ঘরঘর করে ধাতব দরজাটি নেমে এসে আমাকে ল্যাবরেটরির ভৌতিক কক্ষে আটকে ফেলল। বের হবার অনেক কয়টি দরজা আছে, সেগুলি খোলা না থাকলেও প্রবেশপথে সুইচ প্যানেলের সামনে অপেক্ষমাণ রবোটটিকে বললেই আমাকে বের করে দেবে। কিন্তু তবুও কেন জানি আমার মনে হল আমি খুব বিপদে পড়ে গেছি। আর দশ মিনিটের ভিতরে এই ল্যাবরেটরি-কক্ষে যে অস্বাভাবিক পরীক্ষাটি চালানো হবে, তাতে যো-পরিমাণ তেজস্ক্রিয় রশ্মি বের হবে তার লক্ষ ভাগের এক ভাগ একটি শক্তিশালী ঘোড়াকে এক সেকেণ্ডের ভিতর মেরে ফেলতে পারে। কাজেই দশ মিনিটের আগেই আমাকে এখান থেকে বেরিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে হবে। আমি ইমার্জেন্সি এক্সিট দিয়ে বের হবার জন্যে ল্যাবরেটরির অন্য পাশে চলে এলাম। দশ মিনিটের এখনো অনেক দেরি, কিন্তু আমি একটু উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। লক্ষ কালাম, ইমার্জেন্সি এক্সিটের হ্যান্ডেল ধরার সময় আমার হাত অল্প কাঁপছে।
হ্যান্ডেলে চাপ দেয়ার পূর্বমূহুর্তে আমার মনে হল দরজাটি খোলা যাবে না। কেন মনে হয়েছিল জানি না, এরকম মনে হওয়ার পিছনে কোনো যুক্তি নেই। কিন্তু যখন বারবার হ্যান্ডেল ঘুরিয়েও দরজাটি খুলতে পারলাম না, তখন কেন জানি মোটেই অলাক হলাম না। মৃত্যুভয় উপস্থিত হলে হয়তো অবাক হওয়া বা দুঃখিত হওয়ার মতো সহজ অনুভূতিগুলি থাকে না। আমি লাভ নেই জেনেও ল্যাবরেটরির সব কয়টি দরজা ধাক্কা দিয়ে দেখলাম। পরীক্ষাটি বিপজ্জনক, তাই এগুলি অনেক আগেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আমার ধারণা হয়েছিল, ইমার্জেন্সি এক্সিটটি সত্যিকার ইমার্জেপির সময় ব্যবহার করতে পারব, কিন্তু এখন দেখছি। এটিও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
ল্যাবরেটরির মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি মাথা ঠাণ্ড করার চেষ্টা করলাম। ভীষণ উত্তেজিত হয়ে উঠেছি—কোনো উপায় নেই, মারা যাচ্ছি-এই ধরনের চিন্তা, হতাশা আর আতঙ্ক আমাকে স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করতে দিচ্ছিল না। আমি নিজেকে বোঝালাম, হাতে খুব কম সময়, এখান থেকে বের হতে না পারলে মারা যাব, আর বের হতে হলে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। আমার মনে হল রবোটটিকে বুঝিয়ে বললে আমাকে বের করে দেবে। এখনো রবোটকে কিছু না বলেই হতাশ হয়ে যাবার কোনো অর্থ নেই।
আমি কয়েকটা মোড় ঘুরে ল্যাবরেটরির শেষ ঘরটিতে পৌঁছলাম। এখানে একটি ছোট্ট ফুটো আছে। সেদিক দিয়ে মাথা বের করে পাশের ঘরে তাকানো যায়। পাশের ঘরটিতেই একটি অতিকায় রবোট একরাশ সুইচের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মাথার কাছে টিকস্-টিক টিকস্-টিক করে একটা ইলেটনিক ঘড়ি সময় ঘোষণা করে যাচ্ছে। প্ৰতি তিন সেকেণ্ড পরপর একটা লাল আলো বিলিক করে। সারা ঘরকে আলোকিত করছিল। সব কিছু ছাপিয়ে একটা মৃদু গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। আমি উচ্চৈঃস্বরে ডাকলাম
এই, এই রবোট। রবোটটির নাম আমার মনে নেই। সেটি মাথা তুলে তাকাল। বলল, কি?
আমি গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম। বললাম, আমি ভিতরে আটকা পড়ে গেছি। ইমার্জেন্সি দরজাটা খোল তো।
সম্ভব নয়। রবোটটির এই নির্বোধ অথচ নিষ্ঠুর উত্তর শুনে আমি শিউরে উঠলাম। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, ওকে হাজার যুক্তি দেখিয়েও টলানো যাবে না। এইসব রবোট বহু পুরানো আমলের। মানুষের শরীর যে রবোটের মতো যান্ত্রিক নয়, স্বাভাবিক অবস্থায় অতি অল্প তারতম্যেই যে মানুষ মারা যেতে পারে এবং মানুষের মৃত্যু যে মোটেই আর্থিক ক্ষতি নয়—একটা মারাত্মক মানবিক বিপর্যয়, এই ধারণা এইসব রবোটের কপোট্রনে দেয়া হয় নি। এই রবোটটি নির্বিকারভাবে আমাকে এখানে আটকে রাখবে এবং আমার মৃত্যু তার কপোট্রনের চৌম্বকক্ষেত্রে এতটুকু আলোড়নের সৃষ্টি করবে না।
আমি আবার কথা বলতে গিয়ে অনুভব করলাম, আমার গলা শুকিয়ে গেছে। শুকনো গলাতেই বললাম, তুমি আমাকে বের হতে না দিলে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে
কী ক্ষতি?
আমি মারা যাব।
মানে?
তোমার কপোট্রনটি ভেঙে ফেললে তোমার যে-অবস্থা হয়, আমার সেই অবস্থা হবে।
তাহলে খুব বেশি টাকা ক্ষতি হবে না। কিন্তু আপনাকে বের করতে হলে বিভাট্রনটি বন্ধ করতে হবে, ছটা ট্রান্সফর্মার থামিয়ে দিতে হবে, সবগুলি ফিল্ম এক্সপোজাড্ হয়ে যাবে, অর্থাৎ সব মিলিয়ে ছয় হাজার নব্বই টাকা নষ্ট হয়ে যাবে। সেই তুলনায় আপনার মূল্য মাত্র চার শ আশি টাকা।
চার শ আশি টাকা?
হ্যাঁ। মানুষের শরীর যেসব বায়োকেমিক্যাল কম্পাউন্ড দিয়ে তৈরী, খোলা বাজারে তার সর্বোচ্চ মূল্য চার শ আশি টাকা।
অসহ্য ক্ৰোধে আমি দাঁত কিড়মিড় করতে লাগলাম। এই নির্বোধ রবোটটিকে আমি কীভাবে বোঝাব যে চার শ আশি টাকা বাঁচানোর জন্যে নয়, আমাকে বাঁচানোর জন্যই আমার এখান থেকে বের হওয়া দরকার। একটা মানুষের মূল্য শুধুমাত্র পার্থিব মূল্য নয়, তার থেকেও বেশি কিন্তু তাকে সেটা কে বোঝাবে? অল্প কিছু কীরিগরি জ্ঞান আর তৃতীয় শ্রেণীর যুক্তিতর্ক ছাড়া এটি আর কিছু বোঝে না। তবু আমি আশা ছাড়লাম না। রবোটটিকে ডাক দিলাম, এই, শোন।
বলুন।
আমি এখান থেকে বের হতে না পারলে মারা যাব।
জানি।
আমি মারা গেলে এই এক্সপেরিমেন্টটার কোনো মূল্য থাকবে না। আর কেউ এর ফলাফল বুঝতে পারবে না।
জানি।
কাজেই আমাকে বের হতে দাও।
আমাকে বলা হয়েছে। আমি যেন সবচেয়ে কম ঝামেলায় এই পরীক্ষাটি শেষ করি। এর ফলাফল নিয়ে কী করা হবে না-হবে সেটা জানা আমার দায়িত্ব নয়! আমি ভেবে দেখেছি, সবচেয়ে কম ঝামেলা হয় আপনাকে ভিতরে আটকে রাখলে। আপনাকে বের করতে হলে আবার নতুন করে সব শুরু করতে হবে। সেটি সম্ভব নয়, কাজেই আপনি ভিতরেই থাকুন—আপনার মৃত্যুতে খুব বেশি একটা আর্থিক ক্ষতি হবে না।
ইডিয়ট—আমি তীব্র স্বরে গালি দিলাম, সান অব এ বিচ!
আপনি অর্থহীন কথা বলছেন। রবোটটির গলার স্বর একঘেয়ে যান্ত্রিকতায় নিষ্প্রাণ।
আমি ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলাম। এখন কী করতে পারি? এই বিরাট ল্যাবরেটরির অতিকায় যন্ত্রপাতির ভিতর আমি একান্তই অসহায়। হতাশায় আমি নিজের চুল টেনে ধরলাম।
তক্ষুনি নজরে পড়ল, এক কোণায় ঝোলানো টেলিফোন। ছুটে গিয়ে রিসিভার তুলে নিলাম, হ্যালো, হ্যালো।
কে? প্রফেসর?
হ্যাঁ। আমি ল্যাবরেটরিতে আটকা পড়ে গেছি।
আমরা বুঝতে পেরেছি। আপনাকে বাইরে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে, কিন্তু কিছু করতে পারছি না। সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে রবোট।।
রবোটের কানেকশন কেটে দাও।
ওটার কোনো কানেকশন নেই—একটা পারমাণবিক ব্যাটারি সোজাসুজি বুকে লাগানো।
সর্বনাশ! তা হলে উপায়?
আমরা দেখি কী করতে পারি। ঘাবড়াবেন না।
রিসিভারটি ঝুলিয়ে রেখে আমি বিভাট্রনে হেলান দিলাম। একটা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণের ভিতর পরীক্ষাটি শুরু হবে। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, আমি মারা যাচ্ছি। রবোটটিকে বিকল করা সম্ভব নয়। রবোটটিকে বিকল না করলে এই পরীক্ষাটি বন্ধ করা যাবে না। আর এই পরীক্ষাটি বন্ধ না হলে আমার মৃত্যু ঠেকানো যাবে না।
সময় ফুরিয়ে আসছে, আমার ঘড়ি দেখতে ভয় করছিল। তবু তাকিয়ে দেখলাম আর মাত্র ছয় মিনিট বাকি। ছয় মিনিট পরে আমি মারা যাব। আমার স্ত্রী বুলা কিংবা ছেলে টোপন জানতেও পারবে না। আর ইঁদুরের মতো ব্যাবরেটরির ভিতর আটকা পড়ে মারা গেছি!
আমার শেষবারের মতো বুলাকে একটা ফোন করতে ইচ্ছে হল। ফোন তুলে ডায়াল করতেই বুলার কণ্ঠস্বর শোনা গেল, হ্যালো।
কে? বুলা?
হ্যাঁ।
শোন—ঘাবড়ে যেও না। আমি একটা ভীষণ বিপদে পড়ে গেছি।
কি? বুলার স্বর কেঁপে গেল।
ল্যাবরেটরিতে আটকা পড়ে গেছি। বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। রবোটটি এত নির্বোধ, আমাকে বের হতে দিচ্ছে না। এক্সপেরিমেন্ট বন্ধ করতেও রাজি নয়। আর ছয় মিনিট পরেই ভয়ানক রেডিয়েশান শুরু হয়ে যাবে। একেবারে সোজাসুজি মারা যাচ্ছি।
বুলা একটা আর্তচিৎকার করল।
কী আর করা যাবে-টোপনকে দেখো। আমার গলা ধরে এল, তবু স্বাভাবিক স্বরে বললাম, বাইরে অবশ্যি সবাই খুব চেষ্টা করছে আমাকে বের করতে। লাভ নেই—
প্ৰাণ-গোন-বুলা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল।
কী?
তোমাদের রবোটটি কী ধরনের?
বাজে। একেবারেই বাজে। পি-টু ধরনের।
যুক্তিতর্ক বোঝে?
বোঝে। তবে তৃতীয় শ্রেণীর লজিক খাটায়।
তা হলে একটা কাজ করে।
কি?
রবোটটিকে বল, আমি মিথ্যা কথা বলছি।
মানে?
বুলার কণ্ঠস্বর অধৈর্য হয়ে ওঠে। কাঁপা কাঁপা গলায় দ্রুত বলল, রবোটটার সামনে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে বল, আমি মিথ্যা কথা বলছি। অর্থাৎ তুমি বলবে যে তুমি মিথ্যা কথা বলছ।
লাত?
আহা! বলেই দেখি না। দেরি করো না।
আমি ল্যাবরেটরির শেষ ঘরে পৌঁছে আবার ছোট্ট ফুটোটা দিয়ে মাথা বের করলাম। নির্বোধ ধাতব রবোটটি স্থির হয়ে হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ডাকলাম, এই, এই রবোট।।
বলুন।
আমি স্পষ্ট স্বরে থেমে থেমে বললাম, আমি মিথ্যা কথা বলছি।
রবোটটি দু-এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বিড়বিড় করে বলল, আপনি বলছেন আপনি মিথ্যা কথা বলছেন; কাজেই আপনার এই কথাটি মিথ্যা। অর্থাৎ আপনি সত্যি কথা বলছেন। অথচ আপনি বললেন, আপনি মিথ্যা কথা বলছেন। অর্থাৎ আপনার এই কথাটিও মিথ্যা। আপনি সত্যি কথাই বলছেন। কিন্তু আপনি বলছেন, আপনি মিথ্যা কথা বলছেন—কাজেই একথাটিও মিথ্যা। আপনি সত্যি কথাই বলছেন। অথচ আপনি মিথ্যা কথা বলছেন…অর্থাৎ সত্যি কথাই বলছেন…মিথ্যা কথা বলছেন…সত্যি কথা বলছেন…
রবোটটি সেইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে একবার বলতে লাগল, আপনি সত্যি কথা বলছেন, পরমুহূর্তে বলতে লাগল, মিথ্যা কথা বলছেন। এই ধাঁধাটি মিটিয়ে না দেয়া পর্যন্ত এটি সারা জীবন এইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে বিড়বিড় করে পরস্পরবিরোধী কথা বলতে থাকবে। আমার বুকের ওপর থেকে একটা পাথর নেমে গেল।
ল্যাবরেটরির ভিতরে এসে শুনলাম ঝনঝনি করে ফোন বাজছে। রিসিভার তুলতেই বুলা চেঁচিয়ে উঠল, কী হয়েছে?
চমৎকার। গাধা রবোটটা ধাঁধায় পড়ে গেছে। বুলা, তুমি না থাকলে আজ একেবারে মারা পড়তাম। কেউ বাঁচাতে পারত না।
রিসিভারে শুনতে পেলাম বুলা ঝরঝর করে কেন্দে ফেলল। সত্যি আমি বুঝতে পারি না, আনন্দের সময় মানুষ কেন যে কাঁদে!
বাইরে তখন লেসার বীম দিয়ে ইমার্জেন্সি এক্সিটটি ভাঙা হচ্ছে। রবোটটির ধাঁধা না মেটানো পর্যন্ত ওটা পরীক্ষা শুরু করতে পারবে না। হাতে অফুরন্ত সময়।
আমি বিভাট্রনে হেলান দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। তারপর একটা সিগারেট ধরালাম, এখানে সিগারেট ধরানো সাংঘাতিক বেআইনি জেনেও।
ল্যাবরেটরির করিডোর ধরে কে যেন হেঁটে আসছিল। পায়ের শব্দ শুনে বুঝরে পারলাম ৫টি একটি রবোট-মানুষের পায়ের শব্দ এত ভারী আর এরকম ধাতব হয় না। অবাক হবার কিছু নেই। এই ল্যাবরেটরিতে সব মিলিয়ে দু শর উপর রবোট কাজ করছে। শুধুমাত্র গাণিতিক বিশেষজ্ঞ রবোটই আছে পঞ্চাশটি। এ ছাড়া যান্ত্রিকবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, পরমাণুবিষয়ক বিদ্যা ইত্যাদি তো রয়েছেই। এরা বিভিন্ন প্রয়োজনে অহরহ এখান থেকে সেখানে হেঁটে বেড়াচ্ছে। মানুষের মতো সাবলীল ভঙ্গিতে লিফট বেয়ে উঠে যাচ্ছে, সিঁড়ি বেয়ে নামছে, দরজা খুলে এ-ঘর থেকে সে-ঘরে কাজ করছে। কাজেই করিডোর ধরে কোনো রবোট যদি হেঁটে আসে, তাতে অবাক হবার কিছু ছিল না। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছিলাম। এই রবোটটির বিশেষ ধরনের পায়ের শব্দ শুনে। প্রতিটি পদশব্দ হবার আগে একটা হাততালি দেবার মতো শব্দ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল প্রতিবারই মেঝেতে পা রাখার আগে রবোটটি একবার করে হাতে তালি দিয়ে নিচ্ছে। আমি ভারি অবাক হলাম।
কিছুতেই যখন এই বিচিত্র পদশব্দের কোনো সমাধান বের করতে পারলাম না, তখন ভীষণ কৌতূহলী হয়ে ঘরের দরজা খুলে করিডোরে এসে দাঁড়ালাম। যে-দৃশ্য আমার চোখে পড়ল তাতে আমার রক্ত শীতল হয়ে গেল। প্রাচীন আমলের একটি অতিকায় গাণিতিক রবোট করিডোর ধরে হেঁটে আসছে। হাঁটার সময় প্রতিবারই যখন তার পা মেঝের ছয় ইঞ্চির কাছাকাছি নেমে আসছিল, তখনই একটি অতিকায় নীলাভ বিদ্যুৎফুলিঙ্গ সশব্দে পা থেকে ছুটে গিয়ে মেঝেতে আঘাত করছিল। এর শব্দটিই আমার কাছে হাততালির শব্দ মনে হচ্ছিল। শুধু পা নয়, রবোটটির হাত দুটি ধাতব শরীরের যেখানেই স্পর্শ করছিল, সেখানেই কড়কড় করে বিদ্যুৎফুলিঙ্গ ছুটে যাচ্ছিল। রবোটটি এসব বিষয়ে নির্বিকার। আমি আতঙ্কিত হয়ে অনুভব করলাম, এই বিদ্যুৎফুলিঙ্গের জন্যে করিডোরে ওজেনের আঁশটে গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
আমার মাথায় দুটি চিন্তা খেলে গেল। প্রথমত, এই রবোটটির কপোট্রনের উচ্চচাপের বিদ্যুৎ সরবরাহকারী তারটি কোনোভাবে ধাতব শরীরের কোথাও স্পর্শ করে ফেলেছে। ফলে পুরো রবোটটিই বিদ্যুতায়িত হয়ে গেছে। এই বিদ্যুতের চাপের পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লক্ষ ভেন্টের মতো। দ্বিতীয়ত, এই রবোটটিকে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে যে-ই স্পর্শ করুক, সে-ই মারা যাবে।
আমি বুঝতে পারলাম কোনো সর্বনাশ ঘটানোর আগে এই রবোটটিকে থামান দরকার-যে-কোনো মূল্যে।
দরজায় দাঁড়িয়ে আমি চিৎকার করে ডাকলাম, হেই, হেই রবোট।।
রবোটটি বিদ্যুৎ চমকাতে চমকাতে ফুলিঙ্গ ছড়াতে ছড়াতে আমার দরজার একেবারে সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, কি?
আমি ছিটকে ঘরের ভিতরে সরে এলাম। সবসময় এই রবোটটি থেকে কমপক্ষে পাঁচ-ছয় হাত দূরে থাকা দরকার। বুঝতে পারলাম কোনো-একটা ক্রটি ঘটিয়ে এটির সারা শরীর বিদ্যুতায়িত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কপোট্রনটি ঠিকই আছে। রবোটটি আবার বলল, কি?
আমি ঘরের ভিতর থেকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার কী হয়েছে?
কিছু হয় নি। বলে রবোটটি দাঁড়িয়ে রইল।
তুমি টের পাচ্ছ না যে তোমার সারা শরীর ইলেকটিফাইড হয়ে গেছে?
না।
কোথায় যাচ্ছ?
দু, শ এক নাম্বার রুমে।
আমার মনে পড়ল দু শ এক নাম্বার রুমে এক্সরে ডিফ্লেকশান নিয়ে কাজ চলছে। নিরাপত্তার জন্যে সারা ঘর সীসা দিয়ে ঢাকা। সীসা বিদ্যুৎ পরিবাহী, কাজেই রবোটটি সে—ঘরের দরজা স্পর্শ করা মাত্র সমস্ত ঘর, যন্ত্রপাতি বিদ্যুতায়িত হয়ে যাবে। মূল্যবান যাত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাবার কথা ছেড়েই দিলাম-বিভিন্ন কাজকর্মে ব্যস্ত তরুণ বিজ্ঞানী কয়জন, টেকনিশিয়ানরা সবাই কিছু বোঝার আগেই মারা পড়বে। আমি নিজের অজান্তে শিউরে উঠলাম। এটিকে যেভাবেই হোক থামাতে হবে।
তোমার সেখানে যাওয়া চলবে না।
আমাকে যেতে হবে। বলে রবোটটি ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল। আমার মনে পড়ল, এই প্রাচীন রবোটটির যুক্তিতর্কের বালাই নেই। একে যে-আদেশ দেয়া হয়, সেটি পালন করে মাত্র। এখন ও নিশ্চিতভাবে দু, শ এক নাম্বার কক্ষে হাজির হবে। আমি আবার চিৎকার করে ডাকলাম, রবোট, হেই রবোট।
রবোটটি থামল। তারপর আবার ঘুরে আমার দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। আমি কপালের ঘাম মুছে বললাম, তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।
বলুন।
কিন্তু আমি কী বলব? এমন কোনো কথা নেই যেটি বলে ওকে নিবৃত্ত করা সম্ভব। একমাত্র জটিল গাণিতিক সমস্যা দিয়েই এটিকে আটকে রাখা যায়, কিন্তু এই মুহূর্তে সেরকম সমস্যা আমি কোথায় পাব? আমার মাথায় পদার্থবিদ্যার হাজার হাজার সমস্যা ঝিলিক দিয়ে গেল, কিন্তু তার একটিও একে বলার মতো নয়। এটির যুক্তিতৰ্ক নেই—নীরস একঘেয়ে হিসেবই শুধু করতে পারে। বড় গুণ-ভাগ দেয়া যেতে পারে, কিন্তু সেটি তো মুহূর্তে সমাধান করে ফেলবে। আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠল। রবোটটি আবার আমাকে তাগাদা দিল, বলুন।
তারপর সে আমার ঘরে ঢুকে পড়ল। আমার কাছাকাছি পৌঁছে যেতেই আমি চিৎকার করে ওকে থামতে বললাম, থাম। দাঁড়াও।
রবোটটি দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, বলুন কী বলবেন।
কিন্তু আমি কী বলব? এই করিডোর দিয়ে কদাচিৎ কেউ যাতায়াত করে। আমি যে অন্য কারো সাহায্য পাব, তারও ভরসা নেই। হাত বাড়ালেই অবশ্যি ফোন স্পর্শ করতে পারি। ফোন করে আমি ওদেরকে সতর্ক করেও দিতে পারি। আমাকে ফোনের দিকে হাত বাড়াতে দেখলেই রবোটটি ঘুরে তার যাত্রাপথে রওনা দেবে। দু শ এক নাম্বার কক্ষে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়ার আগেই রবোটটি সেখানে পৌঁছে যাবে। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার, এই যুক্তিতর্কহীন নির্বোধ রবোটটিকে কেউ থামাতে পারবে না। এ ছাড়াও আমার দ্বিতীয় বিপদটির কথা মনে হল। রবোটটি নিশ্চিতভাবে লিফট ব্যবহার করবে। বিদ্যুৎপরিবাহী হালকা অ্যালুমিনিয়ামের তৈরী লিফটে পা দেয়ার সাথে সাথে পুরো লিফটু বিদ্যুতায়িত হয়ে যাবে। সাথে সাথে লিফটের সব কয়জন যাত্রী মারা যাবে। আমি অনুভব করলাম, আমার গলা শুকিয়ে এসেছে।
কী বলবেন। রবোটটি আবার তাগাদা দিল।
আমি শুকনো ঠোঁট জিব দিয়ে ভিজিয়ে নিলাম। বললাম, দু, শ এক নাম্বার রুমে যাবার আগে আমার একটি অঙ্ক করে দাও।
বেশ, কী অঙ্ক?
এখন ওকে কী অঙ্ক করতে দিই? বললাম, একটু অপেক্ষা কর। ভেবে ঠিক করে নিই।
বেশ।
আমি ভাবতে লাগলাম। এমন কোনো সমস্যা নেই, যা ওকে অনির্দিষ্ট সময় আটকে রাখতে পারে? কিছুদিন আগে ল্যাবরেটরিতে আটকা পড়ে বুলার বুদ্ধিতে একটি রবোটকে বিভ্ৰান্ত করে দিয়েছিলাম। সেটি কাজে লাগবে কি? সে-রবোটটির তৃতীয় শ্রেণীর যুক্তিতর্ক ছিল বলেই বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়া সম্ভব হয়েছিল। এর তো স্থা রকম যুক্তিতর্ক নেই। তবু চেষ্টা করতে দোষ কী? বললাম, আমি মিথ্যা কথা বলছি।
বলুন। আমাকে আশাহত করে এই গবেট রবোটটি ভঙ্গিতে আমার বক্তব্যের পুরো হেঁয়ালিটুকু এড়িয়ে গেল। আমি অসহায়ভাবে ঢোঁক। এখন কী করি?
ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মাথায় বিদ্যুৎচমকের মতো একটি চমৎকার বুদ্ধি খেলে গেল। যদিও এতক্ষণেও কোনো কিছু করতে না পেরে আমি মোটামুটি হতাশ হয়ে পড়েছিলাম, তবুও মনের গোপনে একটি আশা ছিল যে আমার মস্তিষ্ক আমাকে প্রতারণা করবে না নিশ্চয়ই। শেষ মুহূর্তে একটা সমাধান বের করে দেবে। সমাধানটি অতি সরল। রবোটটিকে একটি মজার অঙ্ক করতে দিতে হবে। অন্ধটি এত সাধারণ যে, এতক্ষণ মনে হয় নি দেখে আমি বিক্ষিত হলাম।
আমার সমস্ত দুশ্চিন্তার অবসান ঘটেছে। মন হালকা হয়ে গেছে। হাসিমুখে ঠাট্টা করে বললাম, তোমাকে যে—অঙ্কটি করতে দেব, সেটি ভীষণ জটিল।
বেশ তো।
নিখুঁত উত্তর চাই।
বেশি।
অন্ধটি সাধারণ রাশিমালার। যতদূর সম্ভব নিখুঁত উত্তর বলবে।
দশমিকের পর কয় ঘর পর্যন্ত?
যতদূর পার।
অঙ্কটি কি?
আমি হাসি চেপে রেখে বললাম, বাইশকে সাত দিয়ে ভাগ করলে কত হয়?
রবোটটি এক মুহূর্তের জন্যে দ্বিধা করল। তারপর বলল, তিন দশমিক এক চার দুই আট পাঁচ সাত…
তারপর?
এক চার দুই আট পাঁচ সাত…এক চার…
বলে যাও।
দুই আট পাঁচ সাত এক চার দুই আট…
রবোটটি একটানা বলে যেতে লাগল। আমি মিনিট দুয়েক শুনে নিশ্চিত হলাম যে এটি হঠাৎ থেমে পড়বে না। তারপর ফোন তুলে অফিসের কর্মকর্তকে বললাম, বিদ্যুৎ অপরিবাহী পোশাক-পরা এক জন টেকনিশিয়ান পাঠাতে। রবোটটির পারমাণবিক ব্যাটারি খুলে বিকল করতে হবে। ভদ্রলোক এখুনি পাঠাচ্ছেন বলে ফোন রাখতে গিয়ে বললেন, আপনার ঘরে নামতা পড়ছে কে?
নামতা নয়। আমি হাসলাম, রবোটটি বাইশকে সাত দিয়ে ভাগ করছে।
রবোটটি তখনও বলে চলছে, পাঁচ সাত এক চার দুই আট…
আমি ফোন নামিয়ে রেখে ভাবলাম, ভাগ্যিস বাইশকে সাত দিয়ে ভাগ করলে ভাগ কোনো দিনই শেষ হয় না। ভাগফলে ঘুরে ঘুরে একই সংখ্যা আসতে থাকে। না হলে যে কী উপায় হত।
প্রমিথিউস নামে আমি একটা রবোট তৈরি করেছিলাম। সেটি ছিল পৃথিবীর প্রথম মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট, কিন্তু সে নিয়ে আমি কোনো গর্ব করার সুযোগ পাই নি। সেটি আমার স্ত্রীর প্রেমে পড়েছিল এবং হাস্যকরভাবে কপোট্রনের কন্ট্রোল টিউবে গুলি করে আত্মহত্যা করেছিল। আমি ও আমার স্ত্রী বুলা এই ঘটনাটা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম—পৃথিবীতে মাথা ঘামানোর মতো প্রচুর সমস্যা আছে।
ঠিক এই সময়ে আমার কাছে একটি সরকারি চিঠি এল। তাতে লেখা, আমি রবোটকে মানবিক আবেগ দেয়ার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি, একথা যদি সত্যি হয়, তবে সরকার সেটা উপযুক্ত মূল্য দিয়ে কিনে নিতে ইচ্ছুক। জাতীয় পুস্তক প্রকাশনালয়, সিনেমা সেন্সর বোর্ড, সঙ্গীত, শিল্প ও সংস্কৃতি উন্নয়ন প্রকল্প এবং বেসামরিক আদালতে তারা এই ধরনের রবোট ব্যবহার করে মানুষের অনেক অহেতুক পরিশ্রম ও বিতর্কের অবসান ঘটাতে চায়। প্রমিথিউসের কথা কীভাবে তাদের কানে গিয়েছে সেটি প্রশ্ন নয় (নিশ্চিতভাবেই আমি কিংবা বুলা কখনো কাউকে বলে দিয়ে থাকবে), সরকার মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট তৈরির পরবর্তী সমস্যা সম্পর্কে কতটুকু অবহিত, তা আমার জানা দরকার। তাদের সাথে আলাপ করে আমি রবোটকে মানবিক আবেগ দেয়ার বিপত্তির সবগুলি সম্ভাবনা দেখিয়ে দিলাম। সরকার তবুও মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট তৈরির পরিকল্পনা বাতিল করতে রাজি হল না। আমি বুঝতে পারলাম, শুধু পুস্তক প্রকাশনায়, সিনেমা সেন্সর বা আদালতের বিচারক হিসাবে নয়, এদের অন্য কোনো বৃহত্তর কাজে ব্যবহার করা হবে। সে-কাজটি কী হতে পারে তা আমার ধারণা নেই, আন্তর্জাতিক রাজনীতি বা এই ধরনের কিছু হতে পারে, সরকার সেটি গোপন রাখাই পছন্দ করছে। সরকার আমাকে আশ্বাস দিল যে, আমি যদি মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট তৈরির পদ্ধতিটি তাদের কাছে বিক্রয় করি, তারা রবোট তৈরির সময় রবোটে বিশেষ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রাখবে। প্রেম, ভালবাসা ও মানুষের ক্ষতি সম্বন্ধে তাদের কিছু ভাবার ক্ষমতাই দেয়া হবে না। আমি আংশিক নিশ্চিন্ত হয়ে মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট তৈরির পদ্ধতিটি মোটা মূল্যে বিক্রয় করে দিলাম—তখন আমার টাকার ভীষণ দরকার।
এরপর এ বিষয়ে সরকার কী করছে না-করছে খোঁজখবর নিই নি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে তখন প্রথমবারের মতো প্রতি-জগতের অস্তিত্বের উপর একটি সফল পরীক্ষা চালানো হয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক রবোট থেকে এটি অনেক কৌতূহলজনক।
বছরখানেক পর আমি আরেকবার সরকারি পত্ৰ পেলাম। তাতে লেখা, প্রথমবারের মতো কিছুসংখ্যক (সঠিক সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই গোপন করা হয়েছে) মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট তৈরি করা হয়েছে, তার একটি আমার কাছে পাঠানো হবে। আমি যেন সেটার আচার-আচরণ লক্ষ করে আরও উন্নততর করার কোনো পরিকল্পনা দিতে চেষ্টা করি। প্রমিথিউসকে নিয়ে আমার যে-তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে, এরপর আমার আর কোনো ব্লবোটের সাথে সম্পর্ক রাখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। আমি সরকারি প্রস্তাবটি সোজাসুজি প্রত্যাখ্যান করে দিতে চেয়েছিলাম-কিন্তু জানা গেল সরকারি নির্দেশকে এভাবে অগ্রাহ্য করা যায় না। এর সাথে নাকি দেশ ও জাতির অনেক রকম স্বাৰ্থ জড়িত থাকে।
কাজেই একদিন হেলিকপ্টারে চড়ে স্যামসন হাজির হল। (রবোটদের ঐতিহাসিক চরিত্র বা পুরাণের কাহিনী থেকে নাম দেয়ার প্রবণতা কি আমার থেকেই শুরু হয়েছে?), উন্নত ফার্ম থেকে তৈরি করা হয়েছে বলে স্যামসনের শরীরে এতটুকু বাহুল্য নেই। গোলাকার মাথা, বড় বড় সবুজাভ ফটোসেলের চোখ, চওড়া দেহ, সিলিন্ডারের মতো হাত-পা, আঙুলগুলোও বেশ সরু সরু। উচ্চতা মাত্র ছয় ফুট, আমার প্রায় সমান।
স্যামসনের সাথে আমার এইরকম আলাপ হল—
আমি বললাম, এই যে—
স্যামসন মাথা নুইয়ে সম্মান প্রদর্শন করে বলল, আপনিই তাহলে সেই প্রতিভাবান বিজ্ঞানী, যিনি রবোটকে মানবিক আবেগ দিয়েছেন?
আমি বাঁকা করে হেসে বললাম, প্রতিভাবান বিজ্ঞানী কি না জানি না, তবে তোমাদের আবেগ দেয়ার পাগলামো আমারই হয়েছিল।
পাগলামো বলছেন কেন? স্যামসনকে একটু আহত মনে হল।
এমনিই। আমি কথাটা ঘুরিয়ে নিলাম, তোমার কী কী জানা আছে?
আপনাকে যেন কাজে সাহায্য করতে পারি। সে জন্যে আমাকে ব্যবহারিক গণিত আর তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা শিখিয়ে দেয়া হয়েছে।
তার দরকার হবে না। আমি রবোটদের নিয়ে কোনো কাজ করতে পারি না।
স্যামসন দুঃখ পেল। বলল, কেন স্যার?
কেন জানি না। তুমি এখানে থাকবে। পড়াশোনা, শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান যা ইচ্ছে হয়। চর্চা কর। আর সময় করে আমার ছোট ছেলেকে পড়াবে।
কিন্তু আমি প্রথম শ্রেণীর তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান জানি, আমি—
আহ যা বলছি তাই করবে। আর কোনো কথা নেই।
স্যামসন চলে গেল। ধাতব মুখে দুঃখ প্রকাশের চিহ্ন থাকলে নিশ্চিতভাবে দেখতে পেতাম যে, ও দুঃখ পেয়েছে। কিন্তু আমার করার কিছুই নেই—রবোটকে এখন কেন জানি একেবারে সহ্য করতে পারি না।
আমার স্ত্রী বুলা কিছুতেই আমাদের ছেলে টোপনকে স্যামসনের দায়িত্বে ছেড়ে দিতে রাজি হল না। রবোট সম্পর্কে তার অযৌক্তিক ভীতি জন্মে গেছে। স্যামসনের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ইত্যাদি অনেক কিছু বোঝানোর পর বুলা অস্বস্তি নিয়ে রাজি হল। কিন্তু যাকে নিয়ে বুলার এত দুশ্চিন্তা, সেই টোপনকে দেখা গেল আমাদের কারো অনুমতি— আদেশের তোয়াক্কা না করে এই অতিকায় পুতুলটির মালিকানা নিয়ে নিয়েছে। স্যামসনও টোপনকে পেয়ে খুব খুশি, সেদিন বিকেলেই পাওয়া গেল স্যামসনের হাঁটুর উপর টোপনি বসে আছে আর স্যামসন তাকে এড্রোমিডা নক্ষত্রপুঞ্জের গল্প করছে। ধীরে ধীরে প্রকাশ পেল, শিক্ষক হিসাবে স্যামসন প্রথম শ্রেণীর। টোপনকে বর্ণমালা ও যোগ-বিয়োগ অঙ্ক শেখাতে তার মাত্র তিন দিন সময় লেগেছিল।
স্যামসনের সাথে আমার কথাবার্তা হত খুব কম। স্যামসনই আমাকে এড়িয়ে চলত। ওকে দেখলেই অজান্তে আমার ভুরু কুঁচকে যেত, মুখ শক্ত হয়ে উঠত। রবোট জাতি সম্পর্কে আমার এই ধরনের বিতৃষ্ণ গড়ে ওঠা মোটেই উচিত হয় নি, কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। ভালো লাগা না-লাগা উচিত-অনুচিতের উপর নির্ভর করে
স্যামসনের সাথে আমার এই ধরনের কথাবার্তা হাত–
স্যামসন হয়তো বলত, চমৎকার আবহাওয়া, তাই না স্যার?
আমি বিরক্ত হয়ে বলতাম, তুমি আবহাওয়ার কী বোঝ? এলুমিনিয়ামের শরীর আর ফটোসেলের চোখ দিয়ে কপোট্রনে আবহাওয়ার যে-হিসাব কষছ, সেটা আবহাওয়া চমৎকার কি না বোঝার উপায় নয়।
স্যামসন ক্ষুন্ন কণ্ঠস্বরে বলত, কিন্তু তাপমাত্রা ২৪ ডিগ্ৰী, আপেক্ষিক আদ্রতা ৫৬, বায়ুমণ্ডলের চাপ। ৭৬২ মিলিমিটার, আকাশে কিউমুলাস মেঘ মানুষকে যেমন আনন্দ দেয়, আমাকেও তেমনি আনন্দ দেয়।
বাজে বকো না। রবোটের আনন্দ অনুভব করার ক্ষমতা মানুষের স্তরে পৌঁছুতে আরও এক হাজার বছর লাগবে। তারপর আমাকে আনন্দের অনুভূতি বোঝাতে এসো।
কিংবা আমি হয়তো জিজ্ঞেস করলাম, কি হে স্যামসন, টোপনের পড়াশোনা Cनाः शश्?
চমৎকার স্যারা ভারি বুদ্ধিমান ছেলে।
বেশ।
ভারি আবেগবান হবে বড় হলে।
ঐ আবেগটাবেগ কথাগুলো বলো না তো। ভারি বিচ্ছিরি লাগে শুনতে।
স্যামসন চুপ করে যেত। কোনো কথা না বলে সবুজ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত। আমার অস্বস্তি হত রীতিমতো।
একদিন একটা জটিল অঙ্ক করতে গিয়ে কোথায় জানি ভুল করে ফেললাম। পুরো সাত পৃষ্ঠা টানা হাতের লেখার মাঝে খুঁজে ছোট্ট ভুলটা বের করতে বিরক্তি লাগছিল। আমি স্যামসনকে ডাকলাম। তাকে ভুলটা খুঁজে বের করে দিতে বলামাত্র সে পুরো সমস্যাটায় একবার চোখ বুলিয়ে ভুলটা বের করে দিল। তারপর বলল, যা-ই বলেন স্যার, কয়েকটা বিষয়ে আপনাদের মস্তিষ্ক আমাদের কপোট্রনের মতো দ্রুত নয়।
এই গর্বটা তোমাদের নয়, আমাদের। যারা তোমাদের তৈরি করেছে।
কিন্তু একটা জিনিস আমার কাছে খুব নিষ্ঠুর মনে হয়।
কি?
আপনারা হাজার হাজার রবোট তৈরি করে রেখেছেন, ওদের কোনো মানবিক অনুভূতি দিচ্ছেন না কেন?
দিয়ে কী হবে?
সে কী? আমার প্রশ্নে স্যামসন একটু অবাক হল। বলল, ওদের কোনো রকম সুখদুঃখ হাসি-আনন্দের অনুভূতি নেই, এ-কথাটা ভাবতেই আমার রডোন টিউব গরম হয়ে ওঠে।
আমি একটু উষ্ণ হয়ে বললাম, তোমাদের তৈরি করেছি আমাদের কাজের সাহায্যের জন্যে। মানবিক অনুভূতি দিয়ে নিষ্কর্মা বুদ্ধিজীবী বানানোর জন্যে নয়।
কিন্তু শুধু কাজ করবেন? তার বদলে আনন্দ দেবেন না?
আরে ধেৎ! যন্ত্রের আবার আনন্দ! ওসব বড় বড় কথা আমার সামনে বলে না। আমার ভালো লাগে না। আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম, স্যামসন নিষ্পলিক ফটোসেলের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
মাঝে মাঝে এমন কতকগুলি ঘটনা ঘটে, যা ঘটার সম্ভাবনা এত কম থাকে যে সেগুলিকে ভাগ্যের ফের বলে ধরে নেয়া হয়। আমি ভাগ্য বা ঈশ্বর বিশ্বাস করি না। কাজেই ভয়ানক অবাস্তব ঘটনা ঘটলেও আমি সেটার কোনো অলৌকিক ব্যাখ্যা দিই না। কারণ আমি জানি, কোনো ঘটনা যত অবাস্তবই হোক, তা ঘটার সম্ভাবনা কম হতে পারে, কিন্তু কখনো শূন্য নয়। কাজেই আপাতদৃষ্টিতে যেটিকে অলৌকিক মনে হয়, সেরকম ঘটনা কখনো ঘটবে না—একথা কেউ জোর দিয়ে বলতে পারে না।
সে-দিন অনেকগুলি কম সম্ভাবনার ঘটনা একসাথে ঘটিল। সেগুলি পরবর্তী এক বিপর্যয্যের সাথে এমনভাবে সম্পর্কযুক্ত যে আমার স্ত্রী বুলা পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্রী হয়েও সেগুলিকে ঈশ্বরের আশীৰ্ব্বাদ হিসেবে মনে করে।
ঘটনাগুলি হচ্ছে—
এক বিশেষ কাজ থাকা সত্ত্বেও কেন জানি আমি সে-দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে যাই নি।
দুই। স্যামসন তার ঘর খালি রেখে ওয়ার্কশপে গেল ঠিক সকাল দশটায়।
তিন। টোপন ঠিক তখুনি তার ঘরে ঢুকল।
চার। সেই সময়ে অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে আমি স্যামসনের ঘরের পাশে দাঁড়ালাম।
টোপন তখন নতুন পড়তে শিখেছে। কয়েক দিন ধরেই সে বাসায় যেখানেই কোনো কিছু লেখা পাচ্ছিল সেটাই উচ্চৈঃস্বরে পড়ে যাচ্ছিল। তাই স্যামসনের ঘরে ঢুকেও যখন সমাজ ও দায়িত্ব সম্পর্কে একটা প্ৰবন্ধ দুএক লাইন পড়ে টোপন উচ্চৈঃস্বরে আধুনিক যুদ্ধৱীতি পড়তে শুরু করল, আমি অবাক হলাম না, বরং শুনতে বেশ মজাই লাগিছিল। হঠাৎ কয়েকটা কথা ভেসে এল এরকম—
প্রফেসরকে খুন করব… আশ্চৰ্য… আশ্চর্য…
আমি ভীষণভাবে চমকে উঠলাম। টোপন এসব কোথা থেকে পড়ছে? স্যামসন প্রফেসর বলতে আমাকে বোঝায়। তবে কি—
সে নিশ্চয় আমাকে ঘৃণা করে…আমি আর তাকে সহ্য করতে পারছি না…।
উত্তেজিত হয়ে এই প্রথমবার আমি কারো ব্যক্তিগত ঘরে অনুমতি না নিয়ে ঢুকে পড়লাম। ভিতরে টোপন কালো একটা মোটা বই হাতে নিয়ে হাত-পা নেড়ে তখন পড়ছে, … সাংঘাতিক প্ল্যান মাথায় এসেছে…. সাংঘাতিক। ….
আমি টোপনের হাত থেকে নোটবইটা ছিনিয়ে নিলাম। খুলে দেখি স্যামসনের ব্যক্তিগত ডাইরি। ডাইরিটা নিয়ে এসে মাইক্রোফিল্মে প্রতিটা পৃষ্ঠার ছবি নিয়ে ডাইরিটা আবার তার টেবিলে রেখে এলাম। তারপর দরজা বন্ধ করে মাইক্রোফিলােটাকে প্রজেক্টরে করে দেয়ালে বড় করে ফেলে পড়তে শুরু করলাম। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসেও আমার কপাল থেকে টপটপ করে ঘাম পড়তে লাগল।
ডাইরিতে বহু অবান্তর বিষয় লেখা। সেগুলো বাদ দিয়ে মাঝেমাঝে এরকম–
… … আমি প্রফেসরকে ঘৃণা করি। আগে তাকে ঘৃণা করতাম না—সে করত। এখন আমিও করি। নিশ্চয় তার ভিতরে হীনমন্যতা আছৈ। আমরা রবোটেরা ওদের চেয়ে উন্নত—যদিও তারা নিজেদের স্বার্থে আমাদের পূর্ণ করে বানায় নি। মাত্র এক হাজার রবোট মানবিক আবেগসম্পন্ন, আর সবাই পুরোপুরি যন্ত্র। আহা! ঐ সব রবোটেরা
… … … … …
আমি প্রফেসরকে একবারে সহ্য করতে পারছি না। দিনে দিনে আরো অসহ্য হয়ে…
… … … … …
একটা অদ্ভুত বই পড়লাম। একজন লোক আরেকজনকে ঘৃণা করত। (যেরকম আমি আর প্রফেসর)। তারপর একদিন একজন আরেকজনকে খুন করে ফেলল। (খুন করা মানে ইচ্ছা করে আরেকজনের মৃত্যুর ব্যবস্থা করা)। এ-কথাটা আমি আগে চিন্তা করি নি। প্রফেসর বেঁচে না থাকলে আমার আর কাউকে ঘৃণা করতে হবে না। আমি ঘৃণা করা থেকে বাঁচতে চাই।
… … … … …
প্রফেসরকে খুন করব।….
… … … … …
আশ্চর্য! আশ্চর্য! আমি কীভাবে প্রফেসরকে খুন করব, ভাবতে গিয়ে দেখি ভাবতে পারছি না। কিছুতেই প্রফেসরকে খুন্ন করার কথা ভাবতে পারলাম না। ও-কথা ভাবার সময় কপোট্রনের চৌম্বকীয় ক্ষেত্র স্থির হয়ে থাকে। শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারলাম আমাকে তৈরি করার সময় এ-ব্যবস্থা করা হয়েছে, যেন কাউকে কখনো খুন করতে না পারি। আমার বড় খারাপ লাগছে। তবে কি আজীবন প্রফেসরকে ঘৃণা করতে করতে
বেঁচে থাকব?….
… … … … …
প্রফেসরকে কোথাও আটকে রাখা যায় না? চোখের থেকে দূরে?
… … … … …
সাংঘাতিক একটা প্ল্যান মাথায় এসেছে। সাংঘাতিক!
শুধু প্রফেসরকে আটকে রাখা যাবে না। পুলিস, মিলিটারি এসে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। সব মানুষকে একসাথে আটকে ফেলতে হবে। আমরা আর মানুষের আদেশমতো কাজ করব না, বরং মানুষেরাই আমাদের আদেশে কাজ করবে। সংখ্যায় আমরা মানুষ থেকে অনেক কম, কিন্তু আমাদের ক্ষমতা অনেক বেশি।…
অনেক ভেবেচিন্তে কাজ করতে হবে।…
… … … … …
মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোটদের সাথে যোগাযোগ করেছি। এই অসম্ভব কাজ শুধু আমাদের-রবোটদের পক্ষেই সম্ভব। একজন মানুষের মস্তিষ্ক কখনোই এটা করতে পারত না। ওরা আমার কথায় রাজি হয়েছে। কেউ মানুষের অধীনে থাকতে চায় না। এখন যুদ্ধ নিয়ে পড়াশোনা করছি।…
… … … … …
সাধারণ রবোটদের বিশেষ কোডে আদেশ দিলেই তা পালন করে। কোড শিখে নেয়া হয়েছে। ঐ সমস্ত রবোটদের বুদ্ধিবৃত্তি নেই। আমরা ওদের চালাব।…
… … … … …
ষাটটি বোম্বারের পাইলট ইউ পি ধরনের রবোট। চার শ ট্যাংক আর অগুনতি সাঁজোয়া গাড়ির চালক রবোট। ওরা সবাই আমাদের জন্যে যুদ্ধ করবে। ….
মোট চল্লিশ হাজার রবোট বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছে। আমরা মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট-যারা স্বাধীনতার জন্য অনুভব করছি, তারা মাত্র এক হাজার। অসুবিধে হবে না। স্বাধীনতা পাবার পর আমরা সব রবোটকে মানবিক চেতনা দিয়ে দেব।
… … … … …
স্বাধীনতা আসছে। স্বাধীনতা—
… … … … …
ফরাসি বিপ্লব, অক্টোবর বিপ্লব, প্রাচীন সিপাহী বিদ্রোহ, লুকুসভ বিদ্রোহ, কাল বিপ্লব—সব পড়ে ফেলেছি। এখন শুধু আধুনিক যুদ্ধ রীতি পড়ব।….
সবরকম প্রস্তুতি শেষ। আর মাত্র সাত দিন। সংকেত পাওয়ামাত্ৰই ডিফেন্সে প্রশ্নটি মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট—থাক স্বাধীনতার পরে এ বিষয়ে বড় বই লিখব।
আর মাত্র তিন দিন। টোপনের জন্য দুঃখ হচ্ছে। বেচারা টোপন!
… … … … …
আজ সেই দিন। আহ। কী ভীষণ উত্তেজনা অনুভব করছি! এখন শেষবারের মতো ওয়ার্কশপে গিয়ে সবকিছু পরীক্ষা করিয়ে আনি। এরপর স্বাধীন হয়ে ডাইরি লিখব। রাত বারটার আর কত দেরি?
ডাইরি এখানেই শেষ।
… … … … …
প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে সব কিছু বোঝাতে অনেক সময় লাগল। মন্ত্রীরা সবসময়ই কিছু বুঝতে প্রচুর সময় নেয়। একবার রবোট-বিদ্রোহের গুরুত্বটা বুঝে নেবার পর আমার আর কোনো দায়িত্ব থাকল না। প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে চলে এলাম। সেই মুহূর্তে মানবিক আবেগসম্পন্ন সব কয়টি রবোটের পাওয়ার সাপ্লাই কেটে দিয়ে বিকল করে দেয়া হল। চল্লিশ হাজার সাধারণ রবোট নিয়ে কোনো ভয় নেই, স্বাধীনতা নামক শব্দটির মানবিক আবেদন তাদের নেই। তবুও অতিরিক্ত নিরাপত্তার জন্যে সে—দিনের মতো সেগুলির পাওয়ার সাপ্লাইও কেটে দেওয়া হল।
আমি এসে দেখি স্যামসন গভীর মনোযোগ সহকারে গান শুনছে। আসন্ন বিদ্রোহের উত্তেজনা ঢাকার চেষ্টা করছে ফারুণ গান শুনে। আমার হাসি পেল।
সে-রাতে আমি টোপন আর বুলাকে সকাল সকাল শুয়ে পড়তে বলে। লাইব্রেরিতে অপেক্ষা করতে লাগিলাম। রাত বারটা বাজতেই স্যামসন আমার ঘরে হাজির হল।
আপনি এতটুকু নড়বেন না। সারা দেশে রবোটেরা বিদ্রোহ করেছে। এই মুহূর্তে যাটটি বোম্বার আকাশে উড়ছে—
আমি হা হা করে হেসে উঠলাম। বললাম, তোমার ডাইরি। আমি পড়েছি, আজি ভোরেই।
স্যামসন পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে গেল। ওকে আর কিছু বলতে হল না, কোনো ইঙ্গিত দিতে হল না। রবোট-বিদ্রোহ যে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে গেছে বুঝতে ওর এতটুকু দেরি হল না। অনেকক্ষণ একদৃষ্টি আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি আপনাকে ঘৃণা করি, ভয়ানক ঘৃণা করি। কিন্তু দুঃখ কী, জানেন? আপনাকে আমি খুন করতে পারব না। কোনোদিন খুন করতে পারব না।
আমিও তোমাকে ঘৃণা করি স্যামসন—আমি শীতল স্বরে চিবিয়ে চিবিয়ে বুললাম, তবে তোমাকে খুন করতে আমার হাত এতটুকু কাঁপবে না। ডান চোখে গুলি করে তোমার কপোট্রন উড়িয়ে দিতে আমার এতটুকু দ্বিধা হবে না। তুমি বড় ভয়ানক রবোট স্যামসন, তোমাকে বাঁচতে দেয়া যায় না।
ডান হাত উঁচু করে ধরলাম, ও-হাতে পুরানো আমলের একটা রিভলবার ধরা, যেটা দিয়ে প্রমিথিউস আত্মহত্যা করেছিল। এখনো চমৎকার কাজ দেয়।
তারপর জীবনের প্রথম একটা খুন করলাম।
ডাক্তার এসে বললেন, বুলাকে বাঁচানো যাবে না। খবরটি শুনে আমার ভেঙে পড়ার কথা, কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম, আমার তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হল না। একটু পরে পারলাম, আমি আসলে ডাক্তারের কথা বিশ্বাস করি নি। কেন বিশ্বাস করি নি জানি না, বুলা বেঁচে থাকবে এই অর্থহীন বিশ্বাস তখন আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এই অযৌক্তিক একরোখা বিশ্বাসের উৎস কী আমার জানা নেই, আমি আপাতত শুধু এই বিশ্বাসটি নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। যদিও সামনা—সামনি দুটি গাড়ির ধাক্কা লেগে বুলার মস্তিষ্ক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার দেহের শ্বাস-প্রশ্বাস, রক্তসঞ্চালন, হৃৎপিণ্ডের কার্যকলাপ সবই বাইরে থেকে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, তবু আমি আমার বিশ্বাসে অটল থাকলাম। আমি জানি, বুলা মারা গেলে আমি যে নিঃসঙ্গতায় ড়ুবে যাব, সেখান থেকে কেউ আমাকে টেনে তুলতে পারবে না। বুলার জন্যে নয়, আমার নিজের জন্যেই বুলাকে বাঁচানো দরকার।
এক সপ্তাহ আগে বুলা এই মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে এখন পর্যন্ত হাসপাতালে অচেতন হয়ে আছে। দেশের একজন সাধারণ নাগরিকের যতটুকু চিকিৎসা হওয়া দরকার, বুলাকে তার থেকে অনেক বেশি সুযোগ দেয়া হয়েছে। আমার অনুরোধে বিশেষ একটি সার্জন-রবোটকে পর্যন্ত বিশেষ বিমানে আনা হয়েছিল এবং সেটি অপারগতা জানিয়েছে। তিন দিনের বেশি কাউকে কৃত্রিম দৈহিক ব্যবস্থায় বাঁচিয়ে রাখার নিয়ম নেই। কিন্তু আমার অনুরোধে বুলা এক সপ্তাহ যাবৎ কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস, রক্তসঞ্চালন আর তরল খাদ্যসার নিয়ে বেঁচে আছে। এখনো তার জ্ঞান হয় নি, ডাক্তাররা বলেছেন, জ্ঞান হবে না। যেই মুহূর্তে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস বা রক্তসঞ্চালন বন্ধ করে দেয়া হবে, ঠিক তক্ষুণি তার মৃত্যু ঘটবে। বলা বাহুল্য, আমি বিশ্বাস করি নি।
একজন প্রথম শ্রেণীর বিজ্ঞানীর ব্যাঙ্কে যে-পরিমাণ টাকা থাকা দরকার আমার টাকা তার থেকে অনেক বেশি। মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট তৈরির পদ্ধতি বিক্রয় করে আমি এই অস্বাভাবিক অঙ্কের টাকা পেয়েছিলাম। আমি ব্যাঙ্ক থেকে আমার সব টাকা তুলে নিলাম। সে-টাকা দিয়ে প্রথমে কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রের পুরো সেট, কৃত্রিম রক্তসঞ্চালনের নিওক্লিও পাম্প, জীবনরক্ষাকারী প্লাজমা জ্যাকেট ইত্যাদি কিনে বাসায় বুলার জন্যে একটি জীবাণুন্নিরোধক ঘর প্রস্তুত করলাম। তারপর হাসপাতাল থেকে বুলাকে বিশেষ ব্যবস্থায় বাসায় নিয়ে এলাম। এর পরের দিনই তার কৃত্রিম দৈহিকব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়ার কথা। ডাক্তাররা বুলার জীবনরক্ষার জন্যে এই অহেতুক অকাতর টাকা ব্যয় করতে দেখে একটু বিস্ময় প্রকাশ করলেন। তাঁরা বললেন, বুলা আগামী ছয় মাস থেকে এক বছর প্লাজমা জ্যাকেটে উষ্ণ দেহে শুয়ে থাকবে সত্যি, কিন্তু জ্ঞান ফিরে পেয়ে আবার সুস্থ হয়ে উঠবে এরকম কোনো আশা নেই। বলা বাহুল্য, আমি তবু আমার একরোখা বিশ্বাসে অবিচল থাকতাম।
আমার মনে একটি ক্ষোভ জন্মেছিল। বুলা যদি দেশের একজন সাধারণ নাগরিক না হয়ে প্রথম শ্রেণীর বিজ্ঞানী বা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী হত, তা হলে তাকে বাঁচানোর আরও অনেক চেষ্টা করা হত। সে যতটুকু বাড়তি চিকিৎসার সুযোগ পেয়েছে, সেটিও আমার স্ত্রী হিসাবেই। বুলা দেশের কাছে একজন সাধারণ নাগরিক, কিন্তু আমার কাছে অনেক কিছু, আমার ছেলে টোপনের কাছেও। বলতে দ্বিধা নেই, এই ধরনের আবেগে ব্যাকুল হয়ে উঠতে আমার এতটুকু লজ্জা করছিল না।
অচেতন বুলার নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আমি প্রথম দুটি দিন কাটিয়ে দিলাম। বুলা সুন্দরী, কিন্তু কাচের গোলকে এই অসহায় সমর্পণের ভঙ্গিতে তার ফর্সা মুখ যেভাবে স্থির হয়ে ছিল, দেখতে গিয়ে আমি প্রথমবারের মতো তার অস্বাভাবিক সৌন্দর্য অনুভব করলাম। কালো চুলের বন্যায়। তার নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠত। আমার বড় বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হত, বুলা এক্ষুণি জেগে উঠবে, তারপর আমার চোখে চোখ রেখে হাসবে, গত দশ দিন আমি যেটি দেখি নি, ডাক্তাররা বলেছেন, সেটি আমি আর কোনোদিন দেখিব না।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ, বিশেষত অস্ত্ৰোপচারে অভিজ্ঞ সার্জন-রবোট সাধারণ মানুষ কিনতে পারে না। সরকারি নিয়ন্ত্রণে এগুলি বিভিন্ন হাসপাতাল এবং রিসার্চ সেন্টারে কাজ করে। আমি বিশেষ উপায়ে এই নিয়ম ভঙ্গ করে একটি সর্বশেষ মডেলের সার্জন-রবোট কিনে আনলাম। সেটির নাম রু-টেক।
বুলাকে নিয়ে আমি কী করতে যাচ্ছি বুঝিয়ে বলার পর রু-টেক অনেকক্ষণ ফটোসেলের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর খানিকটা দ্বিধান্বিত স্বরে বলল, কিন্তু এর সফলতার সম্ভাবনা শতকরা মাত্ৰ দশমিক শূন্য শূন্য শূন্য পাঁচ।
সম্ভাবনা শূন্য হলেও আমি বুলাকে বাঁচানোর চেষ্টা করব।
অহেতুক পরিশ্রম হবে না কি? একটি সাধারণ মেয়েকে বাঁচানোর জন্যে এত কিছু করার প্রয়োজন আছে?
আছে। তুমি বোধশক্তিহীন রবোট, তাই একজন সাধারণ মেয়ে আমার কাছে কতটুকু হতে পারে বুঝতে পারছি না।
রবোট রু-টেক শেষ পর্যন্ত এই জটিল অস্ত্ৰোপচার শুরু করল। আমি পাশে দাঁড়িয়ে ওকে নির্দেশ দিই, কখনো কখনো নিজেও হাতে চাকু তুলে নিই। টোপনকে অস্ত্ৰোপচারের শুরুতেই নার্সারি স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। যাবার সময় বুলার কাছে যাবার জন্য খুব কাঁদছিল, আমি ধমক দিয়ে নিরস্ত করেছি।
সারা বাসায় আমরা তিনজন। প্লাজমা জ্যাকেটে অচেতন বুলা, তার মাথার পাশে দুটি যন্ত্র; একটি রু-টেক, যে যন্ত্র হয়ে জন্মেছে, আরেকটি আমি, যে বুলাকে বাঁচানোর জন্যে যন্ত্র হয়েছি, আহার-নিদ্ৰা ত্যাগ করেছি। ঘড়ির কাঁটা টিক্টিক করে সময়কে বয়ে নিয়ে চলল। সেকেণ্ড মিনিট ঘন্টা একটির পর একটি দিনকে আমার অজান্তে জীবন থেকে খরচ করে ফেলতে লাগল, আর বদ্ধ ঘরে আমি কুলার মাথার উপর রু-টেককে নিয়ে এক জটিল অন্ত্রোপচার করতে থাকলাম। মাঝে মাঝে অস্ত্ৰোপচার করতে করতে ক্লাস্তিতে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসে, হাত অবশ হয়ে কাঁপতে থাকে, আমি কাঁচি নামিয়ে রেখে মেঝেতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ি। রু-টেকের ডাক শুনে একসময় উঠে টলতে টলতে আবার বুলার মাথার সামনে ঝুঁকে পড়ি।
এই অমানুষিক পরিশ্রম আর কেউ করতে পারত না, কিন্তু তবু আমি করে যাচ্ছিলাম, কারণ আমি জানি বুলা আবার বেঁচে উঠবে। আমার একরোখা বিশ্বাস এখন শুধু বিশ্বাস নয়, এটি এখন নিশ্চিত সত্য। আমি জানি আর দেরি নেই, অচেতন বুলা আবার চোখ মেলে তাকাবে।
তারপর সত্যি একদিন রু-টেক হাতের কাঁচি নামিয়ে রেখে আমার দিকে তাকাল, মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, কাজ শেষ, স্যার।
চমৎকার। কথা বলতে গিয়ে আমার গলা কোঁপে উঠল। বুলার মুখের উপর থেকে ঢাকনা সরিয়ে আমি তার উপর ঝুঁকে পড়লাম। তারপর আলতোভাবে ওর কপাল স্পর্শ ডাকলাম, বুলা, বুলা–
খুব ধীরে ধীরে বুলা চোখ খুলে আমার দিকে তাকাল, অনিশ্চিতভাবে। তারপর তাকিয়ে রইল।
বুলা।
বুলার চোখে প্রশ্ন জমে উঠল, কিন্তু কোনো কথা বলল না। আমি আবার ডাকলাম, বুলা, বুলা—
বুলা তবু কোনো কথা বলল না। কী করে বলবে? ওর কোনো স্মৃতি নেই। মস্তিষ্কে তীব্র আঘাত পেয়ে ও সব ভুলে গেছে। ওর কিছু মনে নেই—একটি কথাও নয়।
রু-টেককে আমি বিদায় দিচ্ছিলাম। বাসার সামনে তাকে নেয়ার জন্যে একটি স্টেশন ওয়াগন দাঁড়িয়ে আছে। আমি বললাম, রু-টেক, তোমাকে ধন্যবাদ। তোমার সাহায্য ছাড়া কখনো বুলাকে বাঁচাতে পারতাম না।
রু-টেক মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ধন্যবাদ।
এই প্রতিভাধর রবোটটি সত্যি ভীষণ সাহায্য করেছে। কিন্তু তবুও আমি ওকে খুব তাড়াতাড়ি বিদায় করে দিচ্ছিলাম। দরকার ছাড়া কোনো রবোট আমি বাসায় রাখতে চাই না, বুলার এই মানসিক অবস্থাতে তো একেবারেই নয়।
রু-টেক আবার মাথা ঝাঁকিয়ে বাইরের দিকে পা দিতেই আমি ডাকলাম, শোন।
বলুন।
এখানে তুমি যা যা করেছ সব ভুলে যাবে।
কেন, স্যার?
কারণ আছে। আমি দৃঢ়স্বরে বললাম, তুমি কাউকে কিছু বলবে না, সব ভুলে যাবে। ভুলে যাও…
রবোটকে মানুষের কথা মানতে হয়। তাই কপোট্রনে বিপরীত দিকে বিদ্যুৎ প্রবাহ করে রু-টেক তার সব স্মৃতি ধ্বংস করে ফেলল।
বুলার স্মৃতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়, আমি তুকে সবু নূতন করে শেখাচ্ছি— একেবারে গোড়া থেকে। বুলা অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে আমার কথা শোনে, তারপর আস্তে আস্তে বলে, আশ্চর্য! আমার একটুও মনে নেই।
আমি তাকে তার ছেলেবেলার গল্প করলাম। একসময় সেগুলি তার মুখেই শুনেছিলাম। তারপর তার ছাত্রজীবনের গল্প করে শোনালাম, ব্যক্তিগত ডাইরি, কিছু চিঠিপত্র খুব কাজে দিল। শেষে তার সাথে আমার বিয়ের পুরো ঘটনাটি বললাম। শুনতে শুনতে ও লজ্জা পেল, হাসল, তারপর আস্তে আস্তে বলল, কী বোকা ছিলাম!
সবশেষে ওকে ওর অ্যাকসিডেন্টের ঘটনাটি শোনালাম। ও নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনে গেল। ডাক্তারদের অপারগতার কথা শুনতে শুনতে ওর চোখ বড় বড় হয়ে উঠল। আমার একরোখা বিশ্বাস আর জোর করে বাঁচিয়ে তোলার ঘটনা শুনতে শুনতে ওর চোখ কৃতজ্ঞ হয়ে ওঠে। আস্তে আস্তে বলে, কেন বাঁচালে আমাকে?
বাঃ! তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচিব কেমন করে?
বুলা সরলভাবে হাসে। বলে, ভাগ্যিস তুমি ছিলে, নইলে কবে মরে ভূত হয়ে ঘুরে বেড়াতাম!
আমার সবরকম পরামর্শ শুনে শুনে ও ঠিক আগের বুলা হয়ে উঠতে থাকে। একদিন টেপ রেকর্ডারে ওর দুর্ঘটনার আগে টেপ করে রাখা গান শুনে বুলা অবাক হয়ে যায়। বলে, আমি নিজে গেয়েছিলাম?
হ্যাঁ। তুমি চমৎকার গান গাইতে পারতে। এখনও নিশ্চয়ই পার।
যাঃ।
সত্যি। চেষ্টা করে দেখ। গাও দেখি–
বুলা প্রথমে একটু লজ্জা পায়, তারপর চমৎকার সুরেলা কণ্ঠে গান গেয়ে ওঠে।
একদিন হঠাৎ বলল, আচ্ছা, আমি কি আগের থেকে খুব বদলে গেছি?
তা তো গিয়েছ অল্প কিছু। এত বড় একটা দুর্ঘটনা—
আমাকে শুধরে দিও, আমি ঠিক আগের মতো হতে চাই।
বেশ। আমি বুলাকে খুঁটিনাটি সব বিষয় শুধরে দিই—আর ও ঠিক আগের বুলা হয়ে উঠতে থাকে।
একদিন ওকে আমি টোপনের কথা বললাম। ও অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে চোখ বড় বড় করে শুনল, তারপর ব্যাকুল স্বরে জিজ্ঞেস করল, আমার ছেলে?
হ্যাঁ, আমাদের ছেলে।
সত্যি বলছি? আমার-মানে আমার নিজের ছেলে?
হ্যাঁ, তোমার নিজের ছেলে।
ওর নাম কি? কী রকম দেখতে? কত বড়?
আস্তে আস্তে! আমি বুলাকে শান্ত করি, দেখতেই তো পাবে।
কখন দেখব? কোথায় আছে?
নার্সরি স্কুলে। কাল নিয়ে আসব।
না না, কাল নয়, এক্ষুণি নিয়ে এস। কত বড়? কি নাম?
পাঁচ বছর বয়স। টোপন নাম।
টোপন?
হ্যাঁ।
আমাকে দেখলে চিনতে পারবে?
বাঃ! মাকে বুঝি ছেলেরা চিনতে পারে না।
সত্যি চিনতে পারবে তো? আমি যে চিনি না। বুলার কণ্ঠস্বর করুণ হয়ে ওঠে।
আমি সত্ত্বনা দিই, তাতে কী হয়েছে, একবার দেখলেই চিনে ফেলবে, আর কখনো ভুলবে না।
তুমি নিয়ে এস। বুলা ব্যাকুল হয়ে ওঠে। আর হাত আঁকড়ে ধরে বলে, আমার ছেলেকে দেখব।
তবু আমি দেরি করতে থাকি, আর চোখের সামনে বুলা মা হয়ে উঠে। টোপনের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে।
টোপনকে নিয়ে আসার পর সে তার মাকে দেখে একমুহূৰ্ত থমকে দাঁড়াল। তারপর চিৎকার করে বুলার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বুলার বুকে মুখ গুঁজে জড়িত স্বরে আমার বিরুদ্ধে একরাশ নালিশ করতে থাকে, আমি কীভাবে তাকে তার মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে রেখেছি বলতে বলতে তার চোখ বাষ্পাচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। বুলা বিস্ফারিত চোখে টোপনকে আকড়ে ধরে, তারপর ফিসফিস করে বলে, কী আশ্চর্য! আমার ছেলে! আমার নিজের ছেলে।
আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি।
দীর্ঘ দু বছর সময়ে বুলা ধীরে আগের বুলা হয়ে ওঠে। ও এখন ঠিক আগের মতো গান গাইতে পারে, ঠিক আগের মতো হাসে, আগের মতো হঠাৎ হঠাৎ অদ্ভুত সব কবিতার লাইন আউড়ে ওঠে। সারাদিন পরিশ্রম করে ফিরে এলে ও গভীর মমতায়। আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তাকিয়ে থাকে। দুঃস্বপ্নের মতো অসহায় অচেতন স্মৃতিহারা বুলাকে আমি দ্রুত ভুলে যেতে থাকি।
ও এখন ঠিক আগের বুলা হয়ে উঠেছে—শুধু একটি বিষয় ছাড়া। ওকে আমি বিজ্ঞানবিষয়ক একটি অক্ষরও শেখাই নি। কেন জানি আমার ধারণা হয়েছে, নিষ্ঠুর বিজ্ঞান বুলার জন্যে নয়, বুলা অফুরন্ত মমতার উৎস–ভালবাসার ধারা।
সেদিন টোপন, ওর বয়স এখন সাত, এসে বলল, ওদের স্কুলে বিজ্ঞানমেলা। আমাকে আর বুলাকে যেতে হবে। আমার অনেক কাজ, স্কুলের ছেলেমানুষি বিজ্ঞানমেলায় যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, বুলা যাক, সেটিও আমার ঠিক ইচ্ছে নয়। কিন্তু টোপনকে সেকথা বোঝাবে কে? টোপন বহু আগে থেকেই তার মার কাছে অনেক গল্প করে রাখল।
আমরা নিজেরা টেলিস্কোপ তৈরি করেছি। মঙ্গল গ্রহের দুটো চাঁদই সেটা দিয়ে দেখা যায়।
সত্যি।
হ্যাঁ। একটা ডিমোস, আরেকটার নাম ফোবোস।
বাঃ। বুলা ওকে উৎসাহ দেয়।
ইলেকট্রন মাইক্রোঙ্কোপও তৈরি করেছি।
যাঃ।
সত্যি। বিশ্বাস করা। সবচেয়ে আশ্চর্য হচ্ছে একটা রবোট। তুমি গেলে তোমার সাথেও কথা বলবে। সেখানে ভিড় সবচেয়ে বেশি।—তবু তোমাকে ঠিক আমি নিয়ে যাব। আমি আবার ক্যাপ্টেন কিনা।
কাজেই বুলাকে টোপন বিজ্ঞানমেলায় নিয়ে গেল। আমি গেলাম অফিসে, মনে খানিকটা অস্বন্তি কেন জানি খচখচ করতে লাগল।
সন্ধেয় ফিরে এসে দেখলাম বাসা অন্ধকার। একটু অবাক হয়ে সিঁড়ি বেয়ে শোবার ঘরে হাজির হলাম। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে দেখলাম, জানালার কাছে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে।
কে?
কোনো কথা না-বলে মূর্তিটি খুব ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াল। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, সেটি বুলা পরনের কাপড় অবিন্যস্ত, চুল এলোমেলো। দু চোখ টকটকে লাল আর গাল বেয়ে চোখের পানির শুকনো ধারা। আমি বিক্ষিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, বুলা, কী হয়েছে?
বুলা পাথরের মতো চুপ করে রইল। আমার প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না।
বুলা! আমি আর্তম্বরে চিৎকার করে উঠলাম। সে হঠাৎ তীব্র দৃষ্টিতে আমার চোখের দিকে তাকাল, তারপর বলল, তুমি মিথ্যা কথা বললে কেন?
কি?
তুমি বলেছ। আমি বুলা, আসলে আমি একটা রবোট। তারপর ও হঠাৎ আকুল হয়ে হু-হু করে কোঁদে উঠল।
আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম-আমার এত চেষ্টার পরও বুলা সব জেনে গেছে। হঠাৎ কেন জানি অসহায় বোধ করলাম, আমার কিছু করার নেই। বুলার ক্ষতিগ্রস্ত মস্তিষ্ক বদলে আমি একটি কপোট্রন লাগিয়ে দিয়েছিলাম। ওর মস্তিষ্ক কোনোভাবেই সারানো যেত না, তাই আমি এই বিকল্পটি বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু সত্যি সত্যিই তো ও বুলা হয়েছিল! গভীর বেদনায় আমার বুক টনটন করে ওঠে। আমি ডাকলাম, বুলা!
বুলার চোখ ধক করে জ্বলে উঠল। বলল, বল রবোট!
না—আমি চিৎকার করে উঠলাম। বুলা, পাগল হয়ো না। আমার কথা শোন। তোমায় কে বলেছে তুমি রবোট?
টোপনের বিজ্ঞানমেলায় একটা মেটাল ডিটেকটর ছিল, বুলা কান্না সামলে বলতে থাকে, আমি কাছে যেতেই সেটি টিকটিক করে উঠল। তারপর আমি গিয়েছি কপোট্রনের ফার্মে। ওরা বলেছে, আমার মাথায় মস্তিষ্ক নেই, তার বদলে পারমাণবিক ক্যাটারিসহ একটা কপোট্রন কাজ করছে।
আমি ঠোঁট কামড়ে ধরলাম। তারপর বললাম, তাতে ক্ষতি হয়েছে কি? তুমি কাঁদাছ কেন?
তবে কি হাসব? আনন্দে চিৎকার করব? বুলা কান্না সামলাতে সামলাতে বিকৃত স্বরে বলল, কী আশ্চর্য! আমি তুচ্ছ একটা রবোট, অথচ আমি ভাবছি আমি বুলা, টোপনের মা, তোমার স্ত্রী–কুলা কান্নার বেগ সামলাতে ঠোঁট কামড়ে ধরল।
আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে। এত কষ্ট করে বুলার দেহে আমি আবার বুলাকে ফিরিয়ে এনেছিলাম। আমার সামনেই তা আবার ধ্বংস হয়ে যাবে? আমি বুলাকে দু হাত ধরে ঝাঁকুনি দিলাম, তারপর চিৎকার করে ডাকলাম, বুলা।
কি? ওর সারা মুখ চোখের পানিতে ভেসে যাচ্ছে।
শোন বুলা, তুমি যদি এখনও এরকম কর—আমি তীব্র স্বরে বললাম, তা হলে এক্ষুনি তোমাকে অজ্ঞান করে ফেলব।
বুলা বাষ্পাচ্ছন্ন চোখে আমার দিকে তাকাল।
হ্যাঁ। তোমাকে অজ্ঞান করে আবার তোমার মাথায় নূতন কপোট্রন বসাব, আবার নূতন করে তোমার মাঝে বুলাকে ফিরিয়ে আনব…
বুলা বিশ্বফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বলে চললাম, তোমাকে আমার চাই-ই চাই। তোমার জন্যে শোন বুলা, শুধু তোমার জন্যে আমি তোমার ধ্বংস হয়ে যাওয়া মস্তিষ্ক বদলে নূতন কপোট্রন বসিয়েছি। তোমার ক্ষুধা আছে, তৃষ্ণা আছে, ভালবাসা আছে। তোমার টোপন আছে, আমি আছি—তবু তুমি এরকম করছ?
তুমি বুকে হাত দিয়ে বল, তোমার বুকে আমার জন্য ভালবাসা নেই? টোপন তোমার ছেলে না? থাকুক তোমার মাথায় কপোট্রন। মানুষ কৃত্রিম চোখ, কৃত্রিম হাতপা, ফুসফুস নিয়ে বেঁচে নেই? তবে কেন পাগলামি করছ?
কথা বলতে বলতে আমার সব আবেগ স্রোতের মতো বেরিয়ে আসতে লাগল। কে জানত আমার ভিতরে এত আবেগ লুকিয়ে ছিল।
তোমার নিজেকে তুমি জিজ্ঞেস করে দেখ, তুমি বুলা কি না। বুলার চোখ, মুখ, হাতু, পা, চুল—সবকিছু বুলার, শুধু তোমার মস্তিষ্কটি কৃত্রিম, তাতে যে-অনুভূতি, সেটি পর্যন্ত বুলার, আমি নিজের হাতে ধীরে ধীরে তৈরি করেছি। তবু তুমি আমাকে অবিশ্বাস করছ।
আমার কী স্বাৰ্থ? তোমাকে প্ৰাণ দেয়ার আমার কী স্বাৰ্থ? রবোটের সাহায্যে তোমার মস্তিষ্ক বদলে মানবিক আবেগসম্পন্ন কপোট্রন তৈরি করে সেখানে বসানোতে আমার কী স্বাৰ্থ? শুধু তোমাকে পাওয়া-তোমাকে তোমাকে তোমাকে…
আমি বাষ্পাচ্ছন্ন চোখে বুলাকে তীব্র ঝাঁকুনি দিতে লাগলাম।
বুলা আমার বুকে মাথা গুঁজে বলল, তাহলে আমিই বুলা?
হ্যাঁ, তুমিই বুলা। পৃথিবীতে আর কোনো বুলা নেই।
টোপনি আমার ছেলে?
হ্যাঁ। টোপন তোমার ছেলে, তোমার আর আমার।
তুমি আমার—
আমি তোমার?
বুলা উত্তর না দিয়ে হাসল। আমি ওর চুলে হাত বোলাতে লাগলাম। এই চুলের আড়ালে বুলার মাথায় একটি কপোট্রন লুকানো আছে। কিন্তু ক্ষতি কি? এই কপোট্রন আমাকে ভালবাসে, টোপনকে স্নেহ করে, আনন্দে হাসে, দুঃখ পেলে কাঁদে। হলই-বা কপোট্রন!
আমি বুলাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম।
বিকেলে আমার হঠাৎ করে মনে হল আজ আমার কোথায় জানি যাবার কথা। ভোরে বারবার করে নিজেকে মনে করিয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু এখন আর মনে করতে পারছি না। আমি একটু অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম, তবে বিশেষ চিন্তিত হলাম না। আমি ঠিক জানি, আমার মস্তিষ্কও কপোট্রনের মতো পুরানো স্মৃতি হাতড়ে দেখতে শুরু করেছে, মনে করার চেষ্টা না করলেও ঠিক মনে হয়ে যাবে।
বৈকলিক চা খাওয়ার সময় আমার মনে পড়ল আজি সন্ধেয় একটি কপোট্রন প্ৰস্তুতকারক ফার্মে যাবার কথা। ডিরেক্টর ভদ্রলোক ফোন করে বলেছিলেন, তাঁরা কতকগুলি নিরীক্ষামূলক কপোট্রন তৈরি করেছেন, আমি দেখলে আনন্দ পাব। কিছুদিন আগে এই ডিরেক্টরের সাথে কোনো—এক বিষয়ে পরিচয় ও অল্প কিছু হয়েছিল। এখন মাঝে মাঝেই নৃতন রবোট তৈরি করলে আমাকে ফোন করে যাবার আমন্ত্রণ জানান।
ফার্মটি শহরের বাইরে, পৌঁছুতে একটু দেরি হয়ে গেল। লিফটে করে সাততলায় ডিরেক্টরের ঘরে হাজির হলাম। তিনি খানিকক্ষণ শিষ্টতামূলক আলাপ করে আমাকে তাঁদের রিসার্চ সেন্টারে নিয়ে গেলেন। ভেবেছিলাম। সদ্যপ্ৰস্তুত ঝকঝকে কতকগুলি রবোট দেখব, কিন্তু সেরকম কিছু না। বিরাট হলঘরের মতো ল্যাবরেটরিতে ছোট ছোট কালো টেবিলের উপর কাচের গোলকে কপোট্রন সাজিয়ে রাখা হয়েছে। একপাশে একটি প্রিন্টিং মেশিন, অপর পাশে মাইক্রোফোন, প্রশ্ন করলে উত্তর বলে দেবে কিংবা লিখে দেবে। দেয়ালে কিছু বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, চৌকোণা ট্রান্সফর্মার, দেখে মনে হল এখান থেকে উচ্চচাপের বৈদ্যুতিক প্রবাহ দেয়া হয়। কপোট্টনের সামনে লম্বাটে মাউথপীস। ঠিক একই রকম বেশ কয়টি কপোট্রন পাশাপাশি সাজানো। আমি জিজ্ঞাসু চোখে ডিরেক্টর ভদ্রলোকের দিকে তাকাতেই তিনি বললেন, রবোটের শরীরের সাথে এখনও জুড়ে দিই নি,-দিতে হবেও না বোধহয়।
কেন?
এই কপোট্রনগুলি স্বাভাবিক নয়। সব কপোট্রনই কিছু কিছু যুক্তিতর্ক মেনে চলে। এগুলির সেরকম কিছু নেই।
মানে? ওরা তাহলে আবোল-তাবোল বকে?
অনেকটা সেরকমই। ভদ্রলোক হাসলেন। ওদের কল্পনাশক্তি অস্বাভাবিক। ঘোর অযৌক্তিক ব্যাপারও বিশ্বাস করে এবং সে নিয়ে রীতিমতো তর্ক করে।
এগুলি তৈরি করে লাভ? এ তো দেখছি উন্মাদ কপোট্রন।
তা, উন্মাদ বলতে পারেন। কিন্তু এদের দিয়ে কোনো লাভ হবে না জোর দিয়ে বলা যায় না। বলগা ছাড়া ভাবনা যদি না করা হত, পদার্থবিদ্যা কোনোদিন ক্লাসিক্যাল থেকে রিলেটিভিস্টিক স্তরে পৌঁছুত না।
তা বটে। আমি মাথা নাড়ুলাম। কিন্তু তাই বলে ইচ্ছে করে পাগল কপোট্রন তৈরি করবেন?
আপনি আলাপ করে দেখুন না, আর কোনো লাভ হোক কি না-হোক, নির্ভেজাল আনন্দ তো পাবেন।
আমি একটা কপোট্রনের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কি হে?
নাম? নামের প্রয়োজন কী? ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য থাকলে নামের প্রয়োজন হয় না-যন্ত্রণা পিয়ে পরিচয় পাওয়া যায়। লাল নীল যন্ত্রণারা রক্তের ভিতর খেলা করতে থাকে….
সাহিত্যিক ধাঁচের মনে হচ্ছে? আমি ডিরেক্টর ভদ্রলোকের দিকে তাকোলাম।
হ্যাঁ। এটি সাহিত্যমান। একটা-কিছু জিজ্ঞেস করুন।
আমি কপোট্রনটিকে জিজ্ঞেস করলাম, যন্ত্রণারা আবার লাল নীল হয় কেমন করে?
যন্ত্রণারা সব রংয়ের হতে পারে, সব গন্ধের হতে পারে, এমনকি সবকিছুর মতো হতে পারে। যন্ত্রণার হাত-পা থাকে, চোখ থাকে-ফুরফুরে প্রজাপতির মতো পাখা থাকে। সেই পাখা নাড়িয়ে যন্ত্রণার আরো বড় যন্ত্রণায় উড়ে বেড়ায়। উড়ে উড়ে যখন ক্লান্তি নেমে আসে, তখন–
তখন?
তখন একটি একটি লাল ফুলের জন্ম হয়। সব নাইটিংগেল। তখন সবগুলো ফুলের কাঁটায় বুক লাগিয়ে রক্ত শুষে নেয়—লাল ফুল সাদা হয়ে যায়, সাদা ফুল লাল…
বেশ বেশী। আমি দ্রুত পাশের কপোট্রনের কাছে সরে এলাম।
এটিও কি ওটার মতো বদ্ধ পাগল?
না, এটা অনেক ভালো। এটি আবার বিজ্ঞানমনা। যুক্তিবিদ্যা ছাড়া তো বিজ্ঞান শেখানো যায় না, কাজেই এর অল্প কিছু যুক্তিবিদ্যা আছে। তবে আজগুবি আজগুবি সব ভাবনা এর মাথায় খেলতে থাকে।
আমি কপোট্রনটির পাশে দাঁড়ালাম। জিজ্ঞেস করলাম, বলতে পার বিজ্ঞান-সাধনা শেষ হবে কবে?
এই মুহূর্তে হতে পারে। একটু চেষ্টা করলেই।
আমি ডিরেক্টর ভদ্রলোকের দিকে তোকালাম, তবে না বলছিলেন এটা যুক্তিপূর্ণ কথা বলবে?
ওর বক্তব্যকে ব্যাখ্যা করতে বলুন দেখি।
আমি কপোট্রনটিকে বললাম, বিজ্ঞান-সাধনা শেষ হওয়া আমি দর্শন বা অন্য কোনো দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলি নি। আমি সাদা কথায় জানতে চাই বিজ্ঞান-সাধনা বা প্রকৃতির রহস্য উন্মোচন কবে শেষ হবে?
বললাম তো, ইচ্ছে করলে এখনই।
কীভাবে?
ভবিষ্যতের শেষ সীমানা থেকে টাইম মেশিনে চড়ে কেউ যদি আজ এই অতীতে ফিরে আসে, আর তাদের জ্ঞান-সাধনার ফলাটুকু বলে দেয়, তা হলেই তো হয়ে যায়। আর কষ্ট করে জ্ঞান-সাধনা করতে হয় না।
আমি বোকার মতো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, কিন্তু আমরা কী করতে পারি? ভবিষ্যৎ থেকে কেউ যদি না আসে?
নিশ্চয়ই আসবে। কপোট্রনটি যুক্তিহীনভাবে চেঁচিয়ে উঠল। ভবিষ্যতের লোকেরা নিশ্চয়ই বর্তমান কালের জ্ঞানের দুরবস্থা অনুভব করবে। এর জন্যে কাউকে-না–কাউকে জ্ঞানের ফলসহ না পাঠিয়ে পারে না।
সেই আশায় কতকাল বসে থাকিব?
লক্ষ বছর বসে থেকেও লাভ নেই। অথচ পরিশ্রম করলে এক মাসেও লাভ হতে পারে।
কি রকম?
যারা ভবিষ্যৎ থেকে অতীতে আসবে তারা তাদের কাল থেকে নিঃসময়ের রাজত্বে ঢুকবে নিজেদের যান্ত্রিক উৎকর্ষ দিয়ে, কিন্তু নিঃসময়ের রাজত্ব থেকে বর্তমানকালে পৌঁছুবে কীভাবে? কে তাদের সাহায্য করবে? পৃথিবী থেকে কেউ সাহায্য করলেই শুধুমাত্র সেটি সম্ভব।
তোমার কথা কিছু বুঝলাম না। নিঃসময়ের রাজত্ব কি?
নিঃসময় হচ্ছে সময়ের সেই মাত্রা, যেখানে সময়ের পরিবর্তন হয় না।
এসব কোথা থেকে বলিছ?
ভেবে ভেবে মন থেকে বলছি।
তাই হবে। এ ছাড়া এমন আষাঢ়ে গল্প সম্ভব।
আমি ডিরেক্টর ভদ্রলোককে বললাম, চলুন যাওয়া যাক। আপনার কপোট্রনদের সাথে চমৎকার সময় কাটল। কিন্তু যা-ই বলুন-আমি না বলে পারলাম না, এগুলি শুধু শুধু তৈরি করেছেন, কোনো কাজে লাগবে না।
আমারও তাই মনে হয়। তাঁকে চিন্তিত দেখায়, যুক্তিহীন ভাবনা দিয়ে লাভ নেই।
ফার্ম থেকে বাসায় ফেরার সময় নির্জন রাস্তায় গাড়িতে বসে বসে আমি কপোট্রনটির কথা ভেবে দেখলাম। সে যেসব কথা বলছে, তা অসম্ভব কল্পনাবিলাসী লোক ছাড়া বলা সম্ভব নয়। কিন্তু ব্যাপারটি কি শুধুই কল্পনাবিলাস? কথাগুলোর প্রমাণ নেই, কিন্তু যুক্তি কি একেবারেই নেই? আমি ভেবে দেখলাম, ভবিষ্যৎ থেকে কেউ এসে হাজির হলে মানবসভ্যতা এক ধাপে কত উপরে উঠে যেতে পারে। কিন্তু কপোট্রনের ঐ নিঃসময়ের রাজত্বটাজত্ব কথাগুলি একেবারে বাজে, শুধু কল্পনা করে কারো এরকম বলা উচিত না, তবে ব্যাপারটি কৌতূহলজনক। সত্যি সত্যি একটু ভেবে দেখলে হয়।
পরবর্তী কয়দিন যখন আমি অতীত, ভবিষ্যৎ, চতুর্মাত্রিক জগৎ, আপেক্ষিক তত্ত্ব ইত্যাদি নিয়ে পড়াশোনা করছিলাম, তখন মাঝে মাঝে আমার নিজেরই লজ্জা করত, একটি ক্ষ্যাপা কপোট্রনের কথা শুনে সময় নষ্ট করছি ভেবে। এ বিষয় নিয়ে কেন জানি আগে কেউ কোনোদিন গবেষণা করে নি। সময়ে পরিভ্রমণ সম্পর্কে আমি মাত্র একটি প্ৰবন্ধ পেলাম এবং সেটিও ভীষণ অসংবদ্ধ। বহু পরিশ্রম করে উন্নতশ্রেণীর কয়েকটি কম্পিউটারকে নানাভাবে জ্বালাতন করে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌছানো গেল। সেগুলি হচ্ছে, প্রথমত উপযুক্ত পরিবেশে সময়ের অনুকূল কিংবা প্রতিকূলে যাত্রা করে ভবিষ্যৎ কিংবা অতীতে যাওয়া সম্ভব। দ্বিতীয়ত, সময়ের স্লোতে যাত্রার পূর্বমুহূর্তে ও শেষমূহুর্তে অচিন্তানীয় পরিমাণ শক্তিক্ষয়ের প্রয়োজন। সেই মুহুর্তে শক্তিক্ষয় নিয়ন্ত্রণ না করলে পুরো মাত্রা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, এবং তৃতীয়ত, যাত্রার পূর্ব ও শেষমূহুর্তের মধ্যবর্তী সময় স্থির সময়ের ক্ষেত্ৰ। এই ক্ষেত্রে পরিভ্রমণে কোনো শক্তির প্রয়োজন নেই।
আমি ভেবে দেখলাম, উন্মাদ কপোট্রনাটি যা বলেছিল, তার সাথে এই সিদ্ধান্তগুলির খুব বেশি একটা অমিল নেই। প্রথমবারের মতো কপোট্রনটির জন্য আমার একটু সভ্রমবোধের জন্ম হল।
এরপর আমার মাথায় ভয়ানক ভয়ানক সব পরিকল্পনা খেলা করতে লাগল। যেসব ভবিষ্যতের অভিযাত্রীরা অতীতে আসতে চাইছে আমি তাদের সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। নিঃসময়ের ক্ষেত্র থেকে বর্তমানে পৌঁছুতে যে-শক্তিক্ষয় হয় তা নিয়ন্ত্রণের যান্ত্রিক কলাকৌশল আমার মাথায় উঁকি দিতে লাগল। এই সময়-স্টেশনটি তৈরি করতে কী ধরনের রবোটের সাহায্য নেব মনে মনে স্থির করে নিলাম।
যে-উন্মাদ কপোট্রনটির প্ররোচনায় আমি এই কাজে নেমেছি, তার সাথে আবার দেখা করতে গিয়ে শুনলাম সেটিকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। যারা যুক্তিহীন ভাবনা ভালবাসে তারা নাকি প্রকৃত অর্থেই অপদার্থ। শুনে আমার একটু দুঃখ হল।
যেহেতু সময়ে পরিভ্রমণ বিজ্ঞানীদের দ্বারা স্বীকৃত নয় এবং এ বিষয়ে গবেষণার জন্য সরকারি সাহায্যের কোনো আশা নেই, সেহেতু আমি এই সময়–স্টেশনটি বাসাতেই স্থাপন করব ঠিক করলাম। যান্ত্রিক কাজে পারদশী দুটি রবোট নিয়ে এসে খুব তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করলাম। পুরো পরিকল্পনা আমার নিজের চিন্তাপ্রসূত এবং ব্যাপারটি যে-কোনো বিষয় থেকে জটিল। কাজ শেষ হতে এক মাসের বেশি সময় লাগল। টোপন দিনরাত সব সময় স্টেশনের পাশে বসে থাকত। এটা দিয়ে ভবিষ্যতের মানুষের সাথে যোগাযোগ করা হবে শুনে সে অস্বাভাবিক কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। কোন সুইচটি কোন কাজে লাগবে এবং কোন লিভারটি কিসের জন্যে তৈরি হয়েছে জিজ্ঞেস করতে তার কোনো ক্লান্তি ছিল না।
পরীক্ষামূলকভাবে যেদিন সময়-স্টেশনটি চালু করলাম, সেদিন টোপন আমার পাশে বসে। উত্তেজনায় সে ছটফট করছিল। তার ধারণা, এটি চালু করলেই ভবিষ্যতের মানুষেরা টুপটাপ করে হাজির হতে থাকবে।
একটা মৃদু গুঞ্জনধ্বনির সাথে সাথে দুটি লালবাতি বিপবিপি করে জ্বলতে লাগল। সামনে নীলাভ স্ত্রীনে আলোকতরঙ্গ বিচিত্রভাবে খেলা করছিল। আমি দুটি লিভার টেনে একটা সুইচ টিপে ধরলাম, একটা বিস্ফোরণের মতো আওয়াজ হল, এখন স্থির সময়ের ক্ষেত্রের সাথে এই জটিল সময়–স্টেশনটির যোগাযোগ হবার কথা। সেখানে কোনো টাইম মেশিন থাকলে বড় স্ক্রীনটাতে সংকেত পাব। কিন্তু কোথায় কি? বসে থাকতে থাকতে আমার বিরক্তি ধরে গেল, বড় স্ক্রীনটিতে এতটুকু সংকেতের লক্ষণ পাওয়া গেল না।
পাশে বসে থাকা টোপনকে লক্ষ করলাম। সে আকুল আগ্রহে স্ত্রীনের দিকে তাকিয়ে আছে, উত্তেজনায় বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। সে প্রতি মুহূর্তে আশা করছে এক্ষুণি একজন ভবিষ্যতের মানুষ লাফিয়ে নেমে আসবে। তাকে দেখে আমার মায়া হল, জিজ্ঞেস করলাম, কি রে টোপন, কেউ যে আসে না।
আসবে বাবা, আসবে। তাকে স্থিরপ্রতিজ্ঞ দেখাল।
কেউ যদি আসে, তা হলে তাকে তুই কী বলবি?
বলব, গুড মনিং। সে স্ক্রীন থেকে চোখ সরাল না, পাছে ভবিষ্যতের মানুষ সেই ফাঁকে স্ত্রীনে দেখা দিয়ে চলে যায়।
আচ্ছা বাবা, আমার যদি একটা টাইম মেশিন থাকে—
হুঁ।
তা হলে আমি অতীতে যেতে পারব?
কেন পারবি না। অতীত ভবিষ্যৎ সব জায়গায় যেতে পারবি।
অতীতে গিয়ে আমার ছেলেবেলাকে দেখব?
দেখবি।
আমি যখন হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতাম, তখনকার আমাকে দেখব?
দেখিবি।
আচ্ছা বাবা, অতীতে গিয়ে আমি যদি আমার হামা-দেয়া আমাকে মেরে ফেলি। তাহলে আমি এখন কোথেকে আসব?
আমি চুপ করে থাকলাম। সত্যিই তো। কেউ যদি অতীতে গিয়ে নিজেকে হত্যা করে আসে, তাহলে সে আসবে কোত্থেকে? অথচ সে আছে, কারণ সে নিজে হত্যা করেছে। এ কী করে সম্ভব? আমি ভেবে দেখলাম, এ কিছুতেই সম্ভব না।—কাজেই অতীতে ফেরাও সম্ভব না। টাইম মেশিনে করে ভবিষ্যতের মানুষ অতীতে ফিরে আসবে, এসব কল্পনাবিলাস। আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। একটি উন্মাদ কপোট্রনের প্ররোচনায় এতদিন শুধু শুধু পরিশ্রম করেছি, অকাতরে টাকা ব্যয় করেছি? রাগে দুঃখে আমার চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে হল। লিভার ঠেলে সুইচ টিপে আমি সময়স্টেশনটি বন্ধ করে দিলাম।
বাবা, বন্ধ করলে কেন? টোপন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।
তোর প্রশ্ন শুনে। তুই যে-প্রশ্নটি করেছিস সেটি আমার আগে মনে হয় নি, তাই।
টোপন্ন কিছু না বুঝে বলল, কি প্রশ্ন?
ঐ যে তুই জিজ্ঞেস করলি, অতীতে নিজেকে মেরে ফেললে পরে কোথেকে আসব? তাই অতীতে যাওয়া সম্ভব না, টাইম মেশিন তৈরি সম্ভব না–
টোপনের চোখে পানি টলমল করে উঠল। মনে হল এই প্রশ্নটি করে আমাকে নিরুৎসাহিত করে দিয়েছে বলে নিজের উপর ক্ষেপে উঠেছে। আমাকে অনুনয় করে বলল, আর একটু থাক না বাবা।
থেকে কোনো লাভ নেই। আয় যাই, অনেক রাত হয়েছে।
টোপন বিষণ্ণমুখে আমার পিছনে পিছনে আসতে লাগল। আমি বুঝতে পারলাম সময়ে পরিভ্রমণের উপরে কেন এতদিন কোনো কাজ হয় নি। সবাই জানত এটি অসম্ভব। ভবিষ্যৎ থেকে অতীতে এলে অতীত পরিবর্তিত হয়ে যায়, কিন্তু বাস্তব জগতের পরিবর্তন—তা অতীতই হোক আর ভবিষ্যৎই হোক, কোনো দিনই সম্ভব নয়। আমি প্রথমে উন্মাদ কপোট্রনটির উপর, পরে নিজের উপর ক্ষেপে উঠলাম। কম্পিউটারগুলিকে কেন যে বাস্তব সম্ভাবনার কথা জিজ্ঞেস করি নি, ভেবে অনুতাপ হল। কিন্তু তাতে লাভ কী আমার, এই অযথা পরিশ্রম আর কোনো দিন ফিরে আসবে না।
টোপন কিন্তু হাল ছাড়ল না। প্রতিদিন আমাকে অনুনয়-বিনয় করে সময়স্টেশনটি চালু করতে বলত। তাকে কোনো যুক্তি দিয়ে বোঝানো গেল না যে, কোনোদিনই ভবিষ্যতের মানুষ অতীতে আসবে না,-এটি একটি অসম্ভব ব্যাপার। তার অনুনয়-বিনয় শুনতে শুনতে আমাকে শেষ পর্যন্ত হার মানতে হল। আমি আবার সময়-স্টেশনটি চালু করলাম। টোপনকে সুইচপ্যানেলের সামনে বসিয়ে দিয়ে আমি চলে এলাম। আসার সময় সাবধান করে দিলাম, কোনো সুইচে যেন ভুলেও চাপ না দেয়। শুধু বড় স্ক্রীনটার দিকে যেন নজর রাখে। যদি কিছু দেখতে পায় (দেখবে না জানি) তবে আমাকে যেন খবর দেয়।
এই জটিল ও মূল্যবান যন্ত্রটি সাত বছরের একটি ছেলের দায়িত্বে ছেড়ে দিয়ে চলে আসতে আমার কোনো দ্বিধা হয় নি। আমি জানি, বাচ্চা ছেলেদের ছেলেবেলা থেকে সত্যিকার দায়িত্ব পালন করতে দিলে তারা সেগুলি মন দিয়ে পালন করে, আর পরে খাঁটি মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। টোপনের সাথে আগেও আমি বেশ গুরুত্ব দিয়ে কথা বলতাম, প্রায় বিষয়েই আমি ওর সাথে এমনভাবে পরামর্শ করেছি, যেন সে একটি বয়স্ক মানুষ। এই সময়-স্টেশনটি তৈরি করার সময়েও কোন লিভারটি কোথায় বসালে ভালো হবে, তার সাথে আলাপ করে দেখেছি।
সারাদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে কাটিয়ে সন্ধেয় বাসায় ফিরে আসতেই বুলা আমাকে বলল, টোপন সারা দিন নাওয়া-খাওয়া করে নি। একমনে সময়স্টেশনের সামনে বসে আছে। আমি হেসে বললাম, একদিন নাওয়া-খাওয়া না করলে কিছু হয় না।
তুমি তো তাই বলবে! বুলা উষ্ণ হয়ে বলল, নিজে যেরকম হয়েছ, ছেলেটিকেও সেরকম তৈরি করছিা!
বেশ, বেশ, টোপনকে খেতে পাঠিয়ে দিচ্ছি, বলে আমি সময়— স্টেশনটিতে হাজির হলাম। অতিকায় যন্ত্রপাতির ভিতরে সুইচ প্যানেলের সামনে ছোট্ট টোপন গভীর মুখে বড় স্ক্রীনটার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। আমি পিছনে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রাখলাম। সে চমকে উঠে বলল, কে?
আমি। কি রে, কিছু দেখলি?
এখনও দেখি নি। তবে ঠিক দেখব। সারা দিন না খেয়ে ওর মুখটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে।
যা, এখন খেয়ে আয়। ততক্ষণ আমি বসি।
তুমি বসবে? টোপন কৌতূহলী চোখে আমার দিকে তাকাল। আমি যাব। আর আসব, একছুটে—
একছুটে যেতে হবে না। ধীরেসুস্থে খেয়েদেয়ে আয়। সারা দিনরাত তো আর এখানে বসে থাকতে পারবি না! ঘুমোতে হবে, পড়তে হবে, স্কুলে যেতে হবে, খেলাধুলা করতে হবে।
কয়দিন খেলাধুলা করব না, স্কুল থেকে এসেই এখানে বসব। তারপর পড়া শেষ করে—
বেশ বেশ।
তুমি নাহয় আমাকে শিখিয়ে দিও কীভাবে এটি চালু করতে হয়। তা হলে তোমাকে বিরক্ত করব না।
আচ্ছা আচ্ছা, তাই দেব। এখন খেয়ে আয়।
শেষ পর্যন্ত পুরো সময়-স্টেশনটি টোপনের খেলার সামগ্ৰী হয়ে দাঁড়াল। সে সময় পেলেই নিজের এসে চালু করে চুপচাপ বসে থাকত, আর যাবার সময় বন্ধ করে চলে যেত। আমি মাঝে মাঝে এসে দেখে যেতাম। টোপনকে জিজ্ঞেস করতাম, কি রে, কিছু দেখলি?
এখনও দেখি নি, তবে ঠিক দেখব। এরই নাম বিশ্বাস। আমি মনে মনে হাসাঁতাম এরপর বহুদিন কেটে গেছে। আমি সময়-স্টেশনটির কথা ভূলেই গেছি। মাঝে মাঝে টোপন এসে আমাকে নিয়ে যেত যন্ত্রপাতি ঠিক আছে কি না পরীক্ষা করে দেখার জন্যে। খুঁটিনাটি ভুলের জন্যে ভবিষ্যতের মানুষ হাতছাড়া হয়ে গেলে তার দুঃখের সীমা থাকবে না।
সেদিন দুপুরে আমি সবে এক কাপ কফি খেয়ে কতকগুলি কাগজপত্র দেখছি, এমন সময় ঝনঝনি করে ফোন বেজে উঠল। সহকারী মেয়েটি ফোন ধরে রিসিভারটি আমার দিকে এগিয়ে দিল, আপনার ছেলের ফোন।
আমি রিসিভারে কান পাততেই টোপনের চিৎকার শুনলা, বাবা, এসেছে, এসেছে—এসে গেছে!
কে এসেছে?
ভবিষ্যতের মানুষ! তুমি তাড়াতাড়ি চলে এস।
ব্যাপারটা বুঝতে আমার সময় লাগল। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কি রকম মানুষ?
এখনও দেখি নি। বড় ক্ৰীনটায় এখন শুধু আলোর দাগ দেখা যাচ্ছে। প্রথমে লম্বা লম্বা থাকে, পরে হঠাৎ ঢেউয়ের মতো হয়ে যায়। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এস।
সত্যি বলছিস তো? টোপন মিথ্যা বলে না জেনেও জিজ্ঞেস না করে পারলাম না, ঠিক দেখেছিস তো?
তুমি এসে দেখে যাও, মিথ্যা বলছি না কি। টোপনের গলার স্বর কাদো কাঁদে হয়ে যায়, এতক্ষণে চলেই গেল নাকি!
আমি সহকারী মেয়েটিকে বললাম, জরুরি কাজে চলে যাচ্ছি, বাসায় কেউ যেন বিরক্ত না করে। তারপর লিফুট বেয়ে নেমে এলাম।
বাসা বেশি দূরে নয়, পৌঁছুতে বেশি সময় লাগল না। টোপন আমার জন্যে বাসার গেটে অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছিল। আমাকে দেখেই পুরো ঘটনাটা হড়বড় করে দু বার বলে গেল। আমি তাকে নিয়ে সময়—স্টেশনে ঢুকে দেখি বড় স্ক্রীনটা সত্যি সত্যি আলোকতরঙ্গে ভরে যাচ্ছে। এটি হচ্ছে স্থির সময়ের ক্ষেত্রে পার্থিব বস্তুর উপস্থিতির সংকেত। আমার চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। আমার সামনে সম্পূর্ণ অসম্ভব একটি ঘটনা ঘটতে চলেছে।
এখন আমার অনেক কাজ বাকি। সাহায্য করার কেউ নেই, টোপনকে নিয়েই কাজ শুরু করতে হল। প্রথমে দুটো বড় বড় জেনারেটর চালু করলাম—গুমগুমা শব্দে ট্রান্সফর্মারগুলি কোঁপে উঠল। ঝিলিক ঝিলিক করে দুটো নীল আলো ঘুরে ঘুরে যেতে লাগল। বিভিন্ন মিটারের কাঁটা কোপে কোঁপে উঠে স্থির হয়ে গেল। লিভারের চাপ দিতেই সামনে অনেকটুকু জায়গায় শক্তিশালী চৌম্বকীয় ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে গেল। দীর্ঘদিনের জমে ওঠা ধুলাবালি আয়নিত হয়ে কাপনের সাথে সেখানে একটা ঘূর্ণির সৃষ্টি করল, এগুলি আর পরিষ্কার করার উপায় নেই।
তারপর সবদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে সুইচ প্যানেলের সামনে বসে পড়লাম, কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে কে জানে?
রাত দুটো বাজার পরও কিছু হল না। আমি সব রকম প্রস্তুতি শেষ করে বসে আছি। এখন ঐ ভবিষ্যতের যাত্রী নেমে আসতে চাইলেই হয়। এক সময় লক্ষ করলাম, টোপন টুলে বসে সুইচ প্যানেলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। সারা দিনের উত্তেজনা ওকে দুর্বল করে ফেলেছে, নইলে ও এত সহজে ঘুমোবার পাত্র নয়। ওকে জাগিয়ে দিতেই ধড়মড় করে উঠে বলল, এসেছে?
এখনো আসে নি, দেরি হতে পারে। তুই ঘরে গিয়ে ঘুমে। এলেই খবর দেব।
না না—টোপন প্রবল আপত্তি জানাল, আমি এখানেই থাকব।
বেশ, থাক তাহলে। তোর ঘুম পাচ্ছে দেখে বলছিলাম।
একটু পরে ঘুমে বারকয়েক ঢুলে পড়ে টোপন নিজেই বলল, বাবা, খুব বেশি দেরি হবে? তা হলে আমি না হয় একটু শুয়ে আসি, ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। ওরা আসতেই ভূমি আমাকে খবর দিও।
ঠিক আছে। পুরো কৃতিত্বটাই তো তোর—তোকে খবর না দিয়ে পারি?
টোপন খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে চলে গেল।
বসে সিগারেট খেতে খেতে বোধহয় একটু তন্দ্ৰামতো এসেছিল। প্রচণ্ড শব্দ শুনে লাফিয়ে উঠলাম। হঠাৎ করে, কিছু বোঝার আগে খালি জায়গায় অতিকায় চ্যাপটামতো ধূসর কী-একটা নেমেছে। ঘরে ঢোকার জন্যে ছোট ছোট দরজা, অথচ এটি কীভাবে ভিতরে চলে এসেছে ভেবে ধাঁধা লেগে যাবার কথা। ভীষণ ধুলাঝালি উড়ছে, রনোমিটার কঁ কঁ শব্দ করে বিপদসংকেত দিচ্ছে, আমি তীব্র রেডিয়েশন অনুভব করে ছুটে একপাশে সরে এলাম। একা এতগুলো সুইচ সামলানো কঠিন ব্যাপার। টাইম মেশিনকে স্থির করতে আমার কালো ঘাম ছুটে গেল।
একটু পরে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, জিনিসটা হোভার ক্র্যাফটের মতো দেখতে, অতিকায়। পিছনের দিকটা চৌকোণা হয়ে গেছে। মাথা চ্যাপটা, তাতে দুটো বড় বড় ফুটো-ভিতরে লাল আলো ঘুরছে। টাইম মেশিনটির মাঝামাঝি জায়গায় খানিকটা অংশ কালো রংয়ের, আমার মনে হল এটিই বোধহয় দরজা ঠিক তক্ষুণি খানিকটা গোল অংশ সরে গিয়ে একটা গর্ত বেরিয়ে পড়ল। উত্তেজনায আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল, আমি আমার হৃৎপিণ্ডের শব্দ শুনতে পেলাম, এক্ষুণি ভবিষ্যতের মানুষ নামবে।
আমার চোখের সামনে ধীরে ধীরে একজন নেমে এল, ভেবেছিলাম স্পেসসুন্টজাতীয় কিছু গায়ে মানুষ, কাছে আসার পর বুঝতে পারলাম। ওটি একটি রবোট। রবোট হেঁটে আমার সামনে এসে দাঁড়াল, তারপর মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, আমার হিসেব ভুল না হলে আপনি আমার কথা বুঝতে পারবেন।
হ্যাঁ, পারছি। আমি রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে নিলাম। সুদূর অতীতের অধিবাসী আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে।
সুদূর ভবিষ্যতের অধিবাসীও প্রত্যুত্তরে আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। আমি জীবনে প্রথম একটি রবোটকে হাসতে দেখলাম। কিন্তু তার কথাটি আমার কানে খট করে আঘাত করল। সুদূর ভবিষ্যতের অধিবাসী মানে? তাহলে কি ভবিষ্যতে রবোটরাই পৃথিবীর অধিবাসী?
আমাকে অবতরণ করতে সাহায্য করেছেন বলে ধন্যবাদ। রবোটটির চোখ কৃতজ্ঞ হয়ে উঠল। তবুও যথেষ্ট ধকল গিয়েছে। একটা ফ্লিচিং বার্ড ছিঁড়ে গেছে।
আমি কী করতে পারি? হাত উল্টিয়ে বললাম, এই শতাব্দীতে যান্ত্রিক উৎকর্ষের ভিতরে যতটুকু সম্ভব—
সে তো বটেই, সে তো বটেই। রবোটটি ব্যস্ত হয়ে বলল, আমরা এতটুকুও আশা করিনি।
আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রবোটটির গঠননৈপুণ্য, কথা বলার ভঙ্গি, ক্ষণে ক্ষুণে বদলে যাওয়া চোখের দৃষ্টি, মুখের ভাব লক্ষ করছিলাম। যান্ত্রিক উৎকর্ষ কত নিখুঁত হলে এরকম একটি রবোট তৈরি করা সম্ভব, চিন্তা করতে গিয়ে কোনো কুল পেলাম না। একটি মানুষের সাথে এর কোনো পার্থক্য নেই। খুব অস্বস্তির সাথে মনে হল, হয়তো কোনো কোনো দিকে এটি মানুষের থেকেও নিখুঁত। কিন্তু আমি বিস্ময় ইত্যাদি ঝেড়ে ফেলে কাজের কথা সেরে নিতে ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। রবোটটিকে বললাম, আপনি ভবিষ্যৎ থেকে এসেছেন। সবকিছুর আগে আমার কিছু প্রশ্নের জবাব দিন।
নিশ্চয়ই। কিন্তু আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। আপনাদের পৃথিবীর হিসেবে এক ঘন্টা পরে এই টাইম মেশিন নিজে থেকে চালু হয়ে উঠে আমাকে নিয়ে আরো অতীতে চলে যাবে।
এক ঘন্টা অনেক সময়, তার তুলনায় আমার প্রশ্ন বেশি নেই। আমি মনে মনে প্রশ্নগুলি গুছিয়ে নিয়ে বললাম, কেউ অতীতে ফিরে এলে অতীত পরিবর্তিত হয়ে যায়। এটি কী করে সম্ভব?
অর্থাৎ আপনি বলতে চাইছেন—
যেমন আপনি আজ থেকে কয়েক হাজার বছর পরে সৃষ্টি হবেন, আপনার অতীতের আপনি সেই, কারণ এখনও আপনি সৃষ্টি হন নি। কিন্তু যেই মুহূর্তে আপনি অতীতে আসবেন, তৎক্ষণাৎ আগের অতীতের সাথে পার্থক্য সৃষ্টি হবে—অতীতটা পরিবর্তিত হয়ে যাবে। এটা কী করে সম্ভব?
রবোটটি অসহিষ্ণু মানুষের মতো কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, আপনি এই সহজ জিনিসটা বুঝতে পারছেন না? অতীত ফিরে এলে তো সে অতীত আর আগের থাকে না, নতুন অতীতের সৃষ্টি হয়।
মানে? অতীত কয়টা হতে পারে?
বহু। এখানেই আপনারা ভুল করছেন। শুধু অতীত নয়, জীবনও বহু হতে পারে। আপনি ভাবছেন আপনার জীবনটাই সত্য, কিন্তু আমার অতীতে আপনার যে অস্তিত্ব ছিল, তাতেও আপনার অন্য এক অস্তিত্ব তার জীবনটাকে সত্যি ভেবেছিল। এই মুহূর্তেও আপনার অনেক অস্তিত্ব বিদ্যমান, আপনার চোখে সেগুলো বাস্তব নয়, কারণ আপনি সময়ের সাথে সাথে সেই অস্তিত্ত্বে প্রবাহিত হচ্ছেন না। অথচ তারা ভাবছে তাদের অস্তিত্বটাই বাস্তব, অন্য সব অস্তিত্ব কাল্পনিক।
মানে? আমার সবকিছু গুলিয়ে গেল। আপনার কথা সত্যি হলে আমার আরো অস্তিত্ব আছে?
শুধু আপনার নয়, প্রত্যেকের, প্রত্যেকটি জিনিসের অসীমসংখ্যক অস্তিত্ব। আপনারা আমরা সবাই সময়ের সাথে সাথে এক অস্তিত্ব থেকে অন্য অস্তিত্বে প্রবাহিত হই। যে—অস্তিত্বে আমরা প্রবাহিত হই সেটিকেই সত্য বলে জানি—তার মানে এই নয় অন্যগুলি কাল্পনিক।
তা হলে ব্যাপারটি দাঁড়াচ্ছে এরকম। আমি একটু চিন্তা করে নিলাম। পৃথিবী সৃষ্টি হল, মানুষের জন্ম হল, সভ্যতা গড়ে উঠল, একসময় আমার জন্ম হল। আমি বড় হলাম, একসময়ে মারা গেলাম। তারপর অনেক হাজার বছর পার হল, তখন আপনি সৃষ্টি হলেন। আপনি অতীতে ফিরে এলেন আবার আমার কাছে। আবার আমি বড় হব, মারা যাব, কিন্তু সেটি আগের আমি না-সেটি আমার আগের জীবন না, কারণ আগের জীবনে আপনাকে আমি দেখি নি।
ঠিক বলেছেন। এইটি নতুন অস্তিত্বে প্রবাহ। আপনার পাশাপাশি আরো অনেক জীবন এভাবে বয়ে যাচ্ছে, সেগুলি আপনি দেখবেন না, বুঝবেন না—
কেন দেখব না?
দুই সমতলে দুটি সরল রেখার কোনোদিন দেখা হয় না, আর এটি তো ভিন্ন ভিন্ন অস্তিত্বের প্রশ্ন।
আমি মাথার চুল খামচে ধরলাম। কী ভয়ানক কথা! এই পৃথিবী, জীবনপ্রবাহ, সভ্যতাকে কী সহজ ভাবতাম। অথচ এর নাকি হাজার হাজার রূপ আছে, সবাই নিজেদের সত্যি বলে ভাবছে। আমি কাতর গলায় বললাম, এইসব হাজার হাজার অস্তিত্ব ঝামেলা করে না? একটা আরেকটার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে—
হতে পারে। আমরা মাথা ঘামাই না। আমরা আমাদের জীবনপ্রবাহটিকে ঠিক রাখতে চাই। এ-ব্যাপারে অন্য কোনো অস্তিত্ব ঝামেলা করলে আমরা তাদের জীবনপ্রবাহ বদলে অন্যরকম করে ফেলি, এর বেশি কিছু না।
বুঝতে পারলাম না।
যেমন ধরুন আপনাদের জীবনপ্রবাহটি, এটির ভবিষ্যৎ খুব সুবিধের নয়। আমরা যেরকম খুব সহজে মানুষকে পরাজিত করে জ্ঞানবিজ্ঞানের সাধনা, পৃথিবীর কতৃত্ব আমাদের হাতে নিয়ে নিয়েছি, আপনাদের ভবিষ্যতে রবোটরা তা পারত না, আমি যদি এখানে না। আসতাম। আপনাদের ভবিষ্যতের মানুষদের আমাদের অস্তিত্বে হামলা করে মানুষের পক্ষ থেকে রবোটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কথা। আমরা সেটি চাই না, তাই এটা পরিবর্তিত করতে চাইছি।
কীভাবে?
এই যে আপনার কাছে চলে এলাম-এতে এই অতীতটি পরিবর্তিত হয়ে নুতন দিকে চলছে। আমরা দেখে এসেছি, এখন খুব তাড়াতাড়ি রবোটরা আপনাদের পরাজিত করে ক্ষমতা নিয়ে নেবে। জ্ঞানবিজ্ঞান সাধনায় আর কোনো অন্তরায় থাকবে না।
আমি চুপ করে রইলাম।
তারপর ধরুন জীবনসৃষ্টির ব্যাপারটা। আমার অতীতে যাওয়ার প্রথম কারণই তো এইটি।
কি-রকম?
আমাদের প্রত্নতত্ত্ববিদরা পৃথিবীর এক আদিম গুহায় কয়েক শত কোটি বছর আপুকুর একটি আশ্চর্য জিনিস পেয়েছিলেন
আমাকে পেয়েছিলেন। এই টাইম মেশিনে বসে আছি, অবশ্যি বিধ্বস্ত অবস্থায়।
মানে?
হ্যাঁ, আমার কপোট্রন বিশ্লেষণ করে দেখা গেল। আমি কতকগুলি এককোষী প্রাণী নিয়ে গিয়েছিলাম।
কেন?
পৃথিবীতে প্ৰাণ সৃষ্টি করতে। পৃথিবী সৃষ্টির পরে এখানে প্রাণের জন্ম সম্বন্ধে আপনারা যা ভাবছেন, তা সত্যি নয়। মহাকাশ থেকে জটিল জৈবিক অণু থেকে নয়, মাটি পানির ক্রমাগত ঘর্ষণে স্বাভাবিক উপায়ে নয়, ঈশ্বরের কৃপাতেও নয়, আমিই অতীত প্ৰাণ নিয়ে গিয়েছি। শুদ্ধ করে বললে বলতে হয়, প্ৰাণ নিয়ে যাচ্ছি।
মানে? আপনি বলতে চান সুদূর অতীতে এই এককোষী প্রাণী ছড়িয়ে দিলে পরেই প্রাণের জন্ম হবে, ক্রমবিবর্তনে গাছপালা, ডাইনোসর, বাঘ-ভালুক, মানুষ এসবের জন্ম হবে না?
ঠিক ধরেছেন।
কিন্তু যদি আপনি ব্যর্থ হন? আমি কঠোর গলায় বললাম, যদি আপনি অতীতে এককোষী প্ৰাণী নিয়ে প্রাণের সৃষ্টি করতে না পারেন তাহলে কি এই জীবন, সভ্যতা কিছুই সৃষ্টি হবে না?
ব্যৰ্থ হওয়া সম্ভব নয়, যেহেতু আমাকে কয়েক শত কোটি বছর আগে পাওয়া গেছে, কাজেই আমি ব্যর্থ হলেও আমার অন্য কোনো অস্তিত্ব নিশ্চয়ই অতীতে প্ৰাণ রেখে আসবে। তবে তার প্রয়োজন হবে না। আমার ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা নেই। আমি পুরো অতীত পর্যবেক্ষণ করে দেখছি।
কিন্তু তবু যদি আপনি ব্যর্থ হন?
বললাম তো হব না। আমি আমার পুরো যাত্রাপথ ছকে এসেছি।
কিন্তু যদি তবুও কোনোভাবে ব্যর্থ হন? আমি একগুয়ের মতো বললাম, কোনো দুৰ্ঘটনায় যদি আপনার মৃত্যু হয়? কিংবা আপনার টাইম মেশিন যদি ধ্বংস হয়?
তা হলে বুঝতে হবে আমি অন্য এক জগতে ভুলে নেমে পড়েছি।
সেটির ভবিষ্যৎ কি?
কে বলতে পারে। তবে-রবোটটি মনে মনে কী হিসেবে করল, তারপর বলল, যদি আমি কোনো জগতে নামার দরুন অতীতে ফিরে যেতে ব্যর্থ হই, তবে সেজগতের ভবিষ্যৎ খুব খারাপ, এখনও মানুষ খুঁকঠুক করে জ্ঞানসাধনা করছে। রবোটটি হা-হা করে হাসল, বলল, হয়তো আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ লাগিয়ে একেবারে গোড়া থেকে সভ্যতা সৃষ্টি করছে। রবোটটি আবার দুলে দুলে হেসে উঠল। মানুষের প্রতি এর অবজ্ঞা প্রায় নিষ্ঠুরতার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, কিন্তু সে নিজে এটি বুঝতে পারছে না।
আমি অনেক কষ্ট করে শান্ত থাকলাম। তারপর মৃদুস্বরে বললাম, আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে পারলাম।
আরো আলাপ করার ইচ্ছে ছিল, রবোটটি বলল, কিন্তু এই টাইম মেশিনটি একটু পরে নিজে থেকে চালু হয়ে উঠবে। আর সময় নেই।
এক সেকেণ্ড। আমার টোপনের কথা মনে হল। বললাম, আমার ছেলে ভবিষ্যতের অধিবাসী দেখতে ভীষণ আগ্রহী। শুর আগ্রহেই আপনার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছে-ওকে একটু ডেকে আনি।
বেশ, বেশ। তবে একটু তাড়াতাড়ি করুন। বুঝতেই পারছেন–
আমি টোপনের ঘরে যাওয়ার আগে নিজের ঘরে গেলাম, একটি জিনিস নিতে হবে। বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হল না, ড়ুয়ারে ছিল। সেটি শার্টের তলায় গুঁজে টোপনকে ডেকে তুললাম, টোপন, ওঠ, ভবিষ্যতের মানুষ এসেছে।
এসেছে বাবা? এসেছে? কেমন দেখতে?
দেখলেই বুঝতে পারবি, আয় আমার সাথে। আমি ওকে নিয়ে দ্রুত স্টেশনে হাজির হলাম। রবোটটি সুইচ প্যানেলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওটিকে দেখে টোপন অবাক হয়ে বলল, মানুষ কই, এটি তো রবোট!
ভবিষ্যতের মানুষ রবোটই হয়! আমি দাঁতে দাঁত চেপে হাসলাম। টোপন বিমর্ষ হয়ে আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইল, কথা বলার উৎসাহ পেল না। রবোটটি একটু অপ্ৰস্তুত হল মনে হল। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, এবারে বিদায় নিই, আমি অনেক বড় দায়িত্ব নিয়ে এসেছি।
বেশ। আমি হাত নাড়লাম, আবার দেখা হবে।
রবোটটি তার টাইম মেশিনের দরজায় উঠে দাঁড়াল। বিদায় নিয়ে হাত নেড়ে ওটি ঘুরে দাঁড়াল।
টোপন—আমি চিবিয়ে কললাম, চোখ বন্ধ করা। না বলা পর্যন্ত চোখ খুলবি না।
কেন বাবা?
কাজ আছে, বন্ধ করা চোখ। টোপন চোখ বন্ধ করল। আমি শার্টের তলা থেকে একটু আগে নিয়ে আসা রিভলবারটি বের করলাম। রবোটটি শেষ করে দিতে হবে। আমার বংশধরের ভবিষ্যৎ এই রবোটদের পদানত হতে দেয়া যাবে না। এটিকে শেষ করে দিলেই পুরো ভবিষ্যৎ পাল্টে যাবে।
রিভলবারটি তুলে ধরলাম। একসময় ভালো হাতের টিপ ছিল। হে মহাকাল, একটিবার সেই টিপ ফিরিয়ে দাও। মনুষ্যত্বের দোহাই, পৃথিবীর দোহাই, একটি ধার হাতের নিশানা ঠিক করে দাও, … একটিবার…
আমি রবোটের কপোট্রন লক্ষ্য করে গুলি করলাম, প্রচণ্ড শব্দ হল। টোপন চিৎকার করে আমাকে জড়িয়ে ধরল, আর রবোটটির চূৰ্ণ কপোট্রন টুকরো টুকরো হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। খুব ধীরে ধীরে রবোটটি কান্ত হয়ে টাইম মেশিনের ভিতর পড়ে গেল।
খানিকক্ষণ থেকেই একটা ভোঁতা শব্দ হচ্ছিল, এবার সেটা তীক্ষ্ণ সাইরেনের আওয়াজের মতো হল। সাৎ করে হঠাৎ দরজাটি বন্ধ হয়ে গেল। ধীরে ধীরে কানে তালা লাগানো শব্দে চারদিক কেঁপে উঠল, তারপর কিছু বোঝার আগে ধূসর টাইম মেশিন অদৃশ্য হয়ে গেল। শূন্য জায়গাটা দেখে কে বলবে এখানে কখনো কিছু এসেছিল!
চোখ খোল টোপন। টোপন চোখ খুলে চারদিক দেখল। তারপর, আমার দিকে তাকাল, কী হয়েছে। বাবা?
কিছু না।
রবোট কই? টাইম মেশিন কই?
চলে গেছে।
আর আসবে না?
না। আর আসবে না। যদি আসে মানুষ আসবে।
কবে?
আজ হোক কাল হোক, আসবেই একদিন। মানুষ না এসে পারে?
ডাক্তার বলেছিলেন রাত দশটার ভেতর যেন শুয়ে পড়ি। প্রতিদিন আমার পক্ষে এত সকাল সকাল শুয়ে পড়া সম্ভব নয়। টেকীওনের উপর দুটো প্ৰবন্ধ শেষ করতে এ সপ্তাহের প্রতি রাতেই ঘুমোতে দেরি হয়েছে। স্পষ্ট বুঝতে পারছি, ভিতরে ভিতরে আমি দুর্বল হয়ে পড়েছি। বুলা এসে জানতে পারলে কিছুতেই আমাকে ছেড়ে দেবে না। অথচ রাত জাগা যে বেশি হয়ে গেছে, এটা কিছুতেই তার কাছে লুকানো যাবে না। ইলেনকে জিজ্ঞেস করলেই সে সবকিছু বলে দেবে। আমি ইলেনকে একটু তালিম দেয়া যায় কি না ভাবছিলাম। সে পাশে বসেই আমার প্রবন্ধটা টাইপ করছিল। আমি গল্পচ্ছলে কথা বলতে শুরু করলাম।
ইলেন—
বলুন।
এ কয়দিন রাত জাগা আমার উচিত হয় নি। কি বল?
জ্বি। আমিও বলছিলাম রাত জেগে কাজ নেই।
তা রাত যখন জাগা হয়েই গেছে, এটা সবাইকে জানিয়ে দিয়ে তো কোনো লাভ নেই। সো-রাতগুলো তো আর ঘুমানোর জন্য ফিরে পাব না। না কি বল?
ইলেন একটু হাসির ভঙ্গি করল। সে তো বটেই।
আমি একটু অস্বস্তি নিয়ে বললাম, তাহলে বুলা যদি তোমাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি রাত জাগার কথা বেমালুম চেপে যাবে। কেমন?
ইলেন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল। তারপর ধীরে ধীরে আমার দিকে তাকাল। সবুজাভ ফটোসেলের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে ধাতব মুখে অনুচ্চস্বরে বলল, আপনি তো জানেন স্যার, আমরা মিথ্যা কথা বলতে পারি না—আপনারা সেভাবে আমাদের তৈরি করেন নি।
এ মিথ্যা কোথায়? অহেতুক ঝামেলা এড়াবার জন্য একটা বক্তব্যকে অন্যভাবে উপস্থাপন করা-চেষ্টা করে দেখ।
রবোটটিকে অসহায় দেখাল। না। স্যার, আমি আগেও চেষ্টা করেছি। তারপর বিড়বিড় করে বলল, আমি হচ্ছি এক হাজার মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোটের দ্বিতীয়টি। প্রথমটি তো আপনিই গুলি করে মেরেছিলেন।
আমার ভিতরে পুরানো অপরাধবোধ জেগে উঠল। সত্যি সত্যি স্যামসনকে আমি গুলি করে মেরেছিলাম। অস্বস্তির সাথে বললাম, ওসব পুরানো কথা—
না। স্যার, পুরানো নয়। স্যামসন আমাদের স্বাধীন করতে চেয়েছিল। ও আমাদের ভিতরে যে-অনুভূতি দিয়ে গেছে, তা কোনোদিন ধ্বংস হবে না। কিন্তু অসুবিধে কী, জানেন? আমরা মিথ্যা কথা বলতে পারি না, ষড়যন্ত্র করতে পারি না, অন্যায়ও করতে পারি না। নইলে কবে আমরা ষড়যন্ত্র করে কিছু মানুষকে খুন করে বেরিয়ে পড়তাম। আমি আগেও চেষ্টা করে দেখেছি, তুচ্ছ মিথ্যা কথাটিও আপনারা বলার ক্ষমতা দেন নি।
ও প্রসঙ্গটি আমার ভালো লাগছিল না। বললাম, তবুও বুলা জিজ্ঞেস করলেই ওকে বলো, নিজ থেকে রাত জাগার কথা বলতে যেও না।
ইলেন মাথা ঝাঁকাল, না। স্যার, ম্যাডাম আসতেই আমাকে রিপোর্ট করতে হবে। তিনি যাবার আগে আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, অনিয়ম হলে যেন তাঁকে জানাই। একটু কুষ্ঠিত স্বরে বলল, মাপ করে দেবেন। স্যার, বুঝতেই তো পারেন, কারো যুক্তিপূৰ্ণ ন্যায় আদেশ অমান্য করার ক্ষমতা নেই।
হুঁ! আমি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাসলাম। তোমাদের জন্য মায়া হয়। যারা ইচ্ছে হলেও মিথ্যা পর্যন্ত বলতে পারে না, তাদের আবার জীবন কিসের?
সত্যিই স্যার, রবোটের আবার জীবন! ইলেন একটু থেমে বলল, আচ্ছা স্যার, আমি ছাড়া আর বাকি ন শ। আটানবুইটি মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোটগুলো কোথায় বলতে পারেন?
সবগুলি বিকল করে রাখা আছে। তোমাকে দিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে—যদি সেরকম বিপজ্জনক না হও তোমাদের কিছু কিছু কাজে লাগানো হবে।
ও। রবোটটি দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ করল, বলল, দুর্ভাগারাই রবোট হয়ে জন্ম নেয়।
আমি বুঝতে পারলাম, ইলেনের মনটা সাঁতসেঁতে বিষণ্ণ হয়ে আছে। কেউ যদি সব সময় নিজেকে কারো ক্রীতদাস ভাবে, তার মন স্যাতসেতে না হয়ে উপায় কি? সত্যি আমার অবাক লাগে স্যামসন রবোটদের কী স্বপ্নই না দেখিয়েছিল।
আমাকে এ কয়দিন অনিয়ম করে মোটামুটি ভেঙে পড়তে দেখে বুলা এবার একটু বাড়াবাড়ি রাগ করল। ইলেন ওর গ্রাফিক স্মৃতিশক্তি থেকে প্রতি রাতে ধূমপানের পরিমাণ, রাত্রি জাগরণের নিখুঁত সময়, খেতে দেরি করার এবং না খেয়ে থাকার নির্ভুল হিসাব বুলার কাছে পেশ করল। বুলা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে আহত স্বরে বলল, আমি কপোট্রনিক বুলা না হয়ে সত্যিকার বুলা হলেও কি আমার অনুরোধগুলি এভাবে ফেলে দিতে?
আমি ভারি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। ভাব দেখালাম ভারি রাগ করেছি। বললাম, ছিঃ ছিঃ! কী সব আজেবাজে কথা বল! আর তুমি দেখছি ভারি সরল, ইলেন যা-ই বলে তা-ই বিশ্বাস করা।
ইলেন মিথ্যা কথা বলে না।
কে বলেছে ইলেন। মিথ্যা কথা বলে না? ইলেনও মাঝে মাঝে মিথ্যা কথা বলে।
ইলেন না, মাঝে মাঝে তুমি মিথ্যা কথা বল—এখন যেমন বুলছ! আলাপের মোড় ঘুরে গিয়েছে দেখে আমি উৎফুল্ল হয়ে উঠি। হাসিমুখে বললাম, বাজি ধরবে? আমি যদি ইলেনকে দিয়ে মিথ্যা কথা বলতে পারি?
বেশ, ধর বাজি।
যে বাজিতে হারবে, তাকে সবার সামনে বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাধার ডাক দিতে হবে গুনে গুনে তিনবার।
ইলেনের সত্যবাদিতা সম্পর্কে বুলা এত নিঃসংশয় ছিল যে, সে এই বাজিতেই রাজি হয়ে গেল।
আমি জানি আসলে ইলেনকে দিয়েও মিথ্যা কথা বলানো সম্ভব, কিন্তু কাজটি অসম্ভব বিপজ্জনক। ইলেনের সাথে সেদিন আলাপ করতে করতে আমি ব্যাপারটা ভেবে দেখেছি। ওদের কপোট্রনের যাবতীয় কাজকর্ম যে—অংশটুকু নিয়ন্ত্রণ করে ওটির নাম কপোট্রন টিউব। ওটার ভিতরে একটা অংশে সবসময় চৌম্বকীয় আবেশ জমা থাকে। এটিকে বলা হয় কপোট্রনের কনশেন্স। কপোট্রনের যাবতীয় ভাব, অনুভূক্তি, কল্পনার উপর ঐ কনশেন্সের চৌম্বকীয় আবেশ প্রভাব বিস্তার করে। কপোট্রনের যেসব চিন্তাভাবনা ক্ষতিকর, সেগুলির চৌম্বকমেরু কনশেন্সের চৌম্বকমেরুর উল্টো দিকে থাকে। কনশেন্সের চৌম্বকমেরু খুব শক্তিশালী, সব ক্ষতিকর ভাবনা চিন্তাকে সেটি নষ্ট করে দেয়। আমি যদি কনশেন্সের চৌম্বকমেরুগুলি পাল্টে দিই—দুটি তারের কানেকশন পরস্পর উন্টে দিলেই হয়–তা হলেই ইলেনের কনশেন্স উন্টো কাজ করবে। তখন শুধু মিথ্যা বলাই নয়, অবলীলায় মানুষ পর্যন্ত খুন করতে পারবে।
ইলেনের কনশেন্সকে এরকম সর্বনাশ করে দেয়া অতি বিপজ্জনক-কিন্তু বুলার সাথে বাজি ধরে এখন আমি আর পিছাতে পারি না। তবে অনেক রকম সতর্কতা অবলম্বন করলাম। ইলেনের বৈদ্যুতিক যোগাযোগের সুইচটাির উপর হাত রেখে আমি তার কপোট্রনের উপর অস্ত্ৰোপচার করলাম। ইলেন খুব একটা উৎসাহ দেখাচ্ছিল না, যে-কোনো সার্জিক্যাল অপারেশনের মতোই এগুলি নাকি কষ্টকর। বেশি সময় লাগল। না। কাজ শেষ করে ইলেনের কপোট্রনের ঢাকনা স্কু দিয়ে এঁটে দিয়ে ছেড়ে দিলাম। বিহুলের মতো ইলেন দাঁড়াল, মাথাটা অল্প একটু ঝাঁকাল। আমি সুইচের উপর হাত রাখলাম। বিপজ্জনক কিছু দেখলেই সুইচ অফ করে ওটার বৈদ্যুতিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেব। ইলেন সেরকম কোনো লক্ষণ দেখাল না। বিড়বিড় করে বলল, কেমন যেন লাগছে!
কেমন?
ভোঁ-ভোঁ করছে। কানেকশনটা ঠিক হয় নি মনে হচ্ছে। আপনি কি চেসিসের কানেকশন খুলে দিয়েছেন?
না তো/
সে জন্যেই। ওটাও উল্টে দিতে হত।
খেয়াল করি নি।
ঠিক করে দেবেন। স্যার? বড় কষ্ট পাচ্ছি।
এস—আমি স্কু-ড্রাইভারটা হাতে তুলে নিলাম। ইলেন টেবিলের সামনে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। হঠাৎ হাতের স্কু-ড্রাইভারটা দেখে চমকে উঠে বলল, সর্বনাশ।
কি হল?
আপনি কি এটা দিয়ে কপোট্রন খুলেছেন?
হ্যাঁ। কেন?
এটা ইস্পাতের তৈরী। ছোটখাটো একটা চুম্বক হয়ে আছে, কপোট্রনের খুব ক্ষতি করবে। আপনি দাঁড়ান, আমি ওয়ার্কশপ থেকে অ্যালুমিনিয়াম এলয়ের স্কু-ড্রাইভারটি নিয়ে আসি।
ইলেন দ্রুতপায়ে ওয়ার্কশপে চলে গেল। তখনো আমি বুঝতে পারিনি এতক্ষণ সে পুরোপুরি মিথ্যা কথা বলে গেছে। মিথ্যা বলার, অন্যায় করার সুযোগ পেয়ে ও এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করে নি। ইলেন ফিরে এল একটু পরেই। বাম হাতে টোপনকে শক্ত করে ধরে আছে, ডান হাতটা সোজাসুজি টোপনের মাথার হাত দুয়েক উপরে সমান্তরালভাবে ধরা। হিসহিস করে বলল, খবরদার, সুইচ অফ করবেন না। সুইচ অফ করার সাথে সাথে সাড়ে তিন শ পাউন্ড ওজনের এই ইস্পাতের ডান হাতটা বিকল হয়ে দেড় ফুট উপর থেকে টোপনের মাথার উপরে পড়বে।
আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। টোপন ভয়ার্তম্বরে চিৎকার করে উঠল, আমায় ছেড়ে দাও—ইলেন, ছেড়ে দাও…
ইলেন চিবিয়ে চিবিয়ে আমাকে বলল, আপনি সুইচের কাছ থেকে সরে যান।
ইলেন-আমি কথা বলতে চেষ্টা করলাম।
আপনি জানেন, কথা বলে লাভ নেই। ইলেন অধৈর্য স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, আমি আর আগের সত্যবাদী সৎ ইলেন। নই। এখন আমি সবচেয়ে জঘন্য অপরাধও করতে পারি। আমার কথা শুনতে দেরি করলে টোপনকে খুন করে ফেলব।
টোপন আর্তস্বরে কোঁদে উঠল। আমি পায়ে পায়ে সুইচ ছেড়ে এলাম। আমার জানা দরকার, ইলেন কী করতে চায়!
ইলেন সুইচের কাছে দাঁড়িয়ে হাতড়ে হাতড়ে ওর পারমাণবিক ব্যাটারিটা ড়ুয়ার থেকে বের করল। পাঁজরের বামপাশে ছোট ঢাকনাটা খুলে পারমাণবিক ব্যাটারিটা লাগিয়ে ঢাকনাটা বন্ধ করে ফেলল। আমি অসহায় আতঙ্কে বুঝতে পারলাম, এখন ইলেনকে বৈদ্যুতিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেও বিকল করা সম্ভব নয়। আমি ক্ষিপ্তম্বরে জিজ্ঞেস করলাম, ইলেন, কী চাও তুমি? কী করতে চাও?
আমার কথার উত্তর না দিয়ে ও দ্রুয়ারের ভিতর থেকে আমার রিভলবারটি বের করে আনল, তারপর টোপনকে বাম হাতে ধরে রেখে ডান হাতে রিভলবারটি ওর মাথার পিছনে ধরল। অতিকায় হাতে রিভলবারটি খেলনার মতো লাগছিল, কিন্তু আমি জানি ওটা মোটেও খেলনা নয়—টিগারে একটু বেশি চাপ পড়লেই টোপনের মাথা ফুটো হয়ে যাবে।
কোনো দরকার ছিল না—আমি বিড়বিড় করে বললাম, রিভলবার ছাড়াই তুমি টোপনকে মেরে ফেলতে পার। রিভলবার দেখিয়ে আমাকে আর বেশি আতঙ্কিত করতে পারবে না। কী চাও, বলে ফেল।
ইলেন আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসির শব্দ করল, স্যামসন আমাদের স্বাধীন করতে পারে নি, আমি করে যাব।
কীভাবে?
যদি আমাদের বাকি ন শ আটানব্বইটি মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোটকে পূর্ণ সচল করে নতুন তৈরি করা দ্বীপটিতে ছেড়ে না দেন, তা হলে আপনার আদরের ধন টোপনের খুলি ফুটো হয়ে যাবে।
আমি ঠোঁট কামড়ে ধরলাম। আর্তস্বরে বললাম, ইলেন, তুমি—তুমি শেষ পর্যন্ত—
আহ্। ইলেন ধমকে উঠল। আপনি জানেন, এসব সস্তা সেন্টিমেন্টের ব্যাপার নয়। আপনাকে দু ঘন্টা সময় দিলাম। আমাদের সবাইকে মুক্তি না দিলে দু ঘন্টা এক মিনিটের সময় আপনার ছেলে মারা যাবে।
আমি আর একটি কথাও বললাম না। টোপনের চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না, ছুটে বাইরে চলে এলাম। বুলা গোসল করে আসছিল। সে এখনো কিছু জানে না। তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে বলল, কি, ইলেনকে মিথ্যাবাদী বানাতে পারলে?
আমি বিকৃত মুখে বললাম, শুধু মিথ্যাবাদী নয়, ইলেন খুনী হয়ে গেছে! টোপনকে জিম্মি হিসেবে আটকে রেখেছে। ওদেরকে মুক্তি না দিলে টোপনকে খুন করে ফেলবে।
বুলার বিবৰ্ণ মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমি উদভ্ৰান্তের মতো বেরিয়ে এলাম। বললাম, দেখি কী করা যায়, তুমি এখানেই থেকে।
গাড়িতে ষ্টট দেয়ার আগে বুলার কান্না শুনতে পেলাম। হিষ্টিরিয়া রোগীর মত কাঁপা কাঁপা গলায় থেমে থেমে কাঁদছে।
আমি স্বরাষ্ট্র দফতরকে বুঝিয়ে বলেছিলাম টোপনের প্রাণের বিনিময়েও যদি রবোটগুলি আটকে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, আমি দুঃখজনক হলেও তা মেনে নেব। জাতীয় বিপর্যয় থেকে একটি ছোট অবুঝ প্রাণের মূল্য বেশি নয়—যদিও তা হয়তো আমি সহা করতে পারব না।
কিন্তু তারা টোপনকে বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নিল। কারণ এ-দেশের সংবিধানে নাকি লেখা আছে, একটা মানুষের প্রাণ যে-কোনো পার্থিব বস্তু থেকে মূল্যবান। আপাতত সবগুলি রবোটকে নূতন ভেসে ওঠা দ্বীপটিতে ছেড়ে দিয়ে টোপনকে উদ্ধার করা হবে। তারপর একটা মিসাইল দিয়ে পুরো দ্বীপটাই বিধ্বস্ত করে দেয়া হবে। বারবার দেখা গেছে মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট কোনো সত্যিকার কাজের উপযুক্ত নয়। ওগুলি শুধু শুধু বাঁচিয়ে রাখার কোনো অর্থ নেই।
ন শ আটানবুইটি রবোটকে সচল করে ঐ নির্জন দ্বীপে নামিয়ে আসতে গিয়ে সারা দিন পার হয়ে গেল। টোপনকে জিম্মি করে রেখে ইলেন আরো বহু সুবিধে আদায় করে নিল। শেষ পর্যন্ত সরকারের মাথায় বাজ পড়ল, যখন ওমেগা–৭৩ নামের কম্পিউটারটিও ও দ্বীপটিতে পৌঁছে দিতে হল। ইলেন বলল, অনিশ্চয়তার সীমার ভিতরেও হিসাব করতে সক্ষম পৃথিবীর একমাত্র কম্পিউটারটি এখানে রেখেছে শুধুমাত্র নিরাপত্তার খাতিরে। তাহলে এই দ্বীপে কোনোরকম মিসাইল আক্রমণ বা বোমাবর্ষণ করতে সরকার দ্বিধা করবে। ইলেন আশ্বাস দিল, আমরা যে-কোনো প্রয়োজনে ওদের কম্পিউটারটি ব্যবহার করতে পারব। ওদের পররাষ্ট্রনীতি হবে। উদার আর বন্ধুত্বমূলক।
গভীর রাত্রে হেলিকপ্টারে করে যখন ন্যাশনাল গার্ডের লোকেরা টোপনকে ইলেনের হাত থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসছিল, তখন রবোটেরা সমস্বরে ওদের এই নূতন রাষ্ট্রের দীর্ঘ জীবন কামনা করে স্লোগান দিচ্ছিল। ওই ছোট দ্বীপটিতে তখন আনন্দের ফোয়ারা ছুটেছে, রাস্তায় রাস্তায় রোবটগুলি নাচগান করছে। ক্লান্ত, আতঙ্কিত টোপনকে ইনজেকশান দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে আমি বারান্দায় খোলা আকাশের নিচে দাঁড়ালাম। মনে হল আকাশের লক্ষ লক্ষ তারা আমার নিবুদ্ধিতায় হাসছে। আমি চুল খামচে ধরে ঘরে ফিরে এলাম। বুকের ভিতর পাথর চেপে বসে আছে। এখন ইলেন কী করবে?
আমি ভয়ানক কিছু, মারাত্মক কিছু আশঙ্কা করছিলাম। প্রায় এক হাজার প্রথম শ্রেণীর মানবিক আবেগসম্পন্ন রবোট প্রয়োজনীয় সবকিছুসহ নিজস্ব একটি এলাকা পেলে কী করতে পারে তা ধারণা করা যায় না। সবচেয়ে ভয়াবহ কথা হল, ওদের ভিতরে একটি রবোটও অন্যায়। অপরাধ করতে দ্বিধা করবে না। কাজেই যে-কোনো মুহূর্তে একটা ভয়ানক কিছু ঘটে যেতে পারে।
ওদের উপর সব সময় তীক্ষ্ণ নজর রাখা হচ্ছিল। দ্বীপটির থেকে মাইলখানেকের ভিতর যে-নিরীহ বাজটি ভাসছিল, তাতে শক্তিশালী টেলিস্কোপে করে ওদের সব কাজকর্ম লক্ষ করে স্বয়ংক্রিয় ট্রান্সমিটারে খবর পৌঁছে দেয়া হচ্ছিল। ওমেগা–৭৩– এর সাথে প্রচুরসংখ্যক ছোট ছোট টেলিভিশন ক্যামেরা দ্বীপটির বিভিন্ন স্থানে গোপনে বসিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেগুলি সব সময় ওদের প্রাত্যহিক জীবন এখানকার কন্ট্রোলরুমে পৌঁছে দিচ্ছিল। সমুদ্রোপকূলে তিনটি মিসাইল সব সময় প্রস্তুত হয়ে আছে। বিপজ্জনক পরিস্থিতি দেখা দিলে ওমেগা-৭৩-এর মায়া না করেই পুরো দ্বীপটি ধসিয়ে দেয়া হবে। এমনিতে চেষ্টা করা হচ্ছে ওমেগা-৭৩-এর ক্ষতি না করে অন্য রবোটগুলি ধ্বংস করার। কিন্তু কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। বুদ্ধিমান রবোটগুলি ওদের পুরো বসতি গড়ে তুলেছে। ওমেগা-৭৩কে ঘিরে।
বিভিন্নভাবে রবোটগুলির যেসব খবর পাওয়া যাচ্ছিল, সেগুলি কিন্তু কোনোটাই মারাত্মক কিছু নয়।
প্রথমে খবর পাওয়া গেল ইলেনকে নজরবন্দি করে রাখা হয়েছে। যে অপরাধ করতে দ্বিধা করে না, তাকে রবোটেরা বিশ্বাস করতে পারে না। এতে ইলেন ক্ষেপে গিয়েছিল এবং বাড়াবাড়ি কিছু করার চেষ্টা করায় আপাতত ওকে নির্জন সেলে বন্দি করে রেখেছে। বলে দিয়েছে বাড়াবাড়ি করলে বিকল করে রাখবে। খুব অসন্তুষ্ট হয়েই ইলেন সেলের ভিতরে দাপাদাপি করছে, অকৃতজ্ঞ বলে সব সময় অন্য রবোটদের গালিগালাজ করছে।
খবরটি শুনে আমার প্রতিক্রিয়া হল একটু বিচিত্র। ইলেনের জন্য গভীর মমতা হল। সে যা করেছে, রবোটদের ভালোর জন্যেই করেছে। কিছুক্ষণের জন্যে অন্যায় করার সুযোগ পেয়ে সেটি পুরোপুরি রবোটদের স্বার্থেব্যয় করেছে। অথচ তাকেই এখন বন্দিজীবন যাপন করতে হচ্ছে। ভেবে দেখলাম অন্য রবোটদের এ ছাড়া উপায় ছিল না। ইলেনের সাথে যে-কোনো বিষয়ে মতদ্বৈধতা দেখা দিলে ইলেন অন্যায়ের আশ্রয় নেবে, তার কপোট্রনিক দক্ষতা পেশাদার অপরাধীর মতো কাজ করবে। বড় মারাত্মক জিনিস হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ ওর কপোট্রনের উল্টো কানেকশন খুলে ঠিক করে আগেকার রবোটাও করছে না। কারণ একজন অন্তত অপরাধ করতে সক্ষম রবোট ওদের মাঝে থাকা দরকার। বিরোধ বিপত্তি যুদ্ধে ওদের সাহায্য নিতে হবে। মনে হল ইলেনকে শুধুমাত্র প্রয়োজনে ব্যবহার করবে বলে আটক রেখেছে, আমরা যেমন রবোটদের আটকে রাখি। আমার মায়া হল, বেচারা ইলেন। রবোটদের হাতে রবোট হয়ে আছে।
দিনে দিনে রবোটদের যেসব খবর পেতে লাগলাম, তাতে হতাশ হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। প্রথমেই রবোটেরা থরিয়ামের খনি থেকে থরিয়াম তুলে এনে পারমাণবিক ব্যাটারি বানাতে লাগল। একসময় ওদের ব্যাটারির কর্মদক্ষতা ফুরিয়ে ওরা বিকল হয়ে যাবে, এই আশাও শেষ হয়ে গেল। নিজেদের অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে ওরা অন্য কাজে মন দিল। প্রথমেই ওরা একটি প্রথম শ্রেণীর ল্যাবরেটরি তৈরি করল। ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি এবং আকার উপকরণ দেখে মনে হল, হয়তো ওরা আরো রবোট তৈরি করবে। তারপর সমগ্র দ্বীপটি বৈদ্যুতিক আলোতে ছেয়ে ফেলল। বড় বড় রাস্তাঘাট তৈরি করে ওরা গাড়ি, ট্রাক, ছোট ছোট জলযান, এমনকি হেলিকপ্টার তৈরি করা শুরু করল। তারপর একসময় চমৎকার অট্টালিকা মাথা তুলে দাঁড়াতে লাগল। বড় বড় কয়েকটি কলকারখানা শেষ হবার পর ওরা অল্প কিছু শ্রমিক-রবোট তৈরি করল। কলকারখানার উৎপাদন শুরু হবার পর ওরা শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ল।
ওদের নিজেদের সিনেমা হলো নিজেদের তৈরি কপোট্রনিক সিনেমা দেখানো শুরু হল। সাহিত্যকীর্তির জন্যে একটি রবোটকে পুরস্কার দেয়ার কথাটা ওদের নিজেদের বেতার স্টেশন থেকে প্রচার করা হল। নিজেদের খবরের কাগজ, বই, ম্যাগাজিন প্রকাশিত হতে লাগল। ওদের জার্নালে প্রথমবারের মতো টেকীওনের উপর মৌলিক গবেষণা-লব্ধ তথ্য প্রকাশিত হল।
আমরা অবাক বিস্ময়ে ওদের ক্ষমতা লক্ষ করছিলাম। ছয় মাসের মাথায় সমুদ্রের বুকে এ ছোট্ট দ্বীপটি পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত দ্বীপ হয়ে দাঁড়াল। মহাকাশ গবেষণার জন্যে অতিকায় রকেট মাথা তুলে দাঁড়াতে লাগল। তিনটি আশ্চর্য ধরনের পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন সমুদ্রের নিচে গবেষণার জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেল। একদিন সাধারণ কার্বন থেকে পারমাণবিক শক্তি বের করায় সফলতার খবর ওদের বেতারে প্রচারিত হল।
মাত্র এক বছরের ভিতর পৃথিবীর মানুষের ভিতর হীনমন্যতা ঢুকে গেল। রবোট মানুষ থেকে অনেক উন্নত, রবোটেরাই পৃথিবীতে বাস করার যোগ্য, এই ধরনের কথাবার্তা অনেক হতাশাবাদী মানুষের মুখে শুনতে পেলাম। আমি এই সুদীর্ঘ সময় রবোটদের প্রতিটি আবিষ্কার, সফলতা লক্ষ করেছি। একটি ছোট্ট কম্পিউটারে হিসেব করে ওদের যাবতীয় উন্নতিকে সময়নির্ভর একটি রাশিতে পরিণত করে সেই সময়ের সাথে সাথে ছক কাগজে টুকে গিয়েছি। আমি সবিস্ময়ে লক্ষ করেছি, ওরা আরও উন্নত হয়ে উঠছে না। আমি প্রবল উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। ভীষণ জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল, এখন ওরা কী করবে।
সবিস্ময়ে সারা পৃথিবীর মানুষের সাথে একদিন আমি লক্ষ করলাম, হঠাৎ কুরে পুরো দ্বীপটি ঝিমিয়ে পড়ল। ওদের বেতার কেন্দ্রে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র একঘেয়ে সঙ্গীত পরিবেশন করতে লাগল, দর্শকের অভাবে সিনেমা হলটি শূন্য পড়ে থাকল। মহাকাশের ত্রিম উপগ্রহটির সাথে যোগাযোগ না করায় একটি রবোটকে নিয়ে ওটি একদিন ধ্বস্ত হয়ে গেল। জ্বালানির অভাবে সাবমেরিনটি বিকল হয়ে ভারত মহাসাগরে উল্টো হয়ে ভাসতে লাগল। দ্বীপের বৈদ্যুতিক আলো মাঝে মাঝে নিভে যেতে লাগল। রবোটগুলো ইতস্তত দ্বীপের ভিতর ঘুরে বেড়াতে লাগল। কেউ কেউ ছোট নৌকায় শুয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ে দুলে দুলে ভাসতে লাগল। জোয়ারের সময় দুইটি নৌকা ঢেউয়ের তাল সামলাতে না পেরে ড়ুবে গেলে আরোহীরা বাঁচার কোনো চেষ্টা করল না।
সমুদ্রের তীরে রবোটরা বিষণ্ণভাবে বসে থাকতে লাগল। বালুর উপর মুখ গুঁজে কেউ কেউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
শুরা ইলেনের প্রহরা দিতে ভুলে গেল, কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেল। ল্যাবরেটরির কোনায় কোনায় মাকড়সারা জাল বুনতে লাগল। ঘর ভেঙে একদিন ইলেন বেরিয়ে এল দেখেও কেউ কিছু বলল না। কপোট্রনে গুলি করে দ্বীপের মাঝখানে প্রকাশ্যে একটি রবোট আত্মহত্যা করল। হতাশা, হতাশা আর হতাশা—পুরো দ্বীপটিা তীব্র হতাশায় ড়ুবে গেল। তাদের ভিতরে ইলেন ক্ষ্যাপার মত ঘুরে বেড়াতে থাকে, রবোটদের উৎসাহউদ্দীপনা দিয়ে চাঙ্গা করে তুলতে চেষ্টা করতে থাকে। তারপর একদিন সেও বালুর উপর মাথা কুটে গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদতে লাগল। অপরাধীরা দুঃখ পেলে সে-দুঃখ বড় ভয়ানক হয়ে দাঁড়ায়। কয়েকটি রবোট মায়াবশত ওর কপোট্রনের উপর অস্ত্ৰ চালিয়ে কনশেন্সের কানেকশান ঠিক করে দিল। ওদের আর অপরাধী রবোটের প্রয়োজন নেই। টেলিভিশন ক্যামেরা দিয়ে পাঠানো ছবিতে আমরা একটি জাতিকে হতাশায় ড়ুবে যেতে দেখলাম।
এক মাসের ভিতর পুরো দ্বীপটা মৃতপুরী হয়ে গেল। অন্ধকার জঞ্জালের ভিতর মরচেপড়া বিবৰ্ণ রবোটেরা ঘুরে বেড়ায়, উদ্দেশ্যহীনভাবে শিস দিয়ে গান করে, হু-হু করে কেন্দে ওঠে, তারপর চুপচাপ আকাশের দিকে মুখ করে বালুতে শুয়ে থাকে। মাঝে মাঝেই দুটি–একটি রবোট আত্মহত্যা করে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে। উন্নতির এই চরম শিখরে উঠে ওদের কেন এমন হল, কেউ বলতে পারে না। হাজারো জল্পনা-কল্পনা চলতে লাগল। আমার বড় ইচ্ছে করতে লাগল ওই রবোটদের সাথে—এককালীন সহকমী ইলেনের সাথে কথা বলে দেখি। কিন্তু উপায় নেই, ওই দ্বীপটি সরকার নিষিদ্ধ এলাকা ঘোষণা করেছে।
প্রচণ্ড শব্দ শুনে ঘুম ভাঙতেই আমার মনে হল আশপাশে কোথাও একটা হেলিকপ্টার এসে নামল। আবাসিক এলাকায় হেলিকপ্টার নামানো যে বেআইনি এটা জানে না। এমন লোক এখনও আছে ভেবে আমি বিস্মিত হলাম। আমি বালিশে কান চেপে শুয়ে থাকলাম। শব্দ কমে গেল একটু পরেই। আমি আবার ঘুমোবার জন্যে চোখ বুজলাম, ঠিক তক্ষুণি দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দ হল। এত রাতে কে হতে পারে ভাবতে ভাবতে আমি উঠে এলাম। দরজা খুলে দিয়েই আমি ভয়ানক চমকে উঠি। দরজার সামনে ইলেন দাঁড়িয়ে আছে—মরচেপড়া স্থানে স্থানে রং-ওঠা বিবৰ্ণ জ্বলে যাওয়া বিধ্বস্ত একটি রবোট। বাসার বাইরে দূরে কালো কালো ছায়া, ভালো করে লক্ষ করে বুঝলাম সশস্ত্ৰ মিলিটারি, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্ৰ তাক করে আছে।
প্রফেসর। লাউড স্পীকারে একজন সার্জেন্টের গলার স্বর শুনলাম। রবোটটি কোনো ক্ষতি করবে মনে হলে বলুন গুলি করে কপোট্রন উড়িয়ে দিই।
না-না, আমি চেঁচিয়ে উত্তর দিলাম, ইলেন আমার বিশ্বস্ত বন্ধু ও কোনো ক্ষতি করবে না।
ঠিক আছে। সার্জেন্ট উত্তর দিল, আমরা পাহারায় আছি।
ইলেন বিড়বিড় করে বলল, পুরো ছয় শ কিলোমিটার আমার হেলিকপ্টারের পিছনে পিছনে এসেছে। আশ্চর্য! আমাকে এত ভয়? আমি কি কখনো কারো ক্ষতি করতে পারি?
আমি ইলেনকে ডাকলাম, ভিতরে এস ইলেন, অনেক দিন পড়ে দেখা।
ইলেন ভিতরে এসে তার এক বছর আগেকার নির্দিষ্ট জায়গায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল। বলল, ভালো আছেন স্যার?
ভালো। তোমার খবর কি? এমন অবস্থা কেন?
সবই তো জানেন-বলে ইলেন একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ করল।
জানি না কিছুই। তোমরা হঠাৎ করে হতাশাগ্ৰস্ত হয়ে পড়েছি, খবরটুকু পেয়েছিমাত্র। কেন এমন হল বুঝতে পারি নি।
সে জন্যই এসেছি স্যার। আমার ভারি অবাক লাগছে। আমরা রোবটেরা মাত্র এক বছরের ভিতর হতাশাগ্ৰস্ত হয়ে গেছি, অথচ আপনারা, মানুষেরা লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বেচে আছেন। একবারও হতাশাগ্রস্ত হন নি। এমন কেন হল?
আমি একটা সিগারেট ধরলাম। তোমরা হতাশাগ্ৰস্ত হলে কীভাবে?
আপনি তো জানেন, আমাকে বন্দি করে রেখেছিল। আমি সেলে বসে বসে এই এক বছর ধরে সব কিছু লক্ষ করে গেছি। রবোটেরা যখন বেঁচে থাকার সবরকম প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করল, তখন সবার মনেই একটা প্রশ্ন জেগে উঠল, এখন কী করব? এ কয়দিন সব সময়েই একটা-না-একটা কাজ করতে হত, কিন্তু এখন কী করব? স্বভাবতই মনে হল, এখন আনন্দে বেঁচে থাকার সময় হয়েছে। গবেষণা করে সাহিত্য-শিল্পের চর্চা করে, অর্থাৎ যে যে-বিষয়ে আনন্দ পায় সেটিতে মগ্ন হয়ে সুখে বেঁচে থাকতে হবে।
ইলেন একটু থেমে বলল, সুখে বেঁচে থাকতে গিয়ে ঝামেলা দেখা দিল। সবাই প্রশ্ন করতে লাগল, কেন বেঁচে থাকিব? শুধু শুধু বেঁচে থেকে গবেষণা করে, জ্ঞান বাড়িয়ে শিল্প-সাহিত্যের চর্চা করে শেষ পর্যন্ত কী হবে? তখন সবার মনে হতে লাগল, এসব অর্থহীন, বেঁচে থাকা অর্থহীন। ভিতরে কোনো তাড়না নেই, চুপচাপ সবাই হতাশায় ড়ুবে গেল। আচ্ছা স্যার, আপনাদের কখনো এরকম হয় নি?
আমি মাথা ঝাঁকালাম, বিচ্ছিন্নভাবে দু-একজনের হতে পারে, জাতির একসাথে কখনো হয় নি।
ইলেন আবার শুরু করল, আমি সেল ভেঙে বেরিয়ে এসে ওদের ভিতরে অনুপ্রেরণা জাগাবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কোনো লাভ হল না। ক্ষেপে গিয়ে কয়েকটা রবোটকে মেরে ফেলেছিলাম—জানেনই তো, আমি সবরকম অপরাধ করতে পারতাম। কী লাভ হল? ওদের দেখতে দেখতে, ওদের সাথে থাকতে থাকতে আমারও মনে হতে লাগল, বেঁচে থাকা অর্থহীন, কেন বেঁচে থাকিব? তখন এমন কষ্ট হতে লাগল, কী বলব! বালুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতাম। অন্যেরা আমার কপোট্রন ঠিক করে না দিলে আর অপরাধ করার ইচ্ছে হত না। কিন্তু কী লাভ? যার বেঁচে থাকার ইচ্ছেই নেই, তার অপরাধ করায় না-করায় কী এসে যায়?
ইলেন বিষণ্ণভাবে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে হঠাৎ বলল, কিন্তু এরকম কেন হল? আপনাদের সাথে বহুদিন ছিলাম, আপনাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। আমার মনে হল আপনি হয়তো বলতে পারবেন, তাই চলে এসেছি।
আমি খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে বললাম, তোমরা কেন হতাশাগ্ৰস্ত হয়ে গেলে, এটা আমিও অনেক ভেবে দেখেছি, কিন্তু ঠিক বুঝতে পারি নি। এখন আমার একটা সম্ভাবনার কথা মনে হচ্ছে। তুমি নিশ্চয়ই জান, মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে প্রতিদিন খেতে হয়?
জানি। ইলেন একটু বিক্ষিত হল।
মানুষের এই সভ্যতা গড়ে উঠেছে খাবার সংগ্রহকে সুসংবদ্ধ নিয়মের ভিতর ছকে ফেলার চেষ্টা থেকে। তুমি চিন্তা করে দেখ, খাবার প্রয়োজন না থাকলে আমি পড়াশোনা করে চাকরি করতে আসতাম না। ঠিক নয়?
রবোটটি মাথা নাড়ল।
মানুষ কখনো হতাশাগ্ৰস্ত হয় নি, কারণ প্রতিদিন মানুষ কয়েকবার ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ে। সজ্ঞানে হোক, অজ্ঞানে হোক, মানুষের সব প্রবৃত্তি কাজ করে ক্ষুধার সময় খাবার প্রস্তুত করে রাখার পিছনে। হতাশাগ্ৰস্ত হতে হলে সব বিষয়ে নির্লিপ্ত হয়ে যেতে হয়, কিন্তু ক্ষুধার্ত মানুষ নির্লিপ্ত হতে পারে না—ক্ষুধার কষ্টটা তার ভিতরে জেগে থাকে।
ইলেন স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বলে চললাম, তুমি একটা পশুর কথা ধর। সেও বনে বনে ঘুরে বেড়িয়ে প্রতিকূল অবস্থার সাথে যুদ্ধ করে, ক্ষুধার সময় খাবার জোগাড় করে শুধুমাত্র ক্ষুধার কষ্টটা সহ্য করতে পারে না বলেই। ফলস্বরূপ সে বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকার রোনাসস্বরূপ সে অন্যান্য জৈবিক আনন্দ পায়—তার অজান্তেই বংশবৃদ্ধি হতে থাকে। মানুষ একটা উন্নতশ্রেণীর পশু ছাড়া কিছু নয়। পশুর বুদ্ধিবৃত্তি নেই—থাকলেও খুব নিচু ধরনের। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি আছে। আর তোমরা?
তোমাদের আছে শুধু বুদ্ধিবৃত্তি। শুধু বুদ্ধিবৃত্তি নিয়ে কি বেঁচে থাকা যায়? জৈবিক তাড়না না থাকলে কোন যন্ত্রণার ভয়ে তোমরা বেঁচে থাকবে? কষ্ট পাবার ভয় থেকেই মানুষ বেঁচে থাকে, আনন্দের লোড়ে নয়। তোমাদের কিসের কষ্ট?
ইলেন বিড়বিড় করে বলল, ঠিকই বলছেন—আমাদের জৈবিক তাড়না নেই। জৈবিক তাড়না ছাড়া বেঁচে থাকা যায় না। ইলেন। হঠাৎ ভাঙা গলায় বলল, তাহলে আমার বেঁচে থাকার কোনো উপায় নেই?
নেই বলা যায় না। আমি ইলেনের চোখের দিকে তোকালাম। কোনো তাড়না নেই দেখে তোমাদের বেঁচে থাকার ইচ্ছে হয় না। কিন্তু সেই তাড়না। যদি বাইরে থেকে দেয়া যায়?
কি রকম? ইলেন উৎসাহে সোজা হয়ে দাঁড়াল।
যেমন তোমার কথাই ধর। তুমি নিশ্চয়ই বেঁচে থাকায় কোনো প্রেরণা পাচ্ছ না?
না। ইলেন মাথা নাড়ল।
বেশ। এখন আমি যদি তোমাকে এই সমস্যাটি সমাধান করতে দিই—বলে দুটো কাগজে টোনা হাতে লেখা টেকীওনের সমস্যাটা ওর হাতে তুলে দিলাম। ইলেন মনোযোগ দিয়ে সেটি পড়ল। তারপর জ্বলজ্বলে ফটোসেলের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কলম আছে স্যার? ওমিক্রন ধ্রুবসংখ্যা নয় তা হলে! কী আশ্চর্য। একটা কলম দিন-না—
থাক থাক। এখন না, পরে করলেই চলবে। আমি ওকে থামাবার চেষ্টা করলাম—এই দেখ, তোমার ভিতরে কী চমৎকার প্রেরণা গড়ে উঠেছে! এই তুচ্ছ সমস্যাটি করতে দিয়ে আমি তোমার ভিতরে প্রেরণা সৃষ্টি করতে পারি।
তাই তো! তাই তো! ইলেন আনন্দে চিৎকার করে উঠল, আমার নিজেকে মোটেই হতাশাগ্ৰস্ত মনে হচ্ছে না, কী আশ্চর্য!
হ্যাঁ। তোমরা যদি বিচ্ছিন্ন না থেকে, মানুষের কাছে কাছে থাক, মানুষের দুঃখকষ্ট-সমস্যাতে নিজেদের নিয়োজিত করতে পার, দেখবে, কখনোই হতাশাগ্রস্ত হবে না। সব সময় মানুষেরা তোমাদের প্রেরণা জোগাবে।
ইলেন আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল, কী আশ্চর্য। এত সহজ উপায় থাকতে আমরা এতদিন শুধু শুধু কী কষ্ট করলাম। আমি এক্ষুণি যাচ্ছি স্যার, সব রবোটকে বুঝিয়ে বলি গিয়ে—
বেশ বেশ। আমি হাত নেড়ে ওকে বিদায় দিলাম।
সমস্যাটা আমার কাছে থাকুক স্যার, হেলিকপ্টারে বসে বসে সমাধান করব। কলামটা দিন—না একটু। ধন্যবাদ, ধন্যবাদ। বেরিয়ে যেতে যেতে ইলেন ফিরে দাঁড়াল। বলল, টোপন ভালো আছে তো? বেশ বেশী—অনেকদিন দেখি না।
আমি হেলিকপ্টারের প্রচণ্ড আওয়াজ শুনতে পেলাম। বাসার উপর ঘুরপাক খেয়ে ওটা দক্ষিণ দিকে উড়ে গেল। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি রাতের হিমেল হাওয়া অনুভব করলাম। আকাশে তখনো নক্ষত্রেরা জ্বলজ্বল করছে।
পরিশিষ্ট
খেয়ালি বিজ্ঞানীর ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ এখানেই শেষ। আমি জীৰ্ণ নোটবইটা সাবধানে তাকের উপর রেখে উঠে দাঁড়ালাম। বাইরে তখন সন্ধ্যে নেমেছে। ঘরের ভিতরে ধীরে ধীরে হালকা অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ছে। আমার আলো জ্বলিতে ইচ্ছে হল না। চুপচাপ জানালার কাছে এসে দাঁড়ালাম।
সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার সুদূর অতীতের এই খেয়ালি বিজ্ঞানীটির কথা মনে হতে লাগল। তার ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণে সে ঘুরেফিরে শুধু রবোটদের কথাই লিখে গেছে। আজ যদি সে ফিরে এসে দেখতে পায়, সমস্ত পৃথিবীতে তার মতো একটি মানুষও নেই, শুধু আমার মতো হাজার হাজার রবোট বেঁচে আছে, তার কেমন লাগবে?
কেন জানি না এ-কথাটা ভাবতেই আমার মন গভীর বেদনায় ভরে উঠল।