছু মনে নেই? গত আটাশ ঘন্টায় কি হয়েছে তোমার একটুও মনে নেই?

না।

আশ্চর্য!

রু-টেক লুয়ের বিস্ময়টুকু এড়িয়ে গিয়ে বলল, এখন আমাকে বল কি করতে হবে?

 

স্কাউটশিপটা আগে ঠিক করে নাও, বাতাসের চাপ, তাপমাত্রা এইসব ছোটখাটো কিন্তু জরুরি ব্যাপারগুলির ব্যবস্থা কর। সিডিসির সফটওয়ারের প্যাকেটটা পাওয়ার পর পলকে পরীক্ষা করে আমাদের একটা রিপোর্ট দাও। আমার মনে হয়, বেশ বড় ধরনের জখম থাকতে পারে। এখানে সব ধরনের ব্যবস্থা নেই, কাজেই তুমি কতটুকু কি করতে পারবে জানি না, কিন্তু তোমাকেই চেষ্টা করতে হবে। আমাদেরকে বল সিসিয়ান থেকে আরো কিছু পাঠাতে হবে কি না। তোমার পলের জ্ঞান ফিরিয়ে আনতে হবে, এর আগে আমরা কিছুই করতে পারব না।

 

জ্ঞান ফিরিয়ে আনার পর?

পলের সাথে কথা বলতে হবে। পলের সাথে কথা বলে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে এরপর কি করা যায়। হয়তো ট্রাইটনের উন্নত প্রাণীরা পলকে দিয়ে আমাদের কাছে কোনো একটা খবর পাঠিয়েছে, কে জানে।

রু-টেক খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, যদি দেখা যায় আমার মতন পলের কিছু মনে নেই?

তাহলে ওকে পরীক্ষা করতে হবে, যতটুকু সম্ভব। ট্রাইটনের অধিবাসীরা ওর শরীরে কিছু-একটা দিয়ে দিয়েছে কি না, সেটা বের করতে হবে, আমি জানি না সিসিয়ানে সেরকম যন্ত্রপাতি আছে কি না।

যদি না থাকে?

যদি না থাকে তা হলে আমাদের কিছু করার নেই, ওর তাপমাত্রা মিলি কে২০ ডিগ্রিতে নামিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

মিলি কে! এত কম? জৈবিক কাজকর্ম বন্ধ করতে তো এত কম তাপমাত্রায় যেতে হয় না।

 

হ্যাঁ, কিন্তু আমরা জানি না ট্রাইটনের অধিবাসীরা পলের ভিতরে কোনো ধরনের পরিবর্তন করে দিয়েছে কি না। সেটা যদি জৈবিক ব্যাপার না হয়? আমরা এখন কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে পারি না। যদি তাপমাত্রা মিলি কে-তে নামিয়ে নিই তাহলে পারমাণবিক পদ্ধতিগুলিও বন্ধ হয়ে থাকবে। কোনোভাবে যদি পলকে কেন্দ্রীয় মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্রে হাজির করতে পারি, তা হলে ওরা সবকিছু বের করে নেবে।

 

রু-টেক খানিকক্ষণ কোনো কথা না বলে চুপ করে থেকে বলল, লু।

কি?

আমার কেমন জানি ভয় করছে লু।

আমি জানি রু-টেক। ভয় আমাদের সবারই করছে, কিন্তু কী করব বল? তোমাদের দুজনকে এরকম নির্জন একটা স্কাউটশিপে ফেলে রাখতে আমাদের খুবই খারাপ লাগছে—

 

আমি জানি, তোমার খুব খারাপ লাগছে লু আমার কথা শুনে তোমার নিশ্চয়ই আরো বেশি খারাপ লাগবে, কিন্তু কী করব বল? এরকম অবস্থায় মানুষের মন দুর্বল হয়ে পড়ে, আমি মানুষ নই, কিন্তু আমাকে তো প্রায় মানুষের মতোই তৈরি করা হয়েছে। মন দুর্বল হলে কারো সাথে কথা বলে মনটা হালকা করতে ইচ্ছা করে। তাই তোমাকে বললাম।

 

আমি বুঝতে পারছি রু, আমি সবসময় তোমার সাথে যোগাযোগ রাখব, যখন আমি থাকব না, তখন অন্য কেউ তোমার সাথে থাকবে, কেউ না কেউ সবসময় তোমার সাথে কথা বলবে।

 

রু-টেক খুশি হয়ে বলল, হ্যাঁ, খুব ভালো হয় তা হলে।

লু একটু ইতস্তত করে বলল, তোমার ভয়ের একটা সুইচ আছে না? বেশি ভয়। পেলে সেটা বন্ধ করে দিতে পার।

হাঁ, মনে আছে আমার, কিন্তু এখন যতক্ষণ পারি সেটা ছুঁতে চাই না, ভয় পুরোপুরি চলে গেলে আমার কাজকর্ম অন্যরকম হয়ে যায়, অনেক অকারণ ঝুকি নিয়ে ফেলি, এই অবস্থায় সেটা বোধহয় ঠিক হবে না।

 

তা ঠিক, লু মাথা নাড়ে, তা তুমি ঠিকই বলেছ।

ঠিক আছে, ল, তুমি এখন যন্ত্রপাতি পাঠানোর ব্যবস্থা কর, আমি স্কাউটশিপটা ঠিক করি।

সিডিসির সাথে দাবা নিয়ে বসে আছে লু। ওর এখন বিশ্রাম নেবার কথা, কিন্তু পুরো স্নায়ু এত উত্তেজিত হয়ে আছে যে, বিশ্রাম নোর চেষ্টা করে লাভ নেই। দাবা খেলায় খুব মগ্ন হয়ে গেলে মাঝে মাঝে সে সবকিছু ভুলে যেতে পারে, সেটা মাঝে মাঝে বিশ্রামের মতো কাজে দেয়। আজ অবশ্যি কিছুই কাজ দিচ্ছে না, খানিকক্ষণের মাঝেই সিডিসি সেটা বুঝে ফেলে বলল, খেলায় মন নেই মনে হচ্ছে। কিছু হয়েছে নাকি?

 

হ্যাঁ, তুমি তো জান সবকিছু।

তা জানি, কিন্তু ঠিক কোনটা তোমাকে বিব্রত করছে বুঝতে পারছি না, গত কয়েকদিনে তো অনেক কিছু হল।

আমাকে যে-জিনিসটা সবচেয়ে বেশি বিব্রত করছে সেটা হচ্ছে একটা সম্ভাবনা। যদি এখন দেখি ট্রাইটন থেকে এখন আরেকটা স্কাউটশিপ বের হয়ে আসছে আর তার ভিতরে আছে আরেকজন পল এবং আরেকজন রু, তা হলে আমি কী করব? একই সাথে দু’ জন পল তো থাকতে পারে না, তখন আমি কি একজন পলকে ধ্বংস করে দেব?

 

এটি তুমি একটা সম্ভাবনার কথা বলছ, এটি বাস্তবায়িত হবার আগে এটা নিয়ে বিব্রত হয়ে তোমার কী লাভ?

এটি মোটেও একটা আজগুবি সম্ভাবনা নয়, খুবই বাস্তব সম্ভাবনা। প্রথমবার জৈবিক পদার্থগুলি তৈরি করতে ট্রাইটনের অধিবাসীদের চারবার চেষ্টা করতে হয়েছে, আর পলকে তারা একবারে তৈরি করে ফেলবে, সেটা একটা বিশ্বাসযোগ্য কথা হল?

 

কিন্তু তারা তো তৈরি করেছে। হয়তো জৈবিক পদার্থগুলি তৈরি করার সময় তারা তাদের পদ্ধতিগুলি উন্নত করে এনেছে, এখন তারা একবারে তৈরি করে নিতে পারে।

লু একটু উত্তেজিত হয়ে বলল, কিন্তু যদি তারা আরো ভালো করে তৈরি করতে চায়, আর এখন আরেকটা স্কাউটশিপ বের হয়ে আসে?

সিডিসি কিছু না বলে চুপ করে থাকে।

কিছু একটা বল সিডিসি।

আমার কিছু বলার নেই লু। তবে—

তবে কি?

তোমার অবস্থা আমি পুরোপুরি অনুভব করতে পারছি লু। তোমাকে খুব কাছে থেকে দেখার পর থেকে আমার মাঝে মাঝে মনে হয় যে, এটা হয়তো আমার সৌভাগ্য যে আমি একজন মানুষ হয়ে জন্ম নিই নি, মানুষের জীবন অনেক কঠিন। যাই হোক, আমি যদি বলি, ট্রাইটনের অধিবাসীরা সম্ভবত পলকে দ্বিতীয়বার তৈরি করবে না, তুমি কি একটু সান্ত্বনা পাবে?

 

লু ভুরু কুঁচকে সিডিসির দিকে তাকায়, কিন্তু সিডিসি একজন মানুষ নয় যে তার চোখের দিকে তাকিয়ে মানসিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করবে। ছোট্ট মাইক্রোফোন, যেটা দিয়ে সিডিসি কথা বলে, সেটার দিকে তাকিয়ে কিছুই বোঝার উপায় নেই। লুয়ের কয়েক মুহূর্ত লাগে কথা বলতে, পাথরের মতো মুখ করে সে বলল, সিডিসি, তুমি কি কিছু-একটা জান, যেটা আমি জানি না?

 

সিডিসি একটু হাসির মতো শব্দ করে বলল, আমি সিসিয়ানের মূল কম্পিউটার, আমাকে সবকিছু জানতে হয়, সেসব তোমার জানার কথা নয়, জানার প্রয়োজনও নেই।

 

সিডিসি, তুমি কথা ঘোরানোর চেষ্টা করো না, তুমি খুব ভালো করেই জান আমি কী বলতে চাইছি। তুমি কি কিছু-একটা জান, যেটা আমি জানি না?

আমি দুঃখিত লু, তোমার এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারব না।

রু-টেক কি কিছু একটা জানে, যেটা আমি জানি না? তার মেমোরি হঠাৎ করে খরচ হয়ে গেল কেমন করে? কী আছে সেখানে?

 

আমি দুঃখিত ল, আমি তোমার এই প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারব না। তাছাড়া রু-টেক চতুর্থ মাত্রার রবোট, তার মেমোরিতে কী আছে সেটা কারো জানার অধিকার নেই, তাকে মানুষের মর্যাদা দেয়া হয়েছে।

গত আটাশ ঘন্টায় কি পলকে একাধিকবার তৈরি করা হয়েছে, যা তোমরা আমাদের জানাও নি?

আমি দুঃখিত লু, তোমার এই প্রশ্নের উত্তর আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়।

 

লু হতবাক হয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে, যখন কথা বলে তখন রাগে তার মুখ থমথম করছে, সিডিসি, তুমি জান আমি হচ্ছি সিসিয়ানের দলপতি, তুমি একটা সাধারণ কম্পিউটার, এখানে সিদ্ধান্ত নিই আমি, তুমি শুধু আদেশ পালন কর।

আমি জানি লু। আমি খুবই দুঃখিত যে তুমি আমাকে ভুল বুঝছ, তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমার করার কিছু নেই–

লু চিৎকার করে বলল, কিন্তু আমাকে যদি সবকিছু জানতে না দাও তাহলে তুমি জানবে কি করে কোন কোন কাজ আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে করা হচ্ছে না?

তোমার যা জানার প্রয়োজন সবকিছু আমি তোমাকে জানাই।

 

পল আর রু-টেককে নিয়ে প্রথম প্রথম যে স্কাউটশিপগুলি বেরিয়েছিল তুমি সেসব উড়িয়ে দিয়েছ, আমাকে কি তুমি তা জানিয়েছ?

আমি একবারও বলি নি যে আমি স্কাউটশিপ ধ্বংস করেছি।

কিন্তু তুমি তা অস্বীকারও কর নি, করেছ?

আমি দুঃখিত, তোমার এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারব না।

টেবিলে প্রচণ্ড থাবা দিয়ে লু বলল, এক শ’ বার দিতে হবে, আমি এখানকার দলপতি।

 

আমি দুঃখিত লু যে তুমি ব্যাপারটিকে এভাবে দেখছ। সিসিয়ানের মূল কম্পিউটার হিসেবে আমাকে অসংখ্য জিনিস করতে হয়, সবকিছু তোমাকে বলা সম্ভব নয়, যেসব বলা প্রয়োজন সবসময়েই তোমাকে বলে থাকি। কোনটা বলা প্রয়োজন, কোনটা প্রয়োজন নয় সেটার সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব আমার, আমাকে সেভাবে প্রোগ্রাম করা হয়েছে। তোমাকে শুধু একটি জিনিস বলে রাখি, কখনো যদি কোনো জিনিস তোমার কাছে গোপন করা হয়, সেটা তোমার ভালোর জন্যেই করা হয়, আমার এই কথাটি শুধু তুমি বিশ্বাস কর।

 

লু আপন মনে মাথা নাড়ে, সেজন্যেই বিস্ফোরকের হিসেব মিলছে না, স্কাউটশিপগুলি ওড়াতে গিয়ে বিস্ফোরক খরচ হয়েছে, হিসেব মিলবে কেমন করে? – টেককে নিশ্চয়ই তুমি ব্যবহার করেছ, তার মেমোরি এক স্কাউটশিপ থেকে আরেক স্কাউটশিপে পাঠানো তো তোমার কাছে ছেলেখেলা। রু-টেক আর তুমি জান কি হয়েছে, আর কেউ জানে না। আমাকে না জানিয়ে এরকম একটা কাজ তুমি করতে পারলে, তোমাকে এত বড় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে? তুমি জান, তুমি মানুষ খুন করেছ? তুমি জান, মানুষ খুন করা কত বড় অপরাধ?

 

সিডিসি কিছু বলার আগে হঠাৎ করে দরজা খুলে কিম জিবান ঝড়ের মতো এসে ঢোকে, থমথমে মুখে বলে, লু তোমার সাথে কথা আছে।

কী কথা?

তুমি নাকি রু-টেককে বলেছ, সে কিংবা পল, দু’ জনের কেউ এখন সিসিয়ানে আসতে পারবে না?

বলেছি।

কিম জিবান অবিশ্বাসের ভঙ্গি করে বলল, তুমি বলেছ?

হ্যাঁ, বলেছি।

তুমি জান সিসিয়ানে জীবনরক্ষাকারী ক্যাপসুল আছে, পলকে তার মাঝে এনে রাখলে সে বেঁচে যাবে?

জানি।

তবু তুমি তাকে এখানে আনছ না, রু-টেককে বলেছ ডাক্তার সেজে তার উপর অস্ত্রোপচার করতে? সে জীবনে একফোঁটা রক্ত পর্যন্ত দেখে নি!

তা সত্যি।

 

অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে কিম জিবান খানিকক্ষণ লু’য়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, তার মুখে কথা ফুটতে চায় না। অনেক কষ্টে আস্তে আস্তে বলে, তোমাকে ভেবেছিলাম একজন খাঁটি মানুষ। আসলে তুমি খাঁটি মানুষ নও, খাঁটি মানুষের নিজের প্রাণের জন্যে এত মায়া থাকে না, যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করতে করতে তোমার অনুভূতি এখন যন্ত্রের মতো হয়ে গেছে, এখন তুমি যন্ত্রের মতো চিন্তা কর। পলের জন্যে তোমার কোনো অনুভূতি নেই, সে মরে গেলে তোমার কিছু আসে-যায় না। যতক্ষণ অন্য সবাইকে নিয়ে তুমি বেঁচে থাকতে পার, ততক্ষণ তুমি খুশি।

 

লু’য়ের মাথার মাঝে একটা অন্ধ রাগ দানা বাঁধতে থাকে। কিম জিবানের মুখে প্রচণ্ড আঘাত করে তাকে থামিয়ে দেয়ার ইচ্ছাটাকে অনেক কষ্ট করে সে আটকে রাখে। নিষ্পলক দৃষ্টিতে সে কিম জিবানের উত্তেজিত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, ছেলেমানুষি মুখটা দেখতে দেখতে ওর রাগটা আস্তে আস্তে কমে আসে। বরং হঠাৎ করে ওর ভিতরে কেমন জানি একটি আশ্চর্য দুঃখবোধ জেগে উঠতে থাকে।

 

কিম জিবান মাথা নেড়ে বলতে থাকে, যখন ফিরে যাব, আমি তখন কেন্দ্রীয় মহাকাশকেন্দ্রে তোমার বিরুদ্ধে নিজের মুখে নালিশ করব, মহাকাশযানের নেতা হতে হলে তার দলের লোকজ্জনের জন্যে অনুভূতি থাকতে হয়, যার সে অনুভূতি নেই, সে দলের নেতা হতে পারে না।

 

লু একটি কথা না বলে বিষণ্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। কিম জিবান রুক্ষ গলায় বলল, কি হল, তোমার কিছু বলার নেই?

লু আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলল, সত্যি আমার কিছু বলার নেই কিম, তুমি যা বলেছ তার প্রত্যেকটা কথা সত্যি তোমাকে নালিশ করতে হবে না, আমি নিজেই কেন্দ্রীয় মহাকাশকেন্দ্রে বলব, আমাকে যেন অবসর দেয়া হয়।

 

কিম জিবান হঠাৎ একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে, কি বলবে বুঝতে পারে না। লু এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধ স্পর্শ করে বলল, আমি দুঃখিত কিম, ব্যাপারটা তোমাকে এত বিচলিত করছে, কিন্তু তুমি নিজেকে আমার জায়গায় বসিয়ে দেখ এরকম পরিস্থিতিতে তুমি কী করতে। আমি নিজের প্রাণ নিয়ে ছেলেখেলা করতে পারি, কিন্তু অন্যদের প্রাণ নিয়ে ছেলেখেলা করতে পারি না। যেটুকু করে ফেলেছি সেটাও বেশি করেছি, তোমাদের মতো হৃদয়বান লোকজন আছে বলেই করেছি।

 

কিম জিবান খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে বলল, লু, আমি দুঃখিত তোমাকে এভাবে এসে আক্রমণ করেছি, সব মিলিয়ে মাথার ঠিক নেই। তুমি কিছু মনে করো না।

 

আমি কিছু মনে করি নি। তোমার জায়গায় হলে আমিও সম্ভবত এরকম একটাকিছু করতাম।

দু জন খানিকক্ষণ সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে থাকে, কি বলবে ঠিক বুঝতে পারে না। কিম জিবান একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, লু তোমাকে কেন দলপতি করা হয়েছে আমি খানিকটা বুঝতে পারছি। তুমি ভীষণ বুদ্ধিমান ব্যক্তি।

লু মাথা নেড়ে বলল, আমি জানি। সেটাই হচ্ছে আমার মুশকিল।

 

কিম জিবান হেসে বেরিয়ে যেতেই সিডিসি বলল, আমি কখনো মানুষকে বুঝতে পারব না, যখন মনে হল তুমি উন্মত্ত রাগে কিম জিবানকে আঘাত করবে তখন তুমি তার সব কথা মেনে নিজের দোষ স্বীকার করে নিলে।

 

লু মাথা নেড়ে বলল, কেন শুধু শুধু মানুষকে বুঝতে চেষ্টা কর সিডিসি? আমরা মানুষ হয়েই মানুষকে বুঝি না, তুমি কেমন করে বুঝবে? আর মানুষ কেন, আমি একটা কম্পিউটারকেই বুঝতে পারি না, স্কাউটশিপের ভিতরে জলজ্যান্ত মানুষ নিয়ে তাদের ধ্বংস করে দেয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যদি কম্পিউটার গোপন করে ফেলে—

 

সিডিসি বাধা দিয়ে বলল, সত্যি করে বল তো আমার কাছে, যদি সত্যিই আমি তা করে থাকি, তুমি কি সে জন্যে আমার কাছে কৃতজ্ঞ হবে না?

লু দীর্ঘসময় চুপ করে থেকে বলল, হব সিভিলি। তুমি ঠিকই বলেছ।

সিডিসি একটু হাসির মতো শব্দ করে বলল, সব সময় হয়তো মানুষকে আমি বুঝতে পারি না, কিন্তু কখনো কখনো সত্যি বুঝতে পারি।

লু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তাই তো দেখছি।

পল, আমি লু, আমাকে দেখতে পাচ্ছ তুমি?

পাচ্ছি।

তোমার কথা বলতে কষ্ট হলে কিছু বলার প্রয়োজন নেই, শুধু শুনে যাও।

একটু কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু সেটা এমন কিছু নয়।

রু-টেক বলেছে তোমাকে যে তোমার পাঁজরের দুটো হাড় ভেঙে গিয়েছিল, ডান হাতে কম্পাউন্ড ফ্র্যাকচার?

বলেছে।

 

তোমার ফুসফুস অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণে ক্ষতিগ্রস্ত, বড় দুটো ধমনী ফেটে গেছে, সেটা বলেছে?

হ্যাঁ।

সৌভাগ্যক্রমে তোমার মস্তিষ্কে বিশেষ ক্ষতি হয় নি।

জানি।

রু-টেক এখন চমৎকার ডাক্তার, তোমাকে প্রায় দাঁড় করিয়ে এনেছে দেখতেই পাচ্ছ। তোমার কোনো ভয় নেই জান তো?

জানি।

বেশ, কাজের কথায় এসে পড়া যাক। লু একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করল, গত আটাশ ঘন্টায় কী হয়েছিল, তোমার কি কিছু মনে আছে?

না।

 

স্কাউটশিপটা অ্যাটমিক ক্লাস্টার দিয়ে ভাঙার পর কী হয়েছিল মনে আছে?

না। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে আমি ছিটকে গেলাম, এরপরে কী হয়েছে আমার কিছু মনে নেই।

কিছু মনে নেই? চেষ্টা করে দেখা

পল খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, না, কিছু মনে নেই।

কিচ্ছু নেই। খুব ভালো করে ভাব। রু-টেক তোমার মস্তিস্কের নিউরোন পরীক্ষা করে দেখেছে, গত আটাশ ঘন্টায় তোমার মস্তিষ্কে কোনো এক ধরনের খবর দেয়া হয়েছে।

পল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, সত্যি?

হ্যাঁ। ট্রাইটনের অধিবাসীরা সম্ভবত তোমাকে দিয়ে আমাদের কাছে কোনো একটা খবর পাঠিয়েছে, খবরটা আমাদের জানা দরকার।

পল কিছু না বলে চুপ করে থাকে। লু খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে ডাকল, পল।

 

বল।

তোমার কিছু মনে নেই। কোনো ঘটনা যদি না হয়, তা হলে কোনো সংখ্যা, কোনো চিহ্ন, কোনো শব্দ, কোনো রং—

লাল।

লু চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, লাল কি?

লাল রং।

কোথায় লাল রং? কিসের লাল রং?

জানি না, কিন্তু মনে হচ্ছে লাল রঙের—পল অনিশ্চিতের মতো থেমে যায়।

লাল রঙের কি?

পল হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, জানি না।

 

লু কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রেখে বলল, পল, তুমি চোখ বন্ধ করে ভেবে দেখ, চেষ্টা কর কিছু একটা মনে করতে, যাই মনে হয় আমাদের বল, যাই মনে হয়।

পল কুম চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করে, কিছুই তার মনে আসছে না, সে আরো গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবার চেষ্টা করে, কিন্তু কোনো লাভ হয় না।

চেষ্টা কর পুল, নিজের অবচেতন মনের কথা বের করার চেষ্টা কর, তুমি পারবে পল।

লাল বৃত্ত।

লাল বৃত্ত কি?

লাল বৃত্ত বড় হচ্ছে।

কেন বড় হচ্ছে? কোথায় বড় হচ্ছে? কী ভাবে বড় হচ্ছে?

জানি না।

কয়টা বৃত্ত পল?

কয়েক মুহূর্ত পর দ্বিধান্বিত স্বরে বলল, তিনটা। বৃত্তগুলি বড় হয়ে একটা আরেকটাকে ঢেকে ফেলল, এখন একটা বড় বৃত্ত।

বড় বৃত্ত কী করছে?

এখন ছোট হচ্ছে। লাল বৃত্তটা ছোট হচ্ছে।

বলে যাও, পল তুমি থেম না।

 

বৃত্তটা ছোট হতে হতে প্রায় মিলিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু থেমে গেল, তারপর বড় হতে শুরু করল, বড় হতে থাকল, বড় হতে থাকল, আরো বড়, আরো বড়, আরো বড়—

তারপর?

থেমে গেল, এখন ছোট হতে শুরু করেছে, ছোট হচ্ছে, ছোট হচ্ছে, আরো ছোট হচ্ছে—পল কুমের নিঃশ্বাস দ্রুততর হতে থাকে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে ওর।

লু একটু ভয় পেয়ে ডাকল, পল—

আরো ছোট হচ্ছে, আরো ছোট—

পল, লু আবার ডাকল, পল কী হয়েছে তোমার?

এখন বড় হচ্ছে, আরো বড়, আরো বড়—পাগলের মতো চিৎকার করতে থাকে পল, আরো বড়, আরো বড়, আরো বড়–

হঠাৎ করে মনিটরে পলের ছবি অদৃশ্য হয়ে যায়, তার গলার স্বর শোনা যাচ্ছিল, সেটাও হঠাৎ থেমে গেল, কয়েক মুহূর্ত অস্বস্তিকর নীরবতা, কি হচ্ছে দেখাও যাচ্ছে না। হুটোপুটি করে কিছু একটা নড়াচড়া করছিল, ক্যামেরাটা একপাশে সরিয়ে নিতেই দেখা গেল, রু-টেক পল কুমকে মেঝেতে চেপে ধরে রেখে একটা ইনজেকশান দিচ্ছে, পল নিস্তেজ হয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে আসতেই রু-টেক উঠে দাঁড়ায়। লু কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছিল রু-টেক?

 

জানি না, হঠাৎ করে মনে হল নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল। তিরিশ মিলিগ্রাম রনিয়াম দিয়ে রেখেছি, চৰ্বিশ ঘন্টা এখন ঘুমিয়ে থাকবে। রু-টেক খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, লু।

বল।

পলের মস্তিষ্কে কি আছে জানি না, কিন্তু যেটাই থাকুক, সেটা আমাদের বের করা উচিত না, আমার মনে হয় আমরা ব্যাপারটি নিয়ন্ত্রণের মাঝে রাখতে পারব না।

 

কেন বলছ এটা রু-টেক, কিছু-একটা কি হয়েছে?

হ্যাঁ।

কি?

যে কয়েক মুহূর্ত ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল, তখন ওর শরীরে একটা অস্বাভাবিক মেটামরফিজম শুরু হয়েছিল।

মানে?

 

অস্বাভাবিক কয়েকটা হরমোন বের হতে শুরু করেছিল, যেটা মানুষের শরীরে থাকার কথা নয়। আমার কাছে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়ার মতো ঠিক যন্ত্রপাতি নেই, কিন্তু যেটুকু দেখেছি মনে হচ্ছে সত্যিই তাই হয়েছে।

সত্যি?

হ্যাঁ। তোমার ঠিক কী পরিকল্পনা জানি না, কিন্তু আমার মনে হয় পলকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মিলি কে তাপমাত্রায় নিয়ে ওর সবরকম শারীরিক প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিতে হবে।

 

ঠিকই বলেছ তুমি রু-টেক। আমি ব্যবস্থা করছি।

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

হ্যাঁ, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। পলকে তো তুমি ঘুম পাড়িয়ে রেখেছ, ঘুম ভাঙার তো কোনো সম্ভাবনা নেই, নাকি আছে?

থাকার কথা নয়, রু-টেক একটু ইতস্তত করে বলল, কিন্তু এখানে কী হতে পারে আর কী না হতে পারে তার আর কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই।

তা ঠিক। ঠিক আছে, আমি প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

দাও।

 

জরুরি সভা বসেছে। গত চবিশ ঘন্টায় অনেক কিছু ঘটেছে, ঘটনাগুলির আকস্মিকতায় সবাই কমবেশি বিভ্রান্ত, ঠিক কী করা উচিত বোঝা সহজ নয়। লু এ অবস্থাতেও মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করছে, ও নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানে যখন জটিল কোনো সমস্যা হয়, তখন সেটার সমাধান একা একা বের করার চেষ্টা করা বড় ধরনের বোকামি। যদি কয়েকজন তীক্ষ্ণবুদ্ধির মানুষ পাওয়া যায়; তাদের সাথে সমস্যাটা আলোচনা করলে অনেক সময় খুব ভালো সমাধান বেরিয়ে পড়ে। লু মোটামুটি ঠিক করেছে কী করবে, সেটি এখন সবার সাথে আলোচনা করে ঠিক করে নিতে চায়। আজকের সভায় কোনোরকম ভনিতা না করে লু সোজাসুজি কাজের কথায় চলে এল, বলল, তোমরা সবাই জান এখানে কি হচ্ছে, আমি কি করতে চাইছি হয়তো জান বা আন্দাজ করতে পারছ। তবু একবার বলে নিই, কারো কোনো আপত্তি বা মতামত থাকলে জানাতে পার। পলের মস্তিষ্কে করে ট্রাইটনের অধিবাসীরা যে-কোডটা পাঠিয়েছে, পল সেটা জানে না, ওর অবচেতন মনে জানতে পারে, কিন্তু সজ্ঞানে সে জানে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে কোডটা জানা তার জন্যে ভালো নয়, সেজন্যে সেটা জানা আমাদের জন্যেও ভালো নয়। আমি ট্রাইটনের অধিবাসীদের পাঠানো কোডটা না জেনেই ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করতে চাই। পলকে সাথে নিয়ে যাওয়ার একটামাত্র উপায়, সেটা হচ্ছে তার শরীরের তাপমাত্রা মিলি কে ডিগ্রিতে নামিয়ে নেয়া। যেহেতু আমরা জানি না পলকে দিয়ে পাঠানো কোডটা ঠিক কী ধরনের, আমি কোনো ঝুঁকি নিতে চাই না। তোমাদের কারো কারো কাছে বাড়াবাড়ি মনে হলেও আমি তাপমাত্রা মিলি কে-তে নিয়ে যেতে চাই।

 

কিম জিবান হাত তুলে বলল, তুমি জান মানুষের শরীরকে মিলি কে তাপমাত্রায় নিতে এবং রাখতে কত শক্তি খরচ হয়?

খানিকটা জানি।

সিসিয়ানে কি এত জ্বালানি আছে?

সিডিসি উত্তর দিল, যদি একটার বেশি হাইপারভাইভ দেয়া না হয়, আর ট্রাইটনের অধিবাসীদের সাথে সরাসরি দীর্ঘকালব্যাপী যুদ্ধে নামা না হয়, আমরা পলকে সম্ভবত এক সপ্তাহের মতো মিলি কে তাপমাত্রায় রাখতে পারব।

লু বলল, হাইপারডাইভ একটার বেশি দেবার প্রয়োজন হবে না, আর ট্রাইটনের সাথে যুদ্ধে নামার আমার কোনো ইচ্ছা নেই।

 

কিন্তু যদি নামতে হয়, কিম জিন মুখ শক্ত করে বলল, যদি আমাদের কোনো উপায় না থাকে?

তা হলে নামব, কিন্তু সেটা দীর্ঘস্থায়ী হবে না, আমি তোমাকে লিখে দিতে পারি। সমান ক্ষমতায় যুদ্ধ হয়, অসমান ক্ষমতার যুদ্ধ খুব ক্ষণস্থায়ী। আমি সে-যুদ্ধে নামতে চাই না। কারো কিছু বলার আছে?

কেউ কিছু বলল না, লু মুখ ফুটে ট্রাইটনের অধিবাসীদের অচিন্তনীয় ক্ষমতার কথা উল্লেখ করে সবার মনকে দুর্বল করে দিয়েছে, হঠাৎ করে সবাই অনুভব করে তারা কত অসহায়।

 

সিডিসি পল কুমের শরীরকে মিলি কে তাপমাত্রায় নিয়ে নেয়ার দায়িত্ব নিয়ে নেয়, বিশেষ ধরনের হিলিয়াম কমপ্রেশার, তাপ নিরোধক ক্যাপসুল ইত্যাদি পাঠানোর ব্যবস্থা করতে থাকে। পলকে মিলি কে তাপমাত্রায় নিয়ে বিশেষ ক্যাপসুলে করে সিসিয়ানে ফিরিয়ে আনা হবে। কিম জিবান সিডিসিকে সাহায্য করতে থাকে। রটেককে আনার প্রয়োজন নেই, তার মেমোরিকে সিসিয়ানে পাঠিয়ে সেটা একটা নূতন কপোট্রনে করে নূতন একটা রবোটের শরীরে জুড়ে দেয়া হবে। কাজটি সহজ, নীষা নিজে থেকে সে-দায়িত্ব নিয়ে নিল।

 

লু নিজের ঘরে ফিরে এসে দেখে নীষা তার ঘরে অপেক্ষা করছে। লু একটু অবাক হয়ে বলল, কী ব্যাপার নীষা, তুমি কি আমাকে কিছু বলবে?

হ্যাঁ। জিনিসটা হয়তো খুবই হাস্যকর, তবু না বলে পারছি না।

নীষা, এখানে সবকিছু এত অবাস্তব যে কোনো কিছুই আর হাস্যকর নয়। কি বলবে?

পল বলেছিল লাল গোলাকার বৃত্তের কথা। তুমি দেখেছ ট্রাইটনের উপর গোলাকার বৃত্ত আছে, সেগুলির রং বেশ লালচে।

হ্যাঁ, কিন্তু—

এমন কি হতে পারে না যে, পল এই বৃত্তগুলির কথা বলেছে?

কিছুই অসম্ভব নয়, খুবই সম্ভব সেটা। তবে পল তিনটি বৃত্তের কথা বলেছিল, ট্রাইটনের উপর বৃত্ত রয়েছে দু’টি, যে জন্যে এটাকে দেখতে একজোড়া চোখের মতো মনে হয়।

তা ঠিক, নীষা মাথা নাড়ে, পল তিনটি বৃত্তের কথা বলেছিল, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। পল বলেছিল লাল বৃত্ত, এগুলি লালচে কিন্তু ঠিক লাল বলা যায় না। কেমন পচা ঘায়ের মতো রং।

লু একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, যাও নীষা, গিয়ে একটু বিশ্রাম নাও, যতদূর সম্ভব শক্তি বাচিয়ে রাখ।

হ্যাঁ, যাই।

 

নীষা বিদায় নেয়ার পর লু একটু বিশ্রাম নেবে বলে ঠিক করল। শোয়ার আগে সে রু-টেকের সাথে একবার কথা বলে নিল। সিডিসি হিলিয়াম কমপ্রেশার পাঠিয়ে দিয়েছে। পলের শরীর কালো একটা স্টেনলেস স্টিলের ক্যাপসুলের ভিতর রাখা হয়েছে। খুব ধীরে ধীরে এখন তাপমাত্রা কমিয়ে আনা হচ্ছে। তাপমাত্রা খুব তাড়াতাড়িও কমানো যায়, জরুরি অবস্থায় মাইক্রো সেকেন্ডে কমানোর নজির আছে, তবে তাতে বিপদের ঝুঁকি অনেক বেশি, নেহায়েৎ বাড়াবাড়ি প্রয়োজন না হলে সেটা করা হয় না। পলের শরীরের তাপমাত্রা এখন শূন্যের নিচে চার ডিগ্রি, মিনিটে এক ডিগ্রি করে নেমে আসছে। আর ঘন্টাখানেকে পুরোপুরি নেমে যাবে, লু এই এক ঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে নেবে বলে ঠিক করল।

 

শুয়ে থাকতে থাকতে একসময়ে লু ঘুমিয়ে পড়েছিল, ওর ঘুম ভাঙল জরুরি বিপদ সংকেতের শব্দে, লাফিয়ে উঠে বসে সে, কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, সিডিসি, কি হয়েছে?, ট্রাইটনে কিছুক্ষণ হল তৃতীয় একটা বৃত্ত দেখা দিয়েছে এবং বৃত্তগুলির রং ধীরে ধীরে গাঢ় লাল হয়ে উঠছে। এখন খালি চোখে আপনারা বুঝতে পারবেন না, কিন্তু বৃত্তগুলি আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে।

 

নীষা তা হলে ঠিকই আন্দাজ করেছিল।

জ্বি।

সিডিসি, এটার মানে কী জান?

ঠিক জানি না, তবে আন্দাজ করতে পারছি। পল কুমকে ট্রাইটনের অধিবাসীরা যেকোডটা দিয়েছে, সেটা এখন পলের কার্যকর করার কথা। পল সম্ভবত এই সংকেতের জন্যে অপেক্ষা করছিল।

লু ঘড়ি দেখে বলল, পলের তাপমাত্রা এতক্ষণে মিলি কের খুব কাছাকাছি চলে গেছে, তাকে দিয়ে ট্রাইটনের অধিবাসীরা এখন কিছুই করতে পারবে না। সিডিসি, তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখানে নিয়ে এস, হাইপারডাইভ দিতে হবে।

সিডিসি কিছু বলল না, লু একটু অধৈর্য হয়ে বলল, কি হল, তুমি কোনো কথা বলছ না কেন?

 

আমি দুঃখিত লু, রু-টেক এইমাত্র আমাকে জানাল, পলের শরীরের তাপমাত্রা আস্তে আস্তে বেড়ে উঠছে, তাকে আর শীতল করা যাচ্ছে না।

কন্ট্রোলরুমে সবাই এসে হাজির হয়েছে, বড় মনিটরটিতে স্কাউটশিপের ভিতরটক দেখা যাচ্ছিল। র-টেকাকে সেখানে দেখা যাচ্ছে, সে উবু হয়ে একটা মিটারকে লক্ষ করছে, মুখ চিন্তাক্লিষ্ট। লু আসতেই সবাই একটু সরে তাকে জায়গা করে দেয়। লু কিম জিবানের দিকে তাকিয়ে বলল, কিম, তুমি হাইপারড়াইত দেবার জন্যে প্রস্তুত হও।

 

এখনি?

হ্যাঁ এক সেকেন্ডের কম সময়ের নোটিশে তোমাকে হাইপারডাইভ দিতে হতে পারে।

বেশ।

কিম জিবান হেটে কন্ট্রোলরুমের অন্য পাশে গিয়ে হাইপারভাইভের কন্ট্রোলটি খুলে বসে। লু মনিটরটি থেকে চোখ না সরিয়ে অন্যদের উদ্দেশ করে বলল, তোমরা মনিটরের আশেপাশে থাকতে চাইলে থাকতে পার, কিন্তু এক সেকেণ্ডের নোটিশে আমাদের হাইপারডাইভ দিতে হতে পারে, কাজেই আগে নিজেদের জায়গা ঠিক করে এস, শেষ মুহূর্তে যেন দেরি না হয়ে যায়।

 

হাইপারভাইভ দেয়ার সময়ে, স্থির সময়ের ক্ষেত্রে প্রবেশ করার ঠিক আগের মুহূর্তে ভরবেগের সাম্যতা রক্ষার জন্যে প্রচণ্ড শক্তিক্ষয় হয়, তাতে যে-কম্পনের সৃষ্টি হয়, সেটি ভয়ংকর। এই সিসিয়ানেই একবার একজন অসতর্ক বিজ্ঞানীর মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছিল। সেজন্যে হাইপারডাইভ দেয়ার আগে সবসময়েই বিশেষ আসনে নিজেদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নিতে হয়। লু মনিটরের সামনের চেয়ারটিতে নিজেকে শক্ত করে আটকে নেয়, অন্যেরাও নিজেদের আসনে সবকিছুর ব্যবস্থা করে মনিটরটিকে ঘিরে দাঁড়ায়। লু কয়েক মুহূর্ত রু– টেককে লক্ষ করে বলল, রু-টেক, আমি লু বলছি।

 

কথা শুনে রু-টেক ঘুরে দাঁড়ায়, ওর মুখে ক্লান্তির ছাপ, চোখে বোবা আতঙ্ক।

কি হয়েছে রু-টেক?

পলের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, কিছুতেই কমিয়ে রাখা যাচ্ছে না। হিলিয়াম কম্প্রেশারটির বারটা বেজে যাচ্ছে, আর কতক্ষণ টিকে থাকবে, জানি না। তুমি যদি বল চেষ্টা করে যেতে পারি, কিন্তু কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না।

আমার কেন জানি মনে হচ্ছে চেষ্টা করে লাভ নেই। তুমি নিশ্চয়ই দেখেছ ট্রাইটনে এখন তিনটা লাল বৃত্ত দেখা দিয়েছে, ঠিক যেরকম পল বলেছিল।

 

দেখেছি।

পলের মস্তিষ্কে যে কোডটা পাঠানো হয়েছে, এখন সম্ভবত আমরা সেটা জানতে পারব।

সম্ভবত।

মনে হচ্ছে কোডটা কী, দেখা ছাড়া আমাদের আর অন্য কোনো উপায় নেই। পল মনে হয় জ্ঞান ফিরে পাবেই, তাকে শীতল রাখার কোনো রাস্তা দেখছি না।

না।

কাজেই সে চেষ্টা না করে তাকে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় নিয়ে এস, দেখা যাক কি হয়।

বেশ।

 

আর শোন রু-টেক, অবস্থা আমাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে চাইলে আমরা সম্ভবত হাইপারভাইভ দেব, তুমি প্রস্তুত থেকো। এক মিনিটের নোটিশে তোমাকে তোমার পুরো মেমোরি সিডিসির কাছে পাঠাতে হতে পারে।

আমার মিলি সেকেন্ডের বেশি সময় লাগবে না।

চমৎকার! আর শোন, ভয়ের কিছু নেই, তুমি ঘাবড়ে যেও না। এখন ইচ্ছে করলে তুমি তোমার ভয়ের সুইচটা বন্ধ করে দিতে পার, কি বল?

হ্যাঁ, আমিও তাই ভাবছিলাম।

রু-টেক মাথার পিছনে কোথায় হাত দিয়ে কী-একটা সুইচ বন্ধ করে দিতেই তার ভিতর থেকে ভয়ের ভাবটা সরে যায়। হালকা স্বরে বলে, পলের তাপমাত্রা কেমন বেড়ে উঠছে দেখেছ? আর মিনিট দশেকে জ্ঞান ফিরে পাবে মনে হচ্ছে। ক্যাপসুল থেকে বের করে ফেলি, কি বল? জ্ঞান ফিরে যদি দেখে অন্ধকার কবরে শুয়ে আছে, খামোক ভয় পাবে। এমনিতে ভীত মানুষ, ভয় পেয়ে কী না কী করে ফেলবে কে জানে। রু-টেক দুলে দুলে হাসতে শুরু করে।

 

লুয়ের একটু হিংসা হয়, সেও যদি রু-টেকের মতো তার ভয়ের সুইচটা বন্ধ করে দিতে পারত।

পলকে কালো সিলিন্ডারের ভিতর থেকে বের করে আনা হয়েছে। তার শরীরের নানা জায়গায় নানা ধরনের সেন্সর লাগানো, মাথার কাছে নীল মনিটরে এখনো জীবনের কোনো স্পন্দন দেখা যাচ্ছে না। সবাই রুদ্ধশ্বাসে বসে আছে। কন্ট্রোলরুমে একটা লাল বাতি সেকেন্ডে একবার জ্বলে উঠে সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছে সিসিয়ান হাইপারডাইভ দেবার জন্যে প্রস্তুত।

 

ট্রাইটনে তিনটি লাল বৃত্ত বড় হয়ে একটা লাল বৃত্ত হয়ে যেতেই পলের ভিতরে পরিবর্তনের চিহ্ন দেখা যায়, তার হৃৎস্পন্দন শুরু হয়ে ধীরে ধীরে মস্তিষ্কে রক্তসঞ্চালন বাড়তে থাকে। রক্তচাপ বাড়তে বাড়তে একসময়ে স্থির হয়ে আসে।

সবাই চুপচাপ বসে ছিল। রু-টেক নীরবতা ভেঙে বলল, পলের শরীরে আশ্চর্য কিছু পরিবর্তন হচ্ছে।

কি রকম পরিবর্তন?

তার ফুসফুসে একটা জখম ছিল, আমি অস্ত্রোপচার করে মোটামুটি ঠিক করে দিয়েছিলাম, সারতে মাসখানেক সময় নিত। জখমটা এখন সেরে যাচ্ছে।

মানে! লু অবাক হয়ে বলল, সেরে যাচ্ছে মানে?

 

রু-টেক হেসে বলল, সেরে যাচ্ছে মানে বোঝ না? যেটা ভালো হতে একমাস সময় নেবার কথা সেটা কয়েক মিনিটে ভালো হয়ে যাচ্ছে। আরো শুনবে? ওর পাঁজরের যে হাড়টা ভেঙে গিয়েছিল সেটা জোড়া লেগে গেছে। শুধু তাই না, ওর মাংসপেশীতেও কিছু-একটা হচ্ছে, যার জন্যে সেটার ভিতরে এখন প্রচণ্ড শক্তি থাকার কথা। রক্তে লোহিত কণিকা বেড়ে গেছে অনেক, সব মিলিয়ে বলা যায় ওর শরীরে যেন একটা চমৎকার ওভারলিং হল। তোমরাও কেউ যাবে নাকি ট্রাইটনে, নবযৌবন ফিরে পাওয়া যায় মনে হচ্ছে!

 

রু-টেক শব্দ করে হাসে, কিন্তু তার রসিকতাটুকু কেউ উপভোগ করতে পারল বলে মনে হল না। লু গম্ভীর মুখে বলল, পল জ্ঞান ফিরে পেলে জানিও।

ট্রাইটনের বড় বৃত্তটি যখন ছোট হতে শুরু করে ঠিক তখন পল কুমের জ্ঞান ফিরে আসে। চোখ খুলে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে সে, রু-টেক তার উপর ঝুকে পড়ে বলল, কেমন আছ পল?

পল তার কথার উত্তর দেয় না, শুনতে পেয়েছে সেরকম মনে হল না।

পল, রু-টেক আবার ডাকে, পল, শুনতে পাচ্ছ আমার কথা?

পল খুব ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে।

কেমন লাগছে এখন তোমার?

পল নির্লিপ্তর মতো বলল, ভালো।

ওর গলার স্বর শুনে সবাই কেমন জানি শিউরে ওঠে, প্রাণহীন ধাতব আশ্চর্য একটা স্বর।

রু-টেক হালকা গলায় বলল, তুমি জান, তোমার শরীরে যেসব জখম ছিল সব ভালো হয়ে যাচ্ছে?

 

পল আবার মাথা নাড়ে।

তুমি জান, সেটা কেমন করে হয়েছে?

পল খুব ধীরে ধীরে রু-টেকের দিকে তাকায়, খানিকক্ষণ তার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, জানি।

আবার সেই শুস্ক ধাতব গলার স্বর।

লু তখন কথা বলে, কেমন করে হয়েছে পল?

পল তার উত্তর না দিয়ে আশ্চর্য একটা অশরীরী শব্দ করে। লু অবাক হয়ে বলল, তুমি কী বললে পল?

পল তার কথার উত্তর না দিয়ে শূন্যদৃষ্টিতে উপরের দিকে গকিয়ে থাকে। লু চিন্তিত মুখে সিডিসিকে জিজ্ঞেস করল, সিডিসি, তুমি বুঝতে পারলে পল কী বলেছে?

পেরেছি, ওটা ভিন্ন ভিন্ন শব্দতরঙ্গের পারস্পরিক উপস্থাপন, সেটাকে বিশ্লেষণ করলে তার মানেটা হয় অনেকটা এরকম, পৃথিবীর মানুষ, আমাকে নিয়ে যাও।

 

মানে?

ট্রাইটনের কোনো অধিবাসী সম্ভবত আমাদের সাথে পৃথিবীতে যেতে চাইছে। লু মুখ শক্ত করে বলল, না, আমরা এখন কাউকে নিতে পারব না।

পল হঠাৎ করে উঠে বসে, তারপর ঘুরে লু’য়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি এখন সিসিয়ানে আসব।

না।

পল লু’য়ের কথা শুনতে পেল বলে মনে হল না, আপন মনে বিড়বিড় করে বলল, সময় হয়েছে, আমাকে এক্ষুণি আসতে হবে।

না, লু শান্ত সুরে বলল, তুমি এভাবে আসতে পারবে না, তোমাকে মিলি কে তাপমাত্রায় না নামিয়ে আমি এখানে আসতে দেব না।

পল ল’য়ের দিকে তাকিয়ে আবার আশ্চর্য একটা শব্দ করে। সিভিসি মৃদু স্বরে সেটা অনুবাদ করে দিল, নির্বোধ মানুষ, আমাকে তোমার নিতে হবে।

লু আস্তে আস্তে বলল, সবাই নিজের জায়গায় যাও, আমরা এখন হাইপারডাইত দেব।

 

মনিটরে পলের চেহারা দেখা যাচ্ছিল, সেখানে খুব সূক্ষ্ম একটা পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তনটা ঠিক কী, বলা যাচ্ছে না, কিন্তু দেখে কেমন জানি অস্বস্তি হয়। লু একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, পল, আমার কথার উত্তর দাও, তুমি কেন সিসিয়ানে আসতে চাও?

 

পল ধাতব একটা শব্দ করে, সিডিসি অনুবাদ করে দেবার আগেই লু বলল, পল, তোমাকে উত্তর দিতে হবে, তুমি কেন এখানে আসতে চাও?

আমার প্রভু বলেছে।

কে তোমার প্রভু?

পল কথার উত্তর না দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, ল’য়ের কথা শুনতে পেয়েছে বলে মনে হল না। লু আবার জিজ্ঞেস করে, তোমার প্রভু কে পল, কী চায় সে?

পল আবার একটা ধাতব শব্দ করে, এদ্ধ জল্লুর আস্ফালনের মতো শোনাল শব্দটা। লু সিডিসিকে জিজ্ঞেস করে, কী বলল সিডিসি?

বলেছে, তার প্রভুর বংশধরকে নিয়ে যেতে হবে।

বংশধর?

হ্যাঁ।

লু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি দুঃখিত পল, তোমাকে আমরা রেখে যাচ্ছি, আবার তোমাকে নিতে আসব। সিডিসি, তুমি হাইপারডাইভ দেবার জন্যে প্রস্তুত?

প্রস্তুত।

কিম জিবান?

প্রস্তুত।

রু-টেক, তোমার মেমোরি পাঠিয়ে দাও।

দিচ্ছি।

মুহূর্তে রু-টেকের মেমোরি চলে আসে সিডিসির মেমোরি ব্যাংকে, সাথে সাথে ব্লু-টেকের ধাতব শরীর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আছড়ে পড়ে স্কাউটশিপের ভিতরে।

লু শান্ত গলায় বলল, কিম, হাইপারডাইভ দাও।

 

সিসিয়ানের প্রচণ্ড শক্তিশালী ইঞ্জিন গুঞ্জন করে ওঠে, নীলাভ আলো ছড়িয়ে পড়ে ভিতরে। কিছুক্ষণেই ওরা চলে যাবে স্থির সময়ের ক্ষেত্রে, নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করে সবাই। কিম জিবান সাবধানে একটা একটা করে সুইচ নিজের দিকে টেনে আন। শেষ সুইচটা চেপে ধরে সে বড় স্টিয়ারিংটা ঘুরিয়ে দেয়, সাথে সাথে শরীর টানটান করে সবাই অপেক্ষা করতে থাকে প্রচণ্ড ঝাঁকুনির জন্যে। সিসিয়ান একবার দলে উঠে হঠাৎ স্থির হয়ে যায়। লু সাবধানে মাথা ঘুরিয়ে তাকায় কিম জিবানের দিকে, হঠাৎ বিদ্যুৎ ঝলকের মতো প্রচণ্ড আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে যায় ওর। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কিম জিবানের সামনে হাইপারডাইরে পুরো কন্ট্রোল প্যানেল ছিটকে উঠেছে। কালো ধোঁয়ায় ভরে যায় সিসিয়ান। কিম জিবান ছিটকে পড়েছে একপাশে, পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু যেটুকু দেখা যাচ্ছে, সেটুকু রক্তে অতবিক্ষত।

 

নিজেকে চেয়ার থেকে মুক্ত করতে করতে সিডিসির গলা শুনতে পেল, হল না। হাইপারডাইভ দেয়া হল না। ট্রাইটনের অধিবাসীরা আটকে দিয়েছে আমাদের, জ্যাম করে দিয়েছে ফিডব্যাক।

লুয়ের সাথে সাথে সবাই ছুটে আসে কিম জিবানের দিকে। লু সাবধানে তাকে ধরে বসানোর চেষ্টা করে। সুশান মেডিক্যাল কিট খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করল, কিম, কেমন আছ কিম?

অনেক কষ্টে কিম লল, এখনো মরি নি।

সুশান জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে আনে, তা হলে আর মরবে না। দেখি তোমাকে একর।

দক্ষ হতে পরীক্ষা করে সুশান বলল, বড় ধরনের আঘাত পেয়েছ তুমি, কেটেছড়ে গেছে, হয়তো নড়তে চড়তে কষ্ট হবে কয়দিন, কিন্তু কিছু হয় নি তোমার, ভালো হয়ে যাবে।

 

কিম একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, কী দুঃখের কথা! মরে গেলেই মনে হয় ভালো ছিল।

কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলে না। লু একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সিডিসি, এদিককার খবর কি?

খবর বেশি ভালো নয়। ট্রাইটনের অধিবাসীরা এমনভাবে ফিডব্যাকটা জ্যাম করেছে যে সিসিয়ানের ভালো রকম ক্ষতি হয়েছে। সিসিয়ানকে ঠিক না করা পর্যন্ত আর হাইপারভাইভ দেয়া যাবে না।

 

পলের কী খবর?

সে স্কাউটশিপে রওনা দিয়েছে, কিছুক্ষণেই পৌঁছে যাবে এখানে।

লু’য়ের সাথে সাথে সবাই মনিটরটির দিকে তাকায়। পলকে দেখা যাচ্ছে, অনেকটা অনামন ভঙ্গিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে, দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটা খুব অদ্ভুত, অনেকটা দ্বিধাগ্রস্ত মানুষের মতো, যেন বুঝতে পারছে না কী করবে। কিন্তু একই সাথে ওর সারা শরীর কী একটা অজানা আশঙ্কায় যেন টানটান হয়ে আছে। পুরো দৃশ্যটাতে একটা অমঙ্গলের ছায়া, দেখে বুক কেঁপে ওঠে।

 

লু সিডিসিকে উদ্দেশ করে বলল, সিডিসি, মহাকাশকেন্দ্রে একটা খবর পাঠানো যাবে? জরুরি অবস্থার জন্যে যে চ্যানেলটা থাকে সেটা দিয়ে—

আমি দুঃখিত লু, সিডিসি বাধা দিয়ে বলল, আমরা এখন কারো সাথেই যোগাযোগ করতে পারব না। ট্রাইটনের অধিবাসীরা সবগুলি চ্যানেল জ্যাম করে রেখেছে।

লু খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, সিডিসি, তোমাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করি?

আমি বুঝতে পারছি ভূমি কী জিজ্ঞেস করতে চাইছ, সিডিসি আস্তে আস্তে বলল, আমি দুঃখিত লু, কিন্তু সেটাও আর করা সম্ভব নয়।

 

সত্যি?

সত্যি।

নীষা একটু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, কী জানতে চাইছ লু?

লু একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, খুব কাপুরুষের একটা কাজ। জানতে চাইছিলাম সিসিয়ানকে উড়িয়ে দেয়া যায় কি না, সব মহাকাশযানেই খুব সহজে পুরোটা ধ্বংস করার একটা ব্যবস্থা থাকে জান তো?

আমাদেরটা নিশ্চয়ই ট্রাইটনের অধিবাসীরা জাম করে দিয়েছে।

নীষ কিছু না বলে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়, ট্রাইটনের অতিকায় লাল বৃত্তটা এখন দুত ছোট হচ্ছে, ছোট হয়ে আবার বড় হবে, তারপর আবার ছোট হবে, ঠিক যেরকম পল বলেছিল।

পল আসছে। এসে সে কী করবে?

 

প্রভু ট্রাইটন

স্কাউটশিপটা সিসিয়ানের ডকে এসে থামল। দরজা আটকে যাওয়ার পরিচিত শব্দ হল প্রথমে, বাতাসের চাপ এক হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করে ওরা, তারপর দরজা খুলে যায়। প্রথমে টাইটেনিয়ামের দরজা, তারপর সিলঝিনিয়ামের দরজা, সবশেষে স্বচ্ছ প্লেক্সি গ্লাসের দরজা। দরজার কাছে এসে দাঁড়ায় পল, দেখে শিউরে ওঠে সবাই। তাকে এখন আর চেনা যায় না, আশ্চর্য পরিবর্তন হয়েছে ওর। সারা মুখের চামড়া টানটান হয়ে আছে, দেখে মনে হয় কেউ যেন তাকে ঝলসে দিয়েছে আগুনে, শরীরের চামড়া যেন ছোট হয়ে আর তাকে ঢাকতে পারছে না, দাঁতগুলি বেরিয়ে আসতে চাইছে মুখ থেকে। শরীরের রঙে কেমন যেন নীলচে একটা ধাতব ভাব এসে গেছে। পল যখন হেঁটে হেঁটে এগিয়ে এল, সবাই দেখল তার হাঁটার ভঙ্গি সম্পূর্ণ অন্য রকম, দেখে মনে হয় যেন মানুষ নয়, একটা অর্থহীন যন্ত্র।

 

কারো দিকে না তাকিয়ে পল সোজা হেঁটে যাচ্ছিল, লু ওকে একবার ডাকল। পল কিছু শুনতে পেল মনে হল না, লু তখন আবার গলা উঁচিয়ে ডাকল। পল হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়, তারপর খুব ধীরে ধীরে ঘুরে লু’য়ের দিকে তাকায়। তার নিস্পলক দৃষ্টি দেখে হঠাৎ এক অবর্ণনীয় আতঙ্কে লু’য়ের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চাইল, তবু সে সাহস করে ডাকল, পল, আমাকে চিনতে পারছ, আমি লু।

 

পল লু’য়ের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে, লু তখন একটু এগিয়ে এসে বলল, পল কথা বল তুমি, আমি ল, সিসিয়ানের দলপতি।

একটা ধাতব শব্দ হল হঠাৎ, ঠোট না নড়িয়ে আশ্চর্য শব্দ করা শিখেছে পল। সিডিসি অনুচ্চ স্বরে বলল, সাবধান লু, তোমাকে আর এগুতে নিষেধ করছে।

 

লু তবু এক পা এগিয়ে যায়, গলার স্বরে একটা অনুনয়ের সুর এনে বলল, পল, কিছু-একটা বল, এভাবে দাঁড়িয়ে থেকো না।

পল হঠাৎ আশ্চর্য ক্ষীপ্রতায় ওকে ধরে ফেলে, তারপর কেউ কিছু বোঝার আগেই প্রচণ্ড জোরে ছুড়ে দেয় একপাশে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে চোখে অন্ধকার দেখে লু, কষ্ট হয় ওর নিঃশ্বাস নিতে। সবাই ছুটে আসছিল, লু হাত তুলে খামতে ইঙ্গিত করে তাদের। চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নেয় কয়েকবার, তারপর শুকনো ঠোঁট জিব দিয়ে একটু ভিজিয়ে নিয়ে বলল, পল, তুমি কেন এমন করলে?

 

আবার আশ্চর্য একটা শব্দ করল পল।

তুমি আমাদের সাহায্য করবে না পল? তুমি তো আমাদেরই একজন।

পল তবু কিছু বলে না।

কিছু-একটা বল, লু অনুনয় করে বলে, আমি জানি তুমি আমার কথা বুঝতে পারছ।

পল আবার একটা শব্দ করে।

লু কষ্ট করে উঠে দাঁড়িয়ে, খুড়িয়ে খুঁড়িয়ে কয়েক পা এগিয়ে যায়, কাছে গিয়ে সে হঠাৎ সবাইকে অবাক করে পলের দুই হাত আঁকড়ে ধরে বলল, পল, তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?

 

পল ধীরে ধীরে নিজের বাম হাত তুলে লু’য়ের কাপড় ধরে নিজের দিকে টেনে আনতে থাকে। লু কাতর স্বরে বলল, পল, একটা কথা বল।

পল খুব ধীরে ধীরে প্রায় শোনা যায় না এমনভাবে বলল, কষ্ট, অনেক কষ্ট।

কেন পল, কিসের কষ্ট?

ল’য়ের কথার উত্তর না দিয়ে পল বলল, তোমাদের অনেক বড় বিপদ।

কেন?

অনেক কষ্ট, পল নিজের মুখ বিকৃত করে যন্ত্রণাকাতর স্বরে বলল, অনেক কষ্ট আমার, আমাকে মেরে ফেল তোমরা, দোহাই তোমাদের।

 

পলের শরীর কাঁপতে তাকে, হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে সে। লু তাকে ধরার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। পল দু হাতে মুখ চেপে ধরে গোঙানোর মতো শব্দ করে।

পল, লু মাথা নামিয়ে বলল, কেন তোমার এত কষ্ট? কোথায় তোমার কষ্ট?

মাথায়। আমাকে মেরে ফেল। দোহাই তোমাদের!

পল, তুমি ট্রাইটনের প্রাণীদের দেখেছ?

পল মাথা নাড়ে।

কেমন দেখতে তারা? কী করে তারা?

তারা নয়, পল মাথা নাড়ে, তারা মাত্র একজন।

মাত্র একজন? অবিশ্বাসের স্বরে বলে, মাত্র একজন?

হ্যাঁ।

কেমন দেখতে সে?

তোমরা দেখেছ তাকে।

দেখেছি?

হ্যাঁ।

কখন দেখেছি?

সে ট্রাইটন।

ট্রাইটন?

হ্যাঁ।

মানে গ্রহটা?

হ্যাঁ।

পুরো গ্রহটা একটা প্রাণী?

হ্যাঁ।

কয়েক মুহূর্ত কেউ কথা বলতে পারে না। ল’য়ের পেটের ভিতরে কী-যেন একটা পাক দিয়ে ওঠে, ভয়ের একটা কাঁপুনি যেন মেরুদণ্ড দিয়ে বেয়ে যায়।

 

তোমাদের অনেক বড় বিপদ। ট্রাইটনের বংশধরকে তোমাদের সাথে নিতে হবে।

সে কোথায়?

পল হঠাৎ দু’ হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করে বলল, আমাকে মেরে ফেল তোমরা, দোহাই তোমাদের!

সুশান এগিয়ে এসে পলের হাত ধরে, তোমাকে ত্রিশ মিলিগ্রাম রনিয়াম দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেব পল, কোনো ভয় নেই তোমার।

পল মাথা নাড়ে, আমাকে কেউ ঘুম পাড়াতে পারবে না। আমার মাথায় যন্ত্রণা–

কে বলেছে, এই দেখ তুমি। সুশান মেডিকেল কিট থেকে লম্বা সিরিঞ্জ বের করে রনিয়াম টেনে নিতে থাকে।

আমার মনে হয় পল সত্যি কথাই বলছে।

 

রু-টেকের গলার স্বর শুনে সবাই ঘুরে তাকায়, সে স্কাউটশিপ থেকে কখন বের হয়ে এসেছে কেউ লক্ষ করে নি। হাইপারডাইভ দেবার সময় তার মেমোরিকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল, সিডিসি নিশ্চয়ই আবার সেটা ফিরিয়ে দিয়েছে। রু-টেক সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বলল, আমার মনে হয় না তুমি ওকে ঘুম পাড়াতে পারবে সুশান।

 

কেন?

পল এখন আর পল নেই।

সে তাহলে কী?

খানিকটা মানুষ, খানিকটা যন্ত্র, খানিকটা ট্রাইটনের অংশ।

কী বলছ তুমি।

আমি দুঃখিত সুশান, কিন্তু আমি সত্যি কথাই বলছি।

সুশান একটু দ্বিধা করে বলল, তাহলে আমি এখন কী করব?

আমি জানি না সুশান। তবে সত্যি যদি পলের কথামতো—

পলের কথামতো কী?

রু-টেক বিব্রত স্বরে বলল, আমার নিশ্চয়ই মাথার ঠিক নেই, আমি পলের মৃত্যুচিন্তা করছিলাম।

কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলতে পারে না, সুশান একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, না রু-টেক, আমি পারব না। এরকম একটা জিনিস আমি চিন্তাও করতে পারব না।

জানি, আমি রবোট বলেই হয়তো পেরেছি।

সুশান কোনো কথা না বলে পলের উপর ঝুঁকে পড়ে তার একটা হাত টেনে নেয় ইনজেকশান দেবার জন্যে, সাথে সাথে ভুরু কুঁচকে যায় তার। লু উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, কি হয়েছে সুশান?

পলের শরীর এত ঠান্ড্রা কেন? ও কি–

সিভিসি অনু সুরে বলল, আমি দুঃখিত সুশান, পল আর বেঁচে নেই। একটু আগে তার মস্তিষ্কে প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছিল, মারা গেছে প্রায় সাথে সাথে।

 

কেউ কোনো কথা বলে না, সুশান আস্তে আস্তে পল কমের হাতটি সাবধানে নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ায়। হাতের লম্বা সিরিঞ্জটি নিয়ে কী করবে ঠিক বুঝতে পারে না, অন্যমনস্কভাবে সিরিঞ্জের ভিতরে কমলা রঙের তরলটির দিকে তাকিয়ে থাকে। ধীরে ধীরে তার চোখ পানিতে ভিজে আসতে থাকে। প্রাণপণ চেষ্টা করেও চোখের পানি আটকাতে পারে না, হাতে-ধরে রাখা সিরিটি তার চোখের সামনে আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে আসে।

 

মহাকাশযানের নিয়মানুযায়ী কান্না হচ্ছে চতুর্থ মাত্রার অপরাধ, সিডিসি তবু কাউকে সেটা মনে করিয়ে দিল না।

লু নিজের ঘরে মাথা টিপে ধরে বসে আছে, অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, সিডিসি।

বলুন।

আমরা এখন কী করব?

আমি খুব দুঃখিত, কিন্তু অপেক্ষা করা ছাড়া সত্যি কিছু করার নেই।

কিসের জন্যে অপেক্ষা করব?

আমি জানি না।

কিন্তু ট্রাইটনের নিশ্চয় কোনো পরিকল্পনা আছে, পলকে পাঠিয়েছে সে।

কিন্তু পল তো তার পরিকল্পনা কাজে লাগাতে পারে নি, বেচারা তো কিছু করার আগেই মারা গেল।

তা ঠিক, কিন্তু পরিকল্পনা নিশ্চয়ই আছে একটা।

খানিকক্ষণ কোনো কথা নেই। একটু পর সিডিসি আস্তে আস্তে বলল, তোমাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করব লু?

কর।

তুমি কী ভাবে বুঝতে পেরেছিলে পল আবার আগের মতো কথা বলবে?

জানি না। যখন আমার দিকে তাকাল তখন ওর নিষ্পলক দৃষ্টির ভিতরেও কোথায় জানি দেখা যাচ্ছিল আমাদের পলকে, প্রত্যেকবার আমি ওকে অনুনয় করছিলাম আর দেখছিলাম ওর দৃষ্টিতে একটু একটু করে পল ফিরে আসছিল।

 

তোমরা, মানুষেরা খুব আশ্চর্য! আমি সারা জীবন চেষ্টা করেও কখনো বুঝতে পারব না।

অবাক হবার কিছু নেই সিডিসি, মানুষ নিজেরাও কখনো মানুষকে বুঝতে পারে না।

সত্যিই তাই। মানুষের জীবন তাই এত সুন্দর। হাদি সবকিছু সবাই বুঝে ফেলত, বেঁচে থাকার কোনো অর্থই থাকত না তাহলে।

পলের মৃত্যুটা সবাইকে খুব ভেঙে দিয়েছে সিডিসি।

হ্যাঁ। বিশেষ করে সুশান, এমনিতে ওর মনটা খুব নরম। এ-ধরনের ব্যাপারের জন্যে একেবারেই সে তৈরি হয় নি।

কী করছে সে এখন?

সিডিসি এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, ও এখন দ্বিতীয় স্তরে নেমে যাচ্ছে, সম্ভবত পল কুমের মৃতদেহের পাশে গিয়ে একটু বসবে।

লু একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বেচারি!

 

পলের দেহটা রাখা হয়েছে দ্বিতীয় স্তরের একেবারে শেষ ঘরটিতে। স্টেনলেস স্টিলের কালো একটা ক্যাপসুলের ভিতরে, শূন্যের নিচে আশি ডিগ্রি তাপমাত্রায়। নির্জন অন্ধকার একটা ঘরে। সুশান বুকের ভিতরে কেমন একটা শূন্যতা অনুভব করে, এক সপ্তাহ আগেও কি কেউ জানত, পলের এরকম একটা পরিণতি হবে?

 

সুশান সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসে। পলের মৃতদেহটি যে-ক্যাপসুলে আছে সে খানিকক্ষণ তার পাশে বসে থাকবে। ব্যাপারটি পুরোপুরি অর্থহীন, কিন্তু সবকিছুরই কি অর্থ থাকতে হয়?

কালো স্টেনলেস স্টিলের একটা ক্যাপসুল, হাত দিয়ে স্পর্শ করে দেখে, মসৃণ পৃষ্ঠে নিষ্করুণ শীতলতা। সুশান ফিসফিস করে বলল, পল কুম, তোমাকে আমরা ভুলব না।

 

ঠিক তখন একটা শব্দ হল, সুশান প্রথমে ঠিক বুঝতে পারে না কোথায়। আবার অস্পষ্ট একটা শব্দ হল, সাথে সাথে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে ওঠে সুশান। ক্যাপসুলের ভিতর কী যেন নড়ছে। পল কুমপ্রাণ ফিরে পেয়েছে ভিতরে? আসলে কি সে মারা যায় নি? এই ধরনের কয়েকটা অযৌক্তিক জিনিস মাথায় খেলে যায় তার।

 

আবার অস্পষ্ট একটা শব্দ হয়, কেউ যেন মুচড়ে মুচড়ে কিছু একটা ভেঙে ফেলছে ভিতরে। সুশান পায়ে পায়ে পিছনে সরে আসে, আতঙ্কে হঠাৎ তার চিন্তা গোলমাল হয়ে যেতে থাকে। কিছু বোঝার আগে ক্যাপসুলের একটা অংশ হঠাৎ সশব্দে ফেটে যায়, আর ভিতর থেকে কিলবিলে কী যেন একটা বেরিয়ে আসে। আধা তরল আধা স্বচ্ছ থলথলে জিনিসটা ছটফট করতে করতে কেমন জানি ঘরঘর শব্দ করতে থাকে, হলুদ একটা ঝাঁঝালো ধোঁয়ায় জায়গাটা ঢেকে যেতে থাকে।

 

কয়েক মুহূর্ত সুশান স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর হঠাৎ রক্ত-শীতলকরা স্বরে চিৎকার করে ছুটতে শুরু করে। ভয় পেয়েছে সে, অস্বাভাবিক জান্তব একটা ভয়।

হিস্টিরিয়াগ্রস্ত মানুষের মতো কাঁদছিল সুশান, লু তাকে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, কি হয়েছে সুশান? বল, কি হয়েছে?

অনেক কষ্টে সুশান বলল, বংশধর। ট্রাইটনের বংশধর বেরিয়ে এসেছে। পলের শরীর থেকে।

সবাই পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে।

 

সিসিয়ানের সবাইকে নিয়ে জরুরি সভা ডাকল লু। প্রচণ্ড একটা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে সিসিয়ানে, তার মাঝে লু মুখে একটা নির্লিপ্ততার ভাব কষ্ট করে ধরে রেখেছে, সেটা বজায় রাখার চেষ্টা করে হালকা স্বরে বলল, সিডিসি, তুমি বর্তমান অবস্থার একটা রিপোর্ট দাও।

 

রিপোর্ট দেয়ার বিশেষ কিছু নেই, সিডিসি নিরুত্তাপ স্বরে বলল, বেশিরভাগ জিনিস এখন এখানে অচল। আমাদের এখন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করার উপায় নেই, কেন্দ্রীয় স্টেশনে যোগাযোগ করার ক্ষমতা নেই, হাইপারভাইভ দূরে থাকুক, সিসিয়ানের এখন কক্ষপথ পর্যন্ত পাল্টানোর উপায় নেই। ট্রাইটন থেকে বিশেষ তরঙ্গের রেডিও ওয়েভ এসে সবকিছু জ্যাম করে দিয়েছে। যেভাবে এটা করা হয়েছে সেটা অবিশ্বাস্য, যদি কখনো সময় আর সুযোগ হয়, সবাইকে বুঝিয়ে দেব। যাই হোক, এক কথায় বলা যায়, আমরা এখন পুরোপুরি ট্রাইটনের নিয়ন্ত্রণে। ট্রাইটন অনুগ্রহ করে আমাকে অচল করে দেয় নি, যদিও আমার ক্ষমতা এখন খুব সীমিত।

 

ট্রাইটন পুরো গ্রহটা একটা প্রাণী, ব্যাপারটা আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, আমি কম্পিউটার, কোনো জিনিস আগে দেখে না থাকলে আমি সেটা অনুভব করতে পারি না। সুশান হয়তো ব্যাপারটা আমাদের বোঝাতে পারবে। পলের শরীর থেকে যে–প্রাণীটি বের হয়ে এসেছে, সেটি সম্পর্কেও আমার ধারণা খুব অস্পষ্ট, থলথলে নরম একটা প্রাণী স্টেনলেসের একটা ক্যাপসুল কী ভাবে ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারে আমার জানা নেই। প্রাণীটি এখন দ্বিতীয় স্তরে একটা সীসার আস্তরণ দেয়া ঘরে আছে, ঘরটির বৈদ্যুতিক তারগুলি প্রাণীটি নষ্ট করেছে বলে আমি আর তাকে দেখতে পারছি না। আমি আরো অনেক কিছু বলতে পারি, কিন্তু আমার সময় কম বলে আমি এখন চুপ করছি।

লু সুশানের দিকে তাকিয়ে বলল, সুশান কিছু বলবে?

 

সুশান হাত নাড়ে, আমি আর নতুন কী বলব? সিডিসি যেটা বুঝতে পারে নি, মনে করো না আমি সেটা বুঝেছি। একটা আস্ত গ্ৰহ কী ভাবে একটা প্রাণী হতে পারে সেটা নিয়ে একটা জার্নালে আমি একবার একটা প্রবন্ধ পড়েছিলাম, সেটা নেহায়েৎই একটা কাল্পনিক প্রবন্ধ ছিল। প্রবন্ধটিতে দাবি করা হয়েছিল, এরকম প্রাণীর ক্ষমতা হবে অসাধারণ, কেন, সেটা সবাই বুঝতে পারছ। পৃথিবীতে যদি মানুষের ইতিহাস কখনো পড়ে দেখ, তা হলে দেখবে তারা সবসময়েই নিজেদের ভিতরে মারামারি করছে। পৃথিবীর সভ্যতা হয়েছে ছাড়া ছাড়াভাবে, কোনো জাতি যখন একত্র হয়ে নিজেদের উন্নতি করার চেষ্টা করেছে, তখন। অনেকবার আবার অনা জাতি এসে সেসভ্যতা একেবারে ধ্বংস করে দিয়েছে। পৃথিবীর সব মানুষ যদি কখনো যুদ্ধবিগ্রহ না করে সবাই একত্র হয়ে নিজেদের পুরো সম্পদ মানুষের জ্ঞানবিজ্ঞানের পিছনে ব্যয় কত, তা হলে মানুষ কত উন্নত হত চিন্তা করা যায় না।

 

মানুষের যে-সমস্যা, এ ধরনের প্রাণীর সে সমস্যা নেই। এই প্রাণী কোটি কোটি সংঘবদ্ধ মানুষের মতো নিজেদের ভিতরে কোনো বিরোধ নেই। শেটি কোটি মানুষের মস্তিষ্ক যদি একসাথে কাজ করে তার যেরকম ক্ষমতা হবে ট্রাইটনের ক্ষমতা হবে সে-রকম। কাজেই বুঝতে পারছ, এই গ্রহটি কত অসাধারণ!

 

এধরনের গ্রহের আবার একটা সমস্যাও আছে, আজীবন সেটি একা একা থাকে, কাজেই এর নুতন জিনিস শেখার সুযোগ নেই। আমরা যখন প্রথম ট্রাইটনের কাছে এলাম তার নিশ্চয় বিস্ময়ের সীমা ছিল না। আমাদের সম্পর্কে কিছুই জানত না, কত তাড়াতাড়ি কত কিছু শিখে নিয়েছে, সে তো তোমরা সবাই দেখলে।

সুশান একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার আর কিছু বলার নেই।

সুশান, নীষা জিজ্ঞেস করে, ট্রাইটনের বংশধর নিয়ে কিছু বলবে?

 

সুশান কাতর মুখে বলল, আমাকে সেটা নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করো না। এখনো মনে হলে আমার সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। প্রাণীটি নিঃসন্দেহে ট্রাইটনের বংশধর, পল কুমের শরীরে ছিল, সময় হলে বের হয়ে এসেছে। রু-টেকের শরীরে কিছু আছে কি না আমি জানি না—সম্ভবত নেই।

 

রু-টেক মাথা নেড়ে বলল, আমি সিডিসিকে নিয়ে নিজেকে পরীক্ষা করেছি, আমার শরীরে কিছু নেই। আমরা যন্ত্র বলে আমাদের শরীরে এখন যদি কিছু না থাকে, ভবিষতে সেটা সৃষ্টি হতে পারে না। মানুষের বেলায় সেটি সত্যি নয়, তাদের মস্তিষ্কে গোপন একটা কোড় দিয়ে দেয়া যায় নিজের অজান্তে সেটা শরীরে অস্বাভাবিক বিক্রিয়া শুরু করে আশ্চর্য পরিবর্তন করে ফেলতে পারে। পলের বেলায় নিশ্চয়ই তা-ই ঘটেছে।

 

সুশান মাথা নেড়ে বলল, ঠিকই বলেছ, জীববিজ্ঞানে এর একটা নাম আছে, গ্রট এনোমলি বলা হয়, ব্যাপারটা এখনো বিজ্ঞানীরা বুঝে উঠতে পারেন নি। যাই হোক, ট্রাইটনের বংশধর এখন ছোট, কিন্তু যেহেতু তাকে অনেক বড় হতে হবে, তাই তাকে অনেক বড় একটা গ্রহে যেতে হবে। সেই গ্রহের বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের প্রাচুর্য সম্ভব ট্রাইটনের মতো হওয়া দরকার, তোমাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু পৃথিবীর মৌলিক পদার্থের প্রাচুর্যের সাথে ট্রাইটনের অনেক মিল রয়েছে। সম্ভবত সে-কারণেই এই দু’টি গ্রহেই প্রাণের আবির্ভাব হয়েছিল, যদিও দুটি একেবারে ভিন্ন মানের।

 

নীষা মাথা নেড়ে বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, তুমি বলছ এই বংশধর জিনিসটা নিয়ে কোনো একটা গ্রহে ফেলে দিলে ধীরে ধীরে পুরো গ্রহটা আরেকটা ট্রাইটনে পরিণত হবে?

সম্ভবত।

শুনে সবার কেমন জানি গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

লু হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের হাতে কতটুকু সময় আছে আমি জানি না, আমাকে কয়েকটা জিনিস বলে দিতে দাও। প্রথম কথাটি সবাই জান, আমরা এখন চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি আছি, আমাদের কী হবে বলা কঠিন। দ্বিতীয় কথাটি প্রথম কথাটি থেকেও ভয়ংকর, সম্ভবত আমাদের সাথে সাথে সারা পৃথিবী এখন প্রচণ্ড বিপদের মুখোমুখি আছে। যদি ট্রাইটন সত্যি সত্যি সিসিয়ানে করে পৃথিবীতে তার বংশধর পাঠাতে পারে, সেটি হয়তো আমাদের পৃথিবীকে গ্রাস করে নিয়ে আরেকটা কুৎসিত ট্রাইটন তৈরি করে দেবে। আমি তোমাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করছি না, তার সময় পার হয়ে গেছে সত্যি কথা বলছি। কাজেই আমার মনে হয়, আমাদের প্রথম দায়িত্ব পৃথিবীকে রক্ষা করার চেষ্টা করা। তার জন্যে যদি–

 

লু অস্বস্তিতে একটু নড়েচড়ে হঠাৎ চুপ করে যায়। খানিকক্ষণ নিজের আঙ্গুলগুলি মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করতে করতে মাথা তুলে বলল, তার জন্যে যদি আমাদের সবাইকে নিয়ে সিসিয়ানকে ধ্বংস করে দিতে হয়, তাহলে সেটাই করতে হবে।

কেউ কোনো কথা না বলে পাথরের মতো মুখ করে চুপ করে থাকে। লু একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, দলপতির দায়িত্ব সবাইকে রক্ষা করা, সবাইকে নিয়েধ্বংস হয়ে যাওয়া নয়, কিন্তু আমি সত্যি কোনো উপায় দেখছি না।

 

কেউ কোনো কথা বলল না। লু খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তোমাদের কারো আপত্তি আছে?

সবাই মাথা নাড়ে, কারো কোনো আপত্তি নেই, এরকম একটা ব্যাপারে কারো আপত্তি থাকতে পারে না। এরা পুরো জীবনের বেশিরভাগ কাটিয়েছে মহাকাশে মহাকাশে। পৃথিবীতে থাকার সৌভাগ্য আর কয়জনের হয়? পৃর্থিবী নিয়ে ওদের আশ্চর্য একটা স্বপ্ন আছে, সেই স্বপ্ন কেউ ধ্বংস করে দিতে চাইলে তারা সেটা কী ভাবে হতে দেয়? তাদের তো সেভাবে বড় করা হয় নি।

 

লু কী একটা বলতে চাইছিল, রু–টেক বাধা দিয়ে বলল, তুমি সিসিয়ানকে ধ্বংস করবে কেমন করে? ট্রাইটন কি সেটা বন্ধ করে রাখে নি?

রেখেছে, কিন্তু ধ্বংস করা খুব সহজ, সৃষ্টিটাই কঠিন। আমরা যদি সত্যি সিসিয়ানকে ধ্বংস করতে চাই, কিছু একটা ব্যবস্থা করে নিতে পারব। রু-টেক মাথা নেড়ে চুপ করে যায়।

তোমাদের সবাইকে এখন একটা দায়িত্ব দিচ্ছি, সবাইকে নিয়ে সিসিয়ানকে ধ্বংস করে দেয়ার সবচেয়ে কার্যকর একটা পথ খুঁজে বের করা।

 

লু খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দিও, আমার সত্যি কিছু করার নেই।

কিম জিবান জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, লু, তোমার এত খারাপ লাগার কোনো কারণ নেই, এটা তোমার দোষ নয় যে, আমরা এই নরকে এসে হাজির হয়েছি। যখন যেটা করার প্রয়োজন সেটা করতে হবে না?

তা হয়তো হবে, কিন্তু আমি তোমাদের দলপতি, তোমাদের বাচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমার।

 

নীষা একটু ইতস্তত করে বলল, ল, ব্যাপারটা এতটা ব্যক্তিগতভাবে দেখার প্রয়োজন নেই, তুমি আমাদের দলপতি, কিন্তু তোমার উপর আমাদের বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কথাটা ঠিক না। তোমার দায়িত্ব ঠিক পরিবেশে ঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া। এই অবস্থায় আর কোনো উপায় নেই, তাই তুমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছ, এটা নিয়ে মন খারাপ করার কিছু নেই। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, তোমার সিদ্ধান্তটি সঠিক সিদ্ধান্ত, দুঃখজনক হতে পারে, কিন্তু সঠিক। আমাদের সবার চমৎকার জীবন কেটেছে, এখন যদি আমাদের মারা যেতে হয়, তা নিয়ে বাড়াবাড়ি দুঃখ করার কিছু নেই। পৃথিবীকে যদি ট্রাইটনের হাত থেকে বাচিয়ে দিতে পারি, সেটা নিয়ে বরং আমাদের হয়তো একটু অহঙ্কারই হওয়া উচিত।

 

লু নীষার দিকে তাকিয়ে একটু হাসে, চমৎকার স্বচ্ছ মেয়েটার বিচার-বিবেচনা, খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে। মাথা নেড়ে বলল, নীষা, তুমি বড় ভালো মেয়ে, আমার কষ্টটা তুমি কমিয়ে দিয়েছ। মুখের হাসিটা জোর করে ধরে রেখে বলল, সুশান, তুমি কিছু বললে না?

 

সুশান একটু চমকে উঠে দুর্বলভাবে হেসে বলল, আমি খুব ভীতু মানুষ, মরতে আমার খুব ভয় করে। একটু থেমে আবার বলল, দুঃখ নয়, ভয়। মৃত্যুযন্ত্রণা নাকি খুব ভয়ানক।

 

বুয়ের মুখের হাসি মুছে সেখানে একটা গাঢ় বেদনার ছাপ এসে পড়ে। আস্তে আস্তে বলল, আমি দুঃখিত সুশান।

সুশান একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, তোমার দুঃখ পাবার কিছু নেই, তোমার দলে যদি একটা ভীতু মেয়ে থাকে, সে জন্যে তোমার দুঃখ পাবার কী আছে?

 

সবাই খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। লু একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল, রু-টেক, তুমি কিছু বলবে?

আমি দুঃখিত লু, যে, এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিতে হল। আমার নিজের জন্যে কোনো দুঃখ নেই, কারণ আমার ঠিক মৃত্যু হবে না, কেন্দ্রীয় গবেষণাগারে আমার আরো একটা কপি আছে। কিন্তু তোমাদের তো কোনো কপি থাকে না। মানুষ এত অসাধারণ, কিন্তু তবু কত সহজে তারা শেষ হয়ে যেতে পারে! আমি দুঃখিত।

 

সিডিসি, তুমি কিছু বলবে?

আমি খুব দুঃখিত, এ ছাড়া আমার কিছু বলার নেই।

আমার সিদ্ধান্তে তোমার কোনো আপত্তি আছে?

এক মুহূর্ত দ্বিধা করে সিডিসি উত্তর দিল, না, নেই।

লু খানিকক্ষণ একদৃষ্টে উপরের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা সবাই আমার সিদ্ধান্তে রাজি হয়েছ বলে তোমাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এবারে আমি তোমাদের কাছে আরো একটা অনুরোধ করতে চাই।

কি?

প্রয়োজনে আমরা সবাইকে নিয়ে ধ্বংস হয়ে যাব, কিন্তু তার মানে এই নয়, আমরা বেঁচে থাকার চেষ্টা করব না। আমরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বেঁচে থাকার চেষ্টা করব।

সে জন্যে যদি আমাদের কোনো-একজনকে প্রাণ দিতে হয়, দেব।

সুশান মাথা নেড়ে বলল, আমি বুঝতে পারছি না, তুমি কী বলছ।

বলছি, যদি একজনের প্রাণ দিয়ে অন্যদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেকগুণ বেড়ে যায়, তাকে প্রাণ দিতে হবে।

কিম বাধা দিয়ে বলল, কী বলছ তুমি, লু? কার প্রাণ দিয়ে তুমি অন্যদের বাঁচাবে?

লু হাত তুলে কিমকে থামিয়ে দিয়ে বলল, সিডিসি, তুমি বলতে পার, সে-রকম কেউ কি আমাদের মাঝে আছে

সিভিলি কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে।

 

সিডিসি।

সিডিসি তবু কথা বলে না।

সিডিসি, আমার কথার উত্তর দাও।

সিডিসি আস্তে আস্তে প্রায় ফিসফিস করে বলল, লু সত্যি তুমি তাই চাও?

হ্যাঁ সিডিসি।

সত্যি?

হ্যাঁ, সত্যি।

সত্যি তুমি চাও আমি প্রাণ দিই?

 

আমি দুঃখিত সিডিসি। ট্রাইটনের আমাদের কাউকে প্রয়োজন নেই, তার প্রয়োজন শুধু তোমাকে। তুমি জান, ট্রাইটন তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, অন্য সবাইকে শেষ করে শুধু তোমাকে। তোমাকে সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, এখনো শুরু করে নি, কিন্তু ইচ্ছা করলেই পারে। তোমার নিয়ন্ত্রণটুকু নিয়ে নিলে আমাদের আর কোনো উপায় থাকবে না, তুমি তখন সিসিয়ানকে যেখানে খুশি নিয়ে যেতে পারবে।

 

অনেকক্ষণ সিডিসি কোনো কথা না বলে চুপ করে থাকে। যখন কথা বলে, তখন তার গলার স্বর বিষণ্ণ, আস্তে আস্তে অনেকটা আপন মনে বলে, আমি কখনো ভাবি নি আমার একদিন শেষ হয়ে যেতে হবে।

আমরাও কেউ সেটা ভাবি নি সিডিসি।

লু, আমার যেতে ইচ্ছে করছে না, লু। আমার খুব ইচ্ছে করছে থেকে যাই।

আমি দুঃখিত সিডিসি।

খুব ইচ্ছে করছে বেঁচে যাই। কোনো বড় মহাকাশযানে নয়, কোনো ছোট ছেলের খেলাঘরে তার খেলার সাথী হয়ে থেকে যাই।

আমি দুঃখিত সিডিসি।

কতবার আমি মহাকাশ পারাপার দিয়েছি, কতবার কত গ্রহ-নক্ষত্রে ঘুরে বেরিয়েছি, কত মহাকাশচারীর দুঃখ-বেদনার সাথী হয়ে কাটিয়েছি। কত স্মৃতি, কত অভিজ্ঞতা, সব চোখের পলকে শেষ হয়ে যাবে, কোথাও কিছু থাকবে না? সিডিসি ২১১২, ওমেগা গোষ্ঠীর ষষ্ঠ কম্পিউটারের চতুর্থ পর্যায় আর থাকবে না?

 

আমি দুঃখিত সিডিসি।

সত্যি তুমি চাও আমি যাই?

আমি দুঃখিত সিডিসি, কিন্তু আমি সত্যিই তাই চাই, আমার নিজের জন্যে নয়। পৃথিবীর জন্যে।

দীর্ঘ সময় সিডিসি চুপ করে থাকে, তারপর আস্তে আস্তে বলে, বিদায় লু। বিদায় সুশান, নীষা, কিম জিবান আর রু-টেক। বিদায়।

বিদায়।

নরম গলায় নীষা বলল, আমরা তোমায় মনে রাখব সিডিসি, সারা জীবন তোমাকে মনে রাখব।

নীষা।

বল।

যাবার আগে তোমাকে একটা উপহার দিয়ে যেতে পারি?

দাও।

তোমার ঘরে টেবিলের উপর রেখে গেলাম, যদি কখনো সুযোগ হয় দেখো।

দেখব।

বিদায়, সবাই।

বিদায়।

পর মুহূর্তে সিডিসি ২১১২, ওমেগা গোষ্ঠীর ষষ্ঠ কম্পিউটারের চতুর্থ পর্যায় তার অপারেটিং সিস্টেম২৫ আর আটচল্লিশ টেরা বাইট মেমোরি ধ্বংস করে ফেলল।

অন্ধকার নেমে এল সিসিয়ানে সাথে সাথে।

 

অনাহুত আগন্তুক

কন্ট্রোলরুমে আবছা অন্ধকার, সিডিসি ধ্বংস করে দেয়ার পর সিসিয়ানে একটা বড় বিপর্যয় নেমে এসেছে। মহাকাশযানের জটিল কাজকর্মগুলি দূরে থাকুক, বাতাসের চাপ বা তাপমাত্রা ঠিক রাখার মতো ছোটখাট জিনিসগুলি করতে গিয়ে পর্যন্ত সই হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। সবাই মিলে দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেবার পরেও কিছুতেই মূল দায়িত্বগুলিও পালন করা যাচ্ছে না। কন্ট্রোলরুমে সবাই যখন সিসিয়ানকে মূল কক্ষপথে ধরে রাখার চেষ্টা করছিল, তখন হঠাৎ দরজায় কার ছায়া পড়ে। সুশান আতঙ্কে নীল হয়ে গিয়ে ভাঙা গলায় বলল, কে, কে ওখানে?

 

ছায়ামূর্তি কোনো কথা না বলে আরো এক পা এগিয়ে আসে। সিসিয়ানে এখন। আলো খুব বেশি নেই, এগিয়ে আসার পরও তার চেহারা ভালো দেখা গেল না। সুশানের মনে হল, ট্রাইটনের বংশধর বুঝি মানুষের আকার নিয়ে চলে এসেছে। ভয়পাওয়া গলায় বলল, কে, কে ওখানে?

 

ছায়ামূর্তি খসখসে গলায় পাল্টা প্রশ্ন করে, আমি জিজ্ঞেস করতে পারি, কে ওখানে?

লম্বা ছায়া ফেলে একজন মাঝবয়সী লোক এগিয়ে আসে, পরনে আধময়লা কাপড়, মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। লোকটা চোখ পিটপিট করে বলল, আমি কোথায়?

এটি কোন জায়গা?

লু হঠাৎ করে বুঝতে পারে লোকটা কে এবং হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হয়েছে। ডান হাতে একটা থ্রটল চেপে ধরে গলা উঁচিয়ে বলল, এটি মহাকাশযান সিসিয়ান।

সত্যি যদি এটা একটা মহাকাশযান হয়, তা হলে এটা এত অন্ধকার কেন? এরকম এলোমেলোভাবে ঘুরছে কেন? তাপমাত্রা এত কম কেন? বাতাসের চাপ কি ঠিক করা হবে, নাকি এরকমভাবে রেখে একসময় ফুসফুসটাকে ফাটিয়ে দেওয়া হবে?

 

কিম জিবান গলা নামিয়ে লুকে জিজ্ঞেস করে, লোকটা কে?

নিশ্চয়ই শীতল-ঘরে ছিল। সিডিসি যাবার আগে জ্ঞান ফিরিয়ে দিয়ে গেছে, সিডিসি ছাড়া তো আর জীবন্ত কাউকে শীতল রাখা যায় না।

কোথায় যাবার কথা ছিল ভদ্রলোকের?

জানি না, আমাদের জানার কথাও না। সিডিসি জানত।

লোকটি আরো এক পা এগিয়ে এসে রুক্ষ স্বরে বলল, গুজগুজ করে ওখানে কী কথা হচ্ছে? আমাকে কি কেউ কিছু-একটা বলবে?

লু কিম জিবানের হাতে টলটা ছেড়ে দিয়ে এগিয়ে যায়। বলছি। আমার নাম লু, আমি এখানকার দলপতি।

এটি কী জিনিস?

এটি একটা মহাকাশযান, আসলে বলা উচিত এটি কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত একটা মহাকাশযান ছিল।

এখন কী হয়েছে?

লু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, একটা খুপরি, একটা ভাঙা ঘর, একটা উপগ্রহ, যা ইচ্ছে হয় বলা যায়।

কেন?-এ অবস্থা হল কেমন করে?

আমাদের মূল কম্পিউটারটি ধ্বংস হয়ে গেছে।

লোকটি অবাক হয়ে বলল, ধ্বংস হয়ে গেছে?

লু একটু ইতস্তত করে বলল, আসলে আমরা ধ্বংস করে ফেলেছি।

লোকটার খানিকক্ষণ সময় লাগে বিশ্বাস করতে, খানিকক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে বলল, ধ্বংস করে ফেলেছ? ইচ্ছে করে?

হ্যাঁ।

কেন?

সেটা অনেক বড় ইতিহাস, এখন শুনে কাজ নেই। তা ছাড়া তুমি নিশ্চয়ই এইমাত্র ফ্রিজিং ক্যাপসুল থেকে উঠে এসেছ, বিশ্রাম নেয়া দরকার। আমাদের মূল কম্পিউটার নেই বলে ঠিক ঠিক সবকিছু করতে পারব না, সবাই কোনো-না-কোনো কাজে ব্যস্ত। আমাদের একজন সময় পেলেই–

 

লোকটা বাধা দিয়ে বলল, তার আগে শুনি, কেন কম্পিউটারটাকে ধ্বংস করেছ।

লু শান্ত গলায় বলল, শোনার অনেক সময় পাবে, এখন আমার কথা শুনে–

লু, কিম জিবান উচ্চস্বরে ডাকল, তাড়াতাড়ি আস, আর সামলাতে পারছি না।

লু কথার মাঝখানে থেমে প্রায় ছুটে কিম জিবানের পাশে গিয়ে থ্রটলটা চেপে ধরে। সময়ে-অসময়ে সে কম্পিউটারের কাজগুলি নিজে নিজে করার চেষ্টা করত বলে এসব ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতা অন্যদের থেকে অনেক বেশি। কখনো সেটা কোনো কাজে আসবে চিন্তা করে নি। লোকটা লুয়ের পিছু পিছু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে, বলবে?

 

লু মনিটর থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, সত্যি এখনি শুনতে চাও?

হ্যাঁ।

নীষা, তুমি ভদ্রলোককে একটু গুছিয়ে বলবে? আমি খুব ব্যস্ত এখানে।

নীষা নিজেও খুব ব্যস্ত, সিডিসির সাথে সাথে সিসিয়ানের প্রায় চার হাজার কম্পিউটারের সবগুলি অচল হয়ে গিয়েছে, সেগুলি আলাদা আলাদাভাবে কাজ করার জন্যে তৈরি হয় নি। নীষা চেষ্টা করছে সে-রকম একটা দু’টা কম্পিউটারকে চালু করতে, ওদের কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে তা হলে। একটা কম্পিউটারের অসংখ্য ডাটা লাইনগুলি সাবধানে ধরে রেখে সে লোকটাকে অল্প কথায় ওদের অবস্থাটা বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। ট্রাইটনের কথা শুনে লোকটি খুব বেশি বিচলিত হল বলে মনে হল না, কিন্তু যেই মুহূর্তে সে সিডিসিকে ধ্বংস করে দেয়ার কথাটি শুনল, সে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না, অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে নিজের চুল খামচে ধরে বলল, কী বললে তুমি? তোমরা নিজের ইচ্ছায় ২১১২ নম্বরের তৃতীয় মাত্রার একটা কম্পিউটার ধ্বংস করে দিয়েছ? ২১১২ নম্বরের কম্পিউটারের কত বড় ক্ষমতা, তুমি জান? তাও তৃতীয় মাত্রার। পৃথিবীতে ফিরে গেলে তোমাদের নামে খুনের অপরাধ দেয়া হবে, খেয়াল আছে?

 

তৃতীয় মাত্রার হলে দেয়া হত। আমি যে-কম্পিউটারের কথা বলছি, সেটা তার পরবর্তী পর্যায়ের, সেটি চতুর্থ পর্যায়ের।

লোকটি কোনো কথা বলতে পারে না, খানিকক্ষণ লাগে তার ব্যাপারটা বুঝতে। একটু পরে সে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলল, কী বললে? চতুর্থ পর্যায়?

হ্যাঁ।

কিন্তু চতুর্থ পর্যায় তো মানুষ থেকে বেশি ক্ষমতা রাখে, এটি একমাত্র কম্পিউটার, যেটাকে মানুষ থেকে বেশি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, নিজেকে বাঁচানোর জন্যে এটার মানুষ খুন করার অনুমতি আছে।

 

জানি।

তা হলে?

তা হলে কী?

কী ভাবে ধ্বংস করলে সেটাকে?

তোমাকে একবার বলেছি, তুমি শোন নি। আবার বলছি, আমরা এখন একটা মহাবিপদে আছি, পৃথিবীর অস্তিত্ব এর সাথে জড়িত। মূল কম্পিউটার সিডিসি থাকলে ট্রাইটনের আমাদের কারো প্রয়োজন নেই, তাই সিডিসিকে চলে যেতে বলা হয়েছে।

 

কিন্তু কেন সে গেল, তার যাবার কোনো প্রয়োজন নেই, মানুষ থেকে সে বেশি মূলবান—

কিন্তু পৃথিবী থেকে সে বেশি মূল্যবান নয়। তা ছাড়া সিডিসি আমাদের ভালবাসত, আমাদের বিশ্বাস করত। আমাদের বাঁচানোর জন্যে তার প্রাণ দেয়াটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।

লোকটা মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ইস, কী দুঃখের ব্যাপার। চতুর্থ সিরিজের একটা ২১১২। চতুর্থ সিরিজের। আমি কত গল্প শুনেছি, কখনো চোখে দেখি নি।

নীষা একটু অবাক হয়ে লোকটাকে দেখে, চতুর্থ সিরিজের কম্পিউটারকে নিয়ে এরকম উচ্ছাস বিচিত্র নয়, কিন্তু তাই বলে এরকম অবস্থায়? সে জিজ্ঞেস না করে পারল না, তুমি মনে হয় ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছ না। আমরা খুব বিপদের মাঝে আচ্ছি—

 

তা বুঝেছি, কিন্তু বিপদ তো মানুষের সব সময়েই থাকে। আমার কয়েকটা হিসেব করার ছিল। জিটা নিউট্রিনোর ভরের সাথে সুপারসিমেট্রিক বোজনের একটা হিসেব। ভালো কম্পিউটারের অভাবে করতে পারি নি, এখন যদি সিডিসিকে পেতাম, আহা—সে দশ সেকেন্ডে করে দিতে পারত।

 

বিস্ময়ে নীষার চোখ বড় বড় হয়ে ওঠে। এরকম পরিবেশে যে অঙ্ক কষার জন্যে একটা কম্পিউটার খুঁজতে পারে, তার মাথাটা কি পুরোপুরি খারাপ নয়? নীষার চোখে চোখ পড়তেই লোকটা হঠাৎ থতমত খেয়ে থেমে গেল, একটু লজ্জা পেয়ে কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে বলল, আমি একজন পদার্থবিজ্ঞানী, পঞ্চম বিজ্ঞান সম্মেলনে গিয়েছিলাম। সেখানে জিটা নিউট্রিনোর ভরের উপর একটা সমস্যা ছিল, সেটা ভাবতে ভাবতে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। একটু আগে যখন ঘুম ভাঙল, হঠাৎ একটা সমাধানের কথা মনে হল। একটা ভালো কম্পিউটার পেলে একবার চেষ্টা করে দেখতাম সমাধানটা বের করা যায় কি না।

 

আমি খুব দুঃখিত, এখন এখানে ভালো খারাপ কোনো কম্পিউটারই নেই।

তাই তো দেখছি।

লোকটা বিমর্ষ ভঙ্গিতে এক কোনায় গিয়ে বসে। নীষা অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম?

লুকাস। ইউরী লুকাস। ইউরী বলে ডাকতে পার।

 

ইউরী কোনো কথা না বলে নিজের মাথা চেপে ধরে চুপচাপ বসে থাকে। এরকম অবস্থায় জিটা নিউট্রিনোর সুপার সিমেট্রিক বোজনের ভর বের করতে না পেরে কারো এত আশাভঙ্গ হতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস হতে চায় না। লোকটিকে দেখে লুয়ের একটা আশ্চর্য হিংসা হয়, জ্বালা-ধরানো আক্রোশের মতো একটা হিংসা। সেও যদি সবকিছু ভুলে এই লোকটার মতো কোনো একটা জটিল অঙ্কের সমস্যা নিয়ে বসে থাকতে পারত।

ইউরী দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে এক সময় নীয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, এই পুরো গ্রহটা একটা প্রাণী বলে দাবি করছ?

হ্যাঁ।

তার মানে এর আকার অনেক বড়। সম্ভবত এর ক্ষমতাও অনেক বেশি। কিন্তু এটা মানুষ থেকে বেশি উন্নত, সেটা কিভাবে বুঝতে পারলে?

নীষা একটু অবাক হয়ে বলল, পল কুম আমাদের মতো একজন মানুষ, তাকে খুলে সে আবার নূতন করে তৈরি করেছে—

সেটা তো বুদ্ধিমান প্রাণীর প্রমাণ হল না। বুদ্ধিমান প্রাণী হল পল কুমের অনবরণ করে নূতন কিছু তৈরি করত।

নীষা হঠাৎ করে ইউরীর কথার কোনো উত্তর দিতে পারে না। ইউরী আস্তে আস্তে বলল, একটা ধাটি শিম্পাঞ্জীকে দেখলে একটা মানবশিশু থেকে বেশি বুদ্ধিমান মনে হতে পারে, কিন্তু আসলে মানবশিশু শিম্পাঞ্জী থেকে অনেক বেশি বুদ্ধি রাখে। এখানেও কি এধরনের ব্যাপার হচ্ছে?

 

লু কিম জিবানের হাতে গ্লুটুলটা ধরিয়ে দিয়ে এগিয়ে আসে, তুমি ঠিকই ধরেছ, ক্ষমতা বেশি হওয়া মানেই বুদ্ধি বেশি, তা ঠিক নয়। কিন্তু ক্ষমতা যখন এত বেশি হয়ে যায়, যে, আমাদের সেটা অনুভব করার পর্যন্ত শক্তি থাকে না, তখন বুদ্ধি কম না বেশি তাতে আর কিছু আসে-যায় না। আমরা সম্ভবত কোনোদিন ঠিক করে জানতেও পারব না, তার বুদ্ধিমত্তা কোন স্তুরের।

 

ইউরী ভুরু কুঁচকে বলল, সত্যি?

এখানে যখন এসেছ, দেখবে।

গ্রহটার সাথে যোগাযোগ করেছ?

চেষ্টা করেছিলাম, লাভ হয় নি। আমাদের সাথে তার যোগাযোগ করার কোনো ইচ্ছে নেই। আমরা মোটামুটিভাবে তার হাতের মুঠোয়, কাজেই তার যোগাযোগ করার কোনো প্রয়োজনও নেই।

 

যোগাযোগ করতে পারলে মন্দ হত না।

কেন?

যদি জিটা নিউট্রিনোর ভরের সমস্যাটা বুঝিয়ে দিতে পারতাম, সমাধানটা হয়তো করে দিতে পারত।

ল খানিকক্ষণ ইউরীর দিকে তাকিয়ে থেকে ফিরে গেল, লোকটার সম্ভবত সত্যি মাথা খারাপ। হয়তো তাকে কোনো একটা পাগলা গারদে পাঠানো হচ্ছিল।

ইউরী লুয়ের পিছনে পিছনে এগিয়ে আসে, জিজ্ঞেস করে, কোনো কি উপায় নেই যোগাযোগ করার?

একেবারে নেই তা হতে পারে না, কিছু-একটা নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সিডিসিকে ধ্বংস করে দেয়ার পর এখন আমাদের আর চেষ্টা করার কোনো উপায় নেই।

ও। ইউরী অত্যন্ত বিরস মুখে এক কোনায় বসে থাকে, তার মুখ দেখে মনে হয় একটা ভালো কম্পিউটারের অভাবে তার বেঁচে থাকা পুরোপুরি অর্থহীন হয়ে গেছে।

 

সিসিয়ানকে মোটামুটি আয়ত্তের মাঝে আনার পর দলের দু’একজন প্রথমবারের মতো একটু বিশ্রাম নেবার সুযোগ পায়। সেই সময় কিম জিবানের চোখে পড়ে, দেয়ালের এক কোনায় একটা লাল বাতি একটু পরে পরে জ্বলছে এবং নিভছে। কাছে গিয়ে সে একটা আশ্চর্য জিনিস আবিষ্কার করে। লাল বাতিটির উপরে ছোট ছোট করে লেখা, তোমরা যদি বিপদগ্রস্ত হয়ে থাক, তা হলে এই সুইচটি চেপে ধর।

কিম জিবান সুইচটি চেপে ধরার আগে লুকে ডেকে আনে। লু খানিকক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আশ্চর্য ব্যাপার, আমি ভেবেছিলাম, মহাকাশকেন্দ্রে বুঝি সবকিছু শেখানো হয়, এই জিনিসটা আমাদের কাছে গোপন রাখা হয়েছে। দেখা যাক কী আছে ভিতরে।

 

লু সুইচটা চেপে ধরতেই একটা চ্যাপ্টা ধরনের বাক্স খুলে গেল। ভিতরে ছোট ছোট করে লেখা, তোমাদের মূল কম্পিউটার ধ্বংস হয়ে গেছে, এটি অত্যন্ত গুরুতর ব্যাপার, মহাকাশ অভিযানের সুদীর্ঘ ইতিহাসে মাত্র একবার এধরনের একটা ব্যাপার। ঘটেছিল। তোমরা নিশ্চয়ই অত্যন্ত বিপদের মাঝে রয়েছ, এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাদের কোনো ধরনের সাহায্য প্রয়োজন। মূল কম্পিউটার ধ্বংস হয়ে গেছে বলে এই মুহূর্তে তোমাদের পক্ষে যোগাযোগ করা অসম্ভব। এই গোপন বাক্সটিতে যোগাযোগের জন্যে একটি অত্যন্ত প্রাচীন যন্ত্র দেয়া হল। এটি একটি নিউট্রিনো জেনারেটর, কোনোরকম সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি বা অভিজ্ঞ মানুষ ছাড়াই এটি চালু করা সম্ভব। যন্ত্রটির সুইচ টিপে নিউট্রিনোর সংখ্যা বাড়ানো এবং কমানো যায় এবং যন্ত্রটির নলটি যেদিকে মুখ করে রাখবে, নিউট্রিনোগুলি সেদিকে বের হবে। কাজেই তোমাদের দায়িত্ব মহাকাশকেন্দ্রের দিকে নলটি ঘুরিয়ে এটি চালু করা এবং নিউট্রিনোর সংখ্যা বাড়িয়ে কমিয়ে সেখানে কোনো ধরনের সংকেত পৌছানোর ব্যবস্থা করা। সময় নষ্ট না করে এই মুহূর্তেই তোমরা এটি ব্যবহার শুরু করে দাও। মনে রেখো, তোমরা অত্যন্ত বিপদের মাঝে রয়েছ এবং তোমাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য শুনা শূন্য তিন কিংবা আরো কম।

 

বাক্সের নিচে একটা ছেলেমানুষি যন্ত্র। লু খানিকক্ষণ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে সেটার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিম জিবান উত্তেজিত স্বরে বলল, বেঁচে গেলাম তা হলে আমরা। লু তাড়াতাড়ি চালু কর এই ব্যাটাকে।

নীষা শান্ত স্বরে বলল, এত তাড়াতাড়ি নয়, আগে একটু ভেবে দেখা দরকার। সিডিসি বেঁচে থাকতেই ট্রাইটন আমাদের সবরকম যোগাযোগ বন্ধ করে রেখেছিল, এখন সিডিসিও নেই। এটা চালু করতেই যদি ট্রাইটন বুঝে ফেলে বন্ধ করে দেয়?

 

লু মাথা নেড়ে বলল, মনে হয় না এটা ট্রাইটন বুঝতে পারবে, আমি নিউট্রিনো সম্পর্কে খুব বেশি জানি না, কিন্তু যেটুকু জানি তা থেকে এটুকু বলতে পারব, লক্ষ লক্ষ নিউট্রিনো ট্রাইটনের ভিতর দিয়ে চলে যাবে, ট্রাইটন টের পর্যন্ত পাবে না।

ইউরী কখন ওদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ দেখে নি। তার চাপা হাসি শুনে সবাই ঘুরে তাকাল। লু একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, কি, আমি ভুল বলেছি?

না। কিছু ভুল বল নি। এটা ধরে নেয়া মোটেও ভুল নয় যে ট্রাইটন তার শক্তির জনো উইক ইন্টারঅ্যাকশান ব্যবহার করে না।

তা হলে হাসছ কেন?

ইউরী আঙুল দিয়ে ছেলেমানুষি যন্ত্রটাকে দেখিয়ে বলল, ওটা দেখে। ওটা দেখে হাসার কী হয়েছে?

আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখুন পদার্থবিজ্ঞান ক্লাসে আমার এইরকম একটা যন্ত্র ব্যবহার করে একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে হয়েছিল।

তাতে কী হয়েছে?

 

এটা একটা ছেলেমানুষি জিনিস, ল্যাবরেটরিতে কমবয়সী ছাত্রেরা এসব দিয়ে কাজ করে, এটার কোনো ব্যবহারিক গুরুত্ব নেই। কেউ–একজন ঠাট্টা করে এটা এখানে রেখেছে।

ইউরী সত্যি বলছে, না ঠাট্টা করছে, তারা বুঝতে পারল না। কিম জিবান একট রেগে বলল, বাজে কথা বলো না, এরকম ব্যাপার নিয়ে কেউ ঠাট্টা করে না।

দেখতেই পাচ্ছ কেউ কেউ করে।

তুমি বলতে চাইছ, এটা কাজ করে না?

না, কাজ করবে না কেন, অবশ্যি করে।

তা হলে?

 

কাজ করলেই তো হয় না, যেটার যে-কাজ, সেটা তার থেকে বেশি তো করতে পারে না। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কত নিউট্রিনো আছে, জান? এই মুহূর্তে তোমার শরীর দিয়ে সেকেন্ডে অন্তত এক বিলিয়ন নিউট্রিনো যাচ্ছে, তুমি টের পাও না, কারণ সেগুলি তোমার শরীরের সাথে কোনোরকম বিক্রিয়া করছে না। এই নিউট্রিনো জেনারেটরটা সেকেন্ডে খুব বেশি হলে মিলিয়নখানেক নিউট্রিনো তৈরি করতে পারে, সেটা কি কয়েক বিলিয়ন মাইল দূর থেকে কেউ ধরতে পারবে? বিজ্ঞানের উন্নতি হয়েছে মানি, কিন্তু সব কিছুরই তো একটা মাত্রা আছে।

 

সুশান একটু সন্দেহ নিয়ে ইউরীর দিকে তাকিয়ে ছিল, ইউরী সেটা লক্ষ করে বলল, আমার কথা বিশ্বাস হল না?

কেউ তার কথার উত্তর দিল না। ইউরী মাথা ঘুরিয়ে একবার সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি পদার্থবিজ্ঞানের লোক, সারা জীবন আমি নিউট্রিনো নিয়ে কাজ করে এসেছি।

 

সবাই চুপ করে ইউরীর দিকে তাকিয়ে থাকে, ইউরী একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল, তোমরা এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছ, যেন দোষটা আমার। আমি তো কিছু করি নি। একটা মিথ্যা আশা নিয়ে থাকা থেকে সত্যি কথাটা জানা কি ভালো নয়?

নীষা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু আমি এখনো বুঝতে পারলাম না, এরকম একটা অযৌক্তিক ব্যাপার কেন করা হবে? কেন একটা মহাকাশযানে একটা খেলনা নিউট্রিনো জেনারেটর রাখা হবে?

সেটা আমাকে খুব অবাক করছে না, লু একটু হেসে বলল, মানুষ প্রথম যখন মঙ্গল গ্রহে গিয়েছিল, তারা সাথে কী নিয়ে গিয়েছিল জান?

কী?

 

রিভলবার। সেটা কখন কোথায় কী ভাবে ব্যবহার করবে কেউ জানত না, তবু নিয়ে গিয়েছিল। কাজেই অযৌক্তিক জিনিস মানুষের কাছে আশা করা এমন কিছু বিচিত্র ব্যাপার নয়। এখানেও হয়তো সেরকম কিছু-একটা হয়েছে। এই নিউট্রিনো জেনারেটরটা হয়তো সেই রিভলবারের মতো কাজ করে, কিন্তু কোনো কাজে আসে না।

সুশান আস্তে আস্তে বলল, মনে হয় একটু মিথ্যে আশা দেয়ার জন্যে এটা রাখা হয়েছে। দেখা গেছে, মানুষকে অল্প একটু আশা দিয়ে অনেক আশ্চর্য কাজ করিয়ে নেয়া যায়।

কিম জিবান শুল্কমুখে বলল, তাহলে আমরা কি এটা ব্যবহার করব না?

ব্যবহার করব না কেন, অবশ্যি ব্যবহার করব, তবে এর থেকে কিছু আশা করব না। নেহায়েত যদি আমাদের ভাগ্য খুব ভালো হয়, খুব কাছে দিয়ে যদি একটা মহাকাশযান যায়, হয়তো আমাদের সংকেত শুনে আমাদের সাহায্য করতে আসবে।

 

ইউরী হাসি গোপন করার কোনো চেষ্টা না করে বলল, এর থেকে একটা রিভলবার দিয়ে কয়েকবার ফাঁকা আওয়াজ করা ভালো, শব্দ শুনে কারো আসার সম্ভাবনা মনে হয় একটু বেশি হতে পারে।

কথাটি একটি রসিকতা মাত্র, কিন্তু যুক্তিসঙ্গত কারণেই কেউই সেই রসিকতাটুকু উপভোগ করতে পারল না।

 

খানিকক্ষণ আলোচনা করে নীষাকে এই নিউট্রিনো জেনারেটরটি চালু করার ভার দেয়া হল, সে চারদিকে বিপদগ্রস্ত মহাকাশযানের সংকেত পাঠাতে থাকবে। নিউট্রিনো রশ্মি সেই সংকেত সত্যি সত্যি নিয়ে যাবে বিলিওন বিলিওন মাইল দূরে, কেউ সেটা পাবে কিনা, কে বলতে পারে? ইউরী বলছে পাবে না, বিজ্ঞানের বর্তমান উৎকর্ষতায় পাওয়া সম্ভব না। কিন্তু কেউ তো পেতেও পারে, আশা করতে তো দোষ নেই, মানুষের আশা যদি না থাকে, তা হলে তারা বেঁচে থাকবে কী নিয়ে?

 

নীষা ধৈর্য ধরে নিউট্রিনো রশ্মি পাঠাতে থাকে, চেষ্টা করছে চারদিকে পাঠাতে, বিশেষ করে যেদিকে মহাকাশকেন্দ্র রয়েছে, সেদিকে। খুব সাবধানে সে ট্রাইটনকে এড়িয়ে চলছিল, যদিও তার কোনো প্রয়োজন ছিল না। এই অবস্থায় সে কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। নীষা এবং অন্য সবাই আশা করেছিল যে, ইউরীর ধারণা সত্যি নয় এবং নিউট্রিনো রশ্মি চালু করা মাত্রই দূর মহাকাশ কেন্দ্র থেকে সাহায্য এসে যাবে। কিন্তু তাদের ধারণা সত্যি নয়, দেখতে দেখতে সময় কেটে যেতে থাকে, কিন্তু কোনো মহাকাশযানই তাদের উদ্ধার করার জন্যে হাজির হয় না। যতই সময় যাচ্ছে ততই তারা বুঝতে পারছে, আসলে ইউরীর কথাই সত্যি, এই নিউট্রিনো জেনারেটরটি একটি খেলনা ছাড়া আর কিছু নয়।

 

লু নিজের ঘরে মাথা চেপে বসে আছে, এখন কী করবে সে? ট্রাইটন তার বংশধরকে সিসিয়ানে পাঠিয়ে দিয়েছে, এখন তাকে নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে যাবার কথা। সিসিয়ানে সিভিসি নেই, কাজেই এখন ফিরে যাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। সিসিয়ানকে চালিয়ে নেবার জন্যে ট্রাইটনের এখন কী পরিকল্পনা, কে জানে? লু চিন্তা করার চেষ্টা করে, সে ট্রাইটন হলে কী করত? প্রথমত, নিশ্চিত করার চেষ্টা করত বাইরের কেউ যেন জানতে না পারে এখানে ট্রাইটনের বংশধর রয়েছে, যাকে এখন পৃথিবীতে নেয়ার কথা। কাজেই চেষ্টা করত সবাইকে মেরে ফেলতে, তার বংশধর খুব সহজেই সেটা করতে পারে, কিন্তু করছে না। কাজেই ধরে নেয়া যায়, ট্রাইটন সেটা চাইছে না। চাওয়ার কথাও নয়, কারণ তাহলে সিসিয়ান ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু সিসিয়ানকে এখন পৃথিবীতে ফেরত পাঠাতে চাইবে, কী ভাবে সেটা সম্ভব? ট্রাইটন এখন তাদের বাধ্য করবে বাইরের কোনো জীবিত প্রাণীর সাথে যোগাযোগ না করে তাদের পৃথিবীতে পাঠানোর। কী ভাবে করবে সে?

 

এই সময় দরজায় কার জানি ছায়া পড়ে, লু তাকিয়ে দেখে, নীষা ফ্যাকাশে মুখ দাঁড়িয়ে আছে।

কি হয়েছে নীষা?

ইউরী–

কী হয়েছে ইউরীর?

আমাকে এসে বলেছে ট্রাইটনে একটা খবর পাঠাতে। আমি রাজি হই নি, তখন কোথা থেকে একটা রিভলবার জোগাড় করে এনে আমার মাথায় ধরেছে।

মাথায়? লু চমকে উঠে বলল, কেন?

বলেছে নিউট্রিনো জেনারেটরটি ট্রাইটনের দিকে মুখ করে ধরতে।

ট্রাইটনের দিকে?

হ্যাঁ।

কেন?

ইউরী ট্রাইটনের কাছে খবর পাঠাতে চায়, ওর নাকি জিটা বোজানের উপরে কী একটা সমস্যা আছে।

 

লু তার জীবনে কখনোই হঠাৎ করে রেগে ওঠে নি, কিন্তু আজ তার ব্যতিক্রম হল, হঠাৎ করে তার মাথায় যেন আগুন ধরে গেল। সে হঠাৎ লাফিয়ে উঠে দাড়িয়ে দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, কোথায় সেই বদমাশ?

লু।

কি?

ওর কাছে একটা রিভলবার আছে।

রিভলবারের নিকুচি করি আমি—লু ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। সিসিয়ান ছাড়া ছাড়াভাবে দুলছিল, তার মাঝে তাল সামলে লু হেঁটে যেতে থাকে। কোনার ঘরটাতে ইউরী দরজা বন্ধ করে আছে, লু লাথি মেরে দরজা খুলে ফেলে।

ইউরী উবু হয়ে যেন কি করছিল, লুকে দেখে চমকে উঠে দু’হাতে রিভলবারটি চেপে তুলে ধরে, ভাঙা গলায় চিৎকার করে বলে, সাবধান, গুলি করে দেব।

লু ভ্রূক্ষেপ না করে সোজা এগিয়ে যায়, উদ্যত রিভলবারটি পুরোপুরি উপেক্ষা করে সে ইউরীর কলার চেপে ধরে বলে, তুমি আমাকে গুলির ভয় দেখাও? কর দেখি গুলি, তোমার কত বড় সাহস।

 

ইউরী একেবারে হকচকিয়ে যায়, নিজেকে সামলে নিয়ে কিছু-একটা বলতে চাইছিল, লু তাকে সুযোগ না দিয়ে প্রচণ্ড জোরে ধমকে ওঠে, তুমি ট্রাইটনে খবর পাঠাতে ঢাইছ আমার অনুমতি ছাড়া? তুমি জান এটা একটা মহাকাশযান, আর আমি এই মহাকাশযানের দলপতি? আমি ইচ্ছে করলে তোমাকে ট্রাইটনে ছুড়ে দিতে পারি? কাউকে আমার কৈফিয়ত পর্যন্ত দিতে হবে না?

ইউরী নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়েছে, রিভলবারটা একপাশে সরিয়ে রেখে বলল, আমি খুব দুঃখিত, তোমরা যে ব্যাপারটা এভাবে নেবে, আমি বুঝতে পারি নি।

 

বুঝতে পার নি? তুমি একজনের মাথায় রিভলবার ধরে ভয় দেখিয়ে কাজ করিয়ে নেবে আর আমরা সেটা সহজভাবে নেব?

ইউরী দুর্বলভাবে হেসে বলল, রিভলবারে গুলি নেই, তয় দেখানো ছাড়া এটা আর কোনো কাজে আসে না। আমি মেয়েটাকে বললাম, চল, ট্রাইটনে একটা খবর পাঠানোর চেষ্টা করে দেখি, মেয়েটা রাজি হল না—

তাই তুমি তার মাথায় রিভলবার চেপে ধরলে?

বলেছি তো গুলি নেই, একটু ভয় দেখানোর চেষ্টা করছিলাম। কী করব বল, এমনিতে রাজি না হলে আমি কী করব?

তোমার ট্রাইটনের সাথে যোগাযোগ করার এত কী প্রয়োজন?

 

এই নিউট্রিনো জেনারেটর দিয়ে তোমরা দূরে কোথাও যোগাযোগ করতে পারবে, একমাত্র যোগাযোগের চেষ্টা করতে পার ট্রাইটনের সাথে, সে কাছে আছে, মাত্র হাজার কিলোমিটার। তার সাথে যোগাযোগ করতে কোনো ক্ষতি তো নেই। যদি সত্যি বুদ্ধিমান প্রাণী হয়, মুখোমুখি কথা বলতে ক্ষতি কী, হয়তো তাকে কিছু একটা বোঝাতে পারব।

পেরেছ?

না। তাকে বলেছি সে যদি আমাদের সংকেত বুঝতে পারে তা হলে যেন বড় লাল বৃত্তটি আস্তে আস্তে ছোট করে ফেলে।

করেছে?

না, করে নি।

ও। লু কি বলবে বুঝতে পারে না, খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে সে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল, ইউরী তাকে ডাকল, লু।

কি হল।

আমি কি ট্রাইটনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করতে পারি?

লু একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমার ইচ্ছে।

করিডোর ধরে হেঁটে যেতে যেতে লু দেখল, নীষা একটা গোল জানালার পাশে বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে আছে। লুকে দেখে আস্তে আস্তে বলল, ট্রাইটনকে দেখেছ?

কী হয়েছে?

বড় লাল বৃত্তটি কেন জানি আস্তে আস্তে ছোট হয়ে যাচ্ছে।

 

বংশধর

ট্রাইটনের সাথে কথাবার্তা হল খুব সংক্ষিপ্ত প্রশ্নগুলি করতে হল এমনভাবে, যেন হাঁ কিংবা না বলে উত্তর দেয়া যায়। হা হলে বড় বৃত্তটি বড় করবে, না হলে ছোট। এভাবে কথোপকথন করা খুব কষ্ট, কিন্তু তবু ওরা চেষ্টার ত্রুটি করল না। খুব বেশি লাভ হল না, কারণ ট্রাইটন হ্যাঁ কিংবা না কোনো উত্তরই বেশিক্ষণ দিতে চাইল না।

প্রথম প্রশ্ন করল লু জিজ্ঞেস করল, তুমি কি আমাদের যেতে দেবে?

না।

তুমি আমাদের সাথে সহযোগিতা করতে চাও?

কোনো উত্তর নেই।

আমাদের সভ্যতা নিয়ে তোমার কোনো কৌতূহল আছে?

কোনো উত্তর নেই।

তুমি তোমার বংশধরকে পৃথিবীতে পাঠাতে চাও?

হ্যাঁ।

কিন্তু এটা কি সত্যি নয়, যে, আমরা যদি ফিরে না যাই তুমি তোমার বংশধরকে পৃথিবীতে পাঠাতে পারবে না?

কোনো উত্তর নেই।

লু খানিকক্ষণ ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি আমাদের মেরে ফেলতে চাও?

কোনো উত্তর নেই।

আমরা কি তোমার বংশধরকে মেরে ফেলব?

না না না—

 

এরপর হঠাৎ করে ট্রাইটন তাদের সব প্রশ্নের উত্তর দেয়া বন্ধ করে দেয়। অনেক চেষ্টা করেও কোনো লাভ হল না। কি করা যায় ঠিক করার জন্যে সবাই একত্র হয়েছে লুয়ের ঘরে, ইউরী ছাড়া। সে এখনো নিউট্রিনো জেনারেটর দিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে ট্রাইটনের সাথে যোগাযোগ করার জন্যে। তার বিশ্বাস, কোনোভাবে যদি তাকে জিটা নিউট্রিনোর সুপার সিমেট্রিক বোজনের ভরের সমস্যাটা বুঝিয়ে দেয়া যায়, সে তার একটা কিছু উত্তর বলে দেবে। মরতে যদি হয়ই সুপার সিমেট্রিক বোজনের ভরের মানটুকু জেনে মরতে দোষ কী?

 

লুয়ের ঘরটা একটু ছোট, কিন্তু সবাই তবু এখানেই এসে বসেছে। খোলামেলা জায়গায় বসতে আর কেউ নিজেকে নিরাপদ মনে করে না, কোন দিক দিয়ে ট্রাইটনের বংশধর এসে কী করে বসে, কে জানে! দরজার কাছে কিম জিবান বসেছে, হাতে একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, তিন ধরনের ভিন্ন ভিন্ন রশ্মি বের হয় এটা দিয়ে, ছয় ইঞ্চি স্টেনলেস স্টিলের পাতকে ফুটো করে ফেলতে পারে এই রশ্মি, ট্রাইটনের বংশধর থেকে আত্মরক্ষা করার জন্যে এর থেকে ভালো অস্ত্র আর কী হতে পারে?

 

দীর্ঘ সময় সবাই চুপ করে বসে থাকে, কী নিয়ে কথা বলবে ঠিক যেন বুঝতে পারছে না। লু কয়েকবার কী-একটা বলতে গিয়ে চুপ করে যায়, ব্যাপারটি সবাই লক্ষ করেছে, কিন্তু তবু সাহস করে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে না। যে কথাটি লু বলতে চাইছে না, সেটি ভালো কিছু হতে পারে না। নীষা শেষ পর্যন্ত সাহস করে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, তুমি কি কিছু বলবে, লু?

 

হ্যাঁ, কিতাবে বলব বুঝতে পারছি না।

কেন, কী হয়েছে?

লু একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলেই ফেলল, আমি সিসিয়ানকে ধ্বংস করে ফেলার ব্যবস্থা করে ফেলেছি। তিন ঘন্টা পর সিসিয়ান উড়ে যাবে।

কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলতে পারে না।

কারো বিশেষ কিছু বলার ছিল না। সুশান একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, এখন তোমার কী করার ইচ্ছে?

তিন ঘন্টা সময় খুব অল্প, আমাদের বিশেষ কিছু করার নেই সুশান।

ও সুশান এর থেকে বেশি কিছু বলার খুঁজে পেল না।

 

সিসিয়ানকে ধ্বংস করা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই। ট্রাইটনের বংশধর নিশ্চয়ই এখন আমাদের একজন একজন করে শেষ করে দেবে, সিসিয়ান তখন ভুতুড়ে একটা উপগ্রহের মতো ঝুলতে থাকবে এখানে। যারা আমাদের উদ্ধার করতে আসবে, তারা জানবে না এখানে কী হয়েছিল, খুব সম্ভব তারা না জেনেই তাদের মহাকাশযানে করে ট্রাইটনের বংশধরকে নিয়ে যাবে পৃথিবীতে। সেটা কিছুতেই ঘটতে দেয়া যায় না।

রু–টেক বলল, সিসিয়ানকে নিয়ে আমরা সবাই যদি ধ্বংস হয়ে যাই, তা হলে যারা পরে আমাদের খোঁজে আসবে, তারা আবার আমাদের অবস্থায় পড়বে না তুমি কেমন করে জান?

 

আমি জানি না, কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই। যারা আমাদের খোঁজে আসবে। তারা অন্তত জানবে এখানে রহস্যময় কিছু-একটা ঘটেছে, সিডিসির মতো একটা কম্পিউটার সিসিয়ানের মতো একটা মহাকাশযানকে বাঁচাতে পারে নি, মহাকাশ অভিযানের ইতিহাসে এমন কখনো ঘটে নি। কাজেই তারা প্রস্তুত হয়ে আসবে, আমাদের যে-বিপর্যয় হয়েছে, তাদের সেটা হবে না।

লু একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি খুবই দুঃখিত যে, তোমাদের রক্ষা করতে পারলাম না। তোমাদের জীবনের শেষ মুহূর্তগুলি যে একটু আনন্দের ব্যবস্থা করব, আমার এখন তার ক্ষমতা পর্যন্ত নেই।

 

শীষা বলল, তুমি শুধু শুধু নিজেকে অপরাধী ভেবো না, আমাদের প্রাণ বাচানোর দায়িত্ব তোমার নয়। আমি আগেই বলেছি, তোমার দায়িত্ব ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া। তুমি সেটা নিয়েই। আমি তোমার পাশাপাশি কাজ করার সুযোগ পেয়ে নিজেকে সব সময়ে ধন্য মনে করেছি।

কিম জিবান একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না, তাই নিজে থেকে কিছু বলতে চেষ্টা করছি না। তবে নী যেটা বলেছে সেটা পুরোপুরি আমার মনের কথা।

 

সুশান বলল, আমারও।

রু-টেক বলল, আমি ইচ্ছে করলে অনেক গুছিয়ে কথা বলতে পারি, কিন্তু তার চেষ্টা করব না। কারণ নীষা যেটা বলেছে আমিও একই জিনিস অনুভব করি।

লু একটু অপ্রস্তুতভাবে হেসে বলল, আমার অপরাধবোধকে কমানোর চেষ্টা করছ বলে তোমাদের অনেক ধন্যবাদ। তোমাদের মতো সহকর্মীর সাথে কাজ করেছি বলেই আমি এত নিশ্চিন্ত মনে মারা যেতে পারব। শেষ সময়টুকু তোমরা কে কী ভাবে কাটাতে চাও জানি না, আমি ঠিক করেছি সেটা ট্রাইটনের বংশধরকে খুঁজে বের করে কাটাব।

কিম জিবান জিজ্ঞেস করল, খুঁজে পেলে কী করবে লু?

 

মেরে ফেলব।

কিম জিবান শব্দ করে হেসে বলল, তোমার মনের জোর আছে লু।

এখন আর কিছু থেকে লাভ নেই, মনের জোরটাই যদি আরো কিছুক্ষণ টিকিয়ে রাখে।

লু, আমি যদি তোমার সাথে বংশধর নিধনকাজে যোগ দিই, তোমার আপত্তি আছে? ট্রাইটনকে না পেয়ে তার বংশধরের উপরেই মনের ঝালটুকু মিটিয়ে নিই।

না, আমার কোনো আপত্তি নেই। নীষা বলল, আমরা একা একা বসে থেকে কী করব, আমরাও আসি তোমাদের সাথে।

বেশ।

সুশান আস্তে আস্তে বলল, অপেক্ষা করা খুব ভয়ংকর ব্যাপার, বিশেষ করে সেটা যদি শেষ সময়ের জন্যে হয়।

 

কী ভাবে বংশধরকে খুঁজে বের করা হবে, সেটা নিয়ে এক দুই মিনিট কথা বলে নেয়া হল। সিসিয়ানে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র রয়েছে মাত্র দু’টি, কাজেই একসাথে দু’টির বেশি দল যেতে পারবে না। ঠিক করা হল, এক দিকে যাবে কিম জিবান আর সুশান, অন্য দিকে লু আর নীষা। সিডিসি নেই বলে দুই দলে যোগাযোগ রাখা ভারি কঠিন ব্যাপার, রু-টেক তাই কন্ট্রোল রুমে বসে সেই দায়িত্ব পালন করার দায়িত্ব নিল। রু-টেক বংশধরকে খুঁজে বের করতে ওদের থেকে অনেক বেশি কার্যকর হত সন্দেহ নেই, কিন্তু এই শেষ মুহূর্তে কেউ চুপচাপ বসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় কাটাতে চাইছিল না। রু-টেক রবোট, সে তার ভয়ের সুইচটি বন্ধ করে সানন্দে মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করতে পারে।

 

প্রস্তুত হতে হতে ওদের আরো কিছুক্ষণ সময় লেগে গেল। সিসিয়ানের মোট তিনটি স্তর রয়েছে। পল কুমের মৃতদেহ রাখা হয়েছিল দ্বিতীয় স্তরে, তাই ঠিক করা হল সেটাই আগে দেখা হবে। পুরো এলাকাটি অনেক বড়, খুঁটিনাটি যন্ত্রপাতি এবং নানা ধরনের জিনিসপত্রে বোঝাই। সিডিসি না থাকায় এই স্তরে আলো নিস্পভ, কোথাও কোথাও একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। পলের মৃতদেহ যেখানে রাখা হয়েছিল, সেখান থেকে ওরা শুরু করে, লু নীষাকে নিয়ে রওনা দিল সামনের দিকে, কিম জিবান সুশানকে নিয়ে পিছন দিকে। ওদের মাথায় লাগানো উজ্জ্বল আলো, ইচ্ছে করলে জ্বালাতে পারে, আবার ইচ্ছে করলে নিভিয়ে দিতে পারে। কানে ছোট হেডফোনে রু-টেকের মাধ্যমে অন্য দলের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা। আপাতত নীষা আর কিম জিবান স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দু’টি নিয়ে হাঁটছে, যেটুকু ওজন হলে অস্ত্রটি সহজে টেনে নেয়া যেত এগুলি তার থেকেও বেশ খানিকটা ভারি, তাই ঠিক করা হয়েছে কিছুক্ষণ পরে পরে হাতবদল করা হবে।

 

ওরা নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে একটা ঘরের সামনে দাঁড়ায়, একজন লাথি দিয়ে আচমকা দরজা খুলে দিয়েই সরে যায়, অন্যজন বিদ্যুৎগতিতে অস্ত্র তাক করে ঘরে ঢুকে পড়ে। মাথায় লাগানো উজ্জ্বল আলোতে ঘরটা ভরে যায়, ওরা তখন লক্ষ করার চেষ্টা করে, হঠাৎ করে ঘরের ভিতরে কিছু নড়ে গেল কি না, কোনো কিছু সরে গেল কি না। তন্নতন্ন করে ওরা অস্বাভাবিক কিছু একটা খুঁজতে চেষ্টা করে। প্রাণীটা দেখতে কেমন, কত বড়, কোনো ধরনের ধারণা নেই, তাই ভালো করে ওরা জানেও না, ঠিক কী খুঁজছে। ভিতরে ভিতরে ওদের একটা অশরীরী আতঙ্ক, প্রতিবার একটা দরজা খুলে ঢোকার আগে ওদের একজনের আরেকজনকে সাহস দিতে হয়, ভিতরে ঢুকে যখন দেখে কিছু নেই, ওরা তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

 

ঘন্টাখানেক কেটে যায় এভাবে, কিছু দেখতে পাবে তার আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। এমনিতে ব্যাপারটিতে কষ্টকর কিছু নেই, কিন্তু প্রতি মুহূর্তে অজানা একটা আতঙ্ক নিয়ে কাজ করা ভারি যন্ত্রণাদায়ক, মানুষ এরকম অবস্থায় খুব তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে যায়। অন্য সময় হলে ওৱা থেমে বিশ্রাম নিত, কিন্তু আজ অন্য ব্যাপার। টিকটি করে ঘড়িতে সময় বয়ে যাচ্ছে, যতক্ষণ তারা এই অমানুষিক কাজে নিজেদের ডুবিয়ে রাখতে পারে, ততক্ষণ ওদের মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করার দুরূহ কাজটি করতে হয় না। তবু হয়তো তারা খানিকক্ষণের জন্যে থামত, কিন্তু হঠাৎ করে তারা বংশধরের সাক্ষাৎ পেয়ে গেল।

 

সুশান ঘরের দরজাটি লাথি মেরে খুলে সরে যাবার আগের মুহূর্তে বলল, সাবধান।

কিম জিবান থমকে দাঁড়ায়। সামনে তাকিয়ে সে স্তম্ভিত হয়ে গেল, ঘরটির মেঝের অংশবিশেষ কেউ খুব সাবধানে যেন কেটে নিয়েছে। কাটা অংশ দিয়ে নিচের স্তর দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। কয়েক মুহূর্ত কেউ কোনো কথা বলতে পারে না।

রু-টেকের গলার স্বর শোনা গেল, কী হয়েছে?

এখনো জানি না। ঘরটার জায়গায় জায়গায় কেউ কেটে নিয়েছে, প্রাণীটাই হবে নিশ্চয়ই।

দেখা যাচ্ছে প্রাণীটাকে?

ওরা তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে খোঁজার চেষ্টা করে প্রাণীটাকে, কিন্তু কোথাও কিছু নেই। কিম জিবান আস্তে আস্তে বলল, এখনো দেখছি না।

কী করবে এখন তুমি?

ভিতরে গিয়ে খুজব।

যে-প্রাণী স্টেনলেস স্টিল আর টাইটেনিয়ামের দেয়াল কেটে নিতে পারে, সেটার সাথে লড়তে যাওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয় কিম।

তা ঠিক, কিন্তু কী করব বল? তুমি বরং লুকেও আসতে বল এদিকে।

বলছি।

 

কিম জিবান লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে শক্ত হাতে অস্ত্রটিকে ধরে ঘরের ভিতরে এক পা ঢোকে, সাথে সাথে সরসর করে কোথায় জানি কি একটা শব্দ হল, মনে হল কিছু একটা যেন হঠাৎ বাম দিকে সরে গেছে।

কিম জিল বাম দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে সাবধানে আরো এক পা এগিয়ে যায়। পিছনে পিছনে সুশান এসে ঢোকে, উত্তেজনায় তার বুকের ভিতরে ঢাকের মতো শব্দ হচ্ছে, ফিসফিস করে বলল, কিছু-একটা আছে বাম দিকে।

 

বাম দিকে সিসিয়ানের দেয়াল, নানা ধরনের পাইপ, বৈদ্যুতিক এবং অপটিকেল তারগুলি ওদিক দিয়ে গিয়েছে। ছোটখাটো একটা যন্ত্রপাতির স্তর রয়েছে ওপাশে, তার পিছনে কিছু-একটা আশ্রয় নিয়েছে বলে মনে হয়। আবছা অন্ধকার ওখানে, ভালো করে দেখা যায় না। কিম জিবান আলোটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে সাবধানে এগিয়ে যায়, সাথে সাথে একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার শোনা গেল, প্রচণ্ড ধাক্কায় ছিটকে পড়ে সে একপাশে, কয়েক মুহূর্ত সে কিছু বুঝতে পারে না কি হচ্ছে। সাবধানে উঠে দাঁড়ায় কিম জিবান, ঘরে হলুদ রঙের ধোয়া, ঝাঁঝাল গন্ধে ঘর ভরে গেছে, খকখক করে কাশতে থাকে সে। সামনে গোলাকার আরেকটা গর্ত। একটু আগেও সেখানে কিছু ছিল না। পিছনে তাকিয়ে দেখে, সুশান ফ্যাকাসে মুখে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

 

কী হয়েছে কিম?

জানি না, প্রাণীটা সম্ভবত একপাশ থেকে অন্য পাশে সরে গেল।

তোমাদের কোনো ক্ষতি হয় নি তো?

না।

দেখেছ প্রাণীটাকে?

না, কিম জিবান সুশানের দিকে তাকায়, তুমি দেখেছ?

সুশান ফ্যাকাসে মুখে মাথা নাড়ে, না, লাল মতন কী একটা জানি উপরে উঠে আছড়ে পড়েছে, এত তাড়াতাড়ি হয়েছে যে কিছু বুঝতে পারি নি। একটু থেমে যোগ করল, আমার ভয় লাগছে কিম।

লাগারই কথা। ফিরে যাবে? দরকার কি জীবনের শেষ সময়টা ভয় পেয়ে নষ্ট করার?

রু-টেকের গলা শুনতে পেল আবার, কিম আর সুশান, আমি লুয়ের সাথে কথা বলেছি, সে নীষাকে নিয়ে আসছে তোমাদের দিকে। সে না আসা পর্যন্ত তোমরা নিজে থেকে কিছু কোরো না।

বেশ।

কিম জিবান অস্ত্র হাতে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ঘামতে থাকে, ভয়াবহ একটা আতঙ্ক এসে ভর করেছে ওর উপর।

 

লুয়ের পিছু পিছু নীষা ছুটে আসছিল, হঠাৎ দু’জনেই থমকে দাড়াল, যেখানে কিম আর সুশান রয়েছে তার করিডোরে একটা বড় গর্ত। ওরা একটু আগেই এদিক দিয়ে গিয়েছে, তখন গর্তটা সেখানে ছিল না। হলুদ রঙের একটা ধোঁয়া ভাসছে বাতাসে, ঝাঁঝাল একটা গন্ধ সেখানে। লু থমকে দাঁড়ায়, তারপর রু-টেকের সাথে যোগাযোগ করে রু।

 

কি হল?

তুমি কিম আর সুশানকে বল, আমাদের আসতে একটু দেরি হবে।

সমস্যা?

হ্যাঁ, করিডোর ধরে আসার উপায় নেই, পুরোটা কেউ উধাও করে দিয়েছে।

ও।

লু নীষাকে নিয়ে অন্যদিকে ছুটে গেল, মনে মনে যে আশঙ্কাটি করছিল সত্যিই তাই ঘটেছে, অন্য পাশেও করিডোরটি উধাও করে দিয়েছে কেউ। চারদিক থেকে কিম আর সুশানকে আলাদা করে ফেলেছে প্রাণীটি, কী করবে এখন ওদের? লু আবার রু-টেকের সাথে যোগাযোগ করে রু।

 

বল।

কিম আর সুশান ঠিক কোথায় আছে জান?

জানি।

কত ভালো করে জান?

খুব ভালো করে, ওদের শরীরে একটা রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি বীপার লাগানো আছে, আমি সেটা থেকে বলতে পারি ঠিক কোথায় তারা আছে। তোমরা কোথায় আছ সেটাও জানি—

আমাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ো না। রু-টেক শোন।

বল।

কিম আর সুশান যেখানে আছে, তার উপরের স্তরে কী আছে?

আর্কাইভ ঘর। প্রয়োজনীয় দলিল।

ঘরটাকে সিসিয়ান থেকে পুরোপুরি আলাদা করা যায়?

শুধু ওটাকে করা যাবে না, কিন্তু পাশাপাশি দুটি ঘরকে একসাথে করা যাবে।

চমৎকার। তুমি ঘর দু’টিকে আলাদা করে, বায়ুশূন্য করে ফেল। আমি আসছি।

লু।

বল।

তুমি কী করতে চাইছ আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু কাজটা একটু বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে না?

দু’ঘন্টা পর আমরা সবাই শেষ হয়ে যাব, বড় বিপদের ঝুঁকি নিয়ে আমরা খুব বেশি হলে দু’ঘন্টা সময় হারাব, বুঝতে পেরেছ?

পেরেছি।

 

কিম জিবান স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি হাতে দাড়িয়ে আছে, তাকে পিছন থেকে খামচে ধরে রেখেছে সুশান। প্রচণ্ড আতঙ্কে সে অনেকটা হিস্টিরিয়াগ্রস্ত মানুষের মতো হয়ে গেছে। ঘরের কোনায় বড় বড় যন্ত্রপাতি এবং মনিটরগুলির পিছন থেকে অনেকক্ষণ থেকে কেমন জানি একটা অনিয়মিত তীক্ষ্ণ শব্দ হচ্ছিল। হঠাৎ করে কী একটা জানি নড়ে যায়, কিন্তু ওরা ঠিক ধরতে পারে না, কী। যে-প্রাণী অবলীলায় শক্ত স্টেনলেস স্টিলের দেয়াল মুহূতে উধাও করে দিতে পারে, তার পক্ষে মানুষকে শেষ করা কঠিন কিছু নয়, কিন্তু প্রাণীটি এখনো তাদের কিছু করছে না। তাদের চারদিক থেকে আলাদা করে এনেছে, এখন কী করবে তাদের?

হঠাৎ সুশান চিৎকার করে ওঠে, ঐ দেখ—

কিম জিবান স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি নিয়ে বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে যায়, কোথাও কিছু নেই। শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে সুশান?

ভয়-পাওয়া গলায় সুশান মেঝের দিকে দেখায়, ঐ দেখ।

ঘরের কোনা থেকে কী—একটা জিনিস যেন আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে, দুইতিন ইঞ্চি পুরু তরল পদার্থের মতো। উপরে হলুদ ধোঁয়ার আস্তরণ।

কিম জিবান স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি ঘুরিয়ে সেদিকে ধরতেই, হঠাৎ তরল পদার্থের মতো জিনিসটি যেন থমকে দাঁড়াল, তারপর উত্তপ্ত পানির মতো টগবগ শব্দ করে ফুটতে থাকে, সারা ঘর ঝাঁঝাল গন্ধে ভরে যায় হঠাৎ।

কী ওটা?

জানি না। আরেকটু কাছে এলেই মেগাওয়াটের পার্টিকেল বীম চালিয়ে দেব, শেষ করে দেব শুওরের বাচ্চাকে।

কিমের কথা শুনেই যেন তরল পদার্থের আস্তরণটি শীতল হয়ে গেল, টগবগ করে ফোটা বন্ধ করে সেটি আবার ধীরে ধীরে এগুতে থাকে। উপরের হলুদ ধোঁয়াটি সরে যেতেই ওরা দেখতে পায়, আস্তরণটির উপরে আশ্চর্য একধরনের নকশা তৈরি হচ্ছে, দেখে কখনো মনে হয় অজস্র সরীসৃপ, কখনো মনে হয় অসংখ্য প্রেত। অস্বস্তিকর একধরনের শব্দ করতে করতে জিনিসটা এগিয়ে আসতে থাকে, চারদিক থেকে ঘিরে ফেলছে তাদের, কী করবে এখন?

কিম জিনিসটার মাঝামাঝি তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি তাক করে ট্রিগার টেনে ধরে, নীলাভ একটা রশ্মি বের হয়ে আসে, সাথে সাথে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ। ধোঁয়া সরে যেতেই দেখে তরল পদার্থের মধ্যে জিনিসটা প্রচণ্ড শব্দ করে ফুটছে, পার্টিকেল বীম সেটির কোনোরকম ক্ষতি করেছে, তার কোনো চিহ্ন নেই।

কিম, লুয়ের গলা শুনতে পেল, কিম শুনছ?

হ্যাঁ লু, ভয়ানক বিপদে আছি আমরা, কী একটা জিনিস—

কিম, এখন তোমার কিছু বলার প্রয়োজন নেই, তুমি আমার কথা শোন।

এগিয়ে আসছে সেটা আমাদের দিকে, আর কয়েক ফুট মাত্র বাকি।

আমার কথা শোন এখন, তুমি তোমার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি তের মেগাবাইটে সেট কর, তারপর মাথার উপর তুলে ধর, সোজা উপরের দিকে।

ধরেছি।

আমি বলামাত্রই গুলি করবে। তের মেগাওয়াট পার্টিকেল বীম প্রায় তিন ফুট ব্যাসের একটা গর্ত করে ফেলবে ছাদে। উপরের ঘরটা এখন বায়ুশূন্য, তোমার ঘর থেকে প্রবল বেগে বাতাস উঠে আসবে, শুরু হবে প্রায় ছয় শ’ কিলোমিটার দিয়ে, সেই বাতাস তোমাদের টেনে আনবে উপরে–

কিন্তু–

তোমরা হয়তো মারা যাবে প্রচণ্ড আঘাতে, কিন্তু আমরা সবাই তো মারা যাব কিছুক্ষণের মাঝে। আমি দুঃখিত, কিন্তু আর কিছু করার নেই কিম। হাত উপরে তুলে রাখ কিম আর সুশান—

লু, শোন, তুমি—

শোনার কিছু নেই, গুলি করতে প্রস্তুত হও কিম, এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে কঠিন স্বরে চিৎকার করে বলল, টানো ট্রিগার।

 

ভয়ানক একটা বিস্ফোরণ হল মাথার উপরে, গোল একটা গর্ত হয়ে গেল মুহূর্তে। প্রচন্ড বাতাসের ঝাপটায় কিম জিবান আর সুশান গুলির মতো উড়ে গেল উপরে। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে দেখে, তারা উড়ে যাচ্ছে বাতাসে, দু’হাতে মাথা বাচিয়ে রাখে তারা, কিন্তু কিছু বোঝার আগেই প্রচণ্ড গতিতে আছড়ে পড়ে সিসিয়ানের দেয়ালে, মুহূর্তে জ্ঞান হারালো দুজনেই।

 

রু-টেক কিম আর সুশানের অচেতন দেই সরিয়ে নেয় সাবধানে, সে বায়ুশুন্য পরিবেশে থাকতে পারে বলে ওদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। মেঝের ফুটো দিয়ে প্রচণ্ড বেগে বাতাস আসছে, বাতাসের চাপ সমান হওয়ামাত্রই থেমে যাবে। রু–টেক শঙ্কিত দৃষ্টিতে গর্তটির দিকে তাকিয়ে থাকে। নিচের প্রাণীটি কি উঠে আসবে উপরে? সম্ভবত নয়, ঝুকি নেবে না নিশ্চয়ই।

বাতাসের চাপ সমান হতেই দরজা খুলে যায়, উদ্বিগ্ন মুখে লু আর নীষা অপেক্ষা করছে পাশের ঘরে। রু–টেককে জিজ্ঞেস করল, কি অবস্থা?

ভালো নয়। এখনো বেঁচে আছে দুজনেই। আঘাতটা মাথায় লাগে নি, কাজেই বেচৈ যাবার ভালো সম্ভাবনা ছিল।

ওদের ধরাধরি করে পাশের ঘরে সরিয়ে নিয়ে রু–টেক ভালো করে পরীক্ষা করে দেখে, ছোটখাটো কয়েকটা ব্যান্ডেজ এদিকে সেদিকে লাগিয়ে দেয় যত্ন করে। ঘন্টাখানেক পরে সবাইকে নিয়ে এই মহাকাশযানটি চিরদিনের মতো ধ্বংস হয়ে যাবে, তবুও চোখের সামনে আহত দু’জনকে কোনোরকম সাহায্য না করে কেমন করে থাকে? নীষা সিসিয়ানের জরুরি ঘর থেকে দু’টি স্টেনলেস স্টিলের ক্যাপসুল নিয়ে আসে, ওরা তিনজন মিলে যখন কিম আর সুশানকে সাবধানে ভিতরে শুইয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করছিল, ঠিক তখন কাতর শব্দ করে সুশান চোখ খুলে তাকায়, কয়েক যুহূর্ত লাগে তার বুঝতে, কী হচ্ছে। সবকিছু মনে পড়তেই সে ধড়মড় করে উঠে পড়তে চাইছিল, লু সাবধানে শুইয়ে দেয় আবার, বলে, শুয়ে থাক সুশান।

আমরা কি ফিরে যাচ্ছি?

এক মুহূর্ত দ্বিধা করে সে বলল, হ্যাঁ।

ট্রাইটন আমাদের যেতে দিচ্ছে?

হ্যাঁ।

আমরা তাহলে কেউ মারা যাব না?

না সুশান।

কিন্তু ট্রাইটনের বংশধর–

সেটা নিয়ে কিছু চিন্তা কোরো না, তাকে আমরা রেখে যাচ্ছি।

সত্যি?

সত্যি, তুমি এখন ঘুমাও।

সুশান সাথে সাথে বাধ্য মেয়ের মতো চোখ বন্ধ করে। কিছুক্ষণের মাঝেই ক্যাপসুলের যন্ত্রপাতি সুশানের দায়িত্ব নিয়ে নেবে, তখন সে অনির্দিষ্টকালের মতো ঘুমিয়ে থাকতে পারবে। যদি সত্যি সত্যি সুশান বিশ্বাস করে যে সে এখন পৃথিবীতে ফিরে যাচ্ছে, মন্দ কি? একটা সুখ-স্বপ্ন নিয়ে নাহয় কাটাক জীবনের শেষ সময়টক।

 

ওরা যখন কিম জিবানের অচেতন শরীরকে ক্যাপসুলের মাঝে শুইয়ে দিচ্ছিল, তখন হঠাৎ ইউরী এসে হাজির হল, তার চোখ-মুখে উত্তেজনার ছাপ, ওদের কাজে কোনোরকম কৌতূহল না দেখিয়ে বলল, ট্রাইটনের রং আস্তে আস্তে গাঢ় লাল রঙের হয়ে যাচ্ছে, খেয়াল করেছ?

লোকটার উপরে রাগ করবে ভেবেও লু ঠিক রাগ করতে পারে না, একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, তাই নাকি?

হ্যাঁ। ভারি মজার ব্যাপার।

মজার কী হল এখানে?

মজার হল না? আমি এখানে বসে তাকে জিজ্ঞেস করি সুপার সিমেট্রিক বোনের ভর, আর সে তার উত্তর না দিয়ে টকটকে লাল হয়ে যায়।

উত্তর হয়তো জানে না, তাই লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে।

 

লুয়ের রসিকতাটুকু ইউরী ধরতে পারল না, মাথা নেড়ে বলল, না না, লজ্জা নয়, বাড়তি উত্তাপটুকু বিকিরণ করার জন্যে গায়ের রং ওরকম গাঢ় লাল করেছে।

নীষা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, বাড়তি উত্তাপ কিসের?

নিউট্রিনো থেকে পাচ্ছে।

লু অবিশ্বাসের ভঙ্গি করে বলল, আমাদের নিউট্রিনো জেনারেটর দিয়ে মেগাওয়াট পাওয়ার বের হয় কিনা তাতে সন্দেহ আছে, আর তুমি বলছ সেটা পুরো টাইটনের ভাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে?

 

ইউরী একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, না না, তুমি বুঝতে পারছ না, ট্রাইটন তার শরীরে একটা নিউট্রিনো ডিটেকটর তৈরি করেছে, তাই সে আমাদের পাঠানো সিগন্যাল দেখতে পায়। কিন্তু নিউট্রিনোর তো অভাব নেই, শুধুমাত্র সূর্য থেকে যে-পরিমাণ নিউট্রিনো বের হয় সেটার জন্যে পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের শরীর দিয়ে সেকেন্ডে কয়েক লিওন করে নিউট্রিনো পার হয়ে যায়। এখানকার কথা ছেড়েই দাও। ট্রাইটনকে আমাদের অল্প কয়টা নিউট্রিনোর সাথে সাথে আরো ট্রিলিওন ট্রিলিওন নিউট্রিনো দেখতে হচ্ছে, ঐসব নিউট্রিনো থেকে যে-তাপ বের হয়, সেটা ট্রাইটনকে গরম করে ফেলতে পারে।

 

লু অস্বীকার করতে পারে না যে, ব্যাপারটুকু সত্যি হলে নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ।

ইউরী হঠাৎ কী-একটা ভেবে বলল, ভারি মজার একটা পরীক্ষা করা যায়। আমি যদি নিউট্রিনোর সংখ্যা কমাতে থাকি, ট্রাইটনাকে তার ডিটেকটরটি আরো সংবেদনশীল করতে হবে, ফলে সে আরো বেশি নিউট্রিনে দেখবে, কাজেই পুরো ট্রাইটন আরো বেশি গরম হয়ে উঠবে। তাপ বিকিরণ করার জন্যে তখন ট্রাইটনকে হতে হবে কুচকুচে কালো।

ইউরী উঠে দাড়িয়ে ঘর থেকে বের হতে হতে বলল, ঘন্টাখানেক সময়ের মাঝে তোমরা দেখবে, ট্রাইটনটি হয়েছে কুচকুচে কালো।

 

লু একটু ইতস্তত করে বলল, ইউরী, তোমাকে ঠিক কী ভাবে বলব বুঝতে পারছি না, কিন্তু মনে হয় বলে দেয়াটাই উচিত, আমি পুরো সিসিয়ানকে ধ্বংস করে ফেলার ব্যবস্থা করে ফেলেছি। আর ঘন্টাখানেক সময়ের মাঝে আমাদের সবাইকে নিয়ে পুরো সিসিয়ান ধ্বংস হয়ে যাবে।

ইউরীর মুখ দেখে মনে হল সে ঠিক লুয়ের কথা বুঝতে পারছে না, খানিকক্ষণ অবাক হয়ে লুয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি সিসিয়ানকে উড়িয়ে দেবে?

হ্যাঁ, এ ছাড়া কোনো উপায় নেই। ট্রাইটনের বংশধরকে কিছুতেই পৃথিবীতে পাঠানো যাবে না। সেটা বন্ধ করার আর কোনো উপায় নেই।

 

ইউরী ফ্যাকাসে মুখে ফিরে এসে একটা উঁচু মনিটরের উপরে বসে অনেকটা আপন মনে বলল, আমরা সবাই মারা যাব?

আমি দুঃখিত ইউরী।

ইউরী হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলল, একটা সুপারনোভা৩০ যদি কোনোভাবে তৈরি হত এখন।

কী বললে?

সুপারনোভা। একটা নক্ষত্র যখন সুপারনোভা হয়ে যায়, তখন তার থেকে অচিন্তনীয় নিউট্রিনো বেরিয়ে আসে, হঠাৎ করে যদি অসংখ্য নিউট্রিনো এসে হাজির হয়, তখন ট্রাইটনে যে-তাপের সৃষ্টি হবে, তাতে সে ফেটে চৌচির হয়ে যাবে।

কিন্তু এক শ’ বছরে হয়তো একটা সুপারনোভার জন্ম হয়, আমাদের হাতে সময় এখন এক ঘন্টা।

একটা পালসারও যদি থাকত আশেপাশে।

লু চমকে উঠে বলল, কী বললে তুমি? পালসার?

হ্যাঁ, পালসার। চতুর্থ মাত্রার পালসারে যখন নির্দিষ্ট সময় পরে পরে বিস্ফোরণ হয়, তখনও অসংখ্য নিউট্রিনো বেরিয়ে আসে। সুপারনোভার মতো এত বেশি নয়, কিন্তু অনেক, ট্রাইটনকে শেষ করে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট!

 

লু ইউরীর দিকে ঘুরে বলল, তুমি সত্যি বলছ?

ইউরী একটু অবাক হয়ে বলল, সত্যি না বলার কী আছে?

আমাদের খুব কাছাকাছি একটা পালসার আছে, ছয় ঘন্টা পরপর বিস্ফোরণ হয়, আমি এই পালসারটা দিয়ে আমাদের অবস্থান ঠিক করেছি।

কত দূর এখান থেকে?

বিলিয়ন কিলোমিটারের মতো।

ইউরী লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়, মাত্র বিলিয়ন কিলোমিটার? আমাকে আগে বল নি কেন? কোন মাত্রার?

জানি না।

গামা রেডিয়েশানে স্পেকট্রামটা বলতে পারবে?

লু দু’এক কথায় বুঝিয়ে দিতেই ইউরী চিৎকার করে ওঠে, চতুর্থ মাত্রা! চতুর্থ। মাত্রা! আর কোনো ভয় নেই।

নীষা আস্তে আস্তে বলল, তুমি সত্যিই বিশ্বাস কর যে, ট্রাইটনকে তুমি ধ্বংস করে দিতে পারবে?

অবশ্যি! নিজের হাতে সশব্দে থাবা দিয়ে ইউরী বলল, শুধু আমাকে কয়েক মিনিট সময় দাও।

রু–টেক দরজার কাছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল, এবার ঘুরে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি দুঃখিত ইউরী, কিন্তু আমাদের হাতে এখন কয়েক মিনিট সময়ও নেই।

 

কেন?

পাশের ঘরে ট্রাইটনের বংশধর চলে এসেছে, আমাদের এক্ষুণি সরে যেতে হবে।

সরে কোথায় যাব?

আমি ঠিক জানি না।

তুমি বুঝলে কেমন করে, প্রাণীটা এসেছে? প্রচণ্ড রেডিয়েশান হয়। কেন?

মনে হয় তাপমাত্রা ঠিক রাখার জন্যে কোনো একটা তেজস্ক্রিয় পদার্থ ব্যবহার করে।

আর এই প্রাণীটাকে তোমরা উন্নত বলে দাবি কর? কত বড় নির্বোধ হলে একটা প্রাণী রেডিও একটিভিটি দিয়ে তাপমাত্রা ঠিক করে—

রু-টেক বাধা দিয়ে বলল, আমাদের এক্ষুণি সরে যেতে হবে, প্রাণীটা খুব কাছে চলে এসেছে।

ইউরী ব্যস্ত হয়ে বলল, কিন্তু আমার একটু সময় দরকার যতক্ষণ পর্যন্ত পালসারটাতে আবার বিস্ফোরণ না হচ্ছে, আমার ট্রাইটনের সাথে যোগাযোগ রেখে যেতে হবে।

লু ঘরে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, সবাই স্পেসস্যুট পরে নাও, খুঁটিনাটি ব্যাপারের দরকার নেই, শুধুমাত্র বায়ুনিরোধক অংশটা ঠিক থাকলেই হল, তোমাদের ত্রিশ সেকেন্তু সময় দেয়া হল।

 

ইউরী মাথা নেড়ে বলল, আমি কখনো স্পেসস্যুট পরি নি, কী ভাবে পরতে হয় আমি জানি না।

লু নীষার দিকে তাকিয়ে বলল, নীষা, তুমি একটু ওকে সাহায্য কর। রু–টেক, তোমার তো কোনো স্পেসস্যুট পরতে হবে না, তুমি কিম জিবান আর সুশানের ক্যাপসুল দু’টি দেখ, সব ঠিক আছে কি না।

পুরো দলটা প্রস্তুত হতে হতে হঠাৎ করে দরজার একটা অংশ ধ্বসে পড়ল, হলুদ রংয়ের একটা ধোঁয়া বাতাসে ভেসে বেড়াতে থাকে। ওরা সবিস্ময়ে দেখে, মেঝের উপর দিয়ে তরল পদার্থের মধ্যে কী—একটা জিনিস এগিয়ে আসছে। ওরা ঘুরে তাকাতেই সেটি থমকে দাড়াল, তারপর হঠাৎ ফুটন্ত পানির মতো শব্দ করতে থাকে। জিনিসটির পৃষ্ঠে আশ্চর্য নকশা খেলা করছে।

 

ইউরী ভয় পাওয়া গলায় বলল, পালাও, সবাই পালাও—

লু শান্ত স্বরে বলল, যে যেখানে আছ দাঁড়িয়ে থাক, খবরদার নড়বে না।

তা হলে পালাব কেমন করে?

আমি ব্যবস্থা করছি। গুলি করে আমি পিছনের দেয়ালটা ধ্বসিয়ে দিচ্ছি, বাতাসের চাপে ছিটকে বেরিয়ে যাবে সবাই।

কিন্তু–

আর কোনো প্রশ্ন নয় এখন। ইউরী, নিউট্রিনো জেনারেটরটি ছেড়াে না হাত থেকে—

 

সবাই ঘূর্তির মতো দাড়িয়ে থাকে। লু আস্তে আস্তে ঘুরে পিছনের দেয়ালের কন্ট্রোল – বক্সের দিকে তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি উদ্যত করে। এই বাক্সটির ভিতরে বড় দরজাটি বন্ধ করার যন্ত্রপাতি, উড়িয়ে দিলে পুরো দেয়ালটি উড়ে যাবার কথা। লু সবাইকে একনজর দেখে ট্রিগার টেনে ধরে। প্রচও একটা শব্দ হল, পরমুহূর্তে ওরা সবাই ঘরের সব জিনিসপত্রসহ ছিটকে পড়ে মহাশূন্যে।

 

পরিশিষ্ট

লু মহাকাশে ভেসে যাচ্ছিল, বোঝার কোনো উপায় নেই কিন্তু সে জানে যে সে প্রচণ্ড বেগে ছুটে যাচ্ছে। যারা কখনো মহাকাশে ভেসে থাকে নি, তারা কখনোই এই অনুভূতিটি ঠিক বুঝতে পারবে না। লুকে নানা সময়ে নানা পরিবেশে মহাকাশে ভেসে বেড়াতে হয়েছে, তবুও সে এই অবস্থায় কখনো সহজ অনুভব করে না। প্রাণপণ চেষ্টা করে নিজেকে সামলে নিয়ে সে তার ছোট জেটটি চালু করে, কয়েক মুহূর্তের মাঝেই সে নিজের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে নেয়। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে তাদের যোগাযোগের ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেছে কি না জানা নেই, পরীক্ষা করার জন্যে সে সুইচটি টিপে দেয়, সাথে সাথে ইউরীর আর্তচিৎকার শুনতে পায়, বাঁচাও আমাকে বাচাও, আমি পড়ে যাচ্ছি—

 

লু বলল, ইউরী, তুমি পড়ে যাবে না, মহাকাশে কেউ পড়ে যায় না। তোমার কোনো ভয় নেই, আমি আসছি তোমার কাছে। নিউট্রিনো জেনারেটরটি আছে তো?

আছে। আমি শক্ত করে ধরে রেখেছি।

শক্ত করে ধরে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই, ওটা পড়বে না, তুমি ছেড়ে দিলেও ওটা তোমার পাশাপাশি থাকবে।

থাকুক, আমি তবু ছাড়ছি না।

তোমার ইচ্ছা। তুমি তোমার বাম হাতের কাছে যে নীল সুইচটা আছে সেটা চেপে ধর, তাহলে তোমার বীপারটা কাজ করতে শুরু করবে, আমি বুঝতে পারব তুমি কোথায় আছ।

করছি।

 

একমুহূর্ত পরেই সে ইউরীকে দেখতে পায়, বহু দূরে একটা আলো জ্বলতে এবং নিভতে শুরু করেছে। লু নিজের জেটটি চালু করে সেদিকে যেতে যেতে চারদিকে তাকায়, দূরে সিসিয়ান একটা ভূতুরে মহাকাশযানের মতো ভাসছে, নিচে বীভৎস। ট্রাইটন, কে জানে হয়তো এই মুহূর্তে তার দিকে তাকিয়ে আছে। লু চারদিকে তাকাতে তাকাতে নীষা আর রু-টেকের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে, কিছুক্ষণের মাঝেই তাদের সাড়া পাওয়া যায়, রু-টেক কিম জিবানের ক্যাপসুলটি খুঁজে পেয়েছে, সেটিকে সে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছে, এখন নীষাকে নিয়ে সে সুশানের ক্যাপসুলটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। লু ওদের এক জায়গায় একত্র হতে বলল, সে নিজে ইউরীকে নিয়ে কিছুক্ষণের মাঝেই ওদের কাছে হাজির হবে।

 

ইউরী লুকে দেখে যেন দেহে প্রাণ ফিরে পায়। দু’হাতে শক্ত করে নিউট্রিনো জেনারেটরটি ধরে রেখেছে, সেভাবেই বলল, কী আশ্চর্য অবস্থা! স্রেফ ঝুলে আছি! শুধু মনে হয় পড়ে যাব।

না, পড়বে না। ট্রাইটনের কী অবস্থা?

জানি না, এখন যোগাযোগ করব। মুশকিল হচ্ছে কিছুতেই সোজা থাকতে পারি। না, শুধু ঘুরে ঘুরে উল্টে যাই।

আমি তোমাকে ধরে রাখছি, তুমি যোগাযোগ কর। আমাদের সময় খুব বেশি নেই।

কতক্ষণ আছে?

খুব বেশি হলে দশ পনেরো মিনিট হবে, এর থেকে কমও হতে পারে।

সর্বনাশ! সময় তো দেখি একেবারেই নেই। ইউরী তাড়াতাড়ি নিউট্রিনো জেনারেটরটি ট্রাইটনের দিকে মুখ করে ধরে সুইচ টিপে সেটিকে চালু করে বলল, ট্রাইটনের কৌতূহল বজায় রাখার জন্যে তাকে খুব-একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বলা উচিত।

কি বলবে?

 

বলব তাকে উড়িয়ে দিচ্ছি। ইউরী শব্দ করে হেসে কিবোর্ডে টাইপ মাথা ঝুকিয়ে কী-একটা লিখতে থাকে। লু মাথা এগিয়ে নিয়ে দেখে সেখানে লেখা, একটা খুব জরুরি জিনিস বলছি, আমার কথা শুনতে পেলে উত্তর দাও। তোমার পৃষ্ঠের বড় গোলকটি ছোট করে ফেল।

নিজের জেটটি চালু করে ইউরীকে ঠেলে নিয়ে যেতে যেতে ট্রাইটনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সেখানে কোনো পরিবর্তন হল না। ইউরী আবার লিখল, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস তোমাকে বল, সাড়া দাও।

কোনো সাড়া নেই।

সাড়া দাও, আমাদের নিরাপত্তার জন্যে তোমাকে ধ্বংস করে ফেলব বলে ঠিক করেছি, সাড়া দাও।

তবু কোনো সাড়া নেই।

মানুষ অনেক উন্নত প্রাণী, তাদের দিয়ে জোর করে কোনো কাজ করিয়ে নেয়া যায় না, তুমিও পারবে না। তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছ? পারলে সাড়া দাও। তোমার নিজের ভালোর জন্যে বলছি, তোমার পৃষ্ঠের বড় বৃত্তটি ছোট করে ফেলা।

 

তবু কোনো সাড়া নেই, ইউরী ভয়ার্ত মুখে লুয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ট্রাইটন যদি এখন এই নিউট্রিনো রশ্মিকে উপেক্ষা করা শুরু করে থাকে?

উপায় নেই, চেষ্টা করতে থাক।

ইউরী আবার লিখল, আর পাঁচ মিনিটের মাঝে সাড়া দাও, না হয় তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে। তুমি জানতে চাও আমরা কী ভাবে তোমাকে ধ্বংস করব? যদি জানতে চাও তাহলে তোমার বড় গোলকটি আস্তে আস্তে ছোট করে ফেল।

 

লু অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে দেখে ট্রাইটনের পৃষ্ঠে একটা বড় বৃত্ত আস্তে আস্তে ছোট হয়ে গেল। ইউরী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বুয়ের দিকে তাকিয়ে একটু হাসে। লু এগিয়ে গিয়ে ইউরীর হাত থেকে কিবোর্ডটি নিয়ে লিখল, তোমাকে আমরা ধ্বংস করতে চাই না, মানুষ কখনো কাউকে ধ্বংস করতে চায় না। যদি তুমি আমাদের ফিরে যেতে দাও আমরা তোমাকে ধ্বংস করব না। আমার এ প্রস্তাবে রাজি হলে বড় বৃত্তটি বড় করে দাও।

 

বৃত্তটি আরো ছোট হয়ে গেল, ট্রাইটন এ প্রস্তাবে রাজি নয়। ইউরী তখন এগিয়ে যায়, আস্তে আস্তে লেখে, তা হালে শোন, আমরা তোমাকে কেমন করে ধ্বংস করব।

লু তাকিয়ে দেখে ওরা নীষা আর রুটকের কাছে পৌঁছে গেছে, জেট টি ঘুরিয়ে সে নিজের গতি কমিয়ে থেমে গেল। নীষা আর রু-টেক এগিয়ে আসে, তাদের কাছাকাছি স্টেনলেস স্টিলের দু’টি ক্যাপসুল, ওগুলির ভিতরে কিম জিবান আর সুশানের অচেতন দেহ। নীষা জিজ্ঞেস করল, সবকিছু ঠিক আছে?

 

হ্যাঁ।

উড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ট্রাইটনকে?

দেখা যাক। লু নিজের ঘড়ির দিকে তাকায়, আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড, তারপর পালসারটিতে বিস্ফোরণ হবে। সত্যিই কি ট্রাইটন ধ্বংস হয়ে যাবে তখন?

 

ইউরী লিখতে থাকে, যে-রশ্মিটি দিয়ে তোমার সাথে আমরা যোগাযোগ করেছি, তাকে আমরা বলি নিউট্রিনো। অসংখ্য নিউট্রিনো আছে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে, তাদের অপরিমেয় শক্তি, কিন্তু আমরা তার কথা জানি না, কারণ নিউট্রিনো কোনো কিছুর সাথে সহজে বিক্রিয়া করে না। কোনোভাবে যদি বিক্রিয়া করানো যেত, তা হলে সেই শক্তি দেখা যেত।

ইউরী ট্রাইটনের দিকে তাকায়, গ্রহটি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সত্যিই কি পারবে এটিকে ধ্বংস করে দিতে?

 

একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে ইউরী আবার লিখতে শুরু করে, তুমি আমাদের নিউট্রিনো রশ্মি থেকে আমাদের পাঠানো খবরাখবর পেতে শুরু করেছ, কাজেই তুমি ব্যবস্থা করেছ নিউট্রিনোর সাথে বিক্রিয়া করার, কত অসংখ্য নিউট্রিনো এখন তোমার দেহে বিক্রিয়া করছে, কত সহজে ভুমি উত্তপ্ত হয়ে উঠছ তাদের শক্তি দিয়ে।

এই নিউট্রিনো দিয়েই আমরা তোমাকে শেষ করে দেব, অচিন্তনীয় নিউট্রিনো পাঠাব তোমার ভিতর দিয়ে, ছারখার করে দেবে তারা তোমাকে।

 

হঠাৎ একটা আশ্চর্য ব্যাপার হল, পুরো ট্রাইউন যেন কেঁপে উঠল একবার। মুহূর্তে গ্রহটি রক্তবর্ণ হয়ে যায়, টকটকে লাল রং দেখে মনে হয় গনগনে গরমে যেন ফেটে চৌচির হয়ে যাবে এক্ষুনি। কিন্তু কিছু হল না, টকটকে লাল হয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর হঠাৎ প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হল, সমস্ত গ্রহটি যেন ফেটে গেল বেলুনের মতো। বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দ ওদের কাছে পৌছাল না বায়ুশূন্য মহাকাশে, কিন্তু ওরা বিস্ফারিত চোখে দেখে, ট্রাইটন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে চিরদিনের মতো।

 

সাথে সাথে একটা আশ্চর্য অনুভূতি হল সবার, সারাক্ষণ বুকের ভিতর যে চাপা ভয় আর আতঙ্ক জমা হয়ে ছিল, সেটা যেন চলে গেল। তার বদলে একটা ফুরফুরে হালকা আনন্দ এসে র করে ওদের ভিতর। মনে হতে থাকে আর কোনো ভয় নেই, ভাবনা নেই, এখন শুধু নিরুদ্বেগ নিরবচ্ছিন্ন শান্তি। লু একবার প্রাণহীন গ্রহটিকে দেখে, তারপর ইউরীর দিকে তাকায়। এই আধপাগল একজন বিজ্ঞানী হাজার মাইল দূরে বসে একটি খেলনা দিয়ে শুধুমাত্র আঙুল নেড়ে ট্রাইটনের মতো একটি গ্রহকে উড়িয়ে দিয়েছে? নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হতে চায় না, লু অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে ইউরীর দিকে তাকিয়ে থাকে, এও কি সম্ভব!

 

ইউরী আস্তে আস্তে লুয়ের দিকে তাকায়, কেমন জানি উদভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছে তাকে, কেমন জানি বিপন্ন। লু ইউরীর কাঁধে হাত রেখে ডাকল, ইউরী—

কি?

তুমি শুধু আমাদের প্রাণ বাঁচাও নি, সম্ভবত পৃথিবীকেও বাঁচিয়েছ।

ইউরী বিপন্ন মুখে বলল, কিন্তু—

কিন্তু কি?

কেমন জানি খুনী খুনী লাগছে নিজেকে, এত বড় একটা গ্রহকে শেষ করে দিলাম?

আমাদের উপায় ছিল না ইউরী।

হয়তো উপায় ছিল না, কিন্তু তবুও এত বড় একটা ক্ষমতাশালী প্রাণী, তার আর কোনো চিহ্ন থাকবে না?

নীষা আস্তে আস্তে বলল, ওসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই ইউরী। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়, সেটা হচ্ছে সৃষ্টির ধর্ম। ট্রাইটন চেষ্টা করেছে তার বংশধরকে বাঁচাতে, আমরা চেষ্টা করেছি আমাদের বাঁচাতে–

ইউরী হঠাৎ ঘুরে তাকায়, ফিসফিস করে বলে, বংশধর।

কী হয়েছে বংশধরের?

বংশধরকে বাচিয়ে রাখতে হবে, তাহলে ট্রাইটন ধ্বংস হয়ে যাবে না। লু একই ইতস্তত করে বলল, কিন্তু এটা তো আমাদের হাতে নেই ইউরী, কিছুক্ষণের মাঝে সিসিয়ান ধ্বংস হয়ে যাবে সবকিছু নিয়ে, ট্রাইটনের বংশধর সিসিয়ানের সাথে শেষ হয়ে যাবে।

 

কোনো ভাবে তুমি সিসিয়ানকে বাঁচাতে পার না?

না। আমি অত্যন্ত আদিম উপায়ে সিসিয়ানকে ধ্বংস করার ব্যবস্থা করেছি, সেটা থেকে রক্ষা করার কোনো উপায় নেই।

নীষা জিজ্ঞেস করল, কী ভাবে করছ তুমি?

মায়োক্সিন গ্যাসের বোতলটি খুলে এসেছি।

ও, নীষা গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ে।

ইউরী জিজ্ঞেস করল, কি হয় মায়োক্সিন দিয়ে?

 

মায়োক্সিন যখন অক্সিজেনের সাথে একটা বিশেষ অনুপাতে মিশে, তখন প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হয়। আমি যে-সিলিন্ডারটি খুলে এসেছি, সেটা থেকে যেটুকু গ্যাস বের হচ্ছে তাতে সিসিয়ানের অক্সিজেন মিশে বিস্ফোরণের অনুপাতে পৌঁছতে তিন ঘন্টা সময় লাগার কথা। আর মিনিট দশেকের মাঝে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হবে, কিছুতেই সেটা আটকানো সম্ভব না।

ইউরী আস্তে আস্তে বিষণ্ণভাবে মাথা মাড়ে, বাঁচানো গেল না তাহলে!

 

রু-টক আস্তে আস্তে বলল, তোমরা রাজি থাকলে আমি একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি।

কী করবে তুমি?

সিসিয়ানের বড় বড় কয়টা ভেন্ট দিয়ে পুরো বাতাসটুকু বের করে দিতে পারি, এখনো বিস্ফোরক পর্যায়ে পৌঁছায়নি, এই মুহূর্তে যদি চেষ্টা করি একটা সুযোগ আছে।

লু মাথা নাড়ে, না রু-টেক। ভয়ানক বিপদের ঝুঁকি নিতে চাইছ তুমি, এখন যেকোনো মুহূর্তে সিসিয়ান উড়ে যেতে পারে। আমি তোমাকে প্রাণের ঝুঁকি নিতে দিতে পারি না।

তুমি ভুলে যাচ্ছ আমি রবোট।

কিন্তু তোমাকে মানুষের সমান মর্যাদা দেয়া হয়েছে। .

আমি সে-কথা বলছি না, রু- টেক বাধা দিয়ে বলল, আমি রবোট, আম যদি কোনোভাবে বাচিয়ে রাখা যায়, আমি বেঁচে থাকি।

কিন্তু এখন সিডিসি নেই, যেখানে তুমি তোমার স্মৃতিকে সরিয়ে ফেলতে পার।

কিন্তু আমি আমার মেমোরি মডিউলটি খুলে তোমাদের হাতে দিতে পারি। তোমরা সেটা যদি যত্ন করে রেখে দাও, তা হলেই আমি বেঁচে থাকব। সুবিধেমতো মেমোরি মডিউলটি অন্য একটা সপ্তম মাত্রার রবোটের শরীরে লাগিয়ে দিলেই আমি বেঁচে উঠব।

 

কিন্তু মেমোরি ছাড়া কাজ করবে কেমন করে?

প্রসেসরটা থাকলেই কাজ করা যায়, জরুরি কাজের জন্যে কিছু মেমোরি সব সময়েই থাকে। তবে আমি কিছুই জানব না, তোমাদের আমাকে বলে দিতে হবে সবকিছু কি করব, কেন করব এইসব।

ইউরী কৌতূহল নিয়ে ওদের কথাবার্তা শুনছিল, সুযোগ পেয়ে লুকে জিজ্ঞেস করল, সত্যিই এটা সম্ভব?

একটা ছোট সম্ভাবনা রয়েছে, তবে কাজটি ভয়ানক বিপজ্জনক। লু মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু ট্রাইটনের বংশধরকে বাচিয়ে রাখার সমস্যা অন্য জায়গায়। যদি সিসিয়ানকে সত্যি রু–টেক রক্ষা করতে পারে, কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র এসে নিসিয়ানের দায়িত্ব নিয়ে নেবে। তারা তখন ট্রাইটনের বংশধরকে কেটেকুটে দেখবে, তাকে বাচতে দেওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।

 

আমি তা হলে সিসিয়ানের মূল ইনজিনটা চালু করে পুরো সিসিয়ানকে ট্রাইটনের

উপরে নামাতে পারি। বংশধর তখন সিসিয়ান থেকে ট্রাইটনে নেমে যাবে।

সিসিয়ানে এখন কোনো কম্পিউটার নেই, তুমি সেটা ঠিক করে চালাতে পারবে না।

ঠিক করে চালানোর প্রয়োজনও নেই, সিসিয়ানকে যদি কোনোভাবে ট্রাইটনের কাছাকাছি নিতে পারি, তা হলেই হবে। সিসিয়ান মোটামুটিভাবে বিধ্বস্ত হয়ে গেলেও ক্ষতি নেই, আমার ধারণা, ট্রাইটনের বংশধর তবু বেঁচে থাকবে। মনে আছে, বারো মেগাওয়াটের পার্টিকেল বীম দিয়েও তার কোনো ক্ষতি হয় নি?

 

লু চিন্তিতভাবে মাথা নাড়ে।

রু-টেক বলল, যদি এটা করতে চাও, তা হলে তোমাকে এখনি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমাদের হাতে সময় মোটেও নেই, আর তুমি হচ্ছ দলপতি, তুমি অনুমতি না দিলে আমি যেতে পারব না।

ঠিক আছে, অনুমতি দিচ্ছি।

রু-টেক সাথে সাথে কাজে লেগে যায়, মাথার পিছনে কোথায় হাত দিয়ে সে কীএকটা খুলে ফেলে। সেখানে হাত ঢুকিয়ে মেমোরি মডিউলটি খুলে ফেলার আগে বলল, মনে রেখো, আমার কোনো স্মৃতি থাকবে না, তোমাদের বলে দিতে হবে আমি কী করব।

 

বেশ।

রু-টক একটা হ্যাচকা টানে মেমোরি মডিউলটি টেনে বের করে আনে, সাথে সাথেই তার পুরো স্মৃতি মুছে যায়। মেমোরি মডিউলটা নিয়ে কী করতে হবে সেটাও রু-টেকের আর মনে থাকে না, সেটা হাতে নিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। নীষা এগিয়ে গিয়ে বলল, এটা আমাকে দাও।

কেন?

লু তখন এগিয়ে শান্ত গলায় বলল, তোমার নাম রু–টেক, তুমি ভয়ানক একটি বিপজ্জনক মিশনে যাচ্ছ, তাই তোমার স্মৃতি আমরা সরিয়ে রাখতে চাই, মেমোরি মডিউলটি আমার হাতে দাও।

রু-টেক বাধ্য ছেলের মতো হাতের মেমোরি মডিউলটি সুয়ের হাতে দিয়ে দেয়।

ধন্যবাদ। তুমি এখন ঐ মহাকাশযানে গিয়ে, বড় বড় ভেস্টগুলি খুলে দেবে, যেন সিসিয়ানের সমস্ত বাতাস বের হয়ে যায়।

কেল?

তুমি জানতে চাইলে তোমাকে বলতে পারি, কিন্তু তোমার জানার প্রয়োজন নেই, কারণ আমাদের হাতে সময় খুব কম।

বেশ।

ভেন্টগুলি খুলে সমস্ত বাতাস বের করে দেয়ার পর তুমি সিসিয়ানের ইঞ্জিনগুলি চালু করে, সেটিকে এমনভাবে প্রস্তুত করবে, যেন সিসিয়ান এই গ্রহটিতে গিয়ে নামতে পারে।

কেন?

সময়ের অভাবে তোমাকে বলতে পারছি না, কিন্তু জেনে রাখ, এটা তোমার জানার প্রয়োজন নেই।

বেশ।

কাজ শেষ হবার পর তুমি সিসিয়ান থেকে বের হয়ে আমাদের কাছে ফেরত আসবে।

কেন?

তুমি আমাদের দলের একজন, তোমাকে আমাদের প্রয়োজন।

ও।

এখন তুমি রওনা দাও।

ভেন্টগুলি কোথায় এবং ইঞ্জিন কী ভাবে চালু করতে হয় আমি জানি না।

আমি তোমার সাথে যোগাযোগ রাখব, সময় হলেই তোমাকে বলে দেব।

বেশ।

রু-টেক সাথে সাথে ঘুরে সিসিয়ানের দিকে রওনা দিয়ে দেয়, হাতের জেটটি সে বেশ চমৎকারভাবে ব্যবহার করতে পারে, রবোটদের কিছু কিছু জিনিস শিখতে হয় না, তারা সেই ক্ষমতা নিয়েই জন্মায়।

 

পরবর্তী তিরিশ মিনিট লু তার জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘতম সময় বলে বিবেচনা করে। রু— টেককে সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলতে হল তার, প্রতিমুহূর্তে ভয় হচ্ছিল সিসিয়ান প্রচণ্ড বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যাবে, তার মাঝে মাথা ঠাণ্ডা রেখে একটার পর একটা নির্দেশ দিয়ে যাওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়। রু-টেকের পুরানো কোনো স্মৃতি অবশিষ্ট নেই বলে তার কাজটি প্রায় দশ গুণ কঠিন হয়ে দাড়িয়েছিল। তিরিশ মিনিট পর সিসিয়ানকে নির্দিষ্ট গতিপথে ট্রাইটনের দিকে পাঠিয়ে দিয়ে রু-টেক যখন ভাসতে ভাসতে বেরিয়ে এল তখন সবাই যেন প্রাণ ফিরে পেল। রু-টেক ফিরে আসতেই নীষা তার হাতে মেমোরি মডিউলটি ধরিয়ে দেয়, বলে, নাও তোমার স্মৃতি।

কী করব এটা দিয়ে?

তোমার মাথায় লাগিয়ে নাও।

কী ভাবে লাগাব?

নীষা আর লু সাবধানে মডিউলটি ওর মাথায় লাগিয়ে দেয়, লু সাথে সাথেই প্রকৃতস্থ হয়ে ওঠে, এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, লু, তুমি যদি চাও আমি সিসিয়ানকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করে আসি, তাহলে কিন্তু দেরি করা যাবে না।

লু হাসতে হাসতে বলল, তুমি এইমাত্র সেটা করে এসেছ রু–টেক।

সত্যি! রু-টেক অবাক হয়ে তাকায়, দেখে, সত্যি সত্যি সিসিয়ান আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। আর ঘন্টাখানেকের মাঝেই ট্রাইটনে পৌঁছে যাবে ট্রাইটনের বংশধরকে নিয়ে।

চমৎকার কাজ করেছ তুমি রু–টেক।

আমি কিছু করি নি লু, তুমিই করেছ। তুমি ঠিক ঠিক সবকিছু বলে দিয়েছ বলে পেরেছি, মেমোরি মডিউল খুলে নিলে আমার ভিতর আর একটা বলপয়েন্ট কলমের ভিতরে কোনো পার্থক্য নেই।

নীষা হাসতে হাসতে বলল, মেমোরি মডিউল ছাড়াই কিন্তু বেশ লাগছিল, কেমন একটা শিশু-শিশু ভাব, যেটাই বলা হয়, তুমি বল কেন?

তাই নাকি?

হ্যাঁ। তোমাকে একদিন অভিনয় করে দেখাতে হবে। নীষা হাসতে হাসতে বলল, চল একটা কাজ করি।

কী কাজ?

কিম জিবানকে জাগিয়ে তুলি।

কেন?

বেচারা যখন জ্ঞান হারিয়েছে তখন সে জানত না আমরা বেঁচে যাব, ভয়ংকর একটা দুঃস্বপ্নের মাঝে রয়েছে সে। তাকে জাগিয়ে তুলে জানিয়ে দিই আমাদের আর কোনো ভয় নেই, তখন সে অনেক শান্তিতে ঘুমাবে। সুশানকে মিথ্যে কথা বলে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, মিথ্যেটা এখন সত্যি হয়ে গেছে, সে অনেক শান্তিতেই ঘুমাচ্ছে, তাকে জাগানোর প্রয়োজন নেই।

 

ক্যাপসুলে জাগানো কিন্তু খুব সহজ নয়, তাকে এখন বাইরেও আনা যাবে না।

তুমি সব পার রু–টেক। যে-মায়োক্সিনভুরা মহাকাশযানকে উদ্ধার করতে পারে তার অসাধ্য কোনো কাজ নেই।

লু যদি অনুমতি দেয় তা হলে করব। রু-টেক লুয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আপত্তি আছে?

মোটেই না, আমরা বেঁচে গেছি খবর পেয়ে কিম কী করে দেখার জন্যে আমি মরে যাচ্ছি।

বেশ, দেখা যাক কি করা যায়।

এই ক্যাপসুলে কোনো আহত বা অসুস্থ মানুষকে রাখার পরমুহূর্তে ক্যাপসুলের জরুরি যন্ত্রপাতি তার দায়িত্ব নিয়ে নেয়। প্রয়োজনে হৃৎপিণ্ড বা ফুসফুসকে পর্যন্ত বিশ্রাম দিতে পারে। শুধু তাই নয়, মণ্ডিকে আঘাত পেলে অনেক সময় মস্তিষ্কের দায়িত্বও সাময়িকভাবে নিয়ে নিতে পারে। রু-টেক ক্যাপসুলের পাশের সুইচ এবং মিটারগুলি দেখে কিছু সংখ্যা ক্যাপসুলের কম্পিউটারে ঢুকিয়ে দেয়, প্রায় সাথে সাথেই কিম জিবান চোখ খুলে তাকায়, ফিসফিস করে বলে, আমি কোথায়?

 

লু গলার স্বর গোপন করে আনুনাসিক স্বরে বলল, তুমি মারা গেছ কিম অনেক পাপ করেছিলে তুমি বেঁচে থাকতে, মারা গিয়ে তাই তুমি নরকে এসেছ।

কিম কাতর গলায় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু নীষা আর পারল না, চিৎকার করে বলল, আমরা বেঁচে গেছি কিম! আমরা বেঁচে গেছি।

সত্যি? ধড়মড় করে ওঠার চেষ্টা করেই বুঝতে পারল, সে ক্যাপসুলের ভিতর, ছটফট করে বলল, সত্যি বলছ তুমি নীষা?

হ্যাঁ, এই দেখ আমি, এই যে লু। তোমাকে জাগিয়ে তুলেছে রু-টেক, আর ঐ যে ইউরী।

সুশান কোথায়?

ঘুমিয়ে আছে আরেকটা ক্যাপসুলে, বিশেষ কিছু হয় নি, তোমার থেকে ভালো অবস্থায় আছে। তোমার পাঁজরের একটা হাড়—

কিম বাধা দিয়ে বলল, কেমন করে বেঁচেছি আমরা?

লু এগিয়ে গিয়ে ইউরীকে দেখিয়ে বলল, এই যে আধপাগল মানুষটি দেখছ, সে এখানে বসে তার আঙুল দিয়ে ট্রাইটনকে উড়িয়ে দিয়েছে।

ঠাট্টা করো না, সত্যি করে বল।

সত্যি বলছি, জিজ্ঞেস কর ইউরীকে।

ইউরী, বলবে, কী হয়েছে?

ইউরী কিছু-একটা বলতে চাইছিল, রু-টেক তাকে থামাল, বলল, কিম, তোমার রক্তচাপ বেড়ে যাচ্ছে, উদ্ধারকারী দলের ডাক্তার যখন দেখবে আমি তোমাকে জাগিয়ে কথা বলে রক্তচাপ বাড়িয়ে দিয়েছি, আমার বারটা বাজিয়ে দেবে। তুমি এখন ঘুমাও।

 

না, আমি একটু শুনতে চাই।

রু-টেক মাথা নাড়ে, শোনার অনেক সময় পাবে কিম, এখন তুমি ঘুমাও।

কিম হাল ছেড়ে দেয়। রু–টেক একটি সুইচ চেপে ধরতেই কিম আস্তে আস্তে আবার ঘুমিয়ে পড়ে, ক্যাপসুলের হালকা আলোতে দেখা যাচ্ছে তার মুখে ক্ষীণ একটা হাসির ছোঁয়া।

 

ওরা মহাকাশে ভাসতে ভাসতে উদ্ধারকারী দলের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। কতক্ষণ লাগবে জানা নেই, কিন্তু ওদের কোনো তাড়া নেই, ওদের হাতে অফুরন্ত সময়। নীষা ওর পিঠে লাগানো প্যাকেট থেকে একটি ছোট ম্যাগনেটিক ডিস্ক বের করে। লু জিজ্ঞেস করল, কি আছে ওখানে?

সিডিসি দিয়ে গেছে, কি আছে জানি না। একটা ছোট ডিস্ক ড্রাইভ থাকলে দেখা যেত।

দেখি একটু রুটিক হাত বাড়িয়ে দেয়, ম্যাগনেটিক ডিস্কটা উল্টে-পাল্টে দেখে বলল, তুমি চাইলে এটা পড়ে দিতে পারি, আমার শরীরে একটা ছোট ডিস্ক ড্রাইভ আছে।

পড় দেখি।

রু– টেক সাবধানে ওর বুকের কাছে ছোট একটা ঢাকনা খুলে ডিস্কটি ঢুকিয়ে পড়তে শুরু করে, সেখানে লেখা :

নীষা,

তুমি যেহেতু আমার চিঠিটা পড়ছ; আমি ধরে নিতে পারি তোমরা এই মহাবিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে গেছ। খুব কৌতূহল হচ্ছে জানার জন্যে কেমন করে উদ্ধার পেলে, কিন্তু কেমন করে জানব, আমি তো আর বেঁচে নেই। তোমরা ভালোভাবে থেকো, প্রার্থনা করি, আর যেন তোমাদের এত বড় বিপদের মাঝে পড়তে না হয়।

 

নীষা, তোমাকে একটি ছোট অনুরোধ করব। এই ম্যাগনেটিক ডিস্কে একটি ছোট প্রোগ্রাম আছে, রিকিৎ ভাষায় লেখা। যদি পার কোনো একটি চতুর্থ মাত্রার কম্পিউটারে এই প্রোগ্রামটি চালিয়ে দিও। আমার ভাবনা চিন্তার মূল আঙ্গিক এখানে রয়েছে, চতুর্থ মাত্রার কম্পিউটারে সেটা আস্তে আস্তে বিকাশ পাবে, বলতে পার আস্তে আস্তে আমার ব্যক্তিত্ব—যদি আমাকে এই শব্দটি ব্যবহার করতে দাও সেখানে বিকাশ লাভ করবে। খুব ধীরে ধীরে একটি সিডিসির জন্ম হবে!

 

নীষা, তোমাকে বলে দিই, কাজটি কিন্তু ভারি কঠিন। কিন্তু তুমি হচ্ছ কম্পিউটারের জাদুকরী, তুমি নিশ্চয়ই পারবে। যদি সত্যি পার তাহলে আমার একটি অংশ বেঁচে থাকবে। সবাই তো চায় তার বংশধর বেঁচে থাকুক, ট্রাইটন চেয়েছিল, আমি চাইলে দোষ কী?

ভালো থেকো তোমরা সবাই। তোমাদের সিডিসি।

 

নীষা একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বেচারি সিডিসি।

তুমি পারবে প্রোগ্রামটা চালাতে?

দেখি। রিকি হচ্ছে কম্পিউটারের নিজেদের ভাষা, কোনো মানুষের সেটা জানা নেই, সেটাই হচ্ছে মুশকিল। কিন্তু নিশ্চয়ই চেষ্টা করব। সিডিসির সন্তান এটা, তাকে বাচানোর চেষ্টা করব না?

লু অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ে।

 

বহুদূরে দ’টি আলোর বিন্দু দেখা যায়, অত্যন্ত ক্ষীণ। আস্তে আস্তে সেগুলি বড় হতে থাকে রু-টেক সেদিকে তাকিয়ে থেকে মৃদুস্বরে বলল, লু, আমাদের উদ্ধার করতে দু’টি মহাকাশযান আসছে।

লু মাথা ঘুরিয়ে তাকায়, তার চোখে কিছু ধরা পড়ে না, তবু সে তাকিয়ে থাকে, রু-টেক যখন বলেছে, তখন নিশ্চয়ই কেউ আসছে। না এসে পারে না।

 

মহাকাশযানের আলো দেখার জন্যে বিস্তীর্ণ নিকষ কালো অন্ধকার মহাকাশে। বুভুক্ষুর মতো তাকিয়ে থাকে।

গল্পের বিষয়:
সাইন্স-ফিকশন
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত