কাল আমার বিয়ে,এতো রাতে ডায়েরি
লিখতে বসলাম।হ্যা কাল আমার বিয়ে, গতো ৪বছর প্রেম করার পর কালকে বিয়ের পিরিতে বসতে যাচ্ছি, তবে বর আমার প্রেমিক নয়।বাসা থেকে ঠিক করা বাবার পছন্দের ছেলে।আজকে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান ছিলো একটু আগেই শেষ হলো।সবাই ঘুমিয়ে পরেছে বোধহয়। শুধু আমারই ঘুম আসছে না।কি করবো বলুন, এতো সহজে কি সব টা ভোলা যায়!চার বছর! কতোগুলো মিনিট আর সেকেন্ড হয় চার বছরে??এই পুরোটা সময় ধরে তাকে ভালোবেসে গেছি আমি।আর সে? ভালোবাসা তার আমার প্রতি কেমন ছিলো তা বুঝানোর ক্ষমতা আল্লাহ আমাকে দেয়নি।শুধু এতোটুকু জানি মা বাবার পর কেউ যদি আমাকে অনেকটা ভালোবেসে থাকে তাহলে সেটা ঈশান।এই চার টা বছর একটু একটু করে সম্পর্কটা তৈরি করেছি আমরা। খুব যত্নে আগলে রেখেছি আমাদের ভালোবাসা টা কে।কতো স্বপ্ন ছিলো দুচোখ ভরা।
.
.
.
কিন্তু প্রবলেম টা কোথায় জানেন? ফ্যামিলি..বাসা থেকে কোনো ভাবেই মেনে নিলোনা ওকে।বাসা থেকে বিয়ের জন্যে চাপ দিচ্ছিলো। বেকার ছিলো ও, তবুও বাসায় ওর কথা বললাম।ও সবার সাথে কথা বলেছে, অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছে, আমিও করেছি সাধ্যমতো। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।
.
.
.
ভালোবাসার টানে ঘর ছাড়তে চাইলাম, কিন্তু ও রাজি হলোনা, “সবার মনে কষ্ট দিয়ে সুখী হতে পারবো না আমরা, বাবা মা সম্মান রক্ষা করতে না পারলে কেমন সন্তান আমরা?এভাবে সবার থেকে পালিয়ে গিয়ে আমাদের ভালোবাসা স্বীকৃতি পেলেও আমাদের প্রতি আমাদের বাবা মায়ের যে ভালোবাসা আছে তার যে বড্ড বেশি অপমান হয়ে যাবে।” এরকম কতো কিছু বুঝালো আমাকে।আমার সেই পাগলাটে কখন এতোটা বড় হয়ে গেছে এতোটা বুঝতে শিখে গেছে টেরই পেলাম না আমি।হয়তো সময়ই সব শিখিয়ে দেয় মানুষকে, সময়ই সহ্য ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
.
.
.
.
শেষ যেদিন দেখা হলো আমাদের, কেউ কারো চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারছিলাম না।ওর চোখ গুলো খুব লাল ছিলো, উষ্কখুষ্ক চুল।পুরোটা সময় ধরে মাটির দিকে তাকিয়ে ছিলাম দুজনেই।
দুজনই যেনো ভাষাশূন্য হয়ে পরেছিলাম।
এইতো কদিন আগেও কথা যেনো শেষই হতো না। আর সেদিন শেষবারের মতো কথা বলতে গিয়েও কোনো কথাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না।শুধু বললাম ভালো থেকো, ও মাথা নাড়লো শুধু।
.
কাল আমার বিয়ে, একবুক শূন্যতা নিয়ে যাচ্ছি আরেকজনের ঘর পূর্ন করতে, কি অদ্ভুত!
.
.
.
8অক্টোবর 2016
.
.
আজ ভাইয়ের মেয়ের বিয়ে থেকে অর্থী (আমার মেয়ে) কে নিয়ে বাসায় ফিরছিলাম। স্টেশনে বসে অর্থী কে বললাম পানি নিয়ে আসতে।
হঠাত কেউ পিছন থেকে বললো, নীলা কেমন আছো?গলাটা শুনে চিনতে ভুল হলো না।পিছনে ঘুরে তাকাইলাম,ঈশান দাঁড়িয়ে আছে।কাঁচাপাকা চুল, চোখে চশমা। কিন্তু চোখ গুলো সেই আগের মতোই আছে, তাকানোর ধরণ টাও আগের মতোই আছে।বুক ভেংগে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসলো, বললাম ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? অনেকদিন পর দেখা তাই না?ও হাসলো।তারপর পাশে এসে বসলো।
বললো ভালোই আছি, বুড়ি হয়ে গেছো দেখি!আমি হাসলাম।ওকে জিজ্ঞেস করলাম বিয়ে করেছো?ও হাসলো, কিছু বললো না।কতো কথা বলার ছিলো, কতো দিন পর দেখা, তবু যেনো বলার কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলাম না আমি।জিজ্ঞেস করলাম, খুব কষ্ট হয়েছিলো নিজেকে সামলাতে?ও বললো, তুমি তো আমার চেয়ে বেশি কষ্টে ছিলে, আমি তো তবু নিজের কষ্ট প্রকাশ করতে পারতাম, আর তোমাকে তো শ্বশুর বাড়িতে সব চেপে হাসিমুখে সব কিছু সামলাতে হতো, তাই না?আমি বললাম, আমাকে মনে পরতো না তোমার?ও একটু হেসে বললো থাক না এগুলো এখন।আচ্ছা নীলা, এই সময় টা পারতো না অন্যরকম হতে?আমি বললাম, পারতো, কিন্তু ভাগ্যে যে এটাই ছিলো।
ও বললো, আকাশী শারি তে তোমাকে এখনো আগের মতোই সুন্দর লাগে।
আমি হাসলাম।অর্থী চলে আসলো পানি নিয়ে, অভ্রকে বললাম, এই আমার মেয়ে।
অভ্র অর্থী কে পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলো, তোমার নাম কি মা?
“আমার নাম অর্থী “ঈশান আমার দিকে তাকালো।ওর ঠোঁট কাঁপছিলো।জানি ওর অনেক পুরোনো স্মৃতি মনে পরে যাচ্ছে এখন।ও ঠিক করে রেখেছিলো আমাদের বিয়ের পর মেয়ে সন্তান হলে ওর নামের সাথে মিলিয়ে মেয়ের নাম রাখবে অর্থী।
অর্থী বললো মা ট্রেন এসে পরেছে চলো, অর্থীকে এগুতে বললাম।আমিও উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আসি তাহলে?
ও বললো, এখনো ভালোবাসো??আমি বললাম , তা জানিনা, কিন্তু আমাদের ভালোবাসার অসম্মান হবে বলে এখনো সুন্দর ভাবে সংসার করে যাচ্ছি, তুমি একদিন বলেছিলে, বিয়ের পর আমি উলটা পালটা কিছু করলে আমার ফ্যামিলির তোমাকে দোষ দিবে, বলবে তোমার জন্যেই আমি সব করছি।
সেই ভয়ে আজ পর্যন্ত এমন কিছু করিনি যাতে কেউ তোমার সম্পর্কে খারাপ কিছু বলে।বলতে বলতে আমার চোখ ঝাপ্সা হতে শুরু করেছে, আর চোখের সামনে ভাসছে ঝাপ্সা অতীত, ঝাপসা সোনালি স্মৃতি।ও বললো এটাই কি শেষ দেখা?
আমি বললাম, নাহ দেখা যখন হলো, আবার হয়তো হবে, হারিয়ে যাওয়ার জন্যে পৃথিবী টা অনেক ছোট।ও বললো, শান্তনা একটাই যে ভুল মানুষকে ভালোবাসিনি। সব কিছুই ঠিক ছিলো, শুধু পরিস্থিতি টা ঠিক ছিলো না।আমি বললাম, ভালো থেকে অভ্র।২০বছর আগের মতো ও শুধু মাথা নাড়ালো।আমি ট্রেনে গিয়ে উঠলাম।
ট্রেন চলতে শুরু করলো, আসতে আসতে দূরত্ব বাড়তে লাগলো, ঈশান কে চশমা খুলে চোখ মুছতে দেখলাম রুমাল দিয়ে, হয়তো ট্রেনের চলতে শুরু করেছে বলে ধুলো ওর চোখে চলে গেছে, আবার হয়তোবা অন্য কিছু।সব কিছু জানতে নেই।সব কিছু কি ২০ বছর আগে শেষ হয়ে গেছে? না হয়নি, এখনো কোনো মধ্যরাত কিংবা বর্ষার রিমঝিম বৃষ্টি মুখর সন্ধাবেলায় এই ভালোবাসার মানুষগুলোর চোখের কোন ভিজে উঠে, তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করে বুকের বাম দিক টাতে।
ভালোবাসা কখনো শেষ হয়ে যায়না, সময় ও পরিস্থিতির কাছে হার মেনে সময়ের স্রোতে অনেক ভালোবাসাই হারিয়ে যায়।
কিন্তু কোথাও না কোথাও একটু খানি… থেকেই যায়।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক