মায়া

মায়া
মায়া খুন হয়েছে। শরীরে অজস্র চাকুর দাগ। তার রক্ত দিয়ে সাদা টাইলসের ফ্লোরে বড় বড় করে লেখা- “আমি তোমাকে ভালোবাসি মায়া। এত ভালোবাসি যে তোমাকে আমার কাছে নিয়ে গেলাম।”
চাকুটা পাশেই পড়েছিল। চাকুর গায়ে কোনো আঙুলের ছাপ নেই। বাড়ির দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, জানালাগুলোও আটকানো। কোনোভাবেই কারো পক্ষে ভেতর থেকে বের হওয়া সম্ভব না। পুরো বাড়ির প্রতি ইঞ্চি খোঁজা হয়েছে। কোনো সূত্র পাওয়া যায়নি। এমন জটিল কেসে পুলিশ আশ্চর্য হয়ে গেছে। কেউ কেউ মনে মনে সন্দেহ করছে হয়তো এটা কোনো প্রেতাত্মার কাজ! কিন্তু বলার সাহস পাচ্ছে না। মায়া একাই থাকত বাড়িতে। ওর বাবা মা কারা, কোথায় থাকে কেউ জানে না। বাড়িটা রাজীব চৌধুরী নামে কারো একজনের ছিল যেটা মায়াকে বেশ কয়েক বছর আগে হস্তান্তর করা হয়। রাজীব চৌধুরী কে তা জানা যায়নি। প্রতিবেশীরাও এই বাড়ি সম্পর্কে কিছুই জানে না।
মায়ার ছিল অজস্র প্রেমিক, কেউই স্থায়ী নয়। তবে সবাই-ই কিছুদিন করে তার বাড়িতে থাকার সুযোগ পেত। মায়া একটা ক্লাবের সদস্য ছিল, যেখানে পছন্দমতো সঙ্গী খুঁজে নেয়া যায়। সেই ক্লাব থেকেই ওর প্রাক্তনদের খোঁজ পাওয়া গেছে। সবার কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মোটামুটি এক। সবার কাছেই মায়া ছিল রহস্যময়ী এক নারী। যাকে কোনোভাবেই তারা বুঝতে পারত না। বাড়িটা ছিল ভীষণ আকর্ষণীয়। সবসময় একটা মোহনীয় ঘ্রাণ ভেসে থাকত বাতাসে। মায়াকে এর কথা জিজ্ঞেস করলে উত্তর পাওয়া যেত না, তবে যারা এখানে থাকার সুযোগ পেয়েছে, সবারই ধারণা সে লুকিয়ে কোনো এয়ার ফ্রেশনার ব্যবহার করত ঘরে। আচ্ছা মায়াকে কে খুন করল? কোনো প্রাক্তন? কিন্তু মায়া কারো সাথে শত্রুতা করত না। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে ‘মিউচুয়াল ব্রেকআপ’ করত। বহু খুঁজেও মায়ার কোনো শত্রু পাওয়া গেল না। ওর বর্তমান প্রেমিকই লাশটার খবর পুলিশে দেয়। খুনের সময় সে তার বোনের বিয়েতে ছিল। শক্ত অ্যালিবাই। পুলিশ মাস দুই চেষ্টা করে কেসটা ক্লোজ করে দিল৷ পৃথিবীতে তো রহস্যময় কত কিছুই ঘটে। এটাও হয়তো তেমনই কিছু।
মায়ার বাড়ির কোনো উত্তরাধিকারী না থাকায় সরকার সেটা বাজেয়াপ্ত করে নেয়। প্রায় দেড় বছর পর সেখানে এক পরিবার ভাড়াটিয়া হিসেবে আসে। পরিবারের সদস্য তিনজন। মা, বাবা আর দশ বছরের ছেলে রাফি। রাফি ভীষণ দুষ্ট৷ কথা বলতে বলতে পাগল করে দেয় বলে মা তাকে সারাদিন এটা ওটা খেলা দিয়ে ব্যস্ত রাখে। রাফির সবচেয়ে পছন্দের খেলা গুপ্তধন খোঁজা। মা ঘরের বিভিন্ন জায়গায় খেলনা লুকিয়ে রাখে, রাফি সেসব খুঁজে বের করে। এই গুপ্তধনের খোঁজ করতেই রাফি একদিন আবিষ্কার করে বসল তার মা বাবার ঘরের খাটের নিচে একটা টাইলসের টুকরো একটু কায়দা করে সরালে উঠে আসে। তার নিচে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে। রাফি কৌতুহলী হয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামল। ছোট্ট একটা ঘর। বাইরে থেকে আলো এসে আবছা দেখা যাচ্ছে। সেই আলোয় চোখে পড়ল ছোট্ট একটা খাটের কোণে পড়ে থাকা শুকিয়ে কঙ্কাল হয়ে যাওয়া মৃতদেহ। রাফি চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারাল।
কিছুদিন পর পত্রিকায় খবর ছাপা হলো- “৩রা অক্টোবর ২০২০ সালে খুন হওয়া মায়া চৌধুরীর স্বামী রাজীব চৌধুরীর লাশ পাওয়া গেছে তার বাড়ির একটি গুপ্তকক্ষে। রাজীব চৌধুরীর ডায়েরি থেকে জানা যায় তার কুষ্ঠরোগ হয়েছিল। শরীরের নিচের অংশ ঘা হয়ে পঁচে যাচ্ছিল। ভয়ানক দুর্গন্ধ বের হতো বলে মায়া তাকে মূল বাড়ি থেকে সরিয়ে গুপ্ত ঘরটাতে নিয়ে রেখেছিল। প্রায় সবসময় মায়া তাকে কড়া ডোজের ঘুমের ঔষধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখত। রাজীব মায়ার কর্মকাণ্ড মোটামুটি আন্দাজ করতে পারত, কিন্তু নিজে অক্ষম হওয়ায় কিছু বলত না। ক্রমেই মৃত্যুর দিন গুনছিল সে৷ মায়া তার থেকে সব সম্পত্তি লিখে নিয়েছিল।
ঘটনাচক্রে একদিন মায়া তার স্বামীকে ঘুমের ঔষধ দিতে ভুলে যায়। রাজীবও শরীরে বল পেয়ে একবার নিজের চেষ্টায় ওপরে উঠে আসে। সেদিনই প্রথম প্রাণপ্রিয় স্ত্রীকে অন্য পুরুষের সাথে দেখতে পায় সে৷ খুনের পরিকল্পনা তখনকারই। কয়েকদিন রাজীব ইচ্ছে করেই মায়ার দেয়া ঘুমের ঔষধ না খেয়ে ফেলে দিত। ঘুমের ভান করে পড়ে থাকত সারাদিন। এর মাঝে একদিন সুযোগ বুঝে বের হয়ে আসে। পেছন থেকে আঘাত করে মায়াকে। তারপর মনের সুখে কাটাকাটি করে তার শরীর। কাজ শেষে ফিরে যায় নিজের জায়গায়। ঔষধের বাক্সে রাখা সবকয়টা ঘুমের ঔষধ খেয়ে একটি কলঙ্কিত অধ্যায়ের ইতি টানে।”
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত