(১)
ওবেলায় দেখে গেছিলাম কবরখানার লোহার রেলিংটার সামনের একচিলতে বাঁধানো জায়গাটায় বসে এক বুড়োটে মানুষ চোখ বুঁজে গান গাইছেন। কাঁচাপাকা ঝুপড়ো চুল,একমুখ না কাটা দাড়ি, অপরিচ্ছন্ন পোশাক, কিন্তু ভিখারীও নন যদিও সামনে মাটির ওপর বেশ কিছু কয়েন খুচরো পয়সা ছড়ানো।এবেলায় কলেজ ফেরতাও দেখি একবগ্গা লোকটা কাঠফাটা রোদে একা একা পুড়ছে। নাকি কড়া রোদে স্নান করছে কে জানে। আমার বাড়ী থেকে কলেজ যেতে বাসে সময় নেয় মিনিট পনেরো। আর বাসস্ট্যান্ড থেকে বাড়ী হাঁটাপথে প্রায় দশ মিনিট। রাস্তাটা কবরখানা ঘেঁষা বলে সারাবছরই সুনসান। তবে ভীতিপ্রদ নয়। বাসস্ট্যান্ড থেকে বাড়ী আসার ওটাই শর্টকাট রাস্তা। যাবার সময় যেমন দেখে গেছিলাম কবরখানার বাইরে রেলিং-এ হেলান দিয়ে বিধ্বস্ত ভঙ্গীতে বসেছিল, আসার সময়ও তাই। না একটু ছায়ার দিকে সরে বসেছে, না নিজেরই ছেঁড়া মোজা আর সেলাই করা জুতো থেকে অবাধ্য হয়ে বেরিয়ে আসা পায়ের বুড়ো আঙুলটার থেকে চোখ সরিয়েছে। এলোচুলে এলোপাথাড়ি ভাবনা নিয়ে কিসে যে সে বিভোর তা ওই জানে।
–
লোকটাকে আমি চিনি কি চিনি না এ ব্যাপারে আমার নিজেরই একটু সংশয় আছে। হ্যাঁ কি না, যেটাই বলবো সেটাই ৫০% সত্যি আর ৫০% মিথ্যের মিশেল হয়ে দাঁড়াবে। এই ছোট্ট শহরতলীর সবাই ওকে চেনে। ও গানপাগলা, ও নামেই সবাই জানে ওকে। রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে বেড়ায় কিন্তু ভিখারী নয়। কারো কাছে কিছু চায় না। কারো দিকে মুখ তুলে তাকায়না অবধি। কারো সাথে কথাও বলে না। কেউ যত্ন করে খাওয়ালে খায় নয়ত আপনমনে গান গায়, কখনো হাসে, কখনো কাঁদে। নিজের মনে কথা বলে কিন্তু কেউ কাছাকাছি গেলে চুপ করে যায়। ও যে পাগল তাও নয়। খালি এক ইউটোপিয়ার জগতে বাস করে। প্রতি বছরই একটা নির্দ্দিষ্ট দিনে ভোররাত থেকে মাঝরাত অবধি এই কবরখানর বাইরে রেলিং-এর ধারে বসে কার জন্য যেন অধীর প্রতীক্ষা করে কিন্তু ভুলেও ভেতরে উঁকিটুকু অবধি দেয়না। ঢোকা তো দুরঅস্ত। সারাদিন কেউ জলটুকু খাওয়াতে পারে না। পরদিন থকে আবার ভুলেও কবরখানার রাস্তার ধারেকাছেও দেখা যায়না ওকে।
(২)
মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ। সন্ধ্যেবেলায় পড়তে বসার তাড়া নেই। কেবল ছুটি। বাবা বলেছিলেন আগামী সপ্তাহে বাড়ীর সবাইকে নিয়ে দার্জিলিং যাওয়া হবে। কিন্তু হঠাৎ করে ঠাকুমার শরীর খারাপ হয়ে পড়ায় সব বাতিল। মন খারাপ করে আশা তাই একা একা চলে এসেছে বাড়ীর প্রশস্ত ছাদে। আকাশে তারার মেলা বসেছে,কিন্তু চাঁদ নেই,কিছুটা ঝিরিঝিরি বাতাস ও আছে,মনটা বেশ ভালো হয়ে যায় আশার।আশে পাশের তেমন কেউ নেই,আর অন্ধকারে এত কিছু ভালো করে দেখাও যাচ্ছেনা,আশা চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস নেয়……”আমি এত যে তোমায় ভালোবেসেছি”…
–
আশা চোখ খোলে না,একটু অবাক হয়ে আবার খেয়াল করে, কে গাইছে গানটা?এত দরদ দিয়ে,আবার কানে আসে…মনে হচ্ছে আশে পাশেই কোথাও কেউ গাইছে।চোখ বন্ধ করেই আশা গানটা শুনতে থাকে,আস্তে আস্তে মনটা অনেক ভালো হয়ে যায় ওর।
…”কেন আরো ভালোবেসে পারেনা হৃদয়”…
–
কে গাইছে গানটা?! আশা চোখ খুলে চারপাশে তাকায়,নাহ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না,কিন্তু মনে হচ্ছে খুব পাশেই কেউ গাইছে, হাঁটতে হাঁটতে বাড়ীর ছাদের অন্যপ্রান্তে চলে আসে আশা, নদীর দিকে, আরে একি?!!! সেই ভ্যাগাবন্ড ছেলেটা!! রহিমপুরার মসজিদের কাছাকাছি কোথাও থাকে। আশাকে দেখলেই বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকে যতক্ষন দেখা যায়। আশা টের পায় শুধু ওকে একনজর দেখার জন্যই দিনে দুপুরে ভর রোদে কি বৃষ্টি মাথায় ছেলেটা ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে স্কুলের সামনে, টিউশন স্যারের বাড়ীর মোড়ে, ওদের বাড়ীর সমনের চায়ের দোকানে। কিছু বলে না। খালি বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে। তবে খারাপ লাগে না আশার। কোন অস্বস্তি বোধ হয়না ওর দৃষ্টিতে। বরঞ্চ অবচেতনে এক ভালোলাগাতেই ছেয়ে যায় ওর কিশোরী মন। গান তাহলে ওই গাইছে? এত দিন হয়ে গেল, ছেলেটা এত সুন্দর গান গাইতে জানে সেটা তো আশা জানতো না! ছেলেটা চোখ বন্ধ করে খুব দরদ দিয়ে গান গাইছে,অন্ধকারে ভালোভাবে দেখা না গেলেও আশার মনে হল যেন ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আশা অবাক হয়ে দেখতে লাগল কন্ঠে দরদ আর চোখে জল…মানুষ কিভাবে পারে?!!কার কথা ভেবে এভাবে কাঁদছে ও? খুব জানতে ইচ্ছে করে আশার।তখনই নীচ থেকে মায়ের ডাক ভেসে আসে। স্বপ্নালু ভালোলাগাটুকু মুঠোয় পুরে নীচে নেমে যায় আশা।
–
সেই প্রথম আশা বুঝলো ভালোবাসা কি। আশা আর মানিকের বিশেষ সম্পর্কটা কাছাকাছি থাকা, হাত ধরা, লোকচক্ষুর আড়ালে, গাছের ছায়ায়,পার্কের অন্ধকারে ,পোড়ো বাড়ীর নিরাপদ চৌহদ্দীতে, গল্প-গুজব এসবের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়া পর্যন্ত।কথায় বলে নেশানগরীর অলিতে গলিতে …মৃত্যু,আর ভালোবাসার নেশা তো সর্বনাশা। সেই সর্বনাশা টানেই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর বাড়ীর অমতে ঘর পালিয়ে বিয়ে করেছিল আশা-মানিক। মানিকের আশিয়া আর আশার সোনামন। দিব্যি সুখের সংসার, নতুন গেরস্থালী, রঙিন প্রজাপতি মন আর হাজার স্বপ্ন। সে সুখ, সুখ পায়রা হয়ে উড়ান দিল বড্ড তাড়াতাড়ি। বিয়ের দুবছরের মাথায় ছয়মাসের শিশু আমন আর আমনের মা আশিয়াকে নিয়ে রিকশায় করে সিনেমা দেখতে যাবার সময় কালান্তক এক মালবোঝাই লরীর ধাক্কা ওদের সুখী গৃহস্থলীকে চিরদিনের মত ভেঙ্গে দিয়ে যায়। আশিয়া আর আশিয়ার দুহাতে জড়ানো বাচ্চাটাকে আলাদা করে চেনার উপায় ছিলনা। নাঃ নিজের চোখে সে নারকীয় দৃশ্য দেখেনি মানিক,দেখতে হয়নি, ও তো নিজেই তখন আই সি ইউ তে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। ওর পুরোপুরি জ্ঞান আসার আগেই ধর্মীয় রীতি মেনে আশিয়াদের শেষকাজটা হয়ে গেছিল।
–
তারপরও শহরের প্রতিটি জানালায় উঁকি দিয়ে গেছে প্রতিটি নতুন দিনের চুমুকভরা কিশলয় রোদ্দুর। তবু আশিয়া আর ফিরে আসেনি। কোন কোন রাতে ঘুম ভেঙ্গে যেত। যেন সেই চিরচেনা কণ্ঠস্বরের আওয়াজ শুনতে পেত সে। “সোনা, আমার সোনামন”..গভীর রাতে চিরচেনা বিছানার মাঝখানে বসে দিশেহারার মত এদিক ওদিক চাইতে গিয়ে একটা সময় মনে হত, সে বসে আছে দুরান্তরের বিজন কোন এক স্বপ্নের দ্বীপে…মানসিক অস্থিরতাটা এক কালান্তক ব্যাধির মত ছেয়ে ফেলেছিল তাকে। আশিয়াহীন মনের হাহাকার , চৌচির ভাঙ্গন, এক সময়ে রূপ নিয়েছিল মানসিক বিষাদে, আপাত উম্মত্ততায়, হ্যালুসিনেসনে । আশিয়া যে আর কোনদিন ফিরবেনা এটা মন থেকে মেনে নিতে না পারায় ওর পৃথিবীটা স্থিতিশীল হয়ে যায়। সেখানেই থমকে দাঁড়ায় সময়। আদি অন্তহীন এক নির্মম প্রতীক্ষায় ও বুঝি মানুষ থেকে পাথরই হয়ে যায়। এরপর প্রতিটি বছর ধরে সেই একই দিনে কবরস্হানের বাইরেই রেলিংটায় হেলান দিয়ে বসে থাকে মানিক অলৌকিক এক প্রত্যাশার আশায়। মানিকের পাওয়া না পাওয়ার যত প্রতীক্ষার আগল, নিজেকে নিজের ভুলিয়ে রাখার যাবতীয় কল্পনার জগতটা প্রতিবছর এই দিনে এখানে এসেই হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে। এখন সবার মত আমিও জানি, আগামী বছরটাতেও একই দৃশ্য এইদিনে ঠিক একভাবেই ফিরে আসবে। যতদিন না মানিককে কেউ কাঁধে চাপিয়ে গেট পেরিয়ে নিয়ে যাবে আশিয়ার পাশে। শেষ বিশ্রামে।