লুকায়িত চোখের জল

লুকায়িত চোখের জল

নির্জন পুকুর পাড়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন রাতের বেলায় বাঁশের তৈরি মাছায় বসে আছি একা। মাঝে মাঝে হাকলা বাতাসে নারকেলের পাতা নড়াচড়ার শব্দ ভেসে আসছে কানে।

ঝোপঝাড়ে জোনাকিপোকা হালকা হলুদ রঙের আলোর রঙ ছড়িয়ে দিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। দূরের আকাশে কালো মেঘের ফাঁকে মাঝে মাঝে গুটিকয়েক তারার আলোকরশ্মি দেখা যায়। আবার হঠাৎ করে ঘনকালো মেঘের আড়ালে সব তারা লুকিয়ে যায়। মনোমুগ্ধকর এই পরিবেশে বিষন্নতার গ্লানি নিয়ে আকাশ প্রাণে চেয়ে আছি চুপিসারে।

চোখের কোণে হালকা পানি বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে হারানো সেই দিনগুলোর কথা।
.
সব কিছুই তো ঠিক ছিলো। কেনই বা আচমকা সব পাল্টে গেল? হারিয়ে গেল মুখের হাসি। নিজের অযোগ্যতা আজ নিজের সামনে প্রাচীর হয়ে দাড়িয়ে আছে।

না পারছি এই প্রাচীর ভেঙ্গে সামনে অগ্রসর হতে না পারছি নিজের অতীতে ফিরে যেতে। ব্যর্থতার এই গ্লানি আমার পুরো মনটাকে আস্তে আস্তে জ্বালিয়ে শেষ করে দিচ্ছে।

ভাবতেই চোখের কোণে জলরাশির একধারা প্রবাহিত শুরু করে। যে জলরাশি একবার বয়ে গেলে যা সহজে বন্ধ হতে চায় না। হতাশার এক অমলিন ইতিহাস আমার পুরো জীবন।
.
বেশ কিছুদিন ধরে অতিবৃষ্টি শুরু হয়েছে। থামার কোনো লক্ষনও দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর পর থমকে থমকে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির মাঝে ঝড়ো বাতাসের বেগও বাড়ছে প্রতিনিয়ত।

বাতাসের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে গ্রীষ্মকালে কালবৈশাখী ঝড়ের আগমন। ঝড়ো বাতাস আর বৃষ্টির কারণে মানুষ পড়েছে বিপাকে। রাস্তাঘাট ডুবুডুবু প্রায়।

মানুষের চলাফেরায় ভীষণ অসুবিধা দেখা দিয়েছে। গাড়িঘোড়াও তেমন চলাচল করতে পারছে না। কিছু কিছু মানুষ পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে রাস্তা নামতে হচ্ছে।

এই সময়টা মধ্যবিত্তদের জন্য জীবিকা নির্বাহের জন্য খোরাকি জোগাড় করা খুবই দুষ্কর।
.
মধ্যবিত্ত পরিবারের আমিও তেমন শিক্ষিত বেকার সন্তান। বহু চেষ্টা করেও একটা ভালো চাকরির সন্ধান পাইনি। যেসব চাকরি পাই স্বল্প বেতনের। যা দিয়ে একটা পরিবার চলা খুবই কষ্টকর। পরিবারের পুরো চাকাটা ঘুরে বাবার সামান্য চাকরিটার বেতন দিয়েই। অনেক কষ্ট করে তারা আমাকে পড়ালেখা করিয়েছে অথচ আমি এই পড়ালেখা নিয়ে রাস্তা রাস্তা ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে।

বড় কোনো চাকরির জন্য গেলে সেখানেও মামা খালু না থাকলে সে চাকরি হয় না। ঘুষ না দিলে তো চাকরিটা আশাই করা যায় না।

এমন বৃষ্টিতে বাবার চাকরিতে যাওয়া আসাটা অনেক কষ্টকর হয়ে উঠেছে। তবুও সংসারের মূল চাবিকাঠি তো বাবাই কষ্ট হলেও না গিয়েও পারছেন না।
.
কিছুদিন আগে যখন ভাত খেতে বসলাম। বাবা তখন কাজ থেকে ফিরেছেন। আমাকে খেতে দেখে বাবা বললেন।
“লজ্জা করে না এতো বড় হয়েছিস এখনো বাবা কাধে বসে বসে খেতে। তোকে পড়ালেখা করিয়ে তো দু’পয়সারও লাভ হচ্ছে না। এই বুড়ো বয়সেও কাজ করতে হচ্ছে”
বাবা মাঝে মাঝেই এগুলো বলে থাকে। কিন্তু তখন এতটা কষ্ট লাগতো না। আজকে কষ্ট লাগার কারণ খাওয়ার মধ্যেই খাওয়ার কথা বললেন। আধ খাওয়া রেখে উঠে গেলাম।

মা পুরোটা খাওয়ার জন্য ডেকেছিলেন।
.
সকাল হতেই বের হয়ে পড়লাম কাজের সন্ধানে। ছোট একটা কাজ পেয়েও গেলাম। দিন দেশে ২৫০ টাকা দিবে। সেই সাথে দুপুরের খাওয়াও ফ্রি।

কাজটা আমার জন্য বেমানান হলেও অসময়ে এমন কাজ পাওয়াও খুব কষ্টের। হোটেল বয়ের কাজ পেলাম। সপ্তাহখানেক বাড়ির চৌকাঠ মারাইনি। আর এ কয়দিনে বেশ কিছু টাকাও জমেছে। হোটেল মালিকের কাছ থেকে একদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি এসে দেখি বাবা অসুস্থ হয়ে বিচানায় শুয়ে আছে। মা আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন।

মায়ের এমন কান্না দেখে কিছু বুঝতেছিলাম না। মাকে জিজ্ঞেস করলাম।
“বাবার কী হয়েছে?”
মা নিশ্চুপ কোনো কথা ছাড়াই কেঁদে চলেছেন। মায়ের কান্নার কোনো কিছুই আমার মাথা ঢুকতেছে না। মাকে আবারও জিজ্ঞেস করলাম।
“কি হয়েছে বাবার? বলো না কেন?”
মা জবাব দিলেন…
“সেদিন তুই বের হয়ে যাওয়ার পর তোর বাবা তোকে অনেক খুঁজেছে কিন্তু পায়নি। টেনশনে তিনি স্ট্রোক করেছেন”
.
মায়ের কথা শুনে অনবরত চোখে দিয়ে অশ্রু বের হতে লাগলো। আমার এমন করে বের হয়ে যাওয়াটা ঠিক হয়নি।

যে কয়টা টাকা জমেছিলো তা দিয়ে বাবার ওষুধপত্র কিনে দিয়ে পরেরদিন আবার হোটেল ফিরে আসলাম। মাকে বলিনি কি কাজ পেয়েছি। শুধু বলেছি একটা কাজ পেয়েছি তা করতেছি।

কিন্তু আমার কপালে এ কাজটাও বেশিদিন টিকলো না। হোটেলে আসার তিনদিন না যেতেই পর পর দু’দিন দুইটা জিনিস ভেঙ্গে ফেলেছি।

প্রথম দিন প্লেট ধুয়ে আনার সময় হাত থেকে ফসকে গিয়ে প্লেট ভেঙ্গে যায়। এরপরের দিন একজনের সাথে ধাক্কা লেগে হাত থেকে চায়ের কাপ চা সহ পড়ে ভেঙ্গে যায়।

সেদিনই কাজটা হাত ছাড়া হয়ে গেল। কাপ প্লেটের জরিমানা দিয়ে বাড়িতে চলে আসতে হলো। আবারও বেকার হয়ে গেলাম। বাবাও মোটামুটি সুস্থ হয়ে গেছেন। আমাকে বললেন।
“তুই ছোট থেকে তোকে আর তোকে মাকে খাওয়াতে পেরেছি, এখনোও খাওয়াতে পারবো তোকে কোনো কাজ করতে হবে না”
.
আমি জানি বাবা কথাটা আক্ষেপ করে বলেছেন তাই আমি কাজ খুঁজতে প্রতিদিন বের হই। চাকরি খুঁজতে বের হয়ে চাকরির কোনো সন্ধান না পেয়ে প্রায়শ…………

একটা উন্মুক্ত পার্কের বেঞ্চিতে বসে থাকতাম। চার পাশের মানুষগুলো কি করছে তার কোনো খেয়ালই আমার থাকতো না।

মাঝে মাঝে নিজের এমন ব্যর্থতার কথা চিন্তা করেই চিন্তা শেষে হতাশার এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে পার্ক ত্যাগ করে বাসায় ফিরে আসতাম।
.
দিনশেষে বাবা কাজ করে ক্লান্ত হয়ে বাড়িতে ফিরে এসে দেখতেন হয়ত আমি মাথায় হাত দিয়ে শুয়ে আছি নাহয় হাতের মোবাইল টিপতেছি।

মাথায় হাত দিয়ে শুয়ে থাকতে দেখলে বলতেন, “কিরে কি হয়েছে? কিসের চিন্তা করতেছিস? মাথায় হাত দিয়ে শুয়ে আছিস কেন?” আমি প্রতি উত্তরে বলতাম, “কিছু না বাবা এমনিতেই।”

এরপর বাবা কিছু বলতেন না, খেয়েছি কিনা জিজ্ঞেস করতেন, না খেলে বলতেন, “খেতে আয়” বাবা হয়ত আমার মাথা হাত দিয়ে শুয়ে থাকার কারণটা বুঝতে পারতেন।

তাই হয়ত কোনো কথা আর বলতেন না।
.
সারাদিন চাকরির জন্য ঘুরেছি কিন্তু কোনো চাকরি পায়নি। পত্রিকার বিজ্ঞাপন দেয়া থেকে শুরু করে দেয়ালে পোস্টারিং এর বিজ্ঞাপনের চাকরি গুলোতেও চেষ্টা করেছি।

যেগুলো আমার পছন্দ হয় সেগুলোতে ঘুষ লাগে আর যেগুলো বাধ্য হয়ে করবো ভাবি সেগুলোতে বেতন খুবই স্বল্প।

কোলের মধ্যে পড়ালেখা নামক জিনিসের কিছু সার্টিফিকেট নিয়ে পার্কের বেঞ্চিতে বসে আছি অনেক্ষণ। হঠাৎ কোথা থেকে এসে একটা মেয়ে এসে পাশে বসলো।

আর আমাকে বললো, “আপনার সাথে কথা বলতে পারি?” মেয়েটিকে আমি আগে কখনো দেখিনি, তাই চিনিও না। কি বলতে চায় তা শুনার জন্য বললাম,
.
– জ্বি কি বলবেন বলুন?
– আপনি এখানে চুপচাপ হয়ে বসে থাকেস কেন?
– কেন?
– কিছু না, আমি প্রায়ই দেখি আপনি এখানে এসে চুপ চাপ বসে থাকেন।
– ওহ, এমনিতেই বসে থাকি। জায়গাটা খুব ভালো লাগে তাই।
– ও, আপনার হাতে এটা কি?
– কিছু না, পড়ালেখার কাগজপত্র।
– চাকরি খুঁজছেন?
– হুম, কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিন্তে পারলাম না।
– আমাকে আপনি চিনবেন না। আমিও আপনাকে চিনি না। এখানে আমি প্রতিদিনই আসি। আর বললাম না প্রায়ই আপনাকে এখানে দেখি।

তাই কৌতূহল জাগলো আপনার নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকার কারণটা জানতে।
– ওহ।
– আচ্ছা ভালো থাকবেন।
.
মেয়েটি চলে গেল। আমি বাড়িতে চলে আসলাম। এরপর প্রায় প্রতিদিনই মেয়েটা আমার সাথে কথা বলতো আমিও বলতাম।

আস্তে আস্তে আমাদের মধ্যে ভালোলাগা শুরু হলো তারপর ভালোবাসা। মেয়েটির নাম ছিলো অরিন। অরিনের সাথে পরিচয়ের কিছুদিন পরই বৃষ্টির শুরু হয় যা থামছিলো না।

বাবা কাজ থেকে রিক্সা করে বাড়ি ফিরতেছিলেন। বৃষ্টির কারণে রাস্তায় বেশ পানি জমে গেছে। যার কারণে রাস্তা ঘোলাটে পানিতে দেখা যেত না।

রিকশাচালক অনুমান করেই রিক্সা চালাতো। হঠাৎ করেই রিক্সার পিছনের এক চাকা বড় গর্তে পড়ে যায়। বাবা ধরে রাখার সত্বেও রিক্সা থেকে পড়ে যায়। আর মাথায় প্রচন্ড আঘাতও পান। বাবাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো। হসপিটালের ডাক্টার বাবাকে মৃত ঘোষণা করলেন। ডাক্টার বললেন বাবা ভয় পেয়ে স্ট্রোক করে সেখানেই মারা গেছেন।
.
আমি করবো বুঝতেছিলাম না। এমন একটা ঝড় আমাদের পরিবারের উপর দিয়ে যাবে ভাবতেও পারিনি। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কি করবো।

বাবার দাফন কাপনের কাজ শেষে বাবা যেখানে কাজ করতেন সেখানের মালিক বললেন আমাকেও বাবার কাজটা যেন করি তাহলে পরিবারটা চালাতে পারবো।

কথায় আছে অভাব আসলে ভালোবাসাও জানালা দিয়ে পালায়। বাবার মারা যাওয়ার কয়েকদিন পর অরিন এসে আমাকে বলল,

“বাবা আমাকে বিয়ের জন্য জোর করতেছে তুমি একটা কিছু করো” আমি কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তাই চুপ করে ছিলাম।

আমার নীরবতা দেখে অরিন বললো, “তুমি আমার বাবার সাথে গিয়ে কথা বলো” আমি হ্যাঁ, না কোনো উত্তর দিলাম না।
.
তারপর অরিন চলে গেল। আমি অরিনের বাবার সাথে কথা বলতে গেলাম। অরিনের বাবা আমাকে বললেন,
“তুমি শিক্ষিত, কিন্তু তুমি বেকার। আমার মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে তুমি কি খাওয়াবে? কি পড়াবে?

আমি তো জেনে শুনে কোনো বেকার ছেলের কাছে আমার মেয়েকে বিয়ে দিতে পারবো না। আমি আমার মেয়েকে উপযুক্ত ছেলের হাতেই তুলে দিতে চাই”
.
কিছুদিন পর শুনলাম অরিনের অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেছে। কোনো কিছু ভেবে না পেয়ে সিন্ধান্ত নিলাম। এ পৃথিবীতে আমার মতো বোঝা থাকার চেয়ে না থাকাই তো ভালো।

কিন্তু আত্মহত্যা করতে গিয়েও আত্মহত্যা করতে পারিনি। আমার বিবেক আমাকে বাধা দিলো, আর বলে,
“তুই মরে গেলেই কি সব সমাধান হয়ে যাবে? তোর বাবা না হয় দূরঘটনা প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু তোর মা তো এখনো বেঁচে আছে।

তাকে একা রেখে তুই স্বার্থপরের মতো পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চাস? তোর মায়ের কি তোর উপর কোনো অধিকার নেই?”
তারপর আর আত্মহত্যা করার চেষ্টা করিনি। মাঝে মাঝে অতীত খুব মনে পড়ে।

আর তখন সবার আড়ালে থেকে চোখের অশ্রু ফেলানো ছাড়া কোনো কিছুই করার থাকে না।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত