ফুপি বলল, “তোকে না বলেছি আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় আসবি না।”
“আমি তোমার কাছে আসিনি।”
“কার কাছে এসেছিস?”
“নীতুর কাছে।”
“নীতু কে?”
“তোমার মেয়ে।”
“তাহলে তুই কোথায় এসেছিস?”
“নীতুর কাছে।”
ফুপু রাগে কটমট করে আমার দিকে একবার তাকাল। পারলে পানি ছাড়াই আমাকেই গিলে ফেলে। দু’বছর হলো ফুপা ব্লাড ক্যান্সারে মারা গেছেন। তারপর থেকেই ফুপি কেমন ডেস্পারেট হয়ে গেছে। অল্পতেই মাথা গরম করে যা ইচ্ছা তাই করে বসে।
“নীতুর কাছে কেন এসেছিস?” ফুপি রাগে শুধায়।
“ওকে নিয়ে যেতে।”
“ওরেব্বাস তুই দেখি বিরাট বড় মজনু হয়ে গেছিস।” ফুপি তাচ্ছিল্যর গলায় বলল।
“পারবি ওকে নিয়ে যেতে?”
“তুমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখো। স্রেফ দুই তুড়িতে নিয়ে যাব।”
“দেখাত দেখি।”
আমি দু দু’বার তুড়ি বাজিয়ে চিৎকার করে নীতুকে ডাকলাম,”নীতু.. নীতু..চলে এসো নীতু নীতু নিজের ঘরের দরজায় এসে দাড়াল। আমার দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নীচু করে রইল। আমি বললাম, “এমন কোন শক্তি নাই আজ আমাদের আটকে রাখে। চলে এসো নীতু..চলে এসো নিতুর চেহারা ভাবলেশহীন। কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল,” রিটন ভাই তুমি চলে যাও। মা’র অবাধ্য হয়ে আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব না।” ফুপি ঘর কাপিয়ে ভয়ানক অট্রহাসিতে ফেটে পড়ল। তার হাসি থামতে চায় না। একবার হাসি থামিয়ে বলল, “কীরে মজনু তোর ভালবাসা কই গেল?” ফুটানো বেলুনের মত মুহুর্তে চুপসে গেলাম আমি। ব্যাপারটা কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না।
নীতু সারারাত মোবাইলে কত কি বলল–সবকিছুতে মা’র বাড়াবাড়ি একদম ভাল লাগে না। আমার আর এক মুহুর্ত বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করেনা। কাল তুমি তৈরি হয়ে আসবে। মা’র সামনে দিয়ে তোমার হাত ধরে বেরিয়ে যাব। দেখি ঐ মহিলা কি করে ঠেকায় ? আর এখন ও কি বলছে? রাগে,অপমানে পা থেকে মাথা পর্যন্ত আমার আগুন ধরে গেল। নীতু যে এমনভাবে চিট করবে ভাবতেই পারিনি। নিজেকে খুব তুচ্ছ,তাচ্ছিল্য মনে হল। ‘তরুন সংঘের’ মাঠে রাত সাড়ে এগারটা পর্যন্ত কাটিয়ে বাসায় ফিরলাম। রাতে খাবার খেলাম না। বারান্দায় বসে একটার পর একটা সিগারেট শেষ টেনে যাচ্ছিলাম। হটাত আন নোন নাম্বার থেকে একটা কল আসলো। রিসিভ করতেই নীতু ফিসফিস গলায় বলল, “রিটন ভাইয়া মা তোমার বিরুদ্ধে থানায় জিডি করেছে। আমাদের বাসায় এসো না। পুলিশ তোমাকে এরেস্ট করবে।”
তারপর হটাত ফুপির গলা “হারামীর বাচ্চা তুই ঐ কুকুরটার সাথে আবার কথা বলছিস? তোকে আজ মেরেই ফেলব।” কয়েকটা চড়,থাপ্পড় আর ধস্তাধস্তির শব্দ। তারপর লাইনটা কেটে গেল বুঝতে অসুবিধা হলো না আমার সাথে কথা বলার কারনে ফুপি নীতুকে মা’র ধর করছে। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পায়চারি করতে লাগলাম। ঘড়িতে একবার সময় দেখলাম। রাত বারোটা বাইশ। কি করব বুঝতে পারলাম না। এত রাতে ফুপির বাসায় যাওয়া ঠিক হবে কি হবে না! মন থেকেও কোন সায় পাচ্ছিলাম না। বিষন্ন মনে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। কখন চোখ লেগে গিয়েছিল টের পাইনি। হটাত মাথার কাছে মোবাইল বেজে উঠল। দেখি নীতুর ফোন। ধড়ফড় করে বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠলাম। হ্যালো নীতু নীতু ওপাশ থেকে ফুপি বলল, ” শোন হারামীর বাচ্চা, যদি নীতুর কিছু হয় আমি তোকে ছাড়ব না। তোদের সব ক’টাকে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়ব, মনে রাখিস।”
“নীতুর কি হয়েছে ফুপি?” হটাত ভয় খেয়ে বললাম
“ছাড়ো তুমি ফোন..” নিতুর ছোট ভাই ফারাবির গলা শুনলাম।
“ভাইয়া আমি ফারাবি..”
“হ্যা ফারাবি নিতুর কি হয়েছে? “শঙ্কিত গলায় শুধালাম।
“ভাইয়া নীতু আপা রাগ করে অনেকগুলি ঘুমের ঔষধ খেয়েছে। অবস্থা খুব খারাপ। আমরা ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে এসেছি।”
“কখন?
“এই মাত্র।”
“আমি এখনি আসছি।”
মোবাইলে একবার সময় দেখলাম। তিনটা পঁয়ত্রিশ। মানিব্যাগ হাতে এক দৌড়ে বড় রাস্তায় চলে আসলাম। ভাগ্য ভাল একটা সিএনজি পেয়ে গেলাম। পঁচিশ মিনিটে ঢাকা মেডিকেলে পৌছে গেলাম। সরাসরি ইমার্জেন্সিতে গেলাম। আমাকে দেখে ফুপি আমার উপর আচমকা ঝাপিয়ে পড়ল। “হারামীর বাচ্চা তোর জন্য আজকে এই অবস্থা।” বলেই আমার জামার কলার ধরে টেনে-হিচড়ে এলোপাথাড়ি চড়,থাপ্পড় মারতে লাগল। ফারাবি আর হাসপাতালের কয়েকজন মিলে অনেক কস্টে ফুপিকে নিবৃত্ত করল। ফারাবি ওর মাকে এক পাশে টেনে নিয়ে গেল। আরেকপাশে হাসপাতালের অপরিচিত কয়েকজন আমাকে অন্য একটা চেয়ারে টেনে নিয়ে বসাল। টানাহেঁচড়ার এক পর্যায়ে মাথার পেছনটা দেয়ালে ঠুকে গিয়েছিল। মাথার পেছনে হাত দিয়ে দেখি আলু উঠে গেছে। প্রচন্ড ব্যথায় চারদিক ঝাপসা লাগছিল। ভীড়ের মধ্যে একজন আমাকে বলল, “ভাই এই খান্ডেরাও মহিলা আপনার কি হয়?” আমি কোন উত্তর করলাম না।
আরেকজন বলল, “জীবনে অনেক মহিলা দেখছি কিন্তু এমন সন্ত্রাসী মহিলা আর দেখি নাই।.. কে ভাই এই মহিলা?”
আমি বললাম, “ভাই প্লিজ আপনারা নিজের কাজে যান। উনি আমার ফুপি।” সবাই অবাক হয়ে অবিশ্বাসের চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল। তারপর যে যার মত চলে গেল। হটাত খেয়াল করলাম আমার জামার উপরের বুতাম দুটি টানাটানিতে ছিড়ে গেছে। মাথা ব্যথায় চোখ বোঝে বসে রইলাম। হটাত ফুপি আর ফারাবির কন্ঠ শুনে চোখ খুললাম। ফুপি বলল, “ফারাবি এখনি যা দোকান থেকে তাড়াতাড়ি ঔষধগুলি নিয়ে আয়।” আমি চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে ফারাবির হাত থেকে ছু মেরে ঔষধের প্রেসক্রিপশনটা নিলাম। ফারাবিকে বললাম,”তোর যাওয়া লাগবে না, আমি যাচ্ছি ।” দশ মিনিটেই ঔষধ নিয়ে ফিরলাম।
নীতুর স্টমাক ওয়াশ করা হচ্ছে। হড়বড় করে প্রচন্ড বমির শব্দ আসছে। তার ও কিছুক্ষন পর ওকে অবজার্ভেশন বেডে নেয়া হল। আমি একটা চেয়ারে গিয়ে বসলাম। মাথা ব্যথা আর প্রচন্ড ক্লান্তিতে আমার খুব ঘুম ঘুম পাচ্ছিল। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম ঠিক টের পাইনি। হটাত ফুপির গলার শব্দে ঘুম ছুটে গেল। ফুপি খুশিতে চিৎকার করে বলল,”রিটন রিটন নীতু কথা বলছে আমি উঠে দাঁড়ালাম। ফুপি বলল, “নীতু তোর সাথে কথা বলতে চাচ্ছে..”আমি কোন শব্দ করলাম না। হাসপাতালের গেট দিয়ে সোজা বেরিয়ে পড়লাম। হাটতে শুরু করলাম । এতক্ষনে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। “রিটন রিটন।” বলে ফুপি চিৎকার করতে করতে আমার পেছন পেছন আসছে। অনেকটা দৌড়ে এসে আমার হাত ধরল। “যাসনে বাপ.. নীতুর সাথে একবার দেখা করে যা।” আমি বললাম,” হাত ছাড় ফুপি। আজ থেকে তুমি আর আমার ফুপি না। ভাবব–আমার একজন ফুপি ছিল, সে মরে গেছে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে তোর ফুপি মরে গেছে। এখন একবার নীতুকে দেখে যা বাপ।”
“শোন–আমি তোমার মেয়েকে ভুলে গেছি। তোমার মেয়েকেও আমাকে ভুলে যেতে বলবে।”
“ঠিক আছে ভুলে যাস।এখন অন্তত একবার দেখে যা বাপএক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে বললাম,
“কিসের বাপ? আমাকে ওসব ফালতু বাপ-টাপ ডাকবে না। শোনে রাখ–আমি তোমাকে যেমন ঘৃনা করি, তেমনি নিজের বাবাকেও প্রচন্ড ঘৃণা করি। জায়গা-সম্পত্তি নিয়ে তোমরা তোমাদের এই বিরোধ নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে পারতে। কিন্তু সেটা আমাদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিলে। আই হেট বোথ অফ ইয়ো।” ফুপি মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে তখনো রিটন রিটন বলে বিলাপ করে কাঁদছিল। অভিমানে,অপমানে,কষ্টে আমি আর পেছন ফিরে তাকাই না। দ্রুত হাটতে থাকি..
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক