না পাওয়া সময়ের গল্প

না পাওয়া সময়ের গল্প

“”অনু””!! দুটো অক্ষর! একটা নাম! কোন একটা বাস্তব মানুষকে নিয়ে অাকাঁ আমার একটা কাল্পনিক চরিত্র।
যাকে আকড়ে ধরে রচিত হয়েছে অনেকগুলো গল্প। কয়েকটা বদলানোর, আর কয়েকটা বদলে যাওয়ার। কিছু অভিমানের, আর কিছু প্রেমে পড়ার।

কিছু কাঁদানোর আর কিছু নীরব বোবাকান্নার।
.
একরাশ অভিমান জমানো ফর্সা লালচে মুখ, নীল পাড়ের শাড়ী।
হাতে কয়েকটা কদম ফুল, চুলে বেলী ফুলের মালা, পেন্সিল হিল জুতো পায়ে শরতের ঝকঝকে বিকেলের রোদ ডিঙ্গিয়ে সুখসাগরের রাস্তায় হেটে চলা,, হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যাওয়া।

আমি ধরিনি বলে পিঠের মধ্যে ঠাস! ঠাস! শব্দ। অল্প কিছু দুষ্টুমি, বিনিময়ে উপহার পাওয়া দু’টো কিল, খুনসুটি, হেড়ে গলার গান, মুগ্ধ কন্ঠে উপহার দেয়া দুর্বা ঘাসের ফুল।
.
খুব করে শুনতে চাওয়া রাগকুমারী ডাক। দুটো কাটার ঘড়ি, যেটার একটা কাটা কেনার সময়ই ভাঙ্গা ছিল। তিনবিঘা করিডরের ছবি তোলার সেই গল্প।
ডালিয়া ব্যারেজের পিকনিকে পরোটা নিয়ে কাড়াকাড়িতে আমার হাতটা কেটে যাওয়া। আর ওপাশে অন্য দু’টো চোখে একটু জলের অস্তিত্ব।
.
কখনো সখনো, সিটি পার্কের পাশ হেটে চলা, পূনর্ভবার তীর, কালীঘাটের বড় মন্দিরের পুজোর প্রসাদ। কেকাপ্পার মত নুডলস নিয়ে মাতামাতি।

পুডিং বানাতে গিয়ে চিনির বদলে দু’ দু’বার লবণ দিয়ে অখাদ্য বানানো, আর সেই নিয়ে রেগেমেগে একাকার অবস্থা, কোন এক সন্ধ্যায় টাউন হলের ভুতের ভয়ে কান্না করার গল্প।
.
রাতের আধারে কোণ আইস্ক্রীম নিয়ে পাগলামি, বৃষ্টিবিলাসের কিছু স্বপ্ন।
বি আর টি সির টিকিট হারিয়ে ফেলার এক টুকরো স্মৃতি।
.
কোন এক সন্ধ্যার একটা ঝগড়া, তোকে আমার একটু না দেয়া প্রশ্রয় , আর তোর ওপারে চলে যাওয়া।
পুরোটাই মহাশক্তিধর এর লেখা একটা গল্প ছিলো। মহাশক্তিধর এর লেখা সেই গল্পটায় কিছু চরিত্র ছিলো কিছু অভিনয়ের নাটক, যার এন্ডিং টা অনেকগুলো গল্পের যোগসূত্র।
.
অনু! ওর পুরো নাম ছিলো মাইশারা জান্নাত, ডাকনাম ছিলো মিশু। সবাই ওকে মিশু বলে ডাকলেও, কোন একটা অদ্ভুত কারণে একটা গল্প রচনা হয়েছিল আমাদের।

আর সেই গল্পের সূত্র ধরেই আমি অনু বলেই ডাকতাম ওকে।
.
ছয় বছরের স্কুল লাইফের খুনসুটি শেষে কলেজে ভর্তি!! কিন্তু বন্ধুত্ব টা রয়েই গিয়েছিল সেই আগেরই মত। মাঝেই মাঝেই আমায় বর বানানোর দুষ্টু আবদার।

ফোনসমেত পুকুরের পানিতে ফেলে দিয়ে, আমার রাগী রাগী চোক দেখে ভয় পাওয়া, ওর সেই মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলায় আমার দিকে তাকিয়ে ফ্যাত কাদুনেদের মত কেদে দেওয়া।
.
ইয়াসির স্যারের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সূরভী উদ্যানের সামনে বসে ফুচকা খাওয়া। তারপর স্যারের সামনে পড়ে গিয়ে আধো আধো মুখে একটুখানি কান্নার আভাস। স্যারের হেসে ফেলা।
.
স্বপ্নের মতই ছিলো দিনগুলো! খুনসুটির সেই ফাল্গুনি দিনগুলোরই কোন একটা বিকেলে চিড়িয়াখানার বেঞ্চে বসে ভীতু ভীতু কন্ঠে “আমি তোকে ভালোবাসি অয়ন !” বলেছিল অনু।

প্রথমে কানদুটোকে বিশ্বাস হচ্ছিল না আমার। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলাম ওর মুখের দিকে। তারপর হঠাৎ করেই জড়িয়ে ধরেছিলাম, কবুতরের বাচ্চার মত ভয়ে কুঁকড়ে আসা মেয়েটাকে।
.
নতুন একটা রং খুজে পেয়েছিলাম জীবনটাকে রাঙানোর জন্য। ধীরে ধীরে দু’জোড়া হাত সেখানে তুলির আচড়ে আকতে লাগল নতুন কিছু আল্পনা।

অনেকগুলো ক্যানভাস ভরে গেল নতুন কিছু স্বপ্নে। কৃষ্ণচূড়া গাছের সব রং যেন আমার বুকের বামদিকে এসে জড়ো হল।

নতুন একটা পৃথিবী, অনেক গুলো রঙীন কল্পনা। হেটে চলার কিছু গল্প। কেমন যেন বদলে গেল জীবনটা।
.
মেয়েটার ভেতর অদ্ভুত একটা পাগলামো ছিল, একটা না বলা আবদার, এক লাইন বেশী বোঝার একটা অভ্যাস। একদিন ফোন না করলে অভিমানে গাল ফুলিয়ে না খেয়ে থাকা।

তারপর অনেক রাত্রে মেসেজ দিয়ে এত্তগুলা কান্না করে ফেলা মেয়েটারও সবগুলো স্বপ্ন আবর্তিত হতে লাগলো আমাকে ঘিরেই।
.
জীবনটা খুব বেশীই অদ্ভুত, আমাদের সুখের গল্পটা বুঝি আর লিখতে ইচ্ছা করছিলো না স্রষ্টার। এবার বদলে দিলো গল্পটাকে।

একটা সময় সুখ বয়ে চলা নদীটাকে এবার বদলে দিলো কষ্টের স্রোতধারায়। কেমন করে যেন হারিয়ে গেল সুখগুলো। শুরু হলো আরেকটা গল্পের। মানবজনমের পাপমোচন এর গল্প।
.
ভার্সিটিতে থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় একটা বাস দুর্ঘটনায় এক পায়ের গোড়ালি কাটা পড়ে,, আর এক পায়ের উরুর মাংস থেতলে যায় আমার ।

খুব গুরুতর অবস্থায় আমাকে মেডিকেলে ভর্তি করা হয়। তিনদিন অজ্ঞান থাকার পর জ্ঞান ফিরে আসে আমার।

কিন্তু অনেক বেশি সমস্যা নিয়ে বেচে থাকাটাই কঠিন হয়ে পড়ে আমার জন্যে।
.
মধ্যবিত্ত দিশেহারা বাবা-মা, অর্থসংকটে আটকে থাকা অপারেশন। কিছুই যেন ভাবতে পারছিলাম না আমি সেই সময় আমায় আকড়ে ধরে অনুর কান্না দেখলে মনে হত এর থেকে বুঝি মরে যাওয়াই ভালো ছিলো। অবশেষে বন্ধুদের হার না মানা সংগ্রামে টাকা জোগাড় হলো। একের পর এক অপারেশন আর দুশ্চিন্তা পেরিয়ে তার উরুতে মাংস বসানো গেলেও আরেকটা পা কিন্তু ক্ষতিগ্রস্থই থেকে গেলো।
.
এবার শুরু হয় আরেকটা সমস্যা, কয়েক মাসের দীর্ঘ প্রচেষ্টা,, বন্ধুদের সহযোগীতা,, নিজের মনের জোর আর সৃষ্টিকর্তার দয়াদৃষ্টিতে অনেকটা বেচে গেলেও বন্ধ হয়ে যায় আমার জীবনের স্বাভাবিক চলাফেরার অনেক অংশই।
.
রিটেইক খাওয়ায় কিছুদিনের জন্য হারিয়ে যায় ভার্সিটি লাইফ, ক্যাম্পাস, একটা সময় খুব কাছের কিছু বন্ধু ছাড়া ধীরে ধীরে বাকিরাও ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজেদেরকে নিয়ে।

শুরু হয় জীবনের আরেকটা পথচলার গল্প। সবকিছু হারানোর পরে নতুন করে ঘুরে দাড়ানোর গল্পের শুরু হয় আবারও।
.
কিন্তু বিধাতার ইচ্ছেটা বুঝি অন্যরকম ছিলো! অন্য কোন গল্পই লিখছিল মহাশক্তিধর । এবার আরেকটা অধ্যায়ের শুরু হয়ে যায়,

বাসা থেকে জোর করে অন্য একটা ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক করে ফেলে অনুর। ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসে জীবনের বাকী রংটাও।
.
ধীরে ধীরে সবগুলো আলো নিভে আসা জীবনটায় এবার আরো একটা ঝড়ের আভাস নেমে আসে। নিত্যদিন নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে এবার অবসন্ন হয়ে আসে দেহটাও।

ধীরে ধীরে ভেংগে পড়তে আস্কারা দেয় সময় । সিদ্ধান্ত নেই অনুর জীবন থেকে সরে আসার। ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসে নতুন করে শুরু করার গল্পটা।
.
কিন্তু না! বিধাতার ইচ্ছেটা তখনও অপুর্ণ! নাটকের আরো কিছু অঙ্ক তখনো বাকি। এবার হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে কয়েকশ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে বাসা থেকে পালিয়ে আসে মেয়েটা।

আমার কাছে অল্প একটু আশ্রয় চায়। জীবনের সবচাইতে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি আমি, এবার ওর মা-বাবার কাছে ফিরিয়ে দেই ওকে।
.
নিজের অথর্ব জীবনের সাথে জড়িয়ে আরেকটা জীবন তিলে তিলে শেষ হয়ে যাক সেটা মেনে নিতে পারিনি আমি।

অল্প একটু আবেগের কারণে মেয়েটার জীবন থেকে চিরতরে সুখের অনুভূতিগুলো মুছে যাক সেটা চাইনি আমি। এবারে বিবেকের কাছে হেরে যায় আবেগ, আর মৃত হয়ে যায় ভালোবাসা।
.
এবার আমার জীবনের গল্পের শেষ লাইনটা লেখেন বিধাতা। মরে যায় মেয়েটা! চুপচাপ! খুব সাবধানী আচড়ে টানা লাইনটায় কোন শব্দ ছিলো না,

তবে অনেকগুলো চাপা অভিমান বুকের ভেতর আগলে চলে যাওয়া নিথর দেহটায় কিছু প্রশ্ন ছিলো। অনেকগুলো অভিমান ছিল।

হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ ছিলো, আর তার গল্পটা এভাবে সাজিয়েছে বলে স্রষ্টার প্রতি অদ্ভুত একটা আক্রোশ ছিল।
.
না, মেয়েটার লাশটাকে দেখতে যাই নি আমি, দেখতেও চাইনি! অভিমানে আগল দিয়েছিলাম বুকের সমুদ্রে। নেমে আসা বৃষ্টিটাকে বেধে রেখেছিলাম একটা অন্ধকারে বালিশ ভেজার গল্পে।
.
অনুর গল্পটা ফুরিয়ে আসে! অভিমানের গল্পগুলো এভাবেই ফুরিয়ে যায়। জ্বলজ্বলে চোখে চেয়ে থাকে সময়! অপেক্ষা করে আরেকটা গল্পের, অনেক কিছু পেয়ে হারানোর গল্পটা খুব সময়ের স্মৃতি থেকে খুব সাবধানে মুছে যায় চুপচাপ। ব্যাকস্পেস বাটনে জড়িয়ে যায় একটা গল্প। “না পাওয়া সময়ের গল্প”।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত