আমাদের বাড়িতে আসরের আযানের পরপরই ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে যায়।
আসরের আযান দেয়ার পরপরই কেমন চারদিক অন্ধকার হয়ে আসে। ঘরে ঘরে লাইট জ্বালানো হয়। বড়মার হাঁস-মুরগিগুলো কোথা থেকে ঝাঁক বেঁধে চলে আসে বাড়ির উঠোনে।
চেঁচামেচি করতে করতে হুড়মুড় করে খোপে ঢুকে যায়। যেনো আর একটু দেরি হলেই খোপের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে।
আমি আমাদের পুরাতন আমলের দোতলা বাড়ির ছাদ থেকে প্রায়ই দেখি এগুলো।
এতবড় বাড়ি। কত মানুষ। তবুও মনে হয় রাজ্যের বিষণ্ণতা নিয়ে সন্ধ্যা বুঝি সত্যিই নেমে এসেছে।
বাড়িতে প্রচুর গাছের কারণে আলো কম আসে বলেই হয়তো এমনটি হয়।
বড়চাচাকে আমি কয়েকবার বলেছি গাছ কাটার কথা। বসতবাড়িতে এত গাছ থাকলে কেমন জংলি জংলি লাগে।
এক সকালে পুকুরের ঘাটে ব্রাশ করছি। বড়চাচা গোসলে এলেন। আমি প্রথমেই বললাম, চাচা ঘরের পেছনের বড়বড় গাছগুলো কেটে ফেলা যায় না?
চাচা আমার দিকে তাকালেনই না। সুড়সুড় করে মাজা পানিতে নেমে গেলেন। বুনো প্রাণীর মত ঝাপুর-ঝুপুর শব্দ তুলে সারা পুকুর কাঁপিয়ে একটানা কতগুলো ডুব দিয়ে উঠে এলেন।
এটাকে গোসল বলে না কী বলে কে জানে। বড়চাচা উঠে এসে যাওয়ার সময় থমকে দাঁড়িয়ে বললেন,
: গাছ কাটবো ক্যান? আমার কি টাকার অভাব হইছে? গাছ গাছের জায়গায় আছে, থাক। গাছ তো আর খাইতে চায় না। শুইতেও চায় না।
কী কথার কী উত্তর। আমি চাচার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলাম। চাচার গলায় কী একটা ময়লা লেগেছিলো। হাত বাড়িয়ে সেটা ফেলে দিলাম। বললাম,
: আচ্ছা চাচা ঠিক আছে। গাছ কাটতে হবে না। আপনার তো আজ রাজশাহী যাওয়ার কথা। ভালোমতো যাবেন।
আজও সকালে চাচার সাথে দেখা হলো।
ধবধবে পাঞ্জাবি-পায়জামা পরেছেন।
কী সুন্দর লাগছে চাচাকে। একদম আমার বাবার মতো। বাবা আর বড়চাচা পিঠাপিঠি ভাই। বড়চাচা সুস্থ্য শরীরে বেঁচে আছেন। অথচ বাবা অল্প বয়সে কীসব রোগ বাঁধিয়ে কত দ্রুত মারা গেলেন। আমার বয়স তখন তিন কী চার। বাবার কথা আমার কিছুই মনে নেই। মাঝে মাঝে মায়ের কাপড়ের বাক্স খুললে কেবল বাবার ছবি দেখা হয়।
মাঝারি উচ্চতার একটা মানুষ। সদ্য বিয়ে করেছেন।
সাদা প্যান্টের সাথে নীল শার্ট ইন করে পরে পাশে নতুন বউকে নিয়ে খুব আনন্দে ছবি তুলেছেন।
বাবাকে আমার তেমন মনে পড়ে না।
মনে করতে চেষ্টাও করি না। গল্প যা শুনেছি তাতে বাবার প্রতি কোনো টান আমার নেই। আমার বাবা লোক ভালো ছিলেন না। অথচ এই লোকের জন্য মা আর বিয়ে করলো না।
আমার দাদী খুবই অসুস্থ। অসুস্থ না হলে এখনও সম্ভবত আমাকে প্রতিদিনই একবার না একবার ডেকে বলতো, ও ভাই তোর মা কি সারাজীবন একাই থাকবো? তুই রাজি করা। আমার হাতে লোক আছে।
আমি কতবার বিরক্ত হয়ে দাদীকে বলেছি, আহ দাদী এসব কী কথা! আমি মরে গেলেও মায়ের বিয়ে হতে দেবো না।
সত্যিই আমি চাই না মায়ের অমতে কিছু হোক। মা এভাবেই খুব ভালো আছে বলে আমার মনে হয়।
মানুষের কষ্টের হয়তো একটি জায়গা থাকে। আবার সেই কষ্টের জায়গার বিভিন্ন ক্ষেত্র থাকে। একা থাকার ক্ষেত্রে সেখানে মায়ের কোনো কষ্ট নেই। আমি জানি। মায়ের সবচেয়ে বড় আফসোস যাদের কথা ভেবে মা সারাজীবন এতকিছু ছাড় দিলো, তারাই মাকে সম্পূর্ণ বুঝলো না। মায়ের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিলো না।
কে জানে কেনো এমন হয়। সবাই সবকিছু পেয়ে গেলে পৃথিবী খুব সহজ হয়ে যায় হয়তো। হয়তো প্রকৃতি চায় না এই পৃথিবী, এই মহাবিশ্ব খুব সহজ হয়ে যাক।
:: দুই.
বাড়িতে অনুষ্ঠান হলে ঝাঁকে ঝাঁকে আত্মীয়-স্বজন আসতে দেখেছি। কিন্তু কারো অসুস্থতার জন্য যে কোনো বাড়িতে উৎসবের আবহ তৈরি হতে পারে, তা এ বাড়িতে না জন্মালে হয়তো আমার জানা হত না। এরই মাঝে কাছের দূরের অনেকে এসে ঘুরে গেছে। উদ্দেশ্য দাদী অসুস্থ্য। যেকোনো সময় মারা যাবে। শেষ দেখা দেখতে এসেছে।
দাদী অসুস্থ্য। আমার ধারণা এ অসুস্থতা এমন বড় কিছু না। ডাক্তার দেখালে ঠিক হয়ে যাবে।
কারণ আমি দাদীর পাশে গিয়ে বসলে দাদী উঠে বসতে না পারলেও শুয়ে শুয়ে আমার সাথে কথা বলেন। খুব হেসে হেসেই কথা বলেন। মাঝে মাঝে রসিকতা করার চেষ্টাও করেন।
সেদিন আমি মিষ্টি নিয়ে দাদীকে খাওয়াতে গেলাম। দাদী পান খাওয়ার মত করে মিষ্টি খেতে লাগলেন। হুট করে বললেন,
: তুই এ বাড়িত্থন চইলা যা।
আমি খুবই অবাক হলাম। অবাক হয়ে বললাম-
: কেন দাদী? আমার অপরাধ?
: তুই তো একটা অকম্মা। এতবড় হইছিস আর এখনও রানুরে চুম্মা দিস নাই।
আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।
দাদী এধরণের রসিকতা করতে পারেন আমার ধারণায় ছিলো না। এর আগেও মজা করেছেন কিন্তু এমন করে বলেননি। দাদীর মাথা কি দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে? বললাম-
: রানুকে চুমু দেবো কেন? ও কি আমার প্রেমিকা না বউ?
: রানুরে জিগাইছিলাম। ত্যাজ দেখায় আমার সাথে।
রানু আমার বড়চাচার মেয়ে। আমার থেকে অনেক ছোট। দশ বছরের ছোট তো হবেই। আমরা কেউ কাউকে দেখতে পারি না। পছন্দ করার প্রশ্নই আসে না। দাদীর ধারণা আমাদের মাঝে ‘পিরীতি’ আছে। দাদীকে কতবার বলেছি, দাদী আল্লাহর কসম আমাদের মাঝে কোনো ‘পিরীতি’ নাই।
দাদী বিশ্বাস করেন না। দাদী নাকি বড়চাচার সাথে এবিষয়ে কথা বলবেন।
আমি দাদীর পায়ে ধরে বলে দিলাম,
প্লিজ এ নিয়ে যেনো কথা না ওঠে। তাহলে আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো।
দাদী অসুস্থ হওয়ার পর আর কথা হচ্ছে না তেমন। দাদীর অসুস্থতাকে ঘিরে উৎসব শুরু হয়েছে। ছোটফুপু সেদিন বিরাট লাগেজ নিয়ে, তার ছেলেকে নিয়ে হাজির। এসেই কত আদিখ্যেতা।
সারাদিন দাদীর সামনে গিয়ে কীসব বকবক করেন।
: মা তুমার কী খাইতে মন চায়? মন খুইলা বলো। কুনো চিন্তা করবা না টাকা-পয়সা নিয়া। ও মা, কী খাইতে মন চায়?
চিতল মাছ?
ছোটফুপু একেকদিন একেক ধরণের খাবার রান্না করায় মাকে দিয়ে। ছোটচাচাকে হুকুম করেন এটা আনো, ওটা আনো। বাড়িতে চিতল মাছ আসে, বড় কাতল আসে, চীনাহাঁসের মাংস আসে।
আরো অনেক কিছু আসে। আমার ধারণা দাদী এসব কিছুই খেতে চায় না।
দাদী কখনোই ভোজনরসিক ছিলেন না।
দাদীকে তিনবেলা পান ছেঁচে দিলে দাদী ভাতও খেতে চাইবেন না সম্ভবত।
অথচ দাদীর অজুহাতে ছোটফুপু প্রতিদিন তার ছেলেকে নিয়ে কত আনন্দ করে এটা খাচ্ছে ওটা খাচ্ছে। সন্তানেরা যখন বড় হয়ে যায়, যখন তাদের আলাদা সংসার থাকে, তখন সম্ভবত মা-বাবাকে তাদের আর মা-বাবা মনে হয় না। সবার ক্ষেত্রে সত্যি হয়তো না। কিন্তু এটাই হয়ে যায় স্বাভাবিকভাবে।
যেমন আমাদের ছোটফুপু, ছোটচাচা, আমার চাচাতো-ফুপাতো ভাই বোনেরা।
দাদীর প্রতি তাদের অনুভূতি দিন দিন খুবই নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। যেনো বৃদ্ধ এ মানুষটি প্রতিনিয়ত তার মূল্য হারাচ্ছে।
যেনো এ পৃথিবীতে এখন দাদীর বয়সী মানুষেরা বেঁচে থাকতে পারবে না।
বৃদ্ধ মানুষের আবার কিসের বেঁচে থাকা!
:: তিন.
ঘুম থেকে উঠে এত অবাক হলাম।
জানালা দিয়ে দেখি গাছ কাটার আয়োজন করা হচ্ছে।
কী আশ্চর্য আমার জন্য এতবড় একটা খবর আর আমি জানি না! এতদিনে এ বাড়ি অন্ধকারমুক্ত হবে। এ বাড়িতে আলো আসবে।
আমি নিচে নেমে এলাম। বড়চাচা আমাকে দেখেই এগিয়ে এলেন। সুন্দর করে হেসে ফেললেন। বড়চাচার হাসি দেখলে মনে হয় এ মানুষটির ভেতর কোনো পাপ থাকতে পারে না। মনেই হয় না এ মানুষটি কত রাত আমার মায়ের দরজায় মাঝরাতে টোকা দিয়েছে।
অবশ্য এগুলো দাদীর মুখে শোনা কথা।
দাদী অনেক মিথ্যা কথা বলেন আমি জানি। বড়চাচাকে দেখে আমার কখনো এমন মনে হয়নি।
অথচ দাদী তার বড়ছেলে সম্পর্কে কত সহজে এসব বলেছেন আমাকে।
বড়চাচা বললেন,
: শুভ্র, তোর কথা ফেলতে পারলাম না। কতবার বলেছিস আমি কানে নেইনি।
আসলেই এই গাছগুলো বাড়িটাকে স্যাঁতসেঁতে করে রাখে।
আমি জানি চাচার অবশ্যই কোন উদ্দেশ্য রয়েছে গাছ কাটার পেছনে। সেটা কী জিজ্ঞেস করতে পারছি না।
আমি ঘুরে ঘুরে খুব আনন্দ নিয়ে গাছকাটা দেখতে লাগলাম। একটা করে গাছ কাটা হচ্ছে আর বাড়িতে আলো বাড়ছে। মনে হচ্ছে এই বাড়িটা কত পরিচ্ছন্ন, কত অচেনা। এ বাড়ির প্রতিটি মানুষের মনে যদি এভাবে আলো পড়তো। যদি প্রতিটি মানুষের মন ভরে যেত আলোতে, কী ভালোটাই না হত।
দুপুরের দিকে হুটহাট বড়চাচার সাথে ছোটফুপুর ঝগড়া বেঁধে গেলো। খুবই উচ্চস্বরে ঝগড়া। এমনটি বহুদিন হয় না এ বাড়িতে। এমন করবার মত কোনো মেয়ে মানুষ এ বাড়িতে নেই বলেই হয়তো। আমার বড়চাচী আর আমার মা দুজনেই উদাহরণ দেবার মত ভালো মানুষ। ছোটচাচা বিয়ে করেননি। তাই এমন বাজে ধরনের অবস্থা তৈরি হয় না।
ঝগড়াটা এতটা বিশ্রী পর্যায়ে চলে যাবে আমরা কেউই চিন্তা করিনি। ছোটফুপু শরীরের সব শক্তি দিয়ে বলতে লাগলেন,
: বাড়ি কারো একার না। গাছও কারো একার না। একেকটা গাছের দাম কত আমি জানি। আমিও এই গাছের ভাগিদার।
মনে মনে আশ্চর্য হলাম যথেষ্ট। ছোটফুপুর বিয়ে থেকে শুরু করে মাঝে মাঝে যা প্রয়োজন তা সবই বড়চাচা করেছেন। আর সেই বড়চাচা সাথে ফুপুর এ কি আচরণ!
গাছ কাটার কারণ জানা গেলো। রানুর নাকি বিয়ে। রানুর বিয়েতে সংসারের আসবাব এই গাছ দিয়েই বানানো হবে।
খবরটি ফুপু আমাকে জানালেন। এক ফাঁকে কলতলায় ডেকে এনে কানের সাথে মুখ লাগিয়ে বললেন-
: শুভ্র শোন, গোপনে গোপনে রানুর বিয়ে দিচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ি সব কমপ্লিট হবে। কাউরে কিছু জানায় নাই। আমি জানি। তোদেরকে যে বড়ভাই কীভাবে ঠকাচ্ছে তা তোরা বুঝবি না। তোরা হলি এই পৃথিবীর এক নাম্বার গর্ধব। তুই আর তোর মা।
আমি খবরটি শুনে গুরুত্ব দিচ্ছি বা আমাকে কেনো জানানো হয়নি এতে আমার মন খারাপ হয়েছে, এমন কোনো অভিব্যক্তি দেখালাম না। খুব স্বাভাবিক থাকলাম।
মাকে একবার জিজ্ঞেস করলাম, মা জানো রানুর বিয়ে। ওর বিয়ের জন্যই গাছ কাটা হচ্ছে।
মা অসহায়ের মত চোখ নিয়ে আমার দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকলো।
আমার নিজেরই খারাপ লাগতে লাগলো। মনে হলো আমি এটা মাকে জিজ্ঞেস করে মাকেই যেন অপমান করলাম।
মাকে কেনো জানানো হয়নি এ নিয়ে কথা বলতে বড়চাচীর ঘরে গেলাম।
ঘরে এসেই অভিমান আমাকে জেঁকে ধরলো। আমার চোখ মুহূর্তে ভিজে উঠলো। আশ্চর্য আমি কথা বলতে গিয়ে কথাও জড়িয়ে গেলো আমার। অসম্ভব মমতাময়ী এই নারীর সামনে দাঁড়িয়ে অনেক কষ্টে বললাম,
: বড়চাচী, রানুর বিয়ের কথা মাকে কেনো বলেননি? মা এমনিতেই কত দুঃখী। তারওপর মাকে আপনারা এভাবে অপমান করলেন?
বড়চাচী আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন-
: তুই কাঁদছিস কেনো পাগল? রানুর বিয়ে ঠিক হয়নি। হলে সবাইকে গোপন রাখলেও তোর মাকে আমি জানাতাম। তোকেও জানাতাম। তোর ছোটফুপু কীসব শুরু করলো, তাই তোর চাচা মিথ্যা বলেছে। গাছ তোর কথাতেই কাটানো হচ্ছে। আমি অনুরোধ করেছি তোর চাচাকে।
আমার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো মুহূর্তেই। ইচ্ছা হলো দৌড়ে গিয়ে বড়চাচার সামনে গিয়ে বলি, চাচা আজ থেকে আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি।
::চার.
রাজন আর রানুর খুব ভাব হয়েছে। যখনই ছাদে যাই, দেখি ওরা কী সুন্দর হেসে হেসে গল্প করছে। আমাকে দেখেই রানু প্রতিবার বলে, শুভ্র ভাইয়া আসেন। আমরা খুব মজার গল্প করছি।
আমার একটুও ইচ্ছা করে না ওদের সাথে দাঁড়িয়ে মজার গল্প করতে। আমি মিথ্যা মিথ্যা বলি, না রে, তোরা গল্প কর। সামনেই আমার মাস্টার্স ফাইনাল। অনেক পড়তে হবে।
জানি, আমি না যাওয়াতে রানু খুশি হয়।
আমি ওখানে গেলে রানু বা আমি কেউই মজা পাবো না বরং ওদের মজা নষ্ট হবে। আমি চলে আসার জন্য পা বাড়াই।
আমি দেখতে পাচ্ছি না এমন ভঙ্গিতে রানু মুখে ভেংচি কাটে। রাজন মেয়েদের মত খিলখিল করে হেসে ওঠে। আমার গা জ্বলে যায়। খুব লজ্জা করে।
আমার ফুপাতো ভাই হিসেবে রাজনের সাথে আমার অনেক ভাব হওয়ার কথা অথচ তার কিছুই না। রাজনকে এমনিতে আমার ভালো লাগে। কিন্তু ঠিক কী কারণে যেন আমাদের তেমন মেলামেশা হয়ে ওঠে না। বয়সে ও আমার থেকে অল্প ছোট হবে। দুজনেরই তুই তোকারি সম্পর্ক। যেদিন ওরা এলো, সেদিনই আমি রাতে খাওয়ার সময় বললাম, রাজন তুই আমার ঘরে থাকিস।
রাজন মুখের উপর না করে দিলো।
রাতে দেখলাম দাদীর ঘরের পাশের ঘরটি ওর জন্য ঠিক করা হচ্ছে। কী সুন্দর করে আমার মা রাজনের বিছানা করে দিলো। আমি রাতে রাজনের কাছে গেলাম। বললাম,
: তোরা কতদিন পর এলি। তুই এলে আমার ভালো লাগে। এ বাড়িতে সময় কাটানোর মত কেউ নেই আমার।
রাজন ফস করে বলে উঠলো-
: উহ কী মিথ্যুক তুই। আমি জানি তুই রানুর সাথে ঠিক চুটিয়ে প্রেম করছিস।
দাদী আর রাজনের চিন্তা একরকম দেখে খুব অবাক হলাম। বললাম-
: ছিঃ কী বলিস এগুলো? রানুর সাথে আমার সম্পর্ক ভালো না। কারণ বলি তোকে। কাউকে বলিস না। রানু মায়ের সাথে প্রায়ই তুচ্ছ বিষয়ে রাগ দেখায়। এই সেদিনের মেয়ে। ওকে হাফপ্যান্ট পরা দেখেছি। অথচ একদিন রাগ করে মায়ের সাথে কত বাজে ব্যবহার করলো।
এর জন্য বড়চাচী রানুকে রাতে মারলো।
রানুর ধারণা আমি বড়চাচীকে বলে রানুকে মার খাইয়েছি।
বল এসব ঘটনার পরও ওর সাথে আমি প্রেম করতে পারি? ওকে ভালোবাসতে পারি?
রাজন গ্যাঁট হয়ে বলল-
: হ্যাঁ পারিস। এ বাড়িতে আসার সাথে সাথে নানী আমাকে বলেছে।
আমি হেসে ফেললাম। রাজন এখনো কত বাচ্চা আছে। ওর হাত ধরে বললাম-
: আল্লাহর কসম এসব মিথ্যা। বিশ্বাস কর।
রাজন বিশ্বাস করলো। আমি বললাম-
: আজ রাতে তোর সাথে ঘুমাই?
রাজন না করে দিলো। কী আশ্চর্য এত সহজে কেউ কাউকে না করতে পারে?
আমি চলে আসছি। হঠাৎ রাজন ডেকে নিয়ে বলল-
: নানী নাকি তোর নামে অর্ধেক সম্পত্তি লিখে দিতে চায়?
আমি চলে এলাম। এসব নিয়ে কথা বলার কোনো মানে থাকতে পারে বলে আমার মনে হলো না। ইচ্ছাও করলো না। রাজন এরপর থেকে আমার সাথে খুব কম কথা বলার চেষ্টা করলো। আমিও ওকে ঘাঁটালাম না।
কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে রাজনের একা রুমে থাকার রহস্য আমি ধরে ফেললাম।
এত ঘৃণা হলো আমার। ইচ্ছা করলো রাজনকে বাড়ির মাঝখানে দাঁড় করিয়ে সবার সামনে কয়েকটা চড়-ঘুষি বসিয়ে দেই।
মানুষ এত নোংরা হতে পারে আমি অবাক হই। আবার বিস্মিত হই যে এই মানুষই আবার কত ভালো হয়। শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যাবার মত ভালো।
পৃথিবী বড়ই বিচিত্র জায়গা সত্যি!
:: পাঁচ.
ঘুম থেকে উঠেই দেখি অসুস্থ্য দাদীকে ঘিরে আলোচনা বসেছে। আলোচনার বিষয় আমার জন্য খুবই লজ্জার।
না, রানু সম্পর্কিত কিছু না।
সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে। দাদী চায় তার অর্ধেক সম্পত্তি আমার নামে লিখে দিতে। এটাই আমার জন্য বড় লজ্জা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি বা মা কারোই জমিজমার প্রতি লোভ নেই। অথচ দাদী তার সিদ্ধান্তে অটল।
এতদিন পর মনে হলো আসলে ছোটফুপু একারণেই এসে বসে আছেন এ বাড়িতে। বাড়ির সবাই একসাথে আছি, অথচ ছোটফুপু কীসব কথা অনর্গল বলেই যাচ্ছেন। আমাকে সামনে রেখেই বলতে লাগলেন-
: শুভ্র কি একাই তোমার নাতী? রাজন, রানু, শফিক, তোমার ছোট ছেলে, আমরা কেউ কিছু না? মা তুমি যদি এই কাজ করো তাহলে আমি কিছুই নেবো না। আজই চিরদিনের মত বিদায় নেবো এই বাড়ি থেকে।
আমার দাদী বিছানায় অন্যদিকে ঘুরে শুয়ে শান্ত গলায় বললেন-
: তুই চইলা যা। তোরে আসতে কইছে কে?
দাদীর কথায় রানু খিলখিল করে হেসে উঠলো। আমরা সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। ছোটফুপু সারাক্ষণ সম্পত্তির চিন্তায় বিড়বিড় করতে লাগলেন। যেনো দাদী তার সম্পত্তি কোনো ফকির মিসকিনকে দিয়ে দিচ্ছেন। খুব বড় লোকসান করে ফেলছেন সবার।
ফুপু আমাকে এত ছোট করে দেখছেন অথচ এর জন্য একটুও নিজের কাছে তিনি অপরাধী ভাবছেন না।
আমার সাথে দিব্যি কথা বলছেন। বারবার বলছেন- শফিকরে খবর দে। শফিকের জানানো দরকার। শফিক এইবাড়ির বড় নাতী। ওর একটা হক আছে।
রানু কোথায় থেকে উদয় হয়ে উত্তর দিলো- শফিক ভাই সব জানে। শফিক ভাইয়ের এ নিয়ে কোন মাথাব্যথা নাই। যার মাথাব্যথা সে ওষুধ খাক।
কী আশ্চর্য রানু কত সহজভাবে উত্তর দিয়ে দিলো মুখের উপর। বড়দের মুখের উপর কথা বলা হয়তো ভালো কাজ না। কিন্তু ঠিক এই কারণেই রানুকে আমার বড় ভালো লাগতে লাগলো। ইচ্ছা করলো কাছে ডেকে একবার চুল টেনে দিয়ে বলি – খুব পেকে গেছিস মনে হচ্ছে?
শফিক ভাইকে সত্যি সত্যি খবর দিয়ে আনানো হলো। শফিক ভাইকে ছোটফুপু নিশ্চিয়ই অনেক কথা বানিয়ে বানিয়ে বলে কান ভারি করবে। বাড়িতে একটা মহা ধুন্ধুমার বেঁধে যাবে। আমার খুব অস্থির লাগতে লাগলো। বারবার মনে হতে লাগলো এই বুঝি বড় কোবো দুর্ঘটনা ঘটে যাবে।
শফিক ভাই সন্ধ্যার আলোচনায় সবার সামনে বললেন-
: দাদীর যদি ইচ্ছা করে তার অর্ধেক সম্পত্তি শুভ্রকে লিখে দিবে, অবশ্যই দিবে। তার সম্পদে তার সিদ্ধান্তই বড় কথা। আমার এসব নিয়ে কোনো সমস্যা নাই।
বড়চাচার ছেলে শফিক ভাইকে এই প্রথম খুব করে অনুভব করলাম আমি।
মনে হলো ভাইদের তো এমনই হতে হয়।
আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম দাদী আমাকে যা দিবে তার থেকে আমারটুকু রেখে বাকীটুকু আমি শফিক ভাইকে দিয়ে বলব- ভাইয়া এই নাও দলিল। এই জমি দিয়ে আমি কী করবো? আমাকে তুমি যদি সারাজীবন আপন ছোটভাইয়ের মত ভালোবাসো, তাহলেই আমার চলবে।
রাতে আমি শফিক ভাইয়ের সাথে অনেকক্ষণ গল্প করলাম ছাদে দাঁড়িয়ে।
ছাদ থেকে নেমে আসার আগে শফিক ভাই আমার হাত ধরে বললেন-
: তোর মনে অনেক কষ্ট, না রে শুভ্র? মনে কোন কষ্ট রাখবি না।
আদর পেলে আমার অভিমান বাড়ে। আমি ভেজা চোখে খুব সাধারণভাবে বললাম-
: নাহ। আমার মনে কোনো কষ্ট নাই। আমি পৃথিবীর সুখী মানুষদের একজন।
:: ছয়.
আমাদের বাড়ীতে খুব অল্প সময়ে পরপর দুজন মানুষ মারা গেলো। মাত্র সাত দিনের ব্যবধানে। অনেক জায়গায় দুর্ঘটনায় একই পরিবারের কয়েকজন মারা যায় শুনেছি। কিন্তু তেমন কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই দুজন মানুষকে হারানো ছিলো অভিজ্ঞতার বাইরে। আমার বাবা মারা যাওয়ার পর এই বাড়িতে আর কেউ মারা যায়নি। তাই আমি অনেক কষ্ট পেলাম। সত্যি অনেক কষ্ট পেলাম।
একদিন রাতে মা নিজ হাতে দাদীকে ভাত খাওয়াতে গেলো। দাদীর শ্বাসকষ্ট বেড়েছে। রাত বাড়ার সাথে সাথে কষ্টের পরিমাণ দিগুণ হারে বাড়তে থাকে। ওষুধে কোনো কাজ হয় না।
সে রাতে আমি মায়ের সাথে গেলাম দাদীর ঘরে। ইচ্ছা একটু গল্প করবো।
আমার আয়োজন দেখে রানু দরজায় দাঁড়িয়ে মাকে উদ্দেশ্য করে বললো-
: মেজো চাচী আমি আর রাজন ভাই আসি? গল্প করবো।
মা কিছু বলার আগেই আমি উত্তর দিলাম, না আসার দরকার নাই। পরে গল্প করিস।
বলেই বুঝলাম, ওদের না করে দিয়ে আমি অন্যায় করেছি। আমি ওদের ডাকতে গেলাম। ওরা রাগ করে আসলো না। শেষে অনুনয় করে বললাম, চল রানু। মাফ করে দে আমাকে। আমার ভুল হয়ে গেছে।
ওরা তবুও আসলো না।
আমি দাদীর সাথে অনেক রাত পর্যন্ত একাই গল্প করলাম। মা চলে গেলো মায়ের ঘরে। দাদী আবার সেইসব কথা বলতে লাগলেন। শ্বাস টানতে টানতে বললেন-
: নাহ রানুর সাথে তোর কোনো পিরীত নাই। আমার ভুল হইছে। ওর ঢলাঢলি রাজনের সাথে। রাজন ওর ঘরে রানুরে নিয়া দরজায় খিল দেয় রাইতের বেলা। এই ঘরেত্থন আমি সব শুনি।
আমি দাদীকে থামিয়ে দেই। দাদী অনেক উল্টাপাল্টা বকে এখন। অসুখ বেড়েছে বলেই হয়তো।
ভোরবেলা মা দাদীর ঘরে গিয়ে দেখে দাদী মরে শক্ত হয়ে গেছেন। কী যে আশ্চর্য হলাম। এত দ্রুত আমাদের দাদী এভাবে চমকে দিয়ে পরপারে চলে যাবেন আমার কল্পনার বাইরে ছিলো।
দাদী মারা যাওয়ার পাঁচ দিনের মাথায় ছোটচাচা আর ছোটফুপু আবার নির্লজ্জের মত জমি ভাগ নিয়ে কথা ওঠালেন। বড়চাচা ধমকে উঠে বলে দিলেন-
: বেশি কথা বলবা না তোমরা। মা যা বলছে তার কথার একচুল নড়চড় হইতে দিবো না।
রাজনকেও দেখলাম খুব চুপচাপ। ছোটফুপুকে কয়েকবার ধমক দিতেও দেখলাম। স্পষ্ট শুনলাম রাজন একবার বলল-
: মা তুমি খুব খারাপ। তুমি এই পৃথিবীর সবচে খারাপ সন্তান আর খারাপ মা।
দাদী মারা যাওয়ার ঠিক সাত দিনের মাথায় রাজন মারা গেলো। রাতের বেলা অনেকগুলো ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করলো রাজন। মারা যাবার আগের দিন রাতে আমার ঘরে এসেছিলো ও। খুব রহস্য করে বললো-
: তোকে একটা কাগজ দেবো। তোর মায়ের কসম দিয়ে বল কাল দুপুরের আগে সেটা পড়বি না।
আমি হাসতে হাসতে ড্রয়ারে রেখে দিলাম কাগজটা। সত্যি খুললাম না। কথা দিয়ে কথা না রাখার মত অভ্যাস আমার নেই। রাজন মারা গেছে শুনে আমি একটুও বিশ্বাস করিনি।
ঘোর লাগা কানে আমার ঘরে এসে দরজা আটকে রাজনের দেয়া কাগজটি পড়লাম। রাজন লিখেছে-
শুভ্র,
আমি ছেলে খারাপ ছিলাম। কিন্তু আমি যে কতটা খারাপ তা আমি নিজেও জানতাম না। আমার খারাপ হওয়ার পেছনে সবচে বেশি দায়ী আমার মা।
মা সারাক্ষণ জমিজমা নিয়ে আমার সাথে কথা বলে। কীসব কথাবার্তা বলে শুনলে যে কারো তোদের প্রতি, দাদীর প্রতি রাগে মাথা গরম হয়ে যাবে।
সম্পত্তির লোভ যে কতটা ভয়াবহ তা আমার মাকে না দেখলে আমি কখনই জানতাম না। জানিস বোধহয় লোভ আর রাগ মানুষকে পশু বানিয়ে দেয়।
আমার মা সত্যি পশু হয়ে গিয়েছে। সেইসাথে আমাকে বানিয়েছে পশুর বাচ্চা।
পশুর বাচ্চাকে যদি পশু হতে জ্ঞান দেয়া হয়, তাহলে সে বাচ্চাও পশু হয়ে যায়। আমিও তাই হয়েছি।
আমি মায়ের কিছু কথার কারণে সে রাতে তিনটার দিকে দাদীর ঘরে গেলাম। মাত্র তিন-চার মিনিট দাদীর মুখে হালকা করে বালিশ চেপে ধরলাম।
কোনরকম শব্দ ছাড়াই চুপচাপ দাদী মারা গেলো। আশ্চর্য এত সহজে ও ঠাণ্ডা মাথায় আমি দাদীকে খুন করলাম।
মা কত কাঁদলো। অথচ আমি জানি মা অনেক খুশি। কারণ দাদী তোকে কিছু লিখে দেয়ার আগেই শেষ।
শুভ্র, মানুষ যতক্ষণ অপরাধের মধ্যে থাকে ততক্ষণ সে অন্যরকম এক স্বাভাবিকতার মধ্যে থাকে। কিন্তু যখন তার সুস্থ্য বিবেক বুঝতে পারে যে সে অপরাধী, তখন তার কষ্টটা হয় অবর্ণনীয়। হতে পারে এটা শুধু আমার ক্ষেত্রেই। আমি বেঁচে থাকার মাঝে আর কোনো শান্তি পাচ্ছি না। এই সম্পদ, এ পৃথিবী বড় রঙহীন মনে হচ্ছে। যেনো বেঁচে থাকাটাই সবচে বড় কঠিন কাজ।
শুভ্র, নানীকে মেরে ফেলা যতটা সহজ লেগেছিলো, আমার বেঁচে থাকা তারচে লক্ষগুণ কঠিন মনে হচ্ছে। তুই তো জানিস কঠিন কাজ আমি করতে পারি না।
সবাইকে বিষয়টা তুই জানিয়ে দিস।
-রাজন।
নির্বাক আমি কাউকে একথা জানালাম না। সব কথা সবাইকে জানাতে নেই। কিছু কথা নিজেকেই ভুলে যেতে হয়।
আমার নিজেরই বেঁচে থাকা অর্থহীন লাগতে লাগলো কিছুদিন।
পৃথিবীর উপর খুব অভিমান হতে লাগলো। মনে হলো প্রতিটি মানুষ যেনো আলাদা পৃথিবী। প্রতিটি চাওয়াও যেনো আলাদা আলাদা পৃথিবী। যার সবটুকু আমরা জানি না। বুঝি না। চিনি না।
চেনা সম্ভবও নয়। কারণ অদ্ভুত এই পৃথিবী কারণে-অকারণে রঙ বদলায়।
প্রতিটি মানুষ অপেক্ষায় থাকে কখন আঁধার পেরিয়ে আলো আসবে সেই পৃথিবীতে। :::