আত্মসম্মান

আত্মসম্মান
কিগো বউমা এখনো খাওয়া হয়নাই? বলছিলাম একটু রং চা দিতে, আর কখন দিবা? আরে বাবা ছেলেপুলে তো আমরাও পালছি নাকি? খাইতে নাইতে তো সারাদিন পার করিনাই।
মেয়েটা খাওয়া নিয়ে খুব জালায় ইরাকে। অনেকটা সময় নেয় খেতে। মেয়েকে খাইয়ে তারপর ইরা খায়। মেয়েকে খাওয়ানো শেষ করে মাত্রই এক লোকমা মুখে দিতে নিচ্ছিলো ইরা,তখনি শ্বাশুড়ির গলা ভেষে এলো। সকালে ইরার ননদ এসেছে,দুপুরে খাওয়ার পর বিছানায় বসে মা মেয়ে গল্প জমিয়েছে। কিছুদিন মাত্র হলো ননদের বিয়ে হয়েছে। জামাই রাতে নিতে আসবে,তার জন্য আবার নানান পদের রান্না ইরাকেই করতে হবে। খাওয়া রেখেই উঠে গেলো ইরা।মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে খুব,খাবার এখন বিষের মতো লাগবে ওর কাছে। উঠে রান্নাঘরে চলে গেলো,চা বানালো দু’কাপ,দিয়ে আসলো ওঘরে। দিয়ে আসার সময় ননদ বললো, একটু চিংড়ি মাছের মালাইকারী করো ভাবি,ও খুব পছন্দ করে খেতে। ইরা কিছু বললো না,রুম থেকে বের হয়ে গেলো। ইরার খুব মনে পড়লো নিজের মায়ের কথা,কতদিন ঠিকমত কথা হয়না মায়ের সাথে। সবসময়ই সংসারের কোন না কোন কাজে ব্যস্ত থাকে ইরা,ফোন দিলেও কথা বলা হয়না ঠিকমত।
ইরার বাপের বাড়ীর লোকজনের এ বাড়ীতে আসাটা ইরার শ্বাশুড়ী একদমই পছন্দ করেনা। ইরার বিয়ের কিছুদিন পরই সেটা ইরার মা বাবা বুঝতে পেরে গিয়েছিল,তাই তারা তেমন আসেন না। কিন্তু সেদিন ইরার বাবা এসেছিলো। তেমন কিছুই খাওয়াতে পারেনি বাবাকে। ইরার শ্বাশুড়ি তেমন কিছুই রান্না করতে দেয়নি ইরাকে। ফ্রিজে সবই ছিলো,কিন্তু ইরা রান্না করার অনুমতি পায়নি। ইরার খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো বাবার পছন্দের দু একটা খাবার রান্না করে কাছে বসিয়ে খাওয়ায়। সেদিন বাবা চলে যাবার পর খুব কেঁদেছিলো ইরা। যা ছিলো আগে থেকে রান্না করা তাই দিয়েই খাইয়ে দিয়েছিলো বাবাকে। ইরার শ্বাশুড়ির এক কথা,আমার ছেলের লিমিটেড ইনকাম সেই অনুযায়ীই চলতে হবে,অযথা খরচ চলবে না। অথচ আজ কত কিছু রাঁধতে হবে ইরাকে। প্রায় ছয় বছর ধরে এমনটাই চলছে। এখন এসব সয়ে গেছে ইরার। তবু কষ্ট হয়,তবু ইরার চোখে পানি আসে। মাঝে মাঝে ইরার নিজেকে অস্তীত্বহীন মনে হয়। আর, এই সংসারে ইরার সবথেকে কাছের যে মানুষটা সে সবসময়ই নির্বিকার থাকে। ইরা কখনই চায় না ওর স্বামী নিজের মায়ের সাথে খারাপ ব্যবহার করুক।কিন্তু একটু বুঝিয়ে বললেই হয়তো যেখানে হয়ে যায় সেখানে ওর স্বামী বোবার মত থাকে,যেন কিছুই শোনেনি কিছুই দেখেনি। আরো দুই বছর পর মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়ীতে চলে এসেছে ইরা। স্বামীর জন্য একটা চিঠি রেখে এসেছে।
তোমাকে অল্প কিছু কথা বলবো। কেন আমি চলে গেলাম তা তুমি বুঝতে পেরেছো নিশ্চয়ই। তবু বলি,আমি সামনাসামনি বলতে পারতাম কিন্তু তা হলে তুমি আমার সব কথা মন দিয়ে শুনতে না।চিঠিটা হয়তো মন দিয়েই পড়বে। তোমার মনে আছে? যখন আমি প্রেগনেন্ট ছিলাম আমার শ্বাশুড়িমা আমার খুব যত্ন করতেন। নিজেই রান্না করে এটা ওটা খাওয়াতেন। আমার সত্যি খুব অবাক লাগতো ব্যাপারটা। একদিন কথায় কথায় বলেই ফেললেন, কোন এক পীরের কাছ থেকে নাকি দোয়া নিয়ে এসেছে আমার ছেলে হবার জন্য। উনি ধরেই নিয়েছিলেন যে আমার ছেলেই হবে,কারণ সেই পীর নাকি দোয়া করে দিয়েছে আমার জন্য। সোনোগ্রাফি দেখে ডাক্তার বলেছিলো মেয়ে হবে আমার।আমি উনাকে সেটা বলেছিলামও।উনি সেটা কিছুতেই বিশ্বাস করলেন না,কারণ পীর যা বলেছে তাই হবে।
পীরের প্রতি উনার অগাধ বিশ্বাস। কিন্তু যখন সত্যিই আমার মেয়ে হলো, উনি একটুও খুশি হলেন না,তার সব পরিশ্রম বৃথা গেলো। একটু একটু করে আমার খাবার কমিয়ে দিলেন,মেয়ে হয়েছে এখন আর খাইয়ে কি লাভ! আমি দূর্বল হতে লাগলাম, আমার মেয়ে বুকের দুধ পেতোনা। এতকিছুর পরও তুমি আমার প্রিয় স্বামী ছিলে নির্বিকার,যেন কিছুই হয়নি। কয়েক মাস পর আমার বাবা আমাকে জোড় করে নিয়ে আসলেন,জোড় করে আনতে হলো কারণ বাবার বাড়ী আসবো তাতেও তোমার মায়ের আপত্তি। আমার বাবা আমাকে খাইয়ে দাইয়ে তাজা করলেন,আমার মেয়েটাও খেতে পেলো। বিশ্বাস করো,তোমার কাছে ফেরার আর কোন ইচ্ছেই ছিলোনা আমার। কিন্তু আমার মায়ের সেই চিরাচরিত বুলি,স্বামীর ঘরই মেয়েদের আসল ঘর। সহ্য করে যাও।হা হা সহ্য করতে করতে আজ আমি বড্ড ক্লান্ত।
আমি অনেকটাই শ্যামবর্ন বলে সেটা নিয়েও শুনতে হয়েছে হাজারটা কথা,কাজের লোকের সামনে বাড়ীর বউকে কথা শোনাতেও তোমরা ছাড়তে না। কিভাবে পারো বলতো? আচ্ছা তোমরা কি ভাবতে আমার মান সম্মান নেই? অথচ এই তুমিইতো আমাকে বিয়ে করার জন্য পছন্দ করেছিলে তাইনা? আমি কি তোমাকে জোড় করে বিয়ে করেছিলাম? আমার দোষটা কি ছিলো? সব মেনে নিয়েছিলাম,ভেবেছিলাম সংসার করতে গেলে মেনে নিতেই হয়। মেনে নিয়েওছিলাম সব।
নিজের অপমান সহ্য হয়,কিন্তু আস্তে আস্তে তোমরা আমার মা বাবাকে নিয়েও কথা শুরু করলে।তারা নাকি আমাকে কিছু শেখায়নি,একটা অথর্বো বানিয়েছে। তাদেরকে অপমানজনক কথা বলতে তোমাদের আটকাতো না একটুও। আচ্ছা আমার মা বাবা কি তোমাদের কাছে খেতে পড়তে চেয়েছিলো? তোমরা এমন ভাব করতে যেন তারা রাস্তায় থাকেন। নানান মৌসুমে নানান রকমের উপহার আশা করতে তোমরা আমার মা বাবার কাছ থেকে। ঈদের উপহার,রোযার উপহার, ফলের মৌসুমে ফলের উপহার,শীতের সময় ডালা ভরা পিঠার উপহার! আচ্ছা বলতো, তোমরা কি খেতে পেতে না? আমার বাবা কি এসব দিতে বাধ্য? আমার পেছনেই যদি তাদের এতো খরচ করতে হয় তবে আমার বাকি ভাইবোনের কি হবে বলতে পারো?
এইতো সেদিন বললে, মায়ের বয়স হয়েছে,এই বয়সে কি বলে কি করে তার ঠিক নেই। ওসব ধরলে চলে না। এমন বয়সে এমন আচরণ করাটা স্বাভাবিক। মানলাম তোমার কথা, কিন্তু বলতো ওমন আচরণ শুধু আমার বেলাই কেন করেন উনি? নিজের মেয়ের সাথে তো করেন না? বয়সের কারণে হলে তো সবার সাথেই ওমনটা করার কথা তাইনা? সেবার যখন আমার বাবা খুব অসুস্থ হলো, তোমরা আমায় যেতে দিলে না। আমি গেলে সংসার কে দেখবে,রান্না কে করবে এসব বললে। আচ্ছা যদি আমার বাবা মরেই যেত তবে লাশটা দেখতে যেতে দিতে তো? নাকি তাও দিতে না?
যাক,তোমাকে অনেক লিখে ফেললাম। তুমি চাইলে আবার বিয়ে করে নিতে পারো।আমার মতো একটা অকর্মার সাথে তোমায় আর থাকতে হবেনা।
ভেবোনা, আমি আমার মা বাবারও বোঝা হবোনা। আল্লাহ আমাকে হাত পা দিয়েছেন, কিছু একটা উপায় ঠিকই বের হয়ে যাবে। যিনি রিযিক দেন তিনিই এর ব্যবস্থা করে দিবেন। তবু একটু বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাই, একটু আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে চাই। মানসিক রোগী না,সুস্থভাবে বাঁচতে চাই। তবে একটা অনুরোধ,এরপর এমন কাউকে জীবনসাথী করো যার কোন আত্মসম্মান নেই। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কোন মেয়ে তোমার সাথে সংসার করতে পারবে না। আর একটা কথা মনে রেখো,জুলুমকারীদের আল্লাহ পছন্দ করেন না, জুলুমকারীদের শাস্তি ভয়ংকর হয়।
ভালো থেকো ইরা।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত