বইয়ের পাতায় মুখ ডুবিয়ে বসে আছে তানহা।চোখে মিডিয়াম পাওয়ার এর চশমা।ওকে দেখে মনে হচ্ছে কোন বাইরের জগতে বসে আছে।যেখানে আশেপাশে কেও নেই।তানহা বই নিয়ে বসলে এমনভাবে বইয়ের মধ্যে ঢুকে যায় যে বাকি কোনকিছুর খেয়াল থাকে না।এই মেয়েকে যদি কোন ঘরে শুধু পানি আর বই দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয় তাহলে নাচতে নাচতে চলে যাবে।বয়স মাত্র বিশ।এর মধ্যেই চোখে চশমা উঠেছে।সামনের দিনগুলোতে কি হবে আল্লাহ মালুম।। ফোনে কথা বলতে বলতে রুমে ঢুকলো স্নেহা।তানহাকে বই পড়তে দেখে স্নেহার চক্ষু কপালে উঠলো।পরক্ষণেই আবার নিজেকে সামলে নিল।কারন স্নেহা জানে তানহার থেকে এটাই আশা করা যায়।তাই আবার নিজের ফোনে কথা বলায় মন দিলো।। স্নেহা,তানহা,রিতু,মৌ চারজন কলিজার বান্ধবী।ভার্সিটিতে সারাক্ষণ একসাথে থাকে।স্নেহার বড় বোন সিনথিয়ার বিয়ে এ্যাটেণ্ড করার জন্য সবাই স্নেহাদের বাড়িতে এসেছে।
স্নেহার জীবনে কোন পিছুটান নেই।সে নিজের মতো থাকতে ভালোবাসে।যেকোন বিষয়ে পজেটিভ যুক্তি দাঁড় করিয়ে সহজভাবে মেইনটেইন করতে পারে।সারাদিন হৈচৈ এ মেতে থাকতেই তার বেশি আগ্রহ।পড়াশোনাটাকে অতটা সিরিয়াসলি নেয় না।ফ্যামিলি বন্ধু বান্ধব আড্ডা এগুলো নিয়েই স্নেহার জীবন।কিন্তু রেজাল্টের সময় সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়।পড়াশোনায় মন নেই কিন্তু প্রত্যেক এক্সামে সুপার ডুপার রেজাল্ট।আর ঠিক এই কারনেই কেও ওকে দুরন্তপনার জন্য কিছু বলে না।স্নেহার জীবনে প্রেমের কোন জায়গা নেই।ওর মনে হয় যারা সারাজীবন আগলে রেখে বড়ো করেছে তাদের সিদ্ধান্ত ই জীবনের মূল ভিত্তি হওয়া উচিত।তাই রিলেশনশিপের চরম বিপক্ষে স্নেহা।।।
স্নেহাদের বাড়িতে মানুষ গিজগিজ করছে।বাড়ির বড়ো মেয়ের বিয়ে বলে কথা।বিশাল জমজমাট আয়োজন হচ্ছে।আত্নীয় স্বজন কেও আসা বাকি নেই।সেই সাথে স্নেহাদের তিন ভাইবোনের বন্ধুবান্ধব তো আছেই।।
মৌ এর বিকট চিৎকারে ধরফর করে লাফিয়ে উঠলো তানহা।তারপর চোখ রাঙিয়ে মৌকে বলল,,,,
—-” কি সমস্যা তোর,কে মরছে…???
—-” কেও মরেনি।(হাঁপাতে হাঁপাতে বললো মৌ)
—-” তাহলে চিল্লাচ্ছিস কেন..??
—-” আমি যেজন্য চিল্লাচ্ছি সেটা শুনলে তুই আরও জোড়ে চিল্লাবি।
—-” এতো নাটক না করে বল কি হয়েছে।।
—-” স্নেহা প্রেমে পড়ছে।।।।।।
মৌ এর কথা শুনে তানহার হাত থেকে বইটা পরে গেল।চশমাটা খুলে নিয়ে বিকট আওয়াজে বলে উঠল “হোয়ায়ায়ায়ায়াট” মৌ সাথে সাথে দুহাত দিয়ে কান চেপে ধরলো।তানহা এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না।যে স্নেহা রিলেশনশিপ এর নামে নাক ছিটকায় সে কিনা প্রেমে পড়েছে।এটা জাস্ট ইম্পসিবল। তানহার ভাবনার মধ্যেই রুমে ঢুকলো স্নেহা আর রিতু।রিতুর মুখও স্বাভাবিক ভাবেই হা হয়ে আছে।ওরা কেওই শকটা কাটাতে পারছে না।স্নেহার মুখে লাজুক হাসি।অনেকক্ষণ নীরবতা পালন করার পর তানহা মুখ খুললো,,,
—-” স্নেহা কে সেই জিনিয়াস?যার জন্য চিরজীবনের প্রতিজ্ঞা ভুলে গেলি তুই??
—-” নীল।।(লাজুক হেসে বললো স্নেহা)
ওরা তিনজন আবার চেঁচিয়ে উঠলো।স্নেহা আজকে ওদের একটার পর একটা সারপ্রাইজ দিয়ে যাচ্ছে।তানহা আবারও বললো,,,,
—-” সিফাত ভাইয়ার বন্ধু নীল ভাইয়া??
—-” হ্যাঁ।।।
স্নেহা,সিনথিয়ার বড়ো ভাই সিফাত।মাস্টার্স করে জব করছে।তার বন্ধু নীল।কিছুদিন হল সিফাতের অফিসে জয়েন করেছে।সেই থেকে দুজনের খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে।দেখে মনে হয় যেন কতকালের সম্পর্ক ওদের।সিনথিয়ার বিয়েতে এসে রীতিমতো সবার মধ্যমনি হয়ে গেছে নীল।এসেই সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে।সিফাত একটু আধটু ফাঁকি মারছে।কিন্তু নীল ধরে বেঁধে কাজ করাচ্ছে।স্নেহার বাড়ির বড়োরা নীলের ওপর ভীষণ খুশি।সিফাতের মা তো সবার সামনে ঘোষনা দিয়েছেন নীল ওনার বড়ো ছেলে।সিফাতের মুখটা তখান দেখার মতো হয়েছিল। বেশ ভালোভাবেই সিনথিয়ার বিয়েটা হয়ে গেছে।নীলের ওপর সবাই বেজায় খুশি।নিজের বোনের মতো দায়িত্ব নিয়ে সিনথিয়ার বিয়ে দিয়েছে।সিফাতকে কেও এখন পাত্তা দিচ্ছে না। রাতের খাবারের সময় সবাই একসাথে টেবিলে বসেছে।বিয়ের ঝামেলায় এতোদিন খাওয়া দাওয়ার ঠিক ছিলোনা কারোরই।কাল সকালে প্রায় সবাই চলে যাবে।নিজের জীবনে ব্যস্ত হয়ে যাবে।তাই আজকের ডিনারটা সবাই একসাথে করবে।ছোট বড়ো সবাই টেবিলে বসেছে।স্নেহা আড়চোখে নীলকে দেখছে।কিন্তু নীল ভুলেও তাকাচ্ছে না।খাওয়ার মাঝে স্নেহার বাবা নীলকে বললেন,,,,
—-” আচ্ছা নীল।তুমি আমার ছেলের বন্ধু হলেও তোমাকে আমি নিজের ছেলের মতোই ভাবি।তুমি আমাদের জন্য এতো কিছু করলে কিন্তু তোমার ব্যাপারে কিছুই জানলাম না আমরা।তুমি কি তোমার পরিবার বিষয়ে কিছু বলবে আমাদের…??তোমার বাড়িতে কে কে আছেন..???
—-” কেও নেই।। নীলের কথায় মূহুর্তের মধ্যে টেবিলে নীরবতা নেমে এলো।সবাই অবাক হয়ে নীলের দিকে তাকিয়ে আছে।নীলের দৃষ্টি প্লেটের মধ্যে।সিফাতের মা এগিয়ে এসে নীলের কাঁধে হাত রাখলেন।নীল চোখ তুলে তাকালো।সিফাতের বাবা জানতে চাইলেন সবকিছু।প্রথমে নীল বলতে চাই ছিলোনা।পরে সিফাতের বাবা মায়ের অনুরোধে বলতে শুরু করলো,,,,,
—-” আজ থেকে বিশ বছর আগের ঘটনা।আমি নীলয় হাসান।মা আদর করে নীল বলে ডাকতো।বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে হিসেবে আদরটা তুলনামূলক ভাবে বেশি পেয়েছি।বাবার ছোটখাটো একটা বিজনেস ছিল ভালোবাসায় ভরপুর একটা পরিবার ছিল।মা উচ্চ শিক্ষিত হয়েও চাকরি করেননি আমাকে পুরো সময় দেয়ার জন্য।কোন কিছু না চাইতেই পেয়ে যেতাম।কিন্তু এতো সুখ মনে হয় আমার কপালে লেখা ছিলো না।। ছয় বছর বয়স আমার।বাবা মার সাথে প্রায়ই এদিক ওদিক বেড়াতে যেতাম।সেবার বাবা বললেন গরমের ছুটিতে সিলেট নিয়ে যাবেন।আমার আনন্দের সীমা ছিলোনা।প্লান অনুযায়ী রওনা দিলাম আমরা।বাবা গাড়ি ড্রাইভ করছিল,মা বাবার পাশে বসে ছিল।আর আমি পেছনের সিটে বসে ভিডিও গেম খেলছিলাম।।
হঠাৎই এলো সেই মূহুর্ত।যেটা আমার জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছে সবকিছু।উল্টো দিক থেকে একটা ট্রাক এসে আমাদের গাড়িটাকে ধাক্কা দিলো।কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাড়ি খাদের মধ্যে।কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে চোখ বন্ধ হয়ে গেল।যখন চোখ খুললাম মাথার পাশে ছোট চাচীকে বসে থাকতে দেখলাম।আমার জ্ঞান ফিরতে দেখে চাচী দৌড়ে গিয়ে ডাক্তার আর চাচাকে ডেকে আনলেন।চাচা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন।দুদিন পর হসপিটালকেই থেকে বাসায় এলাম।জানতে পারলাম এক্সিডেন্টে আমার জীবন থেকে একটা বছর হারিয়ে গেছে।বাবা মা স্পটেই মারা গেছে আর আমি এতোদিন কোমায় ছিলাম। হারিয়ে গেছিল আমার জীবন থেকে সব রঙ।সব ভালোবাসা।চাচা চাচী নিজের ছেলের মতো ভালোবাসতেন।কিন্তু বাইরের মানুষের কাছে আমি এতিম হিসেবে পরিচয় পেলাম। ডায়নিং টেবিলে বসা সবার মধ্যে পিনপতন নীরবতা।কারও মুখে কোন কথা নেই।সবাই খাওয়া মাঝপথে থামিয়ে দিয়েছে।একটু থেমে নীল আবার বলতে শুরু করলো,,,,
—-” বাইরের মানুষের কাছ থেকে এতিমের তকমাটা পেলেও চাচ চাচী আদরের কমতি রাখেন নি।ভালোবাসায় ভরিয়ে রেখেছিলেন আমায়।বাবা মায়ের অভাবটা ঘোচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন তারা।আমার চাচার মেয়ে তিথি আমার দু বছরের ছোট ছিল।ও ছিল আমার একমাত্র খেলার সাথী।আমার খুব খেয়াল রাখতো।কোন ছেলে মেয়ে আমাকে এতিম বললে তিথি গিয়ে ওদের সাথে মারপিট করতো।ধীরে ধীরে বড়ো হচ্ছিলাম।তিথির প্রতি অন্য রকম কিছু অনুভব করতাম।তিথিও করতো।কিন্তু কেওই বলতে সাহস পাইনি।আমার ভয় ছিল আমি যে ওদের আশ্রিত।
কিছুদিন পর চাচা নিজে থেকে আমায় বললেন তিথিকে বিয়ে করার কথা।আমিতো আকাশ থেকে পড়েছি।।কিন্তু
মনে মনে ভীষণ খুশি হয়েছিলাম।চাচা চাচীর দোয়া নিয়ে আমাদের বিয়ে হয়ে যায়।বাসর ঘরে তিথি আমাকে কথা দিয়েছিল কখনও ছেড়ে যাবে না।শুরু হলো আমাদের নতুন জীবন।বিয়ের পর প্রতিটা দিন আমি তিথিকে নতুন করে আবিষ্কার করতাম।ও আমার অনেক খেয়াল রাখতো।ওর সারাদিনের চিন্তা ভাবনা ছিল আমাকে ঘিরে।আমি কি খেতে ভালোবাসি,কিভাবে সাজলে আমি খুশি হবো।সারাদিন এগুলোই করতো।তিথির ভালোবাসা আর চাচা চাচীর দোয়ায় ভালোভাবেই দিন কাটছিল আমাদের।কিন্তু এবারেও ভাগ্য আমার সাথে গেম খেললো।। তিথির পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরে চাচা বললেন আমাদের হানিমুনে পাঠাবেন।আমি বললাম “আপনারাও চলেন”।চাচা হেসে বললেন,” আরে ব্যাটা তোদের হানিমুনে আমরা গিয়ে কি করবো।তোরা যা ঘুরে আয়।এখনি তো আনন্দ করার বয়স”।চাচীও চাচার কথায় সায় দিলেন।কিন্তু আমি আর তিথি নাছোড়বান্দা।অবশেষে আমাদের জেদের কাছে হাড় মেনে চাচা চাচী রাজি হলেন।
নির্ধারিত দিনে সব গুছিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম কক্সবাজার এর উদ্দেশ্যে।তিথির হাতে হাত রেখে ড্রাইভ করছিলাম।চাচা চাচী পেছনে বসেছিলেন।হঠাৎই সামনে থেকে ট্রাক এর ধাক্কা।গাড়ি খাদের মধ্যে আর কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে আমার চোখে সবকিছু অন্ধকার। চোখ খুলে জানতে পারলাম আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে আমার জীবনে।চাচা চাচী তিথি স্পট ডেথ।আমি একবছরের জন্য কোমায়।হারিয়ে ফেলেছি আমি আমার তিথিকে।হারিয়ে ফেলেছি বাবা মায়ের মতো চাচা চাচীকে।আমার তিথির মুখটাও শেষ বারের মতো দেখতে পারিনি।কোমা থেকে বেরিয়ে প্রথমে যে কথাটি মনে হয়েছে আমি কেন বেঁচে আছি।ওদের সাথে আমি কেন চলে যাই নি। টেবিলে বসা সবার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।কারো মুখে স্বান্তনার বাণী টুকুও নেই।নীল আবার বলল,,,,
—-সেই থেকে আমি হয়ে গেছি ভবঘুরে।এক জায়গায় বেশিদিন থাকি না।যদি মায়ায় জড়িয়ে যাই।আমি যা কিছু আঁকড়ে ধরতে চাই তাই হারিয়ে যায়।তাই আর কোন কিছু সিরিয়াসলি নেই না।দারুণ দারুণ সব চাকরি পাই আমি।কিন্তু কিছুদিন করে ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যাই।এখানে এসে সিফাতের মতো বন্ধু পেয়েছি,আপনাদের মতো এতো ভালো একটা পরিবার পেয়েছি।কিন্তু এসব কিছু আমার জন্য নয়।এখান থেকেও চলে যাব আমি। টেবিল ছেড়ে নিজের রুমে চলে গেল নীল।একে একে সবাই নিঃশব্দে চলে গেল।স্নেহা এখনও মাথা নিচু করে বসে আছে।একটা মানুষ একজীবনে এতোটা কষ্ট কিভাবে সহ্য করতে পারে জানা নেই স্নেহার।তানহা আর মৌ এসে স্নেহাকে রুমে নিয়ে গেল।।
স্নেহার জীবনে কোন না পাওয়ার গল্প ছিল না।কিন্তু জীবনের পাতায় আজ সেটাও লেখা হয়ে গেল।স্নেহা নীলকে চেয়েছিল,আর নীল পালাতে চেয়েছিল।সর্বহারা নীল আজ পালিয়ে জিতে গিয়েছে কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণ স্নেহা হেরে গিয়েছে।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক