“মা দাদু কোথায় গো?” রান্নাঘরের চৌকাঠে এসে সুমিত প্রশ্ন করলো। “দাদু তো সকাল থেকেই ওপরে চিলেকোঠার ঘরেতে বসে আছে”। সুমিত শুনেই দৌড় লাগাচ্ছিল দাদুর কাছে যাবে বলে, কিন্তু তার মা বাধা দিয়ে বলল, “শোন বাবু এখন যাস না বাবা একটু একা থাকতে চেয়েছেন। কাউকেই যেতে বারন করেছে। আর এছাড়া কলকাতা থেকে এতটা journey করে এলি, একটু fresh হয়ে নে। ততক্ষণে দাদু নীচে নেমে আসবে”।
মায়ের কথায় সম্মতি জানিয়ে সুমিত নিজের ঘরে গিয়ে fresh হয়ে নিল। লুচি, তরকারি খেয়ে সুমিতের পেট এবং সুমিত দু’জনেই খুব খুশি। এবার সুমিতের গন্তব্য ওপরের চিলেকোঠার ঘর। দাদু যে একা একা কি করছে সেটা সুমিতকে জানতেই হবে। তাই যেমন ভাবা, তেমন কাজ। সুমিত চিলেকোঠার ঘরের দরজা ঠেলতে গিয়ে দেখল দরজা বন্ধ। তাই কড়া নেড়ে ডাক দিলো, -“দাদু, ও দাদু”। এবার ভেতর থেকে কথা এলো, “দাদুভাই নাকি?”
-“হ্যাঁ, আমি বাবু”।
এবার দাদু দরজা খুলতেই বলল, “আয় দাদুভাই, কতদিন পড়ে তোকে দেখলাম। ভালো আছিস তো? পড়াশুনা কেমন চলছে? পরীক্ষা কেমন হল?”
-“হ্যাঁ, দাদু পরীক্ষা ভালো হয়েছে। তাই এখন ছুটি পেয়েই চলে এলাম”।
-“তা বেশ করেছিস দাদুভাই। দোলের আগে এসে ভালোই করেছিস। শান্তিনিকেতনের দোল খেলাটা উপভোগ করতে পারবি”।
-“আচ্ছা দাদু, মা বলল তুমি নাকি সকাল থেকেই একা একা চিলেকোঠার ঘরে বসে আছো। কোনো সমস্যা হয়েছে তোমার?”
-“সকালের জলখাবার খেয়েছিস তো?” সুমিতের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সম্পূর্ণ অন্য প্রশ্ন করলো দাদু।
-“হ্যাঁ, খেয়েছি। কিন্তু তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না যে”।
দাদু এবার মাথা নিচু করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কি বলি বলতো? মনটা ভালো নেই”।
-“কি হয়েছে? আমায় বলো। আমি শুনব তোমার কথা”।
সুমিতের কথা শুনে দাদু বলল, “গতকালই আমার retirement ছিল। আর ভালো লাগছিল না। এই কাজ করে আমি কখনোই খুশি হতাম না রে। ফাঁসি দেওয়া কাজ কার ভালো লাগে বলতো! কিন্তু ভালো না লাগলেও আমায় সংসারের কথা ভেবে করতে হতো। যতই আইনী নিয়মে অপরাধীর ফাঁসি দেওয়ার কাজ করি না কেন, সেই তো সেটা প্রাণ নেওয়ারই কাজ। আর যদি কোনো নিরপরাধ ব্যক্তির ফাঁসি দিতে হয়, সেক্ষেত্রে কতটা যন্ত্রণাদায়ক বলতো?” বলে একটু থামল।
-“এরকম কি কোন নিরপরাধ ব্যক্তির সাথে এমনটা হয়েছে?” নীরবতা ছিন্ন করে সুমিত জিজ্ঞাসা করলো।
-“হ্যাঁ রে দাদুভাই। retirement-এর আগে আমার দেওয়া শেষ ফাঁসিটাই এমন হয়েছে। লোকটির নাম ছিল বিমল। ফাঁসির আদেশ ঘোষণা করার পর বিমল অনুরোধ করেছিল যে, জেলের সবার সাথে ও একটাদিন মজা করে কাটাতে চায় এবং স্ত্রীর সাথে দেখা করতে চায়। তখনই ওর সাথে কথা হয়েছিল আমার”।
একটু থেমে দাদু আবার শুরু করলো, “বিমল বারবারই বলতো যে ও নিরপরাধ। সে ওর কাকাকে খুন করেনি। কিন্তু তথ্য প্রমানের অভাবে এবং প্রভাবশালীদের ক্ষমতার জোরে নিরপরাধ বিমলকে অপরাধী করা হয়েছিল। আমি এটুকু জানি দাদুভাই, জীবনের যে কোন সময়ে কেউ মিথ্যে বলতে পারে, কিন্তু মরণের সময় কেউ মিথ্যে বলে না। তার স্ত্রীই তাকে একমাত্র বিশ্বাস করেছিল। কিন্তু শুধুমাত্র তার বিশ্বাসের জোরে বিমলের প্রাণ রক্ষা হয় নি। তারপরের দিনই বিমলের ফাঁসি। ফাঁসির আগে জেলার সাহেবের কাছে সে একটা অনুরোধ করেছিল যে, তার অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা যেন উনি করান। মিথ্যে বলব না, জেলার সাহেব তাকে কথা দিয়ে আশ্বস্ত করেছিল। তখন সে বলেছিল, “স্যার, এবার আমি নিশ্চিন্তে মরতে পারব”।
ফাঁসির আগে সমস্ত নিয়মকানুন সম্পূর্ণ করে বিমল ফাঁসি কাঠে এসেছিল। ওকে দেখেই আমি ওর সামনে হাত জোর করে বলেছিলাম “আমায় ক্ষমা করো তুমি। আমার ফাঁসি দেবার ইচ্ছা না থাকলেও আমার কিছু করার নেই। দয়া করে আমায় ক্ষমা করো”।
আমার কথা শুনে বিমল আমায় বলেছিল, “একি বলছ তুমি! যারা অন্যায় করলো তারা ক্ষমা চাইল না, আর তুমি ক্ষমা চাইছ! এ তো তোমার কর্তব্য। তোমার কর্তব্য তুমি পালন করো”। তারপর বিমলের হাত পিছনে বেঁধে দেওয়া হল। মুখে কালো কাপড় দিয়ে ঢাকার আগে বিমলকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে ওর কোনো শেষ ইচ্ছা আছে কিনা”।
ঐ প্রশ্নের উত্তরে বিমল বলেছিল যে, “আমি নিরপরাধ। আমার মতো আর কোনো ব্যক্তির যেন ফাঁসি না হয়। সবাই ভালো থাকবেন”। তারপরেই সব শেষ। বিমল সারা জীবনের মতো চোখ বুজল। গলায় দড়ির চাপ লেগে একটু ছটফট করছিল, কিন্তু অবশেষে বিমল মুক্তি পেলো”। একটু থেমে দাদু বলল, “একটু জল দিবি দাদুভাই?”
-“হ্যাঁ দাদু, এই নাও”, বলে জল এগিয়ে দিলো সুমিত।
“আহ! গলাটা একদম শুকিয়ে গেছিল”, বলে দাদু চুপ করে রইল। সুমিত লক্ষ্য করলো দাদুর চোখ ছলছল করছে। সুমিত জিজ্ঞেস করলো, “তোমার কি নিজেকে অপরাধী লাগছে?” শুনে দাদু বলল, “হ্যাঁ”।
এবার সুমিত কাছে গিয়ে হাঁটু গেঁড়ে দাদুর হাত দুটো ধরে বলল, “আমি মানছি তুমি এই হাত দুটো দিয়ে এক নিরপরাধ মানুষের ফাঁসি দিয়েছ, কিন্তু তুমি কি এটা ভেবে দেখেছ এই হাত দুটো দিয়েই অপরাধের তকমা লাগানো এক নিরপরাধকে মুক্তি দিয়েছ। আইনের চোখে বা সমাজের চোখে সে হয়তো অপরাধী হয়ে থাকবে। কিন্তু সেটা তো তাকে শুনতে হচ্ছে না। বেঁচে থাকলে এই যন্ত্রণাই তাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হতো। এটা আরো বেশি বেদনাদায়ক নয় কি? তার থেকে এটাই ভালো হল যে তোমার হাত দিয়ে মুক্তি পেয়ে বিমল বাবু নতুন জীবন পাবেন সুমিতের এই কথা শুনে দাদু সুমিতের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “অনেক বড়ো হয়ে গেছিস”।