‘দুইটা বড় বাড়ি আছে আমার ফার্মগেটে। তার মধ্যে একটা তো এগারো তালা। ছাঁদে আবার সুইমিংপুলও আছে। আবার বাড়ির সবার জন্য একটা করে গাড়ি আছে। সামনের মাসে বাবা নাকি একটা মার্সেটাইজ কিনবে। কিন্তু আমার বাবার ব্যবসায় যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই। ইচ্ছে আছে একটা ছোট সরকারি চাকরি নিয়ে নিজের টাকায় অনেক শান্তিতে থাকবো।’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলতে থাকি।
সামনে থাকা দুই বছরের বাচ্চাটা খিলখিল করে হেসে ফেলে। নিশ্চই ধরে ফেলেছে আমার মিথ্যে। মিথ্যে বলা খুব কঠিন। সত্যি কথা বলার চেয়েও কঠিন। এই মুহূর্তে তা আমি খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছি। কিন্তু রফিক ভাই খুব করে বলে দিয়েছে চাকরি পেতে হলে এই কথাগুলোই বলতে হবে। তাই একবার রিহার্সেল করে নিলাম বাচ্চাটার সাথে। কিন্তু সে তো ধরে ফেলেছে। না, আরো চেষ্টা করতে হবে। অনেক বেশি চেষ্টা করতে হবে৷ কালকে সকালেই ইন্টারভিউ। বুঝতে পারিনি কখন তটিনী এসেছে। মেয়েটা চমকে দিতে খুব ভালোবাসে। এবারেও চমকে দিয়েছে আমাকে। না, এতো ছেলেমানুষী আর ভালো লাগেনা। ‘উফ, তটিনী এসব আর আমার ভালো লাগেনা৷’ কণ্ঠ খুব ভারী করেই বলি কথাটা।
‘আহা, এতো রেগে যাচ্ছ কেন!’ বলে তটিনী৷ ঠোঁটে তার মৃদু হাসি লেপ্টে আছে। কোন কথা বলিনা আমি৷ একটু রেগে থাকার অভিনয় করি৷ যদি তার নরম ঠোঁটজোড়া একটু কপালে ছুঁইয়ে দেয়, তবেই রাগ কমবে আমার৷ সে তাই করে৷ একটু সময় নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে আলতো করে ছুঁইয়ে দেয় তার নরম ঠোঁট দুটো আমার কপালে৷ আমার প্রতিটা অভিমানের এই একটাই সার্থকতা। মেয়ে, আমি যে খুব ভালো থাকি তোমার চুম্বনে।
‘এইবার রাগ কমেছে তো?’ লজ্জিত কণ্ঠে বলে তটিনী। এই লজ্জাটাই তো ভালোবাসা। আর ভালোবাসাটা যে বড্ড গভীর।
‘হুম কমেছে।’ নরম স্বরে বলি আমি, ‘এখন বলো কী জন্যে এতো জরুরী বলে ডেকেছ? কোন কিছুকি হয়েছে?’
চোখ মুখ কালো করে মলিন স্বরে তটিনী বলে, ‘নতুন করে আর কিছু হয়নি। গতকাল ভার্সিটির লাস্ট ইয়ারের লাস্ট পরিক্ষা ছিল৷ এখন বাবা বলেছে এই মাসের মধ্যে আমার বিয়ে দিবে। এতোদিন পড়াশোনার কথা বলে শান্ত রেখেছিলাম বাবাকে৷ কিন্তু তা আর পারা যাবেনা৷’ আমি বুঝতে পারিনা আমি কি বলব। চুপ করে থাকাই হয়তো শ্রেয়। না, থাক৷ কিছু বলি, ‘এখন কি আমাকে কিছু করতে হবে?’
তটিনী জোড়ালো কণ্ঠে বলে, ‘হ্যা অবশ্যই৷ এখন তুমি আমার সাথে আমাদের বাসায় যাবে। তারপর বাবার সাথে কথা বলবে।’ কিছু না বুঝেই আমি সম্মতি জানাই। নিজের ভালোবাসাকে তো বাঁচাতে হবে। তবে সত্যি বলতে ইচ্ছে করছে না এখন তটিনীর বাসায় যেতে। কিন্তু নিজেদের ইচ্ছের বাইরে তো অনেক কিছুই করতে হয়। আজকেও তাই করি। ‘দুইটা বড় বাড়ি আছে আমার ফার্মগেটে। তার মধ্যে একটা তো এগারো তালা। ছাঁদে আবার সুইমিংপুলও আছে। আবার বাড়ির সবার জন্য একটা করে গাড়ি আছে। সামনের মাসে বাবা নাকি একটা মার্সেটাইজ কিনবে।…’ একই কথাগুলো খুব সাবলীল ভাবেই বলি তটিনীর বাবার সামনে।
একটা ছোট ঘরের মধ্যে আমি আর তটিনীর বাবা সামনাসামনি বসে আছি। তটিনী চা করতে গেছে। সেই সুযোগে একটু মশকরা করলাম তটিনীর বাবার সাথে। তবে এখন বুঝতে পারছি, নিশ্চয় বেয়াদবি করে ফেলেছি। নিশ্চয় মিথ্যে ধরতে পারেনি ভদ্রলোক। তাইতো বলেন, ‘কিন্তু তটিনী যে বলল, তোমার বাবা মা গ্রামে থাকে৷ তুমি এখনো বেকার। চাকরি নাকি খুঁজছ ঢাকায়।’ বিজয়ী আমি। মিথ্যে বলা শিখে গেছি। মিথ্যেদের বিজয়। ‘জ্বী আঙ্কেল, তটিনী ঠিকই বলেছে। আসলে এতোক্ষণ ধরে সব মিথ্যে বলছিলাম আমি।’ মার্জিত কণ্ঠে বলি আমি। কণ্ঠ ভারী করে ভদ্রলোক বলেন, ‘তাহলে এতোক্ষণ ধরে কি আমার সাথে বেয়াদবি করছিলে? এসব মশকরা আমার একদম পছন্দ নয়।’ ‘স্যরি আঙ্কেল।’
খানিক সময় নেয় ভদ্রলোক। নিশ্চয় সাজিয়ে নিচ্ছিলেন কীভাবে কথাগুলো বলবে আমাকে। বেশ কিছুটা সময় পর ভদ্রলোক একটা সিগারেট ধরান। লম্বা একটা টান দিয়ে একগাল ধোঁয়া ছাড়েন তারপর। সব ধোঁয়া মিলিয়ে যেতে না যেতেই ভদ্রলোক বলে উঠেন, ‘তোমাকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলব আমি এখন। সব শুনবে, তারপর তোমার যা বলার বলবে।’
‘আচ্ছা আঙ্কেল।’ স্বর স্বাভাবিক রেখে কথা বললেও একপ্রকার অস্বস্তি অনুভব করছি মনে মনে। সেই সাথে তটিনীর প্রতিক্ষা। মেয়েটা এখনো আসেনা কেন! ‘আমি যখন ছোটবেলায় ঢাকায় আসি তখন আমার কাছে কোন কাজ ছিল না। ভার্সিটিতে পড়তাম আর বাকি সময় টিউশনি করে আমার খরচ চালাইতাম। কষ্ট করেছিলাম খুব। পড়াশোনায় ভালো ছিলাম তাই ভার্সিটি শেষে ছোট একটা চাকরি পেয়ে যাই দুই তিন বছরের মধ্যে।’ থামলেন ভদ্রলোক। সিগারেটের আরেকটা লম্বা টান দিলেন। তারপর ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, ‘সেই ছোট চাকরির উপর নির্ভর করেই কিন্তু আমি এখনো বেঁচে আছি।
আমার গাড়ি নেই, খুব বড় বাড়ি নেই। তবে আমার যেটুকু আছে তোমার সেটুকুও নেই। তাহলে তুমি ভাবলে কেমন করে যে আমি তোমার মতো একটা বেকার ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে দিবো। যদি আমার মতো একটা ছোট চাকরিও থাকতো, তবে আমি ভেবে দেখতাম।’ কথা শেষ করেন ভদ্রলোক। হাতের সিগারেট তখন জ্বলতে জ্বলতে ফুরিয়ে যাবার পথে। কথাগুলো এক মনে শুনে যাই আমি। তবে বুঝে উঠতে পারিনা ভালো করে। সব মিলিয়ে মনে হয় কোন বাংলা সিনেমার ক্লাইমেক্স। ভদ্রলোক ভিলেইন বাবা। আমি বেকার বাপ্পি চৌধুরী। ভাবতে বেশ মজাই লাগে। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ভদ্রলোক আবার বলেন, ‘তুমি এখন আমার মেয়েকে বলবে যে তুমি তাকে বিয়ে করতে পারবে না, কারণ তুমি বেকার। বাকিটা আমি সামলে নিবো।’
এমন সময় রুমে আসে তটিনী। ট্রে থেকে চায়ের কাপ আমার সামনে রাখে৷ তার চোখে মুখে কৌতুহল ভীড় করছে৷ সে কৌতুহলের খোরাক যে ‘হ্যা’ শুনার তা বুঝতে বাকি নেই৷ তবে আমার উত্তর যে ‘না’ হবে। মিথ্যে ‘না’। তটিনী তার বাবার সামনে চায়ের কাপ রাখার সময় ভদ্রলোক বলে, ‘আমার চা লাগবেনা মা। আমি উঠি। তোরা কথা বল।’ চলে যায় ভদ্রলোক কথা শেষে। ভদ্রলোক যাওয়ার পর তটিনী তার কৌতুহল সবটুকু স্বরে ঢেলে দিয়ে বলে, ‘কি কথা হলো বাবার সাথে, শায়ান?’ সময় নিই আমি। প্রস্তুতি কিছু মিথ্যের। কঠিন মিথ্যের৷ তটিনী অবশ্যই ধরতে পারবে সেই মিথ্যে। হ্যা, অবশ্যই পারবে। আর যদি না পারে? তাহলে বোধহয় মেয়েটা খুব ভালোবাসেনা আমাকে! ‘তটিনী, আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না। তুমি তোমার বাবার ঠিক করা ছেলের সাথেই বিয়ে করো।’ বলি আমি।
সব শুনে একদম নিস্তব্ধ হয়ে যায় তটিনী। ‘না’ যে একটা কঠিন শব্দ। খুব কঠিন। আর মিথ্যে ‘না’। তা যে আরো কঠিন। ভারী কণ্ঠে তটিনী বলে, ‘কিন্তু কেন?’ বোঝা যায় তটিনীর গলা ধরে উঠেছে। ‘কারণ আমি বেকার। বিয়ে করে কি খাওয়াবো তোমাকে।’ আমার গলা কেঁপে উঠে। আবার নিস্তব্ধ হয়ে যায় সব। নিস্তব্ধ তটিনী। নিস্তব্ধ আমি। নিস্তব্ধ আমাদের ভালোবাসা। তটিনী নিশ্চয় ধরতে পেরেছে আমার মিথ্যে। এখনই হয়তো আমার বুকে মাথা ঠেকিয়ে বলবে, ‘তুমি মিথ্যে বলছ সব। আমি তোমাকে খুব ভালো করেই চিনি।’ কিন্তু সে বলেনা। সময় ছুটতে থাকে, তবুও বলেনা সে। তবে কী বলবে নাহ! চলে যাই আমি৷ কিছু মিথ্যে পিছনে ফেলে রেখে চলে যাই আমি।
‘দুইটা বড় বাড়ি আছে আমার ফার্মগেটে। তার মধ্যে একটা তো এগারো তালা। ছাঁদে আবার সুইমিংপুলও আছে। আবার বাড়ির সবার জন্য একটা করে গাড়ি আছে। সামনের মাসে বাবা নাকি একটা মার্সেটাইজ কিনবে। কিন্তু আমার বাবার ব্যবসায় যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই। ইচ্ছে আছে একটা ছোট সরকারি চাকরি নিয়ে নিজের টাকায় অনেক শান্তিতে থাকবো।’ কথাগুলো এখন খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। কী স্বাধীন গলায়ই না বললাম কথাগুলো!
সামনে বসা তিনজন লোক বেশ মনোযোগ দিয়েই শুনে কথাগুলো। নেভি ব্লু কালারের টাই পরা লোকটার মনোযোগ যেন একধাপ বেশিই। বিশ্বাস হয়েছে তো! হয়েছে, অবশ্যই হয়েছে। আমি যে শিখে গেছি মিথ্যে বলা।
কিছুক্ষণ পর টাই পরা লোকটা বলেন, ‘তোমকে সার্টিফিকেট সব দেখলাম। You are a brilliant student. জবটা দেওয়াই যায় তোমাকে।’ তারপর পাশের দুইজন লোকের সাথে কথা বলে তিনি বলেন, ‘আপনি সামনের মাসে জয়েন করতে পারেন।’ বিজয়ের হাসি হাসি আমি। মানুষ মিথ্যেকে কত সহজভাবেই না গ্রহন করতে পারে। তারা মিথ্যে ভালোবাসে!
ফুটপাত দিয়ে হাঁটছি। অন্যধরনের ভালোলাগা কাজ করছে। প্রথম অফিসে যাচ্ছি। আচ্ছা অফিসে গিয়ে যদি বলে, আমার গাড়ি কই! বাবার মার্সেটাইজ এ আসি নাই কেন! চিন্তা নেই। আরেকটা মিথ্যে বলে দিবো। মিথ্যে একটা নেশার মতো। একবার বললে বলতেই ইচ্ছে করে শুধু। এমন সময় তটিনীর কল। ধরিনা আমি। আরেকবার বেজে উঠে ফোন। খানিক সময় নিয়ে ফোনটা ধরি।
‘শায়ান কেমন আছ?’ তটিনীর মিষ্টি সুরেলা কণ্ঠ।
‘ভালো।’ আর কিছু বলিনা আমি।
‘শুনলাম চাকরি পেয়েছ।’
‘হুম।’
‘শায়ান, এবার তো বাবার সাথে কথা বলতে পার!’ বেশ আবেগি শোনা যায় তার কণ্ঠ।
‘কি বলব তোমার বাবাকে?’ বলি আমি।
‘এইযে তুমি চাকরি পেয়েছ। এবার তো বাবা মানবে।’
আবারও চুপ হয়ে যাই আমি। একপ্রকার ক্ষোভ জমাট বাঁধে আমার মনে। কই, আমি তো তাকে কক্ষনো বলিনি, তোমাকে আমি ভালোবাসিনা! সে কি জানেনা, তাকে খুব ভালোবাসি আমি। অনেক বেশি৷ তবে সে কি বলতে পারতো না, লাগবেনা তোমার চাকরি। তুমি বেকারই থাকো। একটা ঘর বসাতে টাকা নয়, ভালোবাসাটাই বেশি জরুরী। এসব সিনেমার ডায়লগ বুঝি চার কোণা স্ক্রিণটার মাঝেই সীমাবদ্ধ। বাস্তব অনেক কঠিন বোধ হয়! না কঠিন না, ভালোবাসলে সে ঠিকই বলতে পারতো। হাতে হাতটা রাখার সাহস তার ঠিকই হতো। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে, আমি কণ্ঠে ক্ষোভ জমিয়ে বলি, ‘তুমি ভুল শুনেছ তটিনী। আমি এখনো বেকার। তোমার বাবাকে বলার আমার কিছু নেই।’ মিথ্যে বলি আমি। সহজ মিথ্যে। এই শহর, শহরের মানুষ, সবাই যে মিথ্যে ভালোবাসে। মিথ্যেটাকেই আপন করে নেয়। হায়রেহ!
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক