০১. পূর্বকথা
তরুণী মাটি অনেক কষ্ট করে উঠে দাঁড়িয়ে দোলনায় শুয়ে থাকা শিশুটির দিকে তাকাল। মাকে দেখে শিশুটির দাতহীন মুখে একটি মধুর হাসি ফুটে ওঠে। সে চঞ্চল হয়ে ওঠে এবং একসাথে দুই হাত আর দুই পা নাড়তে থাকে, ইঙ্গিতটি খুব স্পষ্ট, সে মায়ের কোলে উঠতে চায়। মায়ের শিশুটিকে কোলে নেওয়ার ক্ষমতা নেই, দুর্বল হাতে শিশুটির মুখ স্পর্শ করে ফিসফিস করে বলল, বেঁচে থাকিস বাবা। একা হলেও বেঁচে থাকিস।
শিশুটি মায়ের কথার অর্থ বুঝতে পারল না কিন্তু কথার পেছনের ভালোবাসা আর মমতাটুকু অনুভব করতে পারল। সে হঠাৎ করে আরো চঞ্চল। হয়ে ওঠে, দুই হাত আর দুই পা ছোড়ার সাথে সাথে মুখ দিয়ে সে একধরনের অব্যক্ত অর্থহীন শব্দ করল। মা আবার কিছু একটি বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ করে সে কাশতে শুরু করে এবং কাশির সাথে সাথে ঝলকে ঝলকে রক্ত বের হয়ে আসে। তরুণী মাটি অনেক কষ্ট করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ঘুরে তাকাল। তার ঠিক পেছনেই ক্রিনিটি নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্রিনিটি তৃতীয় মাত্রার। একটি রোবট, অনেকদিন থেকে সে এই পরিরারকে দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করে আসছে।
তরুণী মা একটু শক্তি সঞ্চয় করে বলল, ক্রিনিটি, আমার সময় শেষ হয়ে এসেছে। আমি তোমাকে যা বলি তুমি একটু মন দিয়ে শোনো।
ক্রিনিটি কোনো কথা বলল না, সে জানে মানুষ বেশিরভাগ সময়ই অর্থহীন কথা বলে। মানুষের যে কোনো কথাই তার গুরুত্ব দিয়ে শুনতে হয়, সেটি আলাদাভাবে তাকে বলার প্রয়োজন নেই। তরুণী মাটি একটি বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, আমার মনে হয় নিকি বেঁচে যাবে। যে ভাইরাসটি পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষকে মেরে ফেলছে সেটি আমার এই বাচ্চাটিকে মারতে পারেনি। আমার এই বাচ্চার শরীরে এই ভাইরাসের প্রতিষেধক আছে।
ক্রিনিটি বলল, তোমার ধারণা সত্যি। এই ভাইরাসের আক্রমণে সবার আগে শিশুরা মারা গেছে। নিকির কিছু হয়নি।
আমি আর কিছুক্ষণের মাঝেই মারা যাব ক্রিনিটি। তখন এই নিকিকে দেখার কেউ থাকবে না। কেউ থাকবে না। তরুণী মা কষ্ট করে একটি কাশির দমক সামলে নিয়ে বলল, ক্রিনিটি, তখন তোমাকে এই বাচ্চাটাকে দেখতে হবে। যতদিন সে নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে না পারবে ততোদিন তাকে তোমার দেখেশুনে রাখতে হবে।
ক্রিনিটি কোনো কথা বলল না, মানুষ যখন তাকে কোনো আদেশ দেয়। তাকে সবসময় সেই আদেশ মানতে হয়। তরুণী মাটি কিন্তু একটু অস্থির হয়ে উঠল, বলল, তুমি কথা বলছ না কেন ক্রিনিটি? তুমি কি আমার কথা বুঝতে পারছ?
ক্রিনিটি বলল, আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি।
তাহলে তুমি আমাকে কথা দাও, তুমি আমার সোনামণি নিকিকে দেখে রাখবে।
আমি নিকিকে দেখে রাখব। তুমি আমার গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা কর।
ক্রিনিটি আর কপোট্রনে একটি অসম বৈদ্যুতিক চাপ অনুভব করল, মানুষ সময়ই অর্থহীন কাজ করে। একটি কথা উচ্চারণ করার জন্যে কখনোই কারো গা ছুঁতে হয় না। অন্যসময় হলে সে ব্যাপারটি বোঝানোর চেষ্টা করত কিন্তু এখন সে তার চেষ্টা করল না। কমবয়সী এই তরুণীটি কিছুক্ষণের মাঝেই মারা যাবে, সে কী কথা-ব্রলতে চায় সেটি জেনে রাখা প্রয়োজন। ক্রিনিটি তার শীতল হাত দিয়ে তরুণী মাটির হাত স্পর্শ করে বলল, আমি তোমার গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি।
তরুণী মাটির মুখে তখন অত্যন্ত ক্ষীণ একটি হাসি ফুটে ওঠে। সে একটি বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ক্রিনিটি। অনেক ধন্যবাদ।
ক্রিনিটি কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। এই তরুণী মাটির দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারছে খুব দ্রুত তার জীবনীশক্তি ফুরিয়ে আসছে। ছোট শিশুটি দোলনা থেকে আবার তার দুই হাত-পা ছুড়ে একটি অব্যক্ত শব্দ করে তার মায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল। মা শিশুটির দিকে একনজর তাকিয়ে আবার ঘুরে ক্রিনিটির দিকে তাকিয়ে বলল, ক্রিনিটি। তুমি আমাকে কথা দাও যে তুমি আমার বাচ্চাটিকে ভালোবাসা দিয়ে বড় করবে।
ক্রিনিটি নীচু গলায় বলল, আমি দুঃখিত। আমার ভেতরে কোনো মানবিক অনুভূতি নেই। কেমন করে ভালোবাসতে হয় আমি জানি না।
তরুণী মেয়েটি হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে, তোমাকে জানতে হবে। সারা পৃথিবীর মাঝে শুধু আমার এই বাচ্চাটা বেঁচে আছে। তাকে মানুষের মতো বড় করতে হবে। তাকে ভালোবাসা দিয়ে বড় করতেই হবে।
পুরোপুরি অর্থহীন একটি কথা, কিন্তু ক্রিনিটি প্রতিবাদ করল না। এই মেয়েটির সাথে এখন যুক্তি দিয়ে কথা বলার সময় পার হয়ে গেছে; এখন কোনো প্রতিবাদ না করে মেয়েটির কথাগুলো শুনতে হবে। অর্থহীন, অযৌক্তিক এবং অবাস্তব হলেও শুনতে হবে।
তরুণী মাটি দোলনাটি ধরে কয়েকটা বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, ক্রিনিটি তুমি ভালো করে গুনে রাখো। আমার এই বাচ্চাটি যেরকম বেঁচে গেছে সেরকম পৃথিবীতে হয়তো আর এক-দুটি বাচ্চা বেঁচে গেছে। তুমি আমার বাচ্চাটিকে তাদের কাছে নিয়ে যাবে। বুঝেছ?
ক্রিনিটি শান্ত গলায় বলল, বুঝেছি। কিন্তু-
আমি কোনো কিন্তু শুনতে চাই না ক্রিনিটি। তুমি যেভাবে পার তাদের খুঁজে বের করবে। আমার বাচ্চাটিকে তাদের কাছে নিয়ে যাবে। এই কথাটি তোমার মনে থাকবে?
ক্রিনিটি বলল, মনে থাকবে।
তুমি আমার গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা কর যে তুমি সেটি করবে।
অত্যন্ত অযৌক্তিক একটি ব্যাপার কিন্তু তবুও ক্রিনিটি তার শীতল ধাতব হাত দিয়ে দ্বিতীয়বার তরুণী মাটির হাত স্পর্শ করে বলল, আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে তোমার বাচ্চাটিকে আমি অন্য বাচ্চার কাছে নিয়ে যাব।
তরুণী মাটি ক্ৰিনিটির হাত ধরে বলল, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ক্রিনিটি। অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ক্রিনিটি তার নিস্পলক চোখে তরুণীটির দিকে তাকিয়েছিল, সে বলল, তোমাকে খুব দুর্বল দেখাচ্ছে। আমার মনে হয় উত্তেজিত না হয়ে তোমার বিশ্রাম নেয়া দরকার।
তুমি ঠিকই বলেছ ক্রিনিটি, আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। আমি এখন এখানেই শোবো। আমি জানি আমি আর কোনোদিন উঠতে পারবো না। তুমি কি আমাকে একটু সাহায্য করবে?
কী সাহায্য?
তুমি কি আমার বাচ্চাটিকে আমার বুকের ওপর শুইয়ে দিতে পারবে? আমি আমার জীবনের শেষ মুহূর্তগুলোতে আমার বাচ্চার মুখটির দিকে তাকিয়ে থাকতে চাই।
ক্রিনিটি জানে এই দুর্বল মেয়েটির বুকের ওপর এই দুরন্ত ছটফটে শিশুটিকে শুইয়ে দিলে মেয়েটির অনেক কষ্ট হবে, কোনোভাবেই এই কাজটি করা উচিৎ হবে না। ক্রিনিটি তার কপোট্রনে একটি প্রবল বৈদ্যুতিক চাপ অনুভব করল কিন্তু সে চাপটিকে উপেক্ষা করে এই অযৌক্তিক কাজটি করল। শিশুটি দুই হাতে তুলে মেঝেতে শুয়ে থাকা তরুণীটির বুকে শুইয়ে দিলো।
শিশুটির দাঁতহীন মুখে মধুর একধরনের হাসি ফুটে ওঠে। সে তার ছোট হাত দুটি দিয়ে তার মায়ের রক্তমাখা ঠোঁট দুটি ধরে আনন্দে হাসতে থাকে। তরুণী মাটি তার দুই হাতে বাচ্চাটিকে তার বুকের মাঝে শক্ত করে চেপে ধরে রেখে ফিসফিস করে বলল, সোনা আমার। যাদু আমার। বেঁচে থাকিস বাবা। যেভাবে পারিস বেঁচে থাকিস।
সন্ধ্যে হওয়ার আগেই তরুণী মাটি মারা গেল। ছোট শিশুটি সেটি বুঝতে পারল না, সে তার মায়ের চুলগুলো ধরে খেলতেই থাকল।
ক্রিনিটি নিস্পলক দৃষ্টিতে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে তার কপোট্রনে প্রবল একটি অসম বৈদ্যুতিক চাপ অনুভব করে।
নিকি জানালাটি খুলে বাইরে তাকাল। আকাশ নীল, কোথাও মেঘের চিহ্ন নেই। বাইরে রৌদ্রোজ্জ্বল একটি দিন। নিকি দুই গালে হাত দিয়ে বাইরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর হঠাৎ কী মনে করে সে নিজেকে কোনোমতে টেনে জানালার ওপর উঠে বসে।
ক্রিনিটি জিজ্ঞেস করল, নিকি, তুমি ঠিক কী করতে চাইছ?
বাইরে যাব।
মানুষ জানালা দিয়ে বাইরে যায় না। মানুষ দরজা খুলে বাইরে যায়।
জানালা দিয়ে বাইরে গেলে কী হয়?
কিছু হয় না। কিন্তু জানালা দিয়ে বাইরে যেতে হলে তোমাকে লাফিয়ে নামতে হবে। দরজা খুলে বের হতে হলে তুমি হেঁটে হেঁটে বের হতে পারবে।
নিকি তার দাঁতগুলো বের করে হাসল, বলল, কিন্তু আমি হেঁটে বের হতে চাই না। আমি লাফিয়ে বের হতে চাই। আমার লাফাতে খুব ভালো লাগে।
আমি সেটি লক্ষ করেছি। আজকাল বেশিরভাগ সময়ই তুমি লাফাতে পছন্দ করো।
আমি এখনো মিক্কুর মতো লাফাতে পারি না।
তুমি কখনোই মিরুর মতো লাফাতে পারবে না। মিক্কু হচ্ছে বানর আর তুমি মানুষ।
নিকি একটি ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমিও যদি বানর হতাম তাহলে খুব মজা হতো, তাই না ক্রিনিটি?
ক্রিনিটি তার কপোট্রনে একটি চাপ অনুভব করে। চাপটি কমিয়ে সে বলল, না। তুমি বানর হলে বেশি মজা হতো না।
নিকি মাথা নেড়ে বলল, হতো।
হতো না।
কেন হতো না?
কারণ মানুষের বুদ্ধিমত্তা বানরের বুদ্ধিমত্তা থেকে বেশি। যার বুদ্ধিমত্তা যতো বেশি সেততো বেশি উপায়ে মজা করতে পারে।
নিকি মুখ সুচালো করে কিছুক্ষণ ক্রিনিটির দিকে তাকিয়ে রইলতারপর জিজ্ঞেস করল, বুদ্ধিমত্তা কী?
তোমার চারপাশে যা কিছু আছে সেটি দেখে বোঝার ক্ষমতা এবং সেটিকে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা হচ্ছে বুদ্ধিমত্ত্বা।
নিকি মাথা নাড়ল, বলল, আমার কোনো বুদ্ধিমত্তা নেই।
কে বলেছে নেই?
আমি জানি।
কেমন করে জান?
এই যে তুমি কঠিন কঠিন জিনিম বলেছ আমি সেগুলো করতে পারিনা।
বুঝিনা।
তুমি যখন বড় হবে তখন বুঝবে।
আমি বুঝতে চাইনা।
তাহলে তুমি কী করতে চাও?
আমি মিষ্ণুর সাথে এক গাছ থেকে আরেকাছে লাফ দিতে চাই।
যাদের বুদ্ধিমত্তা আছে তাদের শুধু এক গাছ থেকে আরেকাছে মাফ দিয়ে জীবন কাটাতে হয়না। তাদের আরো বড় কাজ করতে হয়।
নিকি কিছুক্ষন চিন্তা করল, তারপর বলন, জমির বুদ্ধিমত্তা ভালো লাগে।
না।
ক্রিনিটি কোনো কথা না বলে নিকির দিকে তাকিয়ে রইল। নিকি ক্রিনিটির দৃষ্টি থেকে চোখ ফিরিয়ে জানালা দিয়ে একবার বাইরে তাকালো তারপর দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খুলে বের হবার ঠিক আগ মুহূর্তে ক্রিনিটি বলল, নিকি।
বল।
তুমি ঘরের বাইরে যাচ্ছ কিন্তু তোমার শরীরে কোনো কাপড় নেই।
আজকে অনেক সুন্দর রোদ। বাইরে ঠাণ্ডা নেই তাই আমার কাপড় পরারও কোনো দরকার নেই।
ক্রিনিটি কৃত্রিমভাবে তার গলার স্বরটি একটুখানি গভীর এবং থমথমে করে নিয়ে বলল, মানুষ শুধুমাত্র শীত থেকে বাঁচার জন্যে কাপড় পরে না। মানুষ হচ্ছে একটি সভ্য প্রাণী। মানুষকে সবসময় কাপড় পরতে হয়।
নিকি বলল, কিন্তু মিক্কু তো কাপড় পরে না।
মিক্কু মোটেও সভ্য প্রাণী নয়। মিক্ক একটি বানর। কিকি কাপড় পরে না! কিকি একটি পাখি।
নিকির চোখ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, সে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, তুমি কোনো কাপড় পর না।
আমি একটি যন্ত্র। যন্ত্রদের কাপড় পরতে হয় না। তুমি মানুষ তোমাকে কাপড় পরতে হবে। সবসময় অন্ততপক্ষে কোমর থেকে হাঁটুর ওপর পর্যন্ত ডেকে একটি কাপড় পরতে হবে।
নিকি যুক্তিতর্কে সুবিধে করতে না পেরে অন্যপথে গেল। মুখ শক্ত করে বলল, আমি মানুষ হতে চাই না।
ক্রিনিটি বলল, না চাইলেও কিছু করার নেই, তুমি এখন অন্য কিছু হতে পারবে না। তোমাকে মানুষ হয়েই থাকতে হবে।
নিকি মুখ শক্ত করে বলল, কেন মানুষ হলে কাপড় পরতে হবে?
মানুষ সভ্য প্রাণী। যখন তোমার সাথে অন্য মানুষের দেখা হবে তখন তোমার শরীরে কাপড় না থাকলে তারা তোমাকে অসভ্য ভাববে।।
নিকি সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে সেরকম ভঙ্গি করে বলল, ঠিক আছে। যদি আমার সাথে কখনো অন্য মানুষের দেখা হয় তখন আমি দৌড় দিয়ে কাপড় পরে নেব।
ক্রিনিটি বলল, না। কাপড় পরা একটি অভ্যাসের ব্যাপার। যার সেই অভ্যাস নেই সে কখনো দৌড়ে কাপড় পরতে পারবে না। আর সবচেয়ে বড় কথা কী জান?
কী?
মানুষের সাথে কোনোদিন দেখা হোক বা না হোক তোমাকে কাপড় পরে থাকতে হবে।
নিকি মুখ গোঁজ করে বলল, কেন?
তোমার মা আমাকে তোমার দায়িত্ব দিয়ে গেছে। আমাকে বলেছে আমি যেন তোমাকে দেখে শুনে রেখে বড় করি। সেজন্যে আমার তোমাকে ঠিক করে বড় করতে হবে। সভ্য মানুষের মতো বড় করতে হবে।
নিকি এবার দুর্বল হয়ে পড়ল। তার মা-কে সে খুব ভালোবাসে। ক্রিনিটির কাছে তার মায়ের যে হলোগ্রাফিক ছবি আছে সে মুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে, অনেকবার সে তার মা-কে ধরতে গিয়ে দেখেছে সেটি সত্যি নয়। তার খুব ইচ্ছে করে একদিন সে ধরতে গিয়ে দেখবে সেটি সত্যি তখন তার মা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করবে। ক্রিনিটি তাকে বলেছে যে এটি কখনো হবে না, তবুও সে আশা করে আছে যে কোনো একদিন হয়তো এটি হয়ে যাবে।
নিকি ঘরের ভেতর ফিরে গেলো, এক টুকরো কাপড় নিয়ে সেটি তার। কোমরে বেঁধে নিল, তারপর ক্রিনিটিকে বলল, এখন আমি বাইরে যাই?
যাও।
নিকি দরজা খুলে বাইরে যেতেই কক কক শব্দ করে একটি পাখি তার দিকে উড়ে আসে, তার মাথার উপর দিয়ে উড়ে সেটি তার ঘাড়ে বসার চেষ্টা করতে থাকে। নিকি তার হাতটি বাড়িয়ে দিতেই পাখিটি সেখানে বসে নিকির দিকে তাকিয়ে আবার কক কক শব্দ করে ডাকল। নিকি পাখিটির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলল, আমি মোটেও দেরি করতে চাইনি। ক্রিনিটি আমাকে দেরি করিয়ে দিয়েছে।
পাখিটির গায়ের রং কুচকুচে কালো, চোখ দুটি লাল, সে ডানা ঝাঁপটিয়ে আবার কক কক শব্দ করল। নিকি বলল, উঁহু। ক্রিনিটি মোটেও দুই নয়। ক্রিনিটি হচ্ছে রোবট! রোবটেরা অন্যরকম হয়।
কিকি নিকির কথা বুঝে ফেলেছে সেরকম ভঙ্গি করে মাথা নেড়ে আবার শব্দ করে আকাশে উড়ে গেল, নিকি তখন তার পিছু পিছু ছুটতে থাকে। এটি তাদের একরকম খেলা, প্রতিদিনই সে কিকির পেছনে পেছনে ছুটে যায়, সারাদিন বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। দিনের শেষে কিকি তাকে তার বাসায় পৌঁছে দিয়ে যায়।
কিকির পেছনে পেছনে ছুটে ছুটে নিকি বনের ভেতর একটি হৃদের তীরে এসে দাঁড়াল। সেখানে অনেকগুলো বুনো পশু পানি খাচ্ছে, নিকিকে একনজর। দেখে তারা আবার পানি খেতে থাকে।
একটি বড় ঝাপড়া গাছের ডালে হঠাৎ একটি হুঁটোপুটি শোনা যায় সেদিকে না তাকিয়েই নিকি বুঝতে পারে এটি মিকু, ছোট একটি বানরের বাচ্চা, তার সাথে খেলতে এসেছে। নিকি ইচ্ছে করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল, আর মিক্কু গাছের উপর থেকে তার উপর লাফিয়ে পড়ল, তাল সামলাতে না। পেরে নিকি নিচে পড়ে যায়, মিক্কু তখন তার শরীরের ওপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে থাকে। নিকি তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে উঠে বসে হি হি করে হাসতে থাকে আর মিক্কু তখন নিকিকে ঘিরে লাফাতে থাকে। নিকি মিক্কুর পেটে খোঁচা দিয়ে বলল, মিকু, তোমার বুদ্ধিমত্তা আছে?
মিক্কু কিচিমিচি শব্দ করে একটি লাফ দিয়ে তার ঘাড়ে উঠে বসে তারপর সেখান থেকে নেমে তার কাপড়টা টানতে থাকে। নিকি মাথা নাড়ল, বলল, না। এই কাপড়টা খোলা যাবে না। আমার মা বলেছে আমাকে সবসময় কাপড় পরে থাকতে হবে।
মিকু কথাটা বোঝার মতো ভঙ্গি করল, নিকি তখন মিক্কুকে কাছে টেনে এনে বলল, তুমি বানর। আমি মানুষ। বানরের বুদ্ধিমত্তা নেই। মানুষের আছে। বুদ্ধিবৃত্তি কী জান?
মিকু মাথা নাড়ল। নিকি বলল, আমিও জানি না। ক্রিনিটি আমাকে বলেছে আমি বুঝিনি। তুমিও বুঝবে না। বোঝার দরকার নেই। চল আমরা খেলি।
মিকু কথাটা বুঝতে পেরে ছুটতে শুরু করে, তার পিছু পিছু নিকি। ছুটতে ছুটতে তারা বালুবেলায় আছড়ে পড়ে, গড়াগড়ি খেতে থাকে। তাদের মাথার উপর দিয়ে অনেকগুলো পাখি উড়তে থাকে, কিচিমিচি শব্দ করে তারা নিকির আশপাশে নেমে এসে খেলায় যোগ দেয়। নিকি হাত বাড়িয়ে পাখিগুলো ধরার চেষ্টা করে—একটি-দুটি ধরা দেয় অন্যগুলো সরে গিয়ে আবার তার কাছে ছুটে আসে।
বেলা গড়িয়ে এলে নিকি নরম বালুর ওপর মাথা রেখে শুয়ে থাকে। শুয়ে থাকতে থাকতে একসময় তার চোখে ঘুম নেমে আসে। সে পরম শান্তিতে বালুতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কাছাকাছি একটি গাছে বসে কিকি তার দিকে নজর রাখে, একটু দূরে একটি গাছে মিক্কু পা দুলিয়ে বসে থাকে।
ঠিক তখন নিঃশব্দে একটি চিতাবাঘ হেঁটে হেঁটে আসে। হ্রদের পানিতে পা ভিজিয়ে সে চুক চুক করে পানি খায়। তাকে দেখে হরিণের পাল সরে গেল, বুনো পাখিরা কর্কশ শব্দ করে উড়ে গেল।
চিতাবাঘটি মাথা তুলে তাকাল, একটু গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করল এবং হঠাৎ করে নিকিকে দেখতে পেল। সাথে সাথে সেটি সতর্ক পদক্ষেপে নিকির দিকে এগুতে থাকে। কাছাকাছি এসে সেটি খুঁড়ি মেরে বসে তারপর বিদ্যুৎগতিতে। নিকির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। গাছের ডালে বসে থাকা কিকি আর মিক্কু তার স্বরে চিৎকার করে ওঠে সাথে সাথে।
নিকি চমকে উঠে চিতাবাঘটির দিকে তাকাল এবং মুহূর্তে তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে চিতাবাঘটির গলা জড়িয়ে ধরে বলল, দুষ্টু! দুষ্টু চিতা! তুমি কোথায় ছিলে এতোদিন?
চিতাবাঘটি মুখ দিয়ে ঠেলে নিকিকে নিচে ফেলে দিয়ে পেছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। নিকি উঠে দাঁড়িয়ে চিতাবাঘটির গলা জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ ঘষে বলল, কোথায় ছিলে তুমি? কোথায়?
চিতাবাঘটি তার বুকের ভেতর থেকে ঘরঘর করে শব্দ করে, বন্ধুর সাথে। ভাব বিনিময়ের গভীর ভালোবাসার একধরনের শব্দ।
ক্রিনিটি নিকির প্লেটে একটু খাবার তুলে দিয়ে বলল, তোমার এখন বাড়ন্ত শরীর। এখন তোমাকে খুব হিসেব করে খেতে হবে। মানুষের শরীর তো আর যন্ত্র নয় যে একটি ব্যাটারি লাগিয়ে দিলাম আর সেটি চলতে থাকল। মানুষকে খেতে হয় খুব হিসেব করে।
নিকি এক টুকরো রুটি ছিঁড়ে স্যুপে ভিজিয়ে খেতে খেতে বলল, হিসেব করে না খেলে কী হয়?
শরীর দুর্বল হয়ে যায়। শরীরে রোগজীবাণু বাসা বাঁধে।
তুমি বলেছ আমার শরীরে কোনো রোগজীবাণু বাসা বাঁধতে পারে না। সেই জন্যে সবাই মরে গেছে কিন্তু আমি বেঁচে গেছি।
হ্যাঁ। সেটি সত্যি। কিন্তু রোগজীবাণুর কী শেষ আছে। পৃথিবীতে কত রকম রোগজীবাণু আছে তুমি জান?
নিকি মাথা নাড়ল, না জানি না। জানতেও চাই না।
না জানলে হবে না। মানুষকে সবকিছু জানতে হয়।
আমি তোমাকে বলেছি আমি মোটেও মানুষ হতে চাই না?
না চাইলেও লাভ নেই। তোমার মানুষ হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ক্রিনিটি তার প্লেটে একটু খাবার তুলে দিয়ে বলল, এইটুকু শেষ করে ফেল। তাহলে তোমার খাওয়াটা সঠিক হবে।
নিকি খাবারগুলো হাত দিয়ে নাড়তে নাড়তে বলল, ঠিক আছে, আমি খেতে পারি কিন্তু একশর্তে।
কী শর্ত? তুমি আমাকে আজকে গণিত পড়াতে পারবে না।
তুমি এখন বড় হচ্ছ। প্রতিদিন তোমাকে কিছু না কিছু পড়তে হবে। মানুষকে অনেক কিছু জানতে হয়।
নিকি মাথা নাড়ল, বলল, না ক্রিনিটি আমি আজকে কিছু পড়তে চাই না।
তাহলে কী করতে চাও?
নিকি লাজুক মুখে বলল, আমি আমার মা-কে দেখতে চাই।
ক্রিনিটি কয়েক মুহূর্ত নিকির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, ঠিক আছে।
একটু পরেই দেখা গেল নিকি দুই গালে হাত দিয়ে বসে আছে, সামনের শূন্য জায়গাটিতে তার মা কথা বলছেন। হলোগ্রাফিক ছবি, দেখে মনে হয়। জীবন্ত কিন্তু নিকি জানে এটি জীবন্ত নয়। সে অনেকবার তার মা-কে ধরার। চেষ্টা করেছে, ধরতে পারেনি। যতবার ধরতে গিয়েছে দেখেছে সেখানে কিছু নেই।
নিকি ঘুমিয়ে যাবার পর ক্রিনিটি তাকে একটি পাতলা চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়। গলায় ঝোলানো মাদুলিটি খুলে নিয়ে সে ক্রিস্টাল রিড়ারের সামনে বসে। মাদুলিটির ভেতর থেকে ছোট ক্রিস্টালটা বের করে সে ক্রিস্টাল রিডারের ভেতর ঢুকিয়ে সেদিকে তাকায়। আজ সারাদিন নিকি কী কী করেছে সব এখানে রেকর্ড করা আছে।
ক্রিনিটি খানিকক্ষণ দৃশ্যগুলো দেখে তারপর ছোট একটি মাইক্রোফোন কাছে টেনে এনে নিচু গলায় কথা বলতে শুরু করে। রোবটের একঘেয়ে যান্ত্রিক স্বরে ক্রিনিটি বলে, আমি ক্রিনিটি। নিকি নামের মানবশিশুটির দায়িত্বে আছি। আমার দৈনন্দিন দায়িত্ব হিসেবে আজকের দিনের ঘটনাগুলো ভিডি মাধ্যমে উপস্থাপন করছি।
আমি তৃতীয় মাত্রার রোবট। আমার পক্ষে এই দায়িত্ব নেয়া সম্ভব ছিল, কিন্তু অন্য কোনো উপায় না থাকার কারণে আমি দায়িত্বটি নিতে বাধ্য। হয়েছিলাম। আমাকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল সেই সিদ্ধান্তগুলো সঠিক সিদ্ধান্ত কিনা আমি সেটি এখনো জানি না। নিকির মা আমাকে বলেছিল আমি যেন ভালোবাসা দিয়ে নিকিকে বড় করি। আমি তৃতীয়। মাত্রার রোবট, ভালোবাসা বিষয়টি কী আমি জানি না। একজন মা যখন তার সন্তানের সাথে কথা বলার সময় কিছু অর্থহীন শব্দ করে, কিছু অর্থহীন কাজকর্ম করে সেগুলো সম্ভবত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। আমি সেই শব্দগুলো উচ্চারণ এবং সেই কাজকর্মগুলো করার চেষ্টা করে দেখেছি সেগুলো প্রকৃত অর্থেই অর্থহীন এবং হাস্যকর কাজকর্মে পরিণত হয়েছে। কাজেই আমি সেই বিষয়টি পরিত্যাগ করেছি।
আমার মনে হয়েছে আশপাশে কোনো মানুষ না থাকলেও অনেক পশুপাখি আছে এবং সেইসব পশুপাখিদের মাঝে একধরনের ভালোবাসা। আছে। মানুষ অনেক সময়ই পশুপাখিকে পোষ মানিয়েছে এবং তাদের সাথে একধরনের ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তাই আমি খুব সতর্কভাবে নিকির সাথে কিছু পশুপাখির সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করেছি। কাজটি আমাকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে করতে হয়েছে, প্রয়োজনে যেন তাকে ঘিরে একটি শক্তি বলয় তৈরি হয় এবং কোনো পশু যেন তার ক্ষতি করতে না পারে, গোড়াতে আমি সেই বিষয়টি নিশ্চিত করেছি। আমি এক মুহূর্তের জন্যেও নিকির প্রাণের ওপর কোনো ঝুঁকি আনিনি। এখনও আমি তাকে সতর্কভাবে রক্ষা করি। তার গলার মাদুলিটি একটি শক্তিশালী ট্রাকিওশান। মূল তথ্য কেন্দ্রের সাথে এটি যোগাযোগ রাখে এবং তাকে রক্ষা করে।
বনের কিছু পশুপাখির সাথে নিকির একধরনের গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক হয়েছে এবং আমার ধারণা নিকি ভালোবাসা গ্রহণ করতে এবং প্রদান। করতে শিখেছে। নিকির মা আমাকে প্রথম যে দায়িত্বটি দিয়েছিল আমি সেটি পালন করতে পেরেছি।
নিকির মায়ের দ্বিতীয় দায়িত্বটি অনেক কঠিন। সারা পৃথিবী খুঁজে আমার দেখতে হবে আর কোথাও কোনো মানুষ বেঁচে গিয়েছে কিনা। যদি বেঁচে থাকে তাহলে তার কাছে নিকিকে নিয়ে যেতে হবে। আমি সে জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। এখন তার বয়স মাত্র সাত বছর কিন্তু তার বুদ্ধিমত্তা দশ থেকে বারো বছরের বালকের মতো। তাই তাকে নিয়ে আমি বের হতে পারি। আমার ধারণা নিকি এখন এই ব্যাপারটির মুখোমুখি হতে পারবে।
ভূমিকা পর্ব শেষ হয়েছে। আমি এখন আজকের সারাদিনের সংক্ষিপ্ত দিনলিপি সংরক্ষণ করতে চাই। ভোরবেলা ঘুম ভাঙার পর নিকি শরীরে কাপড় রাখা নিয়ে একটি প্রতিবাদী ভূমিকা গ্রহণ করে। বিষয়টিকে আমার গুরুত্ব নিয়ে দেখতে হয়…
ক্রিনিটি তার একঘেয়ে যান্ত্রিক গলায় দিনলিপিটি সংরক্ষণ করে যায়। নিকির মা মারা যাবার পর থেকে প্রতিদিন সে এটি করে আসছে।
নিকি জিজ্ঞেস করল, ক্রিনিটি তুমি কী করছ?
ক্রিনিটি টার্মিনালের সাথে একটি বড় তার জুড়ে দিয়ে উপরের স্কুটা লাগাতে লাগাতে বলল, আমি এই বাইভার্বালটি ঠিক করছি।
তুমি কেন এটি ঠিক করছ? আমরা ঘুরতে বের হব।
নিকির চোখে-মুখে আনন্দের ছাপ পড়ল, আমরা কোথায় ঘুরতে বের হব ক্রিনিটি?
নির্দিষ্ট কোনো জায়গায় নয়। আমরা আসলে ঘুরে ঘুরে দেখব। কোথাও তোমার মতো মানুষ খুঁজে পাই কিনা।
এবারে নিকির মুখে দুশ্চিন্তার একটি ছাপ পড়ল, খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার মতো মানুষ?
হ্যাঁ, তোমার মতো মানুষ।
সেই মানুষের সাথে দেখা হলে আমি তাকে কী বলব ক্রিনিটি?
তোমার সেটি নিয়ে ভাবনা করতে হবে না। তোমার যেটি বলতে ইচ্ছে হয় সেটিই বলবে।
তখন সেই মানুষটি কী বলবে ক্রিনিটি?
সেই মানুষটিও তখন তার যেটি ইচ্ছে হয় সেটি বলবে।
আমি তোমার সাথে যেভাবে কথা বলি সেভাবে কথা বলব?
তার চাইতে অনেক সুন্দর করে কথা বলবে। আমি হচ্ছি মাত্র তৃতীয় মাত্রার রোবট আমি সত্যিকার মানুষের মতো কথা বলতে পারি না। আমি শুধু তোমার সাথে তথ্য বিনিময় করি।
সত্যিকার মানুষ কেমন করে কথা বলে ক্রিনিটি?
সেটি অনেক বিচিত্র। কথা বলার সময় তার হাত নাড়ে, মাথা নাড়ে। চোখ দিয়ে তাকায়, গলার স্বর কখনো উঁচু করে, কখনো নীচু করে। একটি সাধারণ কথা বলার জন্যেও অনেক কিছু করে। আবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা মুখ ফুটে বলে না। একজন আরেকজনের চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝে ফেলে।
নিকিকে এবারে খুব দুশ্চিন্তিত দেখায়। খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, ক্রিনিটি?
বল।
আমি তো চোখের দিকে তাকিয়ে কোনো কথা বুঝতে পারি না।
তোমার সেটি নিয়ে ভাবনা করতে হবে না। তুমি যদি কখনো কোনো মানুষের দেখা পাও তাহলে দেখবে তুমি বুঝতে পারছ।
আর যদি না পারি?
পারবে। যদি না পার তাহলে তুমি শিখে নেবে।
ক্রিনিটি।
বল?
আমি কিন্তু শিখতে পারি না। মিক্কু কী সুন্দর একটি গাছের ডাল ধরে লাফ দিয়ে আরেকটি ডাল ধরে ফেলে। আমি অনেকদিন থেকে চেষ্টা করছি, শিখতে পারছি না।
ক্রিনিটি ঘুরে নিকির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি সেটি অনেক চেষ্টা করেও শিখতে পারবে না। মিক্কু হচ্ছে বানর, তুমি মানুষ। মানুষ চেষ্টা করলেও বানর হতে পারে না। মানুষের অন্য মানুষ থেকে শিখতে হয়, বানর থেকে শিখতে হয় না।
নিকি বলল, ও।
ক্রিনিটি বাইভার্বালের নীচে গিয়ে একটি গোলাকার ফুটোর ভিতরে উঁকি দেয়, সেখান থেকে জংধরা একটি রিং খুলে নতুন একটি রিং লাগাতে শুরু করে। ঠিক তখন তার মাথার উপর দিয়ে কিকি উড়ে এসে বাইভার্বালের একটি হ্যান্ডেলে বসে কর্কশ স্বরে কঁ কঁ করে ডাকল।
নিকি বলল, কিকি আমরা ঘুরতে বের হব। তুমি আমাদের সাথে যাবে?
কিকি কী বুঝল কে জানে, নীচু স্বরে আবার ক ক করে শব্দ করল। নিকি ক্রিনিটির দিকে তাকিয়ে বলল, ক্রিনিটি।
বল।
কিকি আমাদের সাথে ঘুরতে যেতে পারবে?
যেতে চাইলে যাবে। তবে—
তবে কী?
কিকি হচ্ছে কাক জাতীয় পাখি। পাখিদের মাঝে সবচেয়ে বুদ্ধিমান। এরা দল বেঁধে থাকে, আর দলের সবাইকে ছেড়ে সে আসলে যেতে পারবে না।
কেন যেতে পারবে না?
সব পশু-পাখিদের নিজেদের নিয়ম আছে। পাখিরা থাকে দল বেঁধে। বাঘ থাকে একা একা।
নিকি মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, কিকি তার দলের পাখি থেকে আমাকে বেশি ভালোবাসে। তাই না কিকি?
কিকি মাথা নেড়ে বলল, কঁ কঁ।
ক্রিনিটি নিকির কথা শুনে তার দিকে ঘুরে তাকালো, সে এই মাত্র তার কথায় ভালোবাসা শব্দটি ব্যবহার করেছে এবং মনে হয় ঠিকভাবেই ব্যবহার। করেছে। নিকির মা তাকে দায়িত্ব দিয়েছিল ভালোবাসা দিয়ে বড় করতে তার নিজের ভালোবাসা অনুভব করার ক্ষমতা নেই তারপরেও এই ছেলেটিকে সে মনে হয় ভালোবাসার ব্যাপারটি বোঝাতে পেরেছে। ক্রিনিটি দেখল নিকি কালো রঙের পাখিটিকে হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিয়ে তাকে আদর করতে থাকে।
ক্রিনিটি যখন বাইভার্বালের সামনে বড় বড় দুটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র স্ক্রু দিয়ে লাগানো শুরু করেছে তখন নিকি জিজ্ঞেস করল, এগুলো কী ক্রিনিটি।
এগুলো হচ্ছে অস্ত্র।
অস্ত্র দিয়ে কী করে?
অস্ত্র দিয়ে ধ্বংস করে।
নিকি অবাক হয়ে বলল, ধ্বংস করে? কেমন করে ধ্বংস করে?
এর মাঝে বিস্ফোরক রয়েছে। যখন ট্রিগার টানা হয় তখন বিস্ফোরকগুলো ছুটে যায়, যেখানে সেটি আঘাত করে সেখানে বিস্ফোরণ হয়ে সব ধ্বংস হয়ে যায়।
নিকি চোখ বড় বড় করে ক্রিনিটির দিকে তাকিয়ে রইল তারপর ইতস্তত করে বল, কিন্তু ক্রিনিটি–
কিন্তু কী?
তুমি কেন এই বাইভার্বালে অস্ত্র লাগাচ্ছ? তুমি কাকে ধ্বংস করতে চাও?
আমি কাউকে ধ্বংস করতে চাই না। কিন্তু সবসময় একটু সতর্ক থাকতে হয়। এই বনে সব পশুপাখি তোমার বন্ধু। কিন্তু অন্য কোথাও অন্য পশুপাখি তোমার বন্ধু নাও হতে পারে। তারা তোমাকে আক্রমণ করে বসতে পারে—
নিকি মুখ শক্ত করে বলল, না। কখনো কোনো পশুপাখি আমাকে। আক্রমণ করবে না। আমি পশুপাখিকে ভালোবাসি। পশুপাখিও আমাকে ভালোবাসে।
ক্রিনিটি বলল, সেটি সত্যি কথা। কিন্তু আমি কোনো ঝুঁকি নিতে চাই। তুমি হচ্ছ একমাত্র জীবিত মানুষ—তোমার যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেটি আমাকে সবসময় লক্ষ রাখতে হয়।
তুমি বেশি বেশি লক্ষ রাখ।
তা ছাড়া আমরা যখন ঘুরতে বের হব তখন আরো অনেক কিছুর সাথে আমাদের দেখা হবে। তাদের থেকেও বিপদ হতে পারে।
নিকি একটু চিন্তিত সুরে বলল, কার সাথে দেখা হতে পারে?
রোবটদের সাথে।
নিকি এবারে শব্দ করে হেসে ফেলল। রোবট বলতে সে শুধু ক্রিনিটিকে বোঝে, ক্রিনিটি বা ক্রিনিটির মতো কারো কাছ থেকে কোনো বিপদ হতে পারে সেটি এতো অবাস্তব একটি বিষয় যে সেটি কল্পনা করে নিকি না হেসে পারল না। নিকি হাসতে হাসতে বলল, ক্রিনিটি, তুমি বলেছ যে রোবটদের তৈরি করা হয়েছে মানুষদের সেবা করার জন্যে। একটি রোবট কখনো কোনো মানুষের ক্ষতি করতে পারে না। চেষ্টা করলেও পারে না।
সেটি সত্যি কথা। কিন্তু—
কিন্তু কী?
একসময় পৃথিবীতে মানুষ ছিল তখন রোবটদের জন্যে এই নিয়ম ছিল। এখন তো পৃথিবীতে মানুষ নাই তাই রোবটদের মাঝে এই নিয়মগুলো আছে। কিনা সেটি তো জানি না। এখন এই পৃথিবীতে আছে শুধু রোবট তারা কী করছে কে জানে।
নিকি খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, রোবটদের এখন কোনো কাজ নেই। তাই তারা মনে হয় অনেক মজা করছে।
ক্রিনিটি বলল, সব রোবট মজা করতে পারে না।
কেন ক্রিনিটি? কেন সব রোবট মজা করতে পারে না?
মজা করার জন্যে বুদ্ধিমত্তা থাকতে হয়। সব রোবটের বুদ্ধিমত্তা নেই। যাদের মানুষের সমান বুদ্ধিমত্তা তারা মজা করতে পারে।
তুমি কী মজা করতে পার?
না। আমি পারি না। আমি তৃতীয় মাত্রার রোবট। আমার বুদ্ধিমত্তা মানুষ থেকে কম। চতুর্থ মাত্রার রোবটের বুদ্ধিমত্তা মানুষের বুদ্ধিমত্তার সমান।
আর পঞ্চম মাত্রা?
পঞ্চম মাত্রার রোবট পৃথিবীতে তৈরি হয় নি।
কেন তৈরি হয় নি?
পঞ্চম মাত্রার রোবটের বুদ্ধিমত্তা হবে মানুষ থেকে বেশি সেই জন্যে কখনো পঞ্চম মাত্রার রোবট তৈরি করা হয় নি। পৃথিবীর মানুষ নিজের থেকে বুদ্ধিমান রোবট তৈরি করতে চায় নি।
নিকি কিছুক্ষণ ক্রিনিটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ক্রিনিটি।
বল।
আমার মনে হয় তুমি যদিও তৃতীয় মাত্রার রোবট কিন্তু তুমি ইচ্ছা করলে মজা করতে পারবে।
ক্রিনিটি তার কপোট্রনে একধরনের চাপ অনুভব করল, সে চাপটুকু কমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে বলল, তুমি তাই মনে কর?
হ্যাঁ।
তুমি কী রকম মজা করার কথা ভাবছ?
বনে একটি গাছে একটু হলুদ একটু লাল রঙের ফল পাওয়া যায় সেটি খেতে খুব মজা। তুমি সেটি খেয়ে দেখতে পার।
মানুষ হচ্ছে স্তন্যপায়ী প্রাণী তার শরীরে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা থাকতে হয়। সেইজন্যে মানুষকে একটু পরে পরে খেতে হয়। আমি রোবট, আমার শরীরে একটি ব্যাটারি লাগানো আছে, আমাকে খেতে হয় না।
নিকি বলল, আমি জানি। কিন্তু আমার মনে হয় এই ফলটি তবু তোমার খেয়ে দেখা উচিৎ। এই ফলটি খেলে তোমার যেটি মনে হবে সেটি হচ্ছে মজা।
ক্রিনিটি কোনো উত্তর না দিয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দুটি লাগানো শেষ করে তার লেজার আলোটি পরীক্ষা করল।
নিকি বলল, গাছের উপর থেকে হ্রদের পানিতে লাফ দিলেও অনেক মজা হয়।
ক্রিনিটি বলল, আমার ধাতব শরীর পানিতে ভেসে থাকতে পারে না।
নিকি বলল, ড়ুবে থাকলে আরও বেশি মজা। পানিতে লাল রঙের কাকড়া থাকে। সেগুলো দেখা যায়।
ক্রিনিটি কোনো কথা বলল না। সে তৃতীয় মাত্রার রোবট হয়েও এই মানব শিশুটির সাথে কথা বলতে পারে, কিন্তু অনেক সময়ই আবিষ্কার করে সে কোনো একটি কথার উত্তরে যৌক্তিক কোনো কথা বলতে পারছে না। তখন সে চুপ করে থাকে।
নিকির হাতে বসে থাকা পাখিটি একটু চঞ্চল হয়ে আকাশের দিকে তাকাল তারপর চাপা স্বরে ডাকল, কঁ কঁ।
নিকি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ঠিক আছে চল।
ক্রিনিটি বলল, কোথায় যাচ্ছ?
কিকি আকাশে উড়বে। আমি ওর পিছু পিছু দৌড়াব।
ও।
আমার মনে হয় পাখিরা মানুষ থেকে বেশি মজা করতে পারে।
কথাটি সত্য নয়, শুদ্ধ করে নিকিকে সেটি বলা উচিৎ ছিল, কিন্তু ক্রিনিটি কোনো কিছু বলল না। দীর্ঘদিন নিকির সাথে থেকে ক্রিনিটি কিছু জিনিস করতে শিখেছে। নিকিকে সে প্রায় সময়েই যুক্তিহীন বা অতিরঞ্জিত কথা বলতে দেয়। ক্রিনিটি জানে কারণে-অকারণে মানুষ অযৌক্তিক কথা বলে। মানুষকে অযৌক্তিক কথা বলতে না দিলে কিংবা অযৌক্তিক কাজ করতে না দিলে তারা মনে হয় পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে পারবে না।
কিকির পেছনে পেছনে নিকি ছুটতে থাকে। কিকি উড়তে উড়তে আবার নিকির কাছে ফিরে আসে, নিকি তাকে ধরার চেষ্টা করে কিকি শেষ মুহূর্তে উড়ে সরে যায়, এটি দুজনের মাঝে একরকম খেলা। নিকি বারকয়েক চেষ্টা করে কিকিকে ধরে আনন্দে হি হি করে হাসতে থাকে। ক্রিনিটি তার কাজ থামিয়ে নিকিকে লক্ষ করে, নিকিকে বড় করতে গিয়ে সে মানুষের অনেক কিছুই বুঝতে শিখেছে, কিন্তু হাসির ব্যাপারটি সে এখনো ধরতে পারে নি। মানুষ। কেমন করে হাসে সেই ব্যাপারটি তার কাছে এখনো দুর্বোধ্য। সে যদি তিন মাত্রার রোবট না হয়ে চার মাত্রার রোবট হতো তাহলে সে হয়তো এটি বুঝতে পারত, তিন মাত্রার রোবট হিসেবে সে কখনোই এটি জানতে পারবে না।
নিকি কিকির শরীরে হাত বুলিয়ে বলল, ক্রিনিটি বলেছে তুমি নাকি সামাজিক প্রাণী।
কিকি মাথা নেড়ে বলল, কঁ কঁ।
সামাজিক প্রাণী কথাটার মানে বুঝেছ? যারা দল বেঁধে থাকে তাদেরকে বলে সামাজিক প্রাণী। তুমিও কি দল বেঁধে থাক?
কিকি মাথা নেড়ে বলল, কঁ কঁ।
আমি তোমাকে কখনো দল বেঁধে থাকতে দেখি নি।
কিকি আবার মাথা নেড়ে বলল, কঁ কঁ।
বিকেলবেলা ক্রিনিটি যখন বাইভার্বালটির কাজ শেষ করে ইঞ্জিনটি প্রথমবার চালু করেছে তখন সে একটি অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখতে পেল। বনভূমির আকাশ কালো করে হাজার হাজার পাখি কর্কশ শব্দ করে উড়ে বেড়াচ্ছে। বনভূমির সামনে খোলা জায়গাটিতে নিকি দুই হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে আনন্দে চিৎকার করছে আর হাজার হাজার পাখি তাকে ঘিরে ঘুরছে আর ঘুরছে।
নিকি ঘুমিয়ে যাবার পর ক্রিনিটি তার শরীরটি একটি পাতলা চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়। তারপর তার গলার মাদুলিটি খুলে নিয়ে সে ক্রিস্টাল রিডারের সামনে বসে। মাইক্রোফোনটি টেনে নীচু গলায় দিনলিপিটি রেকর্ড করতে শুরু করে :
পৃথিবী থেকে সব মানুষের মৃত্যু হবার পর মূল তথ্য কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেছে, এই এলাকার যোগাযোগটিও বিচ্ছিন্ন। আমি তাই কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছি না। আমি বিচ্ছিন্ন ভাবে স্মরণ করতে পারি, কোনো একটি মানব শিশু যদি কোনো পশুপাখি দ্বারা লালিত পালিত হয়। তাহলে সে সেই পশুপাখির কিছু বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পারে। নেকড়ে বাঘ। দিয়ে লালিত কিছু শিশু নেকড়ে বাঘের মতো চার পায়ে ছুটতে পারত, বুনো কুকুর দ্বারা লালিত শিশু কুকুরের কিছু বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিল। ওরাংওটাং দিয়ে পালিত শিশু গাছে ওরাংওটাং-এর মতো ছুটে বেড়াতে পারত।
নিকি খুব শৈশব থেকে এই বনের কিছু পশুপাখির সাথে বড় হয়েছে। আমি সতর্ক দৃষ্টি রেখেছি বলে পশু পাখির প্রবৃত্তি তার মাঝে গড়ে ওঠে নি, কিন্তু আমার বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে যে নিকি পশুপাখির সাথে কোনো একটি উপায়ে তথ্য বিনিময় করতে পারে।
আমি আজকে নিকিকে বলেছি কিকি কাক জাতীয় প্রাণী এবং কাক জাতীয় প্রাণীরা দল বেঁধে থাকে। নিকি বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্যে কিকিকে তার প্রমাণ দেখাতে বলেছে। কিকি তার প্রমাণ হিসেবে বনভূমির সকল পাখিকে তার সামনে হাজির করেছে। আমি দেখেছি হাজার হাজার পাখি নিকিকে ঘিরে ঘুরছে। নিকি পাখি বা অন্যান্য প্রাণীর সাথে কিভাবে তথ্য বিনিময় করে সেটি আমি এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারি নি। তৃতীয় মাত্রার রোবট হিসেবে আমার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, আমি হয়তো কখনোই বিষয়টি বুঝতে পারব না।
আমি বাইভার্বালটি প্রস্তুত করেছি। খুব দ্রুত আমি নিকিকে নিয়ে বের হব। মানুষ যখন বেঁচেছিল আমি তখন তাদের মুখে এই বনভূমিটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রশংসা শুনেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা যোগাযোগের নেটওয়ার্কের বাইরে। পৃথিবীতে কোনো মানুষ জীবিত আছে কিনা সেটি বের করতে হলে আমাকে সভ্যতার আরো কেন্দ্রবিন্দুতে উপস্থিত হতে হবে।
নিকির দৈনন্দিন কার্যাবলির মাঝে আজকের উল্লেখযোগ্য ঘটনা বাইভার্বালের গঠন প্রকৃতি সম্পর্কে তার প্রথম বাস্তব ধারণা। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে…
ক্রিনিটি তার নিখুঁত ইলেক্ট্রনিক মেমোরি থেকে নিকির সারাদিনের প্রতিটি ঘটনার খুঁটিনাটি ক্রিস্টাল রিডারে লিপিবদ্ধ করতে শুরু করে।
ক্রিনিটি নিকির কোমরে বেল্ট বেঁধে সেটি বাইভার্বালের কন্ট্রোল প্যানেলের একটি হুঁকের সাথে লাগিয়ে দিলো। নিকি জিজ্ঞেস করল, তুমি কেন বেল্ট দিয়ে বেঁধে নিলে?
তোমার নিরাপত্তার জন্যে। তুমি তো আগে কখনো বাইভার্বালে ওঠ নি। তাই হঠাৎ করে যদি পড়ে যাও সে জন্যে।
আমি মোটেও পড়ে যাব না।
আমি জানি তুমি পড়ে যাবে না। কিন্তু তুমি জান তোমার ব্যাপারে আমি কখনো কোনো ঝুঁকি নেব না। তুমি যখন বাইভার্বাল চালানো শিখে যাবে তখন নিরাপত্তার এই ব্যাপারগুলো দরকার হবে না।
আমি কী এটি চালাতে পারব?
অবশ্যই পারবে। পৃথিবীতে যখন মানুষ বেঁচে ছিল তখন অবশ্যি কখনোই তোমার বয়সী একটি শিশুকে কেউ বাইভার্বাল চালাতে দিত না।
কেন দিত না?
প্রয়োজন হতো না। সেজন্যে দিত না। তখন ছোট শিশুদের কোনোরকম দায়িত্ব ছিল না। তারা শুধু মজা করত।
আমারও কোনো দায়িত্ব নাই। নিকি গম্ভীর হয়ে বলল, আমিও শুধু মজা করি।
না। ক্রিনিটি তার গলার স্বরে খানিকটা কৃত্রিম গাম্ভীর্য এনে বলল, তোমার অনেক দায়িত্ব। তুমি এর মাঝে কাপড় পরা শিখে গেছ। এখন তোমাকে এই বাইভার্বাল চালানো শিখতে হবে। তোমাকে যোগাযোগ মডিউল ব্যবহার করা শিখতে হবে। তোমাকে মনে হয় একটু-আধটু অস্ত্র ব্যবহার করা শিখতে হবে। তাছাড়া–
তা ছাড়া কী?
আমরা যদি সত্যি সত্যি কোনো মানুষের দেখা পেয়ে যাই তাহলে আমি সেখানে কোনো কথা বলতে পারব না। আমি তৃতীয় মাত্রার রোবট, মানুষের সাথে কথা বলার যোগ্যতা আমার নেই। তোমাকে তার সাথে কথা বলতে হবে।
আমি তার সাথে কী কথা বলব?
সেটা যখন সময় হবে তখন তুমি ভেবে বের করে ফেলতে পারবে। এখন চল সকাল থাকতে থাকতে আমরা রওনা দিই।
বাইভার্বালটির কাছাকাছি একটি গাছে কিছু পাখি বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাদের লক্ষ করছে। কাছাকাছি আরেকটি গাছে নানাবয়সী বানর। ক্রিনিটি বলল, নিকি, তুমি তোমার বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নাও।
কেন বিদায় নেব ক্রিনিটি? আমি কী মরে যাব?
না। মরে যাবে না। কিন্তু যখন কোনো মানুষ অন্যদের কাছ থেকে চলে যায় তখন বিদায় নেয়।
নিকির মুখটা হঠাৎ ব্যাথাতুর হয়ে ওঠে। সে নিচু গলায় বলল, আমি চলে যেতে চাই না। আমি এখানে থাকতে চাই।
ক্রিনিটি তার কপোট্রনে একধরনের চাপ অনুভব করে, সে চাপটি কমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল তারপর ঘুরে নিকির দিকে তাকিয়ে বলল, নিকি, তুমি সারাজীবন এখানে থাকতে পারবে না। তোমাকে এখন যেতে হবে, অন্য মানুষকে খুঁজে বের করতে হবে।
আমি যেতে চাই না। আমি অন্য মানুষ খুঁজে বের করতে চাই না।
তোমার মা আমাকে বলেছে আমি যেন অন্য মানুষকে খুঁজে বের করে তোমাকে তাদের কাছে নিয়ে যাই। তোমাকে যেতে হবে নিকি।
মায়ের কথা বলা হলে নিকি কখনো অবাধ্য হয় না। এবারেও হলো না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ঠিক আছে আমি যাব। কিন্তু আগে বল তুমি আমাকে আবার এখানে নিয়ে আসবে।
তুমি যদি চাও তাহলে আমি আবার তোমাকে এখানে নিয়ে আসব। কিন্তু কিছুদিনের মাঝেই তুমি নিজেই বড় মানুষের মতো হয়ে যাবে। তুমি তখন
একা একা এখানে ফিরে আসতে পারবে।
আমি বড় মানুষের মতো হতে চাই না। আমি ছোট থাকতে চাই।
ক্রিনিটি এই কথাটির উত্তর দিলো না–বলল, তুমি তোমার বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নাও, বাইভার্বাল চালু করা হলে তার ইঞ্জিনের শব্দে তারা ভয় পেয়ে চলে যেতে পারে।
নিকি তখন মাথা ঘুরিয়ে গাছের ওপর চুপ করে বসে থাকা পশুপাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল, বলল, বিদায় কিকি। বিদায় মিকু। বিদায় সবাই
কিকি এবং মিক্কু নিচু স্বরে একধরনের শব্দ করল কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে বাইভার্বালের ইঞ্জিন গর্জন করে উঠল এবং তার তীব্র শব্দে তাদের কণ্ঠস্বর চাপা পড়ে গেল। বাইভার্বালটি একটি ঝাঁকুনি দিয়ে মাটি থেকে এক মিটারের মতো উপরে উঠে গেল এবং আবার একটি ঝাঁকুনি দিয়ে সেটি সামনের দিকে ছুটে যেতে শুরু করে। নিকি মাথা ঘুরিয়ে পেছনের দিকে তাকাল, অনেকগুলো পাখি কর্কশ শব্দ করে উড়ছে, তার মাঝে কোনো একটি কিকি। দূরে একটি গাছে একধরনের উত্তেজনা দেখা যায় সেখানে নিশ্চয়ই মিক্কু এই মুহূর্তে গাছের একটি ডাল ধরে তার ভাষায় চিৎকার করছে। নিকি চাপা স্বরে বলল, আমি ফিরে আসব। আমি আবার ফিরে আসব। আসবই আসব।
নিকি অবাক হয়ে লক্ষ করল তার চোখে কেন জানি পানি চলে এসেছে। ব্যাপারটি সে বুঝতে পারল না।
ক্রিনিটি বলল, নিকি। তুমি প্রথমে লক্ষ কর আমি কেমন করে বাইভার্বালটি চালাই, তারপর আমি তোমাকে চালাতে দেব।
আমি লক্ষ করছি ক্রিনিটি। কিন্তু তুমি কিছুই করছ না।
তুমি ভুল বল নি। আমি আসলে কিছুই করছি না—এই বাইভার্বালগুলোর ভেতরে সে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি দেওয়া হয়েছে সেটি নিজে থেকেই সবকিছু করতে পারে। আমি শুধু কন্ট্রোল প্যানেলে চোখ রাখছি আর স্টিয়ারিং হুঁইলটা ধরে রেখেছি।
নিকি কন্ট্রোল প্যানেলটির দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, এখানে কী দেখা যায়?
সামনে কী আছে সেটি দেখা যায়।
আমি তো কিছু বুঝি না। এখানে তো শুধু লাল নীল কিছু রং!
তোমাকে এটি শিখতে হবে। রংগুলো দেখাচ্ছে তাপমাত্রা। আকৃতিগুলো দেখে কী দিয়ে তৈরি সেটি বোঝা যায়। কতদূরে সেটি আছে সেটিও বোঝা যায়। ক্রিনিটি ছোট একটি বিন্দুকে দেখিয়ে বলল, যেমন এটি হচ্ছে একটি প্রাণী। সম্ভবত হরিণ।
কেমন করে বুঝলে?
অভিজ্ঞতা থেকে। আমি আগে বাইভার্বাল চালিয়েছি।
নিকি দেখল ক্রিনিটির অনুমান সত্যি, বাইভার্বালটি যখন কাছে এসেছে তখন দেখা গেল একটি গাছের কাছাকাছি একটি বড় হরিণ দাঁড়িয়ে আছে। হরিণটি বাইভার্বালটির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, ইঞ্জিনটির শব্দ স্পষ্ট হওয়ার সাথে সাথে সেটি গাছের আড়ালে লুকিয়ে গেল।
নিকি বাইভার্বালের রেলিংটি ধরে বাইরে তাকিয়ে থাকে। বনভূমিটি পার হয়ে তারা বিশাল একটা জলাভূমিতে চলে এলো। জলাভূমিটি পার হওয়ার পর শুকনো পাহাড়ি এলাকা শুরু হল। এখানে তারা কিছু বিধ্বস্ত বাড়িঘর দেখতে পায়, গাছপালা এবং লাতগুল্ম সেই বাড়িগুলোকে ঢেকে ফেলছে, কোথাও কোনো প্রানীর চিহ্ন নেই। ক্রিনিটি তার বাইভার্বালটি নিয়ে খুব নীচে দিয়ে বাড়িঘরগুলোর উপর দিয়ে উড়ে গেল, বাইভার্বালের ইঞ্জিনিরে শব্দে সচকিত হয়ে কিছু পাখি কিছু বুনো প্রাণী এদিক-সেদিক ছুটে গিয়ে সতর্ক দৃষ্টিতে তাদের লক্ষ করতে থাকে।
সারাদিন তারা বাইভার্বালে করে মাটির কাছাকাছি দিয়ে উড়ে যেতে থাকে। যতদূর চোখ যায় ধ্বংসস্তুপের মতো ছোট ছোট বাড়িঘর। গাছপালা ঝোপঝাড় আর লতাগুল্মে ঢাকা। ঝড় বৃষ্টিতে বিধ্বস্ত। শ্যাওলায় ঢাকা। দেখে দেখে নিকি একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
সন্ধ্যেবেলা ক্রিনিটি একটি বাড়ির সামনে তার বাইভার্বালটি থামাল। নিকি জিজ্ঞেস করল, এখানে কেন থেমেছ ক্রিনিটি?
আমরা রাতে এখানে থামব। তুমি ঘুমাবে। আমি একটু কাজ করব।
কী কাজ?
আমি নেটওয়ার্কের ভেতর ঢুকতে চাইছি। মানুষের নেটওয়ার্ক যদি নাও থাকে রোবটদের একটি নেটওয়ার্ক থাকার কথা?
নিকি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, আমরা তাহলে মানুষদের খুঁজে পাব? শুধু রোবটদের খুঁজে পাব?
এখনো সেটি আমরা জানি না নিকি। যদি রোবটদের নেটওয়ার্কটি খুঁজে পাই তাহলে সেখানে সবরকম খোঁজ পাব। মানুষ আছে কী নেই সেটিও আমরা জানতে পারব।
ও।
বাইভার্বালটি থামার পর নিকি লাফিয়ে সেটি থেকে নেমে এল। বড় বাসাটির দিকে তাকিয়ে সে যখন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেল ক্রিনিটি তখন তাকে থামাল, বলল, নিকি, দাঁড়াও।
কী হল?
তুমি একা একা এখানে ঢুকো না।
কেন ক্রিনিটি?
বহু বছর এখানে কেউ থাকে না। ভেতরে কী আছে আমরা জানি না। হয়তো এমন কিছু আছে যেটি দেখে তোমার খারাপ লাগবে। হয়তো কোনো বুনো পশু, বিষাক্ত সাপ–
আমি বুনো পশু আর বিষাক্ত সাপকে ভয় পাই না।
কিন্তু তারা তোমাকে দেখে ভয় পেতে পারে। কেউ যখন ভয় পায় তখন তারা খুব অদ্ভুত কাজ করে ফেলতে পারে।
ক্রিনিটি বাইভার্বাল থেকে কিছু যন্ত্রপাতি আর একটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নামিয়ে নিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকল। ঘরের ভেতর আলো জ্বালিয়ে এদিক-সেদিক দেখল। ঘরের মাঝখানে একটি আলট্রাসনিক বীপার বসিয়ে অপেক্ষা করল। নিকি লক্ষ করল ঘরের ভেতর থেকে কিছু পোকামাকড়, ছোট ছোট প্রাণী ছুটে বেরিয়ে যেতে থাকে। ক্রিনিটি তার ফটোসেলের চোখ দিয়ে চারদিকে দেখে নিশ্চিত হয়ে নিয়ে বলল, নিকি, তুমি এখন ভেতরে আসতে পার।
নিকি বাসাটির ভেতরে ঢুকল। বহুবছর এখানে কোনো মানুষের পা পড়ে নি, তারপরেও বাসাটি সাজানো গোছানো। ক্রিনিটির সাথে সে বাসাটির ভেতর ঘুরে দেখে, উপর তলায় দুটি ছোট ঘরে দুটি ছোট বিছানা। এখানে নিশ্চয়ই দুটি ছোট শিশু ঘুমাতো। ঘরের দেয়ালে শিশুগুলোর ছবি টানানো, হাসিখুশি দুটি বাচ্চা।
নিকি বাচ্চাগুলোর ছবি দেখে বুকের ভেতর একধরনের ব্যথা অনুভব করে। সারা পৃথিবীর এরকম লক্ষ লক্ষ শিশু বেঁচেছিল,এখন কেউ নেই। সে একা এখন এই নির্জন পৃথিবীতে মানুষ খোঁজ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে জানে না যদি একসাথে অনেকগুলো মানুষ থাকে তাহলে কিভাবে কথা বলতে হয়। কী করতে হয়। সত্যি সত্যি যদি কোনো মানুষের সাথে দেখা হয়ে যায় তাহলে সে কী করবে? তার সাথে কী কথা বলবে?
রাতে ঘুমানোর সময় ক্রিনিটি উপর তলায় ছোট একটি বাচ্চার বিছানা গুছিয়ে নিকিকে শেয়ার ব্যবস্থা করে দিলো। কিছুক্ষণ পর সে তাকে একবার দেখতে এসে আবিষ্কার করল নিকি বিছানা থেকে চাদরটা নিয়ে মেঝেতে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। যে বিছানাটি অন্য একজন শিশুর সেখানে সে শুতে চাইছে না। কেন নিকি বিছানায় শুতে চাইছে না ক্রিনিটি সে বিষয়টা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করল না। মানুষের অনেক বিষয় সে বুঝতে পারে না, সে বোঝার চেষ্টাও করে না, বিষয়টি মেনে নেয়।
ক্রিনিটি নিকির শরীরটি চাদর দিয়ে ভালো করে ঢেকে দিয়ে তার গলার মাদুলিটি খুলে নীচে নেমে আসে। ক্রিস্টাল রিডারে দিনলিপি রেকর্ড করে সে তার যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতে বসল। যখন পৃথিবীতে মানুষ বেঁচে ছিল তখন বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের পুরো স্পেকট্রামটা ব্যস্ত ছিল, অসংখ্য সিগনাল আনাগোনা করত। এখন পুরো স্পেকট্রামটি আশ্চর্যরকম নীরব। ক্রিনিটি একটু একটু করে বিশ্লেষণ করতে করতে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যে অত্যন্ত দুর্বল একটি সিগনাল আবিষ্কার করল। সে দীর্ঘ সময় সেটিকে বিশ্লেষণ করে, এখান থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে শখানেক কিলোমিটার দূর থেকে সেটি আসছে। কাছাকাছি গেলে হয়তো উৎসটা খুঁজে বের করা যাবে।
ক্রিনিটি বাকি রাতটুকু বাইভার্বালকে আরেকটি দীর্ঘ যাত্রার জন্যে প্রস্তুত করে কাটিয়ে দিল। মানুষের মতো রোবটকে ঘুমাতে হয় না,রোবটকে বিশ্রমিও নিতে হয় না। ক্রিনিটি তাই দিনরাত একটানা কাজ করতে পারে। যখন পৃথিবীর মূল তথ্যকেন্দ্র চালু ছিল তখন সে ব্যাপারটি বোঝার জন্যে নানারকম তথ্য সংগ্রহ করেছে, ব্যাপারটি সে বুঝতে পারে নি। ঘুম বিষয়টি তার বোঝার ক্ষমতার বাইরে। স্বপ্ন বলে মানুষের ঘুম সম্পর্কিত আরো একটি বিষয়ের কথা সে শুনেছে, সেটি কী ক্রিনিটি তা অনুমান পর্যন্ত করতে পারে না।
ভোরবেলা নিকিকে নিয়ে ক্রিনিটি আবার রওনা দিয়ে দেয়। কোনদিকে যেতে হবে সেটি মোটামুটিভাবে জানে তাই ক্রিনিটি নিকিকে মাঝে মাঝেই বাইভার্বালটি চালাতে দিচ্ছে। আগে হোক পরে হোক নিকিকে এই ধরনের কাজগুলো শিখতেই হবে। যে শিশুটি পৃথিবীর একমাত্র জীবিত মানুষ তার দায়িত্ব অনেক বড়, তাকে সেভাবে গড়ে নিতে হবে।
উত্তর-পশ্চিমে যেতে যেতে হঠাৎ করে তারা একটি রাস্তা আবিষ্কার করল, কংক্রিটের রাস্তা অব্যবহারের কারণে জঞ্জালে ঢাকা পড়ে আছে। নিকি এই রাস্তা ধরে দীর্ঘপথ অতিক্রম করে নিল। ডানপাশে একটি নীল, হ্রদ আবিষ্কার করে নিকি অকারণেই পুরো হ্রদটি একবার ঘুরে এলো। ক্রিনিটি নিকিকে বাধা দিল না, বাইভার্বালটি আবার যখন পথের উপর উঠে এলো তখন ক্রিনিটি বলল, নিকি, তুমি বাইভার্বালটি ডান দিকে ঘুরিয়ে নাও।
কেন?
সামনে আমি একধরনের সিগন্যাল দেখেছি।
কোথা থেকে আসছে সিগন্যালটি?
আমি এখনও জানি না। কাছে গেলে বুঝতে পারব।
নিকি বাইভার্বালটিকে ডান দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে অল্প কিছুদূর এগিয়ে যেতেই কন্ট্রোল প্যানেলে দুটি ছোট ছোট বিন্দু ফুটে ওঠে। নিকি বলল, ক্রিনিটি, এই দেখ সামনে আরো দুটি হরিণ।
ক্রিনিটি মাথা নাড়ল, বলল, না এগুলো হরিণ না।
এগুলো তাহলে কী?
আমার মনে হয়, এগুলো রোবট।
রোবট?
হ্যাঁ। এটির শরীর ধাতব। এটি নড়ছে।
কী মজা! নিকির মুখে হাসি ফুটে উঠল, তোমার সাথে তোমার রোবট বন্ধুদের দেখা হবে।
নিকির কথা শেষ হবার আগেই কর্কশ গুলির শব্দ শোনা গেল এবং বাইভার্বালের সামনে বায়ুনিরোধক স্বচ্ছ কাচের একটি অংশ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল। নিকি বিদ্যুৎগতিতে নীচু হয়ে চিৎকার করে উঠল, কী হয়েছে?
ক্রিনিটি বলল, গুলি করছে।
কে গুলি করছে?
রোবটগুলো।
কেন গুলি করছে রোবটগুলো?
মনে করছে আমরা তাদের এলাকায় বেআইনীভাবে ঢুকে পড়েছি। ক্রিনিটির গলার স্বরে বিন্দুমাত্র উত্তেজনা নেই, খুবই স্বাভাবিক গলায় বলল, তুমি নিচু হয়ে থাক। তোমার শরীরে যেন গুলি না লাগে।
তুমিও নিচু হয়ে যাও ক্রিনিটি।
আমি রোবটগুলির সাথে যোগাযোগ করছি।
ক্রিনিটির কথা শেষ হবার আগে দ্বিতীয়বার কর্কশ শব্দ করে এক ঝাঁক গুলি ছুটে এলো, বাইভার্বালের বায়ুনিরোধক যেটুকু কাচ বাকি রয়ে গিয়েছিল সেটুকুও এবার উড়ে গেল। নিকি চিৎকার করে বলল, ক্রিনিটি বসে পড়!
ক্রিনিটি বসে পড়ল না বরং মাথা উঁচু করে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ করে বাইভার্বালটি ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে পড়ে এবং চোখের পলকে চারদিক দিয়ে অনেকগুলো বীভৎস ধরনের রোবট বাইভার্বালটিকে ঘিরে ধরে। তাদের হাতে বিকট-দর্শন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। বাইভার্বালটি থামার সাথে সাথে রোবটগুলো একসাথে তাদের অস্ত্রগুলো উঁচু করে চারদিক থেকে তাদের দিকে তাক করে ধরল।
নিকি চাপা গলায় বলল, বোকা! কী বোকা!
একটি রোবট মাটিতে পা ঠুকে বলে, বোকা কে বলেছে আমাদের?
নিকি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি।
তুমি? তুমি কেন আমাদের বোকা বলেছ?
তোমরা সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে অস্ত্র তাক করেছ। এখন সবাই যদি গুলি কর তাহলে একজন আরেকজনকে মেরে ফেলবে।
রোবটগুলো বেশ কয়েক সেকেন্ড কোনো কথা বলল না, তারপর সবাই একসাথে তাদের অস্ত্র নামিয়ে বিড়বিড় করে কথা বলতে লাগল। শেষে একটি রোবট জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?
আমার নাম নিকি।
তুমি কত মাত্রার রোবট? সিস্টেম কতো ধাপের?
আমি রোবট না।
তাহলে তুমি কী?
আমি মানুষ।
সাথে সাথে রোবটগুলোর মাঝে ভয়ংকর এক ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়ে গেল। তারা একে অপরকে ধাক্কা দিতে থাকে, কথা বলতে থাকে, একবার অস্ত্র উপরে তুলে তারপর নামিয়ে আনে এবং সেগুলো কঁকাতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে কেটে যায় তখন ক্রিনিটি হাত তুলে বলল, তোমরা খাম।
রোবটগুলো সাথে সাথে থেমে যায়। একটি রোবট মাথায় ঝাঁকুনি দিয়ে নিকিকে দেখিয়ে বলল, এই যন্ত্রটি আমাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।
ক্রিনিটি বলল, নিকি যন্ত্র নয়। নিকি আসলেই মানুষ।
রোবটটা আবার মাথায় ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, পৃথিবীতে কোনো মানুষ বেঁচে নেই। সব মানুষ মরে গেছে।
দ্বিতীয় একটি রোবট বলল, মরে গেছে।
তখন অন্য সবগুলো রোবট হল্লা করতে শুরু করল, মাথা ঝাঁকিয়ে বলতে শুরু করল, মরে গেছে। মরে গেছে।
নিকি অবাক হয়ে এই বিভৎস দর্শন রোবটগুলোকে দেখে, তাদের এই বিচিত্র ব্যবহার দেখে সে হঠাৎ ফিক করে হেসে ফেলল।
সাথে সাথে সবগুলো রোবট হঠাৎ পাথরের মতো জমে যায়। সবগুলো। রোবট তাদের ফটোসেলের চোখ দিয়ে নিকির দিকে তাকিয়ে থাকে, তারা। অস্ত্রগুলো নামিয়ে নেয় তারপর একে অন্যের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে শুরু করে, হেসেছে।
এটি নিশ্চিত ভাবে হাসি। অন্যকিছু নয়।
অন্যকিছু নয়।
শুধু মাত্র মানুষ হাসতে পারে।
মানুষ শুধুমাত্র মানুষ।
তার অর্থ এই বস্তুটি একটি মানুষ।
সত্যিকারের মানুষ।
আমরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান। আমরা সত্যিকারের একটি মানুষকে দেখতে পাচ্ছি।
সৌভাগ্যবান। অনেক সৌভাগ্যবান।
আমাদেরকে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছিল। সকল মানুষ মারা যায় নি।
মারা যায় নি।
বস্তুটি একটি মানুষ। আমি মানুষটিকে স্পর্শ করে দেখতে চাই।
স্পর্শ করতে চাই। আমার তথ্যকেন্দ্রে তথ্য রয়েছে মানুষের শরীরে তাপমাত্রা নির্দিষ্ট। এটি স্থির থাকে।
চামড়া কোমল এবং খানিকটা আর্দ্র।
এদের চোখ অত্যন্ত সংবেদনশীল।
সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ এদের মস্তিস্ক। দশ বিলিয়ন নিউরন।
আলোচনা এভাবে হয়তো আরো দীর্ঘ সময় ধরে চলত কিন্তু ক্রিনিটি হাত তুলে তাদের থামাল। বলল, তোমাদের অনুমান সত্যি। আমার সামনে পঁড়িয়ে থাকা এই শিশুটি একটি সত্যিকারের মানব শিশু। আমি তৃতীয় মাত্রার একটি রোবট। আমার প্রতিষ্ঠানিক নাম ক্রিনিটি।
সামনে উপস্থিত রোবটগুলো একসাথে কথা বলতে শুরু করে, আমরা দ্বিতীয়মাত্রার রোবট। আমাদের নাম নেই, শুধু সংখ্যা দিয়ে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। বাইনারীতে আমার সংখ্যাসূচক শূন্য এক শূন্য শূন্য এক…
ক্রিনিটি আবার তাদের থামাল, বলল, তোমাদের সংখ্যা সূচক বলার। প্রয়োজন নেই। আমরা যে কাজে এসেছি তোমরা আমাদের সে কাজে সাহায্য কর।
অবশ্যই অবশ্যই আমরা সাহায্য করব। আমাদের যেটুকু ক্ষমতা আছে তার পুরোটুকু দিয়ে আমরা সাহায্য করব।
পৃথিবীর মানুষের মৃত্যু হবার পর তাদের নেটওয়ার্কটি অচল হয়ে গেছে। আমরা কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারছি না। আমরা খোঁজ করছি অন্য কোনো নেটওয়ার্ক চালু আছে কিনা। যদি চালু থাকে তাহলে আমরা কিছু তথ্য পেতে চাই।
আমাদের একটি নেটওয়ার্ক আছে। আমরা সেই নেটওয়ার্ক থেকে কিছু তথ্য পেতে পারি। মানুষের মৃত্যুর পর তথ্যের গুরুত্ব কমে গেছে। আমাদের দায়িত্ব নিয়ে আদেশ নির্দেশ আর পাঠানো হয় না। আমরা সেই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করি না।
ক্রিনিটি বলল, আমি সেই নেটওয়ার্কটি ব্যবহার করে একটু তথ্য সংগ্রহ করতে চাই।
বিভৎস দর্শন একটি রোবট বলল, চল, আমাদের সাথে চল। আমাদের কন্ট্রোল রুমে নেটওয়ার্ক সংযোগ আছে।
নিকি বলল, আমি কন্ট্রোল রুমে যেতে চাই না। নেটওয়ার্ক দেখতে চাই।
ক্রিনিটি জিজ্ঞেস করল, তাহলে তুমি কী করতে চাও?
আমি জায়গাটি ঘুরে ঘুরে দেখতে চাই।
এটি অপরিচিত জায়গা। তোমার যদি কোনো বিপদ হয়?
মাঝারি আকারের বিদঘুটে একটি রোবট বলল, আমি মহামান্য নিকিকে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা প্রদান করব।
সাথে সাথে আরো কয়েকটি রোবট বলল, আমরাও মানব সন্তান মহামান্য নিকিকে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দিতে পারি।
ক্রিনিটি বলল, তা হলো আমরা দুইভাগে ভাগ হয়ে যেতে পারি। কয়েকজন আমার সাথে এসো, অন্যেরা নিকির সাথে থাকো।
বিভৎস রোবটটি বলল, ঠিক আছে।
বিশাল একটি বিল্ডিং-এর পাশে একটি কৃত্রিম হ্রদ। হ্রদটি ঘিরে বড় বড় গাছ। সেই গাছে পাখি কিচিরমিচির করছে। নিকি মাথা তুলে পাখিগুলোকে দেখার চেষ্টা করল।
একটি রোবট বলল, মহামান্য নিকি? পাখিগুলোর চেঁচামেচি কী আপনাকে বিরক্ত করছে? আমি তাহলে এই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিতে পাখিগুলোকে শেষ করে দিতে পারি।
নিকি আঁতকে উঠে বলল, না, না, না! খবরদার পাখিগুলোর কখনো কোনো ক্ষতি করবে না।
আপনার ইচ্ছা মহামান্য নিকি। আপনি যেটি বলবেন সেটিই আমরা মেনে নেব।
নিকি হি হি করে হেসে বলল, আর আমাকে মহামান্য নিকি বলে ডেকো না! যখন আমাকে তোমরা মহামান্য নিকি বলে ডাকো তখন আমার যা হাসি পায় সেটি বলার মতো না। হাসতে হাসতে আমার পেট ব্যথা হয়ে যায়।
রোবটটি বিড় বিড় করে বলল, হাসি এবং ব্যথা এই দুটিই একটি মানবিক প্রক্রিয়া। আমরা এই প্রক্রিয়াগুলো বুঝি না।
নিকি গম্ভীর হয়ে বলল, ভাগ্যিস ক্রিনিটি এখানে নেই। সে থাকলে বলত তোমাদের বুদ্ধিমত্তা কম! ক্রিনিটি সারাক্ষণ আমাকে শুধু বুদ্ধিমত্তা বোঝানোর চেষ্টা করে।
রোবটগুলো কোনো কথা বলল না। নিকি বলল, আমার কী মনে হয়। জানো?
কী?
ক্রিনিটির নিজেরই বুদ্ধিমত্তা কম।
রোবটগুলো এবারেও কোনো কথা বলল না। নিকি বলল, তবে ক্রিনিটির মনটি খুব ভালো। সে আমাকে খুব ভালোবাসে।
রোবটগুলো বাইভার্বালটিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল। ক্রিনিটি ইঞ্জিনটিকে চালু করার সাথে সাথে তারা হাতের অস্ত্র উপরে তুলে চিৎকার করে বলল, জয়, মহামান্য নিকির জয়।
নিকি হাসি মুখে তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, বিদায়! আবার দেখা হবে তোমাদের সাথে।
রোবটগুলো গম্ভীরমুখে বলল, মহামান্য নিকি দীর্ঘজীবী হোন।
বাইভার্বালটি মাটি থেকে মিটার খানেক উপরে উঠে একটু কাত হয়ে ঘুরে গিয়ে ছুটে যেতে শুরু করে। নিকি মাথা ঘুরিয়ে দেখল রোবটগুলো তাদের অস্ত্র উপরে তুলে আবার চিৎকার করে বলল, জয়, মহামান্য নিকির জয়।
নিকি ক্রিনিটির দিকে তাকিয়ে বলল, ক্রিনিটি, এরা আমাকে সবসময় মহামান্য নিকি কেন বলে?
তাদের কপোট্রনে এটি ইলেকট্রনিকভাবে গেঁথে দেয়া আছে। পাকাপাকিভাবে? সবসময় তাদের মানুষকে সম্মান করতে হয়।
সব রোবটরাই কী এরকম?
না। এটি করা আছে শুধু দ্বিতীয় আর প্রথম মাত্রার রোবটে।
তোমার মাঝে নেই?
আমার মাঝে ওদের মতো হার্ডওয়্যার করা নেই। অন্যভাবে আছে। সিস্টেমে রাখা আছে। আমরাও মানুষকে গুরুত্ব দিই।
আর চতুর্থ মাত্রার রোবট?
তারাও মানুষকে গুরুত্ব দেয় কিন্তু তাদের কপোট্রনের দক্ষতা মানুষের মস্তিষ্কের সমান। তাই তারা সমান সমানভাবে গুরুত্ব দেয়।
আর পঞ্চম মাত্রার রোবট?
পৃথিবীতে পঞ্চম মাত্রার রোবট নেই।
কেন নেই?
তৈরি করা হয় নি। আমি তোমাকে বলেছি তাদের বুদ্ধিমত্তা মানুষের। বুদ্ধিমত্তা থেকে অনেক বেশি হবে তাই ইচ্ছে করে তৈরি করা হয় নি। আমার কি মনে হয় জানো?
কী?
পঞ্চম মাত্রার রোবট মানুষকে মনে হয় সম্মান করবে না। তাদের বুদ্ধিমত্তা যদি মানুষ থেকে বেশি হয় তাহলে তাদের সম্মান করার দরকারও নেই। তুমি কী মিক্কুকে সম্মান কর?
নিকি খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, কিন্তু আমি তো মিকুকে অনেক ভালোবাসি। পঞ্চম মাত্রার রোবট মানুষকে ভালোবাসবে না?
মনে হয় ভালোবাসবে। মানুষকে ভালোবাসতে হয়।
ক্রিনিটি বাইভার্বালটিকে একটি হ্রদের কাছাকাছি নিয়ে এলো, হ্রদের তীর ঘেঁষে বাইভার্বালটি গর্জন করে ছুটে যেতে থাকে। বাইভার্বালের শব্দ শুনে অসংখ্য পাখি সচকিত হয়ে উড়ে যেতে থাকে। নিকি পাখিগুলোকে দেখতে দেখতে ক্রিনিটিকে জিজ্ঞেস করল, আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি ক্রিনিটি?
একটি রোবোনগরীতে।
রোববানগরী কী?
পৃথিবীর সব মানুষ মরে যাবার পরে রোবটেরা পৃথিবীর দায়িত্ব নিয়েছে। তারা নগর তৈরি করেছে। সেই নগরকে বলে রোবোনগরী।
সেখানে কী আছে ক্রিনিটি?
আমি এখনো জানি না। এখানে রোবটদের যে নেটওয়ার্ক আছে সেই নেটওয়ার্কে একটু খোঁজ নিয়েছি। মানুষের শহরে যা যা থাকার কথা মনে হয় তার সবই আছে। সিনেমা হল, আর্ট গ্যালারি, মিউজিক হল, স্টেডিয়াম, দোকানপাট।
সবকিছু রোবটদের জন্যে?
হ্যাঁ। সবকিছু রোবটদের জন্যে।
সেখানে কী আমার মতো কোনো মানুষ আছে?
এখনো জানি না। গেলে বুঝতে পারব। আমার মনে হয় নাই। গেলে। খোঁজ পাব, অন্য কোনো রোবোনগরীতে আছে কি নেই। যতক্ষণ না পাই আমরা খুঁজতে থাকব।
তোমার কি মনে হয় ক্রিনিটি, আমরা কি খুঁজে পাব?
আমার মনে হয় পাব। তুমি যেরকম বেঁচে গিয়েছ সেরকম নিশ্চয়ই আরো কেউ বেঁচে গিয়েছে। তারা নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও আছে।
নিকি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আরেকজন মানুষের সাথে দেখা হলে আমি তাকে কী বলব?
আমি তোমাকে বলেছি তোমার সেটি নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। তুমি তখন নিজেই বুঝতে পারবে কী বলতে হবে।
কী মজা হবে তখন, তাই না ক্রিনিটি?
ক্রিনিটি মজা শব্দটি অনুভব করতে পারে না, কিন্তু সে সেটি নিকিকে বুঝতে দিল না।
সন্ধ্যেবেলা রোবোনগরী পৌঁছানোর অনেক আগেই বাইভার্বালের মনিটরে তার উপস্থিতি ধরা পড়ল। সেখানে অনেকগুলো বিন্দু বিন্দু আলো এবং বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের বিচ্ছুরণ দেখা গেল। নিকি সেদিকে তাকিয়ে বলল, অনেক হইচই হচ্ছে। তাই না ক্রিনিটি?
হ্যাঁ।
সেখানে রোবটগুলো কয় মাত্রার?
বেশিরভাগই চার মাত্রার। হয়তো কিছু তিন মাত্রার।
তারা আমাকে দেখলে কী করবে?
আমি এখনও জানি না। সেজন্যে আমি সাবধান থাকতে চাইছি।
কিভাবে তুমি সাবধান থাকবে?
তোমাকে আমি আগেই নিয়ে যাব না। আমি নিজে গিয়ে আগে দেখে আসি।
আমাকে কোথায় রেখে যাবে?
তোমার জন্যে একটি নিরাপদ আশ্রয় বের করে সেখানে রেখে যাব।
আমি একা একা থাকব?
হ্যাঁ।
আমার একা থাকার ইচ্ছে করছে না।
ক্রিনিটি তার কপোট্রনে মৃদু চাপ অনুভব করল। সে চাপটি কমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে জিজ্ঞেস করল, তাহলে তুমি কী করতে চাও?
আমি তোমার সাথে যেতে চাই।
তোমাকে দেখলেই রোববানগরীতে বিশাল উত্তেজনার সৃষ্টি হবে। সেটি ভালো হবে না খারাপ হবে আমি সেটি এখনো অনুমান করতে পারছি না। আমি তোমাকে নিয়ে কখনো কোনো ঝুঁকি নেব না।
ঠিক আছে আমি তাহলে লুকিয়ে থাকব।
কোথায় লুকিয়ে থাকবে?
এই বাইভার্বালের পিছনে যে বাক্সটা আছে তার ভেতরে। তাহলে কেউ আমাকে দেখতে পাবে না।
ক্রিনিটি বলল, বাক্সটা বেশি বড় না, তুমি কি আরাম করে থাকতে পারবে?
হ্যাঁ পারব। আমি গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে যাব। তুমি কোনো চিন্তা করো না।
ঠিক আছে। ক্রিনিটি বলল, আমার মনে হয়, এটি একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান হতে পারে।
কাজেই বাইভার্বালটি থামিয়ে তার পেছনের বাক্সে বেশ খানিকটা জায়গা করে নিয়ে ক্রিনিটি সেখানে নিকিকে শুইয়ে দিল। জিজ্ঞেস করল, তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?
না। এখানে খুব আরামে ঘুমানো যাবে। এখন থেকে প্রত্যেকদিন আমি এখানেই ঘুমাব।
ঠিক আছে, তুমি ঘুমাও। আমি বাইভার্বালটিকে নিয়ে রোবোনগরীতে ঢুকি।
রোববানগরের গেটে দুটি ভয়ংকর দর্শন রোবট ক্রিনিটির বাইভার্বালটিকে থামাল। একজন জিজ্ঞেস করল, তুমি এই কিম্ভুতকিমাকার জঞ্জাল নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?
এটি কিম্ভুতকিমাকার জঞ্জাল নয়। এটি বাইভার্বাল।
এটি এতো পুরানো যে এটাকে জঞ্জাল বলা যায়। যাই হোক তুমি কোথায় যাচ্ছ?
আমি রোববানগরীর ভেতরে যেতে চাই।
তোমার কী লাইসেন্স আছে?
না। আমার লাইসেন্স নেই। আমি অনেকদূর থেকে এসেছি। আমি আগে কখনো রোবোনগরীতে যাইনি।
সেটি আমি তোমাকে দেখেই বুঝতে পারছি। তোমার কপোট্রন থেকে এখনো প্রাচীন কোডিং রেডিয়েট করছে।
আমি কী করতে পারি?
তোমাকে আমি সাময়িক একটি লাইসেন্স দিচ্ছি, চব্বিশ ঘণ্টার। এর মাঝে তোমাকে স্থায়ী লাইসেন্স করাতে হবে।
ঠিক আছে।
রোবটটি তার কিছু যন্ত্রপাতিতে চাপ দিতেই ক্রিনিটি তার কপোট্রনে কিছু তথ্যেরে অনুপ্রবেশ টের পেল। সে কপোট্রনটিকে দ্রুত ফায়ারওয়াল দিয়ে ঢেকে ফেলে। তার কপোট্রনে তথ্য ঢুকে গেলে সমস্যা নেই, কিন্তু কোনোভাবে। সেখান থেকে তথ্য বের করে নিলে তারা নিকির তথ্য জেনে নেবে।
ভয়ংকর দর্শন রোবটটি বলল, যাও। তোমার এই লক্করঝক্কর বাইভার্বালটি নির্দিষ্ট জায়গায় পার্ক করে নিও। আমরা কোডিং দিয়ে দিচ্ছি।
ঠিক আছে। তোমার কাছে কি কোনো ইউনিট আছে?
না নেই।
রোবটটি শীষ দেয়ার মতো শব্দ করে বলল, তাহলে তুমি স্ফূর্তি করবে। কেমন করে। রোববানগরীতে এসেছ ফূর্তি না করে চলে যাবে?
আমি তৃতীয় মাত্রার রোবট। আমার ভেতরে স্ফূর্তি করার মডিউল নেই!
রোবোনগরীতে সস্তায় এই মডিউল লাগানো হচ্ছে। লাগিয়ে নিয়ে স্ফূর্তি করতে পারবে। সত্যি কোনো ইউনিট নেই।
না। তবে—
তবে কী?
আমি একটি মানুষ পরিরারের গৃহস্থালি রোবট হিসেবে কাজ করতাম। সেই পরিরারের অব্যবহৃত কিছু ইউনিট আমার কাছে আছে। খুবই কম।
বল কী? এটি তো সোনার খনি। সোনার খনি?
হ্যাঁ। মানুষের হাতের স্পর্শ পাওয়া ইউনিট রীতিমতো মূল্যবান বস্তু। এর একটি বিক্রি করেই তুমি বড়লোক হয়ে যাবে। মানুষের যে কোনো কিছু খুবই মূল্যবান।
ক্রিনিটি নিজের কপোট্রনে একধরনের চাপ অনুভব করল, সে চাপটি কমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল, তারপর বলল, মানুষের যে কোনো কিছুই মূল্যবান?
হ্যাঁ। মানুষের চুল। নখ। ব্যবহারী কাপড়। এমনকি মানুষের আসল ভিড়িও অনেক ইউনিটে বিক্রি হয়। তোমার কাছে কি কিছু আছে?
আমি গৃহস্থালি রোবট হিসেবে কাজ করেছি, কাজেই আমার কাছে কিছু আছে।
চমৎকার। বিক্রি করে তুমি রাতারাতি ধনী হয়ে যাবে। কপোট্রনের আপগ্রেড করে চারমাত্রায় চলে যেতে পারবে। নতুন পৃথিবী উপভোগ কর।
ক্রিনিটি বলল, আমি চেষ্টা করব।
রোবট দুটি সুইচ টিপে দিতেই ঘরঘর শব্দ করে গেটটা খুলে যায়, ক্রিনিটি তার বাইভার্বালটি নিয়ে রোববানগরীর ভেতর ঢুকল।
রাস্তায় নানা আকারের বাইভার্বাল, আধুনিক এবং স্বয়ংক্রিয়। সেগুলোর তুলনায় তার নিজের বাইভার্বালটি রীতিমতো হাস্যকর একটি যন্ত্র। চতুর্থ মাত্রার কিছু রোবট মাথা ঘুরিয়ে সেটি দেখছে। ক্রিনিটি অনুমান করতে পারে হাসার ক্ষমতা থাকা এই রোবটগুলো নিশ্চয়ই তার বাইভার্বালটিকে দেখে মনে মনে হাসছে।
বাইভার্বালটি নির্দিষ্ট জায়গায় পার্ক করে ক্রিনিটি পেছনে বাক্সের ভেতরে উঁকি দিল, নীচু গলায় ডাকল, নিকি?
নিকি ফিসফিস করে বলল, বল ক্রিনিটি।
তুমি বলেছিলে ঘুমাবে।
ঘুম পাচ্ছে না।
না পেলেও চুপ করে শুয়ে থাক। আমি শহরটা ঘুরে দেখে একটু খোঁজ। খবর নিয়ে চলে আসব।
ঠিক আছে।
ক্রিনিটি এদিক সেদিক তাকায়, তার ইলেকট্রনিক সিগন্যাল বিস্তৃত করে। আশপাশে কেউ তাদের লক্ষ করছে না বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর সে হাঁটতে থাকে। দুটো রাস্তা পরেই দেখা যায় সেখানে বিশাল উত্তেজনা। উজ্জ্বল আলো এবং নানা আকারের রোবোটের অনেক ভিড়। তাদের হইচই চেঁচামেচিতে জায়গাটি মুখরিত হয়ে আছে।
ক্রিনিটি সতর্কভাবে হাঁটতে থাকে। সে টের পায় তার কপোট্রনে অনেক তথ্য জোর করে ঢোকার চেষ্টা করছে, বিষয়টিতে সে অভ্যস্ত নয় তাই ফায়ারওয়াল দিয়ে সে নিজের কপোট্রনে একটি নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে রাখে। আশপাশের ঘরগুলো থেকে তাকে রোবটগুলো ডাকাডাকি শুরু করে দেয়। সংগীতের একটি দোকান থেকে একট রোবট বলল, এই যে রূপবান! আমার ঘরে এস কিনিস্কির নবম সিম্ফোনি শুনে যাও। আজকে ছাড় দিয়েছি, মাত্র আট ইউনিটে পেয়ে যাবে।
ক্রিনটি বলল, আমি তৃতীয় মাত্রার রোবট। সংগীত উপভোগ করার ক্ষমতা নেই।
তাতে কী আছে। কিনে নিয়ে যাও যখন চতুর্থ মাত্রার কপোট্রন বসবে এখন উপভোগ করবে।
চতুর্থমাত্রার কপেট্রনে আপগ্রেড করার মতো ইউনিট আমার কাছে এখন নেই।
এখন নেই তো কী হয়েছে? ভবিষ্যতে হবে।
ভবিষ্যতে যখন হবে তখন আমি বিবেচনা করব।
সংগীতের দোকানের রোবটটি হতাশার মতো শব্দ করে বলল, এই জন্যে তৃতীয় মাত্রার রোবটকে বলে জংধরা জঞ্জাল।
ক্রিনিটি তাচ্ছিল্যটুকু উপেক্ষা করে এগিয়ে যায়। সামনে একটি ঘরের বাইরে অনেক ধরনের উজ্জ্বল আলো জ্বলছে এবং নিভছে। বাইরে উজ্জ্বল রঙের দুটি রোবট একই সাথে ঠিক একইভাবে তাদের যান্ত্রিক হাত নেড়ে কথা বলছে, এসো, আনন্দের ভুবনে এসো। কপোট্রনে সঠিক তরঙ্গ উপস্থাপনের মাধ্যমে মাদকের আনন্দ। সম্পূর্ণ আইনসিদ্ধ বিনোদন, চলে এসো। চলে এসো সবাই।
অনেক রোবট সেখানে ঢুকছে। ক্রিনিটি কয়েক মুহূর্ত ঘরটার সামনে দাঁড়িয়ে রইল তারপর আবার হাঁটতে শুরু করল।
ভয়ংকর ধরনের কিছু অস্ত্রের দোকান, কোল্ড ফিউসান ব্যাটারির একটি দোকান, তারপর কপোট্রন আপগ্রেডের অনেকগুলো দোকান পার হয়ে ক্রিনিটি আরো এগিয়ে যায়। বাইভার্বালের বড় একটি দোকান সে ঘুরে ঘুরে দেখল, নতুন নতুন ইঞ্জিনগুলো চমকপ্রদ তার বাইভার্বালটি নিয়ে নগররক্ষী রোবটগুলো যে তামাশা করেছে তার একটি কারণ আছে।
বাইভার্বালের দোকান থেকে সে নানাধরনের বিনোদনের আরো কয়েকটি ধর পার হয়ে একটি চিড়িয়াখানা দেখতে পেল অনেক ধরনের পশু সেখানে খা আছে। এরপরে একটি আর্ট গ্যালারি এবং কয়েকটি থিয়েটার। তার ঠিক মুখোমুখি একটি বড় হলঘরের সামনে সে দাঁড়িয়ে গেল। এতক্ষণ ধরে সে যেটি খুঁজছে ঠিক সেটি পেয়ে গেছে, হলঘরের উপরে নানা রঙের আলোর ঝলকানি, সেখানে বড় বড় করে লেখা, বিস্ময়কর মানবশিশু। দর্শনীয় দশ ইউনিট।
ক্রিনিটি তার পুরানো ইউনিট পরিবর্তন করে অনেকগুলো নতুন ইউনিট পেয়ে গেল। সেখান থেকে দশ ইউনিট ব্যবহার করে সে হলঘরে ঢুকে যায়। ভেতরে আবছা অন্ধকার, অনেকগুলো রোবট সেখানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। সামনে একটি বড় স্টেজ, সেখানে চতুর্থমাত্রার ছিমছাম একটি রোবট কথা বলছে, বন্ধুগণ পৃথিবীর বিস্ময় হচ্ছে মানব শিশু। তোমাদের সামনে এখনি উপস্থিত হবে সেই বিস্ময়কর মানবশিশু, তোমরা তাকে দেখবে, তার সাথে কথা বলবে, তার গান শুনবে। মাত্র দশ ইউনিটের বিনিময়ে আর কোথাও এই বিনোদন তোমরা খুঁজে পাবে না।
একটি বিচিত্র শব্দ হতে থাকে এবং পেছনের পর্দাটি ধীরে ধীরে সরে গেল, দেখা গেল মঞ্চের মাঝখানে একটি ছোট টুল সেখানে তিন-চার বছরের ছোট একটি শিশু বসে আছে। মঞ্চে তীব্র আলো, সেই আলোতে শিশুটির বড় বড় চোখ খুলে রোবটগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে।
ছিমছাম রোবটটি তার গলায় কৃত্রিম একটি আনন্দের ভান ফুটিয়ে নিয়ে বলল, এই মানব শিশুটির নাম লিশুয়া তার জন্ম দক্ষিণের সমুদ্রতীরে ভাইরাসের কারণে তার পরিরারের সবাই মৃত্যুবরণ করলেও রহস্যময়ভাবে সে। বেঁচে যায়। তাই না লিশুয়া?
লিলুয়া নামের শিশুটি মাথা নাড়ল। ছিমছাম রোবটটি বলল, লিওয়া মানুষের কণ্ঠে কথা বলে শোনাবে—গান গেয়ে শোনাবে। নাচবে, খেলা দেখাবে।
উপস্থিত রোবটগুলোর একজন তখন বলল, হাসি দেখতে চাই। হাসি।
অন্য রোবটগুলো প্রতিধ্বনি করল, বলল, হাসি। হাসি।
ছিমছাম রোবটটি ইতস্তত করে বলল, লিশুয়া একা একা বড় হয়েছে, তাই সে হাসতে ভুলে গেছে। তাই না লিশুয়া?
লিশুয়া মাথা নাড়ল। ছিমছাম রোবটটি বলল, তারপরও সে তোমাদের সামনে হাসার চেষ্টা করবে। কিন্তু তার আগে সে তোমাদের সাথে কথা বলবে। তোমরা প্রশ্ন কর, লিশুয়া সেই প্রশ্নের উত্তর দেবে। তাইনা লিশুয়া।
লিশুয়া মাথা নাড়ল এবং ক্রিনিটি বুঝতে পারল লিন্ডয়া আসলে সত্যিকারের মানব শিশু নয়। এটি জোড়াতালি দিয়ে মানবশিশুর মতো তৈরি করা একটি নিচু শ্রেণীর রোবট। ক্রিনিটি তখন রোবটদের ভিড় ঠেলে বের হয়ে যেতে শুরু করে।
ছিমছাম রোবটটি বলল, এই যে! এই যে রূপবান! তুমি চলে যাচ্ছ।
কেন?
ক্রিনিটি বলল, এটি সত্যিকার মানবশিশু নয়।
তুমি কেমন করে জান?
আমি জানি। কারণ আমি একটি গৃহস্থালি রোবট। আমি মানব শিশু দেখেছি।
ছিমছাম রোবটটি বলল, অন্তত লিশুয়ার একটি গান শুনে যাও।
সত্যিকারের মানব শিশু হলে নিশ্চয়ই শুনতাম।
মাত্র দশ ইউনিটে সত্যিকারের মানব শিশুর গান শোনা যায় না।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি রোবট বলল, লক্ষ ইউনিটেও তুমি সত্যিকারের মানব শিশুর গান শুনতে পারবে না। তার কারণ পৃথিবীতে কোনো মানব শিশু নেই।
জরাজীর্ণ একটি রোবট নিচু গলায় বলল, আছে।
তার কথায় অন্য রোবটেরা কোনো গুরুত্ব দিল না, শুধু ক্রিনিটি রোবটটির দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, কোথায় আছে?
জাতীয় গবেষণাগারে। একটি মেয়ে শিশু আছে।
তুমি কেমন করে জান?
জরাজীর্ণ রোবট টি আরো নীচু গলায় বলল, আমি কেমন করে জানি তুমি কেন সেটি জানতে চাইছ?
ক্রিনিটি বলল, আমি তৃতীয় মাত্রার রোবট। আমার বুদ্ধিমত্তা নিম্নস্তরের। আমি নিজে থেকে একটি তথ্যের সত্য মিথ্যা বুঝতে পারি না। আমাকে যাচাই বাছাই করতে হয়।
রোবটটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ক্রিনিটির দিকে তাকাল। ক্রিনিটি বুঝতে পারল সেটি তার কপোট্রনে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করছে। ক্রিনিটি ফায়ারওয়ালটি উজ্জীবিত করে রেখে তাকে তার কপোট্রনের ভেতর ঢুকতে দিল না।
রোবটটি এক ধরনের যান্ত্রিক শব্দ করে বলল, যে নিজের কপোট্রনকে ফায়ারওয়াল দিয়ে ঢেকে রাখে আমি তাকে বিশ্বাস করি না। তুমি নিশ্চয়ই নিরাপত্তা বাহিনীর একজন গুপ্তচর।
ক্রিনিটি বলল, না। আমি গুপ্তচর না।
জরাজীর্ণ রোবটটি গলা উঁচিয়ে বলল, গুপ্তচর। গুপ্তচর।
হঠাৎ করে রোবটদের মাজে একটি হল্লা শুরু হয়ে গেল। মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকা ছিমছাম রোবটটা হাত তুলে বলল, থাম। সবাই থাম। কী হয়েছে এখানে?
নিরাপত্তা বাহিনীর একটি গুপ্তচর এখানে ঢুকে গেছে।
ক্রিনিটি বলল, না। আমি গুপ্তচর না।
তাহলে তোমার কপোট্রন ফায়ারওয়াল দিয়ে ঢেকে রেখেছ কেন?
আমি আমার তথ্য সবাইকে দিতে চাই না।
রোবটগুলো আবার হল্লা করতে শুরু করল। মঞ্চে দাঁড়ানো ছিমছাম রোবটটি বলল, চুপ কর। তোমরা সবাই চুপ কর। তা না হলে আমি জ্যামার সিগন্যাল দিয়ে সবার কপোট্রন জ্যাম করে দেব।
কিছু কিছু রোবট তখন একটু শান্ত হয়। ক্রিনিটি রোবটদের ভিড় ঠেলে বের হয়ে যেতে থাকে। জরাজীর্ণ রোবটটি বলল, তুমি কেনো চলে যাচ্ছ?
এখানে থাকার আমার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি সত্যিকার মানব শিশু খুঁজছি। এটি সত্যিকার মানবশিশু নয়।
তুমি সত্যিকার মানবশিশু দিয়ে কী করবে?
আমি গৃহস্থালি রোবট। আমি সবসময় সত্যিকার মানব এবং সত্যিকারে মানব শিশুর সাথে কাজ করেছি। কৃত্রিম মানব এবং কৃত্রিম মানবশিশুতে আমার কোনো আগ্রহ নেই।
বুঝতে পেরেছি।
কী বুঝতে পেরেছ?
তোমার কপোট্রনে মানব শিশু নিয়ে অনেক তথ্য আছে। সে জন্যে তুমি তোমার কপোট্রন ফায়ার ওয়াল দিয়ে আড়াল করে রেখেছে।
ক্রিনিটি তার কপোট্রনে প্রবল একধরনের চাপ অনুভব করে, কিন্তু জরাজীর্ণ রোবটের পরের কথায় তার চাপ দ্রুত কমে আসে। জরাজীর্ণ রোবটটি বলল, আমি এখন বুঝতে পেরেছি তুমি কেন তোমার কপোট্রনটি ফায়ারওয়াল দিয়ে আড়াল করে রেখেছ। সত্যিকারের মানবশিশুর তথ্য অনেক। ইউনিটে বিক্রি হয়। এই তথ্যগুলোকে সবাইকে জানতে দিও না।
ক্রিনিটি বলল, দেব না।
দেখে শুনে বিক্রি করো।
করব।
তৃতীয় মাত্রার রোবটটি হিসেবে তোমার বুদ্ধিমত্তা খারাপ নয়। কিছু ইউনিট পেলে কপোট্রনটি চারমাত্রায় আপগ্রেড করে নিও।
করে নেব।
ভালো কোম্পানি থেকে কপোট্রন কিনবে। কপো-কট কোম্পানিটা ভালো। রক্ষণাবেক্ষণের ভালো প্যাকেজ আছে।
ঠিক আছে।
জরাজীর্ণ রোবটটা উপদেশ দিয়ে আরো কিছু একটি বলতে যাচ্ছিল, ক্রিনিটি তার আগেই জিজ্ঞেস করল, তুমি বলেছ জাতীয় গবেষণাগারে একটি মেয়ে শিশু আছে।
হ্যাঁ বলেছি।
জাতীয় গবেষণাগারটি কোথায়?
নতুন রোবনগরী ইস্পনাতে।
সেটি কোথায়?
বেশি দূরে নয়, এখান থেকে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার পশ্চিমে। নেটওয়ার্কে ইস্পনার অবস্থান দেয়া আছে। বাইভার্বালে কো অর্ডিনেট ঢুকিয়ে নিও।
চুকিয়ে নেব।
জরাজীর্ণ রোবটটি আরো কিছু একটি বলতে চাইছিল কিন্তু ঠিক তখন মঞ্চের কৃত্রিম মানবশিশুটি তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে হাত-পা নেড়ে তীক্ষ্ণ গলায় গান গাইতে শুরু করে। ক্রিনিটির সংগীত অনুভব করার ক্ষমতা নেই। তাই সে বুঝতে পারল না সেটি ভালো না খারাপ। সে অবশ্যি তার চেষ্টাও করল না, রোবটদের ভীড় ঠেলে বের হয়ে এলো।
রোবনগরীর রাজপথ ধরে হেঁটে হেঁটে ক্রিনিটি তার বাইভার্বালের কাছে ফিরে এলো। জায়গাটি অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং নিরিবিলি। ক্রিনিটি এদিক সেদিক তাকিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে নিল আশে পাশে কেউ নেই তখন সে বাই ভার্বালের পেছনে গিয়ে ছোট বাক্সটি সাবধানে খুলে উঁকি দেয়, সেখানে নিকির ঘুমিয়ে থাকার কথা। কিন্তু ভেতরে কেউ নেই।
ক্রিনিটি তৃতীয় মাত্রার রোবট তার বিচলিত অথবা আতংকিত হওয়ার ক্ষমতা নেই। তাই সে বিচলিত অথবা আতংকিত হল না। বাইভার্বালের সামনে লাগানো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি খুলে নিয়ে কন্ট্রোল প্যানেলের ওপরে রেখে বিড়বিড় করে বলল, এখন মনে হচ্ছে অস্ত্র নিয়ে আসার সিদ্ধান্তটি সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল।