গ্রামের সহজ-সরল মেয়ে ঈশিকা। ছোটবেলা থেকেই বাবার কাছে মানুষ। জন্মের কিছুদিন পর পরই মা মারা যায়। ভাই-বোন বলতে কেউ নেই, বাবা ও মেয়ের মাঝে। সংসারের অশান্তি ও মেয়ের কথা চিন্তা করেই রাজ্জাক সাহেব দ্বিতীয় বিয়ের কথা আর ভাবেননি কখনো । একমাত্র মেয়েকে নিজেই বড় করে তুলেছেন। ঈশিকা খুব আদরের মেয়ে, ওকে নিয়ে বাবার অনেক স্বপ্ন। বাবার ইচ্ছা মেয়েকে শহরের ভাল কোন ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করাবেন কিন্তু চোখে অনেক স্বপ্ন থাকলেও, স্বপ্ন পূরণ করার মতো সাধ্য তার নাই। তবুও তিনি স্বপ্ন দেখেন, মনে মনে বিশ্বাস করেন একদিন সেই স্বপ্ন সত্যি হবে। রাজ্জাক সাহেবের পারিবারিক অবস্থা খুব একটা ভাল না। জমি-জমা,বিষয়-সম্পত্তি কিছুই নেই গ্রামের ওই বাড়ি আর ছোট্ট একটা মুদি দোকান যা দিয়ে বাবা মেয়ের সংসার চলে।
ঈশিকা এবার এইচ এস সি পরীক্ষা দিবে। মেয়েটা পড়ালেখায় বেশ ভাল এবং বুদ্ধিমতীও। স্কুলের রেজাল্ট যেমন সবসময় ভাল ছিল তেমনি এস এস সি তেও A+ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়। পড়ালেখার ক্ষেত্রে ঈশিকা তেমন কোন সুযোগ-সুবিধা পায় নি,পায় নি কোন প্রাইভেট শিক্ষক তারপর ও নিজের মেধা আর অক্লান্ত প্ররিশ্রমের ফলে এতো দূর এগিয়ে গেছে। আর কিছুদিন পর এইচ এস সি পরীক্ষা।সংসারের সমস্ত কাজ এক হাতে সামলানোর পাশাপাশি ঈশিকা এখন পড়ালেখা নিয়ে বেশ ব্যস্ত।
তার লক্ষ্য একটাই বাবার স্বপ্ন পূরণ করা। অন্যদিকে রাজ্জাক সাহেবের দুঃশ্চিন্তা যেন বেড়েই চলেছে। পরীক্ষা শেষ হলেই যে শুরু হয়ে যাবে ভর্তি পরীক্ষা। আর ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে ভাল ভাল প্রাইভেট শিক্ষক,কোচিং ও বিভিন্ন গাইডলাইন দরকার যা ঈশিকা কখনোই পায় নি। আর্থিক অভাবের জন্য তিনি তার মেয়েকে প্রাইভেট শিক্ষক বা কোচিং কোথাও পাঠাতে পারতেন না। মুদিখানা থেকে যে টুকু আয় হয় তা দিয়ে কোন মতে ২ জনের সংসার চলে যায়। এছাড়াও মেয়ের বই পত্র এবং স্কুলের খরচ তো আছেই।যেখানে সংসারের এসব খরচ চালাতেই হিমশিম খান,সেখানে মেয়েকে কোচিং দেওয়ার কথা ভাবতেও পারেন না। কার কাছে,কোথা থেকে মেয়ের জন্য একটু গাইডলাইন নিয়ে দিতে পারবেন সেসব নিয়ে চিন্তার যেন শেষ নাই…..
মা-মরা একমাত্র মেয়েকে খুব ভালোবাসেন, চোখে হারান বলতে গেলে মেয়েও তেমনি বাবা অন্ত প্রাণ, বাবার স্বপ্ন পূরণের জন্য ব্যাকুল মেয়ের সুখের জন্যই এত কষ্ট,এত প্ররিশ্রম,এত আত্মত্যাগ।
দেখতে দেখতে এভাবে বেশ কিছুদিন চলে গেলো। ঈশিকার পরীক্ষাও শেষ আর কিছুদিন পর ই ভর্তি পরীক্ষা।বরাবরের মতো এবারও A+ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে। তবে ২ টা বিষয়ে A+ না থাকায় গোল্ডেন আসে নি এ নিয়ে ঈশিকা ভাবছে না ,ওর এখন চিন্তা ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে। রাজ্জাক সাহেব মেয়ের রেজাল্টে খুব খুশি। তিনি পড়ালেখার জন্য মেয়েকে উৎসাহ দেন, গ্রামের শিক্ষিত লোকজনের কাছ থেকে সাজেশন নেন, বিগত বছর গুলোর প্রশ্ন সংগ্রহ করে আনেন। বিভিন্ন কোচিং গুলোতে ঘুরে ঘুরে শিক্ষকদের অনুনয়-বিনয় করে লেকচার শিট সংগ্রহ করে এনে মেয়েকে দেন। যেন ভাল করে পড়াশোনা করে শহরের ভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারে তার জন্য। দিন যত যায় রাজ্জাক সাহেবের দুঃশ্চিন্তা ততই বাড়তে থাকে। প্রাইভেট ও কোচিং না করে ঈশিকা কিভাবে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে, এত এত শিক্ষার্থীর মাঝে কিভাবে নিজেকে প্রমান করবে এসব নিয়ে সারাক্ষণ চিন্তা করে কাটায়। ভর্তি পরীক্ষার আর ১ মাস বাকি। নিজের চেষ্টা ও বাবার সহযোগীতায় ঈশিকা বেশ ভালই প্রস্তুতি নিয়েছে তার বিশ্বাস পরীক্ষায় সে ভাল করবে,বাবার স্বপ্ন এবার পূরণ করবে।
আরও কিছুদিন এভাবে কেটে গেলো। রাজ্জাক সাহেবের ঢাকায় আত্মীয়-স্বজন তেমন কেউ নেই,মেয়েকে নিয়ে কবে যাবেন, কোথায় থাকবেন এ যেন আরেক বিপদ। অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলেন নিজেই যাবেন মেয়েকে নিয়ে। গ্রামের এক পরিচিত ভদ্রলোক ঢাকায় থাকেন তার বাসায় গিয়ে উঠবেন এ নিয়ে কথা বলে আগেই সব ঠিক করে রেখেছেন। ঈশিকার প্রস্তুতি মোটামুটি শেষ তবে সে জানে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া এতটা সোজা না ,শহরের ছেলে-মেয়েদের সাথে লড়াই করে তাকে জিততে হবে আর এজন্যই মাঝে মাঝে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে তবে সেও হার মানতে রাজি না,তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ…….
পরীক্ষার ঠিক ২ দিন আগে মেয়েকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। ঢাকায় পৌঁছে রাজ্জাক সাহেব খানিকটা অবাক ই হলেন তিনি দেখেলন রাস্তায় কেউ কেউ অসুস্থ অবস্থায় পরে আছে,কেউ কেউ খাবারের জন্য হাহাকার করছে, কেউ বা আবার স্বামী-সন্তানের জন্য মানুষের কাছে হাত পাচ্ছেন। ঢাকার মানুষ গুলো কেমন জানি,কারো প্রতি কোন মায়া-মমতা নেই , কোন ভালোবাসা নেই , নেই কোন মনুষত্ববোধ। সব মিলিয়ে ঢাকা শহর যেন বোরো অসহায় আর এসব দেখেই রাজ্জাক সাহেবের মন খারাপ হয়ে গেলো, বুকের ভেতরটা তে এক প্রকার ব্যথা অনুভব করতে থাকলেন। রাস্তায় বিভিন্ন রকমের মানুষ দেখতে দেখতে বাসায় এসে পৌঁছালেন। এরপর বাসায় এসে খাওয়া-দাওয়া সেরে সেদিনের মতো বাবা-মেয়ে বিশ্রাম নিয়ে নিলেন।
ঢাকায় এসে ঈশিকার চিন্তা যেন আরও বেড়ে গেল। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া বা পড়াশোনা কোনটাই আর করতে পারল না প্রথমবারের মতো পরীক্ষা দিবে বলেই হয়তো তার এত টেনশন হচ্ছে, একটু ভয় ভয় করছে রাত পার হলেই পরীক্ষা। কি না কি হবে এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে ঈশিকা ঘুমিয়ে পড়ল পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে মেয়েকে নিয়ে রাজ্জাক সাহেব বেরিয়ে পড়লেন। রাস্তায় জ্যাম আর মানুষের ভিড় ঠেলে ঠিক যথাসময়ে পরীক্ষার হলে পৌঁছে গেলেন। মেয়েকে আশীর্বাদ করে ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষা দিতে বললেন আর পরীক্ষা শেষে এখানে এসে অপেক্ষা করেবন বলে মেয়েকে পরীক্ষার হলে দিয়ে চলে আসলেন।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর রাজ্জাক সাহেব এসে মেয়ের জন্য বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন কিন্তু কোথাও তিনি তার মেয়েকে দেখতে পেলেন না। একে একে সবাই বেরিয়ে আসল শুধু ঈশিকা ছাড়া। পাগলের মতো এদিকে সেদিকে,রাস্তায় ,সব জায়গায় খুঁজলেন তবুও খুঁজে পেলেন না।এভাবে প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন কিন্তু মেয়ের দেখা আর পেলেন না ঈশিকা পরীক্ষা দিতে ঠিক ই গেলো অথচ আর ফিরে এল না রাজ্জাক সাহেব প্রতিদিন মেয়েকে খুঁজতে সেখানে যান,ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেন, একে-ওকে জিজ্ঞেস করেন কিন্তু তিনি মেয়ের কোন খোঁজ ই পান না ,হারিয়ে ফেলেন সারাজীবনের জন্য।
সেদিনের পর থেকে রাজ্জাক সাহেব মানসিক ভাবে অসুস্থ। গ্রামে আর ফিরে যান নি, যদি মেয়ে ফিরে এসে বাবাকে দেখতে না পায় সেই আশা নিয়ে দিনের পর দিন এখনো অপেক্ষা করে আছেন। কত স্বপ্ন বুকে চেপে মেয়েকে নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন, শহরের ইউনিভার্সিটিতে মেয়েকে পড়াশোনা করাবেন ভেবেছিলেন কিন্তু কোন স্বপ্ন তো পূরণ ই হল না অথচ নয়নের মনি মেয়েটাকে হারিয়ে ফেললেন। এভাবে আরও ৭-৮ মাস কেটে যায়। প্রতিরাতে মেয়ের স্মৃতি জড়িয়ে এখনো অঝোরে কাঁদেন। রাজ্জাক সাহেব এখন ঢাকায় ই থাকেন, রিক্সা চালান। মেয়ে হারানোর যন্ত্রনা বুকে নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ান।
একদিন ঠিক দুপুর নাগাদ তিনি রিক্সা নিয়ে রাস্তায় বেড়োলেন। এমন সময় ভার্সিটি পড়ুয়া তার মেয়ের সমবয়সী একটা মেয়ে এসে ধানমন্ডি যাবে বলে রিক্সায় উঠলেন। মেয়েটিকে দেখে ঈশিকার কথা মনে করে নিজের অজান্তেই ২ ফোঁটা চোখের জল ফেললেন আর আফসোস করলেন ঈশিকা থাকলে আজ হয়তো সে ও পড়শোনা করতো। এসব ভাবতে ভাবতে মেয়েটিকে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন আজ রাস্তা বেশ ফাঁকা,একদম নিরিবিলি পরিবেশ চারদিকে তেমন কোন লোকজন নেই বললেই চলে…হঠাৎ রাস্তার মাঝপথে কিছু মুখ বাধা মানুষ এসে রিক্সা থামিয়ে দিলেন। দেখতে ভয়ংকর লোকগুলো মেয়েটিকে ঘিরে ধরে তার কাছে টাকা-পয়সা,মোবাইল যা আছে সব কিছু দিয়ে দিতে বলে। মেয়েটি প্রথমে দিতে রাজি না হওয়ায় তার গলায় ছুরি ধরে ভয় দেখাতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে রাজ্জাক সাহেব মেয়েটিকে সুরক্ষা করার জন্য ছুটে যান নিজের বিপদের কথা চিন্তা না করে চাঁদাবাজ গুলোর সাথে হাতাহাতিও করেন, তবে একা বয়স্ক মানুষ তাদের সাথে পেরে ওঠেন না। বরং তিনি নিজেই অনেক মার খান, হাত ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছুরির আঘাত পান শরীর থেকে অনেক রক্ত ক্ষরণ হয় এবং এক পর্যায়ে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
রাজ্জাক সাহেবের এমন করুন পরিস্থিতি দেখে আশেপাশের দুই, চার জন লোকজন ছুটে আসতে থাকেন এবং তাকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য বললেন এদের মধ্যেই ভিড় ঠেলে হঠাৎ এক যুবক এসে উনার পাশে বসলেন এবং রক্তাক্ত শরীর নিজের কোলে তুলে নিলেন। এমতবস্থায়, তাকে দেখেই বলে উঠলেন আর হারাতে দেবো না তোকে……