কাঠগোলাপ গাছটির গাঢ় সবুজ রঙ্গা একটি পাতা হতে জমে থাকা কিছু বৃষ্টির ফোটা টুপটুপ করে ঝরে পড়ছে , এক অসাধারণ ছন্দ বজায় রেখে । গাছটির ওপাশের অন্য একটি ডালে ছোট্ট একটি বাবুই পাখি অবিরাম ডেকে চলেছে । আর আমি অনেকক্ষণ ধরে ঘুম ভাঙ্গা চোখে মন্ত্রমুগ্ধের মতন এই দৃশ্য দেখে চলেছি । মাঝে মাঝে আমার এমনটা হয় , খুব সাধারন একটি দৃশ্য দেখে আমার ভেতর হঠাত করেই গভীর মুগ্ধতা চলে আসে । এইতো এখনও তাই হচ্ছে , এই পাতা, বৃষ্টির ফোঁটা আর বাবুই পাখিটাকে দেখে আমি যারপরনাই মুগ্ধ হয়ে গেছি । আমি জানালার গ্রীল দিয়ে হাত বাড়িয়ে আলতো করে পাতাটা ছুঁয়ে দিলাম । আমার জানালার সাথে এই সুন্দর কাঠগোলাপ গাছটির একটা গভীর প্রেম আছে , আমি বেশিরভাগ সময়ই হুট করে এসে তাদের প্রেমে বাগড়া দেই । তারা অবশ্য আমায় বেশ পছন্দই করে । কারন আমি জানালার পাশে এসে বসলেই এই মায়াবতী গাছটির সবুজ পাতা ছুঁয়ে মিষ্টি একটা বাতাস খেলা করে যায় । আগেই বলে রাখি , আমি কিন্তু এত কাকতালীয় ব্যাপার স্যাপার বুঝতে চাইনা , সবকিছুকে রুপকথার চোখে দেখতেই ভাল লাগে আমার ।
অলস দিনটা দুপুর আর বিকেলের মোহনায় দাঁড়িয়ে আছে । মাঝদুপুরে আকাশ কাল করে বেশ মেঘ করেছিল ,তারপর হয়ত বৃষ্টি ও পড়েছে অনেক , কিন্তু সেই বৃষ্টিতে আমার হাত ভেজানো হয়নি । বেরসিক আমি পুরোটা সময়ই কাটিয়েছি ঘুমিয়ে । ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসেই বিছানা লাগোয়া আমার ঘরের একমাত্র জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি । আরে বেশ তো , আকাশে দেখি বিশাল একটা রংধনু ও উঠেছে । আমার চোখে মনে রুপকথার এমন অপূর্ব ঘোরটা হঠাতই ভেঙ্গে গেল একটি কলিং বেলের আওয়াজে । কলিং বেলের আওয়াজ শুনেই সোজা হয়ে বসলাম আমি , আওয়াজ শুনেই আমি বুঝে গেলাম কে এসেছে ।আমি বিছানা থেকে উঠে এগিয়ে গেলাম আমার ঘরের দরজার দিকে , বুঝলাম আম্মু দরজা খুলে দিয়েছে । আম্মুর সাথে আগন্তুকের আধো আধো কথা শুনে আমি নিশ্চিত হলাম , হ্যা অঝোর ভাই ই এসেছ।
অঝোর ভাই এর কলিং বেলের আওয়াজ শুনেই আমি বুঝতে পারি সে এসেছে । এরকম ” ট্রিং টিং টিং ” শব্দে আমাদের বাসার আর কেউ বেল বাজায় না , বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আওয়াজ টা হয় এমন ধরনের ” ট্রিইইং ”,তাই সহজেই বুঝা যায় । আম্মু অঝোর ভাই কে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে রান্নাঘরে গেলেন , আমি জানি আম্মু এখন অঝোর ভাইয়ের জন্যে তার ফেবারিট লাল চা বানাবেন , সাথে ক্রিম বিস্কিট । মুখ বাকালাম আমি, নিজের ছেলে নেই বলে যাকে তাকে ছেলে বানিয়ে ফেলেছে আমার আম্মু । আমি আমার ঘরের দরজা থেকে সরে এসে আয়নার দিকে এগিয়ে গেলাম । আলতো করে টিপের পাতাটা তুলে একটা নীল রঙের টিপ লাগিয়ে আয়নার দিকে তাকালাম । আমি জানি আমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে , কারন টিপে আমাকে অনেক মানিয়ে যায় । আব্বু বলে , ” কাজল আর টিপ আমার দুই মামনির জন্যই তৈরি হয়েছে ” আব্বুর দুই মামনি হল আমি আর আমার বোন । আব্বুর ভাষ্য, আমার বোনকে কাজলে আর আমাকে টিপ পরলে রাজকন্যার মত লাগে । কাজল নাহয় সবসময় লাগানো যায় , কিন্তু টিপ কি সবসময় দেয়া যায় ? আমি দিতে পারিনা , আমার কেমন লজ্জা লজ্জা লাগে । কিন্তু আমি এখন টিপ পরেই অঝোর ভাইয়ের সামনে যাব । আমি কখনও টিপ ছাড়া তার সামনে যাইনি । সে নিশ্চয়ই ভাবে ,” মেয়েটা কিরকম ঢঙ্গি রে বাবা , বাসাতেও টিপ পরে থাকে ” , আবার নাও ভাবতে পারে , আমাকে নিয়ে এত কিছু ভাবার তার সময় কোথায় ?
আমি ড্রয়িং রুমের সামনে গেলাম , অঝোর ভাইয়ের দিকে না তাকিয়ে আম্মুর রুমের দিকে যাবার ভাব নিচ্ছিলাম , তখনি শুনলাম আমাকে ডাকছে , ” এই মেয়ে ” আমি অঝোর ভাইয়ের দিকে তাকাতেই আমাকে বলল , ” এদিকে আসো ” আমি এগিয়ে গিয়ে মাথা নামিয়ে বললাম , ” আমাকে ‘ এই মেয়ে’ বলে ডাকেন কেন ? আমার তো একটা নাম আছে , আর আমার ধারনা আমার নাম টা খুব সুন্দর ” ” ওহ তাই নাকি ?” আমি কিছু বলতে যাব , তখনি আম্মু রান্নাঘর থেকে ডাকল, ” ইরা ” আমি অঝোর ভাইকে কিছু না বলেই মুখ ভার করে রান্নাঘরে গেলাম । দেখি আম্মু ট্রে সাজাচ্ছে । কফিমগে অনেকখানি লাল চা , একটা পিরিচে অনেকগুলি ক্রিম বিস্কিট । ” আমাকে দেখে আম্মু বলল , ” ছেলেটাকে দিয়ে আয় ” আমি ঠায় দাড়িয়ে বললাম , ” এই ছেলের জন্যে তুমি মাসে কয়শ ক্রিমবিস্কিটের প্যাকেট কিনো ? ” আম্মু হা করে কিছুক্ষন তাকিয়ে হেসে ফেলল , ” যা দিয়ে আয় ” ” এত আদর কইরোনা , এরে বেশি আদর দিয়ে ফেললে শেষে তোমার মেয়ের জামাইরা আর আদর পাবেনা ”
আমি ট্রে টা হাতে নিয়ে সময় নষ্ট না করে ড্রয়িং রুমের দিকে পা বাড়ালাম । চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে , অঝোর ভাই আবার ঠান্ডা চা মোটেই পছন্দ করে না ।
দ্বিতীয় ক্রিম বিস্কিটটায় কামড় বসিয়ে অঝোর ভাই আমাকে বলল , ”নীরা কোথায় গেছে ?” ” নীরাপু সকালে বড়খালামনির বাসায় গেছে , এখনও আসেনাই , এসে পড়বে ” ” আমি ওর কাছ থেকে নোট নিতে আসলাম , আর ও লাপাত্তা , কিছু হইল ?” আমি চুপ করে থাকলাম , অনেক ইচ্ছা হল যে বলি , ”হু কিছু হবে ক্যামনে ? আপনের লাগি চা বিস্কিট তো মাগনা ! ” কিন্তু আমি বললাম না, চুপ করেই থাকলাম । চা খেতে খেতে অঝোর ভাই আমার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল , ” ইরাবতী , তোমাকে সুন্দর লাগছে , খুব সম্ভবত কপালের ঐ টিপ টা সুন্দর ” আমি অপ্রস্তুতের মত তাকাতেই দেখি সে উঠে দাড়িয়েছে ,শার্টের হাতায় চশমার গ্লাস মুছতে মুছতে বলল , ” বদ মেয়েটা তাহলে আর আসলো না । নীরা ফাজিলটাকে বইল যে আমি………” কলিং বেলের আওয়াজ । নীরাপু এসে পড়েছে ।
নীরাপু আর অঝোর ভাইয়া খুব ভাল বন্ধু , ইউনিভারসিটিতে এসে বন্ধুত্ব , এখন দুজনই মাস্টার্স করছে রসায়নে । এই বন্ধুত্বের খাতিরেই আমাদের বাসায় অঝোর ভাইয়ার যাতায়াত । নীরাপু বাসায় এসে অঝোর ভাইকে দেখে চোখ কপালে তুলে বলল , ” তুই ?” অঝোর ভাই ঠোঁট উলটে বলল , ” আসছিলাম তোর থেকে নোট নিতে , তোরে দেখতে না ” ” আহা , একটা ফোন দিয়ে আসতি , তাইলেইতো ” ” আমিতো ভাবলাম এই বৃষ্টি বাদলার দিকে তুই বাসাতেই থাকবি ” ” যাক , ট্রে ও দেখি আছে , চা বিস্কিট তো খাইছিস , এখন বিদায় হ , যা ” ” ওরে ঝাড়ুমুখি , আমি এখনি যাইতাম , কাল ক্যাম্পাসে আসলে ফোন দিস , আমি হলেই আছি ” অঝোর ভাই চলে গেল । আমাকে একটা ” বাই ” ও বলল না । তার চশমার কাঁচ টা যে ঘোলা হয়ে গিয়েছে সেটাও তো বলা হল না । খুব খারাপ লাগল । এসব আজেবাজে ছেলেকে আম্মু কেন ঘরে এনে চা বিস্কিট খাওয়ায় ?
আমি নীরাপুর ঘরে গিয়ে দেখি আপু ফ্রেশ হয়ে টাওয়েলে মুখ মুছছে । এটা সেটা কথার পর বললাম , ” আচ্ছা নীরাপু , অঝোর ভাই এত বাসায় আসে কেন ? ” নীরাপু চোখ মেরে বলল ,” কি জানি , মনে হয় আমার প্রেমে পড়েছে ” হৃৎপিণ্ড হতে সরাসরি অন্ননালীতে উঠে আসা কষ্টের একটা স্রোত আমি ঢোক গিলে নামিয়ে দিলাম , বললাম , ” নীরাপু , তুই কি অঝোর ভাইয়া কে পছন্দ করিস ? ” ” করবোনা কেন ? আমরা কত ভাল বন্ধু তুই তো জানিস ” আমি আরেকবার ঢোক গিলে বললাম , ” আমি বলছিলাম ভালবাসিস নাকি ?” নীরাপু ঝট করে আমার চোখের দিকে তাকাল । আর তাকানোর সময় পেলনা , আমার তো চোখ ছলছল করছে । নীরাপু বলল , ” ইরা তুই এখন ঘরে যা ” আমি চলে আসলাম আমার ঘরে। আয়নায় তাকিয়ে কপালের টিপটা খুলে রেখে দিলাম । এর আর দরকার নেই ।
আমি এবছরই ভার্সিটিতে উঠেছি , কিন্তু এই চুপচাপ ভাবের কারনে ” বন্ধু , আড্ডা , গান ” আমাকে স্পর্শ করেনা । আর ভার্সিটির বাইরে এই আমি পড়ে আছি আমার থেকে প্রায় ছয় বছরের বড় আমার বড় বোনের বন্ধু এই অঝোর ভাইকে নিয়ে । নিজের উপর রাগ লাগে , আমার সব বন্ধুর সমবয়সী প্রেম , অথবা দুএক বছরের পার্থক্য , অথচ আমি এত বড় একটা ছেলের মাঝে কি যে পেলাম আমি নিজেই বুঝিনা । এমন এক ছেলের প্রেমে ডুবে আছি যে কিনা আমাকে নিতান্তই এক পিচকি ভাবে , যে কিনা সম্ভবত আমার বোন কেই পছন্দ করে ,এবং হয়ত নীরাপু ও করে । আমার এই দুঃস্বপ্নের সমাপ্তি কোথায় সেটা খুব জানতে ইচ্ছে করে । একদিন দুপুরে আমি ভার্সিটি থেকে বাসায় এসে কেবল ফ্রেশ হয়েছি ,হঠাত নীরাপুর ফোন আসল, ও বলল , ও এখন হাতির ঝিলে আছে , একটু পর অঝোর ভাই আমাকে নিতে আসবে , আমি যেন তার সাথে হাতির ঝিলে যাই , তিনজন মিলে নাকি অনেক মজা হবে । আমি হ্যা না বলার আগেই নীরাপু ফোন রেখে দিল । আমি বুঝতে পারছিলাম না কি করব , আম্মুকে গিয়ে যখন বললাম , আম্মু বলল , ” হ্যা নীরা আমাকে সকালে বলেছে , যা ঘুরে আয় , একদম তো বেড়াতেই চাস না ” আমি ইতিউতি করে রেডি হয়ে গেলাম । আমার রাজি না হবার তো কারন নেই । কিন্তু ওখানে গিয়ে আমার সত্যিই ভাল লাগবে নাকি নীরাপু আর অঝোর ভাইকে একসাথে দেখে আমার চোখ ছলছল করবে সেটা নিয়েই ভাবছিলাম । অবশেষে আমি অঝোর ভাইয়ের সাথে বের হলাম , রাস্তায় কিছুক্ষণ পরপর নিজের গায়ে চিমটি দিয়ে দেখছিলাম আমি স্বপ্ন দেখছি নাকি । আমি ভেবেছিলাম অনেক কথা হবে, কিন্তু সারাটা রাস্তায় অঝোর ভাই মাত্র একটা কথা বলেছে ,” টিপ টা গোলাপি কেন ?” হতাশ হয়ে আমি আর উত্তর দেইনি , গোলাপি জামার সাথে কি বেগুনি টিপ পরব ? আজব ক্যারেক্টার ।
হাতিরঝিলে গিয়ে অবাক অবস্থা , আপুকে খুঁজে পেলাম না । অঝোর ভাইয়া বারবার তাকে ফোন দিচ্ছে , নীরাপু ধরছেওনা । একসময় নীরাপু নিজেই ফোন দিল , ও কি বলল সেটা তো আমি শুনলাম না , শুধু শুনলাম অঝোর ভাই রাগি গলায় বলছে , ” তুই যখন আসবিই না , তো আমাকে কেন বললি ইরা কে নিয়ে আসতে ? সেলুকাস ! ” ফোন রাখার পর আমার দিকে তাকিয়ে বলল , ” তুমি জানতে তোমার বোন আসবেনা , রাফির সাথে ঘুরতে যাবে ?” আমি আকাশ থেকে পড়লাম , ” মানে ? কি বলছেন ? আমি আপনার সাথে ইচ্ছে করে এসেছি ?আমার কি এত শখ? আর রাফি কে ?” অঝোর ভাই বিরক্ত মুখে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল । আমি বললাম , ” আপনে থাকেন । আমি গেলাম । ” আমি পা বাড়াতেই আমার সামনে এসে দাড়াল , বলল , ” রাফি তোমার দুলাভাই । আর কোথায় যাচ্ছ এখন? আন্টি কে বুঝানোর জন্যেই নীরা এই নাটক ফাঁদছে , তুমি বাসায় গেলে কেমনে হবে ? ” আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম , ” আমার বোন কচি খুকি না যে তাকে বাসায় আটকে রাখা হবে ” অঝোর ভাই রেলিং এ হেলান দিয়ে বলল , ” এখান থেকে এক পা ও যেন নড়তে না দেখি ।” আমার চোখ ছলছল করে উঠল । অঝোর ভাইয়ের এই সুস্পষ্ট উদাসীনতার কারন যে আমার নীরাপু তা আমি বুঝতে পারছিলাম । খুব অভিমান হল , বর্ষার সহজাত কৌশলে আকাশে কখন মেঘ জমল আমি টের ও পেলাম না । ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল । অঝোর ভাই ঠায় দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগল , আমার সাথে একটা কথাও বলল না , আর আমি ভিজতে ভিজতে কাঁদতে লাগলাম । এ কেমন ছেলের প্রেমে পড়লাম , আমার থেকে এত বড় একটা ছেলে সে কিনা আমার কোন আবেগ ই বুঝেনা । সন্ধ্যা সাতটায় আমাকে বাসার সামনে নামিয়ে দিল সে । আমি বাসার দিকে পা বাড়াবার আগে তার দিকে ফিরে বললাম , ” আপনি একটা খারাপ মানুষ , আর কখনো আমাদের বাসায় আসবেন না ”
এরপর কেটে গেল অনেক গুলো দিন । অঝোর ভাই আমাদের বাসায় আর আসে নি । এর মাঝেই একসময় হুট করে নীরাপুর সাথে তার ভালবাসার মানুষ রাফি ভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেল । কমিউনিটি সেন্টারে অনুষ্ঠান হয়েছিল , আমি শুনেছিলাম সে ওখানে গিয়েছিল , আমার সামনে আসেনি তাও । কিন্তু আমি তো তাকে ভুলতে পারিনা । আমার দিনগুলি অসহ্য আর রাতগুলি মর্মান্তিক ভাবে কাটতে লাগল ।
ছয় সাত মাস পর এক শীতের বিকেলে আমি প্রতিদিনের অভ্যাস মত জানালা দিয়ে কাঠগোলাপ গাছের সৌন্দর্য দেখছিলাম , হঠাত দেখলাম , চাদর মুড়ি দিয়ে অঝোর ভাই আমাদের বাসার দিকে আসছে । কতদিন পর তাকে দেখলাম । একটা কলিং বেলের আওয়াজ শোনার জন্য আমার কর্ণ যুগল ব্যাকুল হয়ে উঠল । কিন্তু পনের মিনিট কেটে গেল , কোন আওয়াজ নেই , সে আসল না ,আমি কি ভুল দেখলাম । অঝোর ভাইয়ের জন্য আমি কি শেষমেশ পাগল হয়ে গেলাম । আমি ঘরে থাকতে পারলাম না , দরজা খুলে বের হলাম । এদিকওদিক দেখে দেখে একছুটে চলে গেলাম ছাদে । দেখলাম , অঝোর ভাই রেলিঙ্গে ঠেস দিয়ে সেই চিরচেনা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে । আমি হাঁপ ছাড়লাম , যাক আমি পাগলের মত বিভ্রম দেখিনি , সে সত্যিই এসেছে । কিছুক্ষণ হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে চলে যাওয়ার জন্য ফিরলাম , কিন্তু হঠাত সে পিছু ডাকল , ” এই মেয়ে , এদিক আসো ” আমি গুটি গুটি পায়ে এগুলাম , কি বলব বুঝছিলাম না , অঝোর ভাই বলল , ” ছাদে কি ?” আমি থতমত খেয়ে বললাম , ” গাছে পানি দিতে এসেছি ” ” ও , পানি কই ?” আমি বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকলাম , আমি মারাত্মকভাবে ধরা খেয়েছি । সে বলল , ” ইরাবতী , এখানে এসে দাড়াও ” আমি নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে গেলাম । সে ফোস করে দম ছেড়ে বলল ,” আচ্ছা ইরাবতী , চার বছর আগে তোমাদের বাসায় যখন প্রথম গিয়েছিলাম তুমি তখন কোন ক্লাসে যেন পড়তে ?” ” ক্লাস টেন ” ” হুম টেন , পিচকি একটা মেয়ে তার সাইজের চেয়ে বিশাল আকারের ভাব নিয়ে বসে থাকত । কিছু বললেই তার চশমার ওপাশের ছেলেমানুষি পুকুরে জল থইথই করত । আমার কি যে মায়া লাগত । বলতে ইচ্ছে করত , ইরা তুমি এত মায়াবতী কেন ? বলতে পারতাম না , তাই ‘ ইরা মায়াবতী’র বদলে ইরাবতী বলে ডাকা শুরু করলাম । শুধু এই পিচ্চিটাকে দেখার জন্য যেতাম বারবার । একসময় আবিষ্কার করলাম ,আমি দাদার আমলের মত আমার চেয়ে ছয় বছরের ছোট একটা মেয়ের প্রেমে পড়েছি, অনেকদিন ভেবেছি বলব কিন্তু পিচ্চিটা যে অনেক বেশি পিচ্চি , তাকে এসব বড় বড় কথা কিভাবে বলব সেই ভাষা পেতাম না , আজ বললাম ” আমার চোখ আবার ছলছল করে উঠল । শুনলাম সে বলছে, ” টিপ মিসিং কেন আজকে ?” আমি ভাঙ্গা গলায় বললাম,” ভুলে গেছি ” অঝোর ভাই পকেট থেকে একটা টিপের পাতা বের করে আমার হাতে দিল , দেখি সবই নীলটিপ । ” সব নীল ?” ” হুম আমার ইরাবতীর কপালে শুধুই নীল জোছনা থাকবে ”
আমি ছলছল চোখে আকাশের দিকে তাকালাম , শীতের কুয়াশা মাখা আকাশটাতে আমি হঠাত করেই নীল জোছনা দেখতে শুরু করলাম ।