জনম জনম তব তরে কাঁদিব

জনম জনম তব তরে কাঁদিব
খাটিয়ায় যে মেয়েটি এখন চোখ বুজে শুয়ে আছে, সে বিয়ের পর আমায় তার শয্যাপাশে পায়নি। অথচ মৃদুলার এ নিয়ে তেমন আফসোস করতে দেখতাম না। সে হাসিমুখ করেই রাতে শুতে আসতো। আর আমি ঐ হাসি দেখে আরও রাগতাম। বালিশ ছুড়ে দিতাম ওর মুখে। বলতাম, মেঝেতে ঘুমো। খবরদার! আমার দিকে আসবি না।
সে তার গ্রাম্য ভাষায় বলতো, আসলে কী করবেন, মারবেন? আমি কিছু বলতাম না দেখে সে নিজের মনেই মেঝেতে শুতে শুতে উত্তর তৈরি করে নিতো। অনেককিছু বলে যেত সেইসাথে। “আমাকে মারলে আমিও কি ছেড়ে দিব? প্রতিশোধ নিব! সেই প্রতিশোধ নিব ভালবাসা দিয়া।” এটুকু বলে সে একটু থামতো। তারপর আবার শুরু করতো, আমি কি নিজ ইচ্ছায় বিয়া করছি? আর আমার বাপেই কইছিল আফনের লগে খুব মানাইবো। এতেই তো আফনের বাবা খুশি হইয়া বিয়া দিছেন।
আমি না পেরে জবাব দিই, উনি আমার বাবার বন্ধু বলেই বাবা এতটা করেছেন, বুঝলি? “আফনে ত তাইলে পুরাটা জানেন না। আমার বাপে একসময় তার ভাগের ট্যাহায় আফনের বাপেরে জমি কিনতে সাহায্য করছিল। এই গুলিস্তানের জমিটা আমার বাপের ট্যাহায় কেনা!” আমি কিছু বলি না। কথাটা সত্য, চারিদিক থেকে না হলেও কিছু বিশ্বস্ত লোক হতে এমনটাই জেনেছি। তাই বিশ্বাস না করেও উপায় নেই। মৃদুলার বকবক শুনে তাই একসময় হতাশ হই। আফসোস লাগে শুধুমাত্র বাবার উদ্যোগের কারণে আমার নিজের পছন্দের দাম থাকলো না। আমি উঠে পড়ি। মৃদুলা তখন ঘুমিয়ে কাঁদা। আমার সিগারেটের তৃষ্ণা পায়। সিগারেট হাতে বারান্দায় যেতে গিয়ে কান্নার মত আওয়াজ শুনি। চমকে বলি, তুই কি জেগে ছিলি? মৃদুলা উঠে বসে বলে, আফনে কেমুন স্বামী! বউরে কানতে দেইখাও কিছু কন না?
“দ্যাখ মৃদুলা, তোকে আমি দু’দিন বাদেই ডিভোর্স দেব। আমার সেই প্রিপারেশন নেয়া আছে। পেপারপত্র সব রেডি, এখন শুধু তুই পারিস আমার বাবাকে রাজি করাতে।” মৃদুলা বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। খোলা বারান্দা থেকে আসা চাঁদের আলোয় ওর বাকরুদ্ধ চেহারা দেখি আমি। মৃদুলা অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলে, কিন্তু আমি যে আফনেরে ভালবাসছিলাম! সম্পর্কে তিক্ততা নিয়েই একসময় মৃদুলাকে মেনে নিই। কিন্তু মৃদুলার কোনোকিছুই আমি সহ্য করতাম না। এমনকি সে রান্না করলেও আমি সেটা খেতাম না। একদিন হঠাৎ দেখি সে আমার প্রিয় কাচ্চি বিরিয়ানি রেধেছে। সেদিন রাগ না করে খেলাম। সে পুরোটা সময় পাশে বসে রইলো। খাওয়া শেষে যখন তার দিকে তাকিয়েছি মৃদুলা তখন কাঁদতে কাঁদতে বলল, জনম জনম তব তরে কাঁদিব।
আমি খাটিয়ার সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারছি না। কোনো একজনকে বেশ কিছুক্ষণ আগরবাতি না ধরানোর জন্য বকাঝকা করলাম। সে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। কারণ আগরবাতি ধরানোই রয়েছে। এবং সেটা আমি নিজেও জানি। আগরবাতির তীব্র ঘ্রাণে মনটা খুব বেশিই করুণ হয়ে যাচ্ছে। তবু কেন এমন করলাম জানি না। হয়তো আমার মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। লোকজনও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাদেরকে সচকচিত করে আমি হঠাৎ ধমকে উঠি, এই ভদ্রলোকগুলোকে রোদে দাঁড় করিয়ে রেখেছো কেন? যাও, সামিয়ানার মধ্যে নিয়ে বসাও!
লোকজন সাথে সাথেই সামিয়ানার ভেতর প্রবেশ করতে থাকে। আর তখনই ঘরের ভেতর থেকে সদ্য জন্মানো আমার কন্যা সন্তানের কান্নার আওয়াজ আসে। আমি ছুটে যাই। ঘরে তখন অনেক মানুষ। বেশিরভাগ শ্বশুরবাড়ির লোকজন। তারা কেঁদে কেঁদে এখন যেন সাময়িক শক্তি হারিয়েছেন। মৃদুলার বাবা আমার কাঁধে হাত রেখে বলেন, আমার মেয়েটা বড় দুঃখ নিয়ে মরলো।
কথা শেষ করবার আগেই তিনি কাঁদতে আরম্ভ করলেন। কান্নার মাঝে ভারসাম্য হারিয়ে মেঝেতে পড়ে যাচ্ছিলেন। আমি তাকে ধরে ধরে চেয়ারে বসালাম। তারপর নিজের মেয়ের কাছে আসলাম। মেয়ের কান্না আমাকে দেখার সাথে সাথেই থেমে গেল। অদ্ভুত এক বিস্ময় নিয়ে সে আমাকে দেখছে। আমি জানি না আমি ওর যোগ্য পিতা কিনা। কিন্তু ওর কান্না আমার হৃদয়কে নাড়িয়ে দিয়েছিল। এখন ওর নিশ্চুপ নীরবতায় আমি স্বস্তি অনুভব করছি। আমি মেয়েটাকে কোলে নিয়ে আমার শ্বশুরের দুঃখ অনুভব করলাম। আমি যেখানে নিজের মেয়ের একদিনের কান্নায় সহ্য করতে পারছি না, সেখানে তার মেয়েকে আমি রোজ কাঁদিয়েছি! মৃদুলা মারা গেছে আমার এই মেয়ের জন্মের সময়। গতরাতের ঘটনা, আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরিয়েছি। মৃদুলার কান্নার শব্দ শুনে হঠাৎ ঘরে এলাম। বিরস কন্ঠে বলি, কী হয়েছে? দুঃস্বপ্ন দেখেছো? সে আমার দিকে অদ্ভুত ক্লান্তির চোখে তাকায়। আমি ভয় পেয়ে বলি, কী হয়েছে?  সে বলে, ফ্যানটা ছাড়েন, গরম করে।
“ফ্যান ছাড়াই আছে।”
“আফনে কি আমার একটা কথা রাখবেন? আমি মইরা গেলে আফনে কাউরে বিয়া কইরেন না। আমার আল্লার দোহাই লাগে!” “কী বলো এইসব? আচ্ছা, যাই হোক.. কথা দিলাম। এখন ঘুমাও।”
এটা বলে আমি তার পাশে বসতে যেতেই মৃদুলার প্রসব বেদনা শুরু হল। হাসপাতালে নেবার সবরকম প্রস্তুতি নেয়া শেষে অ্যাম্বুলেন্সে তোলার সময় দেখি তার চোখের জ্যোতি কমে গেছে, ধীরে ধীরে চোখ বুজে আসছে। সেখানে চোখের মনির অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে না। আমি ভয়ে ভয়ে ওর মাথায় হাত রাখি, বলি, ময়না পাখি আমার! আফসোস, সেদিন এত আদর করে ডেকেছি অথচ সে শুনতেই পায়নি। আর পাবেও না কোনোদিন। শুধু অ্যাম্বুলেন্সে যাবার সময় সারা পথে সে ঘোরলাগা কন্ঠে একটা কথায় বলে গেছে, জনম জনম তব তরে কাঁদিব। মৃদুলাকে কবরে শুইয়ে রাখা হয়েছে। সবাই চলে গেলে আমি আবার কবরের সামনে আসি। মৃদুলার বলে যাওয়া কথা চয়নে রয়ে গেছে আজও। সে বলেছিল, ভালবাসার প্রতিশোধ নিবে। আমি বিড়বিড় করে বলি, সত্যিই তুমি তোমার প্রতিশোধ নিতে পেরেছো!
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত