সময় বয়ে যায় কিন্তু মানুষের মনের আঘাত কষ্ট তার মনেই রয়ে যায়।সময়ের পরিক্রমায় কিছু ঘটনা বা কাজ মনের মাঝে স্মৃতি হিসেবে রয়ে যায়।আর সমস্যার কারণটা যদি প্রাকৃতিক হয় তাহলে তো আর কিছুই করার নেই।কেউ কেউ এই সমস্যাকে বলেন অভিশাপ আবার কেউ বলে আল্লাহর সৃষ্টি আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই।কিন্তু মানুষ কি তা মানবে বা বুঝবে! কখনোই না।
তারা পারে মানুষকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতে মানুষের দুর্বল স্থানে আঘাত করতে।বড় নিষ্ঠুর এ জগৎ।কেউই কখনোই কাউকে বোঝার চেষ্টা করেনা।
.
.
আজ ২ দিন রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়েছি।খাওয়া-দাওয়া সব ছেড়ে দিয়েছি।সমাজে যেহেতু আমাদের মতো মানুষের মূল্য নাই সেহেতু সমাজের বাইরে থাকার প্রচেষ্টা।তবে কষ্টে নিজের বুকের ভেতরটা কষ্টে চৌচির হয়ে যাচ্ছে, আমার এই সমস্যা তো আমি ইচ্ছা করে তৈরি করিনি আল্লাহ এটা আমাকে দান করেছেন কিন্তু সমাজ এটা কেন মানতে পারছে না।হ্যা,আমি তোতলা।
তাতে কি আমি কি মানুষ না, আমি আপনাদের মতোই রক্তে মাংসে গড়া মানুষ তবে কেন এতো অবহেলা।
.
.
সব অবহেলা নিরবে সয়ে যেতাম।আশা ছিলো ভালো একটা কলেজে ভর্তি হবো,ভর্তিও হলাম।নিয়মিত ক্লাসও করতাম তবে কারও সাথে বন্ধুত্ব করতাম না।কারণ আমি জানি আমার এই সমস্যার কারণে কেউই ভালোভাবে নিয়ে আমার সাথে বন্ধুত্ব করবে না সবাই মজা নিবে।
তাই সবসময় বটমূলে অবসর সময়ে একা বই পড়ে কাটাতাম।দেখতে মাস’আল্লাহ মোটামোটি সুন্দর ছিলাম তাই অনেকেই আমার একাকিত্বের ব্যাপারটা লক্ষ করতো। অনেকেই অনেকভাবে আমার সাথে বন্ধু পাতাতে আসতো কিন্তু আমি তাদের কাউকেই গ্রহণ করিনি।
.
.
দিনটা ছিলো বুধবার আমি প্রতিদিনের মতো গাছতলায় বসে বই পড়ছিলাম, হঠাৎ গোলযোগের শব্দ শুনলাম তাই কান পেতে কিছুক্ষণ শুনলাম কিন্তু কোন লাভ হলো না,কিছুই বুঝতে পারলাম না।তাই বই থেকে চক্ষু সরিয়ে কলেজের গোলযোগের দিকে দিলাম।দেখলাম একটি মেয়েকে নিয়ে কি যেনো তর্ক-বিতর্ক চলতেছে।তাই আর সেদিকে কান দিলাম না নিজের পড়ালেখার দিকে মনোযোগ দিলাম।
.
.
কিছুক্ষণ পর দেখলাম পুলিশ এসে ৩ জনকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেলো তখনি দেখলাম সেই মেয়েটার মুখে বিশ্বজয়ের হাসি,।
কিছুক্ষণের জন্য কবি হয়ে গেলাম,
জানিনা কেন জানি হাসিটা আমার ভালো লেগে গেলো।
লিওনার্দো দ্যা ভিন্ষ্ণ অঙ্কিত মোনালিসার মতোই তাহার রহস্যময় হাসি।চেষ্টা করেও ভোলবার সাধ্য নেই, হাসলে মনে হয়,দীঘির জলে ঢেউ বয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু আমার এই মায়ায় জড়ানো ঠিক হবে না।তাই উঠে পড়লাম গাছতলা থেকে গন্তব্য বাড়ি।
.
.
এভাবেই চলতে থাকে দিন, মাঝে মাঝে তাকে দেখতাম। মেয়েটা অনেকটা চঞ্চল স্বভাবের সবার সাথে মিলে মিশে চলতে পারে।একদিন কৌতুহলবশত একজন থেকে তার পরিচয় জানতে পারলাম।
এলাকার স্বণামধন্য ব্যাবসায়ী কবির চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে ইমা।মেয়েটা অল্পতেই মানুষের মন জয় করতে পারে।
তাহার রুপটা অনেক মনোমুগ্ধকর।
নীলিমার চেয়েও সে যে আমার প্রিয় তা তো আমি ছাড়া আর কেউই জানেনা।চন্দ্রিমার মতোই অবিরত সে আমার আকাশে আলোক বিতরন করে।নীল অপরাজিতার মতই রুপ আছে তার,তাতে কোনো ভুল নেই,কিন্তু এই রুপতো সবার চোখে পড়েনা।
হৃদয়েরর মাঝখানে এর গভীর ছায়া পড়ে।
রমনী হলে তাকে গ্রীক মিউথোলজির ব্লাক ভেনসি নয়তো রবীন্দ্রনাথেরর কবিতার কৃষ্ণকলি বলা যেত নিশ্চয়ই।
বৃহৎ নীল দুটি নয়ন,সেই নেত্রপল্লবী দু’টি যেন শরতের পদ্মের মতো সারাক্ষন স্বচ্ছ জলে ভাসে।
.
.
.
সময় বয়ে চলে সাথে ইমাও আমার মনের ভেতর গেঁথে বসে।কিন্তু এটা যে আমার কল্পনাই মাত্র,আমার সমস্যা কথা শুনলেও সেও একদিন দৌড়ে পালাবে, তাই নিজেকে অনেকটা দূরেই রাখতাম।
হঠাৎ একদিন সে আমার সামনে এলো সবার মতই পরিচিত হলো তবে নিজেকে সংযত রেখে পরিচিত হলাম।আমি তোতলা তবে সবসময় না,অনেকটা উত্তেজনাপূর্বক হলে বেশি কথা আটকে পড়ে।।
প্রতিদিনই সে আসতো আমার কাছে
ইমা আমাকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলো সাথে সাথেই আমার বুকটা ধক করে উঠলো, আমি মায়া বাড়াতে চাইনা তাই উঠে চলে আসলাম সেখান থেকে।
পরদিন কলেজে প্রতিদিনের মতই বসে আছি আজকেও সে হাত বাড়ালে আজও উঠে ক্লাসে চলে এলাম।বুকের ভেতরটা এতো যেনো জ্বলে যাচ্ছিল তারপরও আমি চাই মানুষের হাসির পাত্র হইতে।
.
.
.
এভাবে প্রতিদিনই সে আমার কাছে বন্ধুত্বের আবদার নিয়ে আসতো আমি আর তাকে না করতে পারলাম না।
শুরু হলো নতুনভাবে পথচলা সারাদিন তার সাথে কথা হত না রাতে মোবাইলে এসএমএস কিনে চলতো চ্যাট।যেই ছেলে রাত ১০ পর্যন্ত জাগতে পারতো না আজ সে ফজরের আযান দিলে ঘুমাতে যায়।
ইমাকে নিয়ে হাজারো স্বপ্ন বাসা বাধে আমার মনে। তাকে নিয়ে প্রতিদিনই স্বপ্নের রাজ্যে হারিয়ে যেতাম।
.
আকাশের অসংখ্য তারকার তীব্র কিরনকে ম্লান করে দিয়ে সগৌরবে সন্ধ্যাতারা উদিত হয়ে যেভাবে রজনীর অন্ধকারকে মিলিয়ে দিয়ে সমগ্র আকাশমন্ডলীর বুকে দীপ্তির মহিমা বিরাজ করে ঠিকই তেমনি অমাবস্যার রজনীতে পৃথিবীর সব আলো নিভে গেলে দিগন্ত ছেয়ে যাওয়া গভীর আধারের মাঝে জোনাকির আলোকের মতই আমার বন্ধু আমার এই বিচিত্র প্রকৃতির মাঝে আলোর দিশারি হয়ে এসেছিলো।
.
.
একদিন সে আমার সাথে বসে ছিলো কিছুক্ষণপর সে ক্লাস করতে চলে যায়, আমি বটমূলেই বসে থাকি। হঠাৎ একটা ছেলে আমাকে ডাক দিয়ে নিয়ে যায় মাঠের মাঝে।অনেকগুলো ছেলে সেখানে হকি ব্যাট দিয়ে দাঁড়ানো।আমি আসতে নাম জিজ্ঞাসা করে এক বড় ভাই আমি করুণ সুরেই উত্তর দিলাম জ্বি আমার নাম আআবির।ভয়ে অনেক উত্তেজিত হয়ে গেছিলাম।হঠাৎ পেছনে মাথাটা চিনচিন করে উঠলো বুঝতে পারলাম কেউ একজন আঘাত করেছে আমাকে। ‘ ইমা কি তোর বউ লাগেরে ওর সাথে বসে আগলা পিরিত করিস’ বলেই বড় ভাইও বুক বড়াবড় একটা লাথি মারলেন আমি সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম।উপর থেকে সবাই সবার ইচ্ছেমতোই মারতে লাগলো।কলেজের ভিতর যেনো একটা ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি হলো।
.
.
কিছুক্ষণপর নিজেকে হাসপাতালে আবিস্কার করলাম।পাশে দেখি বাবা-মায়ের কান্না করা ফোলা চোখ।পাশেই দেখি ইমা দাঁড়িয়ে রয়েছে।আমি এতটুকু বুঝতে পারলাম ইমার কারণে আজ আমার এই হাঁল।
পরে ইমা আমায় সব খুলে বলে ওই বড় ভাই নাকি ইমাকে পছন্দ করে কিন্তু ইমা বখাটে টাইপের ওকে দুচোখে দেখতেই পারে না তাই ইমার সাথে যেই ছেলেকে দেখে তাকেই মারে।কিন্তু ভয়ে সে তার আব্বুকেও বলতে পারে না
কিন্তু এতেতো ইমার কোন দোষ নাই।
.
.
হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাসায় আসি।আমরা এই ঘটণার মাধ্যমে অনেকটা গভীর বন্ধুত্বে জড়িয়ে ফেলি।
১ বর্ষ শেষে দ্বিতীয় বর্ষে পদার্পন করি তখনই১ম বর্ষে আমাদের এলাকারই এক ছেলে আমাদেরই কলেজে চান্স পায়।
.
.
.
হঠাৎ একদিন ইমা এসে বললো
‘তুমি নাকি ঠিকমতো কথা বলতে পারোনা তোতলা ‘
আমি মাথানেড়ে ‘হ্যা’সূচক উত্তর দিলাম।
তারপরই আরম্ভ হলো হাজারো অপমানজনক কথা।কথাগুলো এতোটাই মনের ভেতর গেথে গিয়েছিলো যে আমি সেখানেই সাথে সাথে কান্না করে দেই।এতে যেনো সে আরো ক্ষেপে গেলো
আমি এরকম অপমান না সইতে পেরে কান্না করতে করতেই কলেজ থেকে বেরিয়ে বাসায় চলে আসলাম।রুমের দরজা আটকে নিজের মতো করেই কাঁদলাম।কাঁদলে নাকি মনের কষ্টগুলো লোপ পায় তাই কান্নাই যে আমার শ্রেয় উপায়।আব্বু-আম্মু অনেকবার ডাকে কিন্তু আমি তাদের সাড়া দেইনি।পরে জানলাম তারাও আমার মতই আমার জন্য না খেয়ে থেকেছে।সকালে বেলা রুম খুলে বেরিয়ে আসতেই আব্বু-আম্মু যেন বাচ্চাদের মতো কান্না শুরু করে দিলেন।সারারাত নিজেকে অনেক একা ভাবছি না এটা আমার ভূল ধারণা আমার পাশে আমার বাবা-মা আছে।নিজের ভূলগুলো শুধরে কাল থেকে নতুনভাবে জীবন শুরু করবো।আমার পাশে আমার বাবা-মা আছে আমি আর কাউকেই চাই না।
.
.
সকাল বেলা উঠে কলেজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলাম।কলেজ গেটে প্রবেশ করতেই সবাই যেনো কি রকম চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।প্রতিদিনের মতই একটা ক্লাস করে গাছের নিচে বসলাম।হঠাৎ কিছু ছেলে এসে আমার পাশের গাছের নিচে বসেই আমাকে নিয়ে আলোচনা করছে।একজন বলছে, দেখছোস ছেলেটার সাহস কতো, তোতলা হইয়া একটা সুন্দরী মেয়ের দিকে হাত বাড়ায়,ও কি বুঝে না ও কতো বড় গর্দভ।আরেকজন বলছে,আসল কথা হচ্ছে সুন্দরী মেয়ে দেখলে কেউ লোভ সামলাতে পারে না।মেজাজটা বড়ই তীক্ষ্ণ হয়ে গেলো, উঠে চলে আসলাম।ক্লাসে বসলাম তাও দেখলাম সবাই আমাকে হাসিঠাঁট্টা করছে।না এই কলেজে আর আমার থাকা হবেনা।মেয়েটি পুরো কলেজে আমার সমস্যার কথা রটিয়ে দিয়েছে,এখন সবাই মজা লুটবে কিন্তু কেউই আমার কান্নার লুকানো জল দেখবেনা,আর আমি তাদের দেখাতেও চাই না।চললাম স্বপ্নের কলেজকে বিদায় দিয়ে।
গেট থেকে বেড় হতেই একটি বাইকে আমার সামনে এসে কষে ব্রেক করে, অনেকটা ভয়ে পেছনে চলে আসি।চোখ তুলে দেখি সেই বড় ভাইটা ‘দুষ্টু’হাসি দিয়ে ভিতর চলে গেলো।পিছনে বসা দেখলাম ইমাকে।বুঝতে পারলাম আমি শুধুই ‘ইমার বলির পাঠা হয়েছি’।
যে মেয়েটা আমাকে হাজারো স্বপ্ন দেখাইছে,আমাকে নতুনভাবে বাচতে শিখাইছে,যার জন্য আমি ২ সপ্তাহ হাসপাতাল ছিলাম আজ সেই কালনাগিনী সেই বড় ভাইয়ের বাইকে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।দেখতে কতোইনা মধুর লাগছে।
যেটার ভয়ে থাকতাম আজ সেটাই আমার সাথে ঘটে গেলো।
নিয়তির খেলা বড়ই কঠিন।
আমিও এর প্রতিশোধ নিবো ।
আপাততো আব্বুকে গিয়ে বলি ‘আব্বু আমি আর এই কলেজে পড়বোনা,ট্রান্সফারেরর ব্যাবস্থা করো।
এই জীবনকে এখন আপনারা কি বলবেন অভিশপ্ত জীবন!
………………………………………….সমাপ্ত……………………………………….