অনেক তীক্ষ্ণ রোদে আমি ভ্রূকুটি করে ছিলাম, আমার মোটেও ভাল লাগছিল না যে রোদটা আমায় বার বার স্পর্শ করছে। আমি একটু পরপর আমার দুচোখ বুজে ফেলছিলাম। বুজে থাকা চোখের ভিতর বারবার, অবিরাম, ঘন ঘন কিছু রঙের প্রলেপ ঘুরপাক খাচ্ছিল। নীল, লাল, সবুজ, কালো, হলদে, বেগুনী, কালো আবার নীল। কালোর মাঝে ছোট ছোট লাল বিন্দু, সাথে বেগুনী ছোপ ছোপ হলদে দাগ। রঙগুলো বারবার তাদের ছাপ ফেলে যাচ্ছিল ভেজামাটিতে পড়া পায়ের ছাপের মত। সাদা ক্যানভাসে যদি হঠাৎ যদি বিভিন্ন রঙ ছলকে পড়ে তাহলে যেমন দুর্বোধ্য কিছু চিত্র ফুটে উঠে আমার চোখের তারায় তেমন কিছুই যেন এঁকে যাচ্ছিল রোদটুকু। আমি ঘোর ঘোর চোখে বারবার চোখ বুজে দেখছিলাম রঙগুলোর বদলে যাওয়া। আমার কষ্ট হচ্ছিল, শিশির বিন্দুর মত চোখে অল্প অল্প পানি জমছিল, কিন্তু তবুও কেন যেন আমি কষ্টটুকু বেশ উপভোগ করছিলাম…
আমার মাইনাস পাওয়ারের চশমার কাঁচ আচ্ছন্ন হয়ে গেলো গরম কফির ধোঁয়ায়। বাষ্প হয়ে সাদা সাদা কণাগুলো লেগেই থাকল, যেন এক মুঠো কুয়াশা এনে কেউ আমার চশমার কাঁচে লেপ্টে দিয়ে গেল, আর রোদের তাপ আবার মুছে দিলো সব। আবার আচ্ছন্ন হলাম, আবারো ভ্রুকুটি করলাম, আর এক মুহূর্তের মাঝে সামনে দেখতে পেলাম আমার বাবাকে। সেই রোদেপড়া তামাটে গায়ের রং, চোখ মনিগুলো গাঢ় খয়েরী, গাঢ় খয়েরী সেই চোখের দৃষ্টি ভীষণ দৃঢ়, গভীর। মুখে সবসময়কার সেই মৃদু হাসি, মুখে কোন শব্দ নেই কিন্তু অনেক অনেক কথা। অনেক অনেক অব্যক্ত কথা। দু আঙ্গুলের মাঝে ধরে রাখা সিগারেটের ধোঁয়া কুন্ডলী পাকিয়ে বাতাস গলে রোদের সাথে মিশে যাচ্ছে। যেন না বলা কথাগুলো ধোয়ার সাথে মিশে মিলিয়ে যাচ্ছে কেবলই।
আমি চোখ মুদে আবারও শূন্য দৃষ্টিতে তাকালাম, নিমিষেই আমি আমার মাকে দেখতে পেলাম। সেই লালচে শাড়ি পরা, যে শাড়ি পরলেই তাকে অসাধারণ সুন্দর লাগত। আমার মা নির্বাক ছিলেন, নিশ্চুপ ছিলেন, যেন আমার কাছে না থাকার কষ্ট তাকে ঠায় বসিয়ে দিয়েছিল। আমি আমার এক মৃত মামাকে দেখতে পেয়েছিলাম ,যিনি আমাকে বলেছিলেন—’পরীক্ষায় ফার্স্ট হলে তোকে মস্ত বড় একটা উপহার দিব। এই এত্ত বড় উপহার!!! তোর চেয়েও বড়’। আমি সেবার পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছিলাম, কিন্তু সেই মস্ত বড় উপহার আর সেই মানুষটাকে আমি আর কখনই পাই নি। ক্লাশের সবাই যখন আমার জন্যে হাত তালি দিচ্ছিল আমি তখন নিজের রেসাল্ট কার্ডটা হাতে নিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠেছিলাম।
এরপর আমার ১২ বছর আগের ছটফটে বড় ভাইটাকে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম যাকে আমার আজকাল সব সময় বড্ড অচেনা লাগে। সে একমনে তার পুরোনো নীল মাউথ অর্গান বাজাচ্ছিল। মাউথ অর্গানের বিষণ্ণ সুর শুনে অদ্ভুত বেদনায় আমার বুকের ভেতরটা কেমন টনটন করে উঠছিল। আমি একবুক বেদনা নিয়ে অপলক চোখে আমার অচেনা হয়ে যাওয়া ভাইটাকে দেখছিলাম।
হঠাৎ করেই যেন রোদের তীব্রতা বেড়ে গেল। চলন্ত রেলগাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে যেমন হুশ হুশ করে একের পর এক দৃশ্য বদলে যায় ঠিক তেমনই করে আমার সামনে একের পর এক দৃশ্যপট আর মানুষ বদলাতে থাকল। আমি দেখতে পেলাম, আমার ছেলেবেলার দুই ঝুটি করা বান্ধুবীটি আমার দেয়া রঙ পেন্সিলের বাক্স নিয়ে ছবি আকঁছে। অনেক বছর আগের আমার প্রিয় আইসক্রিম বিক্রি করা বুড়ো লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। তার মাথায় তখনও টাক পড়েনি। গায়ে চকচকে লাল শার্ট, মুখে হাসি। দেখতে পেলাম কোন এক ঘরের একপাশে আমার জীবনে প্রথম পাওয়া বারবি পুতুলটা উলটা হয়ে পড়ে আছে। পুতুলটার একটা হাত ভাঙ্গা, ওকে দেখতে কতই না অসহায় লাগছে।
পুতুলটা মিলিয়ে যেতেই হঠাৎ অনেক বছর আগের আমাকে দেখতে পেলাম। সেই কালো রেশমের মত চুলগুলো দু কাঁধে ছড়িয়ে রেখে আমি তাকিয়ে ছিলাম এক দৃষ্টিতে আমারই দিকে। ঠিক আমার মত করেই আমি গালে হাত দিয়ে বসে ছিলাম। আমি চোখের তারায় ছিল এক আকাশ অভিমান। আমি একরাশ অভিমান নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমি তাকিয়ে থেকেই একটু একটু করে বদলে যাচ্ছিলাম। আমি হয়ে যাচ্ছিলাম নীল ইউনিফর্ম পরা স্কুল পড়ুয়া ছাত্রীটি, ভারত নাট্যম ক্লাশে নাচার সময় পড়ে গিয়ে পায়ে ব্যথা পাওয়া মেয়েটি, এক ঝড় বৃষ্টিময় দুপুরে একা একা বাড়ি ফিরে আসা কিশোরীটি, কলেজের শেষ বেঞ্চিতে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে থাকা বোকা মেয়েটি কিংবা আমি হয়ত কিছু হয়ে যাচ্ছিলাম না। আমি একই ছিলাম। শুধু নিজেকে দেখে অকারণেই অবাক হচ্ছিলাম, তারপর আমার মনে হচ্ছিল আমি মাতাল, উদ্বেগে অস্থির। গলার কাছে নামহীন বাষ্পের পিন্ড আর রক্তিম অনুভূতি আমার। মাঝে মাঝে চোখের সাথে আমার ঠোঁট কুঁচকে যাচ্ছিল। লুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল আমার চারদিকের ছবি, দেয়াল, কফি হাউসের মানুষগুলো, কাউন্টার, দামী কাঠের চেয়ারগুলো, আমার কফির পেয়ালা সঅববব……
অদ্ভুত রোদ আর ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে আমার পৃথিবী, আমার চশমার কাঁচ, সব কিছুই ঘোলাটে। নিজেকে আমার নিঃসঙ্গ, বধির, অন্ধ ও পরিত্যক্ত মনে হল। যেন পুরো পৃথিবী আমাকে নিয়ে তামাশা করছে, হা হা হা করে অট্টহাসি দিচ্ছে। আমি বেমালুম ভুলে গেলাম চশমার কাঁচটা মুছলেই আমি সব দেখতে পাব ঠিক আগের মত। আমি ভুলে গেলাম এক অভিজাত কফি হাউজের কোনায় বসে বসে আমি অহেতুক ভেবে ফেলেছি আমার জীবনের চেনা কতশত মানুষকে, কিংবা নিজেকেই…
অবহেলায় আমার কালোকফি স্বাদটা জুড়িয়ে যাচ্ছিল কেবলই। কাল কফির স্বচ্ছ মেহগনি রংটা ঘুরতে ঘুরতে গাঢ় বাদামী, কালচে বাদামী হচ্ছিল। আমার মনে হল, আমার সামনের সবগুলো মুখ একসাথে অদ্ভুত এক আনন্দ নিয়ে ঐ পেয়ালার মধ্যে চামুচের আবর্তনে ঘুরপাক খেতে খেতে বিষাদের চেহারা নিল। আমার মনে হল আমিও সেই সাথে বাষ্প হয়ে একটু একটু করে মিলিয়ে যেতে শুরু করলাম। একটু একটু… একটু একটু করে……