রাস্তার ওপারে চোখ পড়লো একটা মেয়ের দিকে। মেয়েটাকে দেখতে রিমির মতোই লাগছে। হ্যা এটা রিমিই। জোরে ডাক দিলাম, কিন্তু গাড়ির প্রচন্ড শব্দে হয়তো আমার ডাক শুনতে পায়নি।কিছু বুঝতে পারছিলাম না। কিছু না ভেবেই রাস্তার মধ্যে থেকেই দৌড়ে রাস্তা ক্রস করলাম। কিন্তু ততক্ষনে রিমি একটা সাদা গাড়িতে উঠে গেছে। গাড়িটার পিছনেও ছুটলাম,কিন্তু ওর দেখা পেলাম না।
.
গাড়ির স্পিডের সাথে আমার দৌড়ের সমন্বয়
করা আর সম্ভব না। রিমির গাড়িটা আর ৫-৬টা সাদা গাড়ির মধ্যে মিলিয়ে গেলো। রিমির দেখা আর পেলাম না।
.
রিমি আমার বন্ধু। বন্ধু মানে এতোটাই কাছের যে
আমরা একজন আরেকজনকে ছাড়া এক মুহুর্তও
থাকতে পারতাম না। কিন্তু এই প্রতিটা মূহুর্তই
কাটতো আমাদের ঝগড়ায়। কারন আমি সব ক্ষেত্রেই অকর্মণ্য, মানে কোনো কাজই ঠিক মতো করতে পারতাম না।তাই রবি ঠাকুরের অপরিচিতা
গল্পে অনুপমকে সম্বোধন করে বলা মাকাল ফলের সাথে আমাকেও তূলনা করা যেতে পারে। কলেজে ভীরের মাঝে ঢুকে বোর্ডের রেজাল্টও দেখার ক্ষমতা ছিলো না আমার। রিমিই আমার সব কাজ গুলো সামলে নিতো। আমার কলেজ যাওয়া থেকে পড়াশুনার জন্য ফোনে আমাকে এলার্ট করে দিতো। আর আমাকে অকর্মণ্যের ঢেঁকি বলে সব সময় ঝগড়া করতো।
.
এসব দিনের মতো একদিন আমাদের এই ঝগড়ার বিশেষ কার্যক্রম চলছিলো। কিন্তু সেদিনের বিষয়টা ছিলো আলাদা। আমাকে বাইক চালানো শিখতে হবে, আর রিমিকে পিছনের সিটে নিয়ে চালাতে হবে।
কিন্তু আমি তো সাইকেলই ঠিক মতো চালাতে
পারিনা। যতটুকু পারি সেটাও রিমিই আমাকে শিখিয়েছে। এখন বাইক কিভাবে চালাবো!! সেদিন কোনো ভাবে ওকে কাটিয়ে বাড়ি চলে আসলাম।
.
পরের দিন সকালে আমার ঘুম ভাঙলো ফোনের
রিংটোনে। হাতে নিয়ে দেখলাম রিমির ফোন। ফোনটা হাতে নিয়ে কল কেটে দিলাম।
আবার কল দিলো আবার কেটে দিলাম। আবার
কল দিলো আবার কেটে দিলাম। আবার কল, নাহ এবার রিসিভ করলাম।
রিসিভ করার পর রিমি যে ক্যাট ক্যাট করেছিলো সেটা না শোনাই ভালো।
.
: ঘুমটাতো ভাঙছোস। এখন চিল্লানি বাদ দিয়ে আসল কথা বল।
: তোকে বাইক চালানো শেখানোর জন্য একজন টিউটর খুজে পাইছি।(রিমি)
:বাইক চালানোর জন্য টিউটর! এই তুই এই বাইক
টাইকের কথা বাদ দে তো। আমি পারবো না।
: তুই পারবি না তোর ঘাড় পারবে। আমার এক মামা আছে। তার বাইক আছে। সে তোকে বাইক
চালানো শেখাবে। তার সাথে আমি কথা
বলেছি। তুই আজকে সকাল ১০ টার মধ্যে
মসজিদের পাশের মাঠে চলে আয়, মামা আর
আমি সেখানেই থাকবো। (রিমি)
: আচ্ছা ঠিক আছে, ফোন রাখ। আমি আসছি।
.
বাধ্য হয়েই গিয়েছিলাম সেখানে, নাহলে
রিমি আমাকে বাইকের তলায় রেখে পিষে ফেলতো। সেদিন রিমি ওর মামার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে চলে আসলো। ওর মামা লোকটা খারাপ না, খুব নম্র আচার আচরন।
.
সেদিন থেকেই আমার ট্রেনিং শুরু হলো। প্রথম দু একবার পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু কয়েক দিনের
মধ্যে খুব ভালোভাবেই শিখে গেলাম। রিমি তো শুনেই বলছিলো “বলেছিলাম না তুই পারবি!”
.
৩ দিন পর, রিমিকে ফোন দিয়ে বলেছি রেডি
থাকতে। আজ ওকে নিয়ে ঘুরতে যাবো। বাইকও
রেডি বড় ভাইয়ার কাছে থেকে ওর বাইকটা চেয়ে
নিয়েছি।
রিমির বাসার সামনে পৌছেই দেখি ও ওর
বাসার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
আজ ওকে মনে হয় একটু বেশিই সুন্দর লাগছে। হতেও পারে আমার চোখের ভূল। আর ও এমনিতেও সুন্দর। ও চশমা পরে, যার কারনে ওকে সবসময় একটু বেশিই সুন্দর লাগে।
.
ও উঠে পিছনে বসলো, ওকে নিয়ে রহনা দিলাম
নদীর পারে। যায়গাটা ওর আর আমার খুব পছন্দের।
আমাদের এখান থেকে ৩০ মিনিট লাগবে সেখানে যেতে।
আজ রিমিকে একটু বেশিই খুশি খুশি লাগছে।
জিজ্ঞেস করলাম:-
: কিরে এতো খুশি খুশি লাগছে, কাহিনী
কি???
:- কাহিনী কিছু না। আমি তো খুশি এই কারনে যে আজকে অকর্মণ্যের ঢেকিঁ আমাকে তার পিছনে বসিয়ে সওয়ার করাচ্ছে।(রিমি)
:- তোর ইচ্ছা পূরন করলাম, তারপরেও আমাকে আজ তুই অকর্মণ্যের ঢেঁকি বললি???
:- আচ্ছা তোকে আর অকর্মণ্যের ঢেকিঁ বলবো
না। আর তোকে অনেক অনেক অনেক থ্যাংকস
আমার কথা রাখার জন্য।(রিমি)
:- হইছে হইছে চুপ যা।জুতা মেরে গরু দান করতে
হবে না।
.
বাইকে বসে এমন ভাবেই চলছিলো আমাদের
খুনসুটি। কিন্তু তারপরের অংশটা একটু অন্যরকম।
.
রাস্তা প্রায় ফাকা, স্পীড তখন প্রায় ৮০ তে। রিমি অনেকবার বলেছিলো এতো জোরে বাইক না
চালাতে কিন্তু আমি শুনিনি। তখনই বিপদটা ঘটলো, আমাদের সামনে থেকেই আমাদের বরাবর একটা ট্রাক আসছে।
.
গ্রামের বড় রাস্তা তাই মাঝে কোনো আইল্যান্ড
নেই, দুই পাশ থেকেই গাড়ি চলে। আমাদের হাতে
একটাই উপায়, বাম পাশে যেতে হবে। কিন্তু বাম
পাশে রাস্তায় আমাদের সামনে প্রায় এক ফুট
ভাঙা। এ স্পীডে সেখানে নেয়াও সম্ভব না,হাতেও সময় কম। সামনে গেলেও ট্রাকের সাথে ধাক্কা লাগবে, তাই সাত পাচঁ কিছু না ভেবেই বাইকটা বাম পাশে নিলাম, সাথে জোরে ব্রেক কষলাম।
.
তখনই বাইকটা উল্টে গেলো। জানি না কোথায়
সিটকে পরলাম। ডান পা টা কিছুর সাথে জোরে আঘাত করলো। বাইকটা শূন্যে উঠেই ছিটকে গেলো। রিমি বাইক থেকে কয়েক হাত দূরে গড়িয়ে
গিয়ে পড়লো। পা টা হেচড়ে হামাগুড়ি দিয়ে রিমির
কাছে গেলাম। দেখলাম রিমি অজ্ঞান হয়ে
গেছে,ওর মাথায় প্রচন্ড রক্ত। তখনি কতো গুলো মানুষ এসে আমাকে তুলে নিলো। তারপর…
.
পরে দেখতে পাই আমি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি, ডাক্তার এসে আমার কি কি যেন চেক করলো।
তারপরে আব্বু- আম্মু আরো অনেকে আসলো,
আম্মু কাদঁছে।
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম রিমির কথা। ভাইয়া পাশেএসে বললো রিমির অবস্থা খারাপ হওয়ায় সদর হাসপাতালে নিয়ে গেছে।
জানি না রিমি কেমন আছে। আমার জন্যেই আজ ওর এই অবস্থা। ওকে দেখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সবাই বলেছিলো পরে আমাকে নিয়ে যাবে।
.
৮ দিন পরে গিয়েছিলাম সদর হাসপাতালে। ওর
কেবিনে ঢোকার সময় কেমন যেনো কষ্ট
হচ্ছিলো। রিমি ঘুমিয়ে ছিলো। ডাক্তার বললো ও ঠিক মতো কথা বলতে পারে না। ওর সুস্থতা জ্ঞান
ফেরার পরই বোঝা যাবে। আর এক মুহুর্তও
থাকলাম না, তখনই হাসপাতাল থেকে চলে আসলাম।
.
প্রায় ১ মাস পর রিমিকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ
করেছে। খবরটা রাব্বির কাছ থেকে পেয়েছি।
কিন্তু তার সাথে আরেকটা খবরও শুনলাম।
রিমির ঠিক মতো কোনো কিছুই মনে থাকে না। আর সহ্য করতে পারছিলাম না। ফোনটা বের করে
রিমিকে ফোন করেছিলাম। ফোনটা ওর মা ধরেছিলো, আমার গলা শুনে রিমিকে ফোনটা দিলো। হ্যালো শব্দটাও বলতে যেনো কষ্ট হচ্ছিলো আমার। তবুও কাপাঁ কাপাঁ কন্ঠে বললাম
: হ্যালো, রিমি!
: কে বলছেন??? (রিমি)
: দোস্ত আমি রেহান।
: কোন রেহান?
কথাটা শুনে আমার মাথা আর কাজ করছিলো
না। ওর মা ফোনটা নিয়ে বললো
: বাবা এক্সিডেন্টের পর ওর স্মৃতিশক্তি ক্ষীন হয়ে
গেছে। কোনো কিছইু ঠিক করে মনে করতে পারে না। কথাও ঠিক মতো বলতে পারে না।
তুই পারলে একবার রিমিকে দেখে যা।
: হ্যা, কাকি আমি এখনি আসছি।
.
ফোনটা রেখেই বাড়ি থেকে বের হয়ে রিমির বাড়িতে গেলাম। বাসায় ঢুকার সাথে সাথে কাকি কিছু একটা বলছিলো। সেদিকে খেয়াল না করে
সরাসরি রিমির ঘরে গেলাম। রিমি ওর ঘরেই শুয়ে
ছিলো। ওর মাথায় তখনো ব্যান্ডেজ ছিলো। আমাকে দেখে উঠে বসলো, আর আধো আধো ভাষায় জিজ্ঞেস করলো
:- কেমন আছিস?? হাসপাতালে তো আমাকে
দেখতেই যাসনি। ভূলে গেলি নাকি আমাকে?? আর শোন তোকে একটা কথা বলার আছে।(শেষ কথাটা একটু ক্ষীন স্বরে বললো)
.
:- ….., (আমি কিছুই বলতে পারছিলাম না।)
ওর কথা গুলো শুনেই বোঝা যাচ্ছে ওর কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে।
আমার জন্যেই আজ রিমির এই অবস্থা হয়েছে,
আমি কেন তখন ওর কথা শুনিনি, শুনলে হয়তো আজ ওর এ অবস্থা হতো না।
:- দোস্ত আমার জন্যে আজ তোর এই অবস্থা।
আমি সত্যি অকর্মণ্যের ঢেঁকি। আমি খুব খারাপ।
:- আচ্ছা তোর এই অভ্যাসটা কখনো যাবে না???
সবসময় ভেঙে পরিস, আর আমিই তোকে সব সময় সান্তনা দেই। আমাকে দ্যাখ, আমি তো ঠিকই
আছি। কিন্তু দোস্ত আমি সত্যিই এখন আর সহজে কিছু মনে রাখতে পারি না। তখন সত্যিই আমি বুঝতে পারিনি যে ফোনে তুই ছিলি। (রিমি)
.
চোখটা মুছে ওকে জিজ্ঞেস করলাম
:- কি যেনো একটা কথা বলবি???
:- হ্যা, কি যেনো একটা বলতে চেয়েছিলাম।
কি চেয়েছিলাম??? দেখলি সেটাও মনে করতে পারছি না।
.
ওর অবস্থা দেখে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিলো। সেদিন আর কোন কথা না বলে চলে এসেছিলাম। তারপরে আর রিমির সামনে যেতে পারতাম না। কেন যেনো খুব কষ্ট লাগতো। কিছুদিন পরে ওর ফোনে কল দেয়ার পর দেখলাম ওর ফোনের সুইচ অফ। ওর বাসায় গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে গিয়ে খবর পেলাম। ওরা নাকি এ বাসা ছেড়ে ঢাকা চলে গেছে।
.
তারপর রিমির এক বান্ধবীর কাছে থেকে জানতে
পারলাম ও নাকি কিছুদিন আগেই কানাডা চলে গেছে।
হুম, রিমি হয়তো সেদিন আমাকে এটাই বলতে চেয়েছিলো। কিন্তু বিধাতা সে শক্তিটুকুও ওর
থেকে কেড়ে নিয়েছে।
.
এরপর আর রিমির সাথে কোনোদিন দেখা বা কথা কোনোটাই হয়নি।
তারপর আমরা পরিবার সহ ঢাকা চলে এসেছি। এখানে অনেক কষ্টে একটা পাবলিক ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি। রিমিকে সবসময় অনেক মনে করতাম। তারপরে আমিও আমার মতো ব্যাস্ত হয়ে যাই।
.
আজ ৬ বছর পর আমি আবার রিমিকে দেখলাম
রাস্তার ওপারে। ওর কাছে যেতে যেতেই ও একটা
সাদা গাড়িতে করে চলে গেছে। গাড়িটার পিছনে ছুটেও ওর দেখা পাইনি।
.
সেদিন বিধাতাই রিমিকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে
নিয়েছে। আজ যখন আবার ওর দেখা পেলাম, তখনও ওকে কিছুই বলতে পারলাম না। জানি না বিধাতার কি ইচ্ছা। পৃথিবীটা গোল, বিধাতার ইচ্ছায় আবারো রিমির সাথে দেখা হতে পারে। সেই প্রতীক্ষায় রইলাম আমি।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক