অফিসের পিয়ন নাদিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, হাতে একটি বড় সর ফুলের তোরা। নাদিয়ার চোখে মুখে বিস্ময়। পিয়নের হাতে ফুল কেন ?
.
— আপা এটা আপনাকে এক ভদ্রলোক দিতে বললো।
— কোন ভদ্রলোক দিতে বললো ?
— বললো, ম্যাডাম নাদিয়া কে দিয়ে দিবেন সে আমার পরিচিত ?
— এটা কেমন কথা ! সে আমার পরিচিত হলে, সে তো আমার কাছেই আসতো !
— ভদ্রলোক বললো তার হাতে নাকি সময় নেই।
— আচ্ছা ঠিক আছে দিন আমার কাছে, আপনি আসুন।
.
পিয়ন ছেলেটি ফুলের তোরাটি তার হাতে দিয়ে চলে গেছে।
নাদিয়ার চোখ থেকে এখনো বিস্ময় ভাবটি কাটেনি কারন নাদিয়া যে স্বভাবের মানুষ,
এবং খিটখিটে মেজাজের তাতে করে তো কেউ তাকে ফুল দেওয়ার কথা না।
.
ফুলের মাঝে একটি চিরকুট, সেটা হাতে নিয়ে চোখের সামনে ধরে আছে নাদিয়া, তাকে লেখা।
আপনি এতো সুন্দর কেন ?
নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারেন না ? বারবার আপনাকে দেখে নিজেকে হারিয়ে ফেলি আমি।
.
নাদিয়ার জিজ্ঞাসু চোখ খুঁজে ফিরছে স্মৃতির আয়না। কে এই ছেলে ?
সে কি ছেলেটিকে দেখেছে ?
কলেজ জীবনের অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার পর থেকে সে আর কোন ছেলেকেই বিশ্বাস করে না।
নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে সমস্ত আবেগ এবং ভালোবাসা থেকে।
পুরুষ জাতি কে সে প্রচণ্ড ভাবে ঘৃণা করে। বারবার বাড়ি থেকে বিয়ের কথা বললেও কঠোর ভাবে এড়িয়ে গেছে।
সে আর কোন পুরুষকেই নিজের এই নোংরা শরীরটা কে ভালোবেসে দিতে চায় না।
.
অভয়ের সাথে নাদিয়ার গভীর সম্পর্ক ছিল। অভয়কে অন্ধের মতো ভালবাসতো নাদিয়া।
সেই বিশ্বাসে তারা একদিন লং ড্রাইভে বেড়িয়েছিল কিন্তু অভয়ের নোংরা মনের খবর নাদিয়ার জানা ছিল না।
সামান্য আদরের কথা বলে অপরিচিত একটি বাড়ির ভেতর জোর পূর্বক তার ইজ্জত হনন করে অভয়।
সেই দিন থেকে পুরুষের কামুকতা কে সে প্রচণ্ড ভয় পায়।
নাদিয়া যদিও নিজের কথা ভেবে কিছু দিন পর অভকে বিয়ে করার জন্য বলেছিল কারন নাদিয়া কনসিভ করেছিল…….,
কিন্তু নাদিয়ার গর্ভের সন্তানের স্বীকৃতি এবং বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানায় অভয়।
.
সেদিন নাদিয়ার লোক লজ্জার ভয়ে অভয়ের বিরুদ্ধে কিছুই করা হয়নি। ততো দিনে বাড়ির সবাই জেনে গেছে ব্যাপারটা।
নিজের জন্য হোক কিংবা বাবা মায়ের হুকুমে জন্যে হোক লাইগ্যাশন করতে হয় তাকে।
একটি জীবন্ত ভ্রুন কে হত্যা করতে সামান্য বুক কাঁপেনি নাদিয়ার কিন্তু বুক থেকে চিরদিনের জন্য পুরুষের প্রতি ভালোবাসা হারিয়ে গেছে।
সেখানে স্থান করে নিয়েছে এক সমুদ্র ঘৃণা।
.
আবার নাদিয়া সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে যদিও কিছুটা সময় লেগেছিল কিন্তু কলেজ ইউনিভার্সিটি পার হতে এটা কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি,
যদিও বা নাদিয়ার স্বভাবে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে,খিটখিটে মেজাজ, অবিশ্বাসী চোখ এবং কঠোরতা।
যা তার চাকরি জীবনে কিছু বিপত্তির সৃষ্টি করছে বৈকি। কিন্তু এই গিফটকৃত ছেলেটি কে ? কিবা তার পরিচয় ?
.
নাদিয়া অফিস শেষে বাসায় এসে পড়েছে। তার রুমে ডুকতেই চোখ চরক গাছ।
তার টেবিলের উপর রাখা সেম আরেকটি ফুলের তোরা। এবং সাথে একটি চিরকুট।
তাতে লেখা, আমি জানি অবহেলায় ফুলের তোরাটি আপনি বাসায় আনেননি …..,
কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি চাই আপনি আমাকে নিয়ে একটু ভাবুন তবে এটাও বলে রাখি আপনার অতীত সম্পর্কে আমি অবগত আছি।
.
এবার সত্যি নাদিয়া বিমহিত হয়ে গেছে। যে ছেলেকে আমি চিনি না জানি না তবে তাকে নিয়ে কিভাবে ভাববো আমি !
আর আমার অতীত সম্পর্কে ছেলেটি কিভাবে অবহিত !
অনেকটা আশ্চর্য হয়ে গেছে নাদিয়া। সেই ঘটনার কথা তার বাবা মা আর অভয় ছাড়া আর দ্বিতীয় কেউ জানে না।
.
এভাবে বিভিন্ন ভাবে নাদিয়াকে ফুল আর গিফট দিয়ে ঘোরের ভেতর ফেলে দিয়েছে ছেলেটি।
ছেলেটির প্রতি কোন আগ্রহ না থাকলেও কৌতূহল তো অবশ্যই আছে। এ নিয়ে ভাবনায় ছিল নাদিয়া একদিন অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসলো।
সাধারণত নাদিয়া অপরিচিত নাম্বারে কথা বলে না কিন্তু আজ কি মনে করে নাম্বার টা রিসিভ করলো।
.
— হ্যালো কে বলছেন প্লীজ
— আমাকে আপনি ঠিক চিনবেন না কিন্তু আমি আপনাকে আপাদমস্তক চিনি এবং জানি আপনার অতীত এবং বর্তমান।
— ও.. আপনি সেই ব্যক্তি যে কিনা ফুলের তোরা এবং অন্যান্য সামগ্রী উপহার হিসেবে পাঠান ?
— জ্বি আমি সেই অধম
— কিন্তু আমি তো ঠিক আপনাকে চিনি না, আবার বলছেন আপনি আমার অতীত বর্তমান সব জানেন।
একটু খোলাসা করে বলবেন কি কে আপনি? কি আপনার পরিচয়?
— আচ্ছা আমি কি আপনার সাথে দেখা করতে পারি ?
— দেখা করবেন !!
— ভয় নেই আমি আপনার সাথে পাবলিক প্লেসেই দেখা করব।
.
— আচ্ছা ঠিক আছে আপনি যেহেতু অফিস চিনেন তার পাশেই একটি চাইনিজ রেস্টুডেন্ট আছে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় চলে আসুন।
— ok আমি ঠিক সময় মতো থাকব।
.
শেষ টেবিলের কোনায় একটি ছেলে বসে আছে কিন্তু এই ছেলেটিই সেই ছেলেটি কিনা নাদিয়া ঠিক বুঝতে পারছে না।
কনফার্ম হওয়ার জন্য নাদিয়া ফোন দেয়। হ্যাঁ, ছেলেটি ফোন হাতে তুলে নিয়েছে।
সামান্য আন্তরিকতার জন্য মুখে স্মিত হাসি ফুটিয়ে রেখেছে ছেলেটির দিকে হেঁটে যায় নাদিয়া।
.
— আমি নাদিয়া, আপনি নিশ্চয় সেই ,,_,,_
— জ্বি আমি সেই বিরক্তিকর ছেলেটি।
— বসতে পারি ?
— অবশ্যই, বসুন প্লীজ।
.
নাদিয়া ছেলেটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছে সে কখনো তাকে দেখেছে কিনা কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছে না।
.
— আচ্ছা আমি কি আপনাকে চিনি বা পূর্ব পরিচিত বা কখনো দেখেছি কি ?
— না, আপনি আমাকে চিনেন না বা পূর্ব পরিচিত নয়। আমি তামিম..
— তবে যে চিরকুটে লিখেছেন আপনি আমার অতীত বর্তমান সব জানেন !
— হ্যাঁ এটা অবশ্য ঠিক। আমি আপনার সব কিছুই জানি।
— একটু খোলাসা করে বলবেন কি।
.
— আপনি অবশ্যই অভয় কে চিনেন যাকে আপনার ভোলার কথা না, সেই অভয় আমার পরিচিত।
পরিচিত বললে ভুল হবে ও আমার কাছের এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল এক গ্রামে আমাদের বাড়ি এবং ঢাকাতে আমরা এক বাড়িতেই থাকতাম।
তার মুখ থেকেই আপনার কথা শুনা। আপনাদের সমস্ত কিছুই অভয় আমার সাথে শেয়ার করতো।
আপনার চার বছর আগের ছবিও আমার কাছে আছে।
আপনাকে যে আমি কতো খোঁজা খুঁজেছি সেটা আপনার ধারণার বাইরে।
.
আপনাদের বাড়ির ঠিকানা মতো গিয়ে আপনাকে আমি পাইনি। শুনেছি আপনাদের গ্রামের বাড়ি লক্ষীপুরে চলে গেছেন।
আসলে ঘটনার আড়ালে ঘটনা থাকে সেটা আমরা অনেকেই জানিনা।
যেদিন অভয় আপনার সাথে একটি বাড়িতে খারাপ আচরণ করেছিল সেদিনকার বিষয়টাও আমার কাছে শেয়ার করেছিল, …..
এবং অভয় অনেক অনুতপ্ত এবং বিধ্বস্ত ছিল।
.
আপনি তার সাথে রাগ করে থেকে ছিলেন কিছুদিন।
সে ইতিমধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আপনাকে সে বিয়ে করবে যদিও বা সে বেকার ছিল কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস।
তার একদিন পরেই সে খুবই অসুস্থ বোধ করায় তাকে হাসপাতালে নিয়েছিলাম।
ডাক্তার সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যে উত্তরটা আমাকে দিয়েছিল তার জন্য আমি সহ তার মা বাবা কেউ প্রস্তুত ছিল না।
অভয়ের ব্লাড ক্যান্সার হয়েছিলো যা কিনা শেষ স্টেপে ছিল এবং অনিরাময় যোগ্য।
আর তাই আপনি যখন কনসিভ করলেন এবং তাকে বিয়ের জন্য চাপ দিলেন কিন্তু মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা আপনার অনাগত সন্তান এবং আপনাকে অস্বীকার করলো কিন্তু মৃত্যুর শেষ দিনে আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্নাকাটি করে বলেছিল তার সন্তানের দায়িত্ব যেন আমি নেই।
আপনাকে যেন আমি বিয়ে করি। আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম যেভাবে হোক অভয়ের সন্তান এবং আপনার দায়িত্ব আমি কাঁধে তুলে নিব এবং
বন্ধুর অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রতিদান আমি অবশ্যই দিব।
কথা রাখতে আপনাকে আমি অনেক খুঁজেছি কিন্তু পাইনি। অবশেষে কিছুদিন আগে ফেসবুকে আপনার আই ডি এবং ছবি দেখি।
অবশেষে এবাউট থেকে আপনার অবস্থান এবং অফিসের ঠিকানার সন্ধান পাই।
.
নাদিয়ার হাত পা কাঁপছে বারবার অভয়ের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে। খুব কান্না পাচ্ছে।
অভয় হয়তো অপরাধ করেছিলো কিন্তু সে অনুতপ্ত ছিল এবং বিয়ে করার জন্য প্রস্তুত ছিল তবুও নিজের মৃত্যুর কথা প্রকাশ করেনি।
এটা অভয়ের কেমন ভালোবাসা ছিল নাদিয়ার জানা নেই।
শুধু এভাবেই অভয়ের দায়িত্ব শেষ করে যায়নি তার সন্তান এবং তার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রাণ প্রিয় বন্ধু কে অনুরোধ করে গেছে।
.
— নাদিয়া এখন তো আপনি সব জানলেন যদিও আমি আপনার উপযুক্ত নই তবুও অভয়ের শেষ ইচ্ছা পূরণার্থে আমাকে কি গ্রহন করা যায় ?
আমি আপনাকে হয়তো অভয়ের মতো এতোটা ভালোবাসতে পারবো না কিন্তু আপনাকে আমি সুখী করতে পারব।
একরাশ ভালোবাসা দিয়ে আপনার ব্যথাতুর হৃদয় কে শীতল করতে পারবো। পারবেন কি আপনার হাতটি আমার উপর রাখতে ?
.
নাদিয়া তামিমের দিকে তাকিয়ে আছে, সে কি উত্তর দিবে ভেবে পারছে না।
যে হারিয়ে গেছে তাকে তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না কিন্তু তার কথা রাখতে গিয়ে অপরিচিত একটি যুবক কে কিভাবে সে জীবন সঙ্গী হিসাবে বেছে নেয়।
.
নাদিয়া উঠে দাঁড়িয়েছে চোখ ছলছল করছে।
.
নাদিয়া: আমাকে মাফ করবেন এটা কখনো হয়না। যে দেহ অপবিত্র হয়ে গেছে যার স্বপ্ন মরে গেছে তাকে আর স্বপ্ন দেখিয়ে লাভ নেই।
একাই কাটিয়ে দিতে পারব আমি আমার জীবন। ভালো থাকবেন।
.
নাদিয়া চলে যাচ্ছে। চোখে জমানো জলটুকু গড়িয়ে পড়ছে। তামিম তাকিয়ে আছে নাদিয়া চলে যাওয়ায় পথে কিন্তু পিছু ডাকার সাহস তার হয় না।
তামিমের ভেতর থেকে একটি নিশ্বাস বেড়িয়ে আসে, আসলে সব ঘটনার সমাপ্তি হয় না কিছু থেকে যায় অসম্পূর্ণ এবং অসমাপ্ত।