১) ঘুম ভাঙার পর কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকা মিনহার প্রতিনিয়তকার অভ্যাস।সে চোখ বন্ধ করে একবার গতকাল রাতের ঘটনাটা মনে করে একটি ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে বসল।পাশেই রায়হান অঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন।মিনহা একবার ভাবল ডেকে তুলবে,দেয়ালে ঝুলনো ঘড়িটার তাকিয়ে আর ডাকলনা।
বাথরুমের আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজের ফোলা চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে নিজেরই খুব মায়া হল।যে রাতে সে কান্না করে ঘুমায়,তার পরের দিন দুপুর অব্দি চোখ দুটো ফুলে থাকে।সে মিষ্টি করে একটু হাসল।তারপর ফ্রেস হয়ে রান্না ঘরের দিকে গেল।রায়হানা আর তার ছোট সংসার।বছর তিনেক হতে চলল তাদের বিয়ে হয়েছে।তারা একে অপরকে ভালোবাসতো বলেই হয়তো পরিবার মেনে নেয়নি।
বাধ্য হয়ে তাদের পালিয়ে বিয়ে করতে হল।পরিণতিতে পরিবার ছাড়তে হল।মিনহা এখন তাদের সকালের নাস্তা আর রায়হানের অফিসের খাবার তৈরি করছে।ঠিক সে মুহূর্তে রায়হান পেছন থেকে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল।মিনহা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল “শুভ সকাল! নাস্তা তৈরি প্রায়।
তুমি ফ্রেস হয়ে এসো,নাস্তা দিচ্ছি”রায়হান তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল “মিনহা দয়া করে তুমি এমন আচরণ করো না! আমি জানি আমি যা করেছি ভালো করিনি।এই দেখো আমি কানে হাত দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করছি” মিনহা দেখল রায়হান সত্যিই কানে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে।মিনহা তার হাতটা নিজেই সরিয়ে দিয়ে বলল “হল অনেক নাটক এখন ফ্রেস হয়ে,নাস্তা করে অফিসে যাও”রায়হান অপরাধবোধের সুরে বলল “তুমি কিভাবে আমাকে ক্ষমা করে দাও এত সহজে?”
-কারণ আমি জানি যা হয়েছে তা তোমার অনিচ্ছায় হয়েছে।
-তুমি কত সহজে সব ভুলে আমাকে ক্ষমা করে দাও।আমি কেন পারি না তোমার মত! কেন তোমার ঠুনকো থেকে ঠুনকো ভুল আমার কাছে বড় হয়ে দাড়ায়।
-কারণ তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসো।তাই চাও আমার সব পারফেক্ট থাক। আর সারাদিন অনেক কাজ করো বলে মাথা ঠিক না।হয়ে যাই এমন।
রায়হান মিনহার গালে হাত দিয়ে বলল “অনেক বেশি লেগেছে তাই না! তাইতো মধ্যরাত অব্দি এমন বাচ্চাদের মতো কেঁদেছ”
মিনহা মিষ্টি হেসে বলল “ভুলে যাও সব” রায়হান তার গালে আলতো ঠোঁট ছুঁইয়ে চলে যাই। মিনহা ভাবে,আদৌ কি রায়হারকে মাফ করতে পেরেছে?
প্রায় কিছুদিন পরপর তাদের মাঝে ঝগড়া হয়,মাঝে মাঝে রায়হান তাকে চলেও যেতে বলে তার জীবন থেকে! আবার পরক্ষনেই বদলে যাই যখন তার মেজাজ ঠাণ্ডা হয়।মাঝে মাঝে তার ইচ্ছে করে কোথাও চলে যেতে।দূরে বহু দূরে! সীমানা ছেড়ে।কিন্তু কি এক অজানা অনুভূতি তাকে আটকে ফেলে।এরই নাম কি ভালোবাসা?
(২)
রায়হান তার জীবনটাকে নিয়ে তুমুল দোটানায় ভুগছে।নাহ! মিনহাকে সে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু কি যেন এক অজানা কারণে সে মিনহার ওপর বিরক্ত। তার মনে হচ্ছে মিনহা সবসময় তার অপর নজরদারি করছে,তাকে তার জীবনটাকে তার মত পার করতে দিচ্ছে না। সিগারেট খেতে দেয় না।মদ খেলেও সমস্যা। আজকাল তেমন খায়না সে! মাঝে মাঝে বন্ধুদের পাল্লায় একটু আধটু মদ খায়।
বাসায় ঢুকলে ত সিগারেট খেতেই পারেনা।কিন্তু এমন তো হয় না! মিনহা ছাড়াও তার নিজস্ব কিছু চিন্তা-ধারা,চাওয়া-পাওয়া এবং আলাদা একটা জীবন আছে। মিনহা যখনই চাইবে তখনই তো সে তাকে সময় দিতে পারবে না।এইতো সেদিন,বন্ধুরা সকলে মিলে পুরোরাত পার্টি করল। সে থাকতে পারেনি।কারণ মিনহা! সে বাসায় একা এবং কলের ওপর কল করে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত তাকে ফিরে যেতে হল। তার জীবনটা যেন আটকে অনেকটা ফাঁদে পরার মত।সে অফিসের ফাইলটা নিয়ে মনোযোগ দেবার চেষ্টা করছিল। এমন সময় মোবাইল বেজে উঠল। স্ক্রিনে মিনহার নামটা দেখে কেন যেন খুব রাগ হল তার। সে কলটা রিসিভ করল না,সাইলেন্ট করে দিল। আজ তার এক কলিগের বাসায় পার্টি।যদিও বউ সহ যেতে বলেছে। কিন্তু সে মিনহাকে নেবেনা। এসব পার্টিতে মদের আয়োজন হয়। মিনহা গেলে ছুঁতেও পারবেনা।
সে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল মিনহা কয়েকবার কল দিয়েছে। সে কল ব্যাক করল।কয়েকবার রিং পরতেই মিনহা কল রিসিভ করে বলল “কল দিয়েছিলাম রিসিভ করনি কেন?”
রায়হান বিরক্ত মেশানো কণ্ঠে বলল “ব্যস্ত ছিলাম”মিনহা কিছু বলল না।
রায়হান বলল “শোন আজ আমার আস্তে দেরি হবে।তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে যেও”
-কেন? কোথায় যাবে?
-একটা পার্টি আছে।
-না গেলে হয় না! প্লিজ যেও না। এই রাতটাই তো যা পাই আমি তোমাকে।বাকি সময় তোমার ব্যস্ততা।একটা যদি বাচ্চা থাকত……
-মিনহা সবসময় এসব কথা ভালো লাগেনা।
-ভালো তো লাগবে না। এখন তো আমি পুরনো হয়ে গেছি। রায়হানের খুব রাগ লাগল মিনহার কথায়। সে বলল “হা! হয়ে গেছ পুরনো। দেখ মিনহা তুমি যেভাবে চাইছ,সেভাবে থাকা সম্ভব না। আমি সব সময় তোমার সাথে আঠার মত লেগে থাকতে পারব না। সবসময় তুমি চাও ফোনে অথবা সশরীরে আমি তোমার সাথেই থাকি। আমার দ্বারা তা সম্ভব না” কথাটা বলেই সে কল কেটে দিল।মিনহা তাকে একটুও বোঝার চেষ্টা করেনা। মেয়েরা আসলেই নির্বোধ।সবসময় চাই সঙ্গীটা তাকে বুঝুক,সঙ্গীটাকে বোঝার চেষ্টা তাদের মধ্যে থাকেনা।
(৩)
মাস কয়েক পর… মিনহার কাছে সব কেমন অসহ্যকর মনে হচ্ছে।রায়হান আর আগের মত নেই।বদলে গেছে অনেক।আগে কত সময় দিত,পাশে পাশে থাকত। এখন শুধু দূরে থাকার চেষ্টা।সবসময় কারণে অকারণে রেগে থাকা।সেদিন রেগে গিয়ে তার গালে চড় দিয়েছিল। আরেকদিন রাতে প্রায় অনেক রাতে মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরেছিল।সেদিনও তার সাথে ঝগড়া হয়েছিল।
প্রায়ই হয়। আজও তার ওপর সামান্য কথায় রাগ করে না খেয়েই অফিসে চলে গেল। মিনহা অনেকবার কলও করেছিল তার মোবাইলে,শেষবার রিসিভ করে অনেকটা ঝাঁজালো কণ্ঠে রায়হান তাকে বলল “কি ব্যাপার! এভাবে প্রতি সেকেন্ডে কল দিয়ে বিরক্ত করছ কেন? আমি এখানে বসে থাকি না, আমাকে কাজ করতে হয়।আমাকে আর বিরক্ত করো না, প্লিজ” কথাগুলো বলেই রায়হান লাইন কেটে দিল। একবার জানতে চাইল না,তার কি বলার ছিল।মিনহার খুব মন খারাপ হল। রাগও হোল খুব। মানুষটা কি তাকে বুঝতে পারেনা? আজ তাদের বিবাহিত জীবনের তিনবছর পূর্ণ হল। আর রায়হানের দিনটির কথা মনেই নেই।
সে পুরো দিন এই ছোট্ট ঘরটায় একা একা থাকে।কখনো টিভির সামনে বসে অযথায় চ্যানেল ঘোরায় অথবা লেপটপ নিয়ে নেটে বসে থাকে। এতেই কি মানুষের জীবনের সব মিটে যাই? নেই ভালোবাসার সঙ্গ না আমেজ।সম্পর্কের মাঝে অপরিসীম দূরত্ব। অনেক দিন ধরেই মিনহার শরীরটা ভাল নেই,রায়হানের তুমুল ব্যস্ততার কারণে তাকে কিছু বলতে পারছে না।রায়হান বরাবরই উদাসীন যত্নআত্তির ব্যাপারে। প্রথম প্রথম অনেক খারাপ লাগত মিনহার, পরে সামলে নিয়েছে নিজেকে অনেকটা। সে জানে,মানুষটাকে সে কখনো বদলাতে পারবেনা।মিনহা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, মোবাইলটা হাতে নিয়ে রায়হানকে ম্যাসেজ পাঠিয়ে দিল “আজ আমাদের তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকী…আর এই স্পেশাল দিনটার কথায় তুমি ভুলে গেলে…ভাল!
আজকের দিনটা তোমার সাথে সুন্দরভাবে কাটাতে চেয়েছি,দিলেনা” অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল মিনহা, কিন্তু রায়হান ম্যাসেজ বেক করল না। এরপর সে আর অপেক্ষা করল না।একটা ছোটো চিঠি লিখল রায়হানকে। তারপর সে তৈরি হয়ে নিল। ঘর থেকে বেড় হবার সময় ড্রইংরুমের দেওয়ালে ফ্রেমে বাঁধা যুগল ছবিটায় তার চোখ আটকে গেল। চোখ থেকে পানি পরতেই সে তা সামলে নিয়ে নিজেকেই যেন বলল “আজ এই ছবিও আমায় দেখে উপহাস করছে!” তারপর সে টেবিলে মোবাইল চিঠি আর একটা খাম একসাথে রেখে বেড়িয়ে গেল।
(৪)
মিনহা কখনো দেরীতে দরজা খোলেনা।এক কি দুবার বেল দিতেই খুলে।কিন্তু আজ খুলছে না। আজ তার আসতেও দেরী হয়ে গেছে অনেক। কিছু হয়নি তো? তার হাতে ল্যাপটপের ব্যাগ,ফুল,শাড়ীর প্যাকেট আর কেক। তাই মিনহার মোবাইলে কলও দিতে পারছেনা। এসব মাটিতে রাখবে কিনা ভাবছে,তখন তার মনে পরল,তার কাছে ঘরের চাবি আছে।জিনিসগুলো মাটিতে রেখেই সে দরজা খুলল।অনেক দিন ধরেই মিনহার সাথে তার সম্পর্কটা ভাল যাচ্ছেনা।তাই আজ সারপ্রাইজ দিতেই মিনহার সাথে দিনটার কথা ভুলে যাওয়ার অভিনয় করেছে।
নিজের ব্যর্থতাই সে মিনহাকে কষ্টই দিয়েছে। আজ সে বুঝতে পেরেছ জীবনে তার যা সফলতা মিনহার সঙ্গ,বিশ্বাস এবং ভালোবাসা না থাকলে তা অর্জন হতোনা। তাই তাকে খুশি করার প্রচেষ্টা।ঘরে ঢুকে সে খুব অবাক হল।মিনহা নেই,ঘর খালি। সে পুরো ঘরে মিনহাকে খুজল। বেডরুমেও মিনহা নেই।ভাবল সে হয়তো বাইরে গেছে। কিন্তু এতো রাতে! এই সময় সে তো কোথাও যেতে পারেনা।
তারপর সে পকেট থেকে মোবাইলটা বেড় করে মিনহার নাম্বারে কল দিল।মোবাইল রিং হচ্ছে কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। টেনশনে তার শরীর বেয়ে ঘাম ঝরছে। একটু পর তার মনে হল,মোবাইলটা ঘরেই রিং হচ্ছে। সে শব্দ শুনে ড্রইংরুমের টেবিলে মোবাইলটা দেখতে পেল।একটা কাগজ আর খাম চাপা দেওয়া। কাগজ টা খুলে দেখল রায়হান।
মিনহা তাকে লিখেছে – রায়হান।, এমন অনেক সময় ছিল,আমাদের স্পেশাল দিনগুলো অনেক সুন্দরভাবে পালিত হত। আমাদের একে অপরকে সারপ্রাইজ দেওয়াটাই ছিল আনন্দের। শত কাজ থাকলেও একটা ম্যাসেজ অন্তত করতে। আর এখন এমন দিন তোমার কাছে আমি তাচ্ছিল্যের এবং অবজ্ঞার। তোমার কাছে আমার জন্য সময় নেই।মুখের ওপর আমাকে বিরক্তিকর বলাতেও আটকায় না।আমি তোমাকে ভালোবাসি।
তাই সবসময় তোমাকে ক্ষমা করেছি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে,আমি আর পারব না এই অবজ্ঞা সহ্য করতে। আমি চলে যাচ্ছি।জানিনা কোথায় যাব।বাবা তার বাড়িতে আমায় গ্রহণ করবে না। তোমায় ভালোবেসে বিয়ে করার অপরাধে। কিন্তু তুমি আমায় এতদিন কোন অপরাধের শাস্তি দিলে? ভেবেছিলাম তোমার সামনে থেকে তোমাকে উপহার দেব।তা পারলাম না। খামে ভরাআছে,দেখে নিও।
মিনহা রায়হানের কাছে সব কেমন দুঃস্বপ্নের মত মনে হচ্ছে।সে বুঝতে পারছেনা কি করবে। এই মুহূর্তে তার কি করা উচিৎ। কোথায় খুঁজবে সে মিনহাকে?খামটা চোখে পরতেই তা খুলল সে। খামের ভেতরে রাখা কাগজটা বেড় করে পড়তেই রায়হানের মনে হল সে তার সবকিছু হারিয়ে ফেলেছে। খামে ভরা মিনহার প্রেগনেন্সি রিপোর্ট।রায়হান ডুকরে কেঁদে উঠল।
“মিনহা আমাকে ক্ষমা করে দাও প্লিজ।তুমি ফিরে এসো।আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবনা।প্লিজ মিনহা” রায়হান দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে।আজ তার মনের আত্মশুদ্ধি হলনা।