কাল রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আমি মারা গিয়েছি। আমার ছেলে মেয়ে দুটো মাটিতে বসে একটা একটা মুড়ি নিয়ে খাচ্ছে। কারণ ওদের খিদা লেগেছে এখনো কেউ ওদের খাবার দেয় নি। সবাই আমার শরীর সবার কাছে যা এখন লাশ,তা নিয়ে বিজি। এই শরীর টাকে কেউ তো এতদিন শরীর ভাবে নি। কারো কাছে কাজ করানোর অটো মেশিন ছিল, কারো খিদে মেটানোর। নিজেও যত্ন নিই নি বহুকাল। কেউ অবশ্য বলে নি যত্ন নিও। আজ খুব যত্নে সাজানো হচ্ছে আমার এই শরীর টা। ফুল চন্দনে ডেকে গেছে। বড় করে সিদুর পড়িয়ে সাজিয়ে দেওয়া হলো। যারা কোন দিন একবার ও জন্য আমায় বলে নি তুই বড় সুন্দর রে, আজ ওরা কি মায়া চোখে তাকিয়ে আছে। যারা কখনো বলে নি, তুই বড্ড ভালো রে, বেঁচে থাক আমাদের সাথে। তারা বড্ড আহাজারী করছে। কিছু বুঝতে পারছে না শুধু আমার পাঁচ বছরের মেয়ে আর দুই বছরের ছেলে টা। তাদের মা এখনো খাবার নিয়ে ছুটছে না এতেই তারা খুশি আপাতত।
আমি শিমুল। ঠাম্মি খুব শখ করে এই নাম রেখেছিল আমার। আমি নাকি শিমুল তুলো মতো ধবধবে ফর্সা আর তুলতুলে ছিলাম। মায়ের ভীষণ আপত্তি ছিল। ছেলেদের নাম নাকি এইটা। মা আমায় পুতুল বলে ডাকতো। খুব আদর যত্নে বড় হয়েছি বড় পরিবারে। পাঁচ ভাইয়ের এক বোন ছিলাম। সবার পছন্দে মিতুনের সাথে আমার বিয়ে হয়েছিল। মা বলত – বড় পরিবারে দিলে সারাজীবন কাজ করতে করতে মরেও নাম নেই। নিজের মত করে নিজের সংসার গুছিয়ে নিবি। বেশ সুখে থাকবি। মিতুনের মা ছিল না। বাবা ছিলো। তাও মিতুনের বোনের সাথে থাকত। মাঝেমধ্যে আসতো। পড়ালেখা চুলোয় তুলে বসে গেলাম সংসার সংসার খেলায়। দুইজনের সংসারে এলো আমার মেয়ে, শুরু হলো জীবন যুদ্ধ। সব দিক সামলে উঠার আগেই এসে গেলো ছেলে। না আমি আর পারছিলাম না। হাপিয়ে উঠতাম। মিতুন সারাদিন কাজ শেষে যখন আসতো তখন আমার মেজাজ সপ্তম আকাশে। বাচ্চা ছাড়া আর কোন কাজ নেই আমার। ওদের খাওয়া, দুষ্টমি সামলাও, ঘরের কাজ সব এক করতে করতে আমি চরম খিটখিটে হয়ে গেছি।
তবে ছেলে মেয়ে গুলোকে অযত্নে করতাম না। একটা থাপ্পড় ও লাগাই নি ওদের গালে। আমার কলিজার টুকরো। ওরা কি খাবে? কি করলে ভালো হবে? কোন খেলায় বুদ্ধি বিকাশ হয় এই সব চিন্তা করতে করতে আমার দিন যাই। মিতুনের সাথে প্রায় আমার ঝগড়া হয়, আমার মনে হতে থাকে ও অন্য মেয়ের সাথে আছে। ও আমাকে বার বার বিশ্বাস করাচ্ছে আমি কাজের চাপে সত্যিই টাইম পাই না। আমার অবিশ্বাস দিন দিন বাড়তেই থাকে। এই নিয়ে প্রায় ঝগড়া হয়, বাচ্চাগুলো খুব কান্না করে তখন৷ তাই আবার চুপ হয়ে যাই আমি। ওদের কান্না আমি নিতে পারি না। কাল ব্যাগ থেকে বড় এক জোড়া কানের দুল পেলাম। ওকে বলায় ও বলে, তোমার জন্য এনেছি। আমার বিশ্বাস হয় নি, এই নিয়ে কথা কাটাকাটি। এক পর্যায়ে ও বলে, কি শুনতে চাও? অন্য মেয়ের জন্য? ঠিক আছে যাও তোমার শান্তির জন্য বলছি অন্য মেয়ের জন্য। আমি আর ঠিক থাকতে পারি নি। সে রাতেই রাগের মাথায় এই কাজ টা করে ফেললাম। ঘুম যখন ভাঙ্গে তখন মনে হলো, হয়ত সত্যিই আমার জন্য ছিলো।
উঠে কাজ করতে যাচ্ছিলাম, বাচ্চাদের খাবার বানাতে হবে। ওকে অফিসে যাওয়ার জন্য নাস্তা। না, আমি কিছুই ধরতে পারছিলাম না। আমি দৌড়ে গেলাম মিতুনের কাছে ওকে বলতে। কিন্তু ও শুনছে না। ঘুমাচ্ছে। বাচ্চাদের কাছে গেলাম। ওরা কি সুন্দর ঘুমাচ্ছে। কিন্তু ফ্লোরে পড়ে আছে আমার শরীর৷ আমি অবাক হয়ে থাকিয়ে আছি৷ মিতুন নাস্তা না পেয়ে ডাকতে আসে৷ এই অবস্তা দেখে তারাতাড়ি কোলে নিয়ে খাটে শুয়ে দেয়। কি আকুল ভাবে ডাকতে থাকে, সবাইকে ফোন দেয়, ডাক্তার আনে। ততক্ষনে সবার জানা হয়ে গেছে শিমুল আর নেই। আস্তে আস্তে ভীড় জমতে থাকে, মানুষ জন আসতে শুরু করে। অনেক আত্নীয় এসে অনেক তদারকি শুরু করে দিয়েছে। আমি সবাইকে দেখছি, সবার কথা শুনছি। এইসবের মধ্যে আমার বাচ্চা দুটো উঠে বসে আছে অনেকক্ষন হলো। এতক্ষন আমি ওদের দুইবার খাওয়াতাম। কিন্তু এখনো ওরা কিছু খাই নি। সবাই কান্না জুড়ে দিয়েছে। মিতুনের বোনেরা এসে রান্না ঘরে ডুকে গিয়েছে। তাদের আত্নীয় স্বজন আসতে শুরু করেছে সবাইকে চা নাস্তা ব্যবস্থা করতে হচ্ছে।
আমার মেয়েটা পুতুল বুকে নিয়ে এক দিকে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা বার বার আমার কাছে আসতে চাইছে। ঘুম থেকে উঠে যে মায়ের বুকে থাকতে হয় কিছুক্ষন। তার মা কেন এখনো ঘুমাচ্ছে সে তা বুঝতে পারছে না। আমার মা এসে নাতি গুলোকে বুকে নিয়ে বসল। শোকের মধ্যেও চলছে নানা আয়োজন। শেষ অনুষ্টান। মিতুন চাইলে বসে থাকতে পারছে না। ওকে নানা দিকে ফোন দিতে হচ্ছে। নানা কাজ। এত কিছুর মধ্যেও মিতুন মা কে বলে গেল বাচ্চা গুলো কিছু খায় নি। কিছু যাতে মুখে দিয়ে দেয় ওদের। কখন খাবার হবে তা তো কেউ জানে না। মা তো জানে না কোথায় ওদের খাবার কোথায় কি? মা চা তে ডুবিয়ে বিস্কুট খাইয়ে দিলো। এতে কি ওদের পেট ভরে? ছেলে অন্য বাচ্চাদের সাথে দৌড়া দৌড়ি শুরু করে দিয়েছে। মেয়ে পারছে না। ওর খিদে লেগেছে। আমার বুক টা ফেটে যাচ্ছে। মা ও অন্য দিকে চলে গেল। বাচ্চা দুটো আমার আশেপাশে ঘুরছে। মায়ের কাছে যাবে ওরা। ওদের এই অবস্তায় দেখে সবার চোখ ভিজে যাচ্ছে।
-আহারে, এই বাচ্চাগুলো কি হবে এখন? মা ছাড়া বাচ্চা গুলো কে একেবারে শেষ হয়ে যাবে।
বেলা বয়ে যাচ্ছে। লোকজন আরো বাড়ছে। কেউ খাচ্ছে, কেউ দিচ্ছে খাবার, কেউ গল্প জুড়েছে। আমার ছেলে মেয়ে গুলো ধুলো মাখা সকাল থেকে কিছু না খেয়ে একেবারে অসহায় লাগছে। মিতুনের বোন ওদের ডেকে এনে খাওয়াতে বসল তখন তিনটা। ওর একটা ছোট ছেলে আছে ওর সাথে। এত ঝালের তরকারী কি ওরা খায়? মেয়েটা তাও খেয়ে নিলো। খুব খিদে যে লেগেছে। এমনে তো মায়ের সাথে কত ছুটোছুটি। ছেলেটা কান্না শুরু করেছে। কোলে কোলে নিচ্ছে সবাই। কিন্তু ওর যে খিদে পেয়েছে। শেষমেশ ঘুমিয়ে গেলো। সবাই একটু শান্তি পেল।যাক বাবা। আমি কি পারতাম ছেলেকে এইভাবে না খাইয়ে ঘুম পাড়াতে?
সভা শেষ হলো, আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মেয়েটা এত বুঝে না তাও একটু ছুয়ে দিলো। ছেলে তখনো ঘুম।
সভা শেষে সবার আবার চা খাওয়ার ধুম। সবাই চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ থাকছে। আরো অনেক কাজ বাকি।
দিন গেল রাত এল। ছেলেকে কিছু খাওয়ালো মা। মা বুকে নিয়ে শুয়ে আছে ওদের। ওরা তো মা চেয়েই যাচ্ছে। এইভাবে এক দিন দুই দিন তিন দিন পার হচ্ছে। ঘরে অনেক মানুষ। সবার খাওয়া দাওয়া চলছে। তাও বাচ্চা দুটোর যে মা নেই, তাই কাপড় চোপড় ওই একটা পড়ছে আর কি। দুপুরে আর রাতে ভাত টা ছাড়া আর তেমন কিছু হচ্ছে না খাওয়া ওদের। কখনো ঝাল তো কখনো শক্ত ভাত। পারছে না ওরা। মেয়েটা বড় অদ্ভুত চোখে তাকায়। মাঝেমধ্যে সে নিজেই ভাইকে বিস্কুট তুলে দেয়। কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে যায় ছেলেটা। উঠে কান্না করতে করতে। সারাদিন খিটখিটে। সবাই আর কত সহ্য করবে? দেয় দু চার কিল বসিয়ে। মিতুন চেষ্টা করে। পারে না।
আমার বুক ফেটে যাই। কিছু তো করতে পারি না। সবাই বলে, মা তো স্বার্থপরের মতো নিজে বেঁচে পালালো। বাচ্চা গুলো কে মানুষ করবে? থাক নিজের মত। না খেলে না খাক। নিজেই শিখবে। বাচ্চা গুলো অসহায়ের মতো চেয়ে থাকে। আমি জোরে চিৎকার করে উঠি। আমি উঠে বসি। আমি কি বেঁচে আছি? আমি ঘমছি, হাতড়ে পানির বোতল নিয়ে পানি খাই। ফ্লোর থেকে উঠে খাটে যাই। আমার সোনামণিরা ঘুমাচ্ছে। এতক্ষন দেখা সব কিছু মনে পড়তে আবার ডুকরে উঠলাম। দুইজন কে বুকে নিয়ে জোরে চেপে ধরি। নিজেকে নিজে বলি, যত সমস্যা হোক আমি লড়ে যাবো তাও তোদের ফেলে যাবো না।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক