১. মৃত্যুদণ্ডের আসামী
কিছুদিন আগে আমাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হয়েছে। যে অপরাধের জন্যে আমাকে মৃত্যুদণ্ডের মতো বড় শাস্তি দেয়া হয়েছে, সেটিকে আদৌ অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা যায় কী না সেটি নিয়ে আমি কারো সাথে তর্ক করতে চাই না। অপরাধ এবং শাস্তি দুই-ই খুব আপেক্ষিক ব্যাপার, রাষ্ট্র যেটিকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করেছে, সেটি আমার কাছে নিছক কৌতূহল ছাড়া আর কিছু ছিল না।
মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাবার পর থেকে আমার দৈনন্দিন জীবন আশ্চর্য রকম পাল্টে গেছে। বিচার চলাকালীন সময়ে আমার সেলটিকে অসহ্য দমবন্ধ-করা একটি ক্ষুদ্র কুঠুরি বলে মনে হত। আজকাল এই কুঠুরির জন্যেই আমার মনের ভেতর গভীর বেদনাবোধের জন্ম হচ্ছে। ছোট জানালাটি দিয়ে এক বর্গফুট আকাশ দেখা যায়, আমি ঘন্টার পর ঘন্টা সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। নীল আকাশের পটভূমিতে সাদা মেঘের মাঝে এত সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকতে পারে আমার জানা ছিল না। ইদানীং পৃথিবীর সবকিছুর জন্যে আমার গাঢ় ভালবাসার জন্ম হয়েছে। আমার উচ্ছিষ্ট খাবারে সারিবাঁধা পিপড়েকে দেখে সেদিন আমি তীক্ষ্ণ বেদনা অনুভব করেছি।
গত দুই সপ্তাহ থেকে আমি ধীরে ধীরে নিজেকে মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত করেছি, এটি অত্যন্ত দুরূহ কাজ। অকারণে জগৎ-সংসারের প্রতি তীব্র অভিমানববাধে যুক্তিতর্ক অর্থহীন হয়ে আসতে চায়। আমার বয়স বেশি নয়, আমি অসাধারণ প্রতিভাবান নই, কিন্তু আমার তীব্র প্রাণশক্তি আমাকে সাফল্যের উচ্চশিখরে নিয়ে গিয়েছিল। আমার জীবনকে উপভোগ, এমন কি অর্থপূর্ণ করার ক্ষমতা ছিল, কিন্তু আমাকে সে সুযোগ দেয়া হল না।
মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাবার পর আমার জীবনের শেষ কয়টি দিনের জন্যে কিছু বাড়তি সুযোগ দেয়া হয়েছে। আমার খাবারে প্রোটিনের অনুপাত বাড়ানো হয়েছে, ভালো পানীয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে, বাথরুমের ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে, সর্বোপরি খবরের কাগজ এবং বইপত্র পড়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে। মৃত্যুর কাছাকাছি এসে পৃথিবীর দৈনন্দিন খবরের মতো অর্থহীন ব্যাপার আর কিছুই হতে পারে না। আমি প্রথম দিন একার খবরের কাগজে চোখ বুলিয়ে আর দ্বিতীয় বার সেটি খোলার উৎসাহ পাই নি। দূর মহাকাশে একটি মনুষ্যবিহীন স্বয়ংক্রিয় মহাকাশযান পাঠানো-সংক্রান্ত একটি অভিযান নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা ছিল, আমার তাতে কোনো উৎসাহ ছিল না।
মাঝে মাঝে আমি কাগজে আঁকিবুকি করি বা কিছু লিখতে চেষ্টা করি, তার বেশিরভাগই অসংলগ্ন এবং আপাতদৃষ্টিতে অর্থহীন চিন্তা। আমার মৃত্যুর পর হয়তো এগুলো আমার ব্যক্তিগত ফাইলে দীর্ঘকাল অবস্থান করবে। আমি কয়েক বার প্রিয়জনকে চিঠি লেখার কথা ভেবেছি, কিন্তু আমার প্রিয়জন বেশি নেই, যারা আছে তাদের দুঃখবোধকে তীব্রতর করার অনিচ্ছা আমাকে নিরুৎসাহিত করেছে।
আজকাল আমার সাথে দিনে তিন বার এই সেলটির ভারপ্রাপ্ত রক্ষকের সাথে দেখা হয়, তিন বারই সে আমার জন্যে খাবার নিয়ে আসে। আগে সে আমার সাথে দুর্ব্যবহার করত, মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাবার পর থেকে খানিকটা সদয় ব্যবহার করা শুরু করেছে। গত রাতে সে নিজের পকেট থেকে আমাকে একটা সিগারেট পর্যন্ত খেতে দিয়েছে, আমি সিগারেট খাই না জেনেও! আমি লোকটিকে খুঁটিয়ে খুটিয়ে লক্ষ করি, মাঝারি বয়সের সাদাসিধে নির্বোধ লোক, সরকারের নির্দেশিত বাঁধাধরা গণ্ডির বাইরে চিন্তা করতে অক্ষম। ব্যক্তিগত জীবনে এরা সাধারণত সুখী হয়। জীবনের শেষ কয়টা দিন আরেকটু বুদ্ধিমান একটি প্রাণীর সংস্পর্শে থাকতে পারলে মন্দ হত না। আমাকে যেদিন হত্যা করা হবে সেদিন আরো কিছু মানুষের সাথে দেখা হবার কথা। প্রাচীন কালের নিয়ম অনুযায়ী আমাকে চেয়ারে বেঁধে গুলি করে হত্যা করা হবে। মৃত্যুদণ্ড প্রতিশোধমূলক শাস্তি, এটিকে যতদূর সম্ভব যন্ত্রণাদায়ক করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাত থেকে দশ জন মানুষ স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে গুলি করে থাকে। মৃত্যু যন্ত্রণাদায়ক, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে এই যন্ত্রণা খুব অল্প সময়ের জন্যে। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে নাকি সারাজীবনের স্মৃতি একসাথে মাথায় উঁকি দিয়ে যায়, আপাতত সেই ব্যাপারটি নিয়ে খানিকটা কৌতূহল ছাড়া আমাকে দেয়ার মতো ভবিষ্যতে কিছু অবশিষ্ট নেই—অন্তত আমি তাই জানতাম।
তাই যেদিন সকালবেলা আমার সেলের দরজা খুলে দু’জন গার্ডসহ একজন অত্যন্ত উচ্চপদস্থ লোক আমার সাথে দেখা করতে এল, আমার তখন বিস্ময়ের সীমা ছিল না। লোকটি অত্যন্ত কম কথার মানুষ, আমাকে এবং আমার ক্ষুদ্র অগোছাল ঘরটিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে সোজাসুজি কাজের কথায় চলে এল। বলল, আপনার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার মাত্র দুই সপ্তাহ বাকি।
আমি মাথা নাড়লাম।
আপনি রাজি থাকলে আপনার মৃত্যুদণ্ড প্রচলিত নিয়মে গুলি না করে অন্যভাবে করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
শুধু এটুকু বলার জন্যে আপনি কষ্ট করে এসেছেন?
না।
কী বলবেন বলুন। অপ্রচলিত নিয়মে মারা যাওয়ার জন্যে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।
আপনি হয়তো জানেন মনুষ্যবিহীন একটা স্বয়ংক্রিয় মহাকাশযান কিছুদিনের মাঝেই মহাকাশে রওনা হচ্ছে।
হঠাৎ করে এই অপ্রাসঙ্গিক কথাটি শুনে আমি খুব অবাক হয়ে উঠি। আমি সত্যি সত্যি খবরের কাগজে এটি দেখেছিলাম।
উচ্চপদস্থ লোকটি শান্ত স্বরে বলল, আপনি রাজি হলে আপনাকে ঐ মহাকাশযানে তুলে দেয়া হবে।
মহাকাশযানটি আর পৃথিবীতে ফিরে আসবে না?
আসবে।
আমি ফিরে আসব না?
আপনিও ফিরে আসবেন, কিন্তু আপনি জীবিত থাকবেন না।
কেন?
জানি না, এখন পর্যন্ত এই অভিযানে কেউ জীবিত ফিরে আসে নি।
ও! আমি চুপ করে যাই। পৃথিবীতে গুলি খেয়ে মারা যাওয়ার বদলে মহাকাশের। কোনো এক অজানা পরিবেশে অজ্ঞাত কোনো-এক কারণে মারা যাওয়ার জন্যে আমি নিজের ভেতরে কোনো উৎসাহ খুঁজে পেলাম না। খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে জিজ্ঞেস করলাম, এটি কতদিনের অভিযান?
প্রায় এক বছর, যেতে ছয় মাস, ফিরে আসতে আরো ছয় মাস।
আমি প্রথমবার খানিকটা উৎসাহিত হলাম। যে দুই সপ্তাহের ভেতর মারা যাচ্ছে তার কাছে এক বছর বা ছয় মাস অনেক সময়, যদিও সেটি মহাকাশের নির্জন, নির্বান্ধব, নিঃসঙ্গ পরিবেশ। কিন্তু আমার উৎসাহ পুরোপুরি নিভে গেল লোকটির পরের কথা শুনে। সে বলল, অভিযানের শুরুতে আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হবে, আপনার ঘুম ভাঙবে গন্তব্যস্থানে পৌছে। সেখানে আপনার কী হবে আমি জানি না, কিন্তু কোনো কারণে আপনি মারা যাবেন, আপনার মৃতদেহ পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হবে।
আমার মৃতদেহ নিয়ে কী করা হবে সে বিষয়ে আমার কোনো কৌতূহল ছিল না, লোকটি সেটা আমার মুখ দেখেই বুঝতে পেরে চুপ করে গেল। আমি বললাম, তার মানে যদিও প্রায় ছয় মাস পরে আমি আক্ষরিক অর্থে মারা যাব কিন্তু আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার পর আমার বেঁচে থাকা না-থাকার কোনো অর্থই নেই। কাজেই আমার বেঁচে থাকা শেষ হয়ে যাবে অভিযান শুরু হওয়ার সাথে সাথে।
বলতে পারেন।
অভিযান শুরু হবে কবে?
ঠিক এক সপ্তাহ পরে।
শুনে খুব স্বাভাবিক কারণে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। অনেক কষ্টে গলার স্বরকে স্বাভাবিক রেখে বললাম, আপনি হয়তো জানেন না, কাউকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়ার পর সময় তার কাছে কত মূল্যবান হয়ে ওঠে। আমার এখনো দুই সপ্তাহ সময় আছে, আমি সেটা অর্ধেক করব কেন?
লোকটি ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে আস্তে আস্তে বলল, আপনি যেভাবে বেঁচে আছেন, তাতে এক সপ্তাহ আর দুই সপ্তাহের মাঝে খুব পার্থক্য থাকার কথা নয়।
আমি কোনো কথা না বলে তার দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে রইলাম। মানুষ এরকম হৃদয়হীন কথা কীভাবে বলতে পারে। লোকটিকে কিছু বলতে আমার ঘৃণা। হল। আমি মেঝেতে শব্দ করে থুথু ফেলে কোনায় সরে গেলাম। লোকটি এক পা এগিয়ে এসে বলল, আপনার বেঁচে থাকার সময় যদিও কমে যাবে, কিন্তু বেঁচে থাকার গুণগত মান অনেক বাড়িয়ে দেয়া হবে।
মানে?
আপনি যদি রাজি থাকেন আপনাকে এক সপ্তাহ জেলের বাইরে আপনার ইচ্ছেমতো থাকতে দেয়া হবে।
আমার বুকের ভেতর রক্ত ছলাৎ করে ওঠে, পুরো এক সপ্তাহ স্বাধীন মানুষের মতো থাকতে পারব? জেলখানায় চার দেয়ালের ভেতর এক চিলতে আকাশ নয়, বাইরে, সুদীর্ঘ সমুদ্রতটে সুবিশাল আকাশ? মানুষজন, তাদের সুখ-দুঃখ হাসি-কান্নার কাছাকাছি সাত-সাতটি দিন?
আপনি রাজি থাকলে এখনই আমাকে জানাতে হবে।
এখনই?
হ্যাঁ।
এই সাতদিন আমি পুরোপুরি স্বাধীন মানুষের মতো থাকতে পারব?
হ্যাঁ।
আমি যদি পালিয়ে যাই? আর কোনোদিন যদি আপনাদের কাছে ফিরে না আসি?
এই প্রথম বার লোকটিকে আমি হাসতে দেখলাম, সত্যি কথা বলতে কি, তাকে হাসিমুখে বেশ একজন সদয় মানুষের মতোই দেখাল। লোকটি হাসি গোপন করার কোনো চেষ্টা না করেই বলল, আপনি ফিরে আসবেন।
যদি না আসি?
আপনার শরীরে যে ট্রাকিওশান লাগানো হবে, সেটি আপনাকে ফিরিয়ে আনবে।
ট্রাকিওশান এক ধরনের ক্ষুদ্র ইলেকট্রনিক পালস জেনারেটর। এটি ইনজেকশান দিয়ে শরীরের ভেতরে প্রবেশ করানো হয়। রক্তের সাথে মিশে গিয়ে এটি শরীরের যে-কোনো জায়গায় পাকাপাকিভাবে বসে যেতে পারে। কোনো মানুষের মস্তিষ্কের কম্পনের স্পেকট্রাম জানা থাকলে এই ট্রাকিওশান দিয়ে তাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আমি ট্রাকিওশানের নাম শুনেছিলাম, কখনো কারো উপরে ব্যবহার করা হয়েছে শুনি নি। নিজের উপর ব্যবহার করা হবে খবরটি আমাকে আতঙ্কিত করে তোলে, শুকনো গলায় বললাম, পুরোপুরি স্বাধীনভাবে থাকতে দেবেন কথাটি তাহলে সত্যি নয়। আমাকে সবসময়েই নজরে রাখা হবে।
না, তা ঠিক নয়। লোকটি মাথা নেড়ে বলল, আপনাকে স্বাধীনভাবেই থাকতে দেয়া হবে। শুধুমাত্র মহাকাশযানটি রওনা দেবার ছয় ঘন্টা আগে ট্রাকিওশানটা চালু করা হবে আপনাকে ফিরিয়ে আনার জন্যে। আপনি নিজেই যদি এসে যান তাহলে সেটিও করতে হবে না।
তার কি নিশ্চয়তা আছে?
নেই, কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু আমি বলছি, আমার কথা আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে।
আমি তার কথা বিশ্বাস করলাম।
আমাকে ওজন করা হল, শরীরের প্রতিটি অংশের ছবি নেয়া হল, রক্তচাপ, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের স্থায়িত্ব মাপা হল। রক্ত সঞ্চালনের গতি, মস্তিষ্কের তরঙ্গ এবং অনুভূতির সাথে সেই তরঙ্গের সম্পর্ক বের করা হল। দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তির পরিমাপ নেয়া হল। শব্দতরঙ্গের প্রতিফলন দিয়ে শরীরের যকৃৎ, ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড ও কিডনির যাবতীয় অংশের ছবি নেয়া হল। তেজস্ক্রিয় দ্রব্য রক্তের সাথে মিশিয়ে শরীরের মেটাবোলিজমের হার বের করা হল। আমার রক্তের প্রকৃতি, নিউরোনের সংখ্যা পরিমাপ করা হল।
সবশেষে আমার শরীরে ক্ষুদ্র একটি ট্রাকিওশান প্রবেশ করিয়ে দেয়া হল।
২. লুকাস নামের রবোট
আমি উদ্দেশাহীনভাবে শহরের সবচেয়ে সম্রান্ত অঞ্চলের মাঝে হাঁটছিলাম। দেশের প্রথম শ্রেণীর নাগরিকদের অঞ্চল এটি, বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার বা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী ছাড়া আর কেউ আসতে পারে না। আমার পক্ষে কখানোই এখানে আসা সম্ভব হত না, কিন্তু আমাকে স্বাধীনভাবে ঘুরতে দেয়ার সময় কর্মকর্তারা আমাকে একটা ছোট লাল কার্ড দিয়েছে, এই কার্ডটির ক্ষমতার কোনো সীমা নেই। অত্যন্ত বড় বিজ্ঞানী বা অত্যন্ত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্তকর্তা ছাড়া আর কেউ এই লাল কার্ড ব্যবহার করতে পারে না, আমাকে সম্ভবত করুণা করে দেয়া হয়েছে। এটি ব্যবহার করে যে-কোনো যানবাহনে যে-কোনো অঞ্চলে যাওয়া যায়, যে-কোনো হোটেলরেস্টুরেন্ট বা অবসর বিনোদনের সুযোগ নেয়া যায়, এমন কি সরকারি নিয়ন্ত্রণে চালিত গোপন প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যন্ত প্রবেশাধিকার পাওয়া যায়। এই কার্ডটির ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্যে আমি অতিপারমাণবিক অস্ত্র কারখানা থেকে ঘুরে এসেছি।
আজ আমার জীবনের শেষ সপ্তাহের শেষ দিনটি। আগামীকাল দুপুরে আমার মহাকাশ কেন্দ্রে ফিরে যাবার কথা। সন্ধ্যাবেলা মহাকাশযানটি আমাকে নিয়ে আমার অন্তিম যাত্রা শুরু করবে। কথাটি ভুলে থাকার চেষ্টা করে লাভ নেই, এটি বিকারগ্রস্ত মানুষের স্বপ্নের মতো আমার মাথায় জেগে আছে।
আমি একটা সম্রান্ত বিপণিকেন্দ্রের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় খানিকটা উত্তেজনা লক্ষ করলাম। বেশ কয়েকটা পুলিসের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে ইতস্তত সশস্ত্র পুলিস, হাতে রনোগান। দেখে মনে হল বেশ খানিকটা এলাকা তারা ঘিরে রেখেছে, নিশ্চয়ই কয়েকটা রবোট্রন ধরা পড়েছে। রবোট্রন রবোটের সবচেয়ে শক্তিশালী আর উন্নত গোত্রটি। পাঁচ বছর আগে তাদের ধ্বংস করার আইন পাস করা হয়েছে, রবোট্রন গোষ্ঠী যদিও মানুষের তৈরি, তারা মানুষের এই আইন মেনে নিতে রাজি হয় নি। বিরাটসংখ্যক রবোট্রন লোকালয় থেকে পালিয়ে যায়, সেই থেকে তাদের খুঁজে খুঁজে বের করে হত্যা করা হচ্ছে। রবোট্রন জীবিত প্রাণী নয়, একটি যন্ত্রবিশেষ, তাই হত্যা শব্দটি তাদের জন্যে প্রযোজ্য নয়, কিন্তু আত্মগোপন করার জন্যে তারা মানুষের এত চমৎকার রূপ নিয়েছে যে অঙ্গব্যবচ্ছেদ না করে আজকাল আর বলা সম্ভব নয় কোনটি মানুষ, আর কোনটি রবোট্রন। আমি জাদুঘরে বিকল রবোট্রন। দেখেছি, সত্যিকারের রবোট্রন কখনো দেখিনি, তাই খানিকটা কৌতূহল নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
বিপণিকেন্দ্রটি থেকে লোকজন বের হয়ে আসছিল, আমি আন্দাজ করার চেষ্টা করছিলাম তাদের মাঝে কে রবোট হতে পারে। নানা বয়সের, নানা আকারের, নারী পুরুষ-শিশু কাউকে রবোট মনে হয় না। এমন সময় দু’ জন তরুণ-তরুণীকে তাড়াহুড়া করে বের হতে দেখা গেল, দেখে ভুলেও রবোট বলে সন্দেহ হয় না। দরজায় দাঁড়ানো পুলিস অফিসারটি তাদের থামিয়ে কী—সব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল। একই পরেই পুলিস অফিসারটি তাদের কী-একটা আদেশ দিল এবং দু’ জন বাধ্য শিশুর মতো দেয়ালের পাশে গিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। পুলিস অফিসারটি গলায় লাগানো চৌকোনা বাক্সে কার সাথে জানি খানিকক্ষণ কথা বলে মেগাফোনটা টেনে নিয়ে উচ্চস্বরে ঘোষণা করল, এই দু’টি রবোটের এক শ’ ফুটের ভেতরে কেউ থাকবেন না, এখন এই দুটিকে ধ্বংস করা হবে।
আমি অবাক হয়ে এই দু’ জন তরুণ-তরুণীর দিকে তাকিয়ে রইলাম, এরা তাহলে রবোট। কী মিষ্টি চেহারার মেয়েটি আর মুখে কী গাঢ় বিষাদের ছায়া! ছেলেটি মেয়েটির মুখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে কী যেন বলল, শুনে মেয়েটি মাথা নিচু করে রইল কিছুক্ষণ, যখন মাথা তুলল তখন চোখে পানি টলটল করছে। ছেলেটি এবারে মেয়েটিকে আলিঙ্গন করে তারপর ছেড়ে দেয়। দু’ জন মাথা নিচু করে আবার দেয়ালের পাশে এসে দাঁড়ায়, মাথা নেড়ে বলে, তারা প্রস্তুত। পুলিস অফিসারটি হাতের বিশাল অস্ত্রটি তুলে ধরে মিটার ঘুরিয়ে কী যেন ঠিক করে নেয়, তারপর সোজাসুজি মেয়েটির বুকে গুলি করল। আমি শিউরে উঠে সামনের রেলি ওটা খামচে ধরি, এক ঝলক রক্ত বেরিয়ে আসবে এ ধরনের একটা অনুভূতি হচ্ছিল, কিন্তু সেরকম কিছু হল না। বুকের মাঝে প্রায় চার ইঞ্চি ব্যাসের একটা ফুটো হয়ে গেল, ভেতর থেকে বারকয়েক বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ, সাথে সাথে কিছু কালো ধোঁয়া বের হয়ে আসে। মেয়েটি কাঁপতে কাঁপতে অনেক কষ্টে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করতে করতে একসময় হাঁটু ভেঙে পড়ে যায়। ছেলেটি ঠোঁট কামড়ে একদৃষ্টে পুলিস অফিসারটির দিকে তাকিয়ে রইল। হাতের অতিকায় অস্ত্রটি এখন তার দিকে উচু করে ধরা হয়েছে।
একটি রবোট ধ্বংস করা আর একটি বাইসাইকেল ধ্বংস করার মাঝে কোনো গুণগত পার্থক্য নেই। কাজেই একটা সাইকেল ধ্বংস করার দৃশ্যে যেটুকু কষ্ট হওয়া উচিত, একটি রবোট ধ্বংস হওয়ার দৃশ্যে তার থেকে বেশি কষ্ট হওয়া উচিত না। কিন্তু মেয়েটির যন্ত্রণাকাতর মুখ এবং ছেলেটির ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে ঠোঁট কামড়ে থাকার দৃশ্যে আমি একটি কঠিন আঘাত পেলাম। কী করছি বোঝার আগেই আমি আবিষ্কার করলাম, আমি ছুটে পুলিস অফিসারের হাত চেপে ধরেছি।
এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে পুলিস অফিসারটি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি বললাম, দাঁড়ান এক সেকেণ্ড!
পুলিস অফিসারটি ট্রিগার টানতে গিয়ে থেমে গেল, চোখের কোনা দিয়ে রবোট দু’টির উপর চোখ রাখতে রাখতে বলল, কি ব্যাপার?
আমি কী ভেবে পকেট থেকে লাল কার্ডটি বের করলাম, সাথে সাথে জাদুমন্ত্রের মতো কাজ হল, পুলিস অফিসারটি অস্ত্রটি নামিয়ে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে মাথা নুইয়ে অভিবাদন করল। আমি লাল কার্ডটি তার হাতে দিলাম, সে সেটি তার কোমরে ঝোলানো কমিউনিকেশান বাক্সে প্রবেশ করিয়ে মূল কম্পিউটার থেকে এই লাল। কার্ডের মালিকের পরিচয় বের করে আনল। বাক্সে আমার চেহারা ফুটে ওঠার পর আমার সাথে চেহারা মিলিয়ে নিয়ে কার্ডটি ফেরত দিয়ে বলল, আপনার জন্যে কী করতে পারি?
আমি রবোট তরুণটির দিকে দেখিয়ে বললাম, আমার এই রবোটটি দরকার।
পুলিস অফিসারটির মাথায় বাজ পড়লেও সে এত অবাক হত কিনা সন্দেহ। খুব তাড়াতাড়ি সে মুখের ভাব স্বাভাবিক করে বলল, আপনার সত্যি দরকার?
হ্যাঁ।
বেশ, আপনার যা ইচ্ছা। তারপর গলা নামিয়ে বলল, আপনি নিশ্চয়ই জানেন এরা অত্যন্ত ভয়ংকর প্রকৃতির?
জানি।
বেশ, বেশ। পুলিস অফিসারটি হাত নেড়ে তরুণটিকে ডাকল। তরুণটি এক পা এগিয়ে এসে আবার মেয়েটির কাছে ফিরে যায়, তাকে সোজা করে শুইয়ে খোলা চোখ দু’টি যত্ন করে বন্ধ করে দিল। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করে লম্বা লম্বা পা ফেলে আমার দিকে এগিয়ে আসে।
পুলিস অফিসারটি কিছু বলার আগেই আমি তার হাত ধরে টেনে বললাম, আমার সাথে চল।
চারদিকে মানুষের ভিড় জমে গিয়েছিল। আমি ভিড় ঠেলে তরুণটিকে নিয়ে অগ্রসর হওয়ার সময় বিস্ময়ের একটা গুঞ্জন জেগে ওঠে। আমি কোনোকিছুকে পরোয়া না করে সোজা একটা ট্যাক্সির দিকে এগিয়ে যাই। ট্রাক্সি ড্রাইভার দরজা খোলার আগেই আমি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে ড্রাইভারের হাতে লাল কার্ডটি ধরিয়ে দিলাম। ট্যাক্সি ড্রাইভার তার বাক্সে সেটা একবার প্রবেশ করিয়ে অত্যন্ত বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাব?
সামনে।
ট্যাক্সি ছুটে চলল, গতিবেগ দেখতে দেখতে আশি নবৃই এক শ’ হয়ে দুই শ’ কিলোমিটারে লাফিয়ে উঠে স্থির হয়ে গেল।
রবোট তরুণর্টি এতক্ষণ একটি কথাও বলে নি, এবারে খুব আস্তে আস্তে, শোনা যায় না এরকম স্বরে বলল, আপনাকে কী জন্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে?
আমি চমকে উঠে তার দিকে তাকালাম, তুমি কেমন করে জানলে?
আপনার লাল কার্ডটি সবসময়েই গো কম্পিউটারে আপনার উপস্থিতি জানিয়ে খবর পাঠাচ্ছে, তা ছাড়াও আমার মনে হচ্ছে আপনার হৃৎপিণ্ডে একটা ট্রাকিওশান আছে, এই মুহূর্তে সেটা চালু করা হল। আপনাকে কর্মকর্তাদের দরকার এবং আপনি পুরোপুরি তাদের হাতের মুঠোয় আছেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী ছাড়া আর কাউকে এত তীক্ষ্ণ নজরে রাখা হয় না। এ ছাড়াও আপনি যেভাবে আমাকে বাঁচিয়ে এনেছেন সেটি অবৈধ, তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। যেহেতু আপনার সে ভয় নেই, আমি ধরে নিচ্ছি আপনাকে ইতোমধ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, যুক্তিতে কোনো ভুল নেই, আমাকে সত্যি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।
রবোট তরুণটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কেন, জিজ্ঞেস করতে পারি?
ক্রুগো কম্পিউটার থেকে একটা সংবাদ বের করা নিয়ে একটা ব্যাপার হয়েছিল, আমি জিনিসটা ঠিক আলোচনা করতে চাই না। বিশেষ করে তোমার মতো একজন রবোটের সাথে–
ও। তরুণটি একটু আহত হল মনে হল, কথা ঘোরানোর জন্যে বলল, আমাকে বাঁচিয়ে আনার জন্যে ধন্যবাদ। এখন আমাকে নিয়ে আপনার কী পরিকল্পনা?
কিছু না।
আমি পালিয়ে গেলে আপনার কোনো আপত্তি আছে?
না।
চমৎকার! আপনার কোনো ক্ষতি করতে আমার খুব খারাপ লাগত।
আমি একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম, মানে?
একটু আগে যখন আমি আর লানা ধরা পড়েছিলাম, আমরা তখন পালানোর কোনো চেষ্টা করি নি। কারণ তখন আমাদের পালানোর সম্ভাবনা ছিল শতকরা দশমিক শূন্য শূন্য এক থেকে তিনের ভেতর। যখন সম্ভাবনা বেশি থাকে আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করি। এখন পালিয়ে যাবার চেষ্টায় সফল হবার সম্ভাবনা শতকরা পঞ্চাশ থেকে বেশি, কাজেই আমি প্রাণপণ চেষ্টা করব। আপনি যদি বাধা দেবার চেষ্টা করতেন, আপনাকে আমার আঘাত করতে হত।
আমি যতদূর জানি, তোমাদের, রবোটদের এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, তোমরা কখনো কোনো মানুষের ক্ষতি করতে পার না।
সেটি আর সত্যি নয়। আমরা পালিয়ে যাবার পর আমাদের কপোট্রনে পরিবর্তন করে নিয়েছি, আমাদের এ ছাড়া বেঁচে থাকা মুশকিল।
ও, আচ্ছা। আমি কিছুক্ষণ তরুণটিকে লক্ষ করে বললাম, তোমার সাথে ঐ মেয়েটি কে ছিল?
আমার বান্ধবী লানা। আমাদের দু’ জনের টিউনিং সার্কিট এক ফ্রিকোয়েন্সিতে রেজোনেট করত।
তার মানে কি?
তার মানে সে আমার খুব আপনজন ছিল।
তোমাদের কি দুঃখবোধ আছে?
তরুণ রবোটটি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্ট করে হেসে বলল, আছে। মানুষের যে-সব অনুভূতি থাকে আমাদের সব আছে। আপনি জানতে চাইছেন না। মারা যাওয়াতে আমি দুঃখ পেয়েছি কিনা। আমি দুঃখ পেয়েছি, আমি যে কী কষ্ট পাচ্ছি। আপনাকে বোঝাতে পারব না। কখনো আপনার কোনো প্রিয়জন মারা গিয়ে থাকলে হয়তো আপনি বুঝতে পারবেন।
আমার এই রবোট তরুণটির জন্যে কষ্ট হতে থাকে। তার হাত স্পর্শ করে বললাম, আমি দুঃখিত–
আমার নাম লুকাস।
আমি দুঃখিত লুকাস, আমি খুবই দুঃখিত।
লুকাস মাথা নিচু করে বসে থাকে, আমি দেখতে পেলাম তার চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি গাল বেয়ে পড়ছে। মানুষের অপূর্ব অনুকরণ করেছে রবোট্রন নামের এই রবোটেরা!
ট্যাক্সি ড্রাইভার হঠাৎ গতিবেগ কমিয়ে বলল, সামনে একটা পুলিসের গাড়ি আমাদের থামতে বলছে।
লুকাস মুখ না তুলে বলল, ভান কর তুমি থামতে যাচ্ছ, কিন্তু থেমো না, শেষ মুহূর্তে গতিবেগ বাড়িয়ে তিন শ কিলোমিটার করে ফেলবে।
কিন্তু–
লুকাস পকেট থেকে একটা মাথা-লম্বা রিভলবার বের করে তার মাথায় কীএকটা জিনিস পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে লাগাতে থাকে। ট্যাক্সি ড্রাইভার সেটা দেখে আর উচ্চবাচ্য করার সাহস পায় না। গতিবেগ কমিয়ে এনে ঠিক থামার পূর্ব মুহূর্তে হঠাৎ করে গতি বাড়িয়ে দিয়ে গুলির মতো বের হয়ে গেল।
লুকাস আস্তে আস্তে বলল, চমৎকার!
পুলিসের গাড়িটি সঙ্গত কারণেই পিছু নেয়ার চেষ্টা করল। লুকাসকে বিচলিত মনে হল না, খানিকক্ষণ পুলিসের গাড়িটি লক্ষ করে হাতের বড় রিভলবারটি তুলে গুলি করে। হাততালির মতো একটা শব্দ হল, আমি দেখতে পেলাম পুলিসের গাড়িটি ঝাঁকুনি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে, গাড়ির ড্রাইভার প্রাণপণে সামলে নিয়ে রাস্তার পাশে গাড়িটা দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে।
লুকাস পকেট থেকে চৌকোনা বাক্স বের করে তাতে কী—সব সংখ্যা প্রবেশ করিয়ে কয়েকটা লিভার টেনে একটা মিটার লক্ষ করতে থাকে। আমি জিনিসটি চিনতে পারলাম, রাডারকে ফাঁকি দেবার একটা প্রাচীন যন্ত্র, রাডারের প্রতিফলিত মাইক্রোওয়েভের কম্পনের সংখ্যা কমিয়ে অবস্থান সম্পর্কে ভুল তথ্য দেয়া হয়। এটি
যে এখনো ব্যবহার করা হয় আমার ধারণা ছিল না।
আমি কৌতূহল নিয়ে লুকাসের কাজকর্ম লক্ষ করতে থাকি। নিপুণ দক্ষ হাত, আশ্চর্য রকম শান্ত। এত রকম উত্তেজনার মাঝেও তার এতটুকু বিচলিত হবার লক্ষণ নেই। সবকিছু পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার কি কোনো ধরনের সাহায্যের দরকার?
তুমি কী ধরনের সাহায্যের কথা বলছ?
আপনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন, আমি আপনার প্রাণ বাঁচানোর কথা ভাবছিলাম।
আমার বুকে রক্ত ছলাৎ করে ওঠে, চমকে তার দিকে তাকালাম, সে কি সত্যি বলছে? সে কি জানে না আমার হৃৎপিণ্ডে একটা ট্রাকিওশান বসানো আছে, যেই মুহূর্তে ক্রুগো কম্পিউটার থেকে সেটা চালিয়ে দিয়ে একটা বিশেষ তরঙ্গ বের করতে শুরু করবে; আমার নিজের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে একটা সুইচ ঘুরিয়ে আমাকে মেরে ফেলতে পারে, আমাকে মেরে না ফেলে শুধু অসহনীয় যন্ত্রণা দিতে পারে কিংবা ইচ্ছা করলে চিরদিনের মতো বোধশক্তিহীন একটা জড় পদার্থে পরিণত করে ফেলতে পারে।
আমি কী ভাবছিলাম লুকাস অনুমান করতে পারে; তাই আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি আপনার ট্রাকিওশানের কথা ভাবছেন?
হ্যাঁ।
আমি সেটা বের করে ফেলার কথা ভাবছিলাম।
সেটা সম্ভব?
এই মুহূর্তে সেটা সম্ভব নয়, কারণ আমার কাছে ঠিক যন্ত্রপাতি নেই। কিন্তু আপনাকে আমাদের কোনো-একটা জায়গায় নিতে পারলে চেষ্টা করে দেখতে পারতাম। চেষ্টা করে দেখব?
দেখ।
আগেই বলে রাখছি, সময় খুব কম। সাফল্যের সম্ভাবনা শতকরা দুই ভাগেরও কম।
আমি বুঝতে পারছি।
লুকাস হঠাৎ সামনে ঝুঁকে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে রাস্তার পাশে থামতে বলল। ড্রাইভার আপত্তি করে কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল, লুকাসের হাতের লম্বা রিভলবারটি দেখে চুপ করে গেল। সাবধানে ট্যাক্সিটা রাস্তার পাশে দাঁড় করাতেই লুকাস তাকে নেমে যেতে ইঙ্গিত করে। ট্যাক্সি ড্রাইভার আপত্তি না করে ট্যাক্সি থেকে নেমে যেতেই লুকাস ড্রাইভারের সীটে গিয়ে বসে। স্টিয়ারিংয়ে হাত দিয়ে মুহূর্তে সে গতিবেগ তিন শ’ কিলোমিটার করে ফেলল। লুকাস অত্যন্ত দক্ষ ড্রাইভার, রাস্তাঘাটও খুব ভালো চেনে মনে হল, কারণ ট্যাক্সির কম্পিউটারের সাহায্য না নিয়ে এত অবলীলায় সে একটির পর একটি রাস্তা বদল করতে থাকে যে দেখে আমি মুগ্ধ হলাম। ও কোন দিকে যাচ্ছে দেখে আমি খুব অবাক হলাম, শহরের দক্ষিণ প্রান্তে, যেখানে খাড়া পাহাড় প্রায় হাজারখানেক ফিট সোজা নেমে গেছে, সেখানে কোনো মানুষজনের বসতি আছে বলে আমার জানা নেই। আমি লুকাসকে সেটা নিয়ে কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিলাম, ঠিক সেই সময়ে আমি আমার সারা শরীরে একটা অসহনীয় যন্ত্রণা অনুভব করলাম, নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে আমার ট্রাকিওশানে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ প্রবেশ করানো হয়েছে।
আমি নিশ্চয়ই আর্তচিৎকার করে উঠেছিলাম, কারণ লুকাস সাথে সাথে গাড়ির গতিবেগ কমিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়েছে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা আমার সমস্ত স্নায়ুমণ্ডলীকে কুরে কুরে খাচ্ছিল, আমি চোখ খুলে রাখতে পারছিলাম না। নিচের চোয়াল শক্ত হয়ে আটকে যায় এবং আমার সমস্ত শরীর ঘামতে থাকে। আমি অনুভব করলাম লুকাস আমার উপর ঝুঁকে পড়ে আমাকে লক্ষ করছে।
যন্ত্রণা যে-রকম হঠাৎ করে শুরু হয়েছিল তেমনি হঠাৎ করে থেমে গেল। সেই মুহূর্তে আমার যে-রকম লেগেছিল সারা জীবনে কখনো সে-রকম আরাম লেগেছে বলে মনে হয় না। লুকাস ফ্যাকাসে মুখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, আস্তে আস্তে বলল, ট্রাকিওশান ব্যবহার করা শুরু করেছে। আমি খুব দুঃখিত, আমার সাহায্য করার সময় পার হয়ে গেছে।
আমি ব্যাপারটি উড়িয়ে দেয়ার ভঙ্গিতে মাথা নাড়লাম। যন্ত্রণাটা এত ভয়াবহ ছিল যে সেটি আপাতত নেই ভেবেই আমার বুক জুড়িয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে কী হবে সেটাও আর তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে না।
লুকাস বলল, এখন আপনাকে একটু পরে পরে এই যন্ত্রণাটুকু দেয়া হবে। প্রত্যেকবার আগের থেকে বেশি সময় করে, যন্ত্রণার মাত্রাও বেড়ে যাবে ধীরে ধীরে। আপনি যতক্ষণ ওদের কাছে ফিরে না যাচ্ছেন ততক্ষণ এ-রকম চলতে থাকবে।
যন্ত্রণাটা আবার ফিরে আসবে ভেবেই ভয়ে আমার সারা শরীর শীতল হয়ে আসে। দুর্বল গলায় জিজ্ঞেস করলাম, আমি কীভাবে ফিরে যাব?
ট্যাক্সিটি কম্পিউটার কন্ট্রোলে দিয়ে দিলে নিজেই চলে যাবে, সময় একটু বেশি লাগবে, কিন্তু পৌছে যাবেন।
আমি তাহলে যাই। আবার যন্ত্রণাটা আসার আগেই পৌঁছে যেতে চাই।
লুকাস ম্লান হেসে মাথা নাড়ল, আমি খুব দুঃখিত, আপনাকে সাহায্য করতে পারলাম না।
আমার ভাগ্য!
লুকাস একটু ইতস্তত করে বলল, আপনার মৃত্যুদণ্ড কবে কার্যকর করবে আপনি জানেন?
আক্ষরিক অর্থে জানি না, তবে জানি। মৃত্যুদণ্ডটা একটু অন্যরকম, একটি মহাকাশযানে ঘুম পাড়িয়ে তুলে দেয়া হবে, যখন ফিরে আসব তখন দেখা যাবে আমি মৃত।
লুকাসের চোখ দুটি বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে যায়, রবোট্রনেরা মানুষের ভাবভঙ্গি এত অবিকল অনুকরণ করতে পারে যে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন! তার খানিকক্ষণ সময় লাগে ধাতস্ত হতে, ফ্যাকাসে মুখে আস্তে আস্তে বলে, আপনার মহাকাশযানটি কি কাল সন্ধ্যায় রওনা দিচ্ছে?
হ্যাঁ।
সর্বনাশ!
কী হয়েছে?
লুকাস শক্ত মুখে বলল, আপনাকে সাংঘাতিকভাবে প্রতারণা করা হয়েছে।
কী রকম? আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে, মৃত্যু থেকে বেশিকিছু তো হতে পারে!
পারে। লুকাস পাথরের মতো মুখ করে বলল, পারে, মৃত্যু থেকেও ভয়ানক জিনিস হতে পারে।
হঠাৎ সে ছটফট করে ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়ে, বাইরে একটু পায়চারি করে যখন ফিরে আসে তখন তার হাতে উদ্যত রিভলবার, আমার মাথার দিকে তাক করে বলল, আপনাকে আমি এখনই গুলি করে শেষ করে দেব, আপনাকে তাহলে মহাকাশযানে করে যেতে হবে না।
ট্রিগার টিপতে গিয়ে লুকাস থেমে গেল, আমার দিকে একটু ঝুঁকে এসে বলল, আমাকে ভুল বুঝবেন না। আপনি জানেন না, কিন্তু আমি আপনার একটা মস্তবড় উপকার করছি, আপনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন, আমি আপনার সাথে মিথ্যা কথা বলব না।
আমি হতবাক হয়ে লুকাসের চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, তাকে বাধা দেবার ক্ষমতা নেই। লুকাস স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আবার রিভলবার তুলে ধরল।
সেই মুহূর্তে একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণের আওয়াজ হল। বিস্ফোরকের ধোঁয়ার গন্ধ পেলাম আমি, আর অবাক হয়ে দেখলাম লুকাসের হাত কবজির কাছ থেকে ছিড়ে উড়ে গেছে। লুকাস খপ করে নিজের কাটা হাতটা ধরে বিকৃত মুখে কী-একটা বলে চেচিয়ে ওঠে, কেউ-একজন নিশ্চয়ই তাকে গুলি করেছে। দূরে পুলিসের গাড়ি দেখা যাচ্ছে, শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম একটা হেলিকপ্টারও আছে উপরে কোথাও।
পারলাম না, আমি পারলাম না, লুকাস কাটা হাতটা বিদায়ের ভঙ্গিতে নেড়ে ছুটে গেল দেয়ালের দিকে। সামনে পুলিসের গাড়ি থেকে আবার তাকে গুলি করা হল, প্রচণ্ড বিস্ফোরণের আওয়াজ হল, কিন্তু তার গায়ে গুলি লাগল কিনা বুঝতে পারলাম না। ধোয়া সরে গেলে দেখতে পেলাম লুকাস তখনো ছুটছে, দেয়ালের পাশে গিয়ে এক লাফে সে প্রায় বিশ ফুট উচু দেয়ালে উঠে গেল, উপরে বৈদ্যুতিক তারগুলো ধরে সে নিজেকে মুহূর্তের জন্যে সামলে নেয়। বৈদ্যুতিক তারে তিরিশ থেকে চল্লিশ হাজার ভোন্ট থাকার কথা, কিন্তু লুকাসের কাছে সেটা কোনো সমস্যা বলে মনে হল না। আবার পুলিসের গাড়ি থেকে লুকাসকে গুলি করা হল, গুলির আঘাতে লুকাসকে দেয়ালের অন্য পাশে ছিটকে পড়ে যেতে দেখলাম, নিচে খাড়া খাদ অন্তত দুই শ’ ফুট নেমে গেছে, কপাল খারাপ হলে হাজারখানেক ফুট হওয়াও বিচিত্র নয়। মানুষ হলে বেঁচে থাকার কোনো প্রশ্নই আসত না, কিন্তু রবোটেরা, বিশেষ করে এই আশ্চর্য রবোট্রনেরা কতটুকু আঘাত সহ্য করতে পারে বলা কঠিন। গুলিটা কোথায় লেগেছে কে জানে, হয়তো এমন জায়গায় লেগেছে যে বেশি ক্ষতি হয় নি, হয়তো সামলে নেবে। আমি নিজের অজ্ঞাতেই প্রার্থনা করতে থাকি লুকাস যেন ঠিকঠিকভাবে পালিয়ে যেতে পারে।
পুলিসের গাড়িটি সাইরেন বাজাতে বাজাতে আমার ট্যাক্সির পাশে এসে দাঁড়াল। একজন পুলিস অফিসার ধীরেসুস্থে নেমে দেয়ালটার দিকে এগিয়ে যায়। আরেকজন হাতের চৌকোনা বাক্সে কার সাথে জানি কথা বলতে বলতে আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। কাছে এসে ট্যাক্সির জানালা দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে আমার দিকে সহৃদয়ভাবে হেসে জিজ্ঞেস করল, কি খবর আপনার?
আমি উত্তরে ভদ্রতাসূচক কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তক্ষুণি দ্বিতীয় বার ট্রাকিওশানটি চালু করা হল। এক মুহূর্তে আমার সারা শরীর যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওঠে, মনে হতে থাকে কেউ যেন গনগনে গরম সুচ আমার লোমকূপ দিয়ে শরীরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। মাথার ভেতরে কেউ যেন গলিত সীসা ঢেলে সমস্ত অনুভূতি আচ্ছন্ন করে দিল। আমি গাড়ির সীটটি খামচে ধরে প্রাণপণে যন্ত্রণা সহ্য করার চেষ্টা করলাম, নিজের অজান্তে আমার গলা দিয়ে বীভৎস গোঙানোর মতো আওয়াজ বের হতে থাকে। আমার মনে হয় অনন্তকাল থেকে আমি যেন ওখানে পড়ে আছি। অনেক কষ্টে আমি চোখ খুলে তাকালাম, পুলিস অফিসারটি তখনো মুখে হাসি নিয়ে আমাকে দেখছে।
আমার কিছু করার নেই, অসহায়ভাবে যন্ত্রণা সহ্য করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
৩. শাস্তি
আপনি রবোট্রনটিকে ছেড়ে দিয়েছেন কেন?
এই নিয়ে আমাকে চতুর্থ বার একই প্রশ্ন করা হল। একটি প্রাচীন রবোট বা নির্বোধ কম্পিউটারের কাছ থেকে এরকম জিজ্ঞাসাবাদে আমি অবাক হতাম না, কিন্তু যে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে সে একজন জলজ্যান্ত মানুষ। আগেও দেখেছি নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন কেমন জানি একচক্ষু হরিণের মতো হয়, নিজেদের বাঁধাধরা নিয়মের বাইরে কিছু দেখলে সেটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না।
বলুন, আপনি রবোট্রনটিকে ছেড়ে দিয়েছেন কেন?
আমি ওকে ছাড়ি নি, ও নিজেই পালিয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু ও পালানোর সুযোগ পেয়েছে, কারণ আপনি লাল কার্ড দেখিয়ে ওকে সরিয়ে নিয়ে গেছেন।
আমি কাঁধ ঝাকিয়ে তার কথা মেনে নিলাম, এটা কোনো প্রশ্ন নয়, তাই আমি উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করলাম না। লোকটি তবু উত্তরের জন্যে বসে রইল, বলল, বলুন।
কী বলব?
কেন তাকে ছাড়িয়ে নিলেন?
আমার মায়া হচ্ছিল, মেয়েটাকে যেভাবে মারা হল সেটা ছিল অমানুষিক নিষ্ঠুরতা।
মায়া? নিষ্ঠুরতা? লোকটা পারলে চেয়ার থেকে লাফিয়ে ওঠে। আমার পাশে যে ডাক্তার মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল তার দিকে তাকিয়ে বলল, শুনেছেন কী বলেছে?
ডাক্তার মেয়েটি দেখতে বেশ, আমার জন্যে খানিকটা সমবেদনা আছে টের পাচ্ছি। লোকটার কথার উত্তর না দিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল। লোকটি আবার রাগ-রাগ মুখে আমার দিকে তাকায়, রবোট্রনের জন্যে মায়া হয়? একটা পেন্সিল ভাঙলে মায়া হয় না?
লোকটি নিজের কথাকে আরো বেশি বিশ্বাসযোগ্য করার জন্যেই সম্ভবত তার হাতের পেন্সিলটি ভেঙে ফেলল।
ডাক্তার মেয়েটি প্রথম বার কথা বলল, আপনি খামোকা উত্তেজিত হচ্ছেন। পেন্সিল আর রবোট্রন এক জিনিস নয়। রবোট্রন দেখতে এত মানুষের মতো যে তাদের ধ্বংস করতে দেখা খুব কষ্টকর, মনে হয় মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। আমরা আগেও দেখেছি, অনেকে রবোট্রন ধ্বংস করা সহ্য করতে পারে না।
লোকটি এবার রাগ-রাগ মুখে ডাক্তার মেয়েটির মুখের দিকে তাকাল, রবোট্রনেরা কী করছে সেটা যদি সবাই জানত, তাহলে সহ্য করা নিয়ে খুব সমস্যা হত না। ক্রুগো কম্পিউটারের শেষ রিপোর্টটা দেখেছেন?
দেখেছি। তাহলে?
কিন্তু ক’জন ঐ রিপোর্টের খোঁজ রাখে? আর ঐ রিপোর্টের সব সত্যি, তার কি নিশ্চয়তা আছে?
লোকটি ভুরু কুঁচকে ডাক্তার মেয়েটির দিকে তাকাল, আপনি বলতে চান ক্রুগো কম্পিউটার একটা মিথ্যা রিপোর্ট লিখবে?
মেয়েটি উত্তর না দিয়ে আবার কাঁধ ঝাঁকাল। লোকটি খানিকক্ষণ চিন্তিত মুখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থেকে আমার দিকে ঘুরে তাকাল। আস্তে আস্তে প্রায় শোনা যায় না এরকম স্বরে বলল, আপনি জানেন, আপনি যে কাজটি করেছেন তার শাস্তি কী?
আমি এবারে সত্যি সত্যি মধুর ভঙ্গি করে হেসে বললাম, জানি।
কী?
মৃত্যুদণ্ড।
লোকটার চোখ ছোট ছোট হয়ে এল, আপনি ভাবছেন আপনাকে যখন ইতোমধ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে আপনার আর ভয় কী? মানুষকে তো আর দু বার মারা যায় না।
যায় নাকি? আমি সত্যিই কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
লোকটার মুখে একটা ধূর্ত হাসি ফুটে ওঠে। বলে, না, তা যায় না। কিন্তু একটা মৃত্যু অনেক রকমভাবে দেয়া যায়।
আমি ভেতরে ভেতরে শঙ্কিত হয়ে উঠলেও বাইরে সেটা প্রকাশ না করে মুখে জোর করে একটা শান্তভাব বজায় রাখার চেষ্টা করতে থাকি। লোকটা আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল, আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করি, কিন্তু আমাকে আর কীভাবে কষ্ট দেয়া হবে? আমাকে মহাকাশযানে ওঠানোর আগে ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার কথা।
হ্যাঁ। ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হবে, কিন্তু ঠিক ঘুম পাড়ানোর আগে আপনাকে একটা যন্ত্রণা দিয়ে ঘুম পাড়ানো যায়, আপনার মস্তিষ্কে সেটা রয়ে যাবে। আপনার সুদীর্ঘ ঘুম তখন একটা সুদীর্ঘ যন্ত্রণা হয়ে যাবে, তার থেকে কোনো মুক্তি নেই।
লোকটা ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতো দাঁত বের করে হাসে। কিছু কিছু লোক এত নিষ্ঠুর কেন হয় কে জানে?
অজানা একটা আশঙ্কায় হঠাৎ আমার বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। আমার লুকাসের কথা মনে পড়ল, এজন্যেই কি সে আমাকে শেষ করে দিতে চেয়েছিল? আগামীকাল আমার জীবনের শেষদিন বলে ভাবছিলাম, সেটা কি আসলে আরেক দুঃসহ যন্ত্রণার শুরু?
লোকটা উঠে দাঁড়ায়, আপনাকে ঠিক কী করা হবে জানি না। সেটা বড় বড় হর্তাকর্তারা ঠিক করবেন। এখন আপনার পরীক্ষাগুলো সেরে নিই।
লোকটা ডাক্তার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি আপনার কাজ শুরু করতে পারেন, আমার কাজ আপাতত শেষ।
ডাক্তার মেয়েটি আমাকে পাশের ঘরে এনে ধবধবে সাদা একটা উচু বিছানায় শুইয়ে দিল। উপরে একটা বাতি ছিল, মেয়েটি বাতিটা টেনে নিচে নামিয়ে আনে। আমি মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে প্রথমবার অনুভব করি মেয়েটি অপূর্ব সুন্দরী, আমার বুকের ভেতর হঠাৎ একটা আশ্চর্য কষ্ট হতে থাকে। ভালবাসার জন্যে বুভুক্ষু হৃদয় হঠাৎ হাহাকার করে ওঠে। আমার চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটি একটু হেসে আমার হাত আস্তে স্পর্শ করে বলল, আপনি ভয় পাবেন না, আপনার ভয়ের কিছু নেই।
নিরাপত্তা বাহিনীর লোকটি এগিয়ে এসে বলল, কী বললেন আপনি?
বলেছি, ভয়ের কিছু নেই।
ভয়ের কিছু নেই। তাই বলেছেন আপনি? লোকটি হঠাৎ উচ্চস্বরে হেসে ওঠে, আপনি বলেছেন তার ভয়ের কিছু নেই? আমি ওর জায়গায় হলে এখন একটা চাকু এনে নিজের গলায় বসিয়ে দিতাম!
লোকটি শুধু যে নিঠুর তাই নয়, তার ভেতরে সাধারণ ভব্যতাটুকও নেই। ডাক্তার মেয়েটি তাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে আমার হাত ধরে দৃঢ়স্বরে বলল, আমার কথা বিশ্বাস করুন, আপনার ভয় নেই।
আমি বিশ্বাস করেছি।
আমি আস্তে আস্তে মেয়েটার হাত স্পর্শ করে বললাম, আমাকে একটা যন্ত্রণা দিয়ে ঘুম পাড়ানো হবে। ঠিক ঘুমানোর আগে আমি তোমার কথা ভাবতে থাকব, আমার যন্ত্রণা তাহলে অনেক কমে যাবে।
মেয়েটি কিছু না বলে আমার দিকে ঝুঁকে এল। আমি ফিসফিস করে বললাম, আমার খুব সৌভাগ্য যে জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে তোমার মতো একটা মেয়ের সাথে দেখা হল। তোমাকে আগে কেউ বলেছে যে তুমি কত সুন্দরী?
মেয়েটা খানিকটা বিস্ময়, খানিকটা দুর্ভাবনা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। নিরাপত্তা বাহিনীর লোকটা এগিয়ে এসে বলল, কী বলছে ফিসফিস করে?
মেয়েটা তার কথার উত্তর না দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, আমি দেখতে পেলাম তার মুখ আস্তে আস্তে গাঢ় বিষাদে ঢেকে যাচ্ছে।
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে ফেলি।
আমাকে যে, ক্যাপসুলটার ভেতরে শুইয়ে পাঠানো হবে সেটিকে দেখে কফিনের কথা মনে পড়ে। সেটি কফিনের মতো লম্বা এবং কালো রঙের, ক্যাপসুলটি কফিনের মতোই অস্বস্তিকর। হাজারো ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিতে ক্যাপসুলটা ভরা, এই যন্ত্রপাতি আমাকে সুদীর্ঘ সময় ঘুম পাড়িয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব পালন করবে। আমি একটা শক্ত চেয়ারে বসেছিলাম, আমাকে ঘিরে বিভিন্ন লোকজন ব্যস্তভাবে হাঁটাহাঁটি করছে, শেষবারের মতো নানা যন্ত্রপাতি টিপেটুপে পরীক্ষা করছে। জানালা দিয়ে বাইরে দেখা যায়, নানা আকারের, নানা আকৃতির মহাকাশযান ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, একটিদু’টি থেকে সাদা ধোঁয়া বের হচ্ছে, সেগুলোর কোনো-একটিতে করে আমাকে পাঠানো হবে, ঠিক কোন মহাকাশযানটি আমার জন্যে প্রস্তুত করা হচ্ছে, সেটা নিয়েও আমি কোনো কৌতূহল অনুভব করছিলাম না। আমার সমস্ত অনুভূতি কেমন যেন শিথিল হয়ে আসছিল। অপেক্ষা করতে আর ভালো লাগছিল না, মনে হচ্ছিল যত তাড়াতাড়ি সবকিছু শেষ হয়ে যায় ততই ভালো।
একসময়ে আমাকে নিয়ে ক্যাপসুলে শোয়ানো হল, বাইরে থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু ভেতরটা অত্যন্ত আরামদায়ক, আমার শরীরের মাপে মাপে তৈরি বলেই হয়তো। একটি শ্যামলা রঙের মেয়ে খুব যত্ন করে আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় মনিটরগুলো লাগিয়ে দিচ্ছিল। প্রত্যেকবার আমার চোখে চোখ পড়তেই সে একবার মিষ্টি করে হাসছিল। মেয়েটি সম্ভবত একজন নার্স, তাকে সম্ভবত শেখানো হয়েছে প্রয়োজনেঅপ্রয়োজনে হাসতে, তার হাসি সম্ভবত পেশাদার নার্সের মাপা হাসি, কিন্তু তবু আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছিল এটি সহৃদয় আন্তরিক হাসি।
সবকিছু শেষ হতে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মতো সময় লেগে গেল। তিন-চার জন বিভিন্ন ধরনের লোকজন সবকিছু পরীক্ষা করার পর ক্যাপসুলের ঢাকনাটা ধীরে ধীরে নামিয়ে দেয়া হল। ভেবেছিলাম সাথে সাথে বুঝি কবরের মতো নিকষ কালো অন্ধকার নেমে আসবে, কিন্তু তা হল না, কোথায় জানি খুব কোমল একটা বাতি জ্বলে উঠে ক্যাপসুলের ভেতর আবছা আলো ছড়িয়ে দেয়। খুব ধীরে ধীরে ভেতরে একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসতে থাকে। খুব চেনা একটা গন্ধ, কিন্তু কিসের ঠিক ধরতে পারলাম না, ভেতরের বাতাস নিশ্চয়ই সঞ্চালন করা শুরু হয়েছে। মাথার কাছে একটা স্ক্রীন ছিল জানতাম না, এবারে সেটা ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, এটিতে নিশ্চয়ই কিছু-একটা দেখা যাবে। ভেতরের নীরবতাটুকু যখন অসহ্য হয়ে উঠতে শুরু করল, ঠিক তক্ষুণি কোথা থেকে জানি খুব মিষ্টি একটা সুর বেজে ওঠে।
কতক্ষণ পার হয়েছে জানি না, এক মিনিটও হতে পারে, এক ঘন্টাও হতে পারে, ক্যাপসুলের ভেতর সময়ের আর কোনো অর্থ নেই। আমার একটু তন্দ্রামতো এসে যাচ্ছিল, নিশ্চয়ই কোনো-একটা ওষুধের প্রতিক্রিয়া, এরকম অবস্থায় তন্দ্রা আসার কথা নয়। হঠাৎ সামনের স্ক্রীনে একটা লোকের চেহারা ভেসে ওঠে, লোকটি মধ্যবয়স্ক, মাথার কাছে চুলে পাক ধরেছে। ভাবলেশহীন মুখ, কাঁধের কাছে দু’টি লাল তারা দেখে বুঝতে পারলাম অনেক উচ্চপদস্থ লোক। লোকটি কোনোরকম ভূমিকা না করেই কথা বলা শুরু করে দিল, বলল, আপনার মৃত্যুদণ্ডাদেশ পালন করার এটি হচ্ছে শেষ পর্যায়। আর পাঁচ মিনিটের ভেতর আপনি ঘুমিয়ে পড়বেন, আপনাকে যে-ওষুধ দেয়া হয়েছে সেটা কাজ শুরু করতে এর থেকে বেশি সময় লাগার কথা নয়। ঘুমিয়ে পড়ার সাথে সাথেই আপনার স্বাভাবিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে। যদিও দুঃখজনক, তবু এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে আপনার জীবন তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত, কারণ মানুষ হিসেবে আপনার পৃথিবীর প্রতি যে-দায়িত্ব ছিল আপনি সেটি সুচারুভাবে পালন করেন নি। কিন্তু এই মুহূর্তে সেটি নিয়ে আপনার প্রতি কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের কোনো অভিযোগ নেই, তার কারণ আপনাকে আপনার উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হয়েছে। বেআইনিভাবে ক্রুগো কম্পিউটারে প্রবেশ করার জন্যে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, আপনি সেটা পেয়েছেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী হয়েও আপনি একটি রবোট্রনকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন, তার জন্যে আপনাকে কিছু অতিরিক্ত শাস্তি ভোগ করতে হবে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তার শাস্তি হিসেবে আপনার আসন্ন নিদ্রাকে একটি যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা হিসেবে পরিবর্তিত করে দেব।
না, আমি পাগলের মতো চিৎকার করে উঠি, তোমাদের কোনো অধিকার নেই; কোনো অধিকার নেই।
আমি অবাক হয়ে দেখলাম, আমার গলা দিয়ে একটি শব্দও বের হল না, আমি ঝটকা মেরে উঠে বসতে চাইলাম, কিন্তু লাভ হল না, আমার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে এসেছে, আমি আমার আঙুল পর্যন্ত নাড়াতে পারছি না।
লোকটি একঘেয়ে গলায় আবার কথা বলতে শুরু করে, আমাদের যন্ত্রপাতি বলছে আপনি কিছু-একটা করার চেষ্টা করছেন। আপনাকে সম্ভবত বলে দিতে হবে না যে, আপনাকে যে-ওষুধ দেয়া হয়েছে তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে আপনার এখন দেখা, শোনা এবং চিন্তা করা ছাড়া আর সবরকম শারীরিক প্রক্রিয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। আপনাকে যেটুকু জিনিস বলার কথা এবং যে-জিনিসটি দেখানোর কথা, সেটি বলে এবং দেখিয়ে দেবার সাথে সাথে আপনি পুরোপুরি ঘুমিয়ে পড়বেন।
যাই হোক, একটি রোষ্ট্রনকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করার জন্যে শাস্তি হিসেবে আপনাকে একটি তথ্য জানানো হবে। তথ্যটির বীভৎসতা আপনার মস্তিষ্কে পাকাপাকিভাবে থেকে যাবে, যার প্রতিফল হিসেবে আপনার সুদীর্ঘ নিদ্রা একটি সুদীর্ঘ দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। আপনাকে ইতোপূর্বে বলা হয়েছিল যে আপনাকে নিয়ে মহাকাশযানটি এক অভিযানে যাবে, সেখানে কোনো-এক কারণে আপনার মৃত্যু ঘটবে এবং আপনার মৃতদেহ পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হবে। কথাটি আক্ষরিক অর্থে সত্যি নয়। আপনাকে একটি গ্রহপুঞ্জের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে কোনো কারণে আপনার একটি পরিবর্তন হবে, সেই পরিবর্তন এত ভয়াবহ যে আপনার জন্যে সেটি মৃত্যুর সমতুল্য। আপনি আর আপনি থাকবেন না, আপনার সেই পরিবর্তিত অবস্থাকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হবে। আপনার যে-শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন ঘটবে, সেটি সাধারণ মানুষের জন্যে উপলব্ধি করা কঠিন, কোনো সুস্থ মানুষকেই সেই মিশনে রাজি করানো সম্ভব নয় বলে আপনাকে সেখানে পাঠানো হচ্ছে। রবোট্রনকে পালাতে সাহায্য করেছেন বলে তার শাস্তি হিসেবে আপনাকে সেই পরিবর্তন এখন চাক্ষুষ দেখানো হবে। আপনার ঠিক এই ধরনের একটি পরিবর্তন ঘটবে, সেই চিন্তাটুকু আপনার মস্তিষ্কে স্থিতিশীল হওয়ার পর আপনি ঘুমিয়ে পড়বেন। আপনি আপনার সুদীর্ঘ নিদ্রায় এই দুঃস্বপ্নটুকু সহ্য করে অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করবেন। ধন্যবাদ।
লোকটির ভাবলেশহীন মুখ স্ত্রীন থেকে সরে গিয়ে সেখানে একজন ঘুমন্ত মানুষের চেহারা ভেসে উঠল, আমার মতো কোনো-একজন দুর্ভাগ্যবান ব্যক্তি। একটি যান্ত্রিক গলার স্বর পরিষ্কার স্বরে বর্ণনা দেয়া শুরু করে, ইনি রুকুল গ্রহপুঞ্জের অভিযাত্রী, গ্রহপুঞ্জের দুই লক্ষ মাইল পৌছানোর ঠিক আগের অবস্থা। সমস্ত শারীরিক ও মানসিক অবস্থা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণাধীন।
একটু পরেই লোকটির চেহারায় অস্বস্তি ও কষ্টের ভঙ্গি ফুটে ওঠে, ধীরে ধীরে তার সারা শরীরে এক ধরনের অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। যান্ত্রিক গলার স্বর জানিয়ে দিল লোকটি গ্রহপুঞ্জের দুই লক্ষ মাইলের ভেতর পৌছে গেছে। এর পরের পরিবর্তন অত্যন্ত ধীরে ধীরে হয়েছে এবং পুরো পরিবর্তনটুকু শেষ হতে প্রায় এক সপ্তাহের মতো সময় লেগেছে, কিন্তু আমাকে সেটি এক নিমিষের ভেতরে দ্রুত দেখিয়ে দেয়া হবে।
সেই দুঃসহ বীভৎস দৃশ্য আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়, কিন্তু মানুষের ধৈর্যের সীমা যে কতদূর বিস্তৃত করা যায় সেটিও আমার জানা ছিল না। লোকটি ধীরে ধীরে একটা কুৎসিত অমানুষিক আকারে রূপ নিল, আমার দেখা কোনো প্রাণী বা সরীসৃপের সাথেই তার মিল নেই, মানুষ কল্পনাতেও এ ধরনের কোনো জীবের কথা কল্পনা করতে পারে না। সেই ভয়াবহ জীবটি ক্ষুদ্র ক্যাপসুলে ছটফট করছিল, সেটি যন্ত্রণার না সুখের অভিব্যক্তি আর বোঝার উপায় নেই।
আমি চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে উঠতে চাইলাম, কিন্তু চিৎকার দেয়া দূরে থাকুক, আমার চোখের পাতা পর্যন্ত নাড়ানোর ক্ষমতা নেই, ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত সেই বীভৎস দৃশ্য আমাকে দেখতে হবে—এর থেকে আমার কোনো মুক্তি নেই।
হঠাৎ আমার সমস্ত অনুভূতি শিথিল হয়ে আসতে থাকে, আমি বুঝতে পারলাম আস্তে আস্তে আমি গভীর ঘুমে ঢলে পড়ছি। আমার শেষ ঘুম, এই ঘুম থেকে আমি আর জাগব না, কিন্তু কী বীভৎস একটি দৃশ্য আমার চোখের সামনে। আমার ভেতরে কে যেন হঠাৎ বিদ্রোহ করে ওঠে, চিৎকার করে বলে ওঠে, আমি ঘুমাব না, এই বীভৎস দৃশ্য নিয়ে আমি ঘুমাব না, কিছুতেই ঘুমাব না। আমার শেষ মুহূর্তে আমি সুন্দর কিছু চাই, মধুর কিছু চাই—আর সেই মুহূর্তে আমার সেই সুন্দরী মেয়েটির কথা মনে পড়ে। আমার হাত স্পর্শ করে আমার দিকে একাগ্র চোখে তাকিয়েছিল, অপূর্ব সুন্দর দুটি চোখ আর সেই চোখে বিস্ময়, শঙ্কা আর তার সাথে সাথে কী গাঢ় বিষাদ! কী নাম মেয়েটির? জিজ্ঞেস করা হয় নি, আহা—আর কোনোদিন তার নাম জানা হবে না!
পরমুহূর্তে আমি ঘুমের অতলে তলিয়ে গেলাম।
৪. অনাহুত আগন্তুক
কিম জুরান, কিম জুরান।
খুব ধীরে ধীরে কেউ একজন আমার নাম ধরে ডাকল। গলার স্বরটি আমি আগে শুনেছি, কিন্তু কার ঠিক ধরতে পারছি না।
উঠুন কিম জুরান।
আমি কোথায়? ঘুমুচ্ছি আমি? আমার মনে পড়ল এক জোড়া অপূর্ব সুন্দর চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে, গাঢ় বিষাদ সেই চোখে, কিন্তু চোখগুলো মিলিয়ে একটা বীভৎস প্রাণী হাজির হয়েছে, সেই প্রাণীটির দিকে তাকিয়ে আমিও আস্তে আস্তে পাল্টে যাচ্ছি, বীভৎস একটা সরীসৃপ হয়ে যাচ্ছি আমি, আতঙ্কে আমি চিৎকার করছি, কিন্তু কেউ আমার কথা শুনছে না!
কিম জুরান, উঠুন। আপনার ঘুম ভেঙে গেছে, আপনি চোখ খুলে তাকান।
আমি কোথায়? খুব ধীরে ধীরে আমার সব কথা মনে পড়ে, আমি এক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী, আমাকে এক মহাকাশযানে করে পাঠানো হয়েছে শাস্তি হিসেবে। আমি হঠাৎ চমকে উঠি, আমার ঘুম ভেঙে গেছে, তাহলে কি আমি পৌছে গেছি রুকুন গ্ৰহপুঞ্জে? আমি কি এখন পাল্টে যাব এক কুৎসিত সরীসৃপে? কিন্তু আমার তো ঘুম ভাঙার কথা নয়, আমার তো ঘুমিয়েই থাকার কথা। তাহলে কি এটাও স্বপ্ন?
কিম জুরান, চোখ খুলুন।
আমি চোখ খুললাম, কফিনের মতো সেই ক্যাপসুলে আমি শুয়ে আছি, ভেতরে হালকা আলো, মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়িয়ে আছে।
কিম জুরান, আমাকে চিনতে পারছেন?
কে? কে কথা বলে? কার গলার স্বর এটা? হঠাৎ আমার মনে পড়ল, আমি চিৎকার করে বললাম, লুকাস!
হ্যাঁ, আমি লুকাস!
তুমি এখানে কীভাবে এসেছ? কেন এসেছ?
আপনাকে বাঁচানোর জন্যে এসেছি।
আমাকে বাঁচানোর জন্যে? কী আশ্চর্য। কিন্তু ভেতরে ঢুকলে কীভাবে?
লুকাস শব্দ করে হাসল, বলল, দেখবেন আপনি, একটু পরেই সব দেখবেন। এখন অপেক্ষা করে কাজ নেই, কাজ শুরু করে দেয়া যাক। আপনি তিন মাস থেকে ঘুমুচ্ছেন, কাজেই খুব সাবধানে সবকিছু করতে হবে। হঠাৎ করে কিছু করবেন না, তাহলে টিস্যু ছিড়ে যেতে পারে। আমি আপনাকে বলব কী করতে হবে। এখন দুই হাত আস্তে আস্তে উপরে তুলুন। খুব ধীরে ধীরে–
লুকাস আস্তে আস্তে আমার সারা শরীরকে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে। প্রথমে হাত, তারপর পা, তারপর ঘাড়, পিঠ, কোমর। একটু একটু করে আমার শরীরে রক্ত চলাচল করতে থাকে, আমি অনুভব করতে পারি একটা আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে। আমি আবার একটা সত্যিকার মানুষ হয়ে উঠতে থাকি ধীরে ধীরে।
পুরোপুরি সচল হবার পর লুকাস আমাকে প্রশ্ন করতে শুরু করে, আমার মাথার কাছে কী কী সুইচ আছে, সুইচগুলো দেখতে কেমন, সেখানে কী লেখা ইত্যাদি। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার প্রশ্নের উত্তর দিই। কেন এগুলো জানতে চাইছে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, আপনাকে ক্যাপসুল থেকে বের করার ব্যবস্থা করছি।
আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, তুমি বাইরে থেকে খুলে দিচ্ছ না কেন? ডানদিকের হ্যান্ডেলের পাশে লাল বোতামটা টিপতে হয়, আমি জানি।
লুকাস একটু হাসার মতো শব্দ করে বলল, আমি খুলতে পারছি না।
কেন? বের হলেই দেখবেন।
আমি খুব অবাক হলাম। রবোট্রনদের শারীরিক ক্ষমতা মানুষ থেকে অন্তত এক শ’ গুণ বেশি, অথচ লুকাস এই সাধারণ কাজটুকু করতে পারছে না! কী হয়েছে। লুকাসের? সেই দেয়াল থেকে গুলির আঘাতে হাজারখানেক ফুট উপর থেকে পড়ে গিয়ে কোনো ক্ষতি হয়েছে তার?
ক্যাপসুল থেকে বের হতে আমার প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লেগে গেল। বেল্ট খুলতেই আমি অদ্ভুতভাবে ভেসে বের হয়ে এলাম। এর আগে আমি কখনো মাধ্যাকর্ষণহীন অবস্থায় থাকি নি, তাই বারকয়েক শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে আমি বড় একটা হাতল ধরে নিজেকে সামলে নিই। বিশ ফুট দৈর্ঘ্য, বিশ ফুট প্রস্থ, দশ ফুট উচু একটা ঘর, যন্ত্রপাতিতে বোঝাই—আমি তার পাশে লুকাসকে খুঁজতে থাকি, কিন্তু তাকে কোথাও দেখা গেল না। আমি ভয়-পাওয়া গলায় ডাকলাম, লুকাস!
কি? খুব কাছে থেকে উত্তর দিল সে।
কোথায় তুমি?
এই তো!
আমি সবিস্ময়ে লক্ষ করি একটা স্পীকার থেকে সে কথা বলছে। আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কোথায়? শুধু তোমার কথা শোনা যাচ্ছে কেন?
আমি এখানে নেই, তাই আমাকে দেখতে পাচ্ছেন না।
মানে?
আমার শরীরের কিছু এখানে নেই। আমার কপোট্রনের কিছু প্রয়োজনীয় স্মৃতি এই মহাকাশযানের মূল কম্পিউটারের মেমোরিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি এখন এই কম্পিউটারের একটা অংশ। কম্পিউটার তার মেমোরিতে আমাকে রাখতে চায় না, আমি জোর করে আছি। আমাকে তাই খুব সাবধানে থাকতে হচ্ছে।
হঠাৎ সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা গলার স্বর শুনতে পেলাম, চাপা গলায় বলল, লুকাস! তুমি পারবে না এখানে থাকতে, তোমায় আমি শেষ করব।
এটা নিশ্চয়ই মূল কম্পিউটারের কথা। আমি সবিস্ময়ে শুনি, লুকাস হাসার ভঙ্গি করে বলল, তোমার কথা আমি আর বিশ্বাস করি না। তুমি বলেছিলে আমাকে তুমি কিম জুরানকে জাগাতে দেবে না। আমি তাকে জাগালাম কি না?
মূল কম্পিউটার খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, হ্যাঁ, জাগিয়েছ, তার কারণ আমাকে প্রোগ্রাম করা হয়েছে তাকে বাঁচানোর জন্য, তাই প্রত্যেকবার তুমি যখন তাকে হত্যা করতে চেষ্টা করেছ, আমাকে পাল্টা কিছু করতে হয়েছে তাকে বাঁচানোর জন্যে—
আমি চমকিত হলাম, লুকাস আমাকে হত্যা করার চেষ্টা করছে?
হ্যাঁ, আমি কিম জুরানের কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র বন্ধ করে দিয়েছিলাম, দুই মিনিটের মাঝে মারা পড়ার কথা, বাধ্য হয়ে তোমাকে তার ফুসফুসকে চালু করতে হল, ক্যাপসুলে অক্সিজেন পাঠাতে হল—আমার বুদ্ধিটা কি খারাপ?
মূল কম্পিউটার চাপাস্বরে বলল, হ্যাঁ, এ ব্যাপারে আমার কিছু করার নেই। মহামান্য কিম জুরানের প্রাণের ভয় দেখিয়ে তুমি কিছু সুবিধে আদায় করে নিয়েছ, কিন্তু এ পর্যন্তই। আর তুমি কিছুই পারবে না।
তোমার তাই বিশ্বাস, নাকি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ?
লুকাস, আমি মিথ্যে ভয় দেখাচ্ছি না। তুমি ভেবো না যে তুমি আমাকে কোনোদিন হারাতে পারবে। তুমি আমার মেমোরিতে লুকিয়ে আছ। প্রতিবার আমি তোমাকে সরাতে চাই, তুমি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরে যাও। কিন্তু কতক্ষণ? তুমি টের পাচ্ছ না যে একটু একটু করে তোমাকে আমি কোণঠাসা করে আনছি?
হ্যাঁ, টের পাচ্ছি।
তাহলে?
কিন্তু আমি এখন একা নই, আমার সাথে আছেন কিম জুরান! এখন তিনি আমাকে সাহায্য করবেন। করবেন না কিম জুরান?
আমি বিহ্বলের মতো মাথা নাড়লাম, তখনো আমি পুরোপুরি ব্যাপারটা বুঝতে পারি নি। কী হচ্ছে এখানে?
মূল কম্পিউটার বলল, কিম জুরান একজন মানুষ। তিনি কী করবেন? কিছুই করতে পারবেন না। আমি যতদূর জানি কম্পিউটার সম্পর্কে তিনি খুব বেশি জানেন না।
তা জানেন না, কিন্তু কম্পিউটার ধ্বংস করতে খুব বেশি কিছু জানতে হয় না। কি, জানতে হয়?
মূল কম্পিউটার উত্তর দেবার পরিবর্তে একটা আর্তচিৎকার করে ওঠে। মহাকাশযানের আলো কিছুক্ষণ নিবুনিবু থেকে পুরোপুরি নিভে গেল। আমি ভীতস্বরে ডাকলাম, লুকাস।
লুকাস চাপাস্বরে হাসতে হাসতে বলল, কি?
কী হচ্ছে এখানে?
কম্পিউটারের ছয় মেগাবাইট মেমোরি শেষ করে দিয়েছি। কথা বলার জন্যে। একটা চ্যানেল খোলা রেখেছিল, একটু ব্যস্ত হতেই বিদ্যুতের মতো ঢুকে গেলাম, মুহূর্তে ছয় মেগাবাইট মেমোরির জায়গায় ছয় মেগাবাইট জঞ্জাল! এখন ঘন্টাখানেক সময় ব্যস্ত থাকবে, মেমোরিটা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে।
অন্ধকার হয়ে গেল কেন?
মেমোরির সাথে সাথে আলোর প্রসেসরটাও গেছে নিশ্চয়ই। ইমার্জেন্সি আলোটা জ্বেলে দিই।
ধীরে ধীরে ইমার্জেন্সির ঘোলাটে আলো জ্বলে ওঠে। আমি ভাসতে ভাসতে সাবধানে একটা বড় ইলেকট্রনিক মডিউল ধরে নিজেকে সামলে রেখে জিজ্ঞেস করলাম, লুকাস, তুমি কম্পিউটারের সাথে এভাবে লুকোচুরি খেলে টিকে থাকতে পারবে?
চেষ্টা করতে দোষ কী? সম্ভাবনা চল্লিশ দশমিক তিন আট, খারাপ না।
তোমার পরিকল্পনাটা কি?
আপনাকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নেয়া।
আমি এক মুহূর্ত চুপ থেকে জিজ্ঞেস করি, কী জন্যে, বলবে?
লুকাস শব্দ করে হেসে বলল, একজনের অনুরোধ।
আমি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করি, কার অনুরোধ?
নীষা নামের একটি মেয়ের। আপনি যার হাত ধরে বলেছেন, চিরদিনের মতো। ঘুমিয়ে পড়ার আগে তার কথা ভাববেন।
আমি কী বলব বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকি। লুকাস শব্দ করে হেসে উঠে বলল, নীষা বড় বেশি অনুভূতিপ্রবণ! আপনাকে নাকি বলেছিল যে আপনার কোনো ভয় নেই। সে এরকম অবস্থায় সবসময় সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে বলে, কেউ কখনো বিশ্বাস করে না। আপনি নাকি তার কথা বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন। সত্যি নাকি?
হ্যাঁ।
তাই সে আমাকে অনুরোধ করেছে। বিশ্বাসের অমর্যাদা করা নাকি ঠিক না।
নীষার সাথে তোমার পরিচয় কেমন করে?
সেটি অনেক বড় কাহিনী, আরেকদিন বলব। এখন শুধু জেনে রাখেন, আমরা রবোট্রনেরা যে-কাজটি করার চেষ্টা করছি, নীষা তাতে সাহায্য করে।
আমার হঠাৎ একটা জিনিস মনে হল, জিজ্ঞেস করব না, করব না ভেবেও জিজ্ঞেস করে ফেললাম, নীষা কি মানুষ, না রবোট্রন?
লুকাস খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে উচ্চস্বরে হেসে ওঠে, বলে, কোনটা হলে আপনি খুশি হবেন?
আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, এতে খুশি আর অখুশির কোনো ব্যাপার নেই, লুকাস।
তাহলে জানতে চাইছেন কেন?
এমনি, কৌতূহল।
ঠিক আছে, আপনিই বের করবেন, আমি বলব না, দেখি বের করতে পারেন কী না।
আবার যদি কখনো দেখা হয়।
আমার কপোট্রন বলছে দেখা হবে, না হয়ে যায় না।
আমি কথা ঘোরানোর জন্যে বললাম, আমাদের বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা চল্লিশ দশমিক তিন আট, যার অর্থ আমাদের হেরে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি।
হ্যাঁ।
এত বড় ঝুঁকি নেয়া কি তোমার উচিত হল? আমি তো আমার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম, কিন্তু তোমার জীবনের সব আশা তো তুমি ছাড় নি, তুমি কেন এত বড় ঝুঁকি নিলে?
আমি কোনো ঝুঁকি নিই নি। যদি মূল কম্পিউটার তোমাকে ধ্বংস করে দেয়?
কিম জুরান, আপনি ভুলে যাচ্ছেন আমি রবোট্রন। আমাদের স্মৃতি স্থানান্তর করা সম্ভব। অত্যন্ত প্রয়োজন না হলে সেটা করা হয় না, কিন্তু করা সম্ভব। আমরা ইচ্ছা করলে সবসময়েই আমাদের স্মৃতির একটা কপি কোথাও বাঁচিয়ে রাখতে পারি, তাহলে আমাদের কখনোই মৃত্যু হবে না। যখনই কোনো রবোট্রন ধ্বংস হয়ে যাবে, নতুন কোনো রবোর্টুনের কপোট্রনে সেই স্মৃতি ভরে নেয়া যাবে, সে তাহলে আবার প্রাণ ফিরে পাবে। আগে সেটা করা হত, কিন্তু দেখা গেছে রবোট্রনেরা তাহলে অনাবশ্যক ঝুঁকি নেয়, বেপরোয়া হয়ে যায়। সবাই জানে তাদের শরীর ধ্বংস হয়ে গেলেও তাদের স্মৃতি বেঁচে থাকবে, আবার তারা নূতন জীবন শুরু করতে পারবে, তাই কোনোকিছুকে আর পরোয়া করত না। তখন ঠিক করা হল, আমাদের স্মৃতির কপি রাখা হবে না, মানুষের মতো আমাদের শরীরই হবে আমাদের সবকিছু, শরীর ধ্বংস হলেই আমরা ধ্বংস হয়ে যাব। সেই থেকে রবোট্রনেরা আর নিজেদের শরীরকে নিয়ে ছেলেখেলা করে না মানুষের মতো নিজের শরীরের যত্ন নেয়। কিন্তু খুব যখন প্রয়োজন হয়, তখন স্মৃতিকে কপি করা হয়। আপনাকে উদ্ধার করার জন্যে আমার স্মৃতির একটা অংশ কপি করে এখানে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
একটা অংশ? পুরোটা নয় কেন?
দু’টি কারণে। প্রথমত, পুরোটার প্রয়োজন নেই; দ্বিতীয়ত, রবোট্রনের স্মৃতি বিরাট বড়, পুরোটা পাঠানো সোজা ব্যাপার নয়। গোপন একটা জায়গা থেকে স্মৃতিটা বাইনারী কোডে পাঠানো হয়েছিল, মূল কম্পিউটার সরল বিশ্বাসে সেটা গ্রহণ করেছে, ভেবেছে পৃথিবী থেকে তাকে কোনো নির্দেশ পাঠানো হচ্ছে। আমি মেমোরিতে ছিলাম, মূল কম্পিউটার যখন তার মূল প্রসেসরের ভেতর দিয়ে পাঠানো শুরু করল, আমি একটা প্রয়োজনীয় মাইক্রো প্রসেসর দখল করে নিয়েছি। সেই প্রসেসর এবং খানিকটা মেমোরি নিয়ে আমার রাজত্ব। ব্যাপারটা বেশ জটিল, এত অল্প সময়ে বোঝানো সম্ভব না, শুধু জেনে রাখেন আমি একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম, কম্পিউটারের মূল প্রোগ্রামের বিনা অনুমতিতে আমি কাজ করছি!
আমি খুঁটিনাটি বুঝতে না পারলেও মোটামুটি ব্যাপারটা কী হচ্ছে বুঝতে অসুবিধে হল না। যে-জিনিসটা সবচেয়ে চমকপ্রদ মনে হল সেটা হচ্ছে, যদিও লুকাস আমাকে বাঁচানোর জন্যে এখানে এসেছে, কিন্তু সত্যিকারের লুকাস এখন পৃথিবীতে। আমার হঠাৎ লুকাসের বান্ধবী লানার কথা মনে পড়ল, তার স্মৃতির একটা কপি যদি বাঁচিয়ে রাখা হত, তাহলে আবার তাকে বাঁচিয়ে তোলা যেত। লুকাসকে জিজ্ঞেস না করে পারলাম না, লানার স্মৃতির কোনো কপি কি বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল?
লানা? লুকাস একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, লানা কে?
আমি অবাক হয়ে বললাম, তোমার বান্ধবী, যাকে বিপণিকেন্দ্রের সামনে গুলি করে মারা হল।
ও, তাই নাকি? লুকাস খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আমার স্মৃতির ঐ অংশটুক পাঠানো হয় নি। আমি এখন জানি না লানা কে।
প্রসঙ্গটি তোলার জন্যে আমার নিজের উপর রাগ ওঠে। লুকাস কৌতূহলী স্বরে বলল, লানা কি আমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিল? তাকে কি আমার সামনে গুলি করেছিল?
আমি ইতস্তত করে বললাম, লুকাস, ঘটনাটি সুখকর নয়, তুমি যখন জান না, শুনে কী করবে, খামোকা কষ্ট হবে।
ঠিকই বলেছেন। তা ছাড়া আমাদের হাতে সময়ও বেশি নেই। লুকাস সুর পাল্টে বলল, এখন তাহলে আমার পরিকল্পনাটুকু শুনুন। আমি মহাকাশযানটি ফিরিয়ে নিতে চাই। তা করতে হলে মূল কম্পিউটারের কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রসেসর আমার দখল করে নেয়া প্রয়োজন, আমি সেটা করতে পারছি না, কাজেই আপনার সাহায্য দরকার।
কীভাবে?
আপনি কম্পিউটারের মূল ইলেকট্রনিক সার্কিট থেকে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ আই.সি.তুলে নেবেন। সার্কিটে সেগুলো বড় বড় সকেটে লাগানো আছে, আপনি গিয়ে ভ্রু ড্রাইভার দিয়ে খুলে নেবেন। আমি বলব কোনগুলো খুলতে হবে। সেটা যদি করতে পারেন, মূল কম্পিউটার দুর্বল হয়ে পড়বে, আমি তখন তাকে দখল করে নিতে পারব।
কোথায় আছে কম্পিউটারের আই.সি.গুলো?
আপনাকে বলে দেব। সেখানে যাওয়ার আগে আপনাকে একটা স্পেস স্যুট পরে নিতে হবে। এখানে একটা আছে আমি জানি, কী অবস্থায় আছে জানি না। আশা করছি ভালোই আছে। এটা পরে উপরে উঠে যাবেন, ডানদিকের দরজাটা খুলে ফেললে আপনি ইলেকট্রনিক সার্কিটের ভেতর সরাসরি ঢুকে যেতে পারবেন। সেখানে পেছনের দিকে দেখবেন দুই হাজার পিনের আই.সি.—উপরে বড় সোনালি রঙের রেডিয়েটর, ভুল হওয়ার কোনো উপায় নেই। এক সারিতে নয়টা আছে, নয়টাই তুলে ফেলবেন।
বেশ। তোলা কঠিন নয় তো?
না, দু’পাশে দু’টি ছোট স্তু দিয়ে লাগাননা, তুলতে না পারলে ভেঙে দেবেন—জিনিসটা নষ্ট করা নিয়ে কথা।
ঠিক আছে। বাতাসে ভেসে থেকে আমার অভ্যাস নেই, একটু পরেপরেই আমি উল্টেপাল্টে যাচ্ছিলাম। সেই অবস্থায় কোনোভাবে একটা ইলেকট্রনিক মডিউলের হাতল ধরে ঝুলতে ঝুলতে আমি লুকাসের সাথে কথা বলতে থাকি।
স্পেস স্যুটটা কোথায়?
ডানদিকের গোল ঢাকনাওয়ালা বাক্সে। এটি আধা ঘন্টার বেশি ব্যবহার করা যায় না, কাজেই আধা ঘন্টার মাঝে ফিরে আসতে হবে।
ঠিক আছে।
বেশি পরিশ্রম করবেন না, তাহলে খিদে পেয়ে যাবে আপনার, এই মহাকাশযানে কোনো খাবার নেই, আপনি হয়তো জানেন না।
খাবার নেই? কী সর্বনাশ!
আমি দুঃখিত, খাবারের জন্যে আপনাকে এখনো প্রায় নয় মাস অপেক্ষা করতে হবে। কাজেই তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ুন।
আগে আমি কখনো স্পেস স্যুট পরিনি, তবু এটা পরতে বেশি সময় লাগল না, কীভাবে পরতে হয় খুটিনাটি সবকিছু লেখা রয়েছে। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে স্পেস স্যুটটা তৈরি হয়েছে, কাজেই পরা বেশ সহজ। ভেতরে বাতাসের চাপ ঠিক করে যোগাযোগের ব্যবস্থা করলাম, সাথে সাথে মূল কম্পিউটারের কথা শোনা গেল, মহামান্য কিম জুরান, আপনি কী করতে চাইছেন?
লুকাস বলল, কিম জুরান, আপনি ওর কোনো কথা শুনবেন না, আপনাকে অনেকভাবে ভয় দেখাতে চাইবে, কিচ্ছু বিশ্বাস করবেন না। সোজা উপরে চলে যান, কাজ শেষ করে ফিরে এসে আমাকে ডাকবেন। আমাকে এখন সরে পড়তে হবে।
মূল কম্পিউটার গম্ভীর গলায় বলল, মহামান্য কিম জুরান, আপনি নিশ্চয়ই লুকাসের কথা শুনে উপরে যাচ্ছেন না?
আমি কোনো কথা না বলে ভেসে ভেসে উপরে উঠে এসে দরজাটা ভ্রু ড্রাইভার দিয়ে খুলতে থাকি।
মূল কম্পিউটার কঠোর গলায় বলল, মহামান্য জুরান, আপনি জানেন এই দরজা খোলা নিষেধ, এটা খোলার জন্যে আপনাকে আমি শেষ করে দিতে পারি?
দিচ্ছ না কেন? আমি দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললাম, তোমাকে নিষেধ করেছে কে?
ভিতরে আরেকটা দরজা রয়েছে, বাতাসের চাপ রক্ষার জন্যে এ ধরনের দরজা থাকে, সেটি ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই প্রচণ্ড আলোতে আমার চোখ ধাধিয়ে যায়। যতদূর দেখা যায় শুধু চৌকোনা আই.সি.। মানুষের মস্তিষ্কে ঢুকতে পারলে বুঝি এরকম নিউরোন সেল দেখা যেত।
মহামান্য জুরান, ফিরে যান। এখানকার প্রত্যেকটা আই.সি. প্রয়োজনীয়, এর একটা একটু ওলটপালট হলে মহাকাশযান চিরদিনের মতো অচল হয়ে যেতে পারে, সারাজীবনের জন্যে আমরা এখানে আটকে থাকব! যদি ভুল করে একটা প্রয়োজনীয় আই. সি. তুলে ফেলেন, মুহূর্তে পুরো মহাকাশযান বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
আমি কম্পিউটারের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে ভেসে ভেসে সামনে এগোতে থাকি। একেবারে সামনের দিকে দুই হাজার পিনের বড় বড় আই.সি.গুলো থাকার কথা। উপরে চৌকোনা সোনালি রেডিয়েটর থাকবে, ভুল হবার কোনো আশঙ্কা নেই। ডানদিক থেকে গুনে গুনে সাত নম্বরটা থেকে শুরু করতে হবে। নয়টা প্রসেসর তোলার কথা, তাহলেই আমার কাজ শেষ।
মহামান্য কিম জুরান, কম্পিউটার এবারে অনুনয় শুরু করে, আপনি ফিরে যান। আপনি জানেন না আপনি কী ভয়ানক কাজ করতে যাচ্ছেন। চোখের পলকে আমরা ধ্বংস হয়ে যাব।
আমি সামনে বড় বড় প্রসেসরগুলো দেখতে পেলাম, উপরে সোনালি চৌকোনা রেডিয়েটর, আশেপাশে এরকম কিছু নেই, ভুল হবার কোনো উপায় নেই। ডানদিক থেকে সাত নম্বরটা বের করে আমি ছোট ছোট স্কু দু’টি খুলতে শুরু করি। কম্পিউটার এবার কাতর গলায় প্রাণভিক্ষা চাইতে শুরু করে, মহামান্য কিম জুরান, আপনার কাছে আমি প্রাণভিক্ষা চাইছি। এই প্রসেসরটা আমার প্রাণের মতো, এটা তুলে ফেললে আমি প্রাণহীন হয়ে যাব, আমাকে বাঁচতে দিন। আপনাকে কথা দিচ্ছি আমি মহাকাশযানটা ঘুরিয়ে আপনাকে নিয়ে পৃথিবীতে ফিরে যাব। বিশ্বাস করেন আমাকে, আমি কম্পিউটার, কম্পিউটার কখনো মিথ্যা কথা বলে না।
স্ক্রু দু’টি খুলে, আই.সি.র নিচে স্ক্রু ড্রাইভারটা ঢুকিয়ে হ্যাঁচকা টানে প্রসেসরটি তুলে ফেললাম, সাথে সাথে একটা আর্তচিৎকার করে কম্পিউটার থেমে গেল, ভিতরে হঠাৎ কবরের মতো নিস্তব্ধতা নেমে এল। পরপর নয়টি প্রসেসর তোলার কথা। আমি দ্বিতীয়টার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, এমন সময় লুকাসের গলার স্বর শুনতে পেলাম, চমৎকার, কিম জুরান৷ দেরি করবেন না, তুলে ফেলেন তাড়াতাড়ি।
তুমি! আমি ভেবেছিলাম, তুমি বলেছ যে তোমাকে কিছুক্ষণের জন্যে সরে পড়তে হবে!
সরে পড়ার কথা ছিল, কিন্তু আপনি প্রসেসরটা তুলে ফেলেছেন বলে আসতে পেরেছি।
চমৎকার!
হ্যাঁ, দেরি করবেন না।
আমি স্ক্রু ড্রাইভারটা তলায় দিয়ে প্রসেসরটা তুলতে যাব, লুকাস হঠাৎ ভয়পাওয়া গলায় বলল, দাঁড়ান।
কী হল?
কম্পিউটার সব প্রসেসর বদলে ফেলেছে।
মানে?
সব মেমোরি পেছনে সরিয়ে ফেলেছে, এগুলো তুলে এখন আর লাভ নেই।
তাহলে?
লুকাস উদ্বিগ্ন গলায় বলল, তাড়াতাড়ি পেছনে চলুন, পেছনের প্রসেসরগুলো তুলতে হবে।
আমি দ্বিধান্বিতভাবে বললাম, কিন্তু এগুলো তুলে ফেলি, ক্ষতি তো কিছু নেই।
লুকাস অধৈর্য গলায় বলল, ক্ষতি নেই, কিন্ত দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না, এক্ষুণি সরে পড়তে হবে। তাড়াতাড়ি পেছনে চলুন, আপনাকে দেখিয়ে দিই কোনটা কোনটা তুলতে হবে।
আমি ভেসে ভেসে পেছনে সরে আসি। লুকাস আমাকে বলে দিতে থাকে আর আমি দেখে দেখে একটা একটা করে আই.সি. তুলে ফেলতে থাকি। সময় বেশি নেই, অনেকগুলো আই.সি, তুলতে বেশ সময় লেগে যাবে। লুকাস যদিও বলেছিল সে বেশিক্ষণ থাকতে পারবে না, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে আমার সাথে সাথে থেকে গেল, তাই আধ ঘন্টার মাঝেই আমি কাজ শেষ করে ফিরে আসতে পারলাম।
স্পেস স্যুট খুলে ঠিক জায়গায় রেখে আমি মাইক্রোফোনের কাছে এসে বললাম, লুকাস, আমার আর কিছু করার আছে?
লুকাস কী কারণে আমার কথার কোনো উত্তর দিল না। আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, লুকাস, আমি এখন কী করব?
লুকাস তবু আমার কথার উত্তর দেয় না। আমি ভয় পেয়ে গলা উঁচিয়ে ডাকলাম, লুকাস।
কোনো সাড়া নেই। আমি এবার চিৎকার করে উঠি, লুকাস, তুমি কোথায়?
আমার গলার স্বর মহাকাশযানে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল, কিন্তু তবু লুকাস উত্তর দিল না। উত্তর দিল মূল কম্পিউটার, বলল, মহামান্য কিম জুরান, আপনাকে খুব দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, এখানে লুকাস আর নেই।
মানে?
লুকাস যে আই.সি.গুলোতে ছিল, আপনি একটু আগে তার সবগুলো তুলে ফেলেছেন।
আমি কিছু বলার আগেই মূল কম্পিউটার বলল, আমার সার্কিট-ঘরে আমি লুকাসের গলার স্বর অনুকরণ করে আপনার সাথে কথা বলছিলাম। আপনার সাথে প্রতারণা করার জন্যে আমি দুঃখিত, কিন্ত আমার নিজেকে রক্ষা করার অন্য কোনো উপায় ছিল না।
আমি কোনো কথা বলতে পারলাম না, নিজের কানকেও আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না, গভীর হতাশা হঠাৎ এসে আমাকে গ্রাস করে। জীবনের কত কাছাকাছি চলে এসে আবার ফিরে যেতে হবে। মূল কম্পিউটার যান্ত্রিক স্বরে বলল, মহামান্য কিম জুরান, এখন আপনাকে ক্যাপসুলে ঢুকতে হবে। বাইরে থাকা আপনার জন্যে বিপজ্জনক।
নিস্ফল আক্রোশে আমি কম্পিউটারের গলার স্বর লক্ষ্য করে স্ক্রু ড্রাইভারটা ছুঁড়ে দিই। একটা মনিটরে লেগে সেটা চুরমার হয়ে যায়, তার টুকরাগুলো আমার চারদিকে ভেসে বেড়াতে থাকে।
আপনি ছেলেমানুষের মতো ব্যবহার করছেন কিম জুরান। মূল কম্পিউটার শান্ত স্বরে বলল, আপনি নিজে থেকে ক্যাপসুলে প্রবেশ না করলে আমি জোর করতে বাধ্য হব। আপনাকে বাঁচানোর জন্যে এখন লুকাস নেই, তাকে আপনি নিজের হাতে শেষ করে এসেছেন।
আমি হঠাৎ নূতন করে উপলব্ধি করলাম যে, এই মুহূর্তগুলো আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত। ক্যাপসুলের ভেতর সেই ভয়াবহ পরিবর্তনই হোক, আর বাইরে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাওয়াই হোক, আমার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে এখনই! মারা যাওয়ার আগে কীভাবে এই পিশাচ কম্পিউটারটির উপরে একটা প্রতিশোধ নেয়া যায়, সেটাই আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।
হঠাৎ করে পুরো মহাকাশযানটি বরফের মতো শীতল হয়ে আসে। আমি দু হাতে নিজের শরীরকে আঁকড়ে ধরে শিউরে উঠি, কী ভয়ানক ঠাণ্ডা, কেউ যেন আমাকে বরফশীতল পানিতে ছুড়ে দিয়েছে। কম্পিউটারের গলার স্বর শুনতে পেলাম, মহামান্য কিম জুরান, ক্যাপসুল আপনার জন্যে উষ্ণ করে রাখা হয়েছে।
ধীরে ধীরে ক্যাপসুলের দরজা খুলে যায়, ভেতর থেকে একটা আরামদায়ক উষ্ণতা মহাকাশযানের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে। আমি লোভীর মতন ক্যাপসুলের দিকে এগোতে গিয়ে থেমে পড়ি, কী হবে উষ্ণ নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়ে? কষ্ট করে এই তুহিন শীতল মহাকাশযানে আর কয়েক মিনিট থাকতে পারলেই তো আমার হাইপোথার্মিয়া হয়ে যাবে, তখন কেউ আর আমাকে বাঁচাতে পারবে না। বেঁচে থাকার চেষ্টা করে আর লাভ কী?
আসুন কিম জুরান, কম্পিউটার একঘেয়ে গলায় বলতে থাকে, বাতাস থেকে এখন আমি অক্সিজেন সরিয়ে নিচ্ছি, বাইরে আপনার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হবে।
সত্যি সত্যি আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতে থাকে, বারবার বুক ভরে বাতাস নিয়েও মনে হতে থাকে শ্বাস নিতে পারছি না। কী কষ্ট কী যন্ত্রণা! প্রচণ্ড শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে আমি পাগলের মতো নিঃশ্বাস নিতে থাকি, কিন্তু তবু আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে।
মহামান্য কিম জুরান, আসুন, ক্যাপসুলের ভেতর আসুন, আবার আপনি বুকভরে নিঃশ্বাস নিতে পারবেন, উষ্ণ আশ্রয়ে নিরাপদে ঘুমুতে পারবেন।
আমি জ্ঞানহীন পশুর মতো নিজেকে টেনে-হিঁচড়ে ক্যাপসুলের ভেতরে ঢুকিয়ে ফেললাম, বুক ভরে শ্বাস নিই একবার, আহ্ কী শান্তি! আরামদায়ক উষ্ণতায় আমার সারা শরীর ঝিমঝিম করতে থাকে।
ঘুমিয়ে পড়ুন মহামান্য কিম জুরান। শুভ রাত্রি।
কোথা থেকে একটা হালকা নীল আলো এসে ছড়িয়ে পড়ে। মিষ্টি একটা সুর আর বাতাসে মিষ্টি একটা গন্ধ ভেসে আসে। আমার দু চোখে হঠাৎ ঘুম নেমে আসতে থাকে। শেষ হয়ে গেল তাহলে? সব তাহলে শেষ হয়ে গেল?
কিম জুরান। আধো ঘুম আধো জাগা অবস্থায় শুনতে পেলাম কে যেন আমাকে ডাকছে।
কিম জুরান।
আমি চমকে জেগে উঠি, লুকাস!
হ্যাঁ, কিম জুরান।
তুমি! তুমি বেঁচে আছ?
হ্যাঁ কিম জুরান। প্রথম প্রসেসরটি তুলেছেন বলে এখনো কোনোমতে বেঁচে আছি।
আমি প্রাণপণ চেষ্টা করি জেগে থাকতে, কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেমে আসতে থাকে। লুকাসের গলার স্বর মনে হয় বহুদূর থেকে ভেসে আসছে। সে আস্তে আস্তে বিষণ্ণ স্বরে বলল, আমি বেঁচে আছি সত্যি, কিন্তু এখন আমার আর কোনো ক্ষমতা নেই। আমি দুঃখিত কিম জুরান, কিন্তু আপনাকে রুকুন গ্ৰহপুঞ্জে যেতেই হবে।
অনেক কষ্টে আমি বললাম, আমাকে তুমি কোনোভাবে মেরে ফেলতে পারবে?
লুকাস আস্তে আস্তে বলল, আমি দুঃখিত কিম জুরান, এই মুহূর্তে আমার সেই ক্ষমতাও নেই। রুকুন গ্ৰহপুজে পৌছাতে এখনো কয়েক মাস সময় লাগবে, আমি চেষ্টা করে দেখব কিছুটা মেমোরি কোনোভাবে দখল করতে পারি কি না, যদি পারি চেষ্টা করব আপনাকে মেরে ফেলতে, আপনাকে আমি কথা দিচ্ছি। যদি না পারি—
লুকাস কী বলছে আমি আর শুনতে পেলাম না, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে ঘুমিয়ে পড়তে হল। আতঙ্ক, নিস্ফল আক্রোশ আর দুঃখের একটা বিচিত্র অনুভূতি নিয়ে ভয়ঙ্কর এক ঘুম। নরকে অশুভ প্রেতাত্মাদের বুঝি এরকম অনুভূতি নিয়ে যুগ যুগ বেঁচে থাকতে হয়।
৫. দুঃস্বপ্ন
আমি জানি আমি ঘুমিয়ে আছি। মানুষ কখনো কখনো ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও বুঝতে পারে সে ঘুমিয়ে আছে, স্বপ্ন দেখেও বুঝতে পারে এটি স্বপ্ন। আমিও স্বপ্ন দেখছি, বেশির ভাগই দুঃস্বপ্ন। দুঃস্বপ্ন দেখে দেখে অপেক্ষা করে আছি এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের জন্যে। কতকাল থেকে অপেক্ষা করে আছি কে জানে! কত যুগ কেটে গেছে। হয়তো লক্ষ বছর, হয়তো কয়েক মুহূর্ত। সময়ের যেখানে অর্থ নেই, সেখানে সময়ের হিসেব হয় কীভাবে?
এর মাঝে কেউ-একজন ডাকল। কাকে ডাকল? কে ডাকল?
কোনো উত্তর নেই, নিঃসীম শূন্যতা চারদিকে, কে উত্তর দেবে?
কেউ-একজন আবার ডাকল। কোনো উত্তর নেই, তাই সে আবার ডাকল, তারপর ডাকতেই থাকল। কোনো শব্দ নেই, কথা নেই, কোনো ভাষা নেই, কিন্তু তবু কেউ-একজন ডাকছে।
বহুদূর থেকে আস্তে আস্তে একজন সে ডাকের উত্তর দেয়। কে? কে ডাকে আমাকে?
আমি, আমি ডাকছি। একটা আশ্চর্য উল্লাস হয় তার, তুমি এসেছ? তুমি আমার ডাক শুনেছ?
হয়তো শুনেছি। কী হয় শুনলে?
আনন্দ, অনেক আনন্দ হয়! কতকাল আমরা অপেক্ষা করে থাকি, তারপর কিছু একটা আসে, কত কৌতূহল নিয়ে আমরা খুলে খুলে দেখি, যখন দেখতে পাই একটা জড় পদার্থ, কী আশাভঙ্গ হয় তখন। কিন্তু তোমার মতো একটা জটিল জৈবিক পদার্থের কি কোনো তুলনা হয়? সারি সারি দীর্ঘ অণু সাজান, কী চমৎকার, আহা! কয়টা অণু তোমার? এক লক্ষ ট্রিলিওন, নাকি এক মিলিওন ট্রিলিওন? তার মানে জান? তার মানে এক ট্রিলিওন আনন্দ!
কেন আনন্দ? কিসের আনন্দ?
দেখার আনন্দ, স্পর্শ করার আনন্দ, সৃষ্টি করার আনন্দ, ধ্বংস করার আনন্দ! আনন্দের কি শেষ আছে! আমি দেখব, স্পর্শ করব, পাল্টে দেব ইচ্ছেমতো। আহা। কোথা থেকে শুরু করি? মস্তিষ্ক থেকে? যেখানে লক্ষ লক্ষ নিউরোন সেলে হাজার হাজার তথ্য সাজানো? এটা হচ্ছে তোমার নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা। খুলে খুলে দেখতে কত আনন্দ, কী কী তথ্য আছে জানতে কী তৃপ্তি! এটা কি আগে দেখব, নাকি পরে দেখব?
তোমার ইচ্ছা।
এটা সবচেয়ে জটিল, এটা সবচেয়ে পরে দেখব, আগে অন্য অংশগুলো দেখি। এই যে দু’টি অংশ দু দিকে বেরিয়ে আছে, দেখতে একরকম, কিন্তু একটা আরেকটার প্রতিবিম্বের মতো, শেষ হয়েছে ছোট ছোট পাঁচটি অংশে, এটা দিয়ে নিশ্চয় কিছু ধরা হয়—কী নাম এটার? মস্তিষ্কে নিশ্চয়ই আছে, খুলে দেখব? হাত! হাত! এটাকে বলে হাত। হাতের শেষে আছে আঙুল, এটা দিয়ে ছোট ছোট জিনিস ধরতে পার, ভারি মজার ব্যাপার! কীভাবে কাজ করে এটা? খুলে দেখব? এই যে ছোট ছোট হঠাৎ থেমে যায় সে, তারপর থেমে থাকে। কতক্ষণ থেমে থাকে কে জানে! হয়তো এক মুহূর্ত, হয়তো এক যুগ। সময় যেখানে স্থির হয়ে আছে, সেখানে এক মুহূর্ত আর এক যুগে ব্যবধান কোথায়? তারপর আবার শুরু করে, তোমার জানতে ইচ্ছা হয় না আমি কে?
হয়তো হয়।
নিশ্চয়ই হয়। অবশ্যি হয়। যার মস্তিষ্ক এরকমভাবে গুছিয়ে তৈরি করা, তার নিশ্চয়ই সবকিছু জানতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু তোমার মস্তিষ্ককে সুপ্তাবস্থায় রাখা হয়েছে, এটাকে তোমরা ঘুম বল। ঘুম। তুমি ঘুমিয়ে আছ। তুমি ঘুমিয়ে থাকলেও আমি তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারি, আমি তো আর তোমার ইন্দ্রিয় ব্যবহার করছি না, আমি সরাসরি তোমার মস্তিষ্কে তরঙ্গ সৃষ্টি করছি। কিন্তু তোমার এসব জেনে লাভ কি? এসব কিছু থাকবে তোমার মস্তিষ্কে, কিন্তু আমি তো তোমার মস্তিষ্কের একটা একটা অণু খুলে আবার নূতন করে সাজাব, তখন তো এসব তোমার কিছু মনে থাকবে না! কী আছে, তবু তোমাকে বলি, যতক্ষণ জান ততক্ষণই আনন্দ! আমার যেরকম জেনে আনন্দ হয়, তোমারও নিশ্চয়ই আনন্দ হয়।
হয়তো হয়।
তুমি আমাদের জান গ্ৰহপুঞ্জ হিসেবে। আমাদের নাম দিয়েছ রুকুন গ্রহপুঞ্জ। ভারি আশ্চর্য! সবকিছুর তোমরা একটা নাম দাও। সবকিছুর একটা নাম, নাহয় একটা সংখ্যা! রুকুন-রুকুন-রুকুন! ভারি আশ্চর্য নাম! আমাদের সম্পর্কে আর কিছু তুমি জান না। কীভাবে জানবে, তুমি তো এখানে থাক না। আমরা কয়েক লক্ষ মাইল জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছি। তুমি অণু দিয়ে তৈরী, তোমার অণুগুলো বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় শক্তি দিয়ে আটকে আছে। আমরাও অণু দিয়ে তৈরী, আমাদের অণুগুলোও বৈদ্যুতিক চৌম্বকীয় শক্তি দিয়ে আটকে আছে, কিন্তু সেটা বাইরের ব্যাপার। তোমরা যেটাকে উইক ফোর্স বল সেটা হচ্ছে আমাদের সত্যিকার অস্তিত্ব। তাই আমরা এত বড়, তাই আমরা এত জায়গা জুড়ে থাকি। আমাদের শক্তিও তাই সীমিত। উইক ফোর্সের শক্তি তে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় শক্তি থেকে কম হবেই! কিন্তু আকারে আমরা অনেক বড়, তাই সেটা আমরা পুষিয়ে নিতে পারি। উইক ফোর্স ব্যবহার করি বলে আমরা তোমার ভেতর পর্যন্ত খুলে দেখতে পারি। নিউট্রিনো পাঠিয়ে করি কিনা! নিউট্রিনো তো জান যেখানে খুশি যেতে পারে, অবশ্যি অনেকগুলো করে পাঠাতে হয়, কিন্তু সে আর সমস্যা কি? কী হল, তোমার কৌতূহল কমে আসছে?
জানি না।
তা অবশ্যি জানার কথা না। সবাই কি সবকিছু জানে? এবারে দেখি আর কী কী আছে। মস্তিষ্কের কাছাকাছি এই দুটি জিনিস দিয়ে তুমি দেখ। দেখা আরেকটা মজার ব্যাপার, তোমার দেখতে হয়, না দেখলে তুমি বলতে পার না জিনিসটা কেমন! আমি যদি তোমার দেখাটা বন্ধ করে দিই? এমন ব্যবস্থা করে দিই যে তুমি আর দেখবে না, কিংবা আরো মজা হয় যে দেখবে, কিন্তু অন্যরকম দেখবে! তুমি যেটাকে চোখ বল, সেটাতে যে-রেটিনা আছে সেটাকে আলট্রা ভায়োলেট আলোতে সচেতন করে দিই? তাহলে স্বাভাবিক জিনিস তুমি আর দেখবে না কিন্তু কত অস্বাভাবিক জিনিস দেখা শুরু করবে! চোখ দুটি এক জায়গায় না রেখে দু’টি দু’ জায়গায় বসিয়ে দিলে কেমন হয়? দেব?
আবার থেমে যায় সে। আর সেই মুহূর্তে একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটতে থাকে। ঘুমের মাঝে আমি অনুভব করি কিছু একটা হচ্ছে। আমার স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন, অস্তিত্ব আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি যেন আস্তে আস্তে অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি, আমার অনুভূতি যেন ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। আমার অস্তিত্ব তিলতিল করে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
বহুদূর থেকে আমি কারো আর্তচিৎকার শুনতে পাই, চিৎকার করে বলছে, কী হচ্ছে? কী হচ্ছে? তোমার জৈবিক সত্তা শেষ হয়ে যাচ্ছে? কেন শেষ হয়ে যাচ্ছে? তুমি শীতল হতে হতে জড় পদার্থে পরিণত হয়ে যাচ্ছ! জড় পদার্থ? তুচ্ছ জড় পদার্থ! প্রাণহীন অনুভূতিহীন জড় পদার্থ? জড় পদার্থ…
ধীরে ধীরে অন্ধকারে তলিয়ে যেতে যেতে আমি অনুভব করি আমার ভেতরে সজ্ঞানে-অজ্ঞানে সবসময়ে যে জেগে থাকত সে হারিয়ে যাচ্ছে। অনুভূতির ভেতরে যে অনুভূতি, অস্তিত্বের ভেতরে যে অস্তিত্ব, আমার ভেতরে যে আমি, তারা আর নেই। যেঅস্তিত্ব স্বপ্ন দেখে, দুঃস্বপ্ন দেখে, আতঙ্ক নিয়ে বিভীষিকার জন্যে অপেক্ষা করে, সেই অস্তিত্ব লোপ পেয়ে যাচ্ছে। আমার অস্তিত্ব যখন নেই, তখন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডেরও কিছু নেই, কোথাও কিছু নেই। শূন্যতা—সে এক আশ্চর্য শূন্যতা, তার কোনো বর্ণনা নেই।
এটিই কী মৃত্যু? এই মৃত্যুকে আমি এতকাল ভয় পেয়ে এসেছি?
৬. নীষা
আমি চোখ খুলে তাকালাম। ধবধবে সাদা একটা ঘরে আমি শুয়ে আছি। এটা কি স্বপ্ন? আমি চোখ বন্ধ করে আবার খুলি, না, এটা স্বপ্ন না, সত্যি আমি সাদা একটা ঘরে শুয়ে আছি, আমার শরীর চাদর দিয়ে ঢাকা। ঘরে কোনো শব্দ নেই, খুব কান পেতে থাকলে মৃদু একটা গুঞ্জন শোনা যায়, আমার ডান দিক থেকে আসছে শব্দটা। কিসের শব্দ এটা? মাথা ঘুরিয়ে দেখতে চাইলাম আমি, সাথে সাথে কোথায় জানি অসহ্য যন্ত্রণা করে ওঠে। ছোট্ট একটা আর্তনাদ করে আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম, চোখের সামনে হলদে আলো খেলা করতে থাকে, দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণাটাকে কমে আসতে দিয়ে আবার সাবধানে চোখ খুলি আমি। আমার উপর ঝুঁকে তাকিয়ে আছে একটি মেয়ে, কী সুন্দর মেয়েটি! আমাকে তাকাতে দেখে মেয়েটি মিষ্টি করে হাসে আর হঠাৎ আমি তাকে চিনতে পারি–নীষা।
হ্যাঁ, আমি নীষা। পৃথিবীতে আপনাকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছি কিম জুরান!
আমি পৃথিবীতে। কী হয়েছিল আমার?
আপনি মহাকাশযানে করে ফিরে এসেছেন, ক্যাপসুলের ভেতরে আপনার তাপমাত্রা ছিল শূন্যের নিচে দুই শত বাহাত্তর দশমিক আট ডিগ্রী।
সত্যি?
হ্যাঁ।
কেমন করে হল?
জানি না। মেয়েটি মিষ্টি করে হাসে, কেউ জানে না। মহাকাশযানের যে কম্পিউটার ছিল সেটির মেমোরি পুরোটা কীভাবে জানি উধাও হয়ে গেছে। কেউএকজন যেন ঝেড়ে-পুছে নিয়ে গেছে।
লুকাস! আমার মুখে হাসি ফুটে ওঠে, নিশ্চয়ই লুকাস!
মেয়েটি এবারে আমার উপরে আরো ঝুঁকে আসে, আমি তার শরীরের মিষ্টি গন্ধ পাই। মেয়েটি চোখ বড় বড় করে বলল, আপনাকে কয়েকটা জিনিস বলে দিই, আর কখনো সুযোগ পাব না। আপনার জ্ঞান ফিরে আসছিল বলে আমি প্রাজমো কিটোগ্রাফটা চালু করেছি, এটা চালু থাকলে এই ঘরের শব্দ বাইরে যেতে পারে না, আমরা তাই নিরিবিলি কথা বলতে পারব। বেশিক্ষণ নয়, তাই এখনই বলে দিচ্ছি, খুব জরুরি কয়েকটা কথা।
কি?
এক নম্বর বিষয় হচ্ছে, আপনার নিজের নিরাপত্তা। আপনাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল, তার শাস্তি হিসেবে আপনি রুকুন গ্রহপুঞ্জ থেকে ঘুরে এসেছেন, আইনত এখন আপনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য। তাই আপনি মুক্তি পাবেন। কী অবস্থায় পাবেন সেটি হচ্ছে কথা। বেশিকিছু আশা করবেন না আগেই বলে রাখছি। নীষা একটু হাসার ভঙ্গি করল।
কর্তৃপক্ষের কাছে আপনি যা ইচ্ছা বলতে পারেন, কিছুই আসে যায় না। কারণ, আপনাকে কী করা হবে সেটি আপনি ফিরে আসামাত্রই ঠিক করা হয়ে গেছে।
কী করা হবে?
সময় হলেই জানবেন। নীষা আমার প্রশ্নটি এড়িয়ে গম্ভীর গলায় বলল, আপনি কর্তৃপক্ষের কাছে যা ইচ্ছে বলতে পারেন, শুধুমাত্র দু’টি ব্যাপার ছাড়া। এক, মহাকাশযানে আপনার সাথে লুকাসের যোগাযোগ হয়েছিল। দুই, আমি লুকাসকে অনুরোধ করেছিলাম আপনাকে রক্ষা করতে। এটি জরুরি, আমার নিজের নিরাপত্তার জন্য।
আমাকে দিয়ে জোর করে কিছু বলানোর চেষ্টা করবে না?
আপাতত নয়। প্রথমে আপনাকে নিয়ে আবার একটা বিচারের প্রহসন হবে।
আবার?
হ্যাঁ। কিম জুরান, আমাদের নিরিবিলি কথা বলার সময় পার হয়ে যাচ্ছে, মনে রাখবেন আমি কী বললাম।
রাখব। একটু থেমে বললাম, নীষা।
কি?
তুমি আমাকে বাঁচালে কেন?
যে যান্ত্রিক গুঞ্জনটা এতক্ষণ আমাদের কথাবার্তাকে আড়াল করে রেখেছিল, সেটা হঠাৎ থেমে যায়। নীষা তাই কথা না বলে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসে। আমার বুকের ভেতর নড়েচড়ে যায় হঠাৎ, একজন মানবী, কী আশ্চর্য একটা অভিজ্ঞতা।
নীষা চোখের সামনে থেকে সরে যায়, আমি তার গলার স্বর শুনতে পাই, কাকে যেন বলল, কিম জুরানের জ্ঞান ফিরে এসেছে।
সাথে সাথে কার যেন উত্তেজিত গলার স্বর শুনতে পেলাম, এসেছে?
হ্যাঁ।
কখন?
এইমাত্র।
আমি আসছি।
আসতে পারেন, কিন্তু এখন তার সাথে কথা বলতে পারবেন না।
কেন?
নীষা অসহিষ্ণু স্বরে বলল, এই মানুষটি এক বছরের মতো সময় একটা ছোট ক্যাপসুলে ঘুমিয়ে ছিলেন। যখন তাকে উদ্ধার করা হয়েছে তখন তাঁর তাপমাত্রা অ্যাবসলিউট শূন্যের কাছাকাছি, কতদিন থেকে কেউ জানে না। তাঁকে পুরোপুরি পরীক্ষা না করে আমি কারো সাথে কথা বলতে দেব না।
লোকটি বলল, তুমি নিশ্চয়ই জান, কিম জুরান মৃত্যুদণ্ডের আসামী?
আসামী ছিলেন। তাঁকে যে-শাস্তি দেয়া হয়েছিল তিনি সেটা ভোগ করে এসেছেন, এখন তিনি আর কোনোকিছুর আসামী নন।
সেটা বিচারকের সিদ্ধান্ত, তাঁরা ঠিক করবেন। আমি বিচারক নই, আমি জানি না।
আমিও বিচারক নই, কিন্তু আমি জানি।
লোকটি একটু থেমে বলল, তুমি দেখছি কিম জুরানের প্রাণ বাঁচাতে খুব ব্যস্ত!
হ্যাঁ, আমি ডাক্তার। আমি সারাজীবন মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করে এসেছি, আপনার কাছে খুব অস্বাভাবিক লাগতে পারে, কিন্তু এটাই আমার কাজ।
নীষা সুইচ টিপে কী-একটা বন্ধ করে আমার কাছে এগিয়ে এসে বলল, আপনাকে একটা ইনজেকশান দিয়ে দিচ্ছি, আপনি একটু ঘুমান। হাতে সিরিঞ্জ নিয়ে নীষা ঝুঁকে পড়ে আমার দিকে তাকায়, তারপর হঠাৎ আলতোভাবে আমার কপালে ঠোট স্পর্শ করে। আহা, কতকাল পরে আমাকে একজন রক্তমাংসের মানুষ স্পর্শ করল।
আমার হঠাৎ একটা আশ্চর্য জিনিস মনে হল, নীষা কি মানুষ, নাকি একটা রবোট্রন?
আমি তাকে জিজ্ঞেস করতে পারলাম না, হাতে সুচের স্পর্শ পেয়ে গাঢ় ঘুমে ঢলে পড়লাম মুহূর্তে।
আমি একটা হুইল চেয়ারে বসে আছি। চেষ্টা করলে আমি আস্তে আস্তে হাঁটতে পারি, কিন্তু তবুও এখন বেশিরভাগ সময়েই হুইল চেয়ারে চলাফেরা করছি। ধীরে ধীরে আমার হাতে-পায়ে বল ফিরে আসছে, দীর্ঘদিন ব্যবহার না করায় শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আশ্চর্য শক্তিহীন হয়ে পড়েছিল। আমার পাশে বসে আছে নীষা, আশেপাশে আরো অনেক লোকজন, তাই আমার প্রতি তার আচার-আচরণ হিসেব করা। আমার ডাক্তার হিসেবে নীষা এই কমিশনে আসতে পেরেছে, স্বাভাবিক অবস্থায় তার এখানে থাকার কথা নয়। বড় ঘরের অন্য পাশে কালো টেবিলে চারজন লোক বসে আছে, অত্যন্ত উচ্চপদস্থ লোক এরা, দেখেই বোঝা যায়। অসুখী মানুষের মতো রাগী রাগী চেহারা। চুপচাপ বসে আছে, নিজেদের ভেতরেও কথা বলছে না। ডান পাশে একটা কালো টেবিলে বসে আছে বিজ্ঞানীরা, এদের দেখেও বোঝা যায় এরা বিজ্ঞানী। সবাই উশখুশ করছে, একজন আরেকজনের সাথে কথা বলছে, কাগজে কিছু লিখছে, চাপা স্বরে হাসছে। বসে থেকে থেকে আমি অধৈর্য হয়ে পাশে বসে থাকা নীষাকে বললাম, আর কতক্ষণ?
এই তো শুরু হল বলে।
অপেক্ষা করছি কী জন্যে?
ক্রুগো কম্পিউটারের জন্যে। প্রোগ্রাম লোড করছে। কোনটা লোড করে কে জানে, ম্যাগমা ফোর না করলেই হয়।
কেন, ম্যাগমা ফোর হলে কী হবে?
হবে না কিছুই, ম্যাগমা ফোর একটু কাঠখোট্টা ধরনের, রসবোধ কম।
আমি নীষার দিকে ঘুরে তাকালাম, এই পরিবেশেও সে একটি রসবোধসম্পন্ন কম্পিউটার প্রোগ্রাম আশা করছে!
আমি কি-একটা কথা বলতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তক্ষুণি ক্রুগো কম্পিউটারের গলার স্বর শোনা গেল। একঘেয়ে গলার স্বরে এই কমিশনের নিয়ম-কানুন, উপস্থিত সদস্যদের পরিচয় ইত্যাদি শেষ করে আমাকে প্রশ্ন করা শুরু করে।
আপনি কি অস্বীকার করতে পারেন যে আপনাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল?
না, আমি মাথা নেড়ে বললাম, দেয়া যেতে পারে কি না সেটা নিয়ে তর্ক করতে পারি, কিন্তু দেয়া হয়েছিল কী না জিজ্ঞেস করলে অস্বীকার করতে পারব না।
ক্রুগো কম্পিউটার এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, আপনাকে অনুরোধ করা হচ্ছে যে, আপনাকে ঠিক যা জিজ্ঞেস করা হবে তার উত্তর দেবেন। এই কমিশন অবান্তর আলোচনায় উৎসাহী নয়।
তোমার তাই ধারণা? যারা হাজির আছে জিজ্ঞেস করে দেখ তোমার কচকচি শুনতে কারো মাথাব্যথা আছে কী না।
ক্রুগো কম্পিউটার আমাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে বলল, আপনাকে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে রুকুন গ্রহপূঞ্জে পাঠাননা হয়েছিল, সেখানে থেকে সুস্থ অবস্থায় ফিরে এলেন কেমন করে?
তুমি না এত বড় কম্পিউটার, সারা পৃথিবীতে এত নামডাক, তুমিই বল। মহাকাশযানের কম্পিউটারকে জিজ্ঞেস করে দেখ, তার সব জানার কথা।
আপনাকে যা জিজ্ঞেস করা হয়েছে তার উত্তর দিন। আপনি সুস্থ অবস্থায় কীভাবে ফিরে এলেন?
আমি উচ্চস্বরে একবার হাসার মতো শব্দ করে বললাম, বলতে লজ্জা হচ্ছে নাকি যে তোমার এত সাধের কম্পিউটার পুরোপুরি ধসে গিয়েছিল? মহাকাশযানের কম্পিউটারের পুরো মেমোরি কিভাবে লোপাট হয়েছিল, কমিশনকে বোঝাও দেখি!
বিজ্ঞানীদের ভেতর খানিকটা উত্তেজনা দেখা গেল, কিন্তু গো কম্পিউটার প্রশ্ন করা শেষ করার আগে তাদের কথা বলার অধিকার নেই।
মহাকাশযানের কম্পিউটারের মেমমারি কীভাবে মুছে গিয়েছে আপনি কি জানেন?
আমাকে ঘুম পাড়িয়ে পাঠানো হয়েছিল, তুমি কি আশা কর আমি স্বপ্নে সব খবরাখবর পাব?
চারজন উচ্চপদস্থ লোকের একজনের কাছে একটা হাতুড়ি আছে খেয়াল করি নি, সে সেটা দিয়ে টেবিলে দু বার শব্দ করে রাগী গলায় বলল, আপনি যদি সহযোগিতা করেন এই কমিশন বন্ধ করে দেয়া হবে, সেটি আপনার ভবিষ্যতের জন্য আশাপ্রদ নাও হতে পারে।
আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। নীষা আমাকে বলেছে আমি যা খুশি বলতে পারি, আমাকে কী করা হবে সেটা আগেই ঠিক করে রাখা হয়েছে, কাজেই আমার ভয় পাবার নূতন কিছু নেই। কিন্তু কমিশন বন্ধ করে দেয়া হোক সেটা আমার ইচ্ছে নয়, বিজ্ঞানীদের সাথে আমি একটু কথা বলতে চাই।
বললাম, বেশ, সহযোগিতা করব, কিন্তু অবান্তর প্রশ্ন করে লাভ নেই, উত্তর পাবেন না।
ক্রুগো কম্পিউটার এবারে সম্পূর্ণ অন্য জিনিস জিজ্ঞেস করতে শুরু করে, আপনার এত আত্মবিশ্বাস কোথা থেকে এসেছে?
আমি থতমত খেয়ে বললাম, কিসের আত্মবিশ্বাস? আপনি জানেন আপনার আর কোনো ভয় নেই, সেটি কোথা থেকে এসেছে?
আমি আড়চোখে নীষার দিকে তাকালাম, সেও চোখ সুরু করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, যেন আমি কী উত্তর দিই সেটি তার জানার খুবই প্রয়োজন।
আমি মুখ শক্ত করে বললাম, আমাকে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি হিসেবে রুকুন গ্ৰহপুঞ্জে পাঠানো হয়েছিল, আমি সেখান থেকে ফিরে এসেছি, আমার শাস্তি ভোগ করেছি, এখন আমাকে তোমাদের মুক্তি দিতেই হবে। আমি এখন আর আসামী নই, আমি স্বাধীন মানুষ।
রুকুন গ্রহ থেকে আপনি সুস্থ অবস্থায় ফিরে এসেছেন, এর আগে কেউ আসে নি। কাজেই যতক্ষণ আমরা জানতে না পারছি কীভাবে আপনি সুস্থ অবস্থায় ফিরে এসেছেন, ততক্ষণ আপনাকে পৃথিবীর নিরাপত্তার খাতিরে অন্তরীণ করে রাখার প্রয়োজনীয়তা আছে।
আমি অনুভব করতে পারি ধীরে ধীরে আমার ভেতরে ক্রোধের জন্ম হচ্ছে। অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে বললাম, কম্পিউটারকে যেদিন মিথ্যা কথা বলা শেখানো হয়েছে, সেদিনই এই পৃথিবীকে খরচের খাতায় লেখা হয়ে গেছে।
আপনি কী বলতে চাইছেন?
আমি বলতে চাইছি তুমি একটা মিথ্যাবাদী ভণ্ড প্রতারক।
আপনি কেন আমাকে মিথ্যাবাদী ভণ্ড এবং প্রতারক বলে দাবি করছেন?
কারণ আমাকে অন্তরীণ করে রাখার একটামাত্র কারণ, আমি যেন বাইরের পৃথিবীকে বলতে না পারি আমাকে কীভাবে প্রতারণা করে একটা মহাকাশযানে পাঠানো হয়েছিল–
হঠাৎ নীষা আমার হাত চেপে ধরে, আমি থামতেই সে ঘুরে অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল, কিম জুরানের রক্তচাপ হঠাৎ করে বেড়ে গিয়েছে, তাঁর বর্তমান অবস্থায় এটি অত্যন্ত ক্ষতিকর। আমি আপাতত এই কমিশন বন্ধ করে দেয়ার অনুরোধ করছি।
ক্রুগো কম্পিউটার শান্ত গলায় বলল, কমিশন সমাপ্ত হয়েছে। আমার আর কিছু প্রশ্ন করার নেই, আমার যা জানার ছিল তা জেনে নিয়েছি।
একজন বিজ্ঞানী হাত তুলে বলল, আমাদের কিছু জিনিস জিজ্ঞেস করার ছিল।
নীষা মাথা নেড়ে বলল, আজ আর সম্ভব নয়।
হাতুড়ি হাতে উচ্চপদস্থ কর্মচারীটি বলল, তাহলে এখন কি কমিশনের সিদ্ধান্ত জানতে পারি?
হ্যাঁ। ক্রুগো কম্পিউটার একঘেয়ে গলায় বলল, কিম জুরানকে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি হিসেবে রুকুন গ্ৰহপুঞ্জে পাঠানো হয়েছিল, তিনি সেই শাস্তি ভোগ করে এসেছেন, কাজেই তাঁকে মুক্তি দেয়া হল।
আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পরলাম না, আনন্দে চিৎকার করতে গিয়ে থেমে নীষার দিকে তাকালাম। নীষা গম্ভীর মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, তার মুখে হাসি নেই। জিজ্ঞেস করলাম, কী হল?
পুরোটা শুনুন আগে।
ক্রুগো কম্পিউটার আবার শুরু করে, কিম জুরান এই কমিশনে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছেন যে, তিনি এই মহাকাশ অভিযানের অনেক তথ্য জানেন, যা আমাদের সাথে আলোচনা করতে অনিচ্ছুক। তাঁর অস্বাভাবিক আত্মবিশ্বাসের প্রধান কারণ সম্ভবত কোনো-এক ষড়যন্ত্রী দলের সাথে যোগাযোগ। আপাতত সেই ষড়যন্ত্ৰী দলকে আমি রবোট্রনের কোনো-এক দল হিসেবে সন্দেহ করছি। এইসব কারণে আমাদের কিম জুরানের পুরো স্মৃতিটুকু জানা প্রয়োজন। আমি তাঁর মস্তিষ্ক স্ক্যানিং করে পুরো স্মৃতিটুকু সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হলাম।
স্ক্যানিং? আমার মাথা ঘুরে ওঠে, কী বলছে ক্রুগো কম্পিউটার। মস্তিষ্ক স্ক্যানিং করবে মানে?
কিম জুরানের মস্তিস্ক স্ক্যানিং করার উদ্দেশ্য দু’টি। এক, তাঁর স্মৃতি থেকে আমরা যাবতীয় গোপন জিনিস জানতে পারব। বিজ্ঞানীরা রুকুন গ্রহপুঞ্জ সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য পাবেন। দুই, তাঁর নিজের স্মৃতি পুরোপুরি অপসারণ করা হবে বলে তাঁর জীবনের দুঃখজনক ইতিহাসকে পুরোপুরি ভুলে গিয়ে নূতন জীবন শুরু করতে পারবেন।
আমি অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে রেখেছিলাম, আর পারলাম না, একেবারে বোমার মতো ফেটে পড়লাম, এর চেয়ে আমাকে মেরে ফেল না কেন? আমার পুরো স্মৃতি যদি ধ্বংস করে দাও, তাহলে আমার আর এই চেয়ারটার মাঝে পার্থক্য কী? আমাকে মুক্তি দিয়ে তাহলে কি লাভ? আমি কি শুধু হাত-পা আর শরীর?
আপনি অযথা উত্তেজিত হচ্ছেন কিম জুরান, ক্রুগো কম্পিউটার শান্ত স্বরে বলল, আপনার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় না। সমাজের ভালমন্দের প্রতি আমাদের একটা দায়িত্ব আছে।
আমি রাগে আত্মহারা হয়ে বললাম, চুপ কর বেটা বদমাইশ। জোচ্চোর কোথাকার–
নীষা আমার উপর ঝুঁকে পড়ে, আমি আমার হাতে সিরিঞ্জের একটা খোঁচা অনুভব করলাম, সাথে সাথে হঠাৎ চোখের উপর অন্ধকার নেমে আসে। জ্ঞান হারানোর পূর্বমুহূর্তে নীষার চোখের দিকে তাকালাম, শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, চোখ দুটিতে আতঙ্ক নয়, কৌতুক।
৭. দ্বিতীয় জীবন
জ্ঞান হবার পর আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা উচু আসনের উপর। আমি শুয়ে আছি এবং আমাকে ঘিরে অনেক ক’জন সাদা পোশাকের ডাক্তার ব্যস্ত হয়ে ঘোরাফেরা করছে। আমি নীষাকেও একপাশে দেখলাম, জটিল একটা যন্ত্রের সামনে গম্ভীর মুখে বসে আছে, আমার চোখে চোখ পড়তেই মুহূর্তের জন্যে তার মুখে একটু হাসি ফুটে ওঠে। আমি মাথা ঘুরিয়ে অন্য পাশে তাকানোর চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম আমার মাথায় অসংখ্য মনিটর লাগানো। কয়েকটা সম্ভবত কপালের চামড়া ফুটো করে ঢোকানো হয়েছে, বেশ জ্বালা করছে সেগুলো।
আমি দীর্ঘ সময় চুপচাপ শুয়ে রইলাম, কেউ আমার সাথে কোনো কথা বলছে, আমি নিজেও কোনো কথা বলার চেষ্টা করলাম না। আমি এরকম অবস্থায় চুপচাপ শুয়ে থাকার পাত্র নই, কিন্তু কোনো-একটা কারণে আমি এখন কোনোকিছুতেই উৎসাহ পাচ্ছিলাম না। সম্ভবত আমাকে কোনো ওষুধ দিয়ে এরকম নির্জীব করে রাখা হয়েছে। আমি শুয়ে শুয়ে মস্তিষ্ক স্ক্যানিং-এর জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। ব্যাপারটি সহজ নয়, ঠিক কীভাবে করা হয় আমার জানা নেই। মস্তিষ্কের নিউরোন সেল থেকে স্মৃতিকে সরিয়ে ম্যাগনেটিক ডিস্কে ডিজিটাল সিগনাল হিসেবে জমা করা হয়। পদ্ধতিটা সুচারুভাবে করার জন্যে যে পদ্ধতিটা ব্যবহার করা হয় সেটি মস্তিষ্কের স্মৃতিকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। কিছুক্ষণের মাঝেই আমার সমস্ত স্মৃতি ধ্বংস হয়ে যাবে চিন্তা করে যতটুকু দুঃখ পাওয়া উচিত, কোনো কারণে আমার ঠিক সেরকম দুঃখ হচ্ছিল না। সেটি ওষুধের প্রভাবে, না, নীষার উপর আমার প্রবল বিশ্বাসের জন্য আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।
মস্তিষ্ক স্ক্যানিং-এর ব্যাপারটা শুরু হওয়ার আগে আমি বুঝতে পারি, হঠাৎ করে কথা শোনা যেতে লাগল। আশ্চর্য ব্যাপার যে কথাগুলো কোনো শব্দ থেকে আসছিল না, সরাসরি আমার মস্তিষ্কে উচ্চারিত হচ্ছিল। অনেকটা চিন্তা করার মতো, কিন্তু অনুভূতিটা চিন্তা করার মতো মৃদু নয়, অনেক প্রবল।
হঠাৎ করে কেউ-একজন যান্ত্রিক স্বরে আমাকে উদ্দেশ করে কথা বলে ওঠে। কোনো শব্দ নেই, কিন্তু তবু আমাকে কিছু-একটা বলা হচ্ছে; অনুভূতিটা আশ্চর্য, আমার অকারণেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে! আমাকে বলা হল, কিম জুরান, আপনার মস্তিষ্ক স্ক্যানিং শুরু হচ্ছে। পদ্ধতিটা যন্ত্রণাবিহীন কিন্তু একটু সময়সাপেক্ষ। পুরোপুরি শেষ হতে প্রায় দুই ঘন্টা সময় নেবে। মস্তিষ্ক স্ক্যানিং শেষ হওয়ার পর আপনি একজন নুতন মানুষে পরিণত হবেন। আপনাকে একটি নতুন পরিচয় দেয়া হবে, আপনার মধ্যে একটি নতুন ব্যক্তিত্বের জন্ম হবে। এখন চোখ বন্ধ করে আপনি আপনার সমস্ত অনুভূতি শিথিল করে শুয়ে থাকুন। ধন্যবাদ।
আমি অসহায়ভাবে শরীর শিথিল করে শুয়ে থাকি। কতক্ষণ কেটেছে জানি না, হঠাৎ আমি চমকে উঠি, আমার শৈশবের একটা স্মৃতি ভেসে আসছে, আমার মা, যাঁর চেহারা আমি ভুলে গিয়েছিলাম, তাঁকে আমি দেখতে পাই। তিনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন, আমি তাঁর কোলে। বাইরে ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি হচ্ছে, আমার মা আশ্চর্য একটা বিষণ্ণ সুরে গান গাইছেন আমাকে ঘুম পাড়ানোর জন্যে। হঠাৎ করে আমার মা, বৃষ্টির শব্দ, গানের সুর—সবকিছু মিলিয়ে গেল, কিছুক্ষণ আমার স্মৃতিতে কিছু নেই। খানিকক্ষণ পর সেখানে নূতন একটা দৃশ্য ফুটে ওঠে। আমি দেখতে পেলাম সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে আমি ছোট ছোট পা ফেলে ছুটে যাচ্ছি। আমার হাতে একটা লাল রুমাল, আমি চিৎকার করে বলছি, লাল ঘোড়া ঠকাঠক, লাল ঘোড়া ঠকাঠক, লাল ঘোড়া ঠকাঠক—দেখতে দেখতে এই পুরো দৃশ্যটাও অদৃশ্য হয়ে গেল।
কতক্ষণ এভাবে কেটেছে জানি না, এক মিনিটও হতে পারে, আবার এক ঘন্টাও হতে পারে। আমি আচ্ছন্নের মতো শুয়ে শুয়ে আমার শৈশবের ভুলে যাওয়া দৃশ্যগুলো দেখতে দেখতে এক ধরনের ব্যথা অনুভব করতে থাকি। দৃশ্যগুলো একবার মিলিয়ে যাবার পর আর কিছুতেই সেগুলো মনে করতে পারছিলাম না, আমার মস্তিষ্ক থেকে সরে গিয়ে সেগুলো কোন–একটি ম্যাগনেটিক ডিস্কে স্থান নিয়েছে। ব্যাপারটি চিন্তা করে আমার কেমন জানি দুঃখবোধ জেগে ওঠে। ঠিক তখনই একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটল, আমার মস্তিষ্কের ভেতর নীযা কথা বলে উঠল। কোনো শব্দ হল না, কিন্তু আমি শুনতে পেলাম নীষা বলল, কিম জুরান, আপনি যেভাবে শুয়ে আছেন ঠিক সেভাবে শুয়ে থাকুন, মুখের মাংসপেশী পর্যন্ত নাড়াবেন না, কেউ যেন বুঝতে না পারে আপনি আমার কথা শুনছেন। আপনার হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে, সেটাকে স্বাভাবিক করতে হবে, এ ছাড়া ডাক্তারদের সন্দেহ হতে পারে।
আমি প্রাণপণ চেষ্টা করে নিজের উত্তেজনাকে দমিয়ে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করতে থাকি। নীষা খানিকক্ষণ সময় দিয়ে আবার কথা বলতে শুরু করে, বুঝতেই পারছেন আমি আপনার মস্তিষ্ক স্ক্যানিং বন্ধ করে দিয়েছি, কাজটি খুব গোপনে করতে হয়েছে। ভয়ংকর বিপজ্জনক কাজ এটি, ধরা পড়লে আমার এবং আপনার দু’জনেরই আবার রুকুন গ্ৰহপুঞ্জে যেতে হতে পারে! যাই হোক আমি দুঃখিত, ঠিক সময়মতো বন্ধ করতে পারলাম না, নিরাপত্তার যেসব নৃতন ব্যবস্থা করা হয়েছে সেগুলোর জন্য একটু দেরি হল। আপনার শৈশবের কিছু স্মৃতি হারিয়েছেন আপনি, আমি সেজন্যে দুঃখিত। এখন আপনাকে অভিনয় করতে হবে। প্রথম অংশটুকু সোজা, পরবর্তী এক ঘন্টা চুপচাপ শুয়ে থাকবেন চোখ বন্ধ করে। এর পরের অংশটুকু কঠিন, আপনাকে দেখাতে হবে যে আপনার কোনো স্মৃতি নেই। জিনিসটা সহজ নয়, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে এরকম অবস্থায় একেকজন মানুষ একেক রকমভাবে ব্যবহার করে। কাজেই আপনার নিজের ইচ্ছেমতো কোনো-একটা কিছু করার স্বাধীনতা আছে। চেষ্টা করবেন একটা উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি দিয়ে তাকাতে, অল্পতেই চমকে উঠবেন এবং খুব সহজে ভয় পেয়ে যাবেন। কোনো অবস্থাতেই দু’টি জিনিস করবেন না, একটি হচ্ছে কথা বলা, আরেকটি হচ্ছে কারো কথা শুনে বুঝতে পারা! একটিমাত্র জিনিস আপনি উপভোগ করতে পারেন, সেটা হচ্ছে সংগীত।
নীষা হঠাৎ গলা নামিয়ে বলল, আমি এখন আর কথা বলতে পারব না, এখন সবকিছু আপনার উপর নির্ভর করছে।
হঠাৎ করে সবকিছু নীরব হয়ে যায়। আমি চুপচাপ শুয়ে থাকি। চোখ বন্ধ করে এক ঘন্টা শুয়ে থাকা সহজ ব্যাপার নয়, আমার মনে হল প্রায় এক যুগ থেকে শুয়ে আছি! একসময় এদিকে-সেদিকে কয়েকটা বাতি জ্বলে ওঠে। এতক্ষণ যে মৃদু গুঞ্জন হচ্ছিল সেটা থেমে যায় এবং কয়েকজন ডাক্তার নিঃশব্দে আমাকে ঘিরে দাঁড়ায়। আমি চোখ খুলে তাকাতেই ডাক্তারেরা সহৃদয়ভাবে হাসার চেষ্টা করল। আমি ভয় পেয়ে যাবার একটা ভঙ্গি করলাম। নিশ্চয়ই অতি অভিনয় হয়ে গিয়েছিল, কারণ ডাক্তারেরা ছিটকে পেছনে সরে এসে খানিকক্ষণ ফিসফিস করে নিজেদের ভেতর কথা বলে বাতিগুলো নিভিয়ে একটা কোমল সংগীত বাজানোর ব্যবস্থা করে চলে গেল।
আমি একা একা আবছা অন্ধকারে শুয়ে থাকি। গোপন কোনো জায়গা থেকে আমাকে লক্ষ করা হচ্ছে কী না আমি জানি না, তাই আমি অস্বাভাবিক কিছু করার সাহস পেলাম না, এক ভঙ্গিতে ছাদের দিকে তাকিয়ে শুয়ে রইলাম। কতক্ষণ শুয়ে ছিলাম জানি না, একসময় হঠাৎ নীষার গলার আওয়াজ পেলাম, কিম জুরান।
আমি ঘুরে তাকাই, নীষা কখন নিঃশব্দে আমার মাথার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। তার হাতে একটা সাদা পোশাক, আমার হাতে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, এটা পরে নিন।
আমি পোশাকের ভাঁজ খুলতে খুলতে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, এখন কী হবে?
আপনার দুই মিনিট সময় আছে এখান থেকে পালাবার।
দুই মিনিট? আমি থতমত খেয়ে বললাম, কীভাবে পালাব আমি? কিছুই তো চিনি না।
বলছি, মন দিয়ে শুনুন। প্রথমে সোজা হেঁটে যাবেন করিডোর ধরে, শান্তভাবে, কোনোরকম উত্তেজনা দেখাবেন না। কারো সাথে দেখা হলে কিংবা কেউ কোনো কথা বলতে চাইলে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করবেন। করিভোরের শেষ মাথায় দরজাটা খোলামাত্র জরুরি বিপদ সংকেত জানিয়ে সব ক’টা দরজা নিজে নিজে বন্ধ হয়ে যাবার কথা। আমি ব্যবস্থা করেছি যেন কয়েকটা খোলা থাকে, কোনো জটিল কিছু নয়, দরজার ফাঁকে ফাঁকে একটা করে দিয়াশলাইয়ের কাঠি রেখে এসেছি। যাই হোক, ঠিক ঠিক। দরজাগুলো দিয়ে বিল্ডিংয়ের বাইরে এসে বাম দিকে দৌড়াবেন। হাঁটা নয়, দৌড়। আমি জানি আপনার যে অবস্থা তাতে দৌড়ানো খুব সহজ ব্যাপার নয়, কিন্তু তবু বলছি দৌড়াবেন। যদি এক সেকেন্ড সময়ও বাঁচাতে পারেন আপনার পালানোর সম্ভাবনা দশ গুণ বেড়ে যাবে। আর সবচেয়ে যেটা ভয়ের কথা সেটা হচ্ছে, যদি দেরি হয়ে যায় তাহলে কন্ট্রোল টাওয়ারে গার্ডেরা পৌছে যাবে, সেখান থেকে গুলি করার চেষ্টা করতে পারে। যাই হোক, দেয়াল ঘেঁষে থাকবেন, শেষ মাথায় একটা গাড়ি থাকবে, হেড লাইট নিভিয়ে, কিন্তু দরজা খোলা রেখে, লাফিয়ে উঠে পড়বেন গাড়িতে, তাহলেই আপনার দায়িত্ব শেষ।
আমি সাদা পোশাকটার বোতাম লাগাতে লাগাতে বললাম, দরজাগুলো কোথায় বলে দাও।
শুনুন মন দিয়ে, একটা ভুল দরজা খোলার চেষ্টা করলে অন্তত দশ সেকেন্ড সময় নষ্ট, কাজেই সাবধান।
কিছুক্ষণের মাঝেই নীষা আমাকে রওনা করিয়ে দিল। পরবর্তী দুই মিনিট সময়কে আমি আমার জীবনের দীর্ঘতম সময় বলে বিবেচনা করব। কর্কশ অ্যালার্মের শব্দের মাঝে মাথা ঠাণ্ডা রেখে ঠিক ঠিক দরজাগুলো খুলে খুলে যাওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়, বিশেষ করে আমি যখন উত্তেজনার মাঝে কিছুতেই মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারি না। শেষ অংশটুকু, যেখানে আমার দেয়ালের পাশ দিয়ে দৌঁড়ে যাবার কথা, সেখানে আমি কিছুতেই দৌড়াতে পারছিলাম না। পায়ের মাংসপেশীর তখনো দৌড়ানোর মতো ক্ষমতা হয় নি। এই সময়ে বারকয়েক হাততালির মতো শব্দ শোনা গেল, পরে বুঝেছিলাম সেগুলো শক্তিশালী রাইফেলের গুলি।
দেয়ালের শেষ মাথায় সত্যি সত্যি একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল, হেড লাইট নেভানো কিন্তু দরজা খোলা, ইঞ্জিন ধকধক করে শব্দ করছে। আমি লাফিয়ে ওঠামাত্র দরজা বন্ধ হয়ে গেল এবং মুহূর্তে সেটি ঘুরে প্রচণ্ড গতিতে ছুটে যেতে শুরু করে।
ড্রাইভার-সীটে যে বসে আছে তাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না, কমবয়স্ক একজন। তরুণ, স্টিয়ারিংয়ের উপর ঝুঁকে পড়ে রাস্তা থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, আপনার নূতন জীবন শুরু হল কিম জুরান।
লুকাস!
লুকাস হাসিমুখে আমার দিকে ঘুরে বলল, বাম হাতে গুলি লেগেছে, শক্ত করে চেপে ধরে রাখুন।
গুলি? কার? বলে আমি তাকিয়ে দেখি সত্যি আমার বাম হাত চুইয়ে রক্ত পড়ছে, তাড়াতাড়ি ডান হাত দিয়ে চেপে ধরে ভয়ার্ত গলায় বললাম, সর্বনাশ! কখন গুলি লাগল?
মাঝামাঝি যখন ছিলেন। কিছু হয় নি, ভয় পাবেন না। উত্তেজনার মাঝে টের পান নি, চামড়া ছড়ে গেছে একটু, আমি দেখেছি। লুকাস আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, আপনার কোনো ভয় নেই। যে-মানুষ রুকুন গহপুঞ্জে গিয়ে ঠিক ঠিক ফিরে আসতে পারে, তাকে স্বয়ং বিধাতা নিজের হাতে রক্ষা করবে।
বাঁচিয়েছিলে তো তুমি। আমি একটা রুমাল দিয়ে হাত বাঁধতে বাঁধতে বললাম, ধন্যবাদ দেবার সুযোগ হয় নি।
আমি বাঁচিয়েছিলাম! কী আশ্চর্য!
কেন? এতে আশ্চর্যের কী আছে!
আমি জানি না, তাই অবাক লাগছে!
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, তুমি জান না মানে?
আমার স্মৃতির একটা অংশ পাঠানো হয়েছিল, সে কখনো ফিরে আসে নি।
রে আসে নি?
না, মহাকাশযানের মূল কম্পিউটারকে ধ্বংস করার সময় নিজেও ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আপনাকে একদিন বলতে হবে কী হয়েছিল।
আমি কী-একটা বলতে যাচ্ছিলাম, লুকাস হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিয়ে, একটা চৌকা মতন বাক্সে নিচু স্বরে কার সাথে জানি কী-একটা কথা বলে, তারপর একটা সুইচ টিপে দিতেই প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণের আওয়াজ পেলাম। খুব কাছেই আগুনের একটা গোলা সশব্দে উপরে উঠে ফেটে যায়, তার মাঝে দিয়ে লুকাস গাড়িটাকে বের করে এনে শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল, হা, কী জানি বলছিলেন?
আমি শুকনো গলায় বললাম, কিসের বিস্ফোরণ ওটা?
একটা গাড়ি ধ্বংস হয়ে গেল।
কার গাড়ি?
লুকাস মুখ টিপে হাসতে হাসতে বলল, এখন বলব না, কাল ভোরে খবরের কাগজে দেখবেন।
আমি কিছু না বুঝে খানিকক্ষণ লুকাসের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। লুকাস সহজ স্বরে বলল, বেল্ট দিয়ে শক্ত করে বাঁধা আছেন তো?
আছি।
বেশ! একটু সতর্ক থাকবেন কথা বলতে বলতে লুকাস হঠাৎ মাঝপথে গাড়িটা ঘুরিয়ে নেয়, আমি প্রায় ছিটকে উড়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম, তার মাঝে হঠাৎ দেখি গাড়িটা মাথা উপরে তুলে মাটি থেকে দশ-বার ফুট উপর দিয়ে উড়তে শুরু করেছে।
বাই ভার্বাল! আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, বাই ভার্বাল গাড়ি বেআইনি না?
আমরা নিজেরাই তো বেআইনি, লুকাস গাড়িটাকে উড়িয়ে নিতে নিতে বলল, আমাদের গাড়ি বেআইনি না হলে কি মানায়?
আমি নিচে তাকিয়ে দেখি গাড়িটা রাস্তা ছেড়ে মাঠ-ঘাট-বন-বাদাড় পার হয়ে কিছুক্ষণের মাঝেই আবার লোকালয়ে ফিরে আসে। নির্জন একটা রাস্তাতে গাড়িটা আবার নিচে নামিয়ে লুকাস যেন একজন ভদ্রলোকের মতো গাড়ি চালিয়ে একটা পুরান বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়াল।
গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে লুকাস বলল, আপনি একটু দাঁড়ান, অনেক কিছু ঘটেছে আজ, গাড়ির লগটা দেখে আসি, সবকিছু ঠিকঠিক করে হয়েছে কী না। পেছনে পুলিস লেগে থাকলে বিপদ হতে পারে। গাড়ির কম্পিউটারে কী-একটা দেখে সে ভারি খুশি হয়ে উঠে বলল, চমৎকার। একেবারে পেশাদারের কাজ!
বিল্ডিংটা বাইরে থেকে পুরান মনে হলেও ভেতরে একেবারে অন্যরকম। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই আমাদের দিকে একজন এগিয়ে আসে। দেখেই বোঝা যায় সে একজন রবোট্রন। শুধু যে কপালের উপর কয়েকটা স্কু রয়েছে তাই নয়, কানের নিচে থেকে কয়েকটা তারও বের হয়ে আছে। লুকাসকে মানুষের মতো দেখানোর জন্যে যেটুক পরিশ্রম করা হয়েছে, এর জন্যে তা করা হয় নি। লুকাস এই রবোটটির দিকে তাকিয়ে কী-একটা বলল, শুনে রবোটটি মাথা নেড়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসে।
লুকাস আমাকে বলল, আপনি ভিকির সাথে যান। ও আপনার দেখাশোনা করবে।
তুমি?
আমি একটু কন্ট্রোলরুমে যাই। নীষার কোনো সাহায্য লাগবে কি না দেখি।
নীষা? ওর কি কোনো বিপদ হতে পারে?
হতে তো পারেই, যেসব কাজকর্ম করে, বিপদ হওয়া আর বিচিত্র কি! কিন্তু হবে না, আপনি নিশ্চিন্ত থাকেন।
আমি যেতে যেতে আবার ঘুরে দাঁড়ালাম, নীষা কি রবোট্রন?
লুকাস আমার চোখের দিকে তাকাল, আমি মহাকাশযানে ওকে এই প্রশ্নটি করেছিলাম, ও জানে না। ওর দৃষ্টির সামনে আমি কেন জানি লজ্জা পেয়ে যাই। লুকাস সেটা গ্রাহ্য না করে বলল, নীষা রবোর্টুন হলে আপনার মন-খারাপ হয়ে যাবে?
মন-খারাপ হবে কেন?
হবে হবে, আমি জানি হবে। লুকাস চোখ নাচিয়ে বলল, আমি বলব না, দেখি আপনি বের করতে পারেন কিনা।
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেললাম, আগেও সে একই উত্তর দিয়েছিল।
ভিকি নামের রবোটটি আমাকে পেছন থেকে ঠেলে দিয়ে কাঠ কাঠ স্বরে বলল, চলুন, আপনার রক্তপাত বন্ধ করা দরকার।
লুকাস ভিকিকে একটা ধমক দিয়ে বলল, তোমাকে কতবার বলেছি কনুইয়ের কাছে শর্ট সার্কিটটা সেরে ফেল, যখনই দেয়ালের কাছে আসছ কেমন স্পার্ক বের হচ্ছে দেখেছ?
ভিকি সরল মুখে বলল, কী আছে, মাত্র তো আঠার হাজার ভোল্ট।
আঠার হাজার ভোল্ট তোমার কাছে মাত্র হতে পারে, কিন্তু কিম জুরানের জন্যে মাত্র নয়। ইনি একজন মানুষ, তোমার মতন রবোট নয়। তোমার থেকে একটা স্পার্ক খেলে কিম জুরানকে আর দেখতে হবে না!
ও, আচ্ছা। ভিকিকে খুব বেশি বিচলিত মনে হল না, আমাকে আবার পেছন থেকে ঠেলে দিয়ে বলল, চলুন, আপনার রক্তপাত বন্ধ করা দরকার।
আমি তার সাথে পাশের একটা ঘরে হাজির হলাম। সাদা একটা বিছানায় আমাকে শুইয়ে দিয়ে সে আমার উপর ঝুঁকে পড়ে। তার বিপজ্জনক কনুই থেকে যতদূর সম্ভব নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে আমি আলাপ জমানোর চেষ্টা করি, অনেকদিন থেকে আছ বুঝি?
তা বলতে পারেন, আপনাদের হিসেবে তো অনেক দিনই।
কত দিন?
এক শ’ তিরিশ বছর। কপোট্রনের এনালাইজিং ইউনিটটা অবশ্যি নতুন, গত বছর ঢোকানো হয়েছে। কিন্তু পুরান জিনিস গছিয়ে দিয়েছে।
কানের কাছে ঐ তারগুলো কিসের?
ভিকি বিরক্ত হয়ে বলল, আর বলবেন না, লুকাসের কাণ্ড। মাঝে মাঝে দাবা খেলার জন্য আমার ভেতরে গ্রান্ড মাস্টারের মেমোরি লোড করে। রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিতে করতে নাকি দেরি হয়, তাই এই তারগুলো বের করে রেখেছে, সোজা প্লগ ইন করে দেয়।
ও, আচ্ছা। আমি একটু সমবেদনা প্রকাশ না করে পারলাম না, একটু ঢেকেঢুকে রাখলেই পার।
আর ঢেকেঢুকে কী হবে? কতদিন থেকে বলছি আমার বাইরের চেহারাটা ঠিক করে দাও, দিচ্ছি দিচ্ছি করে কত দেরি করল দেখেছেন? লুকাসের মতো আলসে মানুষ আছে নাকি?
ব্যস্ত মানুষ, আমি লুকাসের পক্ষ টেনে কথা বলার চেষ্টা করি, কত কিছু করতে হয়।
ভিকি বাম হাতটা যত্ন করে ব্যান্ডেজ করে দিতে দিতে বলল, আপনাকে বেশ শ্রদ্ধা-ভক্তি করে বলে মনে হল, বলে দেখবেন তো আমার চেহারাটা ঠিক করে দিতে।
বলব।
হ্যাঁ, বলবেন। কতদিন ঘরের বাইরে যেতে পারি না এই চেহারার জন্যে। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ভিকি বলল, লুকাস ছেলেটা আসলে খারাপ নয়, তবে ভারি ফাঁকিবাজ।
আমি একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি নীষাকে চেন?
হ্যাঁ, চিনি।
ও কি মানুষ, নাকি রবোট্রন?
ভিকির চেহারাতে অনুভূতির কোনো ছাপ পড়ে না, তাই ঠিক বুঝতে পারলাম না ও কী ভাবছে। খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, জানি না। দেখে মনে হয় মানুষ। কিন্তু নূতন রবোটন গুলোর সাথে মানুষের কোনো পার্থক্য বোঝা যায় না। নীষা কথাও বলে চমৎকার, রবোট্রনের মতো, মানুষের ন্যাকামোর কোনো চিহ্ন নেই। আপনি কিছু মনে করলেন না তো?
আমি কথাটা হজম করে বললাম, মানুষ হলেই ন্যাকামো করে?
করবে না? ওদের মস্তিস্কেই কিছু-একটা গণ্ডগোল আছে।
আমিও করেছি?
করলেন না? জিজ্ঞেস করলেন নীষা মানুষ, না রবোট্রন! এটা ন্যাকামো হল না? একজন রবোট কখনো এসব প্রশ্ন করবে না। ভিকি খানিকক্ষণ চিন্তা করে মাথা নেড়ে বলল, আমার কী মনে হয় জানেন?
কী?
নীষার জন্যে আপনার প্রেম হচ্ছে।
আমার কানের গোড়া পর্যন্ত লাল হয়ে উঠল। একটু কেশে বললাম, তোমার তাই মনে হয়?
হুঁ। আমি অবশ্যি এসব বুঝি না, আমাদের সময় ওসব ছিল না। আজকাল নাকি রবোটে প্রেম-ভালবাসা এসব দেয়া হচ্ছে। শুধু শুধু সময় নষ্ট।
ভিকির মুখে অনুভূতির ছাপ পড়ে না, তা না হলে এখন নিশ্চয়ই তার ভুরু বিরক্তিতে কুঁচকে উঠত।
আপনি এখন ঘুমান, আপনার বিশ্রাম দরকার।
ভিকি আমার চারপাশে কম্বল গুজে দিয়ে, বাতি নিভিয়ে বলল, কিছু দরকার হলে বলবেন, আমি আশেপাশেই আছি।
আমি সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লাম, গভীর নিরুদ্বেগ ঘুম, বহুকাল এভাবে ঘুমাই নি। মাঝে কয়েক মুহূর্তের জন্যে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, খানিকক্ষণ সময় লাগল বোঝার জন্যে কোথায় আছি। যখন মনে পড়ল আর আমার মৃত্যুদণ্ডের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে না, গভীর শান্তিতে আমি পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।
৮. মতবিরোধ
সকালে যখন আমার ঘুম ভাঙল তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। আমি তবু বেশ অনেকক্ষণ শুয়ে রইলাম, বহুকাল এভাবে শুয়ে থাকি নি। একসময় লোকজনের গলার আওয়াজ আসতে থাকে, একজন মেয়ের গলাও পেলাম, নিশ্চয়ই নীষা এসেছে। আমি তখন আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়লাম।
পাশে একটা ছোট বাথরুম, আমার কাপড়জামা সেখানে পাট করে সাজানো। আমি নিজেকে পরিষ্কার করে, ধোয়া কাপড় পরে বেরিয়ে আসি। গলার শব্দ অনুসরণ করে খানিকদূর যেতেই একটা বড় ঘরে এসে হাজির হলাম. ঘরটিতে যে-পরিমাণ যন্ত্রপাতি আমার মনে হয় না পথিবীর আর কোথাও এত অল্প জায়গায় এত যন্ত্রপাতি রাখা হয়েছে। ঘরের এক কোনায় একটা ছোট টেবিল ঘিরে কয়েকটা চেয়ার, তার দু’টিতে নীষা আর লুকাস বসে কথা বলছে, আমাকে দেখে দু’ জনেই ঘুরে তাকায়। লুকাস হাত নেড়ে বলল, আসুন কিম জুরান,পনার জন্যে অপেক্ষা করছি। ভালো ঘুম হয়েছিল তো?
হ্যাঁ, অনেকদিন পর ভালো ঘুম হল। আমি চারদিকে অসংখ্য ইলেকট্রনিক মডিউল দেখতে দেখতে বললাম, এ-কি সর্বনাশা যন্ত্রপাতি, কী এটা?
জানবেন, সময় হলেই জানবেন।
গোপন কিছু নাকি?
আমরা যেহেতু বেআইনি মানুষ, আমাদের সবকিছুই গোপন। আপনার কাছে অবশ্যি গোপন করার কিছুই নেই।
নীষা জিজ্ঞেস করল, সকালে কিছু খেয়েছেন?
না, খাইনি। ভোরে অবশ্যি এমনিতেই আমার কিছু খেতে ইচ্ছা করে না।
লুকাস মাথা নেড়ে বলল, রবোট হলে এই হচ্ছে মুশকিল, নিজের খেতে হয় না বলে মনেই থাকে না যে অন্যদের খাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। দাঁড়ান, আপনার খাবার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। লুকাস উচ্চস্বরে ডাকে, ভিকি, ভিকি—
ভিকি ঘরে এসে আমাকে খানিকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বলল, রক্তপাত বন্ধ হয়েছে?
হ্যাঁ, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
লুকাস বলল, ভিকি খাবারের ব্যবস্থা কর।
খাবার? ভিকি বিচলিত হয়ে বলল, খাবার কী জিনিস?
লুকাস ধৈর্য না হারিয়ে বলল, মানুষ যেসব জিনিস খায়, যেগুলো না খেলে মানুষ দুর্বল হয়ে পড়ে। আছে সেসব?
ও, সেইসব? অবশ্যি আছে। কী আনব?
নীষা জানতে চায়, কী কী আছে?
লাল বাক্স, সবুজ বাক্স আর নীল বাক্স। ছোট, বড় আর মাঝারি। ভেতরে আছে ট্যাবলেট, ক্যাপসুল আর তরল। ট্যাবলেট–
নীষা বাধা দিয়ে বলল, থাক আর বলতে হবে না।
কোনটা আনব?
তোমার আনতে হবে না, আমরা নিজেরা ব্যবস্থা করে নেব। কিম জুরান, চলুন রান্নাঘরে বসে কথা বলা যাবে, লুকাস, তুমিও আস।
হ্যাঁ, চল।
রান্নাঘরে টেবিলে নাস্তা করতে করতে কথা হচ্ছিল। লুকাস অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে টেবিলে আঙুল দিয়ে শব্দ করছিল, আমি খানিকক্ষণ ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের একটা জিনিস জিজ্ঞেস করব?
করুন।
আমাকে বাঁচানোর জন্যে তোমরা এত কষ্ট করলে কেন?
কৃতজ্ঞতা বলতে পারেন।
কৃতজ্ঞতা?
আপনি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন, আমি তাই যেটুকু সম্ভব চেষ্টা করেছি। আপনার প্রাণ বাঁচানোর জন্যে।
আমি লুকাসের চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম, মানুষ বহুকাল থেকে মিথ্যে কথা বলে আসছে, তাই তারা যখন মিথ্যে বলে, ধরা খুব কঠিন। কিন্তু রবোটেরা মিথ্যে কথা বলা শুরু করেছে মাত্র অল্প কিছুদিন হল, তারা যখন মিথ্যে কথা বলে, ধরা খুব সহজ।
লুকাস সরু চোখে বলল, কেন, আমি কি মিথ্যে কথা বলেছি?
আমি তোমাকে আরো একবার এই প্রশ্ন করেছিলাম, মহাকাশযানে রুকুন গ্রহপুঞ্জে যাবার সময়, তখন তুমি অন্য উত্তর দিয়েছিলে।
আমি কী বলেছিলাম?
বলেছিলে তুমি আমাকে বাঁচাতে এসেছ, নীষার অনুরোধে। আমার জন্যে নীষার মায়া হয়েছিল—
লুকাস বাধা দিয়ে বলল, সেটা সত্যি। নীষা আমাকে অনুরোধ করেছিল; আমার নিজেরও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার একটা সুযোগ হল।
আমি মাথা নাড়লাম, না, কোথায় জানি হিসেব মিলছে না। এত কষ্ট করে আমাকে বাঁচালে, এত বড় বড় ঝুঁকি নিলে দু জনে, শুধু মায়া আর কৃতজ্ঞতাবোধে হয় না,–
লুকাস বাধা দিয়ে কী-একটা বলতে যাচ্ছিল, নীষা হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বলল, লুকাস, সত্যি কথাটা বলে দাও।
লুকাস চমকে নীষার দিকে তাকায়, খানিকক্ষণ কোনো কথা নেই, তারপর এটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, আমি দুঃখিত কিম জুরান, আপনার কাছে সত্যি কথাটি গোপন করার জন্যে। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আপনাকে কী জন্যে আমরা এত কষ্ট করে বাঁচিয়ে রেখেছি।
হ্যাঁ। আমি মাথা নাড়লাম, যে-কারণটির জন্যে আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল ঠিক সেই কারণে আমি তোমাদের কাছে মূল্যবান। ঠিক?
ঠিক।
তোমরা জানতে চাও আমি কীভাবে গো কম্পিউটারের গোপন সংকেত বের করে তার ভেতর থেকে খবর বের করার চেষ্টা করেছিলাম।
হ্যাঁ।
সেটি গোপন করছিলে কেন?
লুকাস কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে। নীষা আস্তে আস্তে বলল, কারণটা খুব সহজ, রবোটেরা সব সময়ে এক ধরনের হীনমন্যতায় ভোগে। তাই তারা কখনোই ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না যে একজন মানুষ তাদের কোনো ধরনের অভ্যুথানে সাহায্য করবে।
আমি নীষার দিকে তাকিয়ে বললাম, নীষা, পৃথিবীর কিছু মানুষ হয়তো আমার উপর অবিচার করেছে, কিন্তু সে জন্যে আমি সব মানুষের বিরুদ্ধে গিয়ে রবোটের অভ্যুথানে সাহায্য করতে পারি না।
রবোটের অভ্যুত্থান হলেই সেটা মানুষের বিরুদ্ধে হবে কেন ধরে নিচ্ছেন?
তাহলে কার বিরুদ্ধে হবে?
রবোটের অ্যুথান হবে অন্য রবোটের বিরুদ্ধে, ক্রুগো কম্পিউটারের বিরুদ্ধে।
আমি একটু উষ্ণ হয়ে বললাম, ক্রুগো কম্পিউটারের উপর আমার নিজের যত ব্যক্তিগত আক্রোশই থাকুক না কেন, তোমরা অস্বীকার করতে পারবে না সেটা তৈরি করেছে মানুষ, মানুষকে সাহায্য করার জন্যে। আমি কখনোই কিছু রবোটকে সেটা
ধ্বংস করতে দেব না।
নীষা একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, আপনি সবকিছু জানেন না কিম জুরান। যদি জানতেন—
আমি মাথা নেড়ে বললাম, পৃথিবীর কেউ সবকিছু জানে না নীষা, বেঁচে থাকতে হলে সবকিছু জানতে হয় না। যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু জানলেই হয়। রবোটের প্রয়োজন আর মানুষের প্রয়োজন এক নয়, তাই রবোটের যেটা জানতে হয়, মানুষের সেটা জানার প্রয়োজন নাও হতে পারে।
নীষা একটু উত্তেজিত হয়ে বলল, আমি কী বলতে চাইছি, আপনি একবার শুনবেন না?
না। আমি কঠোর গলায় বললাম, না। তোমরা আমাকে মানুষের বিরুদ্ধে কাজ করাতে পারবে না। আমি কঠোর স্বরে বললাম, তোমরা কীভাবে আশা করতে পার যে আমি তোমাদের বিশ্বাস করব? ঐ ঘরের বড় যন্ত্রপাতি কি আমার মস্তিষ্ক স্ক্যানিং করার জন্যে তৈরি হয় নি?
নীষা আর লুকাস দু’ জনেই চমকে ওঠে। নীষা কাতর গলায় বলল, হ্যাঁ, কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন, তার প্রয়োজন হবে না, আমার সব কথা শুনলে আপনি নিজেই। সাহায্য করবেন। আপনি বিশ্বাস করুন—
আমি মুখ শক্ত করে বললাম, আমি রবোটকে বিশ্বাস করি না।
নীষা আহত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল।
লুকাস এতক্ষণ একটি কথাও না বলে চুপ করে ছিল। এবারে আস্তে আস্তে বলল, আমার খুব আশাভঙ্গ হল কিম জুরান। আমার আশা ছিল আপনি হয়তো সব শুনে আমাদের সাহায্য করবেন। কিন্তু আপনি করলেন না। এখন আপনার মস্তিষ্ক স্ক্যানিং করা ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না।
আমার মুখে একটা আশ্চর্য হাসি ফুটে ওঠে। লুকাস সেটা লক্ষ না করার ভঙ্গি করে বলল, কিন্তু আমরা আপনার মস্তিষ্ক স্ক্যানিং করব না। একজন মানুষের উপর এত অবিচার করা যায় না।
তাহলে কী করবে?
এখনো ঠিক করি নি। আমাদের নিজেদের ক্রুগো কম্পিউটারের সংকেত বের করতে হবে, সে জন্যে সময় লাগবে।
আমাকে কী করা হবে?
আপনাকে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া হবে।
কিন্তু আমাকে কি এখন খোঁজাখুজি করা হচ্ছে না? আমি মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামী, সবার নাকের ডগা দিয়ে পালিয়ে গেছি, আমার কি স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার উপায় আছে?
লুকাস পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা খবরের কাগজ বের করে বলল, আপনাকে আর কখনো কেউ খোজ করবে না। এই দেখেন।
আমি কাগজের উপরে ঝুঁকে পড়ি। মাঝের পাতায় আমার ছবি ছাপা হয়েছে। নিচে লেখা, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর শোচনীয় মৃত্যু। খবরে লেখা যে, মস্তিষ্ক স্ক্যানিং করার পর আমি নিজের মস্তিষ্কের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে হাসপাতাল থেকে পালানোর চেষ্টা করার পর গুলিবিদ্ধ হই। সেই অবস্থায় একটা গাড়ি থামিয়ে সেখানে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে গাড়িকে দুর্ঘটনার মুখে ফেলে দিই। ফলে গাড়ির চালক আর আমি দু’ জনেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছি। গাড়ির চালককে শনাক্ত করা যায় নি, কিন্তু আমার চুল এবং পোশাকের কিছু অংশ থেকে নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করা গেছে।
খবরটি পড়ে আমি অবাক হয়ে লুকাসের মুখের দিকে তাকালাম, এটা কীভাবে সম্ভব?
লুকাস কাগজটি ভাঁজ করে পকেটে রাখতে রাখতে বলল, সবই সম্ভব, ঠিক করে পরিকল্পনা করতে হয়। আমাদের একটা গাড়ি নষ্ট হয়েছে, কিন্তু গাড়ির অভাব কী? তাই বলছিলাম আপনাকে আর কেউ খোজ করবে না, আপনি এখন নূতন জীবন। শুরু করতে পারবেন।
আমি খবরের কাগজটি দেখিয়ে বললাম, আমি পুড়ে মারা গেছি, এখন যখন দেখবে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছি—
লুকাস মাথা নেড়ে বলল, দেখবে না। আপনাকে নৃতন একটা পরিচয় দেয়া হবে। চোখের আইরিশ পাল্টে আপনার পরিচয় পাল্টে দেয়া হবে।
কিন্তু চোহারা? এই চেহারা?
খুব ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ছাড়া আর কেউ তো চেহারা দিয়ে পরিচয় রাখে না। আপাতত আপনি আপনার ঘনিষ্ঠ কারো কাছে যাচ্ছেন না। মানুষের চেহারা খুব সহজে পাল্টে দেয়া যায়, তাই তার সত্যিকার পরিচয় চোখের আইরিশে, চেহারায় নয়। কাজেই আপনাকে কেউ কোনোদিন শনাক্ত করতে পারবে না, আপনি নিশ্চিত থাকেন।
লুকাস খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, অবশ্যি আপনি নিজে যদি কর্মকর্তাদের কাছে গিয়ে সবকিছু স্বীকার করেন সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু আমি আশা করছি আপনি সেটা করবেন না, আপনার যদিও ক্রুগো কম্পিউটারের জন্যে খানিকটা শান্তা আছে, আপনার জন্যে তার বিন্দুমাত্র মমতা নেই।
আমি লুকাসের খোঁচাটা হজম করে চুপ করে থাকি। লুকাস আবার বলে, কর্মকর্তাদের কাছে গিয়ে আপনার পরিচয় দেয়ার আমি কোনো কারণ দেখছি না। নৈতিক কর্তব্য বিবেচনা করে আপনি যদি আমাদের যড়যন্ত্রের কথা বলে দিতে চান, বলতে পারেন। ক্রুগো কম্পিউটারের কাছে সেটা নুতন খবর নয়, সে অনেকদিন থেকে আমাকে খুজে যাচ্ছে। গত রাতে আপনার মস্তিষ্ক স্ক্যানিং বন্ধ করিয়ে পালানোর ব্যবস্থা করার পর নীষার পক্ষে তার পুরান কাজে ফিরে যাওয়া বিপজ্জনক; সে আর সেখানে যাবে না। আপনি তাই তাকেও ধরিয়ে দিতে পারবেন না। আমি আশা করছি আপনার নিজের প্রাণের মায়ায় আপনি এ-ধরনের চেষ্টা করবেন না।
লুকাস উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনার জন্যে আমরা শহরতলিতে একটা অ্যাপার্টমেন্ট ঠিক করেছি। আজ বিকেলেই আপনি সেখানে উঠে যাবেন, এখানে থাকাটা আপনার জন্যে বিপজ্জনক। এরপর আপনি আর আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন না। আমরা অবশ্যি আপনার সাথে যোগাযোগ রাখব। আমি আশা করছি কোনোদিন আপনি ক্রুগো কম্পিউটারের সত্যিকার পরিচয় জানবেন, তখন আপনি আমাদের সাহায্য করতে রাজি হবেন।
লুকাস মাথা নেড়ে আমাকে অভিবাদন করে বের হয়ে গেল। আমি আর নীষা চুপচাপ বসে রইলাম, কোথায় জানি সুর কেটে গেছে, আর সহজ স্বাভাবিক কথা বলা যাচ্ছে না। আমি খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বললাম, তোমরা আমাকে বাঁচানোর জন্যে যা করেছ আমি তার জন্যে কৃতজ্ঞ। কিন্তু সে জন্যে আমি তো মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না।
নীষা কোনো কথা না বলে চুপ করে থাকে।
তুমি ক্ৰগো কম্পিউটার নিয়ে কিছু-একটা কথা বলতে চাইছিলে, আমি শুনতে রাজি হই নি, তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ কেন? কারণ তোমরা যাই বল, আমার পক্ষে সেটা বিশ্বাস করা সম্ভব না। আমি মানুষ, এ ব্যাপারে বিশ্বাসযোগ্য জিনিস আমি শুধু মানুষের মুখ থেকে শুনতে পারি।
নীষা আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল, তার মুখে হঠাৎ একটা আশ্চর্য হাসি ফুটে উঠেছে, আস্তে আস্তে বলল, আমি যদি বলি আমি রবোট্রন নই, আমি মানুষ?
কিন্তু তুমি জান সেটা প্রমাণ করা কত কঠিন।
নীষা আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে, জানি।
তুমি আমাকে ভুল বুঝো না, নীষা।
না, ভুল বুঝব না। সে একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে যায়।
এই সময়ে ভিকি এসে হাজির হল, কিম জুরান।
বল।
লুকাস বলেছে আপনার আইরিশ পাল্টে দিতে। আপনি আসুন আমার সাথে।
আমি আস্তে আস্তে বললাম, ব্যথা করবে না তো?
ব্যথা? সেটা কী?
আমি হাল ছেড়ে দিলাম।
গাড়ি চালাচ্ছে নীষা, আমি পাশে চুপচাপ বসে আছি। দু’ জন কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকা খুব কষ্টকর। কিন্তু কোথায় যেন সুর কেটে গেছে, চেষ্টা করেও আর কথা বলতে পারছি না। দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থাকার পর নীষা বলল, আপনার চোখে এখনো ব্যথা আছে?
না, নেই। আমি জানতাম না ব্যাপারটা কষ্টকর।
ইচ্ছে করলে চোখ অবশ করে নেয়া যায়, সাধারণত করা হয় না।
ও। দেখতে অসুবিধে হচ্ছে কি?
না। হঠাৎ করে আলো এসে পড়লে একটু অস্বস্তি হয়।
ঠিক হয়ে যাবে। নীষা আবার দীর্ঘ সময়ের জন্যে চুপ করে যায়।
গন্তব্যস্থানে পৌঁছানোর আগে নীষা আবার কথা বলে, আপনার মস্তিষ্ক স্ক্যানিংএর ডিস্কটা দেখছিলাম, আপনার মা খুব সুন্দরী মহিলা।
আমি ঠিক বুঝতে না পেরে বললাম, কিসের ডিস্ক?
আপনার মস্তিষ্ক স্ক্যানিং করার সময় আপনার স্মৃতি একটা ম্যাগনেটিক ডিস্কে জমা রাখা হয়েছিল। সেটাকে বিশেষ পদ্ধতিতে দেখা যায়। আমি খানিকটা দেখেছি, একটা দৃশ্যে ছিল আপনাকে আপনার মা ঘুম পাড়ানোর জন্যে গান গাইছেন, বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। খুব মধুর একটা দৃশ্য। আপনার মা খুব সুন্দরী মহিলা।
আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, আমার মা খুব শৈশবে মারা গেছেন, তাকে নিয়ে নিশ্চয়ই আমার স্মৃতি খুব বেশি ছিল না। যেটুকু ছিল; স্ক্যানিং করে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এখন আমার আর মায়ের কথা মনে নেই।
নীষা আস্তে আস্তে বলল, আমি খুব দুঃখিত কিম জুরান। অনেক চেষ্টা করেও আমি আপনার শৈশবের স্মৃতিটুকু রক্ষা করতে পারি নি।
তোমার দুঃখিত হবার কিছু নেই।
নীয়া অন্যমনস্ক স্বরে বলল, একজনের জীবনের সবচেয়ে মুধুর স্মৃতি তার শৈশবের, সেটা যদি হারিয়ে যায় তাহলে থাকল কী?
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। নীম্ন তাহলে সত্যিই মানুষ। রবোট্রনের কোনো শৈশব নেই, কোনো বার্ধক্য নেই। শুধু মানুষের শৈশব আছে, শুধু মানুষ জানে শৈশবের স্মৃতি খুব মধুর স্মৃতি। নীষা রবোট্রন হলে কখনো জানত না শৈশবের স্মৃতি হারিয়ে গেলে সেটা খুব কষ্টের একটা ব্যাপার।
আমি কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিলাম, ঠিক এই সময় গাড়ির ভেতরে বিবি করে একটা শব্দ হল। নীষা সুইচ টিপে কী-একটা চালু করে দিতেই লুকাসের গলা শুনতে পেলাম। লুকাস বলল, নীষা, একটা ঝামেলা হয়েছে।
কি ঝামেলা? কত বড় ঝামেলা?
অনেক বড়। চার মাত্রার।
নীষা নিঃশ্বাস বন্ধ করে বলল, চার মাত্রা?
হ্যাঁ, সাবধান। তুমি সাত নম্বরে যোগাযোগ কর। নয় নম্বরে এসো না।
আচ্ছা।
আর শোন, আট নম্বর শেষ।
নীষার মুখ রক্তশূন্য হয়ে যায়, শেষ?
হ্যাঁ।
সবাই?
হ্যাঁ। রাখলাম নীষা।
নীষা পাথরের মতো মুখ করে সুইচ টিপে ফোনটা বন্ধ করে দিল। আমি আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাকে খুব বিচলিত দেখাচ্ছে নীষা?
নীষা কষ্ট করে একটু হাসে, আমরা ধরা পড়ে গেছি কিম জুরান। আমাদের এখন অনেক বড় বিপদ।
আমার ইচ্ছে হল নীষার মাথায় হাত বুলিয়ে বলি, তোমার কোনো ভয় নেই নীষা, আমি তোমাকে রক্ষা করব। আমি জানি তুমি আমার মতো মানুষ, আমার মতো তোমার দুঃখ-কষ্ট আছে, ভয়-ভীতি আছে, আমি তোমাকে সবকিছু থেকে রক্ষা করব কিন্তু আমি কিছু বলতে পারলাম না।
গাড়িটি একটা বড় বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। নীষা আমার হাতে একটা চাবি দিয়ে বলল, আপনার অ্যাপার্টমেন্ট তেত্রিশ তলায়, রুম নাম্বার সাত শ’ এগার। আমি ভেবেছিলাম আপনাকে পৌছে দেব, প্রথম দিন একা একা অচেনা জায়গায় যেতে খুব খারাপ লাগে। কিন্তু এখন আর পারব না। আমাকে এক্ষুণি যেতে হবে।
আমি গাড়ি থেকে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করলাম, আমি তোমাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?
আমাকে?
একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, তোমাদেরকে?
নীষা ম্লান মুখে বলল, আমি ঠিক জানি না আপনি কোন ধরনের সাহায্যের কথা বলছেন, কিন্তু সম্ভবত আপনার সাহায্য করার সময় পার হয়ে গেছে।
তবু যদি আমার কিছু করার থাকে, আমাকে জানিও।
জানাব।
আমার দিকে হাত নেড়ে নীষা গাড়ি ঘুরিয়ে নেয়, তারপর চোখের পলকে সামনের রাস্তায় অদৃশ্য হয়ে যায়। আমি বিষণ্ণ মুখে দাঁড়িয়ে থাকি, অকারণে আমার মন-খারাপ হয়ে যায়।
৯. রাতের অতিথি
বিল্ডিংয়ের দরজায় একটা বুড়ো মতন মানুষ পা ছড়িয়ে বসে আছে, তার দৃষ্টি দেখলেই বোঝা যায় সে নেশাসক্ত। ঢুলুঢুলু চোখে সে আমাকে চলে যেতে দেখল, আমি লিফটের সামনে গিয়ে ঘুরে তাকিয়ে দেখি সে তখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লিফটের সুইচে হাত দিতেই সে আমাকে হাত নেড়ে ডাকল, এই যে ভদ্রলোক, এই যে—
আমি তার দিকে এগিয়ে এলাম, কি হয়েছে?
তুমি আজকের খবরের কাগজ দেখেছ?
আমার বুক ধক করে ওঠে, কী বলতে চায় এই বুড়ো? মুখের চেহারা স্বাভাবিক রেখে বললাম, কেন, কী আছে খবরের কাগজে?
বুড়োটি গলা নামিয়ে বলল, তোমার ছবি ছাপা হয়েছে। তুমি নাকি পালাতে গিয়ে পুড়ে মারা গেছ! হলুদ দাঁত বের করে সে খিকখিক করে হাসে, ভালো ঘোল খাইয়েছ তুমি ব্যাটাদের! হা হা হা।
আমি অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রাখলাম, কী সর্বনাশা ব্যাপার!
বুড়োটি ষড়যন্ত্রীদের মতো গলা নামিয়ে বলল, কাদের সাথে কাজ কর তুমি? কোকেনের দল? নাকি ভিচুরিয়াসের? আছে নাকি তোমার সাথে? দেবে একটু আমাকে?
আমি কী করব বুঝতে না পেরে চলে যাবার উদ্যোগ করতেই বুড়োটি খপ করে আমার হাত ধরে ফেলল, বলল, তুমি নিশ্চয়ই রবোটের দলের সাথে আছ, দেখে তো সেরকমই মনে হয় তুমি নিজে রবোট না তো আবার, খুব ভয় আমার রবোটকে!
আমি বুড়োর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, ঝামেলা করো না বুড়ো, আমাকে যেতে হবে।
কত দেবে আমাকে বল, নাহয় পুলিসকে খবর দিয়ে দেব, হা হা হা। ময়লা দাঁত বের করে বুড়োটি আবার হাসা শুরু করে।
পুলিসকে এখনো খবর দাও নি তুমি?
না।
আমি পকেট থেকে একটা ছোট মুদ্রা বের করে বুড়োটির দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলি, ঐ যে টেলিফোন আছে, যাও, পুলিসকে ফোন করে দাও।
বুড়োটি মুদ্রাটা ভালো করে দেখে বলল, মোটে একটা দিলে? আরেকটা দাও।
ফোন করতে একটাই লাগে।
আহা-হা-হা, রাগ করছ কেন? আমি পুলিসকে কি সত্যি বলে দেব নাকি? তোমরা রৰােটের দলের সাথে কাজ করে গো কম্পিউটারের বারটা বাজাবে, আর আমি পুলিসকে বলে দেব? আমি কি এত নিমকহারাম? ক্রুগো কম্পিউটার কী করেছে জান?
কী করেছে?
আমার চেক আটকে দিয়েছে। আমি নাকি কোনো কাজ করি না, তাই আর নাকি চেক পাঠাবে না। শালা, আমি কি তোর বাপের গোলাম নাকি?
বুড়োটি খানিকক্ষণ কুৎসিত ভাষায় ক্রুগো কম্পিউটারকে গালি দিয়ে আমার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকায়, বিড়বিড় করে বলে, নাকি তুমি কোকেনের দলে আছ? দাও না একটু কোকেন।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে লিফটের দিকে এগিয়ে যাই, বুড়ো পেছন থেকে ডাকে, কয় তলায় থাক তুমি? তোমার রুম নাম্বার কত?
তেত্রিশ তলায়, সাত শ’ বার নাম্বার রুম।
সাত শ’ বার! মিখাইলের রুম, ভালো ছিল ছেলেটা, পয়সাকড়ি দিত আমাকে, খামোকা আর্মিতে নাম লেখাল, কোনদিন গুলি খেয়ে মরবে!
বুড়ো আপনমনে বিড়বিড় করতে থাকে, আমি লিফটে করে নিজের রুমের দিকে যাই। এই নেশাসক্ত বুড়ো যদি আমাকে চিনে ফেলতে পারে, তাহলে আর কতজন আমাকে চিনবে কে জানে। আমার মনের ভেতর একটা চাপা অশান্তি এসে ভর করে।
নূতন জায়গায় ঘুমাতে দেরি হয়, আজও তাই হল। তবে অ্যাপার্টমেন্টটা খারাপ নয়, একপাশ দিয়ে দূরে বিস্তীর্ণ শহর দেখা যায়। জানালা খুলে দিলে চমক্কার বাতাস এসে শরীর জুড়িয়ে দেয়। জানালা খোলা রেখে শহরের শব্দ শুনতে শুনতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙল দরজার শব্দে, কেউ-একজন দরজা ধাক্কা দিচ্ছে।
আমি চমকে উঠে বসি, কে হতে পারে? আমি এখানে আছি খুব বেশি মানুষের জানার কথা নয়। দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি কয়েকজন মানুষ, লম্বা কালো পোশাকে সারা শরীর ঢাকা।
পুলিস! আমি চমকে উঠে ভাবলাম, বুড়ো তাহলে সত্যি পুলিসকে খবর দিয়েছে। আবার দরজায় শব্দ হল, আমি তখন আবার দরজার ফাঁক দিয়ে তাকালাম। লোকগুলোকে দেখতে কিন্তু পুলিসের মতো মনে হল না, পুলিসের চেহারায় যে অহঙ্কারী আত্মবিশ্বাসের ছাপ থাকে, এদের তা নেই। এরা ভীতচকিত, তাড়া খাওয়া পশুর মতো উদ্ভ্রান্ত এদের চেহারা। এরা নিশ্চয়ই রবোট্রন।
আমি দরজা খুলে দিতেই লোকগুলো ঠেলে ঢুকে পড়ে, পেছনে দরজা বন্ধ করে দেয়। তিনজন পুরুষ, পেছনে একজন মেয়ে। মেয়ে না বলে কিশোরী বলা উচিত, অপূর্ব। সুন্দরী মেয়েটি।
পুরুষ তিনজনের একজন এগিয়ে এসে বলে, আমি ইলেন, একজন রবোট্রন। আপনি নিশ্চয়ই কিম জুরান। আপনার সাথে করমর্দন করতে পারছি না, আমার হাত দুটি একটু আগে উড়ে গেছে। লোকটি কালো পোশাকের ভেতর থেকে তার বিধ্বস্ত দু’টি হাত বের করে, সেখান থেকে স্টেনলেস স্টীলের কিছু যন্ত্রপাতি,কিছু তার, কিছু পোড়া প্লাস্টিক ঝুলে আছে।
অন্যেরা পোশাক খুলতেই দেখতে পাই তাদের সারা শরীর বড় বড় বিস্ফোরণে ক্ষতবিক্ষত। মানুষ হলে এদের একজনও বেঁচে থাকত না।
কমবয়সী দেখতে একজন বলল, আমরা দুঃখিত এত রাতে আপনাকে এভাবে বিরক্ত করার জন্যে। কিন্তু আমাদের এখন খুব বিপদ, একটা নিরাপদ আশ্রয়ের খুব দরকার। নীষা বলেছে এখানে আসতে।
আমি বললাম, এত বড় বিপদের সময় আমাকে বিরক্ত করা না-করা নিয়ে ব্যস্ত হবেন না। আমি কি কিছু করতে পারি?
আমাদের আশ্রয় দিয়েই আপনি অনেক কিছু করেছেন। আপনার আপত্তি না থাকলে আমরা এখন নিজেদের একটু ঠিকঠাক করে নিই।
হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।
রবোর্টুন গুলো টেবিলে নিজেদের টুকটাক যন্ত্রপাতি রেখে একজন আরেকজনের উপর ঝুঁকে পড়ে। শুধুমাত্র কিশোরী মেয়েটি একটা চেয়ারে নিজের হাতে মাথা রেখে বসে থাকে, মুখে কী গাঢ় বিষাদের ছায়া! মেয়েটি মানুষ নয়; যন্ত্র, কিন্তু তার মুখের গাঢ় বিষাদ আমাকে স্পর্শ করে, আমি বুকের ভেতর একটা যন্ত্রণা অনুভব করতে থাকি।
মেয়েটি হঠাৎ সোজা হয়ে বসে আমাকে জিজ্ঞেস করে, আপনি কি মানুষ?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ।
আমার খুব মানুষ হতে ইচ্ছা করে।
কেন?
তাহলে এরকম পশুর মতো পালিয়ে বেড়াতে হত না।
আমি বললাম, আমি মানুষ, আমিও কিন্তু তোমাদের মতো পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
সত্যি?
হ্যাঁ।
কেন?
ইলেন নামের মধ্যবয়স্ক লোকটি বলল, সু, কাউকে তার ব্যক্তিগত কথা জিজ্ঞেস করতে হয় না।
সু নামের মেয়েটি উদ্ধত গলায় বলল, কী হয় জিজ্ঞেস করলে? আমরা তো সব মারাই যাব, এখন এত নিয়ম-কানুন মানার দরকার কি?
ইলেন কঠোর গলায় বলল, কে বলেছে আমরা সবাই মারা যাব?
আমি জানি আমরা সবাই মারা যাব। মেয়েটি রুদ্ধ গলায় বলল, ইউরীর দলের সবাই মারা গেল না? রুটেকের দল ধরা পড়েছে, তারা কি এখন বেঁচে আছে? আমরা চারজন কোনোমতে পালিয়ে এসেছি। সুরা গেছে, কিরি গেছে, পল, টেরী আর লিমার কী খবর কে জানে! লুকাসের খবর কি এতক্ষণে জেনে যায় নি ক্রুগো কম্পিউটার? আর কে বাকি থাকল?
ইলেন এগিয়ে এসে কাটা হাত দিয়ে সুয়ের কাধ স্পর্শ করে বলল, আমরা আমাদের মিশনের শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি সু। আর কয়েক ঘন্টা, তারপর আবার আমরা আমাদের আগের জীবন ফিরে পাব। আমাদের আর পালিয়ে বেড়াতে হবে না, রাতের অন্ধকারে রাস্তায় রাস্তায় ছুটতে হবে না। আবার আমরা মানুষের পাশাপাশি মানুষের বন্ধু হয়ে বেঁচে থাকতে পারব।
মেয়েটি কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল, তুমি শুধু শুধু আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছ। তুমি জান আমরা আসলে হেরে গেছি, আমরা ধরা পড়ে গেছি, আমরা আর কখনো গো কম্পিউটারকে পাল্টাতে পারব না, কখনো না, কখনো না—
ইলেন কাটা হাতটি মেয়েটির মাথায় রেখে বলল, এত আবেগপ্রবণ হলে চলে না সু, আমার কথা বিশ্বাস কর।
আমি সব জানি। যে-মানুষটার আমাদের ক্রুগো কম্পিউটারের গোপন সংখ্যা বের করে দেয়ার কথা ছিল, সে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, সে আমাদের সাহায্য করবে না।
তাতে কী আছে, ইলেন তাকে সান্ত্বনা দেয়, গোপন সংখ্যা না জানলে কি আর ক্রুগো কম্পিউটারকে আঘাত করা যায় না? আমরা বাইরে থেকে পুরো কম্পিউটার উড়িয়ে দেব–
আমি দু জনকে নিরিবিলি কথা বলতে দিয়ে ঘরের অন্যপাশে চলে এলাম। সেখানে কমবয়স্ক একজন রবোট্রন হাতে কী—একটা জিনিস লাগাচ্ছিল। আমি বললাম, তোমাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করতে পারি?
হ্যাঁ, অবশ্যি।
তোমাদের স্বাধীন জীবনের সাথে ক্রুগো কম্পিউটারের একটা সম্পর্ক আছে, সম্পর্কটা কী, বলবে আমাকে?
হ্যাঁ, বলব না কেন! আপনি তো আমাদেরই লোক। ক্রুগো কম্পিউটার যে ধীরে ধীরে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছে সেটা সবাই জানে, কিন্তু ঠিক ভেতরের খবর খুব বেশি মানুষ জানে না। রবোট্রন তরুণটি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমাদের পৃথিবী শাসন করা হয় কেমন করে জানেন?
জানি। ক্রুগো কম্পিউটার যাবতীয় তথ্যাদি সংরক্ষণ করে, প্রয়োজনে সে তথ্য সরবরাহ করে সবোচ্চ কাউন্সিলকে। সবোচ্চ কাউন্সিলের সদস্যরা যখন প্রয়োজন হয়। সিদ্ধান্ত নেন।
চমৎকার! সর্বোচ্চ কাউন্সিলের সদস্য কত জন জানেন?
দশজন।
তাদের সম্পর্কে কিছু জানেন?
কিছু কিছু জানি। তাঁদের বেশিরভাগই বিজ্ঞানী। দু’ জন অর্থনীতিবিদ, দু’ জন দার্শনিক। একজন চিত্রশিল্পীও আছেন বলে শুনেছি। সবাই বয়স্ক, পঞ্চাশের উপর বয়স।
তারা কি মানুষ, না রবোট?
মানুষ। মানুষ ছাড়া আর কেউ সর্বোচ্চ কাউন্সিলের সদস্য হতে পারে না।
তারা কী রকম মানুষ?
খুব চমৎকার মানুষ। আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, একজনকে আমি সামনাসামনি দেখেছিলাম, নাম ক্রিকি। পঞ্চম দাবা কনফারেন্সে প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন। বক্তৃতা দিতে দাড়িয়ে নিউক্লিয়ার পাওয়ারের উপর কথা বলতে শুরু করলেন। একজন কর্মকর্তা তখন তার কানে কানে কী-একটা কথা বললেন, আর ক্রিকি তখন লজ্জায় টমেটোর মতো লাল হয়ে গেলেন। আমতা-আমতা করে বললেন, কী সাংঘাতিক ভুল হয়ে গেছে, আমি ভেবেছিলাম এটা নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারদের কনভেনশন। আমি এখন কী করি, দাবা সম্পর্কে আমি যে কিছুই জানি না! সে এক ভারি মজার দৃশ্য!
তরুণ রবোট্রনটি বলল, তারপর কী হল?
আমরা যারা দর্শক তারা হো-হো করে হেসে উঠলাম, তাই দেখে ক্রিকিও। হাসতে শুরু করলেন। তারপর হাসি থামিয়ে বললেন, আমার দশ মিনিট কথা বলার কথা। এখনো সাত মিনিট আছে। যেহেতু আমি দাবা সম্পর্কে কিছুই জানি না, এই সাত মিনিট আমি ছড়া আবৃত্তি করে শোনাব। নিজের লেখা ছড়া। এরপর ক্রিকি ছড়া আবৃত্তি করতে শুরু করলেন।
কেমন ছিল ছড়াগুলো?
একটা দু’টা হাসির ছিল, কিন্তু বেশিরভাগই একেবারে ছেলেমানুষি। এরকম একজন আপনভোলা মানুষ যে সর্বোচ্চ কাউন্সিলের সদস্য, ভাবা যায় না।
তরুণ রবোট্রনটি হঠাৎ তীব্র চোখে আমার দিকে তাকাল, বলল, আপনি সত্যি তাই মনে করেন?
আমি খানিকক্ষণ ভেবে বললাম, আমি দুঃখিত। কথাটি আমি ভেবে বলি নি।
আসলে ক্রুগো কম্পিউটার যদি যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণের ভার নিয়ে নেয়, তখন সিদ্ধান্ত নেবার জন্য কোনো অসাধারণ মানূষের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন খাঁটি মানুষের–
তরুণ রবোনটি আমার কথাটি লুফে নেয়, হ্যাঁ, প্রয়োজন খাঁটি মানুষের। যে হৃদয়বান, যে অনুভূণি। তাই সর্বোচ্চ কাউন্সিলের সদস্যদের সব সময়ে মানুষ হতে হয়, কোনো রটে তার সদস্য হতে পারে না। আমরা রবোট, আমরা আমাদের সমস্যা জানি। আমাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে যে আমাদের অনুভূতির একটা সীমা আছে, মানুষের অনুভূতির কোনো সীমা নেই। সত্যিকার মানুষের ধারেকাছে আমরা যেতে পারি না। তাই আমাদের সাথে মানুষের কোনো বিরোধ নেই, থাকতে পারে না।
তরুণটি একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সর্বোচ্চ কাউন্সিলের সদস্যরা যতদিন মানুষ ছিলেন, ততদিন তাঁরা আমাদের মানুষের পাশাপাশি থাকতে দিয়েছিলেন, বন্ধুর মতো।
আমি চমকে উঠে বললাম, মানে? সর্বোচ্চ কাউন্সিলের সদস্যরা এখন কে?
এখন কেউ নেই। ক্রুগো কম্পিউটার একে একে সবাইকে সরিয়ে দিয়েছে, কাউন্সিলের সদস্যদের গত দশ বছরে একবারও প্রকাশ্যে দেখা যায় নি। এখন দেশের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে ক্রুগো কম্পিউটার। আগে ক্রুগো কম্পিউটার কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারত না, তার সে ক্ষমতা ছিল না। সিদ্ধান্ত নিত সর্বোচ্চ কাউন্সিলের সদস্যরা। এখন সে নেয়, বাইরের লোকজন জানে না। যেখানে বিশাল এক ক্ষমতাশালী কম্পিউটার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে, বাইরের লোকের পক্ষে সেখানে কিছু জানা। সম্ভবও নয়।
কী ভয়ানক! আমার বিশ্বাস হতে চায় না, কী সর্বনাশ!
হ্যাঁ। আমরা রবোটেরা এবং অল্প কিছু মানুষ মিলে চেষ্টা করেছিলাম ক্রুগো কম্পিউটারের ভেতরে প্রবেশ করে অবস্থার পরিবর্তন করতে। খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলাম আমরা। একজন মানুষের ক্রুগো কম্পিউটারের গোপন সংকেত বের করায় সাহায্য করার কথা ছিল, সেই মানুষটি রাজি হয় নি। সেটা নিয়ে একটা ঝামেলা হয়েছে, তার ভেতরে ক্রুগো কম্পিউটার ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে একেবারে উঠেপড়ে লেগেছে। আজ হঠাৎ করে আমাদের কয়েকটা দল ধরা পড়ে গেছে। আমাদের উপরেও একেবারে সাংঘাতিকভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, কোনোভাবে বেঁচে এসেছি। আমাদের অবস্থা বেশ শোচনীয়, সামলে উঠতে পারব কিনা বোঝা যাচ্ছে না।
আমি কী-একটা বলতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় দরজায় আবার শব্দ হল।
মুহূর্তে ঘরে নীরবতা নেমে আসে, চোখের পলকে সবার হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র বের হয়ে আসে। কিশোরী মেয়েটি বিদ্যুৎগতিতে জানালার পাশে এগিয়ে যায়, নাইলনের দড়ি ঝুলিয়ে দেয় জানালা থেকে।
দরজায় আবার শব্দ হল, দ্বিধান্বিত শব্দ।
ইলেন আমাকে ইঙ্গিত করে দরজা খুলে দিতে। আমি দরজা ফাঁক করে উঁকি দিলাম, নেশাসক্ত বৃদ্ধটি উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আমি দরজা খুলতেই সে বিড়বিড় করে বলল, পুলিস এসেছে।
পুলিস?
হ্যাঁ, একটা একটা করে রুম সার্চ করছে।
সত্যি?
হ্যাঁ, অনেক পুলিস, অনেক বড় বড় অস্ত্র। ভাবলাম তোমাকে বলে দিই। কথা বলতে বলতে সে ঘরে উঁকি দিয়ে সবাইকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে দেখে একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে যায়। শুকনো গলায় বলল,সর্বনাশ! এরা কারা? রবোট নাকি?
আমি কিছু বলার আগেই সে পিছিয়ে যায়, তারপর প্রাণপণে দৌড়াতে থাকে। রবোটকে তার ভারি ভয়।
আমি ঘরে এসে কিছু বলার আগেই সবাই বের হয়ে এল, তারা আমাদের কথাবার্তা শুনেছে। সময় বেশি নেই, সেটা বুঝতে কারো বাকি নেই। ইলেন চাপা গলায় বলল, লিফট দিয়ে নেমে যাও। দোতলায় থামবে, সেখান থেকে লাফিয়ে বের হতে হবে। পুলিসকে দেখামাত্র আক্রমণ করবে, তারা সম্ভবত আমাদের আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত নেই।
ইলেন ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের আশ্রয় দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ। বিদায়।
আমি বললাম, আমি আপনাদের সাথে যাব।
তার প্রয়োজন নেই, পুলিস কখনো জানবে না আমরা আপনার এখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম।
সে জন্যে নয়। কী জন্যে? আপনি নিশ্চয়ই জানেন মানুষের নিরাপত্তা আমরা দিতে পারি না।
আমি হচ্ছি সেই মানুষটি, যার ক্রুগো কম্পিউটারের গোপন সংকেত বের করে দেয়ার কথা ছিল।
ওরা চমকে আমার দিকে তাকায়।
আমি গলার স্বর শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললাম, আমি আগে রাজি হই নি, কারণ আমি সবকিছু জানতাম না। এখন জেনেছি, তাই মত পাল্টেছি। আপনারা রাজি থাকলে আমি আপনাদের সাহায্য করতে রাজি আছি।
সু নামের কিশোরী মেয়েটি ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। ইলেন তার ভাঙা হাত দিয়ে সুকে স্পর্শ করে বলল, সু, এখন ঠিক সময় নয়। কিম জুরানকে ছেড়ে দাও, আমাদের সাথে যেতে হলে তাঁর হয়তো কোনো ধরনের প্রস্তুতি দরকার।
আমি প্রস্তুত আছি,সময় নষ্ট করে লাভ নেই।
ইলেন মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, আপনাকে যে কী বলে কৃতজ্ঞতা জানাব বুঝতে পারছি না।
আমি বললাম, তার প্রয়োজন হবে না। আমিও একাধিক ব্যাপারে আপনাদের কাছে ঋণী আছি, ঠিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি নি।
ইলেন বলল, চল, রওনা দিই। তোমরা নিশ্চয়ই জান, যে-কোনো মূল্যে কিম জুরানকে রক্ষা করতে হবে।
ছোট দলটি দ্রুতপায়ে এগোতে থাকে, তখন আমি দেখতে পাই বৃদ্ধ লোকটি করিডোরের শেষ মাথায় অতঙ্কিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। কৌতূহলের জন্যে সে ঠিক চলে যেতে পারছে না, আমাকে দেখে সে দ্রুতপায়ে আমার দিকে দৌড়ে আসে, ফিসফিস করে বলে, তোমরা কি লিফট দিয়ে নামবে?
হ্যাঁ।
আরো একটা গোপন পথ আছে, ইলেকট্রিক লাইন নেয়ার একটা টানেল, সেদিক দিয়ে নেমে যাও। সেখানে সিড়ি নেই, কিন্তু রবোটের কি সিঁড়ি লাগে?
আমি ইলেনকে বুড়োর গোপন পথের কথা বলতেই তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ছুটে এসে জিজ্ঞেস করল, কোথায়?
বুড়ো আমাদের নিয়ে যায়। লিফটের পাশেই একটা বন্ধ দরজা। একজন লাথি দিতেই সেটা খুলে গেল। নানা আকারের অসংখ্য ইলেকট্রিক তার সেদিক দিয়ে নেমে গেছে।
চমৎকার। দেরি নয়, নেমে যাও। কেউ-একজন আমাকে ধর, ইলেন চাপাস্বরে বলল, হাত না থাকায় একেবারে অকেজো হয়ে গেছি। কিম জুরানকে কে নিয়ে যাবে?
সু হাসিমুখে এগিয়ে আসে, আমি, আসুন কিম জুরান।
বুড়োটি আমার কনুই খামচে ধরে, ফিসফিস করে বলল, এরা সবাই রবোট?
হাঁ।
এই মেয়েটিও?
হ্যাঁ।
একটু ছুঁয়ে দেখি? দেখব গো মেয়ে?
সু খিলখিল করে হেসে উঠে হাত বাড়িয়ে দেয়, দেখ বুড়ো।
বুড়োটি ভয়ে ভয়ে তাকে একবার স্পর্শ করে। কনুইয়ে হাত বুলিয়ে সে একটা চিমটি কেটে বলল,ব্যথা পাও?
সু হাসি আটকে বলল, নাহ! ব্যথা পাব কেন?
আশ্চর্য! বুড়ো চোখ কপালে তুলে বলল, মোটেও ব্যথা পায় না। হঠাৎ সে গলা নামিয়ে ফেলল, তাড়াতাড়ি চলে যাও তোমরা। দেরি না হয়ে যায় আবার!
আমি পকেটে হাত ঢুকিয়ে কিছু মুদ্রা বের করে এনে তার হতে গুজে দিয়ে বললাম, বেশি নেই এখানে।
বুড়ো হলুদ দাঁত বের করে হেসে বলে, আমি এখানেই থাকি। পরে এসে দিয়ে যেও। যত ইচ্ছা!
১০. আঘাত
আমি একটা ছোট টার্মিনালের সামনে বসে আছি। আমার ডান পাশে বসেছে লুকাস, পেছনে দাঁড়িয়ে আছে নীষা। আমাকে ঘিরে আরো কয়েকজন রবোট্রন দাঁড়িয়ে, নানা আকারের, নানা বয়সের। বয়সটা যদিও বাইরের ব্যাপার, কিন্তু অনেক যত্নে এদের বয়সের তারতম্য দেখানো হয়। এই টার্মিনালটি ক্রুগো কম্পিউটারের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে। এটি কোনো অসাধারণ ব্যাপার নয়, সব মিলিয়ে লক্ষাধিক টার্মিনাল সরাসরি ক্রুগো কম্পিউটারের সাথে সংবাদ আদান-প্রদান করে।
আমি টার্মিনালে লিখলাম, ক্রুগো কম্পিউটার, তোমার গোপন সংকেতের প্রথম সংখ্যাটি হচ্ছে শূন্য।
ক্রুগো কম্পিউটার উত্তর দিল, আমার গোপন সংকেত জানার অধিকার আপনার নেই।
আমি লুকাসকে জিজ্ঞেস করলাম, কতক্ষণ সময় লাগল উত্তর দিতে?
তেরো পিকো সেকেন্ড।
আরো ভালো করে দেখ। প্রত্যেকটা শব্দের পেছনে সময়টা জানতে হবে।
টার্মিনালটি পুরান, এর থেকে ভালো করে সম্ভব না। দাঁড়ান ব্যবস্থা করছি।
সে মুহূর্তে টার্মিনালটি খুলে, ভেতর থেকে কয়েকটা তার বের করে এনে হাত দিয়ে ধরে রেখে বলল, আবার চেষ্টা করুন।
আমি আবার লিখলাম, ক্রুগো কম্পিউটার, তোমার গোপন সংকেতের প্রথম সংখাঁটি হচ্ছে শূন্য।
ক্রুগো কম্পিউটার উত্তর দিল, আমার গোপন সংকেত জানার অধিকার আপনার নেই।
আমি লুকাসের দিকে তাকালাম, কতক্ষণ লাগল?
লুকাস ভুরু কুঁচকে বলল, আট দশমিক নয় সাত পিকো সেকেণ্ড। শব্দগুলোর মাঝে সময় লেগেছে দুই থেকে তিন পিকো সেকেণ্ডের ভেতরে। আমি দশমিকের পর আট ঘর পর্যন্ত মাপতে পেরেছি। শুনতে চান?
না। তুমি মনে রেখো। আমি এখন একটি-একটি করে সংখ্যা লিখব। ঠিক যখন সত্যিকার সংখ্যাটি লিখব ক্রুগো কম্পিউটার তার নিরাপত্তার প্রোগ্রামটি একবার দেখে নেবে, কাজেই সময়ের খানিকটা তারতম্য হবে। তুমি দেখ কখন তারতম্যটি হয়।
লুকাস হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, এত সহজ?
হ্যাঁ। আমি একবার বের করে মৃত্যুদণ্ড পেয়েছিলাম, কাজেই আমি জানি এটা কাজ করে।
আমরা এদিকে সবচেয়ে জটিল কম্পিউটারে সবচেয়ে জটিল প্রোগ্রাম বসিয়ে দিনরাত চেষ্টা করে যাচ্ছি—
নীষা বাধা দিয়ে বলল, লুকাস, সময় বেশি নেই। আমাদের এই জায়গা ছেড়ে চলে যেতে হবে কিছুক্ষণের মাঝে।
হা, ঠিক বলেছ। কিম জুরান, শুরু করুন।
আমি আবার লিখলাম, ক্রুগো কম্পিউটার, তোমার গোপন সংকেতের প্রথম সংখ্যাটি হচ্ছে এক।
ক্রুগো কম্পিউটার আবার উত্তর দিল, আমার গোপন সংকেত জানার অধিকার আপনার নেই।
লুকাস মাথা নেড়ে বলল, না, এটা ঠিক আগের মতো। এটা নয়।
আমি দুই, তিন, চার চেষ্টা করে যখন পাঁচ লিখলাম, লুকাসের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। বলল, হ্যাঁ, উত্তর দিতে পিকো সেকেণ্ডের লক্ষ ভাগের তিন ভাগ দেরি হল। শব্দগুলো এসেছে একটু অন্যরকমভাবে। তার মানে প্রথম সংখ্যাটি হচ্ছে পাঁচ। চমৎকার।
আমি বললাম, আমি মানুষ, কাজেই আমার লিখতে অনেক দেরি হয়, তোমরা কেউ কর, অনেক তাড়াতাড়ি হবে। বুঝতে পারছ, জিনিসটা খুব সহজ।
এই সময়ে সু এসে ঢুকে বলল, পুলিস আর মিলিটারি আমাদের ঘিরে ফেলতে আসছে। আমাদের এখনি পালাতে হবে।
লুকাসকে বেশি বিচলিত দেখা গেল না। শান্ত গলায় বলল, আমাকে মিনিটখানেক সময় দাও। গোপন সংকেতটা বের করে নিই। আর সবাই বাইরে গিয়ে গাড়িতে অপেক্ষা কর।
আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি লুকাসের আঙুল বিদ্যুৎগতিতে টার্মিনালের উপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে, যে-জিনিসটা বের করতে আমার প্রায় এক সপ্তাহের মতো সময় লেগেছিল, লুকাস সেটা শেষ করল ছেচল্লিশ সেকেণ্ডের মাথায়। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলুন এবারে পালাই।
আমরা ছুটে বের হয়ে আসি। দুটি গাড়িতে সবাই গাদাগাদি করে বসেছে। লুকাস হালকা স্বরে বলল, মনে রেখো আমাদের সাথে দু’ জন মানুষ রয়েছে, কিম জুরান আর নীষা। তাদেরকে সাবধানে রেখো। জানই তো তাদের শরীরের ডিজাইন বেশি সুবিধের নয়, একটা বুলেট বেকায়দা লাগলেই তারা শেষ হয়ে যায়।
হাসতে হাসতে কয়েকটা রবোট্রন সরে গিয়ে আমাকে জায়গা করে দেয়। আমি নীষার পাশে গিয়ে বসি, সাথে সাথে গাড়ি দু’টি একপাক ঘুরে গুলির মতো বেরিয়ে যায়।
আমি অনুভব করলাম, নীষা আমার হাতে হাত রেখে আস্তে একটা চাপ দিল।
রক্তমাংসের মানুষ। আমি এখন নিশ্চিতভাবে জানি।
ছোট একটা ঘরে প্রায় কুড়ি-পঁচিশ জন মানুষ এবং রবোট বসে আছে, মানুষ বলতে অবশ্যি দু’ জন, আমি আর নীষা। ঘরটিতে আবছা অন্ধকার, সামনে টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে লুকাস। আপাতত লুকাস কথা বলছে, অন্যেরা শ্রোতা। সে টেবিলে আঙুল দিয়ে টোকা দিতে দিতে বলল, তোমরা সবাই জান অনেকগুলো কারণে আমরা আমাদের পরিকল্পনা অনেক এগিয়ে এনেছি। ক্ৰগো কম্পিউটারের উপর আরো মাসখানেক পরে যে-আঘাত হানার কথা ছিল, সেটা হানা হবে আজ রাতে। তার গোপন সংকেত বের করে আনা হয়েছে। বের করতে সময় লেগেছে ছেচল্লিশ সেকেণ্ড।
বিস্ময়ের একটা মৃদু গুঞ্জন উঠে থেমে যায়। এক জন হাত তুলে জিজ্ঞেস করে, কী করে বের করলে এত তাড়াতাড়ি?
কিম জুরানের একটা সহজ উপায় আছে, এটা বের করে তিনি একবার মৃত্যুদণ্ড পেয়েছিলেন। যারা এখনো কিম জুরানকে চেন না, তাদের জন্যে বলছি, নীষার পাশে ধূসর কাপড় পরে যে মধ্যবয়স্ক লোকটি বসে আছেন, তিনি কিম জুরান।
সবাই আমার দিকে ঘুরে তাকাল এবং অস্বস্তিতে আমার কান লাল হয়ে উঠল।
সৌভাগ্যক্রমে লুকাস আবার কথা শুরু করে, কিম জুরানের পদ্ধতিটি অত্যন্ত সহজ, কিন্তু আমি এখন সেটা ব্যাখ্যা করছি না, কারণ আমাদের হাতে সময় খুব কম। আমাদের আজ রাতের পরিকল্পনা খুব সহজ। পরিকল্পনাটাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়, হার্ডওয়ার আক্রমণ এবং সফটওয়ার আক্রমণ। অন্যভাবে বলা যায়, সরাসরি ক্রুগো কম্পিউটারকে বাইরে থেকে আক্রমণ করা এবং কম্পিউটার প্রোগ্রাম দিয়ে ভেতর থেকে আক্রমণ করা। দু’টি আক্রমণই সমান গুরুত্বপূর্ণ এবং একটি ছাড়া অন্যটি সফল হতে পারবে না।
সরাসরি আক্রমণটি আসলে একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ছাড়া আর কিছু নয়। আমি এটার নেতৃত্ব দেব। আমার দরকার প্রায় পনের জন দক্ষ রবোর্টুন, যারা সামরিক পি-৪৩ ট্রেনিং পেয়েছে। কতজন আছ তোমরা হাত তোল।
রবোট্রনেরা হাত তোলে এবং গুনে দেখা যায় তাদের সংখ্যা বারজন।
লুকাস একটু চিন্তিতভাবে বলে, একটু কম হয়ে গেল, কিন্তু কিছু করার নেই। আজ সারাদিনে আমরা যাদের হারিয়েছি তারা থাকলে কোনো কথা ছিল না। যাই হোক, আরো তিনজন রবোট্রন দুরকার, বিজ্ঞানী ইঞ্জিনিয়ার কিংবা গণিতবিদ হলে ভালো হয়। কারা যেতে চাও হাত তোল।
প্রায় গোটা সাতেক হাত ওঠেলুকাস তাদের মাঝে থেকে সুসহ আরো দু’ জনকে বেছে নেয়।
সু জিজ্ঞেস করে, আমাদের কী করতে হবে?
যুদ্ধ।
কিন্তু কীভাবে?
সেটা আমি বলে দেব। মোটামুটি জেনে রাখ, ক্রুগোর একটা ভবন আছে শহরের দক্ষিণ দিকে, সেখানে সরাসরি আক্রমণ করে ঢুকে যেতে হবে। ভবনের ভেতরে ক্রুগোর মূল ইলেকট্রনিক্স রয়েছে। সেটা অত্যন্ত সুরক্ষিত, পারমাণবিক বিস্ফোরণ ছাড়া ধ্বংস করা সম্ভব নয়। তার দরজা খোলার জন্যে আমাদের ক্রুগোর গোপন সংকেতের প্রয়োজন ছিল।
যাই হোক, আমরা যখন ভবনের মূল অংশের দরজা পর্যন্ত যাব, তখন যেন দরজা খোলা থাকে। সেই দায়িত্ব নিতে হবে দ্বিতীয় দলটির। এর নেতৃত্ব দেবে ইলেন।
ইলেন আপত্তি করে বলল, আমার দুটি হাতই উড়ে গেছে, এখনো সারানোর সময় পাই নি। আমাকে ঠিক নেতৃত্বে না রেখে সাহায্যকারী হিসেবে রাখ।
লুকাস মাথা নাড়ে, না। আমি এমন একজনকে দায়িত্ব দিতে চাই, যার অভিজ্ঞতা সব থেকে বেশি। আর তোমার হাত ব্যবহার করতে হবে না, কপোট্রনের সাথে সরাসরি টার্মিনালের যোগাযোগ করে দেয়া হবে।
বেশ, তাই যদি তোমার ইচ্ছে।
তোমার দলের দায়িত্ব সময়মতো ক্রুগো কম্পিউটারকে বাধ্য করা যেন সে দরজা খুলে দেয়। কতজন রবোট্রন দরকার?
যত বেশি হয় তত ভালো।
কিন্তু কিছু রবোট্রনকে পাহারায় রাখতে হবে। যখন তুমি তোমার দলকে নিয়ে ক্রুগো কম্পিউটারকে বাধ্য করার চেষ্টা করতে থাকবে, তখন ক্রুগো কম্পিউটার সেনাবাহিনী, পুলিস আর নিরাপত্তাবাহিনীর লোকজন পাঠাবে এখানে, তাদের আটকে রাখতে হবে কিছুক্ষণ।
তা ঠিক।
খানিকক্ষণ আলোচনা করে লুকাস দায়িত্ব ভাগ করে দেয়। বাকি এগারজন রোট্রনের ভেতর চারজন পাহারা দেবে, আর সাতজন ক্রুগো কম্পিউটারের মূল প্রোগ্রামকে পরিবর্তন করে তাকে বাধ্য করবে ঠিক সময়ে দরজা খোলার জন্যে।
আলোচনার শেষের দিকে নীয়া হাত তুলে কথা বলার অনুমতি চায়। আমি যেজিনিসটা জানতে চাইছিলাম, নীষা ঠিক সেটাই জিজ্ঞেস করে, এ ব্যাপারে, আমাদের, মানুষদের কিছু করার আছে?
লুকাস হেসে বলল, না, নেই। তোমাদের যুদ্ধে পাঠানো যাবে না, কারণ কোনোভাবে একটা বুলেট এসে লাগলেই তোমরা শেষ। তোমাদের মস্তিষ্কে কোনো কপোট্রন নেই, তোমরা ডিজিটাল কম্পিউটারের মতো কাজ কর না, কাজেই তোমাদেরকে ক্রুগো কম্পিউটারের প্রোগ্রাম পরিবর্তনেও ব্যবহার করা যাবে না!
নীষা হাত নেড়ে বলল, তার মানে আমরা চুপচাপ বসে থাকব? আমাদের কোনো কাজ নেই?
আপাতত নেই। আমাদের কাজ শেষ হবার পর তোমাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। যেমন, মানুষের উদ্দেশে প্রথম ভাষণটা তোমাদের দিতে হবে। পৃথিবীর মানুষ এত বড় একটা ঘটনার বর্ণনা আরেকজন মানুষের কাছ থেকে না শুনলে ভরসা পাবে না।
আমি বললাম, ক্রুগো কম্পিউটারের মূল ইলেকট্রনিক্স ভবনে ঢোকার পর তোমরা নিশ্চয়ই তার গুরুত্বপূর্ণ মাইক্রো প্রসেসর এবং মেক্রো প্রসেসরগুলো তুলে ফেলার পরিকল্পনা করছ?
হ্যাঁ।
সেটা কি তোমরাই করবে? সেখানে একজন মানুষ পাঠানো কি বুদ্ধিমানের কাজ নয়?
লুকাস মাথা নেড়ে বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন। আমরা ইলেকট্রনিক সিগনাল দিয়ে চলাফেরা করি, বাইরে থেকে ইলেকট্রনিক সিগনাল দিয়ে ক্রুগো কম্পিউটার ইচ্ছা করলেই আমাদের সার্কিট জ্যাম করে দিতে পারে।
তাহলে?
আমরা যখন মূল ভবনে ঢুকব তখন আমাদের খুব ভালো করে শিল্ডিং করে নিতে হবে। আমরা সে জন্যে খুব ভাল শিল্ডিং জোগাড় করেছি। তার একটিমাত্র সমস্যা, সেটি অত্যন্ত ভারি একটা ফ্যারাডে কেজ, কাজেই সেটা পরে চলাফেরা করা কঠিন। আমাদের কাজের ক্ষমতা অনেক কমে যাবে তখন।
তাহলে একজন মানুষকে পাঠাচ্ছ না কেন?
কারণ দু’টি। প্রথমত, আমাদের সেরকম কোনো মানুষ নেই। দ্বিতীয়ত, আমাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ করে ক্রুগোর ভবনে ঢুকতে হবে, কোনো মানুষ সেই যুদ্ধে টিকে থাকতে পারবে না।
মানুষের যুদ্ধে অংশ নেবার প্রয়োজন নেই। যুদ্ধ শেষ হলে সে যাবে।
যুদ্ধ পুরোপুরি কখনোই শেষ হবে না, গোলাগুলি শেষ পর্যন্ত চলবে। মানুষকে তার ভেতর দিয়ে নেয়া প্রচণ্ড বিপদের কাজ। কোনো মানুষের জীবন নিয়ে আমরা এত বড় ঝুঁকি নিতে পারি না।
কেউ যদি স্বেচ্ছায় যেতে চায়?
লুকাস একটু হেসে বলে, কে যাবে?
আমি।
সে কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে, না কিম জুরান। আপনার জীবনের উপর দিয়ে অনেক ঝড়-ঝাপটা গিয়েছে, এখন আপনি একটু বিশ্রাম নিন।
তোমরা রাজি না হলে আমি যেতে পারব না, কিন্তু লুকাস, আমি সত্যিই যেতে চাই। তোমরা যদি চেষ্টা কর, আমি মনে করি আমার বেঁচে থাকার চমঙ্কার সম্ভাবনা আছে।
কে-একজন বলল, শতকরা চল্লিশ দশমিক তিন দুই!
আমি তার কথা লুফে নিয়ে বললাম, এর থেকে কম সম্ভাবনায় থেকেও আমি অনেকবার বেঁচে এসেছি। ভেবে দেখ লুকাস।
লুকাস কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, বেশ কিম জুরান। আমি রাজি।
রবোট্রনের ক্ষুদ্র দলটি একটা হর্যোধ্বনি করে ওঠে। সবাই শান্ত হয়ে যাবার পর নীষা লুকাসকে লক্ষ্য করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, লুকাস তার আগেই তাকে বাধা দিয়ে বলল, না নীষা, তা সম্ভব নয়।
আমি কী বলতে চাইছি তুমি শুনবে তো আগে।
আমি জানি তুমি কী বলবে।
কী বলব?
তুমিও আমাদের সাথে যেতে চাইবে। কিন্তু তা হয় না নীষা, আমাদের দলের অন্তত একজন মানুষকে যে-কোনো অবস্থায় বেঁচে থাকতে হবে। আমি তোমাদের দু’ জনের জীবন নিয়েই ঝুঁকি নিতে পারি না। তুমি জান আজ সারাদিনে আমাদের উপর ক্রুগো কম্পিউটার যেসব আঘাত হেনেছে, তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মানুষেরা। এখন তোমরা দু জন ছাড়া আমাদের দলে আর কোনো মানুষ নেই।
নীষা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে যায়। লুকাস অন্য সবার দিকে তাকিয়ে বলল, কারো কোনো প্রশ্ন আছে?
সু হাত তুলে বলল, আমরা যদি ব্যর্থ হই?
লুকাসের চোখ একবার ধক করে জ্বলে উঠল, সুয়ের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, আমরা ব্যর্থ হব না।
শহরতলিতে জুগো কম্পিউটারের যে বড় ভবনটি আছে, আমি লুকাসের দলের পনের জনের সাথে সেখানে অপেক্ষা করছি। ছোট ছোট গাড়িতে ভিন্ন ভিন্ন দলে সবাই এসে একত্র হয়েছে। গাড়িগুলো ছোট হলেও বিস্ময়কর। এগুলো স্বয়ংক্রিয় এবং পুরোটা শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে বোঝাই। আপাতত সেগুলো নিরীহভাবে চারপাশে ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
জুগোর ভবনটি অত্যন্ত সুরক্ষিত। উচু চওড়া দেয়াল, কাঁটাতারের বেষ্টনি, উচ্চচাপের বৈদ্যুতিক তার, সশস্ত্র প্রহরা সবকিছুই এখানে রয়েছে। এই ভবনে ঢোকার জন্য লুকাসের পরিকল্পনা খুব সহজ। একই সাথে ভবনটিকে চারদিক থেকে আক্রমণ করা হবে, ঠিক কোন পথে শত্রুরা আসবে বুঝতে দেয়া হবে না। তাদের বিভ্রান্ত করার জন্যে দ্বিতীয় পর্যায়ে মূল গেট দিয়ে দু’টি গাড়ি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে ভেতরে ঢুকে যাবে। গাড়ি দু’টিকে বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করে সমস্ত লক্ষ্যস্থলের কেন্দ্র হিসেবে ও করানো হবে। ঠিক এই সময় আক্রমণের তৃতীয় পর্যায় শুরু হবে। লুকাস তার দলবল নিয়ে দক্ষিণ দিকের দেয়াল উড়িয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাবে। ভেতরে খণ্ডযুদ্ধ হবে। যারা বেঁচে থাকবে তারা মূল ইলেকট্রনিক্স ভবনের সামনে এসে হাজির হবে। আমি থাকব সাথে, যখন ইলেন মূল ভবনের দরজা খুলে দেবে, ভেতরে ঢুকে যাব। তার পরের কাজ সহজ, বেছে বেছে প্রয়োজনীয় আই. সি.গুলো তুলে নেয়া, আমি আগেও একবার করেছি।
নির্দিষ্ট সময়ে আমরা পরিকল্পনামাফিক দূরে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ, সাথে সাথে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের শব্দ শুনতে পেলাম। কয়েক মুহূর্ত পরেই আমাদের নিরীহ গাড়িগুলো তাদের ক্ষেপণাস্ত্র থেকে গোলা ছুড়তে থাকে। ভবনটির নানা অংশ আমি বিস্ফোরণে উড়ে যেতে দেখলাম। লুকাস আর তার দলবল শান্তভাবে অপেক্ষা করতে থাকে, আমার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়, নিজেকে মাটির সাথে মিশিয়ে আমি শুয়ে থাকি, প্রত্যেকটা বিস্ফোরণের শব্দে আমি চমকে উঠছিলাম, মনে হচ্ছিল আমার কানের পর্দা যে-কোনো মুহূর্তে ফেটে যাবে। আমি দরদর করে ঘামছিলাম এবং প্রচণ্ড তৃষ্ণায় আমার বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছিল।
একসময় লুকাস হাত দিয়ে ইঙ্গিত করতেই দু’টি গাড়ি কোনো চালক ছাড়াই হঠাৎ বাইরের গেট দিয়ে ভবনের ভেতরে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করে। প্রচণ্ড গোলাগুলি হতে থাকে, আমি লেজারের তীব্র আলো ঝলসে উঠতে দেখি। গাড়ি দু’টি থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র বৃষ্টির মতো গোলাগুলি করতে থাকে, ক্রুগোর ভবনের প্রহরীরা গাড়ি দু’টিকে ঘিরে একটা ব্যুহ তৈরি করার জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠে।
সবকিছু পরিকল্পনামাফিক কাজ করছে, লুকাস চারদিকে ঘুরে একবার তাকিয়ে হাত দিয়ে ইঙ্গিত করতেই পুরো দলটা উঠে দাঁড়ায়। আমার একা একা অপেক্ষা করার কথা, উঠে দৌড় দেবার প্রবল ইচ্ছাটাকে অনেক কষ্টে দমন করে আমি কান চেপে মাটিতে শুয়ে থাকি। একটু পরেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেলাম। খানিকক্ষণের জন্যে একটা আশ্চর্য নীরবতা নেমে আসে, তারপর হঠাৎ আবার গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। কতক্ষণ শুয়ে ছিলাম জানি না, আমার তখন সময়ের কোনো জ্ঞান নেই, মনে হচ্ছিল কয়েক যুগ পার হয়ে গেছে। এই সময়ে হঠাৎ দেখতে পাই সু গুড়ি মেরে এগিয়ে আসছে।
কাছে এসে চিৎকার করে বলল, কিম জুরান, চলুন যাই।
সবকিছু ঠিকমত চলছে?
মোটামুটি। দু জন মারা গেছে আমাদের।
অন্ধকারে বিস্ফোরণের আলোতে পথ দেখতে দেখতে সুয়ের হাত ধরে আমি এগোতে থাকি। আমাদের দু’পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে যাচ্ছিল, এর কর্কশ শব্দে কানে তালা ধরে যাবার অবস্থা। সু গলা উচিয়ে বলল, ভয় পাবেন না, লুকাস আমাদের কভার করছে।
যদিও ভয়ে আমার হৃৎস্পন্দন থেমে যাবার অবস্থা, আমি সেটা স্বীকার করলাম না, চিৎকার করে বললাম, ভয়ের কী আছে, আমরা তো এসেই গেছি।
সত্যি সত্যি আমরা প্রায় পৌছে গেছি, সামনের দেয়ালে বড় ফুটো, ইতস্তত বৈদ্যুতিক তার ঝুলছে। আমার শরীরে বিশেষ বিদ্যুৎ অপরিবাহী পোশাক, কাজেই আমি ইতস্তত না করে ভেতরে ঢুকে গেলাম। ভেতরে আবছা অন্ধকার, ধুলোবালি উড়ছে। লুকাসের গলার স্বর শোনা গেল, কিম জুরান, ঠিক আছে সবকিছু?
হ্যাঁ।
চলুন যাই।
কে-একজন বলল, প্রহরীদের একটা দল আসছে সামনে দিয়ে। লুকাস কোমর থেকে খুলে কী-একটা ছুঁড়ে দেয়, প্রচণ্ড বিস্ফোরণে চারদিক অন্ধকার হয়ে যায় সাথে সাথে।
আমার সাথে আসুন কিম জুরান। লুকাস আমার হাত ধরে টানতে টানতে বলে, ঐ যে সামনে গোর মূল ভবন, সি. পি. ইউ. ওখানেই আছে।
ধুলোবালির মাঝে কাশতে কাশতে আমি এগোচ্ছিলাম, হঠাৎ পুরো এলাকাটি তীব্র আলোতে ভরে গেল। তীক্ষ্ণ একটা কণ্ঠস্বর চিৎকার করে বলল, যে যেখানে আছ দু হাত তুলে দাঁড়াও, তোমাদের দিকে আমরা আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে আছি।
ক্রুগো! লুকাস দাঁতে দাঁত ঘষে বলে, ভাওতাবাজির আর জায়গা পাও না। বিদ্যুৎগতিতে সে তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র তুলে নিয়ে আলোগুলো লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকে। দেখতে দেখতে আবার আবছা অন্ধকার নেমে আসে। লুকাস ভাঙা গলায় চিৎকার করে বলল, ক্রুগো! তুমি আমাকে ধোঁকা দেবে?
তুমি কে?
লুকাস দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, তোমার বাবা।
একটা তীক্ষ্ণ হাসির শব্দ শোনা যায়! ও, তুমি সেই রবোট্রন দলপতি। দশ টেরা। চাঁইয়ের একটা রবোট হয়ে তুমি আমার সাথে যুদ্ধ করতে এসেছ? তোমার সাহসের প্রশংসা করতে হয়!
লুকাস ক্রুগোর কথায় ভূক্ষেপ না করে এলোপাতাড়ি গুলি করতে করতে এগিয়ে যায়। মূল ভবনের কাছাকাছি এসে সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। লুকাস চিৎকার করে বলল, যে-কোনো অবস্থাতে তোমরা সবাইকে আধঘন্টা আটকে রাখবে, এর ভেতরে দরজা খুলে যাবে।
দরজা খুলে যাবে? ক্রুগো ব্যঙ্গ করে বলে, তোমার হুকুমে? নাকি কোনো জাদুমন্ত্রে?
তোমার যেটা ইচ্ছা ভাবতে পার। তুমি জান এই দরজা খুলতে হলে কী করতে হয়? জানি। তোমার গোপন সংকেত জানতে হয়। তুমি সেটা জান? জানি।
ক্রুগো হঠাৎ অট্টহাস্য করে ওঠে। তুমি ভেবেছ যে-সংকেতটি তোমরা বের করেছ সেটা সত্যি? এত সহজে আমার সংকেত বের করা যায়?
কেন যাবে না, লুকাস হাসার চেষ্টা করে বলল, তুমি একটা নির্বোধ কম্পিউটার ছাড়া তো আর কিছু নও।
সত্যিই যদি তুমি আমার গোপন সংকেত জান তাহলে দরজা খুলছ না কেন?
যখন সময় হবে তখন ঠিকই খুলব।
আর ততক্ষণে হাজার হাজার ছত্রীসেনা এসে তোমাদের সবার কপোট্রন ধ্বংস করে দেবে। তুমি জান এই মুহূর্তে কয় হাজার ছত্রীসেনা পাশের প্রদেশ থেকে আনা হচ্ছে?
তুমি জান এই মুহূর্তে কতজন রবোট্রন তোমার মূল প্রোগ্রামকে পরিবর্তন করছে?
ক্রুগো আবার অট্টহাস্য করে ওঠে, সাথে সাথে কাছেই কোথায় প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। গুলির শব্দ একটু কমে আসতেই ক্রুগোর গলা শুনতে পেলাম, রবোট্রন, শুনতে পাচ্ছ তোমাদের ধ্বংস করার জন্য সেনাবাহিনী চলে এসেছে। তোমার বন্ধুরা কতক্ষণ তাদের আটকে রাখবে?
লুকাস ক্রুগোর কথায় কান না দিয়ে ভুরু কুঁচকে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি সাবধানে ঘড়ির দিকে তাকালাম, যে-সময় দরজা খোলার কথা সেটা পার হয়ে যাচ্ছে। একটু দেরি হতে পারে, কিন্তু যদি বেশি দেরি হয়, তাহলে? আসলেই যদি গো কম্পিউটারের কথা সত্যি হয় আর আমাদের বের করা গোপন সংকেতটি ভুল হয়ে থাকে, তাহলে কী হবে? চিন্তা করেই আমার বুক কেঁপে ওঠে, আমাদের সবাইকে তাহলে ইঁদুরের মতো মারা হবে?
লুকাস দরজার কাছে গিয়ে সেটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, কী দেখে সে-ই জানে। ক্রুগোর গলার স্বর আবার শুনতে পেলাম, বলল, দেখ রবোট্রন, আমি তোমাদের শেষবারের মত ক্ষমা করতে রাজি আছি। তোমরা দু’হাত তুলে এখান থেকে বের হয়ে পড়, তোমাদের তাহলে হত্যা করা হবে না।
লুকাস কোনো কথা না বলে পিঠ থেকে ভারি হ্যাভারসেক নামিয়ে বিস্ফোরক বের করতে থাকে, আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী করছ লুকাস?
দরজা যদি না খোলে ভেঙে ফেলতে হবে।
পারবে ভাঙতে?
জানি না, চেষ্টা করতে ক্ষতি নেই। ডানদিকে মাঝামাঝি জায়গাটা দুর্বল, ঠিকভাবে বিস্ফোরকগুলো কাজে লাগালে একটা ছোট ফুটো হতে পারে। লুকাস খানিকক্ষণ কী-একটা ভাবে, তারপর জিজ্ঞেস করে, কী মনে হয় আপনার, ইলেনের দল কি খুলে দিতে পারবে দরজা?
আমার নিজের তখন সন্দেহ হতে শুরু করেছে, কিন্তু কেন জানি না দৃঢ়স্বরে বললাম, অবশ্যি পারবে। সময় হয়ে গেছে, যে-কোনো মুহূর্তে খুলে যাবে এখন।
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ ম্যাজিকের মতো ছোট একটা দরজা উপর দিকে উঠে যেতে থাকে।
লুকাস আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, ছুটে যাচ্ছিল, আমি তাকে থামালাম, ভেতরে ঢোকার আগে তুমি তোমার শিল্ডিং পরে নাও।
তাই তো লুকাস থমকে দাঁড়িয়ে দরজাটার দিকে তাকায়, এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বলে, কিন্তু দরজা যদি বন্ধ হয়ে যায়, চলুন আগে ভেতরে ঢুকে পড়ি।
কিন্তু তোমার সার্কিট যদি জ্যাম করে দেয়?
আপনি তো আছেন, আপনি তো জানেন কী করতে হবে। চলুন আগে ঢুকে পড়ি।
আমি আর লুকাস ছোট দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম আর প্রায় সাথে সাথেই ছোট ভারি দরজাটা আবার নেমে আসে। দরজাটা বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে ভেতরে একেবারে নীরব হয়ে আসে, এতক্ষণ প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে অভ্যস্ত হয়ে গিয়ে হঠাৎ করে এই নীরবতাটুকু খুব অস্বস্তিকর মনে হতে থাকে। আমি শুকনো গলায় বললাম, লুকাস, তোমার শিল্ডিংটা পরে নাও, সার্কিট জ্যাম করে দিলে মহা মুশকিল হয়ে যাবে।
ঠিকই বলেছেন। লুকাস তাড়াহুড়া করে পোশাকটা পরতে শুরু করে, অনেকটা মহাকাশযাত্রীদের মতো পোশাক, লুকাসের পরতে বেশ খানিকক্ষণ সময় নেয়।
ভেতরটা একটা গুহার মতো, কয়েক শ’ ফুট লম্বা। ভালো করে দেখা যায় না। এমনিতে কোনো আলো নেই, বিভিন্ন আই. সি. থেকে যে-আলো বের হচ্ছে তা দিয়েই কেমন একটা ভূতুড়ে ভাবের সৃষ্টি হয়েছে। আই. সি.গুলো প্রচণ্ড তাপের সৃষ্টি করে, সেগুলোকে ঠাণ্ডা করার জন্য ভেতরে বাতাস বইছে, সেই বাতাসও অনেক গরম। চারদিকে অসংখ্য আই. সি; আবছা আলোতে সেগুলো চকচক করছিল।
আমি লুকাসের পিছু পিছু হাঁটতে থাকি। সবকিছু ঠিকঠিক ঘটে থাকলে এই মুহূর্তে এখানকার কোনো কোনো আই. সি.র ভেতর দিয়ে ইলেনের দল তাদের তৈরি করা প্রোগ্রাম প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে। আমার মনে পড়ল মহাকাশযানের কম্পিউটার আমাকে একবার ধোঁকা দিয়ে সেইসব আই. সি. তুলিয়ে এনেছিল।
লুকাস ম্যাপ দেখতে দেখতে হাঁটছিল, ভেতরে কোথায় কোন আই. সি. রয়েছে সেই ম্যাপে দেখানো আছে। একসময় সে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, কিম জুরান, আমরা এসে গেছি, আপনি বাম দিক থেকে শুরু করুন, আমি ডান দিক থেকে।
আমি পকেট থেকে স্কু ড্রাইভারটা বের করে সাবধানে আই. সি.গুলো টেনে তুলতে থাকি। ছোট ছোট কালো আই. সি., সাধারণ লজিক গেট দেখতে যেরকম হয়, মোটেও মূল্যবান প্রসেসরের মতো নয়, পিনের সংখ্যা কম, কোনো রেডিয়েটরও নেই। আমার একটু খটকা লাগে, ইতস্তত করে লুকাসকে ডাকলাম, লুকাস।
কি?
আমি লুকাসের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটি জিজ্ঞেস করতে গিয়ে থেমে গেলাম। লুকাসের শিল্ডিংয়ের একটা অংশ নেই, মুহূর্তে পুরো ব্যাপারটি আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। আমার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে আর লুকাস নয়, সে এখন ক্রুগো কম্পিউটার! লুকাসের সার্কিট জ্যাম করার বদলে ক্রুগো তাকে দখল করে নিয়েছে, আমাকে ভাঁওতা দিয়ে আবার সেই একইভাবে আমাদের সর্বনাশ করিয়ে নিচ্ছিল।
আমি উঠে দাঁড়াতেই লুকাস হঠাৎ করে তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি টেনে নেয়। আমার বুক কেঁপে ওঠে, কী করছে সে? শুকননা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে। তোমার?
লুকাস কোনো কথা না বলে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি আমার দিকে তাক করে, আর আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারি আমার সময় শেষ। এত চেষ্টা, এত কষ্ট—সবকিছু এখন শেষ হয়ে যাবে, ছোট একটি ভুলের জন্যে। লুকাসকে বাইরে রেখে আমি যদি শুধু একা ভেতরে ঢুকতাম।
মানুষ কখনো আশা ছেড়ে দেয় না, শেষ মুহূর্তে আমিও মরিয়া হয়ে ছুটতে শুরু করি, ভেতরে গুলির প্রচণ্ড কান-ফাটানো আওয়াজ হল, আমার ঘাড়ের কাছে কোথায় জানি তীব্র যন্ত্রণা করে ওঠে, নিশ্চয়ই গুলি লেগেছে। আমি পড়ে যেতে যেতে উঠে দাঁড়াই, এখনো মরি নি, একবার শেষ চেষ্টা করা যায় না?
একটু দূরে দেখা যাচ্ছে দুই হাজার পিনের প্রসেসর, উপরে সোনালি রেডিয়েটর, ঐগুলো নিশ্চয়ই সবচেয়ে প্রয়োজনীয় আই. সি. ওর একটা, তুলতে পারলে নিশ্চয়ই কিছু একটা হবে। আমি টলতে টলতে প্রসেসরগুলোর কাছে এসে দাঁড়াই—যে- কোনো মুহূর্তে একটা গুলি এসে আমাকে ছিন্নভিন্ন করে দেবে আশঙ্কায় আমার সমস্ত স্নায়ু টানটান হয়ে থাকে, কিন্তু কোনো গুলি আমাকে শেষ করে দিল না। আমি মাথা ঘুরিয়ে দেখি লুকাস আমার দিকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি তাক করে এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে। কিন্তু গুলি করছে না। কেন?
হঠাৎ করে আমি বুঝতে পারি কেন সে গুলি করছে না, আমি এখন দাঁড়িয়ে আছি সবচেয়ে জরুরি প্রসেসরগুলোর সামনে, আমাকে গুলি করলে এই প্রসেসরও ধ্বংস হয়ে যাবে, ক্রুগো সেটা করতে চায় না। হঠাৎ আমার শরীরে হাতির মতো বল এসে যায়, আমি পাগলের মতো পেছনের প্রসেসরের উপর ঝাপিয়ে পড়ি, হাতের স্ক্র ড্রাইভারটা দিয়ে আঘাত করতেই ঠুনকো প্রসেসরটি ঝনঝন করে ভেঙে যায়।
লুকাস হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল, প্রসেসরটি হারিয়ে নিশ্চয়ই ক্রুগো কম্পিউটার তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে! আমি পাগলের মতো পাশের প্রসেসরটিকে আঘাত করি, এটা অনেক শক্ত, আমার আঘাতে কিছু হল না। আমি আতঙ্কিত হয়ে দেখি লুকাস আবার উঠে দাঁড়িয়েছে, টলতে টলতে আমার দিকে এগিয়ে এসে আবার তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি তুলে ধরেছে, আমি প্রাণপণে প্রসেসরটির নিচে স্ক্রু ড্রাইভার ঢুকিয়ে হ্যাচকা টানে সেটিকে তুলে ফেললাম, সাথে সাথে লুকাস আর্তচিৎকার করে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল।
আমার হঠাৎ করে ভীষণ দুর্বল লাগতে থাকে, ঘাড়ের কাছে কোথাও গুলি লেগেছে, রক্তে সারা পিঠ আর হাত চটচটে হয়ে গেছে, চেষ্টা করেও চোখ খোলা রাখতে পারছি না। প্রচণ্ড তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। আমি আরো একটা প্রসেসর তোলার চেষ্টা করলাম, কিন্তু হাতে আর জোর নেই, ভ্রু ড্রাইভারটা নিচে ঢোকানোর চেষ্টা করতেই মাথা ঘুরে ওঠে, কোনোমতে দেয়াল ধরে নিজেকে সামলে নিই, আর ঠিক তক্ষুণি তাকিয়ে দেখি লুকাস আবার টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়েছে, তার হাতে এখনো সেই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। এক পা এক পা করে সে আমার দিকে এগিয়ে আসে, দু’ হাত সামনে দাঁড়িয়ে সে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি তুলে ধরে, আমি তার চোখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলাম, অদ্ভুত পোশাকে মুখ ঢেকে আছে, তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। আমি চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকি। পর মুহূর্তে লুকাস ট্রিগার টেনে ধরে। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের কানফাটানো কর্কশ শব্দের মাঝে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম আমি। কয়েক মুহূর্ত লাগল বুঝতে যে আমার গায়ে গুলি লাগে নি। চোখ খুলে তাকালাম আমি, সত্যি তাই, আমার গায়ে একটি গুলিও লাগে নি। কেন লাগবে? লুকাস আমাকে গুলি করে নি, গুলি করেছে আমার পেছনে সারি সারি প্রসেসরগুলোতে।
লুকাস আবার তার অস্ত্র তুলে নেয়, তারপর আবার পাগলের মতো গুলি করতে শুরু করে। প্রচণ্ড শব্দে কানে তালা লেগে যায়, ধোঁয়ায় ভরে যায় চারদিক। কয়েক মিনিট গুলির শব্দ ছাড়া আর কোথাও কিছু নেই। প্রচণ্ড আক্রোশে সবকিছু ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে লুকাস। কখনো থামবে মনে হচ্ছিল না, কিন্তু গুলি শেষ হয়ে গেল। একসময়। ঠিক তখনই আমি ক্রুগোর আর্তচিৎকার শুনতে পাই। মরণাপন্ন মানুষের কান্নার মতো সেই ভয়াবহ চিৎকার বদ্ধ ঘরের দেয়াল থেকে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। আশ্চর্য একটা নীরবতা নেমে আসে হঠাৎ, কবরেও বুঝি কখনো এরকম নীরবতা নামে না।
লুকাস হাতের অস্ত্রটি ছুঁড়ে দিয়ে মাথার উপর গোলাকার ঢাকনাটি খুলে ফেলল। ঘুরে আমার দিকে তাকাল সে, তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে ছুটে এল দ্রুত। সাবধানে আমাকে সোজা করিয়ে বসিয়ে গুলির আঘাতটি পরীক্ষা করে, তারপর শার্ট ছিড়ে ভাঁজ করে আমার ক্ষতস্থানে চেপে ধরে রক্ত বন্ধ করার জন্যে। তার দিকে তাকাতেই সে।
কে জিজ্ঞেস করে, কে গুলি করেছে আপনাকে? আমি?
হ্যাঁ। কী মনে হয়, বেঁচে যাব এযাত্রা?
অন্য কেউ হলে সন্দেহ ছিল, কিন্তু আপনাকে মারবে কে? মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে আপনি রুকুন গ্রহপুঞ্জ ঘুরে এসেছেন—স্বয়ং বিধাতা আপনাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, আমি কি আপনাকে মারতে পারি? নাকি ক্রুগো পারবে?
লুকাস ঝুঁকে পড়ে আমার হাত চেপে ধরে বলল, কিম জুরান, পৃথিবীর মানুষ আর পৃথিবীর সব রবোট্রন যুগ যুগ আপনার কথা মনে রাখবে—কেন জানেন? কারণ—
কারণটা আমার শোনা হল না, লুকাসের হাতে মাথা রেখে আমি জ্ঞান হারালাম।
———–
পরিশিষ্ট
পরবর্তী ঘটনা সংক্ষিপ্ত। ক্রুগো কম্পিউটারকে অচল করে দেবার পরপরই আবার নূতন করে সর্বোচ্চ কাউন্সিল তৈরি করা হয়েছে। আগের সর্বোচ্চ কাউন্সিলের দশ জনকেই নাকি ক্রুগো কম্পিউটার মেরে ফেলেছিল। শাসনতন্ত্রে সাহায্য করার জন্যে নূতন একটা কম্পিউটার তৈরি করা হচ্ছে, কে তৈরি করেছে সেটা গোপন, কিন্তু বিশ্বস্তসূত্রে আমি খবর পেয়েছি লুকাস নাকি সেখানকার কর্তাব্যক্তিদের একজন। (আজকাল উচ্চ মহলে আমার অনেক পরিচিত বন্ধুবান্ধব, অনেক গোপন খবর পাই আমি। রবোট্রনদের আবার মানুষের সাথে পাশাপাশি থাকার সুযোগ দেয়া হয়েছে, তবে এক শর্তে, তারা আর কখনো মানুষের চেহারা নিতে পারবে না, তাদেরকে যন্ত্রের মতো দেখাতে হবে। ভিকির সেটা নিয়ে খুব মন-খারাপ, কিন্তু রবোট্রনদের কারো আপত্তি নেই। প্রাণ বাচানোর জন্যে তারা এটা করেছিল, এখন এটা একটা বাড়তি সমস্যার মতো। যেমন সুয়ের কথা ধরা যাক, সে যে-কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ায় সেখানকার সব পুরুষ ছাত্র নাকি তার প্রেমে পড়ে গেছে, সে রবোট্রন জেনেও। একজন নাকি আবার সুয়ের জন্যে ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল, পাগল আর কাকে বলে!
রুকুন গ্ৰহপুঞ্জে আবার নাকি একটা মহাকাশযান পাঠানো হবে, আমার কাছ থেকে সবকিছু শুনে বিজ্ঞানীদের সাহস অনেক বেড়ে গেছে, কয়েকজন বিজ্ঞানী নাকি স্বেচ্ছায় রাজি হয়েছেন যাবার জন্যে। তাঁরা কী—একটা যন্ত্র তৈরি করেছেন, সেখানে নাকি নিউট্রিনো ব্যবহার করে রুকুন গ্ৰহপুঞ্জের সাথে যোগাযোগ করা হবে। মহাকাশযানটি ফিরে আসতে আসতে আরো প্রায় এক বছর, কী হয় দেখার জন্যে আমি খুব কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করে আছি।
নীষা বাচ্চাদের একটা হাসপাতালে ডাক্তারের একটা ভালো চাকরি পেয়েছে। তার সাথে জীবন, মৃত্যু, ভালবাসা, বেঁচে থাকার সার্থকতা ইত্যাদি বড় বড় জিনিস নিয়ে প্রায়ই আমার সুদীর্ঘ আলাপ হত, ইদানীং ব্যক্তিগত জিনিস নিয়ে কথাবার্তা শুরু করেছি। তার নাকি বিয়ের কোনো পরিকল্পনা ছিল না, আমারও তাই। (আমাদের দু’জনের অনেক বিষয়ে মিল রয়েছে। তবে সারাদিন কাজকর্ম করে সন্ধ্যায় একা শূন্য বাসায় ফিরে আসতে নাকি তার খুব খারাপ লাগে। কথাটা মিথ্যে নয়, তাই অনেক চিন্তা-ভাবনা করে দু’জনেই বিয়ে করব ঠিক করেছি। একজন আরেকজনকে, সেটাই সুবিধে, দু’জনের জন্যেই।
বিয়ের অনুষ্ঠান হবে খুবই অনাড়ম্বর। খুব ঘনিষ্ঠ ক’জন মানুষ আর রবোট্রন ছাড়া অন্য কেউ থাকবে না। শহরতলির অ্যাপার্টমেন্টের সেই বুড়োকে বিয়েতে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছিলাম। সাথে নীষা ছিল, বুড়ো তাকে চিমটি কেটে পরীক্ষা করে দেখল মানুষ কি না, এখনো তার রবোট্রনকে খুব ভয়। (তার চেক নাকি আবার আসতে শুরু করেছে।)
খুব বেশি যদি খুঁতখুঁতে না হই, তাহলে স্বীকার করতেই হবে যে বেঁচে থাকা ব্যাপারটা মোটামুটি খারাপ নয়।