অনুতাপ

অনুতাপ

মাথাটা প্রচন্ড ধরেছে, সারা শরীর তীব্র ব্যাথা! তার উপড় মাতলামী তো আছেই! বার বার বিছানা থেকে ঢলে পড়ে যাচ্ছে সাব্বির! নেশাটা ধরেছে বেশ বুঝায় যাচ্ছে। নেশার আধারে পাগলামী ও কম করেনি। ড্রিংসের পরিমান টা খুব বেশী হয়ে গেছে। বিপদের আভাস দেখে তাই আজ বাড়ী ফিরেনি সে। উঠছে তার পরম বন্ধুদের সাথে যারা এক সাথেই আজ ড্রিংসে ব্যস্ত ছিল! তার বন্ধুদের সাথে যোগ দিয়েছে সে। বর্তমানে তারা একটি এলাকার দু:ধর্ষ ক্যাডার বাহিনী। পেশাগত ভাবে তারা খুনের অর্ডার পর্যন্ত নেয়!!! এছাড়া ছোট খাট মারামারি, ছিনতাই, ইভটিজিং, মেয়েদের নিয়ে ব্যাবসা, রাজনীতিক প্রতিহিংসায় গুলাগুলি নিত্য ঘটনা। তাদের এই ক্ষমতার পিছনে আছে এক মন্ত্রির ছায়া। তাই দিন দিন গ্রুপটি চরম ভয়ংকর হয়ে উঠছে।
সাব্বির, এক রক্ষনশীল পরিবারের বড় সন্তান। ভদ্র, মেধাবী, সল্পভাষী। প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে তেমন কথা বলত না। ঘরে মা-বাবার সাথে আছে প্রিয় ছোট বোন নুসরাত। সুখী পরিবার। সাব্বির একটি পাবলিক ইউনিভার্সিটির ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়ে। ইলেকট্রিকাল এন্ড ইলেক্ট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং এ। সপ্ন দেখে বড় কিছু করার, চোখে মুখে সপ্ন ছিল তার। তার বাবা এক সরকারী চাকুরীজীবি! সপ্ন দেখতেন ছেলে কে নিয়ে! মা গৃহিনী, ছেলের প্রতি টেক কেয়ারের অভাব ছিল না। ছোট বোন, সদ্য এস.এস.সি পাশ করে ভাল একটি কলেজে ভর্তির অপেক্ষায় আছে। ফ্যামিলিতে কোন ধরনের অশান্তি নেই। বলা যায় এই শহরে তাদের পরিবারটি ছিল সব চেয়ে সুখি পরিবার।
কিন্তু একদিন এক রং নাম্বারের ফোন তার জীবনটা এলোমেলো করে দেয়। রাতের খাবার শেষ করে পড়তে বসেছে হঠাৎ একটি ফোন। ওপাশে সুকন্ঠী এক জন। ভুলে কল এসেছে। এক পর্যায়ে পরিচিয় হয় তার সাথে। তার নাম রিয়া, পড়ে দেশের নামকরা একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে। আরো মজার ব্যাপার তাদের লোকেশন খুব কাছাকাছি। তাই প্রতি রাতে তাদের আলাপটা জনতে লাগল। এভাবেই রিয়া নামের মেয়েটির প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে সাব্বির। এর পর আসে দেখা করার জন্য অনুরোধ। ঠিক হলো হাতির ঝিলে দেখা হবে তাদের। এজন্য রিয়া পড়বে টুকটুকে লাল থ্রি পিস জামা, আর সাব্বির পড়বে ডীপ ব্লু কালারের টি-শার্ট সাথে জিন্স। টাইম ঠিক করা হলো বিকাল ৫টায়।
নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত ড্রেস পড়ে হাজির হলো সাব্বির। তবে সে দুর থেকে পর্যবেক্ষন করার চেস্টা করবে। জীবনে এই প্রথম কোন মেয়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে সাব্বির। বরাবরের মতই মেয়েদের প্রতি অসম দুর্বলতা তার। তাই একধরনের সংকোচ বোধ তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। কেমন জানি লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়াত মত অবস্থা। লাল ড্রেসের কাউকে খুজছে তার অনুসন্ধানী চোখ! হঠাৎ এমন একজন কে চোখে পড়ল তার। কিন্তু এই কি সেই মেয়ে? জানার জন্য তার সেলে ফোন দিল !!! অদ্ভুদ, মেয়েটি ভ্যানেটি ব্যাগ থেকে তার সেল ফোন বাহির করছে। যতটা কল্পনা করেছে তার চাইতে বেশী সুন্দর। যেন আকাশ থেকে নেমে আসা কোন পরি!!!
-হ্যালো, তুমি কোথায়, দেখতে পাচ্ছি না কেন?
-খুজে দেখো।
-এত হেয়ালী করো না, সামনে আসো।
-দেখো, আমার ভয় করছে, আমি…. মানে….
-হয়েছে, আমি দেখেছি তোমায়, সামনে আসো…
সেই মুহুর্তটি যেন এক অদ্ভুদ শিহরন বয়ে গেল সাব্বিরের মনে প্রানে! এই প্রথম কোন মেয়ের চোখাচোখি হলো সে!!!
এর পর ঘুরাঘুরি, অনেক ভাল সময় কেটেছে তাদের। একদিন রিয়ায় তাকে প্রপোজ করে আর তাতে চোখ বন্ধ করে সাড়া দেয় সাব্বির। রিয়া কেমন জানি উগ্র ধরনের। মোবাইলে ফ্লেক্সি হতে শুরু করে, এটা ওটা নিয়ে খুব আগ্রহ তার। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে হওয়ায় সাব্বির রিয়ার অনেক কিছু পুরন করতে হিমসিম খেত! তার পরেও চেস্টা করত। এক সময় সাব্বির শুধু রিয়ার মনোযোগ পেতে প্রচুর খরচ করতে লাগল। ঘরে মিথ্যা বলে টাকা নিত, এর ওর কাছে ধার দেনা করে খুশি রাখত তার জীবনের প্রথম ভালবাসাকে। রিয়া কে সে তার সব কিছু দিয়ে ভালবাসে তাই অনেক নিচে পর্যন্ত নামতে হয়েছে তাকে। এভাবে প্রায় বছর খানেক চলল। ফ্যামিলি তে তার এই স্পস্ট পরিবর্তন লক্ষ্য করে তার বাবা। মায়ের চোখকে ফাকি দিতে পারেনি সে। এ নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করলেই খারাপ বিহেভ করত সে। একদিন সাব্বিরের ঘরে টেবিল এ বসে কি যেন খুজছিল তার ছোট বোন নুসরাত। কিন্তু সে কেন না বলে তার ঘরে ঢুকল এই নিয়ে তুলকালাম কান্ড ঘটাল সে!!! প্রচন্ড রাগের মাথায় সজোরে থাপ্পর মেরে বসে তার ছোটবোন কে!!!! নুসরাত কাঁদতে কাঁদতে তার রুমে চলে গেল। এদিকে হতাশায় আর অনুতাপে একেকের পর এক সিগারেট ধরাচ্ছে সাব্বির। হতাশাকে চাপা দেওয়ার চেস্টা!!! না এভাবে চলবে না, রিয়াকে আজকেই ফাইনাল ডিসিশান দিতে হবে। ওদের ফ্যামিলি তে বিয়ের প্রপোজাল পাঠাতে চায় সে। এই কয় দিন রিয়ার মতি গতি ভাল লাগছেনা তার। ফোন প্রায় সময় ওয়েটিং পাওয়া যায়। এই নিয়ে প্রতিদিন ঝগড়া হয় তাদের। আজ ফাইনাল ডিসিশান চাইবে সে। কিন্তু ফোন তো ঘন্টা খানেক ধরেই বিজি!!! রাগে গিজ গিজ করল সাব্বির, ফোন টা আছরে ফেলে দিল সে!!!
এর পর দিন রাতে সাব্বিরের ফোনে এক অপরিচিত ফোন কল….
-হ্যালো লাভার বয় মিস্টার সাব্বির!!! হাউ আর ইউ???
-কে বলছেন আপনি? আর লাভার বয় মানে??? হোয়াট ননসেন্স! হু আর ইউ???
– ও!!! এত রাগ করো কেন প্রেমিক! রিয়ার সাথে শুধু প্রেম করার জন্য অনুমতি ছিল, বিয়ের জন্য নয়!!! ইদানিং তুমি নাকি বিয়ের জন্য তোর জোর শুরু করেছ? কিন্তু আমি দু:খিত মিস্টার তোমার এই সপ্ন কোন দিন পুরন হবে না!!! গুড বাই মিস্টার লাভার বয়!!!!! হাহাহাহাহাহা….
-বাস্টার্ড!!!! হু আর ইউ!!! কথা বল! তুই কে??? কাপুরুষ কোথাকার!!!! ফোন টা রেখে দিল ওই পাশের আগন্তুক!!!
পাগলের মত হয়ে গেল সাব্বির!!! কি শুনছে এসব!!! তার মানে সে ট্র্যাপের শিকার!!! পাগলের মত আবার ফোন দিল রিয়ার নাম্বারে!!! কিন্তু ভেসে উঠল মেয়েলী কন্ঠে “দু:খিত এই মুহুর্তে মোবাইল সংযোগ দেওয়া….”
রাগে দু:খে সাব্বির পাগল হয়ে যাচ্ছে!!! সে এত দিন একটি ট্র্যাপের শিকার হয়েছিল! কিছুই বুঝেনি সে!!! মিথ্যা প্রেমের অভিনয়ে অনেক কিছু হারিয়েছে সে! টাকা পয়সা, দামী মোবাইল গিফট, শপিং, টাকা ধারের কথা বলে বিশাল অংকের টাকা নেওয়া!!!!! মাথায় যেন বাজ পড়ল তার!!! টলে পড়ল বিছানায়!!! জ্ঞান হারাল!!!…..
ঢাকা শহরে এরকম প্রতারনার শিকার হচ্ছে অসংখ্য যুবক! একটি প্রতারক চক্র সুন্দরী মেয়ে দের দিয়ে এই ধরনের ব্যবসা করে! এজন্য এই চক্রটি আগে থেকেই কারো পারসোনাল ডিটেইলস ইনফো নিয়ে থাকে। তার পর রং নাম্বারের দোহায় দিয়ে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে!!! এর পর হাতিয়ে নেয় টাকা পয়সা সহ অনেক কিছু! চক্রটি প্রতি নিয়ত পর্যবেক্ষনে রাখে তাদের টার্গেটকে!!! অনুসরন করে তাদের প্রতিটি মুহুর্ত!!! বিপদ দেখলেই এভাবেই তারা সরে পড়ে! এক টার্গেটের জন্য এক সীম ব্যাবহার করে প্রতারক চক্রটি!!!!
পরের দিন সকালে উঠে সাব্বির কাকে কি বলবে, কার কাছে সাহায্য চাইবে বুঝতে পারে না। ফোন দিল তার এক পুরান সহপাঠি কে। দেখা করে সমস্থ কথা বলল। তার বন্ধু একটি রাজনৈতিক দলের ক্যাডার। সাব্বির কে বুঝিয়ে বলল এই প্রতারক চক্রের ব্যাপারে কিছুই করা সম্ভব না। সাব্বির লজ্জায় কাউকে মুখ দেখাতে পারেনা! আস্তে আস্তে তার জীবনের এই চরম ভুলকে ভুলে যাওয়ার জন্য জড়িয়ে পড়ে তার বন্ধুর সাথে। আস্তে আস্তে নেশা, চাঁদাবাজি, ইভ টিজিং এ জড়িয়ে পড়ে সে! এটায় যেন তার পৃথিবী! প্রতিদিন রাস্তাঘাটে মেয়েদের উত্যক্ত করত সাব্বির! সাথে থাকত তার বখাটে বন্ধুরা!!! এভাবে দিন দিন নস্টের পথা পা বাড়াচ্ছে সে!!!
ইভ টিজিং সাব্বিরের এখন ডেইলি রুটিন!!! এক মেয়ে তাকে জীবনে চরম ধোকা দিয়েছে, তার সাজানো জীবন এলো মেলো করে দিয়েছে, তাই মেয়েদের প্রতি চরম ঘৃনা থেকেই সে বেছে নিয়েছে এই কাজটি। এখন এই কাজেই সে অনেক মজা পায়। ভাবে এক মেয়ে জীবন নস্ট করেছে, সে আরো দশ জনের জীবন নস্ট করবে। এভাবেই প্রতিদিন সাব্বিরের হাতে অনেক মেয়ে তার ইজ্জত হারাতো, ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করত না। বেপরোয়া হয়ে উঠে সে দিন দিন। অস্ত্র নিয়ে হাটে! জীবন তার কাছে তুচ্ছ এখন। ভুলে গেছে তার সাজানো বাগানের মত পরিবারের কথা, তার ভবিষ্যতের কথা, তার ক্যারিয়ারের কথা, তার বড় ইঞ্জিনিয়ার হওয়ায় সপ্নের কথা!!! তার আদরের ছোট বোনের কথা!
একদিন কলেজের সামনে সাব্বির দাড়িয়ে তার শিকারের অপেক্ষায় ছিল। একটি রিক্স্যায় এক সুন্দরী মেয়ের আগমন ঘটল! রিক্সা থামায় সাব্বির! মেয়েটি যে অসম্ভব সুন্দর তা তার চোখ দেখেই বোঝা যায়!!! মেয়েটি হিজাব পড়ে ছিল। তা খুলতে জোর করল সাব্বির। মেয়েটি অনুরোধ করছে, প্লিজ আমাকে যেতে দিন, আমার মুখ আপনি দেখবেন না প্লিজ!!! এই বলে অঝোরে কাঁদছে রিক্সায় বসা মেয়েটি!!! কান্না থামছেই না! যেন কেউ মারা গেছে!!!! কিছুটা থতমত খেলেও পরক্ষনে রিয়ার মুখ ভেসে উঠে সাব্বিরের ভাবনায়, রিয়া ও এরকম কান্না করত তাকে ম্যানেজ করতে!!! ক্রোধের আগুন ফুটে উঠে তার বুকে!!! কোন মায়া দয়া নেই তার, জোর করে মেয়েটির হিজাব টান দিল সে!!!
এর পর যা দেখল, তার জন্য প্রস্তুত ছিল না সাব্বির!!! নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছে না!!! এ যে….. তারই আদরের ছোট বোন নুসরাত!!!! অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে নুসরাত!!! ভাইয়া কি করলি তুই?? শেষ পর্যন্ত…..
সাব্বির পাথর হয়ে গেল! তার রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেল, যেন হীম হয়ে গেছে তার সারা দেহ! এ যেন জীবন্ত পাথর!!! বিস্ময়ের সীমা নেই তার চোখে। এ কি করলাম!!! সে তখনো তার ফিলিংস বুঝতে পারছে না, ঠিক যেমন কোন দুর্ঘটনায় শরীরের কোন ক্ষত ঠিক ওই মুহুর্তে বোঝা যায় না। তখনো কেঁদেয় চলেছে নুসরাত, রিক্সা চলে গেল, ঠায় দাড়িয়ে আছে সাব্বির!!! নড়ার ক্ষমতা টুকু হারিয়ে ফেলেছে সে!!!! বুকে ফেটে আর্তনাদ বের হয়ে আসছে তার, সারা শরীর যেন বিদ্রোহ করছে, চোখ ভেংগে জলের বাধের মত অস্রু আসছে তার তার চোখে!!!
আমার আর বেচে থাকার কোন অধিকার নেই! মনে মনে ভাবল সাব্বির! এ অশম যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পাওয়ার একটায় উপায় আছে, মৃত্যু!!!! কারন এই জগত যদি তাকে চরম শাস্তি ও দেয়, সে শাস্তি বিবেকের শাস্তির কাছে কিছুই নয়। তার বিবেক প্রতিনিয়ত তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে!!! কিছুতেই মুক্তি মিলছেনা তার। তার বিবেক তাকে প্রতি মুহুর্তে শাস্তি দিচ্ছে!!! তাই সিদ্ধান নিয়েই ফেলল সাব্বির!!! আত্ম হত্যায় এখন তার মুক্তি!!!! আর কোন পথ খোলা নেই!!!
আত্মহননের চেস্টা ব্যর্থ হয়ে যায় তার কাছের এক বন্ধুর বুদ্ধিমত্তার কারনে!!! এই যাত্রায় বেচে যায় সাব্বির, এর পর শরনাপন্ন হয় এক সাইক্রিয়েস্টিস্টের কাছে। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে জীবনটাকে আবারো রংগিন করে তোলার চেস্টা করে যায় সে!!
এর পর কি হয়েছিল তা জানা নেই! হয়ত সাব্বির তার সপ্ন পুরন করেছে, হয়ত ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে আবারো জীবন সংগ্রামে মন প্রান সপে দিয়েছে। তবে একটি ভুলে ভরা জীবনের সফল উপাখ্যান এখানে লক্ষ্যনীয়।
[বি:দ্র- গল্পের নাম এবং চরিত্রগুলো কাল্পনিক, বাস্তবে কারো সাথে মিল থাকা কাকতাল মাত্র ]

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত