আজকে অফিস ছুটি। তাই ঘুম থেকে উঠেই খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ পরে মা এক কাপ চা ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো। এরপর বিছানা ছেড়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম।
.
হাত মুখ ধুয়ে এসে চায়ের কাপ টা হাতে নিয়ে একটু চুমুক দিলাম। বেশ ভালোই লাগছে..!! চা খেতে গিয়ে হঠাৎ করে বুকসেল্ফে রাখা পুরনো ডায়েরিটার দিকে চোখ পড়লো। তারপর বিছানা থেকে নেমে সেল্ফ থেকে ডায়েরিটা বের করলাম।
.
অতঃপর ওটা নিয়ে বারান্দায় চলে আসলাম। রকিং চেয়ারে বসে ওটার উপর জমে থাকা ধুলোর প্রলেপটা হাত দিয়ে মুছেও দিলাম। বেশ খানিকটাই ময়লাই জমে গেছে ডায়েরিটার উপর। তারপর বাহিরে একনজর তাকিয়ে ডায়েরিটার কভার পৃষ্ঠাটা উল্টালাম।
.
উল্টানোর সাথে সাথেই মনে হল বুকের ভিতরটা কেউ যেন খামছে ধরলো। কেন জানি মনে হচ্ছে আজ আমি বেঁচেও মরে রয়েছি। কারন ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠাটায় আমার আর নওরিনের ছবি লাগানো। সেই ভুবন ভোলানো হাসি যে হাসির জন্য ওর প্রেমে পড়া।
.
ছবিতে নওরিনের হাসিটা দেখলে আজও থমকে যাই। প্রতিদিন রাতে স্বপ্নে আর কল্পনায় নওরিনকে দেখি। অনুভব করি ও আমার সাথেই আছে। কিন্তু চোখ মেললে কেন যেনো সব ভুল মনে হয়। আর এমনটা করে আজ প্রায় চারটা বছর কাটিয়ে দিলাম।
.
আমি ফারাবি। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি তে সিনিয়র পদে জব করি। চাকরীর সুবিধার জন্য মাকে নিয়ে নিজ শহর ছেড়ে অন্যশহরে থাকি। আর এই নওরিন হল আমার জীবনটা নিজ হাতে সুন্দর সাজিয়ে দিয়ে দূরে চলে যাওয়া ভালোবাসার মানুষ।
.
ডায়েরিটা নওরিনের ছিল। বিয়ের পর হঠাৎ একদিন একটা ডায়েরির আবদার করে বসে। তারপর সুন্দর দেখে একটা ডায়েরি এনে দিয়েছিলাম। এর মধ্যে ওর মনের কথা গুলো সুন্দর করে তুলে রাখতো। আর সাথে আমাদের দুজনকে নিয়ে দেখা স্বপ্ন গুলো লিখতো।
.
কিন্তু ওর সেই দেখা স্বপ্ন গুলো পুরোপুরি বাস্তব না করার আগেই আমায় ছেড়ে চলে গেছে। বড্ড স্বার্থপর নওরিন। আমায় একা ফেলে চলে গেছে। কি হত আমায় সাথে নিয়ে গেলে। ভালো লাগে না এক মূহুর্ত এখন।
.
যাকে চোখের সামনে থেকে এক মূহুর্ত আড়াল করে রাখতে পারতাম না। আজ সে নিজেই আমায় ফাকি দিয়ে সত্যিই চোখের আড়াল হয়ে গেছে। সব কিছুই তো ঠিকমত চলতে ছিলো। কিন্তু এমন ভাবে এলোমেলো হয়ে যাবে সবকিছু এক নিমিষে বুজতে পারি নি।
.
পরে সবকিছু চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে ডায়েরিটার প্রথম পৃষ্ঠা উল্টে এক এক করে পড়তে শুরু করলাম।
.
দুই সপ্তাহ হয়ে গেলো আমাদের বিয়েটা হল। কখনো ভাবতে পারিনি আমার দেখা স্বপ্ন বাস্তব হবে। বিয়েটা দুই পরিবারের সম্মতিতে খুব ধুমধাম করেই হয়েছে। পাগলটা আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
.
পাগলটাকে বলতে গেলে সেই ভার্সিটির প্রথম দিন থেকে ভালো লেগে যায়। তারপরে বান্ধবিদের কাছ থেকে জানি ও আমাদের সাথেই পড়ে। ক্লাসের সবথেকে ভালো ছাত্রদের মধ্যে ও ছিল একজন। প্রায় সময়ই দেখতাম ক্যাম্পাসের বকুলগাছের নিচে বসে বই পড়তে।
.
এর মধ্যে হঠাৎ একদিন গ্রুপ ভিত্তিক কিছু কাজ করার জন্য সবাইকে কয়েকটা গ্রুপে ভাগ করে দেয়া হয়। ভাগ্যবশত আমি ফারাবির গ্রুপে পড়ি। আর ফারাবি ছিল আমাদের গ্রুপের ক্যাপ্টেন। মনে মনে বলেছিলাম-“যাক অবশেষে পাগলটার সাথে বন্ধুত্ব করা যাবে।”
.
এরপর থেকে প্রায় সময় পড়ালেখার অযুহাত নিয়ে ফারাবির কাছে যেতাম। প্রতিদিনই ওকে দেখে নতুন করে ভালা লাগা কাজ করতো মনের ভিতর। এমন ভাবে চলতে চলতে কবে যে ফারাবিকে ভালোবেসে ফেলেছি বুজতে পারি নি।
.
ফারাবিকে বিভিন্ন ভাবে বুজতে চেয়েছিলাম যে আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু ও কোনো পাত্তা দিতো না। এরপরে একদিন সুযোগ বুজে আমিই ওকে সরাসরি প্রপোজ করে বসি। সেদিন ফারাবি শুধু এটুকুই বলেছিল যে, “ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। আর আমি বড়লোকের মেয়ে। আমাদের সম্পর্ক তৈরি হলেও তা কখনো পূর্ণতা পাবে না।” তার পরও হাল দেয় নি।
.
পরে আরোও দুদিন ওকে আমার ভালোবাসার কথা বলেছিলাম। কোনো কথা না বলে চুপ করে ছিলো ফারাবি। আমিও আর বেশি একটা জোরাজুরি করিনি। শেষ যেদিন ওকে আমার ভালোবাসার কথা বলি তারপর থেকে তিনদিন ফারাবি ভার্সিটিতে আসে নি।
.
এদিকে না আসায় অনেকটা চিন্তায় পড়ে যাই। ওর অন্য বন্ধু যারা ছিল তারাও কিছু বলতে পারলো না। তিনপর ফারাবিকে যখন কলেজ গেট দিয়ে ঢুকতে দেখলাম ঠিক তখনি দৌড়ে গিয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়লাম।
.
পরে ওর কলেজে না আসার কারন জানতে চাওয়ায় ফারাবি বিভিন্ন অজুহাত দেখানো শুরু করলো। যদিও ওর কথা গুলো মোটেও সত্য ছিলনা। তারপরও সেদিন মেনে নিয়েছিলাম।
.
তারপর দেখতে দেখতে একটা বছর শেষ হয়ে যায়। এরমধ্যে ফারাবিও আমায় অল্প অল্প করে ভালোবাসতে শুরু করছে। এদিকে বাসা থেকেও বিয়ের জন্য প্রচুর চাপ শুরু করতে থাকলো। বাবা মার এক মাত্র মেয়ে বলে সবসময় যা চেয়েছি তাই পেয়েছি।
.
পরে বাবা আর মাকে ফারাবির সম্পর্কে সব খুলে বললাম। বলা শেষে বাবা শুধু বলেছিল একদিন ফারাবিকে বাসায় নিয়ে যেতে। আমিও সেদিন খুব খুশি ছিলাম। কারন বাবা ফারাবির সাথে কথা বলতে চেয়েছে।
.
পরদিন ফারাবিকে বাবার সাথে দেখা করার জন্য অফিসে নিয়ে যাই। আর এই প্রথম ফারাবি বুজতে পারে আমার পরিবার সম্পর্কে। পরে রুমে ঢুকে ফারাবিকে বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে একটু বাইরে বের হলাম।
.
কিছু সময় পরে বাবা আর ফারাবি একসাথে রুম থেকে বের হয়ে আসলো। আমিও কোন কথা না বাড়িয়ে ফারাবিকে নিয়ে চলে আসলাম। পরে বাবার থেকে যা জানলাম তাতে খুশিতে কি করবো বুজতে পারি নি।
.
সেদিন বাসায় ফিরে বাবা বলেছিল, “ফারাবির মতই ছেলে তোর জন্য খুঁজছিলাম। ফারাবি বলেছে সে নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তারপর বিয়ে করবে।” ফারাবির আত্মবিশ্বাস, সাহস আর বুদ্ধিমত্তা দেখে বাবাও অবাক হয়ে গেছিলো।
.
অবশেষে ফারাবি প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছ। খুব ভালো লাগে যখন ফারাবি মাঝেমধ্যে বলে তার এই প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পিছনে তার মায়ের পর আমি অনেক অবদান রেখেছি।
.
আসলে ভালোবাসার মানুষটা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় পাশে থেকে সাপোর্ট দেয়াটা খুব একটা কষ্টের কাজ না। বরং এটা আনন্দ আর সুখের। আমি সবসময়ই ফারাবির সাথে থেকে ওর কঠিন সময়ে পাশে থাকার চেষ্টা করবো যতই কষ্ট হোক। কখনো একা ফেলে চলে যাবো না।…..
.
(বেশকিছু পৃষ্ঠা পরে)
১২.০৮.০৭
.
বেশ কয়েকদিন ধরে একটা অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে। কারন আমি মা আর ফারাবি বাবা হতে চলেছে। আমি আর ফারাবি মিলে নামও ঠিক করে ফেলেছি। যদি মেয়ে হয় তাহলে নাম রাখবো “হিয়া” আর যদি ছেলে হয় তাহলে নাম রাখবো “নীল”
.
ফারাবিকে বললাম, “আমাদের একটা রাজকুমারী হবে।” কিন্তু ফারাবি বললো, “আমাদের নাকি রাজকুমার হবে।” এনিয়ে দুইজনে অনেক সময় বিতর্ক করলাম। পরে মা এসে বকা দিয়ে পাগলটাকে অফিসে পাঠিয়ে দিল।
.
(কয়েক পৃষ্ঠা উল্টানোর পরে)
.
ডাক্তার বললো কিছুদিন পরেই আমি আমারা আমাদের সন্তানকে দেখবো। ফারাবি আর আমি অধীর আগ্রহ নিয়ে দিন গুনছিলাম। আমাদের অপেক্ষার প্রহর শেষই হতে চাচ্ছে না। অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম দুজনে মিলে তা এবার বাস্তব হবে।
.
নতুন মেহমানকে নিয়ে সবাই খুঁশি। ভাবতেই কেমন জানি আনন্দ লাগছে, আমাকে মা বলে ডাকবে আর পাগলটাকে বাবা বলে ডাকবে। সাথে সারা ঘর মাতিয়ে রাখবে। উপরওয়ালা যেন সবকিছু সুন্দর ভাবে এবং ঠিক মত রাখে।….
.
এরপরে আমার পাগলী টা আর লিখতে পারে নি তার না বলা স্বপ্ন গুলো। কারন এই লেখার দুদিন পরেই নওরিনের প্রসব ব্যথা উঠে। আর তখন হসপিটালে নেয়ার পথে আমাদের গাড়িটির এক্সিডেন্ট হয় বিপরীত দিক দিয়ে আসা একটা ট্রাকের সাথে।
.
সেদিন আমি কোনমতে বেঁচে গেলেও। নওরিন আর অবস্থা বাচ্চার ভালো ছিল না। মেডিকেল এনে দ্রত অপারেশনে নেয়া হয় ওদের। কিন্তু অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ এবং জোরে আঘাত লাগার জন্য নওরিন আর আমাদের সন্তান অপারেশন টেবিলেই মারা যায়।
.
তারপর বেহুশ অবস্থাায় বেশকিছু দিন মেডিকেল ভর্তিও ছিলাম। মোটামুটি সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে আসি। বাসায় এসে সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগা শুরু করে। কোনকিছু ভালো লাগতো না। পরে কিছুটা ভুলে থাকার জন্য অফিসে যোগদিলাম।
.
এরই মধ্যে আমাকে কয়েকবার বিয়ের জন্য জোর করলে সবগুলো না বলে দেই। কারন নওরিনকে ভুলতে পারবো না, মুছতে পারবো না কোনদিন মন থেকে। তাই আর বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেই।
.
প্রতিবারই ওর এই অসমাপ্ত ডায়রিটার শেষের লেখা পৃষ্টাটা চোখের পানিতে ভিজে যায়। ডায়েরিটাকে বন্ধ করে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালাম। এরপর রুমে এসে ডায়েরিটাকে আবারও সেল্ফে রেখে দিলাম। সবশেষে রুম থেকে বের হয়ে নিচে চলে গেলাম।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক