ভাল একটা বাসা

ভাল একটা বাসা
আমি জীবনের সবচেয়ে বিশ্রী কাজটি মাত্র করে ফেললাম। আমি এত জঘন্য একটা কাজ করে ফেলব বুঝতে পারিনি। সেটা হল- আমি আসিফ কে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছি আর ওর কানের বাঁ পাশ থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। গালের পাশ টা কেটে গিয়েছে।
আমার ধৈর্যশক্তি অনেক বেশি বলেই জানতাম। ছোট বেলা থেকে আশেপাশের থাকা মানুষজন সবসময় বলত – মিতার ধৈর্য অনেক বেশি। মিতা এত সুন্দর করে সব ম্যানেজ করে। নিশ্চয়ই ও অনেক সংসারী হয়ে সুখী হবে।
বিশ্বাস করুন আমি গত ৬ টা বছর অনেক বেশি চেষ্টা করেছি আপনাদের ভাষায় তথাকথিত সুখী হবার।
আমি ঘরে মনোযোগ দিয়েছি যেন সংসার টা ঠিক থাকে। আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি এখন আমি অন্ত প্রাণ! অথচ এই দুজন আমার মুখ ও দেখবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কারণ তার ছেলে সুন্দর আর আমি ময়লা শ্যামলা!! যাইহোক, আমি কিন্তু চাকরি খুঁজে ফিরিনি। ঘর ঠিক রেখেছি। ধ্যান-জ্ঞান জুড়ে সংসারকে রেখেছি। স্বামীর প্রতি সকল দায়িত্ব পালন করেছি। তার সকালে উঠে নাওয়াখাওয়া র যোগাড়, তার শার্ট প্যান্ট দোকানে না দিয়ে নিজে ইস্ত্রি করে দিয়েছি। দুপুরে টিফিনে ৩ রকমের খাবার দিয়েছি যাতে সে খাবারের জন্য অনিহা না আনে। এসে হাত মুখ ধুয়েই টেবিলে বসে ই নাস্তা পেয়ে যায়।এরপর অফিসে এর কাজে বসেন। আমি গিয়ে কফি নিয়ে বসি। সে তখনও ব্যস্ত।
আমি রাতের বেলা সবকাজ সেরে এসে দেখি সে ঘুমায়৷ আমি ও ঘুমিয়ে যাই। আবার উঠি সে ভোরে। গত ৬ বছর ধরে আমার রুটিন এক নিঃশ্বাসের সাথে লিখে ফেললাম। এখন বলুন আমার দোষ টা কোথায়??? এই ত সব জায়গায় মুখে ফেনা তুলে ফেলে সবাই যে মেয়ে চাকরি করে তার ঘর টেকে না!! আমার ক্যান এমন নয়??? আমার স্বামী গত দুবছর যাবত আমার ই ক্লাস মেট অন্তিকে সময় দিচ্ছে। অফিসের কাজের সূত্রে পরিচয় হতে হতে আজ বাসায় পরিচয়ে পরিচিত হয়ে গেছেন আমার বর ও আমার বান্ধবী। কাকে আসলে প্রথমে খুন করব বুঝতে পারছিনা। আমার কাছের প্রিয় বান্ধবী জানালেন আজ বিকেলে যে তিনি আসিফের অত্যন্ত কাছের মানুষ যার নিকটের প্রমাণ করতে গিয়ে জানালেন তিনি মা হবেন!!! আসিফকে যেন ছেড়ে দেই। তারা বিয়ে করতে চান!!
আমার কি করা উচিত???এখনও নিশ্চয়ই বলবেন, আসিফের কোন দোষ নেই। সব দোষ আমার বান্ধবির।। আমি চিৎকার করে বলব- আপনারা অন্ধ!! একটা অন্যায়ে দুজনের হাত আছে, দুজনেই সমান অপরাধী। আপনারা যথেষ্ট স্বার্থপর কারণ আপনারা নিজেদের মত করে সমাজ সংসার সাজান। মেয়ে এমন হলে তেমন হবে, ওমন হলে এমন হবে -এ ধরনের কথা গুলো বলতে বলতে সবাইকে ঠেসে ধরেন এসব কথা মুখস্ত করার জন্য। বাধ্য করেন সবাই কে এই কথাগুলোইকে বেদবাক্য ভাবতে।।একটা মেয়ে সাধে চাকরি করতে আসেনা বা সংসার ছাড়েনা! ওর এত শখ নাই নাটাই বিহীন ঘুড়ি হয়ে কোন উদ্দেশ্য ছাড়া উড়ে বেড়াতে। একটা মেয়ে মানুষ আজীবন ওকে স্বীকৃতি খোঁজে। এক না হয় সে একজন ভালো মেয়ে, বা তিনি ভালো স্ত্রী, ভালো মা অথবা ভালো শ্বাশুড়ি এইই স্বীকৃতি গুলো খুঁজে বেড়ান। এই স্বীকৃতি গুলো অর্জন করতেই এই মহিলাদের এত যুদ্ধ, এত খরচ! কিন্তু দিন শেষে স্বীকৃতি ত ছাড়, বাসায় এককোনায় ও জায়গা সবাই পায়কিনা সন্দেহ!!! যাইহোক, এসব আমি আসিফকে যখন জিজ্ঞেস করি-
– এরমানে কি? অন্তি র সাথে তোমার এফেয়ার?
– হু!
-হু মানে?? তুমি বিবাহিত, তোমার স্ত্রী আমি!! তারপর ও কেন এসব??.
– বিরক্ত করোনা ত! যাওও!!
আমার মেজাজ এত বেশি খারাপ হয়ে গেল যে শার্টের কলার ধরে ওকে টেনে বসা থেকে উঠিয়ে দিলাম একটা ধাক্কা! সে হতভম্ব হয়ে রইল। সেও হাত উঠিয়ে মারতে আসলে আমি শাড়ি কোমড়ে গুজে খুন্তি নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে বললাম
– স্পষ্ট করে সত্যি বলে চোখের সামনে থেকে চলে যাওও,!!
– তুমি সারাদিন ধরে রান্নাঘরে ব্যস্ত,সংসারে ব্যস্ত থাকো! তোমাকে নিয়ে মানুষের সামনে যাওয়া যায়? টিপিকাল মেয়ে মানুষ!! সংসার সামলাতে সামলাতে নিজেকে দেখেছ কখনো আয়নায়?? যার সাথে প্রেম করতাম তার এই হাল দেখে লজ্জ্বা লাগে আমার!! অন্তি স্মার্ট, ওয়ার্কিং ওম্যান! ওর আমার জন্য সময় আছে!! আমি ওর সাথে কমফোর্ট!! আমার জন্য ও পারফেক্ট!! রাগে অন্ধ হয়ে গেলাম কথাগুলো শুনে। খুন্তি টা ফেলে আমি আসিফ কে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলাম ডাইনিং টেবিলের কাছে। টেবিলের কোণায় বাড়ি লেগে ওর কানের বাঁ পাশ থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। গালের পাশ টা কেটে গিয়েছে। ও ফুসছে!!
– পাগল হয়ে গেছো তুমি মিতা!!।
-হ্যা পাগল হয়ে গিয়েছি।!!
প্রেম ও করব, সংসার ও করব সব কিছু তোমার চাইইই, আমার কি চাই জানতে চেয়েছিলে?? বিয়ের আগে নাটক করে বলেছো আমার পরিবারের লোকজন দের যত্ন নিও। তোমার পরিবারের লোকজন কে যত্ন নিয়েছি আর তুমি এইই খুশিতে আরেকজনের যত্ন নিতে চলে গেলে!! আমি যদি যেতাম?? তুমি আমাকে সময় দাওনি বলে আমি যদি তোমার বাবা মা কে ফেলে যেতাম?? তখন?? বেশ্যা ডাকতে! তোমাকে কি ডাকব?? পুরুষ বেশ্যা??? চেহারা ধুয়েমুছে জল খাবা কতদিন??
– আমি এত জ্ঞান শুনতে চাইনা মিতা!! প্লিজ লিভ মি!! আমি অন্তিকে ভালোবাসি। আমাদের মুক্তি দাও! আমি এতক্ষণে মরে গিয়েছি নিজের কাছে ই! এখন শেষ বাক্য শুনে আমার নিজেকে বেহায়া মনে হল! এই লোক কে বিয়ে করেছিলাম কেন!! রাগে অন্ধ হয়ে গেলাম!! আমি টেবিলে রাখা গ্লাস মাথায় ভেঙে ফেলি! মাথার পাশে দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। আমি ভয়ংকর ভাবে হাসি দিয়ে আসিফ কে বলি
– এখন থানায় যাব, তোমার নামে মামলা করব, তোমার স্ত্রীকে তুমি নির্যাতন করছ আরেকজনের জন্য!! দেখো কিভাবে মুক্তি দেই তোমাদের। । উইশ ইউ এ হ্যাপি ম্যারেড লাইফ। আমি বাসা থেকে বের হয়ে এলাম। আমার ছ বছরের সাজানো ঘর ছেড়ে। থানায় হয়ত যাবনা! থানায় গেলে মামলা হবে,কথা ছড়াছড়ি হবে, জিতব আমি,টাকা ও পাব আমি, এই আপনারা ই দাঁত বের করে বলবেন -মিতা মেয়েটা কি খারাপ, স্বামীর নামে মামলা করে!!
এতকিছুর পরও মানুষ টা ত আমার হবে না! যে আমার না তারে আমার কাছে রাখার চেষ্টা করব কেন? আমার নিজের ত আত্মসম্মান বলে কিছু একটা আছে!! আমি ব্যার্থ হলেও অধম নই যে ভালবাসা দিয়ে সততা দিয়ে এতবছর চুপচাপ ছিলাম৷ এখনও থাকব। যে বাসায় ভালবাসা নামক ঘর নেই সে ঘরে এত ভালবাসা সাজিয়ে কি করব??? মানুষ সারাজীবন পরিশ্রম করে একটা বাসা তৈরি করে ভালবেসে ভালবাসা নিয়ে বাঁচার জন্য। অথচ এই ভালবাসা টাই ত এত ঠুনকো হয়ে গেছে! কই খুঁজব ভাল একটা বাসা? কই পাব ভালবাসা??
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত