দুঃখ নিবাসী

দুঃখ নিবাসী
– ভাইয়া! আপনার হাতের ক্যামেরা টা কি ভালো!
– জ্বি! ভালোই।
– একটা ছবি তুলা যাবে??
– হ্যাঁ, যাবে।
– আচ্ছা একটু বসুন। আমি আসছি তাহলে মেয়েটা আমার থেকে একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে তার বয়ফ্রেন্ডকে সাথে করে নিয়ে এলো। আমি তাদের দু’জনের একটিই ছবি উঠালাম। যখনি ক্যামেরাতে সাউন্ড হল! ছেলেটা তখনি বলল,
– আচ্ছা তিনু! আমি এবার যাচ্ছি তাহলে?? তিনু ছেলেটার কোন উত্তর না দিয়ে শুধু আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
– ভাইয়া! ছবিটা কি ঠিকমতো উঠেছে??
– হ্যা! ঠিকমতই উঠেছে।
তিনু আমার ক্যামেরায় ছবিটা দেখতে এলো কেমন হয়েছে। দেখার পর সে যেই বলবে, ‘ভাইয়া আরেকটা’ ঠিক তখনি পেছনে ফিরে দেখলো ছেলেটা উধাও। আমিও আশপাশ গভীরভাবে খুঁজে দেখলাম। কোথাও খুঁজে না পেয়ে, আমি তিনুকে ছবিটা ট্রান্সফার করতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
– আচ্ছা তিনু আপু! ছেলেটা এভাবে চলে যাওয়ার কারণটা জানতে পারি?
– খবরদার! আপনি কখনোই আমাকে তিনু বলে ডাকবেন না।
– আমি আপনাকে পাবো কোথায়! যে তিনু বলে ডাকতে যাব কখনো??
– আসলে….
– আসলে কি??
– এই নামটা শুধু সে-ই বলতো। আমার নাম ‘তানজানিয়া তিন্নি’।
– আচ্ছা এবার আসল ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলুন!
– বুঝিয়ে বলার মত তেমনকিছু নেই।
তার খালাতো বোনের সাথে কাল তার বিয়ে হবে। তাই শেষ বিদায় নিতে এলো। ঝটপট কথা গুলো একদমে বলে ফেলল তিনু। সে চলে যাবার আগে দুইশত টাকার একটা নতুন নোট আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
– রেখে দিন।
নোট টা অসাধারণ সুন্দর। আমি দীর্ঘদিন দেশের বাহিরে ছিলাম। তাই এই নোট আমি আজই প্রথম হাতে পেলাম। যদিও এর আগে ফেইসবুকে অনেকের রিভিউ পড়েছিলাম এই নোট সম্পর্কে। টাকাটা আমি রেখে দিলাম। টাকাটা হাতে নিয়ে আমি খুব গভীরভাবে দেখছি। এমনসময় এক টোকাই ছেলে হুট করে নোটটা নিয়ে একলাফে নদীর ধারে নেমে গেল। আমি ওর পিছু নিতে নিতে সে নদীতে ঝাপ দিয়ে, মাত্রই ছাড়তে যাবে এমন একটি নৌকায় উঠে পরলো। আমি ছেলেটার এমন নৈপুণ্য দেখে হতবাক হয়ে গেলাম। তিনুর স্মৃতিটা হারিয়ে ফেলেছি ভেবে সামান্য মন খারাপ নিয়ে সামনের দিকে এগুচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম তিনু আবার আমার সামনে হাজির।
– ভাইয়া ছবিটা তো গেলারিতে সাপোর্ট করছেনা??
– আমাকে আপনার মোবাইলটা দিন আমি ঠিক করে দিচ্ছি। মোবাইলটা হাতে নিয়ে অনলাইন কনভার্টার থেকে কনভার্ট করে ছবিটি গেলারিতে সাপোর্ট করিয়ে দিলাম। সে ধন্যবাদ দিয়ে চলে যেতে চাইলে আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম,
– টাকা না দিয়ে চলে যাচ্ছেন যে??
– এই সামান্য কাজের জন্যেও টাকা?
– আপনার দেয়া দুইশত টাকার নোট একটু আগে এক বাচ্চা ছিনতাইকারী ছিনিয়ে নিয়েছে। এতক্ষণে সে নদীর ওপারে।
– আলহামদুলিল্লাহ্‌ বলেন। কারণ আপনার ক্যামেরাটা নেয়নি। হাহাহাহা।
তিনুর হাসিটা অসাধারণ। আমি এই ঘটনা না বললে এমন হাসির দেখা পেতাম না। এত সুন্দর করে হাসে! সাথে গালে টোলও পরে! তবুও মেয়েটাকে ছেড়ে আপন খালাতো বোনকে বিয়ে করবে তার বয়ফ্রেন্ড! ব্যাপারটা আমাকে বেশ কৌতূহলী করে তুলল। না জানি ছেলেটার খালাতো বোন কত সুন্দর হবে! তিনুর থেকে ঠিকানা চেয়ে নিলাম। বললাম ফটোগ্রাফার হিসেবে বিয়েতে যাবো। তিনু আমাকে ঠিকানা সম্পর্কে ধারণা দিয়ে বলল,
– কি হয় নাহয় আমাকে একটু জানাবেন! আর যদি সেখানে গিয়ে ছবি তুলতে পারেন আমাকে পাঠাবেন।
– আপনাকে কিভাবে পাঠাবো??
– মেসেঞ্জারে!
– কিন্তু আমি ত আপনার মেসেঞ্জারে এড নেই??
– ওহ তাইতো! আচ্ছা আপনার আইডি থেকে আমাকে সার্চ করুণ।
অত:পর ফেইসবুকে তিনুর সাথে এড হই। পরদিন ছেলের বাসার কাছে যাই আমার এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে, বিয়ের মত কোন আয়োজন হচ্ছে কিনা তা যাচাই করে দেখতে। কিন্তু বিয়ের কোন আয়োজন আমাদের চোখে না পরায়, বাসার সামনে থাকা এক দোকানদারকে ছেলের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। দোকানদার উত্তর দেন যে,
– ছেলেটার ব্রেইন ক্যান্সার ছিল। আজ সকালে তাদের গাড়ি বিমানবন্দর এর উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেছে। ইন্ডিয়াতে চিকিৎসা করাতে গিয়েছে। এতটুকুই জানি। আমার সব ধারণা পাল্টে যায় একমুহুর্তে। আমি আমার বন্ধুর দিকে এক অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। বলার মত কোন ভাষা আমি খুঁজে পাইনি। রাতে আমাকে তিনু ম্যাসেজ করে সেখানকার পরিস্থিতি জানার জন্য। আমি এই সত্যটা তিনুর কাছে কিভাবে লুকাব! তা ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলাম তিনুর থেকে কিছু জেনে নেয়া যাক তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে।
– আচ্ছা তিনু! এই ছেলেকে আপনি কতদিন ধরে চেনেন??
– আমি না আপনাকে তিনু বলে ডাকতে নিষেধ করেছিলাম??
– আচ্ছা ভুল হয়েছে। এবার উত্তর বলুন!
– কলেজের এক অনুষ্ঠান থেকে আমাদের পরিচয়।
– তাহলে তো তার বন্ধুরাও আপনার বন্ধু ছিল?
– নাহ। সে আমার সিনিয়র। তাছাড়া আমি কলেজে তেমন কারো সাথে কথা বলতাম না। মেয়ে ফ্রেন্ড ছাড়া আমার কোন ছেলে বন্ধু নেই।
– আপনাদের সম্পর্ক কতদিন ধরে??
– একবছর তিনমাস হল।
– এর আগে আপনি কোন রিলেশন করেছিলেন??
– না ভাইয়া! কিন্তু আপনি এত প্রশ্ন করছেন কেন? আপনি কি তাদের বাসায় যান নি??
– গিয়েছি।
– তবে??
– তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান বাসায় হচ্ছেনা।
– ওহ আচ্ছা।
ইচ্ছে করে মিথ্যেটা বলতে হয়েছে আমাকে। যেহেতু মেয়েটার জীবনের প্রথম ভালবাসার মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত! তাই আমি বাধ্য হই সত্যটা আড়াল করতে। আমি মনেমনে চিন্তা করি তিনুর সাথে প্রথমত ভাল করে বন্ধুত্ব করব। এরপর ছেলেটার বিষয়ে সত্যটা বলে দেব। আমি ঠিক তাই করি। মাঝেমধ্যেই আমরা দেখা করতাম। তিনুর সামনে গেলে আমার নিজেকে খুব তুচ্ছ ও প্রতারক মনে হত। একদিন আমি সিদ্ধান্ত নেই ছেলের বাসায় যাব। গিয়ে ছেলের বন্ধু পরিচয় দিয়ে ছেলেটা কেমন আছে সে সম্পর্কে জেনে আসবো। প্রায় দু’মাস পর ছেলেটার বাসায় গেলাম। শুন-শান নীরবতা ওদের বাসাটাকে যেন আচ্ছাদিত করে রেখেছে। বাসার ছাদে অনেক গুলো ছোটছোট পাখির বাসা। ছাদের উপর একটি কামিনী ফুলের গাছে অসংখ্য চড়ুইপাখি বসে আছে। এই পাখি গুলো বাসায় আসা যাওয়া করছে। ছেলেটার নাম তাহমিদ। তার ছোট ভাই তামজিদ আমাকে বলল,
– এই পাখি গুলোকে ভাইয়া প্রতিদিন খাবার দিত। এই যে দেখছেন হাউজ! এটা পাখিদের গোসল করার জন্য ভাইয়া বানিয়েছিল। ছাদে এলে আমার বুকফাটা কান্না আসে। তাই আমি শুধু পাখিদের খাবার দিয়েই চলে যাই। ভাইয়া আমাকে অনুরোধ করে গিয়েছে পাখি গুলোর খেয়াল রাখতে। তাই শুধু দায়িত্ব পালন করতে আসি। তামজিদ কথা গুলো বলে অন্যদিকে তাকিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বলল,
– আপনাকে তো কোনদিন বাসায় আসতে দেখিনি! আপনি কেমন ফ্রেন্ড ছিলেন! ভাইয়া চলে যাওয়ার দিনও এলেন না??
– আসলে আমি প্রবাসে ছিলাম তো!
তামজিদের অনুমতি নিয়ে আমি তাহমিদের থাকার ঘরে প্রবেশ করি। তামজিদকে আমি বুঝিয়ে বলি যে, দেখো তো কোন বইয়ের ভেতর তোমার ভাইয়ার কোন চিরকুট লেখা আছে কিনা! আমরা দু’জন মিলে প্রায় পনেরোষোলো মিনিটের মত সন্ধান চালানোর পর একটি চিরকুট খুঁজে পাই। সেখানে লিখা, প্রিয় তিনু! সামনের মাসে তোমার পরিক্ষা। আমি জানি আমার অসুস্থতার খবর পেয়ে তুমি হয়ত ভেঙে পরবে। তাই তোমার জন্য এই চিরকুট রেখে গেলাম। যদি জীবন নিয়ে এই শহরে ফিরতে না পারি! তবে আর সত্যটা তোমার জানা হবেনা।
সত্যের বোঝা যে এত ভারী! তা আমি কোনদিন ভাবিনি। যেখানে তোমার অশ্রুসিক্ত চোখের অশ্রু মুছে দেয়ার কথা ছিল! সেখানে আমি সত্যের বোঝা বুকে চাপা দিয়ে তোমার ঘৃণা নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। ডাক্তার আমাকে বলেছেন ব্রেইনে চাপ পরার মত কোন কাজে নিজেকে না জড়াতে। তাই তোমাকে নিয়ে আপাতত কিছু ভাবতে চাইনাা। তবে তোমার জন্য বেঁচে থাকার সর্বুচ্চ চেষ্টা করব। যদি আমাদের এই পরিচিতির শহর ছেড়ে আমি হারিয়েও যাই! তবে ক্ষমা করে দেয়া তোমার ইচ্ছের ব্যাপার। তোমার চির অবাধ্য – তাহমিদ। আমি চিরকুট টা তামজিদের চোখের আড়ালে পকেটে ভরে ফেললাম। এরপর সেখান থেকে ফিরে এলাম। তামজিদের ফোন নাম্বার নিয়ে এসেছি। প্রায়শই তাহমিদের ব্যাপারে তার থেকে খবর নিচ্ছি। তিনুর পরিক্ষা শেষ হওয়ার পর সবকিছু তিনুকে জানাব। এদিকে বিরুধি দলের হরতাল হয়, আর তিনুর পরিক্ষা পিছিয়ে যায়। এভাবে দু’মাস লেগে গেল তিনুর পরিক্ষা শেষ হতে। আমি তিনুকে নদীর ধারে আসতে বললাম। তিনু আমার জন্য শীতকালীন জলপাইয়ের আচার নিয়ে এলো। পরিক্ষার শেষে তার চোখেমুখে এক মুক্তির ছাপ ফুটে উঠছিল। আমি তিনুকে বললাম,
– তিনু! আমাকে ক্ষমা করে দিও।
– কেন ক্ষমা চাচ্ছো! কিসের জন্য ক্ষমা চাচ্ছো??
– তিনু! তাহমিদ গতকাল রাতে মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গিয়েছে।
তিনু কেবলি আঁচারের কাগজটা খুলে আমাকে দিতে যাচ্ছিল। সে কাগজটা আমার পায়ে ফেলে দিয়ে মাটিতে বসে পরলো। আমি তিনুকে সান্ত্বনা দিয়ে কিছু বলতে গেলে সে চিৎকার করে আমাকে উত্তর দিল,
– খবরদার! আমার সাথে আর একটাও কথা বলবিনা। তুই সব জেনেও আমার কাছে লুকিয়েছিস কেন প্রতারক? আমি তিনুকে তাহমিদের চিঠিটা ধরিয়ে দিয়ে বললাম,
– এটা তাহমিদের চিঠি। এখানে তাহমিদ তোমার প্রশ্নের উত্তর লিখে গেছে। তিনু কাঁদতে কাঁদতে বাসার দিকে চলে যাচ্ছে। আমি নদীর স্বচ্ছজলে আমার পা থেকে তিনুর আঁচার ধুয়ে দিচ্ছিলাম। হঠাৎ আমার চোখ থেকে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরে তৈলাক্ত নদীর জল দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। বুকভরা হতাশা নিয়ে আমি বিদায়ের পা বাড়ালাম আমার গন্তব্যের দিকে। তিনদিন পর আমার ফ্লাইট। আমি টিকেট পাচ্ছিলাম না বলে তিনুকে আমার চলে যাওয়ার সঠিক দিনটি জানাতে পারিনি। তিনুর একদিন অভিমান ভেঙে যাবে। সে হয়তো আমাকে ফেইসবুকে ম্যাসেজ করে বলবে,
– নাঈম! আগামীকাল নদীর দ্বারে এসো। আমি আবারও আমার দুঃখিনী সন্ধ্যার স্বাক্ষি বানাব তোমায়। আমি তখন আবারও প্রতারক হব তিনুর কাছে। তাকে না বলে বিদেশে ফিরে যাওয়ার অভিযোগে। মাঝেমধ্যে জীবন বড় জটিল হয়ে উঠে। অপ্রত্যাশিত কিছু না চাওয়া গল্প, আমাদের জীবনকে কখন যে জড়িয়ে ফেলে! আমরা তা কল্পনাও করতে পারিনা।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত