মিস্টার ফ্রেজার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন। কেউ তাঁকে লক্ষ করছে না। করবেই বা কেন, তাঁকে তো কেউ চিনতে পারছে না। এটা এমন এক দেশ যে কেউ কারো দিকে ফিরেও তাকানোর সময় পায় না।
হাঁটতে হাঁটতে ভাবছেন তিনি, বাহ, জায়গাটা তো খুব সুন্দর। কী সুন্দর স্বচ্ছ নির্মেঘ আকাশ, টলটলে লেকের পানি, তাতে কয়েকটা হাঁস সাঁতার কাটছে। বিকেলের মৃদুমন্দ হাওয়ায় অনেক মানুষ হাঁটতে এসেছে এখানে, কেউ কেউ হাত ধরাধরি করে হাঁটছে, কোথাও বাবামায়ের হাত ধরে হাঁটছে ছোট ছোট বাচ্চারা, সুন্দর একটা দৃশ্য, কিছুক্ষণ লেকের পাড়ের পুরনো বেঞ্চে বসে থাকলে মন আপনা থেকেই ভালো হয়ে যায়। বাতাস এখানে বিশুদ্ধ, ধোঁয়া নেই, কোন দূষণ নেই, একটা পরিশুদ্ধিতার আবেশ পাওয়া যায়। এত সুন্দর বাইরের পৃথিবীটা, আর লোকগুলো নাকি তাঁকে একটা চারকোণা ঘরে দিনের পর দিন আটকে রাখে।
মিস্টার ফ্রেজার একটা বেঞ্চে বসে লেকের অপর পাড়টি দেখতে চেষ্টা করছেন, অনেক বড় লেকের অন্য পাড়টি দেখতে পাওয়া মুশকিল, তবে আবছা দেখা যাচ্ছে, ঐ পাড়েও অনেক মানুষ, বিকেলে ঘুরতে বেরিয়েছে। মিস্টার ফ্রেজার বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে ফুসফুস ভরে নিতে লাগলেন।
রাস্তার ধারে একটা কালো স্যালুন গাড়ি এসে থামলো, ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা পা। ক্রমে পুরো মানুষটাকেই দেখা গেলো, কাটা কাটা মুখ, মসৃণ শেভড গাল, চোখে রোদচশমা, সুটেড বুটেড। দেখে মনে হয় কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, কোন হুকুম পালনের জন্য সদা প্রস্তুত হয়ে আছে।
গাড়ি থেকে নেমে কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে জামাকাপড় পরিপাটি করলো সে, তারপর সোজা এগিয়ে আসতে লাগলো মিস্টার ফ্রেজার যে বেঞ্চে বসে আছেন তার দিকে।
কাছে এসে থামল সে, জুতোয় একরকম আওয়াজ করলো, গলা খাঁকারি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলো।
মিস্টার ফ্রেজার বিরক্ত চোখে তাকালেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে হয় একা একা, সেখানে দ্বিতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি সবসময়ই বিরক্তির উদ্রেক করে। তার ওপরে অনেকদিন পরে তিনি খোলা জায়গায় আসতে পেরেছেন। এই লোক চায় কী?
বসতে পারি? খোলতাই হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো লোকটা। মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন মিস্টার ফ্রেজার।
বসার অনুমতি পেয়ে ধন্য হয়ে গেছে এমন একটা ভাব করলো সে। মুখের হাসিটা নকল, যে হাসি ঠোঁটের ডগা থেকে ঝুলে থাকে, তা কখনো আসল হয় না। মিস্টার ফ্রেজার সতর্ক বোধ করলেন। বদ মতলব নেই তো?
বেঞ্চে জাঁকিয়ে বসে লোকটা আলাপ জুড়ে দিল, আমি হফলার, ব্রেন্ডান হফলার। আপনি?
সংক্ষেপে নিজের নাম বললেন তিনি, ভাবভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, বিরক্ত কোরো না ছোকরা, এখানে রিলাক্স করতে এসেছি।
খুব একটা সাড়া না পেয়ে লোকটা চুপ মেরে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই, একতরফা আলাপ জমে না। মিস্টার ফ্রেজার নিশ্চিন্ত বোধ করলেন। লোকটা এখন পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে গুঁতোগুঁতি করছে।
কিছুক্ষণ পর আবার পকেটে হাত দিল সে, বের করে আনল একটা ছোট্ট ডিবে। ইনহেলারের মতো দেখতে জিনিসটা। এই বয়সে হাঁপানিও আছে নাকি? মিস্টার ফ্রেজার আড়চোখে একবার তাকালেন। তারপর ডুবে গেলেন নিজের চিন্তায়। কে আমি? কোথায় ছিলাম? ঐ এপ্রন পড়া বিটকেলে লোকগুলো দিনের পর দিন আমাকে আটকে রাখতো কেন? উফ, কথা বলতে গেলেই একান-ওকান একটা হাসি দিত, বোঝাতে চাইতো যেন কত ভালো চায় তাঁর! মাঝে মাঝে কিম্ভূতকিমাকার সব যন্ত্রের সাথে বেঁধে নাকের সামনে একটা ঘড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে জিজ্ঞেস করতো, কিছু মনে করতে পারছেন, মিস্টার ফ্রেজার? আপনি চেষ্টা করুন, নিশ্চয়ই পারবেন। আপনার স্মৃতি আস্তে আস্তে ফিরে আসবে। আপনি আবার আগের মতো হয়ে যাবেন। আবার আপনার প্রিয়জনদের কাছে ফিরে যেতে পারবেন। আরেকটু চেষ্টা করুন। পাগলের গুষ্টি সব!
নাহ, কিছু মনে পড়ছে না। কেন এমন হল? কীভাবেই বা হল? ঐ লোকগুলো কারা ছিল? বের হয়ে পড়ে কি ভুল করলাম? এখন যাবোই বা কোথায়?
পাশের লোকটা কাছে ঘেঁষে এসেছে আরও।
ইনহেলারটা ধরল তাঁর নাকের কাছে, বাধা দেবার সময় পেলেন না মিস্টার ফ্রেজার। একটা ছোট্ট শব্দ পেলেন তিনি, পারফিউমের বোতল চাপলে যেমন হয় তেমনি। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো, সবকিছু ঝাপসা হয়ে গেল। তারপর সব অন্ধকার।
লোকটা সচল হয়ে উঠলো, ব্যস্ত ভাব করে মিস্টার ফ্রেজারকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল, তারপর গাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটে চলল। পার্কের মানুষজন জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল, পরোয়া করলো না সে, একজন মুখোমুখি এসে পড়াতে বলল, বাবা অজ্ঞান হয়ে গেছেন, পথ ছাড়ুন প্লিজ, এখুনি হাসপাতালে নিতে হবে। লোকটা ব্যস্তসমস্ত হয়ে পথ ছেড়ে দিল।
কালো স্যালুন গাড়িটা গুলির মতো বেরিয়ে গেল, মিলিয়ে গেল রাস্তার অনেক গাড়ির ভিড়ে।
সোয়ান মেন্টাল এন্ড সাইকোলজিক্যাল থেরাপি সেন্টারের ইন-চার্জ ডক্টর ক্রিস্টিনা ক্লারার মেজাজ অনেকক্ষণ ধরে বিগড়ে আছে, সামনে যাকে পাচ্ছেন তাকেই ধমক দিচ্ছেন। ছোকরা ডাক্তার মিলনার ফ্রিম্যান কিছু একটা জানতে এসেছিল, এক ধমকে রুমের বাইরে চলে গেছে। এই বৃদ্ধাকে এই ক্লিনিকের সবাই ভয় পায়, দূরে দূরে থাকতে চায়, সবার ধারণা, পেশেন্টদেরকে মেন্টাল থেরাপি দিতে দিতে ডক্টর ক্লারার মাথাও কিঞ্চিৎ “দশাগ্রস্ত” হয়ে গেছে। সবাইকে ধমকানো তাঁর স্বভাব, কিছুদিন আগে বুড়ো ডাক্তার সলোমন ক্লারার চিৎকারে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।
একের পর এক বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে যাচ্ছেন ক্লারা, মিস্টার ফ্রেজারকে না খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত স্বস্তি নেই। রাস্তায় তাঁকে তিন মাস আগে পেয়ে নিয়ে এসেছিল ডক্টর ব্রেসনানের এক আত্মীয়, এখন কি স্মৃতিভ্রষ্ট বৃদ্ধ লোকটা আবার রাস্তাতেই হারিয়ে গেল?
হ্যাঁ, মিস্টার ফ্রেজার ছিলেন এই ক্লিনিকের একজন পেশেন্ট, তাঁর স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন ডাক্তাররা, যদিও কোন লাভ হয় নি এই কদিনে। কাজেকর্মে ঢিলেমির জন্য মিলনার ফ্রিম্যান অনেক বকা খেয়েছে ক্লারার কাছে, কিন্তু চেষ্টার কোন ত্রুটি সে করেনি, এটা জোর দিয়ে বলতে পারে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সব লাথি মেরে ফেলে চলে যেতে, কিন্তু ক্লারা বেতন ভালো দেয়, উপায় কী? মন্দা চলছে অর্থনীতিতে, এখন চাকরি ছাড়া মানে নিজের পায়ে কুড়াল মারা।
এখন ক্লারা কথা বলছেন কাউন্টির পুলিশ ফাঁড়ির অফিসারের সাথে, অফিসারের নাম জাস্টিন ম্যাকনিল। রাশভারী এই অফিসারের সাথে ঈশ্বরের পৃথিবীতে একমাত্র ডক্টর ক্লারাই চোটপাট করে কথা বলেন। কিছুদিন আগেও এক পেশেন্ট পালিয়ে গিয়েছিল, ম্যাকনিল খুব তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করে ফিরিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু মিস্টার ফ্রেজার যেন বাতাসে উবে গেছেন, কোন পাত্তা লাগানো যাচ্ছেনা।
তোমরা কি ঘাস খাচ্ছ? একটা জলজ্যান্ত মানুষ আমাদের এখান থেকে পালিয়ে গেল, তোমরা কোন কিনারা করতে পারছ না? রাত হয়ে গেছে, বুড়ো মানুষটা যেকোনো সময় একটা বিপদে পড়তে পারে।
আপনি শান্ত হোন মিস ক্লারা, আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।
তাড়াতাড়ি খুঁজে বের করে দাও, ম্যাকনিল, নয়তো তোমার খারাপ কিছু ঘটলে আমি কিছু দায়ী থাকবো না। উপরমহলে কিন্তু খবর দিয়ে দেবো, তোমার চাকরির দফারফা করে ছাড়বো।
ঠিক আছে, মিস ক্লারা। রাখছি।
ফোন রেখে চেয়ারে এলিয়ে পড়লেন ক্লারা। কয়েক মুহূর্ত পরেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, একটা কাজের কথা মনে পড়ে গেছে, তিন নম্বর পেশেন্টকে একটা “ডলা” দিতে হবে। যাওয়ার পথে মিলনারের রুম পাশেই পড়ে। মিলনার দুপুরে খুব ব্যস্ত ছিল, খাওয়ার সময় পায় নি। এখন একটা পেল্লায় সাইজের স্যান্ডউইচ খাচ্ছিল, ক্লারাকে পাশ দিয়ে যেতে দেখে বিষম খেলো, গলায় রুটির দলা আটকে গেছে। ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ক্লারা, তারপরই নিজের কাজে চলে গেলেন।
ক্লারা অবিবাহিতা, এটাই স্বাভাবিক, এমন ধেনো মরিচকে কে বিয়ে করবে? তাঁর আত্মীয়স্বজন বলতেও কেউ নেই, বাবা-মাকে তিনি দেখেন নি, অরফানেজ থেকে লেখাপড়া করেছেন। এই খ্যাতিমান সাইকিয়াট্রিস্টের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হল তাঁর হসপিটাল এবং পেশেন্টরা। এই হসপিটালের দায়িত্ব যেদিন থেকে পেয়েছেন, সেদিন থেকেই চুলচেরা কোন ভুল দেখলে তাঁর মাথা খারাপ হয়ে যায়। তবে কেন যেন কিছুদিন পরপরই এখান থেকে পেশেন্টরা পালানোর মতলব করে। বোধহয় ক্লারার সাইকোথেরাপির চোটে, অনেকেই সেগুলো হজম করতে পারে না।
অফিসার জাস্টিন ম্যাকনিল হতাশ হয়ে পড়ছেন। প্রতিদিন তো কত লোকই হারিয়ে যায়, কতজনকে আর খুঁজে বের করা যায়? এই মিস্টার ফ্রেজার, যে একজন মানসিক রোগী, সে কীভাবে এত সিকিউরিটি ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে গেল? আর যদি গেলই, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কেন? সময় ফুরিয়ে আসছে, খুঁজে না পাওয়া গেলে ঐ ক্লারা ভীষণ ভোগাবে। বুড়ি ডাক্তারের মুখ ছুটলে সামলানো মুশকিল।
সাজানো গোছানো ল্যাবরেটরিটা দেখলে একটা পুলক জাগে মনে। সবকিছু ছিমছাম, কোথাও এক ফোঁটা ধুলোবালি নেই।
কালো স্যুট পড়া লোকটা দরজা ঠেলে ঢুকল। স্যার, আপনার স্যাম্পল এসে গেছে।
ধবধবে সাদা পোশাক পড়া প্রবীণ মানুষটি ঘুরে দাঁড়ালেন, কপালের নীল শিরা দপদপ করছে। মুখে ফুটেছে একটা হাসি, সেই হাসি খুব ক্রূর।
নতুন সাইকেলটা পরখ করে দেখতে পনেরো বছরের কিশোর এন্ড্রু বেরিয়ে পড়েছে। ঢালু পাহাড়ি রাস্তায় তার সাইকেল তরতর করে নেমে যাচ্ছে। খুব ফুর্তি লাগছে তার, একবার চিৎকার করলো সে, হু উ উ উ উ উ।
মূল শহর অনেক পেছনে পড়ে গেছে, সামনে আছে গাছগাছালিতে ঢাকা ক্যানিয়ন। সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছে এন্ড্রু, থামছে না, গতিও কমাচ্ছ না। এই তো জীবন।
এন্ড্রুর বয়সের ছেলেরা বন্ধুবান্ধব নিয়ে ফুর্তি করে, ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু এন্ড্রু খুব একা। তার কোন বন্ধুবান্ধব নেই বললেই চলে। তাই সময় পেলেই সে বেরিয়ে পড়ে ঘুরতে, বনেবাদাড়ে ঘোরার মতো আনন্দের আর কী হতে পারে? এতদিন পুরনো সাইকেলটা নিয়ে ঘুরত সে, এই জন্মদিনে বাবা একটা চমৎকার নতুন সাইকেল কিনে দিয়েছেন, সেটা চালানোর সময় মনে হয় যেন বাতাসে উড়ে যাচ্ছে সে।
অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখে গতি কমাল এন্ড্রু, গাছের নিচে রাস্তার ধারে এক লোক পড়ে আছে উপুড় হয়ে। মাথার হ্যাটটা খানিকটা দূরে পড়ে আছে। এই নির্জন জায়গায় এই লোক এভাবে পড়ে আছে কেন?
সাইকেলটা রেখে এগিয়ে গেল এন্ড্রু, একটা মানুষকে ফেলে তো আর চলে যাওয়া যায় না। লোকটাকে চিত করে শোয়াল সে। অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। শরীরে কোন আঘাতের চিহ্ন নেই।
হ্যালো মিস্টার। ডাকল এন্ড্রু। হ্যালো।
চোখ খুলে গেল লোকটার। অবাক হয়ে গেল এন্ড্রু। ভয় পেয়ে গেল, লোকটার চোখ দুটো টকটকে লাল।
এন্ড্রুর মা বারবারা হাপুস নয়নে কাঁদছেন। এন্ড্রু সকালে সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছে, এখনো ফেরে নি। কোথায় গেল ছেলেটা? একা একা বনেজঙ্গলে ঘুরত, তিনি আগেই আশঙ্কা করেছিলেন, এমন একটা কিছু ঘটবে। কেন যে আগে নিষেধ করেননি!
স্বামী এডওয়ার্ড তাঁকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছেন। ওকে পাওয়া যাবে, নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে, বারবারা। হয়তো কোন বন্ধুর বাসায় গেছে, খবর দিতে ভুলে গেছে।
ওর কোন বন্ধুবান্ধব আছে? স্কুলে ওর ক্লাসে যত ছেলেমেয়ে আছে, সবাইকে ফোন করেছি, কোথাও নেই। কিচ্ছু শুনতে চাই না, আমার ছেলেকে এনে দাও।
এডওয়ার্ড দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। পুলিশে খবর দেয়া হয়েছে, কিন্তু পুলিশে তাঁর কিংবা বারবারা, কারোরই কখনো ভরসা ছিলনা।
“স্পাইস পাবে” বসে গলা ভেজাচ্ছে দুজন লোক, একটা গোল টেবিল দখল করে। একজন স্যুটেড বুটেড, আরেকজনের পরনে জিন্সের প্যান্ট আর হাওয়াই শার্ট। আলাপ করছে দুজন। পাবের বাইরে রাখা আছে একজনের স্যালুন গাড়িটা, আরেকজনের ভাঙাচোরা ঘিয়ে ভাজা একটা মোটরবাইক।
ঐ বুড়ো ডাক্তার তো মহা ধড়িবাজ।
সেটা তো দেখতেই পেলাম।
আমাদের সাথে মামদোবাজি। পুরো পাঁচশো ডলার কম দিয়েছে। আরে, তোর স্যাম্পল দরকার, সেটা তো এনে দিয়েছি। আগে থেকেই কথা ছিল কত টাকা দিবি। এখন কম দিলি কেন?
বলে কীনা একটা স্যাম্পল স্মৃতিভ্রষ্ট, আরেকটা গম্ভীর প্রকৃতির। আমরা কি বায়োডাটা নিয়ে স্যাম্পল আনতে যাই? জানবো কী করে, কে কেমন? ব্যাটা বুড়ো ভাম কোথাকার।
আবার কি চোটপাট। বলে বেগড়বাই করলে পুলিশে খবর দেবে। মায়ের কাছে মামার বাড়ির গল্প। আমাদেরকে পুলিশ চেনায়। পুলিশ ওর পশ্চাদ্দেশ দিয়ে ঢুকিয়ে দেবো। (কথাটা আরও নোংরাভাবে বলল সে, শালীনতা রক্ষার্থে স্টেনোগ্রাফার মরিসন এভাবে লিখেছে।)
বাদ দাও। চিয়ার আপ, ম্যান। ঐ কেস খতম। নতুন কিছু পাওয়া যায় কীনা দেখি। খুঁজলে আরও কাজ পাওয়া যাবে। যে টাকা আছে তাতে বেশ কিছুদিন চলে যাবে। কাল গা ঢাকা দিতে হবে, পুলিশ অনেক সতর্ক হয়ে গেছে। সারা শহরে পাগলা কুকুরের মতো ছোঁকছোঁক করছে।
ঠিক আছে, কাল আমি একদিকে, তুমি আরেকদিকে।
একটু বোস তো, আমি একটু ওদিকটায় যাচ্ছি।
আরে, আবার কোথায় যাচ্ছ?
বোস না, এখুনি চলে আসবো। টেবিল ছেড়ে এগিয়ে যায় সে।
কয়েক সেকেন্ডেই ঘটনা বুঝে যায় অন্যজন। পাবের ঐ কোণায় একটা সুন্দরী মেয়েকে দেখা যাচ্ছে, ব্যাটা ওর সাথে ভাব করতে গেছে। মুখ তেরছা করে হাসি দিল সে, তারপর এক চুমুকে ভদকার গেলাস খালি করে দিল। জিনিস বেশি খাওয়া হয়ে গেছে, হাঁসফাঁস লাগছে। তলপেটে চাপ লাগছে, খালি হয়ে আসি গে, ভাবল সে।
অফিসার জাস্টিন ম্যাকনিল এখন ভয় পাচ্ছেন। তাঁর ফোর্স চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু কেউ মিস্টার ফ্রেজারের কোন খোঁজ দিতে পারেনি। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে আরও একটা নিরুদ্দেশের খবর। একটা পনেরো বছরের ছেলে হাপিশ হয়ে গেছে। উফ, কি যন্ত্রণা। এদিকে বুড়ি ক্লারা মাথার কাছে ঘ্যানরঘ্যানর করেই যাচ্ছে। কোন প্ল্যান কাজে আসছে না, সন্দেহজনক যত জায়গা আছে, সবখানে হানা দিয়েছে তাঁর লোক, কিন্তু কিছু কাজে আসে নি, লাভের মধ্যে ধরা পড়েছে এক ছিঁচকে চোর। ম্যাকনিলের সহকারী ফার্গুসন তো কিছু না জেনেই পিটিয়ে আধমরা করে ফেলেছে, চোর ব্যাটার এক কথা, সে নির্দোষ, জীবনে এক চুরি ছাড়া আর কোন পাপ করেনি সে। এখন নাকে চারটা স্টিচ নিয়ে বসে আছে চোরটি, পেটা শরীরের ব্যায়ামবীর ফার্গুসনের মার কঠিন জিনিস।
মানুষের প্রাইভেসি আজকাল খুব বেশি। লাল রঙয়ের একটা হাফপ্যান্ট পরে ঘরে বসে ছিল এক বুড়ো, লাঠি হাতে তেড়ে এসেছিল পুলিশ দেখে, তিনি পালিয়ে বেঁচেছেন। দিনকাল বড় খারাপ পড়েছে, পুলিশ পর্যন্ত পরোয়া করে না পাবলিক।
কোথায় হারিয়ে গেছে মানুষদুটো? এদিকে সারাদিনে কোন রেস্ট নিতে পারেন নি তিনি, মাথা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে পড়ছে। এসব কাঁহাতক আর সহ্য হয়?
সাদা এপ্রন পড়া বৃদ্ধ হা হা করে হেসে উঠলেন, ল্যাবরেটরি কাঁপিয়ে। এতদিনের কষ্ট বৃথা যায় নি, নিশ্চিত সাফল্যের দিকে এগোচ্ছে। আর মাত্র কয়েকঘন্টা, তারপরেই স্যাম্পলগুলোকে জায়গামত পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। এইভাবে যে লোকগুলো এক্সপেরিমেন্টে সাড়া দেবে তিনি ভাবতেই পারেননি।
ভাগ্য যখন ভালো হয়, তখন সবদিক থেকেই ভালো হতে শুরু করে। একবার চেয়ে দেখলেন তিনি তাঁর গিনিপিগগুলোর দিকে, শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে তারা। জেগে ওঠার আগেই যেখানকার জিনিস সেখানে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে হবে। লোকজন এদেরকে দেখে তাজ্জব বনে যাবে, আড়ালে বসে বসে তিনি সেটা উপভোগ করবেন।
গুটিসুটি মেরে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন মিস্টার ফ্রেজার এবং এন্ড্রু। আয়নাতে নিজেকে দেখলেন বৃদ্ধ, কপালের শিরাটা গভীর নীল।
সেই দুজন লোক সারারাত বারে ফুর্তি করলো, কাজ হয়ে গেছে, টাকাও পাওয়া হয়ে গেছে, আর বেশীক্ষণ এখানে থাকা উচিৎ হবে না। ভোরের আলো ফুটতেই দুজন বিদায় নিয়ে চলে গেল। রাতারাতি এখান থেকে দূরে চলে যাবে তারা, অনেক দূরে, যাতে পুলিশ টিকিটাও ছুঁতে না পারে। পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হলে আবার ফিরে আসা যাবে, নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করা যাবে। বুড়ো শকুনটা আবার যদি কোন স্যাম্পল ধরে আনতে বলে, তাহলে সেটাই করে দেবে তারা, ক্ষতি কী?
দুদিন পরের সকাল। নাইট ডিউটি পড়েছিল মিলনারের, সকালের শিফটের ডাক্তার জেমস এসে পড়াতে সে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। কাজে ফাঁকি দেবার কোন উপায় নেই, সবসময় ছোঁকছোঁক করে বেড়ায় বুড়ি ডাক্তার ক্লারা। বিকট একটা হাই তুলল সে, এবার বাড়িতে গিয়ে একটা তোফা ঘুম দিতে হবে। সপ্তাহে সপ্তাহে শিফট চেঞ্জ হয়ে যায় তাদের, শরীরে আর কিছু নেই।
চোখ ডলতে ডলতে পার্কিং লটের দিকে যাচ্ছিল সে, তখন দেখল গুড়িসুড়ি মেরে কে যেন পড়ে আছে গাড়িটার সামনে। কে?
দৌড়ে এলো মিলনার। লোকটার নাড়ি টিপে দেখল। না, মরে যায়নি। কাত হয়ে শুয়ে ছিল লোকটা, চিত করে শোয়াতেই চেহারা দেখা গেল। চিনতে পারলো সে, মিস্টার ফ্রেজার।
পরক্ষনেই সে উঁচু গলায় ডক্টর ক্লারাকে ডাকতে লাগলো।
ডক্টর সিম্পসন একটা জার্নাল পড়ছিলেন, অনলাইনে ভালো কাটতি আছে পত্রিকাটার। তিনিও মাঝেমধ্যে আর্টিকেল লেখেন। এমন সময়ে ফোনটা বেজে উঠলো।
হ্যালো, সিম্পসন, আমি ক্লারা।
বল, ক্লারা।
দুটো কেস আছে, আমার মনে হয় তুমি আগ্রহী হবে। দুজন পেশেন্ট অস্বাভাবিক আচরণ করছে।
কারা? সেই যে দুজন হারিয়ে গিয়েছিল, আবার ফিরে এসেছে তারা?
হ্যাঁ। তুমি বুঝলে কী করে?
আন্দাজ করেছি। খানিকটা গোয়েন্দাগিরি করছি আর কি। এখনো তেমন কিছু জানি না। আমার অনুমান সঠিক হলে বলতে পারবো।
বেশ তো। চলে এসো।
মিস্টার ফ্রেজারকে হাসপাতালের পার্কিং লটে খুঁজে পেয়েছিল মিলনার, আর বাসার সামনেই কে যেন ফেলে গিয়েছিল এন্ড্রুকে।
দুজনই সম্পূর্ণ সুস্থ, কোনরকম ক্ষতি হয় নি কারো। অন্তত প্রথমে তাই মনে হয়েছিল। কিন্তু তারপরেই এমন কিছু ঘটেছে, যাতে চিন্তিত হয়ে পড়েছে সবাই। ডক্টর ক্লারা, এন্ড্রুর মা সবাই। ক্লারা তাই ডক্টর সিম্পসনকে তলব করেছেন।
ভালো করে মিস্টার ফ্রেজারকে দেখলেন ডক্টর সিম্পসন, আগাপাশতলা। লোকটার মধ্যে কিছু শারীরিক পরিবর্তন ঘটেছে। ঠোঁটের উপরে দুপাশে রোঁয়ার মতো উঠেছে মিস্টার ফ্রেজারের, কেমন যেন ইঁদুরের গোঁফের মতো লাগছে। আর তিনি মিষ্টি খাবার খেতে চাইছেন শুধু।
এক টুকরো কেক বাড়িয়ে দিলেন ডক্টর সিম্পসন, দু হাতে সেটা টেনে নিলেন মিস্টার ফ্রেজার। সামনের দাঁত দিয়ে কুট করে ভেঙে মুখে পুরলেন, কিচকিচ শব্দ করে খেতে থাকলেন। মানুষ মাড়ির দাঁত দিয়ে খায়, সামনের দাঁত দিয়ে এভাবে চিবোয় না। কী হয়েছে ফ্রেজারের? সারা মুখে খুব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাদামী লোম দেখা যাচ্ছে, মানুষের মুখে এভাবে কখনো লোম ওঠে না। সিম্পসন চিন্তিত মুখে তাকিয়ে থাকেন।
এটা কি কোন অসুখ, সিম্পসন? উদ্বিগ্ন ক্লারা জিজ্ঞেস করলেন।
সেটা তো তোমার জানার কথা, ডক্টর।
আমরা ওর পুরো শরীর এক কথায় স্ক্যান করে ফেলেছি, কোন নতুন ধরণের মাইক্রোঅর্গানিজম, কোন খারাপ ধরণের ব্যাক্টেরিয়া, কিছুই পাই নি। হতে পারে পরিবর্তনটা মানসিক, নয়তো এমন কিছু, যেটা আমরা জানি না।
ঠোঁটের ওপরে এই রোঁয়াগুলোকে কী বলবে?
কাঁধ ঝাঁকালেন ক্লারা। উত্তর জানা নেই তাঁর।
এন্ড্রুর মা, মিসেস বারবারা চোখ মুছলেন। আমার ছেলেকে ফিরে পেলাম, ডক্টর, কিন্তু এ কী হয়ে গেল? কে করলো এমন?
হাত নেড়ে চুপ করতে বললেন ডক্টর সিম্পসন, ভিডিও ফুটেজটার দিকে এখন তাঁর পুরো মনোযোগ।
ভিডিওতে এন্ড্রুকে দেখা যাচ্ছে, নিজের ঘর তছনছ করে ফেলেছে সে। বালিশের তুলো ঘরময় উড়ছে। ভারী আলমারিটা সে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিল, তারপরও থামল না, উল্টে ফেলে দিল। এই বয়সী ছেলের গায়ে এমন আসুরিক শক্তি থাকে না। গরিলার মতো জান্তব আওয়াজ করছে মুখ দিয়ে সে, বুক চাপড়াচ্ছে। ভিডিওতে তার মাকে ঘরে ঢুকতে দেখা গেল, সাথে সাথেই বাধ্য ছেলের মতো সে চুপ করে বসে পড়লো।
ডক্টর সিম্পসন এন্ড্রুকে সামনাসামনি বসিয়ে কথা বলেছেন, সে খুব স্বাভাবিকভাবে জবাব দিয়ে গেছে। ফ্রেজার আর এন্ড্রু, কারোরই মনে নেই, হারিয়ে যাওয়ার পরে তারা কোথায় ছিল, তাদেরকে কী করা হয়েছিল। কেউ তাদেরকে নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করেছে। আর মুছে দিয়েছে তাদের স্মৃতি। কিন্তু কীভাবে?
সিম্পসন বললেন, একবার ওভাবে চিৎকার কর তো এন্ড্রু। যেমনটা দেখলে।
আমি তো এটা পারি না, ডক্টর। শান্তভাবে উত্তর দিল এন্ড্রু। আমি জানিনা, কীভাবে অমন করেছিলাম।
ঠোঁট কামড়াচ্ছেন ডক্টর সিম্পসন, কেউ ফ্রেজার আর এন্ড্রুকে গিনিপিগ বানিয়েছে, একটা খেলা শুরু করেছে তাদেরকে নিয়ে, খুব ভয়ংকর একটা খেলা। সহসা এক অজানা প্রতিপক্ষের সামনে পড়ে গেছে তারা। একটা সন্দেহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, কিন্তু তিনি কাউকে বলতে পারছেন না।
ডক্টর নরিস আর সিম্পসন অনেকদিনের বন্ধু। দুজনের ফ্যাকাল্টি আলাদা। জেনেটিক এঞ্জিনিয়ারিং এর জগতে ডক্টর নরিস, সুপারহিরো চাক নরিসের মতোই পরিচিত নাম। অনেকগুলো পাবলিকেশন আন্তর্জাতিক খ্যাতি কুড়িয়েছে। কাজপাগল এই বৃদ্ধ সবসময় তাঁর এক্সপেরিমেন্টে ডুবে থাকেন, নিউরোসায়েন্সেও তাঁর দক্ষতার কথা সর্বজনবিদিত। কারো তাঁর সাথে দেখা করার অনুমতি নেই। পাগলাটে স্বভাবের জন্যেও খ্যাতি আছে নরিসের।
তবে বন্ধুবর সিম্পসনের কথা আলাদা। তিনি মাঝেমধ্যে এখানে আসেন, কথাবার্তা বলেন। এই সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে নরিসের এত দহরম মহরম কীভাবে হল, সেটা এক রহস্য। এখন দুই বুড়ো ল্যাবরেটরির এক কোণায় বসে বসে দাবা খেলছেন আর ধূমপান করছেন। দুজনের পাইপের ধোঁয়ায় ঘর অন্ধকার, সেদিকে কারো খেয়াল নেই।
ডক্টর সিম্পসন এখন সিরিয়াস মুডে আছেন, অনেকদিন ধরে দাবাখেলায় হারাতে পারেন নি নরিসকে, আজ হারাতেই হবে। সমস্যা হল, নরিসের খেলা একেবারে যন্ত্রের মতো, প্রায় কোন ভুলই করেন না। গত সপ্তাহে একবার বাগে পেয়েছিলেন, কিন্তু বান মাছের মতো পিছলে বেরিয়ে গিয়েছিলেন নরিস, তারপর হাতিটা দিয়েই মাত করে দিয়েছিলেন। সেই থেকে তক্কে তক্কে আছেন সিম্পসন। বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, এইবারে ঘুঘু তোমার বধিব পরান।
মন্ত্রীটা কোণাকুণি তিন ঘর এগিয়ে দিয়ে বললেন সিম্পসন, বললেন, তোমার নতুন এক্সপেরিমেন্টের খবর কী?
ভালো, শেষের পথে। আমাকে তো খুব ঠোঁট উল্টাতে হে, কিন্তু এবার দেখো, আমাকে মানুষ আবার নতুন করে চিনবে।
জেনেটিক ব্যাপারস্যাপার ভালো বুঝি না, জানই তো। কিন্তু তোমার এই জিনিসগুলো খুবই ইন্টারেস্টিং। মস্তিষ্ককে জায়গামত উত্তেজিত করতে পারলে অনেক ভেল্কি দেখানো যায়, কী বল?
অবশ্যই। জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড সি। তা তোমাদের ঐ দুই পেশেন্টের কী অবস্থা?
কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। একজন ইঁদুরের মতো কেক খাচ্ছে, আরেকজন গরিলার মতো বুক চাপড়াচ্ছে।
ইন্টারেস্টিং। যে করেছে সে খুব প্রতিভাবান, স্বীকার করতেই হবে।
তা তো বটেই। তবে খুব বিপজ্জনক। যাদের ওপর এই লোক কাজগুলো করেছে, তাদের মধ্যে ফিজিক্যাল চেঞ্জ আসছে। এটা কোথায় গিয়ে থামবে, থামানোর উপায়ই বা কী, কেউ ধরতে পারছে না। তুমি তো এসব নিয়ে কাজ কর, তুমি কিছু বলতে পারো না?
দাঁতের ফাঁকে পাইপটা কামড়ে ধরেই বললেন নরিস, আমি? হাহ। আরে, একটা জ্যান্ত মানুষ পেলে তো ব্রেন নিয়ে কাজ করতাম, কিন্তু উপায় কী? কুকুর বেড়াল দিয়ে যা করার করেছি। মনের মতো কাজ করার উপায় আছে এই দেশে? কত করে বললাম আমাকে একটা মানুষ জোগাড় করে দাও, টাকাপয়সা যা লাগে আমিই দেবো, শুনলে না তো। তাহলে এখন সাহায্য করতে পারতাম।
হাসলেন সিম্পসন। নরিস প্রায়ই এমন কথা বলেন, পাগল কি আর সাধে বলে লোকে?
হাতিটা পিছিয়ে নিয়ে এলেন নরিস, বসালেন ফার্স্ট র্যা ঙ্কে। হাত কাঁপছে তাঁর।
সিম্পসন গম্ভীর হয়ে গেলেন, দশ মিনিট ধরে গুম মেরে বসে রইলেন। নরিস ভুল করেছে চালে। ভাবনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।
কী হল, তোমার চাল তো। নরিস তাড়া দিলেন।
আচ্ছা নরিস। নড়ে উঠলেন ডক্টর সিম্পসন।
বল।
তোমার ল্যাবে কি আর কেউ ঢোকে?
না তো। কেউ ঢুকলে টুঁটি ছিঁড়ে ফেলবো না?
তোমার এই এক্সপেরিমেন্টের খবর বাইরের কেউ তো জানে না।
আরে দূর। জানলেই কী? কুকুর আর বেড়াল নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট, জেনেও কচুটা করতে পারবে না কেউ।
কিন্তু আমি মনে হয় জানি।
কীভাবে?
আই এম সরি, নরিস। তোমার ল্যাবে একটু গোপনে আমাকে ঢুকতে হয়েছিল।
বলছ কী? কেন?
কিছু সন্দেহের সুতো জোড়া লাগাতে।
কী সব বলছ আবোলতাবোল। আমি কী করেছি?
আমার মনে হয়, ঐ হারিয়ে যাওয়া এবং ফিরে আসা বৃদ্ধ ফ্রেজার এবং টিনএজ ছোকরা এন্ড্রু সম্পর্কে তুমি কিছু জান।
বৃদ্ধ নরিস কেঁপে উঠলেন, টেবিলের ওপাশ থেকেও দেখতে পেলেন ডক্টর সিম্পসন।
সিম্পসনের চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। বলতে লাগলেন তিনি, সবকিছু ঘেঁটে যা বুঝতে পেরেছি, তুমি তোমার এক্সপেরিমেন্টে বড় বেয়াড়া পথে এগিয়েছ। তুমি কুকুর, বেড়াল, গিনিপিগ ব্যবহার করতে। তাতে তোমার চলছিল না, দরকার ছিল একজন মানুষ। সেটার সুযোগ নেই বলে তুমি তাদেরকে যোগাড় করেছিলে। তুমি ব্যবহার করেছো মানুষ।
তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, সিম্পসন।
আমিও সন্দেহ করতে চাই নি, নরিস। কিন্তু তুমি তো মিথ্যে বলছ।
মিথ্যে বলছি?
হ্যাঁ। একটু আগে তুমি একটা ভুল চাল দিয়েছ, ঠিক যখন তুমি বলছিলে একজন মানুষ তোমার এক্সপেরিমেন্টের জন্য দরকার। তুমি ভুল চাল দেবার পাত্র নও। মিথ্যে বলার সময় মানুষের মস্তিষ্ক খুব উত্তেজিত থাকে, তখন দাবা খেলার মতো জিনিসে পুরো মনোযোগ দিতে পারে না। তাছাড়া তোমার হাত কাঁপছিল, নরিস। এসব পরিবর্তনের কারণ মনোবিজ্ঞানীদের জানতে হয়।
অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ডক্টর নরিস।
সিম্পসন বললেন, আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট, নরিস। মানুষ যখন মিথ্যে বলে, তখন আমি বুঝতে পারি। আসল ঘটনা হল, মানুষ তোমার দরকার নয়, মানুষ তুমি ইতোমধ্যে ব্যবহার করে ফেলেছ।
হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছেন ডক্টর নরিস। কপালে দপদপ করছে একটা নীল শিরা। এপ্রনের হাতায় ঘাম মুছে নিলেন।
দাবার বোর্ডের দিকে তাকিয়ে আছেন ডক্টর সিম্পসন। এক মুহূর্ত দ্বিধা করলেন, তারপর নৌকাটা তুলে এনে বসালেন তৃতীয় ফাইলে। বললেন, চেকমেট, নরিস।
নরিস এলিয়ে পড়লেন চেয়ারে। ঠোঁটের ডগা গোল করে শিস দিয়ে উঠলেন ডক্টর সিম্পসন। নিজের আয়নার মতো চকচকে টাকমাথায় হাত বুলোলেন। অনেকদিন পর নরিসকে হারানো গেছে।
পুনশ্চঃ
ডক্টর নরিস একটা বিশাল এক্সপেরিমেন্ট করছিলেন, সেটা সিম্পসন অবশেষে ধরে ফেললেন। মস্তিষ্কের বিভিন্ন জায়গা উত্তেজিত করে মানুষকে দিয়ে অবিকল একটা পশুর মতো কাজ করিয়ে নেয়া যে যায়, এমনকি শক্তিও বাড়িয়ে নেয়া যায় অনেকগুণে, সেটা নরিসেরই আবিষ্কার। তবে তিনি থামতে ভুলে গিয়েছিলেন। মানুষের ওপর তাঁর আবিষ্কৃত সিরামটা ব্যবহার করলে যে ভয়াবহ শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন ঘটবে, সেটা তিনি আমলে আনেন নি।
তবে তাঁর প্ল্যান ছিল পরিষ্কার, ফ্রেজার আর এন্ড্রুকে ভাড়াটে লোক দিয়ে ধরে নিয়ে গেলেও কেউ বুঝতে পারে নি। কে জানতো, দাবাখেলার একটা ভুল চাল নরিসের ভরাডুবি ঘটাবে?
নরিসের ফর্মুলা পাওয়া গেছে ল্যাবেই, গোপন দেরাজে। সেটা দেয়া হয়েছে একদল বিশেষজ্ঞের কাছে, এবং সবসময় খুব দেখেশুনে রাখা হচ্ছে, যাতে খারাপ কারো হাতে না পড়ে। গবেষণাটা শেষ হলে একটা দারুণ ব্যাপার হবে, নিউরোসায়েন্সে একটা নতুন অধ্যায় উন্মোচিত হবে। তবে কাকপক্ষীও যেন জানতে না পারে, সে ব্যাপারে সবাই খুব সজাগ। আর ডক্টর নরিসের কারাবাস নিশ্চিত। তিনি হিসহিস করে বলেছেন, তোমরা আমাকে কাজটা শেষ করতে দাও, তোমরা যা চাও আমি তাই দেবো। মূর্খের দল, তোমরা জান না কী নিয়ে নাড়াচাড়া করছ।
সৌভাগ্যক্রমে ডক্টর নরিসের সেই সিরামের অ্যান্টিডোটও পাওয়া গিয়েছিল। সেটা পরিমিত মাত্রায় প্রয়োগ করে এখন মিস্টার ফ্রেজার আর এন্ড্রুকে সারিয়ে তোলা গেছে। মিস্টার ফ্রেজারের মুখের বাদামী লোম দূর হয়ে গেছে, তিনি এখন আর কুটকুট করে কেক খাচ্ছেন না। আর এন্ড্রুও ঘর তছনছ করছে না। এন্ড্রুর মা-বাবা দুজনেই ডক্টর সিম্পসনকে ধন্যবাদ দিয়েছেন।
ক্লারা? তিনি তাঁর পেশেন্টদের নিয়েই ব্যস্ত আছেন, এই তো কষে ধমক দিলেন মিলনারকে। অফিসার ম্যাকনিল জানাতে এসেছিলেন যে ঐ দুই ভাড়াটে অপহরণকারী ধরা পড়েছে। দূরের দুটো আলাদা আলাদা পাবে দুজনেই পাঁড় মাতাল হয়ে পড়ে ছিল, যখন পুলিশের লোকেরা তাদেরকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে এলো, তখন টেরও পেলো না। পুলিশ যে কিছু করতে পারে, সেটা ক্লারাকে জানানো দরকার মনে করেছেন ম্যাকনিল। এই প্রথম ক্লারা ম্যাকনিলকে বসিয়ে কফি আর কুকিজ খাইয়েছেন।
মিস্টার ফ্রেজারের উন্নতি হচ্ছে, আবছা আবছা অনেককিছু মনে করতে পারছেন। আর এন্ড্রু সাইকেল নিয়ে এখনো বেরিয়ে পড়ে যখনতখন, মায়ের মানা শোনে না। তাই তিনি একটা জিপিএস ট্র্যাকার বসিয়ে দিয়েছেন সাইকেলে, ছেলে যাতে আর হারিয়ে না যায়।
ডক্টর সিম্পসন তাঁর প্র্যাকটিস চালিয়ে যাচ্ছেন। সেই সাথে দাবা খেলাটা আরও ভালোভাবে শিখে নিচ্ছেন। কে জানে, হয়তো ভবিষ্যতে আরও কাজে লাগবে।
………………………………………………(সমাপ্ত)…………………………………………….