জল ছায়া

জল ছায়া

কালচে রংয়ের কাঠের দরজাটা খুলেই টলতে টলতে নিজেকে সামলিয়ে সামনের দিকে আরো দু – পা এগিয়ে গেলাম। ইশ! আরেকটু হলেই ছোট্ট চড়ুই পাখির বাচ্চাটা পায়ের নিচে পিষে যেত।

রাতের জার্নির ধাক্কাটা এখনও যায়নি। ঢাকা থেকে সোজা পার্বত্য চট্টগ্রাম, রাত তিনটায় কোয়ার্টারে পৌঁছেছি। রাত তিনটা!

একটা মেয়ের জন্য খুব একটা ভালো না সাথে শাওন ছিল বলেই আসতে পেরেছি। ইদানিং সবকিছু পরিকল্পনা ছাড়াই হয়ে যাচ্ছে! আগে এমনটা ছিল না।

সবকিছুতেই বেশি বেশি আগ্রহ কাজ করছে।
কোনরকমে নাস্তা টা সেরে রুমে ঢুকে আবার দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমানোটা জরুরী হয়ে পড়েছে।
.
.
বিকেলের দিকে মা, রাগে গজগজ করতে করতে রুমে ঢুকে বললেন,
– তুই আর কখনও চশমা পরবি না মানসী। আমার জানা মতে তোর চোখে কোন সমস্যা নেই ।
চশমা পরলে তোকে বুড়ি বুড়ি লাগে।
– দেখছো তো মা বই পড়ছি। তাছাড়া আমার চশমা পরতে ভাল লাগছে। চশমাই তো পরেছি অন্যায় তো কিছু করিনি!
আর বুড়ি বুড়ি দেখালেও আমার তো কোন সমস্যা হচ্ছে না!
– তুই ওসব বুঝবি না। নিষেধ করেছি, ব্যাস আর পরবি না।
আমার হাতে হূমায়ূন আহমেদের “আমার আছে জল ” বইটা দেখে মা আরো রেগে গেলেন।
আজ পর্যন্ত এই বইটা যতবার হাতে নিয়েছি মা, কখনও সেটা পরতে দেননি। কেন দেননি সেই কারণ টাও জানিনা। যক্ষের ধনের মত লুকিয়ে রাখেন।

যেন আমি চোর! যে কোন মুহুর্তে তার এই বইটা আমি সরিয়ে ফেলতে পারি।
আমি অসম্ভব ভদ্র একটা মেয়ে এই কথাটা মা হয়ত বিশ্বাস করতে পারে না বা বিশ্বাস করতে চায় না।
– এই নাও তোমার বই আর চশমা, আলমারিতে তালা দিয়ে রাখো যাও।। ছাদে যাচ্ছি সন্ধ্যার আগে নামবো না। ডেকো না যেন।
এই…এ…মানসী ..শুনে যা ……
মা…ন…সী…
.
বাবা ছাদে বসে আরাম করে চা খাচ্ছিলেন। আমাকে দেখেই কাছে ডাকলেন। ভালোই হলো বাবাকে পেয়ে। মনে মনে বাবাকেই খুঁজছিলাম। গত দু রাত এক মুহুর্তের জন্যও ঘুমাতে পারিনি। শেষমেষ উপায় না দেখে শাওনকে নিয়েই আসতে হলো। ছেলেটাকে কেন জানিনা আমার পছন্দ না।মায়ের মত সবসময় নজরদারি করে। কারো নজরদারিতে থাকতে অপ্রস্তুত লাগে, নিজেকে মূল্যহীন মনে হয়।
-কি হয়েছে, মা? তোকে এমন অন্যমনস্ক লাগছে কেন!
– আচ্ছা বাবা আমার যদি একটা বেবি থাকতো তবে ভালো হতোনা??
আমার মুখে এমন প্রশ্ন শুনে বাবা প্রথমত চমকে উঠলেন কিন্তুু খুব কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে হাসতে শুরু করলেন।

হঠাৎ এমন ইচ্ছা কেন মা? তুই তো এমনি এমনি কিছু বলিসনা ! কোনকিছু লুকিয়ে রাখতে নেই, খুলে বলতো আমায় কি হয়েছে?
– আমি স্বপ্নে একটা বাচ্চাকে দেখেছি যে হুবহু আমার মত দেখতে। ভীষণ ইচ্ছা করছিল ওকে আদর করতে কিন্তুু পারছি না।

স্বপ্নটা বারবার এক জায়গায় এসেই ভেঙ্গে যাচ্ছে আমি কিছুতেই ওর কাছে যেতে পারছি না। পরপর দু রাত এমন হয়েছে।
কথা বলার সময় খেয়াল করলাম বাবা আরো বেশি চিন্তায় ডুবে যাচ্ছেন।
– কি হলো বাবা? কিছুতো বলো? মাকে বললে মা রাগ করবে, তুমিও চুপ করে থাকলে আমিতো পুরো মানসিক রোগী হয়ে যাব।
-তুই মিছেই স্বপ্নটেকে গুরত্ব দিচ্ছিস মানসী মা, বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করছিস বলে এমন হচ্ছে।
আমরা সারাদিন সেসব নিয়ে ভাবি বা করি আমাদের অবচেতন মন সেগুলোকে স্মৃতি করে রাখে পরবর্তীতে স্বপ্নের মাধ্যমে সেগুলোর অনেক কিছুই দেখতে পাই।

তোর থিসিসের কতদূর কি হলো? শাওন ছেলেটাকেও তো অনেক অপেক্ষা করালাম। সে তো বিয়ের জন্য তাগাদা দিচ্ছে ..
– কি জানি! হবে হয়ত। দিনদিন বোধয় ইনসোমিয়ার রোগী হয়ে যাচ্ছি।
বলেই সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত নিচে নেমে আসলাম। শুধু বাচ্চা না সাথে আরেক জনকেও দেখেছি অস্পষ্ট ভাবে।

মাঝেমাঝে মাথায় খুব যন্ত্রণা হয় যখন আমার মস্তিষ্ক সেই অস্পষ্ট চেহারার মানুষটার সাথে বাস্তবে কাউকে খুঁজে বেড়ায়। বাবাকে সেকথা আর বলা হলো না।
.
.
-এই দিদি …দিদি ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস?
পিহু ডাকছে পেছন থাকে। পিহু আমার বোন আর মায়ের স্পাই।রাত বারোটা বেজে এক মিনিট, উদ্যেশ্য ছিল ছাদে যাব।

রাতের আকাশটা ভীষণ ভালো লাগে নিজের মত করে সবকিছুকে ভাবা যায়। সে সব চিন্তা ভেস্তে দিল পিহুটা। মন চাচ্ছে আচ্ছা করে একটা চড় লাগাই। কিন্তুু তাকে মারা যাবেনা।

রাগ সংবরণ করে মায়া মায়া করে বললাম,
– পিহু, লক্ষী বোনটা আমার চল দুবোন মিলে জমিয়ে গল্প করি?
পিহু যেতে রাজি হলোনা। শুধু বললো “বেশি রাত জাগিস না দিদি ” মাথা ব্যথাটা বেড়ে যাবে। ”
মেয়েটা ইদানীং বুদ্ধি করে কথা বলছে। আমার ইচ্ছা পিহুটা সারাজীবন ছোট থাকুক আর আমি ইচ্ছেমত ওর পাকা পাকা কথাগুলো বিরক্ত হলেও শুনতে থাকি।
ছাদে যাওয়ার প্ল্যান বাদ দিয়ে বাবার পড়ার রুমে ঢুকলাম। বাবাকে এখানে পাওয়ার ক্ষীণ আশা আছে।
পড়ার রুমে বাবাকে পাওয়া গেল না। সেলফ থেকে বই খুঁজতে গিয়ে বাবার ডাইরিটা চোখে পরলো। দেখবোনা দেখবোনা করেও হাতে তুলে নিলাম।

অন্যের ডাইরি পড়া অভদ্রতা কিন্তুু এই অভদ্রতামি আগেও কয়েকবার করেছি। লুকিয়ে লুকিয়ে ডাইরি পড়া আমার অভ্যাসে মিশে গেছে।
.
.
বাবা লিখেছেন —
“”মানসীটা আর কিছুদিন পরে মাধ্যমিক দিবে ভাবতেও ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে এইতো কিছুদিন আগেই ওর মায়ের কাছে ওকে উপহার দিয়েছিলাম।

আমাদের প্রথম সন্তান মৃত জন্মেছিল, রেবা আমার স্ত্রী সেও ভীষণ অসুস্থ ছিল। সেই হাসপাতালেই মানসী জন্মেছিল। ওর বাবা মায়ের কোন খোঁজ ছিলনা।

ফেলে গিয়েছিল হাসপাতালের মেঝেতেই। ফেলে গিয়েছিল বলেই তো রেবার কোলে মানসীকে তুলে দিতে পেরেছিলাম।। না হলে হয়ত!! …”
.
“পিহুকে পড়ানোর জন্য নতুন টিচার রেখেছি। ছেলেটা আমাদের চিলেকোঠার ঘরেই থাকে। গ্রাম থেকে এসেছে এখনও বাসা পায়নি,

তাই বাড়িতেই থাকতে দিয়েছি যদিও বর্তমান যুগে এটা একদমই ঠিক করিনি। শুধু মানবিকতার খাতিরে কিছু বলতে পারছি না। ”
.
“ছেলেটাকে নিয়ে মানসীর মা শঙ্কায় ছিল আমি প্রথমে পাত্তা দেইনি সেসবে কিন্তুু …!! কিন্তুু মেয়েটা শেষ পর্যন্ত কিশোরী বয়সের ভুলটা করেই ফেললো।

ছোটখাটো ভুল না মারাত্নক ভুল! “”
.
.
মাথাটা ঝিমঝিম করছে আর পড়তে পারছি না। বাইরে থেকে মা আর পিহুর গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি, কোনকিছু নিয়ে তর্কাতর্কি করছে মনেহয়।

আমি আয়নার সামনে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে শুধু একবার নিজেকে চিনতে চেষ্টা করলাম।

শকুন যেমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছোঁ মেরে শিকার ছিনিয়ে নেয় আমিও তেমন করে পিহুুর হাত থেকে বইটা নিয়ে নিয়ে নিলাম। মা এবার আরো বেশি রেগে গেলেন।

আমার সেসবে ভূক্ষেপ নেই। আমার সমস্ত আগ্রহ এখন বইটিকে ঘিরে,,
বইটার শেষ পৃষ্ঠায় বড় বড় হরফে লেখা ছিল —
“”প্রিয় মানসী,
আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকী তে তোমার জন্য ছোট্ট উপহার, তোমার প্রিয় বইটা। আর শোন আমাদের মেয়ের নাম অবশ্যই ‘মহী’রাখবে। ”
—মৃন্ময়—”
.
মৃন্ময় নামের মানুষটাকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করছি। তার সাথে আমার সম্পর্কটা এখন পরিষ্কার শুধু তার চেহারাটা এখনও অস্পষ্ট।

আমার স্মৃতির কোথাও মাধ্যমিকের সেই সময়গুলো খুঁজে পেলাম না।
কিছুদিন আগে তাও বছর পাঁচেক হবে, আমার নামে একটা পার্সেল এসেছিল।মৃন্ময় নামেরই কেউ একজন পাঠিয়েছিল। আমি সেটা মায়ের কাছে দিয়েছিলাম। তবে কি এই সেই মৃন্ময়!!!!!!
নাহ, কিছু ভাবতে পারছি না আর। মৃন্ময়, মহী কাউকে না, কাউকে মনে পরছে না!
.
.
দুদিন পরে জ্ঞান ফিরল আমার। হাতের ব্যান্ডজ টা দেখে বুঝলাম সেদিন রাতে কিছু একটা ঘটিয়েছি। মা পাশেই বসা ছিল।

পিহুটা চশমার ফাঁক দিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। ইশারা করে মাকে কাছে ডেকে কথা বলতে চাইলাম। মা পিহুকে বাইরে যেতে বলে দরজা লাগিয়ে দিলেন।
মা বললেন–
– শাওন ভালো ছেলে, সে তোমার অতীত জেনেও রাজি হয়েছে। আমরা আর দেরী করতে চাইছি না।
আমি জোর গলায় বললাম “মা, মহীকে আমি দেখতে চাই।
মা এবারও বললেন মহী বলে কেউ নেই। আমি প্রায় পাগলের মত বলে উঠলাম -মিথ্যা বলোনা মা! মহী আছে, মহী আছে মা সে আমার মেয়ে।

পিহু আমাকে সব বলেছে।মায়ের চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে এতক্ষণে। আবারও বললাম —
– মৃন্ময়কে কেন তাড়িয়েছিলে মা?? সে কোথায় আছে জানো তুমি? প্লিজ মা শুধু একটাবার মহীকে আমার কাছে এনে দাও??
মায়ের দয়া হলো আমার কথায়। পরেরদিন মহীকে বাড়িতে আনা হলো। আমি প্রথমবারের মত আমার মেয়েকে দেখতে পেয়েছি। ঠিক স্বপ্নে দেখা মুখটার মতই।
.
এই ক দিনেই মেয়ের সাথে আমার ভাব হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম ওর একটু কষ্ট হচ্ছিল হয়ত। মায়ের আদর মেয়েটা পায়নি এতদিন।

মা, বলে কেউ আছে সেটাও হয়ত জানতো না। পিহুর কাছে ভীষণ ঋণী হয়ে থাকব, ও ছিল বলেই সব সম্ভব হয়েছে …
বাবার কাছে গিয়ে বাবাকে বললাম —
মা বিয়ের জন্য তোড়জোড় করছেন,তিনি তার মেয়েকে সুখি দেখতে চান। কিন্তুু মা জানেনা আমার সুখটা ঠিক কোথায়। আমার সুখ আমার পৃথিবী এখন সবটাই আমার মেয়ে মহীকে ঘিরে।

আমি চাইনা সেও আমার মত করে বেড়ে উঠুক।আমি আর আমার মেয়ে নিশ্চই তোমাদের কাছে বোঝা হয়ে যাবনা??
শাওন কে বলে দিয়েছি আমি তাকে বিয়ে করতে পারব না। আমার কোন দায়বদ্ধতা ছিল না তবুও বলেছি। ক্ষমা ও চেয়ে নিয়েছি।
বাবা আমাকে থামিয়ে দিলেন,
– তোর মত করে বেড়ে উঠবে বলতে কি বুঝাতে চাইছিস মানসী??
-বাবা, তোমার কিছুই অজানা নয়। মা জানেনা আমি তার গর্ভজাত সন্তান নই, তুমি মাকে বুঝতে দাওনি, আমাকেও না। আমি আর পিহুর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই তোমার কাছে।

শাওন হয়ত তোমার মত হবেনা। সেই বিশ্বাস আমার ওর ওপরে নেই।প্লিজ বাবা মাকে তুমি বোঝাও। মা তোমার কথা ফেলতে পারবেনা।
.
বাবার চোখে কয়েক ফোটা জল চিকচিক করছে। মেয়ে হিসেবে এটা আমার চরম ব্যর্থতা। তবুও আজ আমার দ্বিতীয় কোন পথ খোলা নেই।বাবা উঠে রুমে চলে গেলেন।
আমার বিশ্বাস বাবা ঠিক আমার কথাগুলো বুঝতে পারবেন।
.
আমি মহীকে নিয়ে ছাদেই বসে রইলাম। সে আমার হাত দুটো শক্ত করে ধরে রেখেছে। জ্যোৎস্নার রুপালি আলো মহীর নিস্পাপ মুখ জুরে ঠাওরে পরছে। বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেছে।

চাঁদের আলোয় বৃষ্টির জলে, আমার অস্পষ্ট স্মৃতিতে মৃন্ময়ের মুখটা খোঁজর চেষ্টা করছি।

সে হয়ত জলের ছায়া হয়েই কোথাও মিশে আছে……….

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত