ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল

ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল
বিয়ের পর পর যখন শশুরবাড়ি থেকে মায়ের বাসায় যেতাম , পৌঁছানোর বোধহয় ঘন্টা দুই না যেতেই শাশুড়িমা ফোন দিয়ে খুব আদুরে গলায় বলতেন,
— বউমা , ঠিকমতো পোঁছে গেছো ,ভীষণ খারাপ লাগছে,বাড়িটা একদম খালি খালি লাগে । সারাদিন তোমার সাথে থাকতে থাকতে এখন কেমন যেন মায়া লাগছে।
— জি ,আম্মা পৌঁছে গেছি অনেক আগেই । আমার আম্মুরও তো খারাপ লাগে একটা রাত অন্তত থাকি ? বললেও ভীষণ খুশি হতাম মনে মনে ।
— তা থাকো । মার তো খারাপ লাগবেই তারপরও এটাই এখন তোমার নিজের বাসা। মাকে তো মেয়ে বিয়ের পর একাই থাকতে হয়।
— জি আম্মা । তা তো অবশ্যই।
— আচ্ছা , তোমার মায়ের সাথে গল্প করো তুমি । আমার একা একা ভালো লাগছে না তোমাকে ছাড়া। তাই ফোন দিলাম। থেকে আসো আর বেয়াইনকে আমার সালাম দিও।
— ঠিক আছে আম্মা রাখি , সাবধানে থাকবেন ।আমি চলে আসবো বলে একটু মন খারাপ করতাম আর ভাবতাম আহারে ! বেচারি আমাকে কত ভালবাসে ! পরে মাকে যখন বলতাম ,
— মা শাশুড়ি ফোন দিয়েছিলো ,তার নাকি ভালো লাগছে না।
— তোর শাশুড়ির একটা ছেলের বউ তুই, ভালো তো বাসবেই। তুই কি আজ চলে যাবি ? একটা রাত থেকে যা। কাল সকালে যাস।
–হমম ,তাই বলেছি কিন্তু ভেবেছিলাম কয়েকদিন থাকবো তোমার সাথে।
— শোন এখন ওরাই তোর আপন যেহেতু ফোন করেছেন , নিশ্চয়ই উনার খারাপ লাগছে। শাশুড়ির ভালোবাসা পাওয়া যা তা কথা না । এই ভালোবাসার মূল্য দিতে শিখতে হবে। কাল চলে যাস। আমিও মাথা নেড়ে সায় দিতাম কারন মুরুব্বি মানুষটার জন্য আমার ও খারাপ লাগছে। রাতেও আবার শশুর শাশুড়ি ফোনে খোঁজ খবর নিয়ে আরো একবার আসতে বলতেন। মাকেও বলতেন,
— বেয়াইন , আপনার মেয়েটার জন্য খুব খারাপ লাগছে।আমার মাও বুদ্ধি করেই উত্তরে বলতেন,
— চলে যেতেই চেয়েছিলো আপা , আমরাই একটা রাত জোর করে থাকতে বললাম। কিছু মনে করবেন না। কাল চলে যাবে । আমার ও তো একটাই মেয়ে । মাঝে মাঝে থাকলে তো আমারও ভালো লাগে।
— তা তো লাগবেই । আমাদের খারাপ লাগছে তাই জানালাম আর কি? বলে কথা শেষ করে রেখে দিতেন ফোন। আর আমিও অতি ভালোবাসার টানে পরদিনই শশুর বাড়িতে চলে আসতাম। ভুল করেও কখনও মনে হয়নি যে, এর আড়ালে আর কিছু থাকতে পারে। এতোটা বছর সব সময় দুই একদিন বাবার বাসায় থেকে আবার চলে আসতাম। মাঝে মাঝে বিরক্ত হলেও তাদের কখনও বুঝতে দেয়নি । ভাবতাম সত্যিই হয়তো ভালোবাসেন। আজ ঠিক পাঁচ বছর পর,যখন আমার সদ্য বিবাহিতা একমাত্র ননদ তৃনা ওর শশুরবাড়ি থেকে মায়ের সাথে ফোনে কথা বলছে তখন আমি একটু চমকেই উঠলাম। না, আড়ি পাততেও হয় নি , আমার কাজে আমি শাশুড়ির ঘরের বারান্দায় যাওয়ার সময় পরিষ্কার শুনতে পেলাম। তিনি বলছেন,
— শোন , শাশুড়ি কে বলে দশ বারো দিনের জন্য আমার এখানে চলে আয়। ওপাশ থেকে তৃনা কি বলেছে? শুনতে পেলাম না। তিনি আবারও বললেন,
— শোন , আসার পর শাশুড়ি ফোন দিয়ে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করবেই ।এটা নিয়ে মাথা ঘামাস না ,তুই তো সব জানিসই এগুলো। এমন একটু করতে হয়ই। ওসবে ভুলে গেলে চলবে না। তুই তো আর বোকা না। আমার মনে হচ্ছে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিনা।তার মানে আমি এতোদিন বোকা ছিলাম। আমি যে কথাটা শুনেছি সেটা বোঝানোর জন্য তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি ফোন কেটে দিলেন। আমিই হাসিমুখে বললাম,
— তৃনার সাথে কথা বলছিলেন আম্মা?
— হমম । আসতে চাচ্ছে এ বাসায় কিন্তু ওর শাশুড়ি আসতে দিতে চাচ্ছে না।
— এটাই তো স্বাভাবিক , তাইনা ! একমাত্র ছেলের বউ এর জন্য তারও বোধহয় আপনার মতো খারাপ লাগে।
— কি জানি? সবাই কি আর আমার মতো নাকি ? বলে উঠে চলে গেলেন ,তবে মনে হলো ইচ্ছে করেই আমার সামনে থেকে আড়াল হলেন। এতো দিনে আমারও বাচ্চা হয়েছে , ছেলেকে সাথে নিয়ে মায়ের বাসায় বেড়াতে যাচ্ছি , আমার হাজব্যান্ডকে বললাম,
–এবার আমি চার পাঁচ দিন থেকে আসবো ।
— আসো , সমস্যা নেই।
— না , তোমার বাবা মা তো আবার আমাকে না দেখে অস্থির হয়ে পড়েন। এবার বললেও আসবো না ।এতো বছর পর বুঝেছি ওসব ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল।
— কি জানি ? ওতো প্যাচঘোচ মাথায় আসে না আমার। বলে চলে গেলো অন্য দিকে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে , এবার আমার শাশুড়ি ঠিক দুইদিন পর ফোন করে বললেন,
— বুবুন সোনাকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে ,মা। সারাদিন ওকে না দেখলে খারাপ লাগে।
— জি ,আম্মা । একমাত্র নাতির জন্য খারাপ লাগাটা তো স্বাভাবিকই । চলে আসবো । আমার মায়েরও একমাত্র মেয়ের একমাত্র ছেলে বুবুন । তারও খারাপ লাগে।আর দুটো দিন থেকেই চলে আসবো । জানিনা ,কি মনে করলেন । ফোনটা রেখে দিলেন তার আগে শুনতে পেলাম বললেন,
— আচ্ছা আর একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস।
আর ফোন করেননি আমি ঠিক পাঁচ দিন পর আসলাম বাসায় , আমার ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই ফেললেন।
আমার প্রতি ভালোবাসাটা মিথ্যে হলেও নিজের নাতির প্রতি ভালোবাসাটা একদম খাঁটি যেটা বোঝাতে অভিনয় করতে হয়না। আমি আর সেসবে মাথা ঘামাই না। বাসায় ননদ তৃনা বেড়াতে এসেছে ,মা মেয়ে ভীষণ খুশি আর ও বাড়ির গল্প যেন শেষই হয়না । গল্পের মূল বিষয় তৃনার শাশুড়ি, যার কোন গুণ নেই গল্প শুনে তাই মনে হলো, যত দোষের কথা শুনলাম তাতে তার গুণগুলো টর্চ লাইট জ্বালিয়েও খুঁজে বের করা সম্ভব হবে কিনা সন্দেহ আছে। আস্তে করে চুপচাপ সরে আসি আমি । একজন শাশুড়িকে এভাবে বেগুন বানাতে তৃনার মতো বউই যথেষ্ট। যাইহোক,তৃনার এ বাসায় চার পাঁচ দিন থাকার কথা কিন্তু আসার পরেরদিন দুপুরেই ফোন এলো তৃনার শশুর এর নাম্বার থেকে ,ওর শাশুড়ি নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। খুব চিন্তিত হয়ে আমি আর তৃনা দ্রুত হাসপাতালে চলে গেলাম । গিয়ে দেখি তেমন কিছুই হয়নি। ডাক্তার বললেন,
— প্রেশারটা সামান্য একটু বেড়ে গিয়েছিল , রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবে। বাসায় নিয়ে যান। তৃনার শাশুড়ি বললেন,
— বউমা ,আসছো । তুমি নেই বাসায় আমার এতো অস্থির লাগছিলো যে, মনে হচ্ছিল একা একা পাগল হয়ে যাচ্ছি ।
— আপনি আপনার প্রেশারের ঔষধ বোধহয় ঠিক মতো খেতে ভুলে গেছেন,আম্মা।আর আব্বা তো ছিলেনই বাসায়।তৃনা চিন্তিত হয়ে বলল।
— আরে রাখো তোমার শশুর । ঘরে বউ না থাকলে কি ভালো লাগে ? আমার একটা মাত্র ছেলের বউ চোখের সামনে থাকবে । দেখলেই তো শান্তি লাগে।
— ঠিক বলেছেন আন্টি । আমার শাশুড়িও আবার আমাকে না দেখে থাকতে পারেন না। আপনার মতোই খুব ভালোবাসেন।
ফোড়ন কাঁটাতে আমি অভ্যস্থ না তারপরও কথাটা বলে কেমন যেন একটা শান্তি পেলাম। মনে হচ্ছে এতো বছর পর একটা মধুর প্রতিশোধ নিতে পারছি । কথায় আছে ,অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়ে রাখলে সেই গর্তে নিজেকেই পড়তে হয়। বুঝতে আর বাকি রইলো না ,তৃনার শাশুড়ির গুন কম থাকলেও বুদ্ধিতে মাশাআল্লাহ।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত