একমুঠো অপেক্ষা

একমুঠো অপেক্ষা
ঈশানের অপেক্ষায় বসে আছি।আজ প্রায় তিন মাস পর ওর সাথে দেখা হবে।এই তিনমাস ও বান্দরবানের হিলট্রাকে ছিল।আমাদের সেই প্রিয় কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসেছি।এলোকেশে,সবুজ শাড়ীর সাথে দুহাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি।ঠিক যেমনটা ঈশানের পছন্দ।পাশের ফুচকাওয়ালা ছেলেটা দেখেই বুঝে ফেলেছে।একগাল হেসে বলল,,
–” ঈশান ভাই আসছে তাই না তনু আপু?
–” হ্যাঁ ভাই,ও আসছে।
–” তাহলে আজকে আমার দোকান থেকে ফুচকা খেতে হবে কিন্তু।
–” অবশ্যই খাবো।তোমার ভাইয়া আসুক।
ছেলেটা বড্ড সহজ সরল।কি সুন্দর মিষ্টি করে হাসে।তিন বছর ধরে ওকে চিনি।ঈশানের সাথে সম্পর্কের শুরুটা হয়েছিল এই জায়গায়।তখন থেকে ঘুরতে এলেই ওর দোকানে বসি। তিনবছর আগে আমাদের একসাথে পথচলা শুরু হয়।অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের মাঝামাঝি সময় চলছে তখন।ভার্সিটিতে যাওয়া আসার পথে প্রায়ই ফলো করতো ঈশান।বুঝতে পারতাম কিন্তু এড়িয়ে চলেছি।ঈশান তখন সবেমাত্র ডিফেন্সে জব পেয়েছে।জয়েনিং লেটার পেয়ে পরদিনই আমাদের বাসায় চলে গিয়েছিল বাবা মাকে নিয়ে।আমাদের বাসা থেকেও সবাই এককথায় রাজি হয়ে গেছিল।তারপর একদিন বান্ধবীদের নিয়ে এখানে ঘুরতে আসি।হঠাৎই কোত্থেকে ঈশান এসে সবার সামনে প্রোপজ করে বসলো।ভাবতেও পারিনি পারিবারিক ভাবে বিয়ে ঠিক হওয়া ছেলে এভাবে প্রোপোজ করবে।লজ্জারাঙা মুখে গ্রহন করেছিলাম ওর দেওয়া একগুচ্ছ শুভ্র কদম ফুল।বান্ধবীদের বিদায় দিয়ে সারা সন্ধ্যা ওর সাথে ঘুরেছি।হাতে হাত রেখে হেঁটে বেরিয়েছি পুরো রাস্তা জুড়ে।কাঁধে মাথা রেখে সূর্যাস্ত দেখেছি। সুমনের ডাকে চমকে উঠলাম।ফুচকার দোকানের ছেলেটার নাম সুমন।ও চেঁচিয়ে বলছে,,
–” আপু অনেক্ক্ষণ তো হয়ে গেল।ভাইয়া এখনও কেন আসছেনা?
সত্যি তো।এতোক্ষণ খেয়ালই করিনি।ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি বারটা বেজে গেছে।তারমানে দু’ঘন্টা ধরে আমি বসে আছি।কিন্তু ঈশানের আসতে এতো দেরী কেন হচ্ছে।ফোন দিয়ে যে জিজ্ঞেস করবো তারও উপায় নেই।ট্রেনিং টাইমে নিজেদের ফোন ব্যবহার করতে পারে না।তিনমাসে যা দু-একবার কথা হয়েছে সেটা অফিসের ফোন দিয়ে।তাও ধরাবাঁধা সময়ে পাঁচ মিনিট কথা বলা যেত। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চললো।কিন্তু ঈশানের দেখা নেই।বাড়ি থেকে আম্মু দু-একবার কল দিয়ে বাড়ি চলে যেতে বলেছে।কিন্তু আমি যে ঈশানকে কথা দিয়েছি ওকে নিয়েই বাড়ি ফিরব। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে।সেই সাথে সুমনের প্রশ্নের ঝুলি বেড়েই চলেছে।আর বাড়ছে আমার অস্থিরতা।বসা ছেড়ে পায়চারি করতে লাগলাম।চোখের কাজল লেপ্টে গেছে।খোলা চুলগুলোকে দমবন্ধকর কোন বস্ত মনে হচ্ছে।তাই পেঁচিয়ে হাতখোপা করে রাখলাম। ঈশানের জন্য এই তিন বছর আমিই অপেক্ষা করেছি।সবসময় নির্দিষ্ট সময়ের কিছুটা আগে এসে বসে থাকতাম।ওর জন্য অপেক্ষা করতে ভালো লাগতো।ও এসে দূর থেকে আমাকে দেখতে পেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলতো,,
–” আজও দেরী করে ফেললাম তনু।
ওর বোকা বোকা ফেসটা দেখে ভীষণ হাসি পেত।কিন্তু মুখে কপট রাগের আবরন ফুটিয়ে রাখতাম।আর ও সেটা সত্যি ভেবে রাগ ভাঙাতে আসতো।ওর রাগ ভাঙানোর উদ্ভট কৌশলে না হেসে পারতাম না।কিন্তু আজ যে সত্যিই রাগ হচ্ছে আমার।ঈশান কেন আসছে না রাগ ভাঙাতে। সন্ধ্যাে হয়ে এসেছে।চারপাশের প্রকৃতিটা গুমোট বেঁধে আছে।এমন সময় আব্বু আর ঈশানের ছোট ভাই ইরাদ এলো।আব্বুর চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে।আব্বু কাছে এসে বলতে লাগলো,,
–” তনু চল মা বাসায় চল।
–” না আব্বু,আর একটু অপেক্ষা করি।ঈশান এসে আমাকে না দেখলে রাগ করবে।ও একদম অপেক্ষা করতে পারে না।
–” ভাইয়া বাড়ি চলে এসেছে তনু। ইরাদের ভেজা কন্ঠস্বর শুনে ওর দিকে তাকালাম।ও আমার দিকে তাকাচ্ছে না।আমিই ওর সামনে গিয়ে বললাম,,
–” কি বললি।ভাইয়া এসেছে মানেটা কি হ্যাঁ?
–” হ্যাঁ তনু ভাইয়া কিছুক্ষণ আগেই পৌঁছেছে বাড়িতে।তুই চল।
–” যাবোনা আমি।কেন এসেছিস তুই।তোর ভাইয়ের জন্য সকাল থেকে এখানে অপেক্ষা করে চলেছি।
আর সে বাড়িতে এসে বসে আছে। একপ্রকার চেঁচিয়েই বলছিলাম কথাগুলো।চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।ইরাদ এসে দুহাতে আমাকে আগলে গাড়িতে বসালো।আমি তখনও কেঁদে চলেছি।ঈশানের ওপর অভিমানটা বড্ড বেশি জেগে উঠেছে। ভেজা তোয়ালে বিছানায় রাখার অভ্যাস কোনদিন গেল না আর।একটা মানুষ কতটা অগোছালো হতে পারে তা ওনাকে দেখে শেখা উচিত।
–” কি বিরবির করছো তনু?
–” বিরবির করছি কোথায়,জোড়ে জোড়েই বলছি।তুমি শুনতে না পেলে আমি কি করব?
–” তুমি কি আমাকে ইনডায়রেক্টলি বয়রা বলছো?
–” ইনডায়রেক্টলি বলার কি আছে।তুমিতো এমনিতেই বয়রা।
–” তাই না?আচ্ছা শোন,আমাকে বিকেলেই রওনা দিতে হবে।তুমি জামাকাপড় গুছিয়ে রেখো। হঠাৎই বুকটা কেঁপে উঠলো।ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম,,
–” না গেলে হয় না?
–” তনু মাত্র একসপ্তাহের ব্যাপার।এটাতো আমার কাজ,যেতে তো হবেই।
কপালে আলতো পরশ দিয়ে বেরিয়ে গেল ঈশান।আমি ধপ করে খাটের ওপর বসে পড়লাম।আজও মনে পড়ে দুবছর আগের সেদিনটার কথা। ইরাদ আর আব্বু আমাকে নিয়ে বাড়িতে না এসে হসপিটালে গিয়েছিল।ঈশান তখন আইসিইউর বেডে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে।সারা শরীরে ব্যান্ডেজ,মুখে অক্সিজেন মাস্ক।সহ্য করতে পারিনি ওকে ওভাবে দেখে।অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।
ট্রেনিং থেকে ফেরার পথে ত্রিশ জন যাত্রী সহ ওদের গাড়িটা এক্সিডেন্ট করে।দু’একজন সাথে সাথে মারা গেলেও বাকিদের অবস্থা ছিল শোচনীয়।পুরো ছয় মাস লেগেছিল ঈশানের সুস্থ হতে।এই ছয় মাস ঈশানের সাথে ছায়ার মতো লেগেছিলাম।ওকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে কষ্ট হলেও বেঁচে আছে এটা ভেবে মনকে স্বান্তনা দিয়েছি।একমুঠো অপেক্ষার প্রতিদান হিসেবে ওকে ফিরে পেয়েছি আমি। আজ আবার সেই পাহাড়ি অঞ্চলে যাবে।প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে ঈশানের লাগেজ গুছিয়ে দিলাম।রান্নাবান্না করে অপেক্ষা করতে লাগলাম।ঈশান ফিরল তিনটার দিকে।ওকে খেতে দিয়ে সামনে বসে তাকিয়ে আছি।চোখগুলো ভরে আসছে।ঈশান প্লেটের দিকে তাকিয়েই বলে উঠল,,
–” চোখের পানিটা যেন গড়িয়ে না পড়ে।তাহলে কিন্তু মাইর হবে। এতোক্ষণ না পড়লেও ওর কথা শুনে পানি গড়িয়ে পড়লো।এতোকিছু বোঝে অথচ ও গেলে আমার কষ্ট হয় এটা বোঝে না।ঈশান মুচকি হেসে আবারও বললো,,
–” আমি জানি,কেও একজন কেঁদে সমুদ্র বানিয়ে ফেলবে।তাই দুটো টিকেট কেটেছি।তাড়াতাড়ি রেডি না হলে কিন্তু একাই যাব রাঙামাটি। চোখ মুছে ঈশানের দিকে তাকিয়ে দেখি ও হাসছে।আর না বসে রুমে চলে এলাম।কাবার্ড থেকে জামাকাপড় বের করে লাগেজে রাখছিলাম।ঈশান পেছন থেকে এসে একটা প্যাকেট হাতে দিয়ে বলল,,
–” এটা পড়ে রেডি হও। খুলে দেখি একটা সবুজ রঙের জামদানী শাড়ি।একমুঠো পাথরের চুড়ি আর একটা টকটকে লাল গোলাপ।মুচকি হেসে প্যাকেটটা বুকে জড়িয়ে ধরলাম।এটা যে আমার পরম পাওয়া।একমুঠো অপেক্ষার প্রতিদান।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত