ধুলোয় চাপা কষ্ট

ধুলোয় চাপা কষ্ট

বারান্দাটায় বসে আছি গত দুই ঘন্টা ধরে । আমার বাম পাশে দোলনাটা । প্রবল বাতাসের ধাক্কায় বার বার দোল খেয়েই যাচ্ছে । আর আমার ডান পাশে আমার সাইকেলটা । সেই সাইকেল । ট্রিনিটি ব্র্যান্ডের । ক্লাস এইটে কিনে দিয়েছিলেন বাবা । কেনো যেন আজকে সাইকেলটাকে অনেক আপন লাগছে ।

উঠে দাড়িয়ে সাইকেলটার কাছে এগিয়ে গেলাম । ধূলোর মিহি আস্তরনে ঢাকা তার ধাতব শরীর । সাইকেলটার অন্তীমকাল উপস্থিত । গত দশটা বছর নিরলস সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে বেচারা । সামনের চাকাটা টাল হয়ে গেছে , পিছনের চাকার বেয়ারিংটা একটু মনে হয় বাঁকা । গোটা কয়েক স্পোক ঠিক না করলে যে কি দুর্ঘটনা হয় তা নিয়ে চিন্তা করতে চাই না ।

দুর্ঘটনা !

হ্যা এই সাইকেলটাকে অভিশপ্ত বললে ভুল হবে না একদম । অনেক অভিশপ্ত কাহিনির জন্মদাতা এই সাইকেল । অভিশপ্ত মানে আমার ক্ষেত্রে অভিশপ্ত আর কি । অর্থাত্‍ সাইকেলটা দিয়ে অনেক দুর্ঘটনা ঘটিয়েছি আমি । প্রথম যখন সাইকেলটা কিনেছি , তখন খুশিতে প্রায় আত্মহারা ছিলাম । প্রতিদিন সকালে বাবা আমাকে সাইকেল চালানো শিখাতেন । বাবা এক হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল আর এক হাতে সাইকেলের ক্যারিয়ার ধরে রাখতেন । আর আমি পরম নিশ্চিন্তে প্যাডেলিং করতাম । মনে ভয় থাকতো না এতোটুকু ।

বাবা টা এতো দুষ্টু ! কিছুক্ষন পরই হাত দুটো সরিয়ে নিতেন । কয়েক সেকেন্ড একটা ঘোরের মধ্যে চালিয়ে তারপর যখন দেখতাম যে বাবা পাশে নেই তখন আতংকিত হয়ে পরতাম । দিশেহারা হয়ে যেতাম । বেকুবের মতো পেডেলিং করা আর থামাতাম না । যার ফলে সাইকেল দিকভ্রান্ত হয়ে যেত । একটু দূর গিয়ে একেবারে সাইকেল সহ ভূপতিত হতে হত ।

অপমানে , রাগে , দুঃখে মাথার চুল ছেড়ার উপক্রম হতো আমার । আর আমার দুষ্টু বাবাটা হো হো করে তার ইয়া বড় পেট দুলিয়ে হাসতো । তারপর দ্রুত কাছে এসে আমাকে টেনে তুলতো । আবার বাবা একই ভাবে সাইকেল ধরতো আর আমি নিশ্চিন্তে পেডেলিং করতাম । একবার এইরকম করতে করতে হটাত্‍ যখন বাবা ছেড়ে দিলেন , তখন সোজা গিয়ে ড্রেইন কে আলিঙ্গন করলাম । মূহুর্তেই সাদা আমি কালো হয়ে গেলাম ! আমার দুষ্টু বাবা তখনও হেসেছেন । ইস্ লোকটা এতো হাসে কেনো ?

একদিন ভোরে বাসা থেকে বের হলাম । বাবাও আমার সাথে আছেন । বাবা সেদিন একটু গম্ভীর ছিলেন । আমার কাঁধে হাত রেখে বলেছিলেন “সামনে চোখ রাখবে । দেখবে আর কখনো ভারসাম্য হারাও নি ।” . . সেদিন আমি প্রথম একা সাইকেল চালাতে শিখেছিলাম । বাবা সেদিনও হেসেছিলেন । আমি ঠিক বুঝি না এতে হাসির কি হলো ?

স্যারের বাসায় প্রতিদিন সাইকেলে দিয়ে যেতাম । অবশ্য রিক্সায় যাওয়া নিয়ে বাবা অথবা মা কখনই অমত করেন নাই । তবুও সাইকেলেই যেতাম । কারন যে একদম ছিল না তা কিন্তু নয় । সাইকেল চালানোটা নেশা হয়ে গিয়েছিলো । তার উপর স্যারের বাসার সামনেই ছিলো মেয়েদের স্কুল । অল্প বয়সে যা হয় আর কি । রোমিও টাইপ চিন্তাভাবনায় খোঁচায় অস্থির থাকতাম । মন পাখি উড়াউড়ি করতো ইতিউতি । বাস্তবতার খেই হারিয়ে কল্পার জগত্‍টাই অধিক বাস্তব মনে হতো ।

চুলে জেল , মুখে ফেসওয়াস আর হাতে কয়েক ডজন ব্রেসলেট পরে পাংখা স্টাইলে বের হতাম । শার্টের উপরের দিকে দুইটা বোতাম তো অবশ্যই খোলা থাকতো । চোখে সানগ্লাস থাকা চাই ই চাই । তবে এখানে একটা কথা আছে , ঐ ইংরেজ প্রদত্ত সানগ্লাস অথবা সূর্যকাচঁ নামক ফালতু কথাবার্তায় আমি বিশ্বাসি ছিলাম না । আমার চিন্তা হলো মানবীর মন জয় করতে সানগ্লাসের বিকল্প নেই । চাই কি রাতেও সানগ্লাস পরে থাকতে পারি । এবং থাকতামও ।

বাবা আমার এই কার্যকলাপ দেখে তখনও হাসতেন । আর মা রেগে মেগে একদম প্রেসার কুকার হয়ে যেতেন । একের পর এক আদেশ জারি করতেন । আর আমি ভাবতাম যে কিভাবে মায়ের এই ফরমায়েশ থেকে বেঁচে একটু শান্তির বাতাস গ্রহন করতে পারি । এই ব্যাপারটাতে আবার বাবার কোন জুড়ি নেই । মা কে তিনি বোঝাতেন আর আমাকে লাই দিয়েই যেতেন ।

তবে আমার এই পাংখাগিরি বেশিদিন স্থায়ী হলো না । প্রেমের রাজ্যে পৃথিবী যে ছ্যাঁকাময় আর পূর্নিমার চাঁদ যে সেখানে আইক্কা বাঁশ তা বুঝতে বেশিদিন সময় লাগে নি । ছ্যাঁকা খাইয়া জ্বর বাধিয়ে বসলাম । তখন আবার অপরিপক্ক মন শুধু ঐ মানবীকেই ভাবতো । আমার মা আমার সাথে ধর্মঘট শুরু করলেন , বড় ভাই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর বড় বোন শুরু করলো আমাকে পচাঁনোর ষড়যন্ত্র । তখন আমার পক্ষে মিত্র বাহিনী হিসেবে ছিলেন বাবা ।

(২)

আকাশটা গর্জে উঠলো ভীষনভাবে । আকাশ তার নীল রং হারিয়ে দ্রুত ধূসর কালো হয়ে যাচ্ছে । মাঝে মাঝে আকাশের এই অদ্ভুত আচরনে ব্যাখ্যা খুঁজে হয়রান হয়ে যাই । মনে হয় এতো দ্রুত কিভাবে পারে নিজেকে বদলে ফেলতে ? এতটাই কি সহজ ? হয়তো সহজ । মানুষও তো এভাবেই বদলে যায় ।

আমার মা টা ছিলো একদম ছোট্ট একটা মেয়ে । অন্তত আমার কাছে তাই মনে হতো । ছোট ছেলে হিসেবে এই মহিলা কি আমাকে একটু বেশিই আদর করতো নাকি একটু বেশিই শাষন তা বুঝতে অনেক সময় লেগেছিলো । অবশ্য ধারনাটা এখনো পরিষ্কার নয় । মায়ের কাছে আবদার করেছিলাম অনেক । তবে এই মহিলা খুব বেছে বেছে আবদারগুলো গ্রহন করতেন । তাই তার চেয়ে আমার বাপটাই ভালো । যা চাই তাই দেয় । বাবা ঠিক আমার অভিভাবক ছিলেন না , ছিলেন আমার বন্ধু ।

ভালই তো ছিলাম । প্রতিদিন সকালে উঠে আপুর সাথে খুনসুটি । অথবা ভাইয়ার বকাবকি । কিংবা মায়ের হাতের বানানো অমৃত খাওয়া । বাবার সাথে দুষ্টমি আর আমার সাইকেলটা নিয়ে মেয়েদের স্কুলের সামনে স্কিড করে ভাব নেওয়া ।

হটাত্‍ করেই যেনো সব ওলটপালট হয়ে গেলো । কিছু বুঝে উঠার আগেই আমাদের সুন্দর পৃথিবীটা তছনছ হয়ে গেলো । সব স্বপ্নগুলো কর্পূরের মতো উবে গেলো , আর সেখানে এসে বাসা বাঁধলো নিকষ কালো আঁধার । যে আঁধারের মাঝে প্রতিনিয়ত হাবুডুবু খাচ্ছি আমি । আলোর খোঁজে হন্য হয়ে দৌড়াদৌড়ি করছি , কিন্তু খুঁজে আর পাচ্ছি না । কষ্টগুলো দলা পাকিয়ে থাকে বুকের ভিতরে । গলা দিয়ে উঠে আসতে চায় । শ্বাস আটকে আসে আমার । বুক ব্যাথা করে । স্মৃতিগুলো দুঃস্বপ্ন হয়ে তাড়া করে আমাকে ।

শুরুটা হয়েছিলো আপুকে দিয়ে । পাড়ার একটা ছেলের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে যখন বিয়ে করে ফেলল তখন । আপুকে বাবা অনেক বেশিই আদর করতো । এই নিয়ে আমরা দুই ভাই হিংসায় মরে যেতাম । সেই আপু বাবাকে কিছু না বলে এহেন কাজ করেছে । আমার সদা হাস্যজ্বল বাবার মুখের হাসিটা ম্লান হতে হতে মিলিয়ে গিয়েছিলো । আর আমি অবাক হয়ে আপুর দিকে তাকিয়ে ছিলাম । বাবা আপুকে কিছুই বলেন নাই , এমনকি মা ও যখন তাকে বকতে গিয়েছিলেন ,তখন মা কেও বাবা ডেকে নিয়ে যায় । আপু কাঁদছিলো , আমার কষ্ট হচ্ছিলো বোধহয় বোনটার জন্য ।

আমাকে শুধু কয়েকটা প্রশ্ন করেছিলাম যে “কেনো করলে এটা আপু ? আমাদেরকে কিছু না জানিয়ে ? আমরা কি তোমার কেউ নই ?”

এই প্রশ্নগুলোর জবাব আপু দিতে পারে নি । আমি জানি সে মুখ তার নাই । কষ্ট লাগে এটা ভেবে যে যেই বাবা তাকে এতটা বছর এতো কষ্ট করে বড় করেছে , সেই বাবাকে সে এক চুটকিতে মাটিতে নামিয়ে এনেছে । তারপর বাধ্য হয়েই আপুকে ঘটা করে বিয়ে দেয় বাবা , হ্যা ঐ ছেলের সাথেই । তবে সবার মধ্যে ছিলো কষ্টের শীতলতা । অনেক ইচ্ছা ছিলো একমাত্র বোনটার বিয়েতে অনেক মজা করবো , অবাক হয়ে সেদিন দেখেছিলাম আমি পুরোপুরি শান্ত ছিলাম ।

বাবার হার্টের প্রবলেমটা সেখান থেকেই শুরু । সেটা চরম আকার ধারন করে ভাইয়ার কার্যকলাপে । বিয়ে হওয়ার পর ভাইয়া আমাদেরকে আর চিনতই না । আমাকে কারনে অকারনে খোঁটা দিত । যেটা করি নি সেটার জন্য বকা ঝকা এমনি গায়েও হাত তুলতো । কিছুই বলতাম না । তারপর একদিন ভাইয়া সবার সামনে বলল যে সে আর ভাবি আলাদা হয়ে যাচ্ছে ।

বাবা যেনো স্তব্ধ হয়ে গেলেন । আর মা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন ছেলের দিকে । যেই ছেলেকে দশ মাস ধরে গর্ভে লালন করেছেন । ভাইয়া কথাটা বলেই চলে যাচ্ছিলো । আমি দৌড়ে গিয়ে ভাইয়ার পা পর্যন্ত ধরেছি । সে একটা লাথি দিয়ে পা ছাড়িয়ে নেয় । আমার ঠোট ফেটে রক্ত বের হয়ে আসে । আমি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে দেখেছিলাম আমার ভাইয়ের কান্ড । এই ছেলে আমার ভাই না । নাহ, হতে পারেই না ।

বাবার বুক ব্যাথা শুরু করে । বাতাসের অভাবে হাঁসফাঁস করছিলেন তিনি । তাকে দ্রুত হসপিটালে নিয়ে যাই আমি । সবে ইন্টার পরিক্ষা দিয়েছি , কতোই বা বয়স ? সমস্ত দায় দায়িত্ব আমার ঘাড়ে এসে পরলো ।

বাবাকে আইসিইউতে ভর্তি করা হলো । অবস্থা খুব খারাপ ।

ডাক্তার যখন কোন আশার বাণীই শোনাচ্ছিলেন না , তখন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরলো । মা কে কিভাবে বলবো ? ভাইয়া , আপুকে ফোন দিলাম । কিন্তু তারা ধরে নি । আমার পাগলপ্রায় অবস্থা । মা কে অনেক বুঝিয়ে বাসায় রেখে এলাম । সেখানে বড় খালা আছেন , তাই মাকে নিয়ে টেনশন হয় না ।

হসপিটালে এসে বাবার বেডের সামনে বসেছিলাম । বাবার মুখটা অদ্ভুত শান্ত । মুখে অক্সিজেন মাস্ক আটকানো । আমার দুষ্টু বাবার ঐ হাসিটা কোথায় যেনো হারিয়ে গেছে । বুকটা ফাঁকা লাগছে । বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম । একটু পর একটা অস্পষ্ট কথার আওয়াজ শুনতে পেলাম ।

মুখ উঠিয়ে দেখি বাবা চোখ খুলে তাকিয়ে আছে আমার দিকে । তার চোখের দৃষ্টিতে পরম মমতা । কি যেনো বলতে চাচ্ছেন । তার মুখের কাছাকাছি ঝুকঁলাম । বাবা তার একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন । হাতটা শক্ত করে ধরলাম । বাবা অস্পষ্ট স্বরে বললেন “সামনে দেখে চলবা বাবা , তাহলে ভারসাম্য রাখতে সুবিধা হবে । মা কে দেখে রেখো ।” -“অবাক হয়ে দেখলাম , বাবা তার অক্সিজেন মাস্কটা অন্য হাতটা দিয়ে টেনে খুলে নিলো ।” তারপর আমার কপালে একটা চুমু দিতে চেষ্টা করলেন । কপাল ঝুঁকিয়ে তার ঠোটের কাছাকাছি নিয়ে গেলাম । বাবা আস্তে করে একটা চুমো দিলেন ।

আমি সোজা হলাম । বাবার মুখে ঐ স্নিগ্ধ হাসিটা আবার দেখতে পেলাম । আমার দুষ্টু বাবার চোখে গভীর মমতা । আমার দুষ্টু বাবা হটাত্‍ করেই ঘুমিয়ে গেলো চিরদিনের জন্য ।

তারপর পেরিয়ে গেছে ৪ টা বছর । হটাত্‍ করেই আজকে কেন যেনো কথাগুলো মনে পরলো । খেয়াল করলাম বাতাসের বেগ প্রচন্ড বেড়ে গেছে । তুমুল ঝড় হবে আজকে । ঘরের ভিতর থেকে মা ডাক দিলেন ভাত খাওয়ার জন্য । আমার বদরাগী মা আজকে কতো পরিবর্তিত হয়ে গেছে ! তিনি এখন কেমন যেন অসহায় হয়ে গেছেন । তার দৃষ্টিতে আগের মতো তেজ খুঁজে পাই না ।

বারান্দার এক কোনায় একটা ন্যাকড়া পরে ছিলো । ভাবলাম সাইকেলটাকে একটু মুছবো । কিন্তু মুছতে গিয়ে হাত থেমে গেলো । থাক না এভাবেই । কি দরকার নতুন করে আবার পুরোনোকে জাগিয়ে তোলার ? কি দরকার কষ্টের উপর জমে থাকা ধুলোগুলোকে ঝেড়ে আবার কষ্টটাকে নতুন করে ফুটিয়ে তোলার ?

আকাশে বিদ্যুত্‍ চমকাচ্ছে । এই আকাশের সাথে আমার একটা মিল আছে । আমার জীবনের আকাশেও মেঘের ঘনঘটা । পার্থক্য শুধু একটাই , পৃথিবীতে ঝড়ের পর রৌদ্র হাসে । আর আমার ক্ষেত্রে ঝড়ের মধ্যে রৌদ্র হাসে । তাও কদাকিন্চিত্‍ ।

আর ভাবতে ইচ্ছা করছে না । মাথায় সবকিছু তালগোল পাকিয়ে গেছে । আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম । গন্তব্য ডাইনিং রুম যেখানে আমার জন্য অপেক্ষায় আছেন এক অসহায় মানুষ ।

ধুলোয় চাপা পরা কষ্টগুলোর উপর আরো কয়েকমুঠ বালু চাপা দিয়ে এগিয়ে গেলাম আমি . . .

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত