স্বপ্ন ভাঙ্গা

স্বপ্ন ভাঙ্গা
‘টাকা পয়সা থাকলে সার্টিফিকেট দিয়া আর কী অইবো!’ বাবা যখন পাত্রের লেখাপড়া নিয়ে প্রশ্ন তুললেন, ঠিক তখন পাত্রপক্ষ থেকে এই কথাটাই বলে উঠলেন একজন। ভেতরের কক্ষে বসে আমি সব আলাপ আলোচনা শুনছিলাম। আমাকে দেখা পর্ব শেষ। পাত্রপক্ষের বেজায় পছন্দ হয়েছে। এখন সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেই বিয়ের পাকা কথা দেওয়া হবে। ছেলের পরিবার বেশ বিত্তবান। আমার পরিবারের তো বেশ পছন্দ হয়েছে শুনেই। কিন্তু সমস্যা একটাই, ছেলে মাধ্যমিক পাশও নয়। মা বললেন, ‘ওসব পাশ দিয়ে কী হবে! কতোগুলো সার্টিফিকেট জমিয়ে ঘুরে বেড়ানোর থেকে, টাকা পয়সাওয়ালা অশিক্ষিত ছেলেও ভালো।’ উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছি সবে। আমার স্বপ্ন বিশাল আকাশের মতো। বাবা-মাকে বললাম, আরো পড়াশোনা করতে চাই।
তারা বললেন, ‘অনেক পড়েছো। বাদবাকি পড়া শ্বশুরবাড়ি গিয়ে পইড়ো। এত ভালো সম্বন্ধ কোনো মতেই হাত ছাড়া করা ঠিক না।’ আমার ইচ্ছেগুলো ভাঙ্গা কলসির মতোই ঘরের এক কোণে পড়ে রইলো, মূল্যহীন। ছবি আঁকতে খুব ভালোবাসি আমি৷ সবাই বেশ প্রশংসা করে থাকেন। ছবি আঁকা প্রতিযোগিতাগুলোতে সবসময় প্রথম হতাম। এই আঁকাআঁকি নিয়ে বহুদূর অব্দি পৌঁছানোর স্বপ্ন দেখতাম রোজ। কিন্তু সেই স্বপ্নগুলো বাবা-মা’কে স্পর্শ করতে পারেনি বলেই স্বপ্নটা কেবল আমারই রয়ে গেলো। বাবা মা’র চিন্তার জগতে আর স্থান পেলো না। মা বলে, মেয়েদের বেশি বয়স করে বিয়ে দিতে নেই। বিয়ের বাজারে কমবয়সী মেয়েদের প্রাধান্য বেশি। বেশি পড়াশোনা করিয়ে বিয়ে দিতে গেলে শেষে ভালো পাত্র পাওয়া যায় না। আজকাল অধিকাংশ চাকুরীওয়ালা পাত্ররাও কম বয়সী সুন্দরী মেয়ে খুঁজে।
চোখ জোড়া জুড়ে কেবল হতাশা। স্বপ্নগুলো নড়বড়ে হয়ে গিয়েছে। বিয়ের তারিখ ঠিক করে ফেলেছে দুই পক্ষ। আগামী সপ্তাহে বিয়ে৷ বাবা একটু বেশিই তাড়াহুড়ো করছেন। ভালো পাত্র বলে কথা। আমায় সান্ত্বনা দিয়ে বাবা বললেন, ‘ওরা তোকে পড়াবে। বিয়ের পর তুই পড়িস।’ বাবার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না। মা বললেন, পাত্র পক্ষই নাকি বলেছে কথাটা। মা’কে বারবার আকুতি করে প্রশ্ন করলাম, ‘ওরা সত্যি বলেছে মা? আমার পড়াশোনাটা বন্ধ করবে না তো? আমায় আঁকাআকি করতে দেবে তো?’ মা বললেন, ‘এতো পড়াশোনা দিয়ে হবেটা কী বলতো? আর এসব আঁকাআঁকি করে কী লাভ! শুধু শুধু সময় নষ্ট। তারপরেও ওরা যখন বলেছে পড়াবে, তখন নিশ্চয়ই পড়াবে। আর না পড়ালেও বা কী! ছেলের তো টাকা পয়সার কমতি নেই। তোকে তো এতো পড়াশোনা শিখে চাকুরি করে রোজগার করতে হবে না।’ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। বাবা-মা তাদের ভালো পাত্রের জন্য নিজের কন্যার চোখের সব স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে ফেলছেন। এ দৃশ্য বড়ই মর্মান্তিক।
তারপর বিয়ে হয়ে গেলো। আমার ছবি আঁকা বন্ধ হয়ে গেলো ওখানেই। শ্বাশুড়ি মা বললেন, ‘ঘরের বউদের ঘরের কাজ কর্মে মনোযোগ দেওয়া উচিত। এসব ছবি এঁকে সময় অপচয় করার কোনোই দরকার নেই।’ সংসারের সুখের কথা চিন্তা করে ছবি আঁকা নিয়ে কোনোই কথা তুললাম না আর। ভাবলাম, পড়াশোনাটা হোক তবে। কিন্তু কিছুদিন যেতেই বুঝলাম আমার পড়াশোনাটাও আর হচ্ছে না৷ শ্বশুর বললেন, ‘বাড়ির বউ দিয়ে চাকুরি করে টাকা আয় করার কোনোই ইচ্ছে নেই। শুধু শুধু পড়াশোনার পেছনে সময় নষ্ট না করে সেই সময়টা সংসারে দাও। বয়স হয়েছে, নাতি নাতনির মুখ দেখে মরতে চাই।’ নিজের ভেতর থেকেই এখনো শিশুসুলভ চরিত্রটা যেন সরেনি। তার ভেতরেই আরেক শিশুর দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে চাইছেন শ্বশুরবাড়ির পরিবার।
যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে, তার সঙ্গে চিন্তায় চেতনায় কিছুতেই যেন আমার মেলে না। আমার অনুভূতি, চাওয়া, ইচ্ছে কোনোটাই তাকে স্পর্শ করে না। আমার জীবনে তার মতামতই শিরোধার্য, আমার কথা সেখানে মূল্যহীন।
প্রতি রাতে টের পাই স্বপ্ন ভাঙ্গার শব্দ, স্বপ্ন ভাঙ্গার যন্ত্রণা। বিছানায় এপাশ ওপাশ করি, ঘুম আসে না। চোখে বেয়ে জল গড়িয়ে বালিশ ভেজে। ভেতরের ব্যথায় ছটফট করি, দীর্ঘশ্বাসে ভরে ওঠে চারপাশ। আর পাশে থাকা মানুষটা তখনো নাক ডেকে ঘুমায়।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত