হাফিজ সাহেব সিগারেট খান প্রায় ত্রিরিশ বছর। আর তাঁর একমাত্র ছেলে রেহান সিগারেট খায় ৪ বছর ধরে। প্রতিদিন একই দোকান হতে অফিস আর কলেজ যাওয়ার পথে বাপ-ছেলে একই ব্রান্ডের সিগারেট কিনে এক প্যাকেট করে। না একসাথে নয়। এমনিতে হাফিজ সাহেব একমাত্র ছেলেকে প্রচুর ভালোবাসে। তবে সিগারেট খাওয়ার কথা জানতে পারলে নির্গাত লঙ্কাকান্ড বাঁধিয়ে দিবেন।
এক্ষেত্রে দোকানদার মামারা বেশ বিশ্বাসী হয়। বাপের কাছে ছেলের সিগারেট খাওয়ার কথা লাগান না। তাঁদের কাছে সিগারেট বিক্রি হলো বড় কথা।
গত চার বছর ধরেই এক রোটিন চলছিল রেহানের তবে ঘটনাটা ঘটল গত শুক্রবার। সেদিন ছিল ওর বাবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। রেহান বাসা হতে বের হয়েই মামার দোকানে গিয়ে সিগারেট কিনল আর একটা সিগারেট ধরিয়ে সুখটান দিচ্ছিল। এমন সময় তাঁর বাবা কোথা হতে যেন এসে ঠিক তাঁর সামনে হাজির হয়ে গেলো। হাত হতে রেহান সিগারেট টা দ্রুত ফেলে দিলো ঠিকই কিন্তু মুখের ভিতরে রয়েছে ধোঁয়া। ওর বাবা কোন কথা না বলেই গাল বরাবর ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিলো। আর ধোঁয়াও ওর মুখ থেকে বের হয়ে গেলো। এতগুলো মানুষের সামনে মার খেয়ে লজ্জিত রেহান শুধু এতটুকুই বললো,
– Don’t make a scene আব্বু! আমরা বাসায় গিয়ে এই বিষয়ে কথা বলতে পারি।
[ রেহানের বাবা রেহানের হাত শক্ত করে ধরে বাসায় নিয়ে এলেন। তারপর ডাইনিং রুমের ভিতর তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে রেহানের মাকে ডাকলেন। রেহানের মাও ছুটে এলেন]
– দেখে যাও! তোমার গুনধর পুত্র কত বড় হয়ে গেছে! সে এখন সিগারেট খায়! তাও আবার যেই সেই সিগারেট না। একদম টপ ব্রান্ডের সিগারেট। এই হারামজাদা! কতদিন ধরে খাচ্ছিস বল! নয়তো তোর কপালে শনি আছে।
প্রতিদিন রাতে এই জন্যই খুশখুশ করে কাশিস। তারপরেও তোর হুশ হয়না তুই বিষ খাচ্ছিস? অকালে মরার এত শখ হারামজাদা!
[বলেই এক চড় বসিয়ে দিলেন রেহানের গালে। রেহানও বাবাকে ক্ষেপানোর জন্য মাথা নিচু করে বলল –
– তুমিও তো খাও! প্রতিদিন এক প্যাকেট! তোমার থেকেই শিখেছি!
এই কথা শোনার পর রেহানের বাবা রেহানকে আরও দুই তিনটা চড় মারলো কিন্তু ওর মা ওকে ছাড়িয়ে ওর রুমে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বুঝাতে লাগলো।
– এই হারামজাদা! আমি ইনকাম করি। তাই নিজের টাকায় খাই। তুই কয়টাকা ইনকাম করিসরে? হারামজাদা! আজ হতে তোর সব হাত খরচ বন্ধ! দেখি তুই কই টাকা পাস সিগারেট কেনার জন্য!
৩ দিন পর!
রেহানের বাসার পরিবেশ বেশ শান্ত! কিন্তু সেদিনের ঘটনার পর রেহানের উপর বেশ কড়া নজরধারী আরোপ করা হলো। রেহান বুঝতে পারলো না আসলে কিভাবে ওর বাবা ঘটনাটা জানতে পেরেছে? কেউতো নিশ্চয়ই বলেছে। রেহান ওর আম্মুর কাছ হতে জানতে পারে। ওর বাবাকে কথাটা বলেছে পাশের ফ্ল্যাটের নতুনভাড়াটিয়ার মেয়ে ফারিয়া! ও নাকি রেহানকে সিগারেট খেতে দেখেছে। দুইমাস হলো এই বাসায় এসেছে। মেয়েটি প্রায়ই ওদের বাসায় আসে এবং পরিবারের সবার সাথে বেশ খাতির করে ফেলেছে। বিশেষ করে রেহানের বাবা মেয়েটিকে খুব পছন্দ করে। রেহানতো রেগে মেগে এক হয়ে গেলো। সেও ভাবতে লাগলো কিভাবে মেয়েটির উপর প্রতিশোধ নেওয়া যায়।
রেহান ঐ বাসায় গোয়েন্দা লাগালো অন্য ফ্ল্যাটের ছোট বোনকে দিয়ে। যা জানতে পারলো ওদের পরিবার খুব ধার্মিক পরিবার! মেয়েটার বাবা কোরআনের হাফেজ একটা মসজিদে ইমামতি করেন। পুরো পরিবারকে খুব নিয়ম কানুনের উপর রাখেন। বাসায় কোন টেলিভিশন পর্যন্ত নেই মেয়েরা বখে যাবে বলে। অথচ ফারিয়া মেয়েটি বাবাকে না জানিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কোচিং পড়তে যাওয়ার কথা বলে গান শিখে।
রেহানও তাঁর প্রতিশোদের অস্ত্র পেয়ে গেলো। সেদিনই মাগরিবের নামাজ পড়ে আসার সময় ফারিয়ার বাবাকে রেহান সব বলে দিলো।
– আংকেল আপনাকে একটা কথা বলার ছিল!
বলো বাবা!
– মানে আংকেল! দেখলাম ফারিয়া গান শিখে বুলবুল স্যারের কাছে! উনার কাছে না দিয়ে রবি স্যারের কাছে দিতেন। উনি বেশ ভালো গান শিখায়! ওনার কাছ হতে শিখে কত ছেলে মেয়ে টিভি রেডিওতে গান গাচ্ছে [ একটু কৌশলে]
ইমাম সাহেব বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তিনি কোন কথার জবাব না দিয়ে বাসায় এসে সব জিজ্ঞেস করলেন! ফারিয়াও সত্য স্বীকার করলেন। ইমাম সাহেবও কোন কিছু না বলেই মেয়ের হাত ধরে দরজার বাহিরে ধাক্কা মেরে বের করে দিলেন। শুধু এতটুকু বললেন “তুমি এই বাসার আর এসোনা। এই বাসায় তোমার কেউ থাকেনা”।
রেহান সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে সবকিছু দেখলো। ফারিয়া মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে ছাদের দিকে গেলো। রেহানও তাঁর পিছুপিছু। ফারিয়া ছাদে রাখা দোলনায় বসে পা ঝুলিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে! কিছুক্ষন পর কান্না কান্না থামলো। চোখ মুছে দিয়ে সে গলা ছেড়ে একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে শুরু করলো। উফ! কি যে সুমিষ্ট কন্ঠ! রেহান মন্ত্রমুগ্ধের মত গান শুনতে লাগলো! একটা মানুষ এত সুন্দর করে কিভাবে গাইতে পারে? সে নিজের ভুল বুঝতে পারে। প্রতিশোধের বশে তাঁর ইমাম সাহেবকে কথাটা বলাটা ঠিক হয়নি।
রেহান সিগারেট ধরালো। তাঁর পা এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে চাইছে না। তাঁর পা এগোচ্ছে ফারিয়ার পাশে গিয়ে বসে গান শোনার জন্য! ফারিয়া গাইছে…
আমি, জেনে শুনে বিষ করেছি পান।
প্রাণের আশা ছেড়ে সঁপেছি প্রাণ।
যতই দেখি তারে ততই দহি,
আপন মনোজ্বালা নীরবে সহি,
তবু পারি নে দূরে যেতে, মরিতে আসি,
লই গো বুক পেতে অনল-বাণ।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক