“হাত ছাড়ো, মানুষ দেখছে। রাস্তার মধ্যে নাটক করবে না একদম।” শান্ত অথচ দৃঢ় কন্ঠে বলল মেয়েটা। লোকটা মেয়েটার হাত ছেড়ে দিলো। সে অসহায়ের মতো চারদিকে তাকাচ্ছে। স্বভাবতই এতগুলো মানুষের সামনে সে বিব্রত বোধ করছে। ইস্ত্রি করা প্যান্ট-শার্ট পরা লোকটাকে দেখে ভদ্রলোকই মনে হলো। তার ফরমাল লুকের সাথে এমন নাজেহাল অবস্থাটা ঠিক মানাচ্ছে না। মেয়েটা লাগেজ টেনে শান্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে যেতে লাগলো। কুলিদের হাক-ডাক,পত্রিকা-ওয়ালাদের ছুটে যাওয়া, যাত্রীদের হৈ-হুল্লোড় করে ট্রেনে ওঠা-নামা কিংবা ফ্ল্যাগ ম্যানের তীক্ষ্ণ হুইসেল-রেল স্টেশনের যাবতীয় কোলাহলে তার কিছু আসে যায় না। আন্তঃনগর ট্রেন চলে এসেছে। সে ট্রেনে উঠে পড়বে। লোকটা মুখে কিছু না বললেও স্ত্রীর পিছুপিছু যেতে লাগলো। সে সম্ভবত আশা করে আছে শেষ মুহুর্তে তার স্ত্রীর রাগ পড়ে যাবে। সে ট্রেনে উঠবে না।
“তোমার রাগ কি একটুও কমছে না?” মিনমিন করে বলল লোকটা। মেয়েটা তার দিকে ঘুরে তাকালো। প্রশ্নের জবাবে তার দিকে এমন ভাবে তাকালো যে চোখের আগুনে ভস্ম করার ব্যাপারটা বাস্তব হলে এতক্ষণে লোকটি পুড়ে ছাই হয়ে যেতো। লোকটা চোখ সরিয়ে নিল। এমন অগ্নি চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। সে আকাশের দিকে তাকালো। মাথার উপর কালো মেঘের সমুদ্র। যে কোন সময় সেই সমুদ্রে জোয়ার আসবে।
“আকাশের অবস্থা ভালো না। বৃষ্টি হতে পারে। বাবার বাড়ি যেতে চাও কাল যেয়ো।” অনেক সাহস সঞ্চয় করে বলে ফেললো লোকটা।
“বৃষ্টি এলে আসবে। আমি তো হেঁটে যাচ্ছি না। ট্রেনে উঠে পড়লেই আর সমস্যা নেই।” যাক এই জবাবটা শান্ত কন্ঠে দিয়েছে বলে কিছুটা সাহস পেলো সে। সে বোঝানোর চেষ্টা করল, “ঝড়ও হতে পারে। এমন দূর্যোগের দিনে যাওয়ার দরকার টা কী?”
“আমাকে নিয়ে এতো ভাবতে হবে না তোমাকে। আমার জন্য এত চিন্তা থাকলে আমাকে খালি বাসায় রেখে বাইরে রাত কাটাতে না তুমি। এখন এসেছো দরদ দেখাতে। এসব আলগা ভালোবাসা দেখাতে আসবে না। একদম না।” মেয়েটার গলা ক্রমেই উঁচুতে উঠতে লাগলো। লোকটা আবারও অসহায়ের মতো চারদিকে তাকাতে লাগলো। সবাই অদ্ভুত চোখে তাদের দিকে তাকাচ্ছে। বেশ আগ্রহ নিয়েই তাকাচ্ছে। নিজের সংসারে যতই ঝামেলা থাকুক, অন্যের সংসারের ঝগড়া বরাবরই তৃপ্তি দেয় মানুষকে। কেমন শান্তি শান্তি লাগে। এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দ পাওয়া যায়।
“বাইরে রাত কাটিয়েছি কথাটা খারাপ শোনায়। হাস্পাতালে ছিলাম। জানোই তো কথা শেষ হওয়ার আগেই মেয়েটা বলে ওঠে, “এই কথাটা বেশ কয়েকবার তোমার মুখে শুনেছি। আর বলার দরকার নেই। তুমি যে রাতে ফিরবে না এটা আমাকে একটি বার জানানোর প্রয়োজন মনে করোনি।”
“তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না?”
“করি। কিন্তু এটা বিশ্বাসের প্রশ্ন না।
গুরুত্ব দেয়ার বিষয়। ইটস অ্যা ম্যাটার অব গিভিং ইম্পর্ট্যান্টস্। ইউ নেভার সি দিজ ফ্রম মাই পয়েন্ট অব ভিউ মেয়েটা একটানা ইংরেজি বলে যেতে লাগলো। যার সারমর্ম হচ্ছে সে আর আগের মতো ভালোবাসা পাচ্ছে না। তার স্বামী তাকে পুরোনো মনে করে। সে সহজলভ্য হয়ে গেছে। লোকটা কিছু বলতে গিয়েও বললো না। সম্ভবত সে স্ত্রীকে আর রাগাতে চাচ্ছে না। যতটুকু রেগে আছে এটা কমানোই বলতে গেলে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন সময় বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি পড়তে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টির বেগ বাড়বে।
“তুমি তাহলে ফিরবে না?” কাতর গলায় বললো লোকটা।
“নাহ্।” শান্ত কন্ঠে জবাব এলো।
মেয়েটা লাগেজ টেনে নিলো। সোজা হাঁটতে লাগলো সামনের বগিটার দিকে। লোকটার মধ্যে একটা দিশেহারা ভাব চলে এলো। সে কী করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। সে উদ্বাস্তুদের মতো দৌড়ে গেলো। দু’হাতে মেয়েটার পথ আগলে দাঁড়িয়ে বললো, “তুমি আমার একটা কথা শোন। শুধু একটা কথা।” মেয়েটা দাঁড়িয়ে গেল। বলল, “বলো।”
“প্লিজ যেয়ো না। অ্যা’ম সরি। আর এমন ভুল হবে না। প্রমিজ।” স্ত্রীর হাত ধরে বলল সে।
“কথা বলা শেষ হয়েছে?” মেয়েটা বলল।
“হ্যাঁ”
মেয়েটা স্বামীর হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নিলো। তারপর বলল, “এবার তাহলে সামনে থেকে সরে দাঁড়াও। ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে।” লোকটা পথ থেকে সরে দাঁড়ালো। মেয়েটা লাগেজ নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লো। এক বারের জন্যও পেছনে ফিরে তাকালো না।
ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়েছে। চলতে শুরু করেছে ট্রেন। লোকটা বেশ কিছুদূর ট্রেনের সাথে দৌড়ে গেলো। হয়তো জানালা দিয়ে কিছু বলতে চাচ্ছিলো স্ত্রীকে। এক সময় সে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর হতাশ হয়ে ফিরে আসতে লাগলো। স্টেশনের সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই অসংখ্য উৎসুক দৃষ্টির ভীড়ে আমিও ছিলাম। বেশ কিছুদিন ধরেই লেখালেখিতে মন দিতে পারছিলাম না। রাইটিং ব্লক চলছে। গল্প মাথার ভেতর ঘুরপাক খায় কিন্তু কলম পর্যন্ত আসে না। লিখতে বসলেই একটা শব্দও নেই। এদিকে “নৈঃশব্দের কান্না” উপন্যাসের সম্পাদনাও শেষ হয়নি। ব্লকের সেই বিশ্রী অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সিদ্ধান্ত নেই কোথাও বেড়াতে যাবো।
সেই উদ্দেশ্যে স্টেশনে এসেই এই ঘটনাটা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হলো। লোকটা ক্লান্ত পায়ে ফিরে এসেছে। এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো সে। সম্ভবত বসার জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না। আমার পাশে কিছুটা জায়গা খালি ছিলো। আমি আরও খানিকটা সরে বসলাম। সে আন্তরিক ভঙ্গিতে বলল, “থ্যাংক ইউ।” লোকটার ভদ্রতা দেখে কিছুটা অবাক হতে হলো। এত ছোট বিষয়ে কেউ কাউকে ধন্যবাদ দেয় না আজকাল। তার বসার ভঙিও বেশ অদ্ভুত। মাথা নিচু করে জুবুথুবু হয়ে এক পাশে চেপে বসে রইলো সে। লক্ষ্য করলাম তার হাত কাঁপছে। সে বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে ফিরেছে। এজন্যই বোধহয় ঠান্ডা লাগছে। লোকটা হাতের ইশারায় একজন চা-ওয়ালাকে ডাকলো। মাঝবয়সী চা-ওয়ালা দৌড়ে এলো। কাঁপা হাতে চায়ের কাপ হাতে নিলো লোকটা।
সে খুব মনোযোগ দিয়ে চা খাচ্ছে। লেখকদের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা সাধারণের চেয়ে বেশি হতে হয়। সেই ক্ষমতা আমার নেই। তবু লক্ষ্য করলাম খানিক আগে লোকটির উপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেছে তার চেহারায় এখন সেই ছাপ নেই। হয়তো চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই সব ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছে সে। আমি সাধারণত বাইরের মানুষের সাথে খুব একটা মিশি না। আগ বাড়িয়ে কিছু জিজ্ঞেসও করি না। কিন্তু এই লোকের সাথে কথা বলার জন্য কেন জানি আগ্রহ কাজ করলো। কিন্তু কিভাবে কথাবার্তা শুরু করবো সেটা বুঝতে পারছিলাম না। লোকটা কিভাবে যেন আমার মনের কথা বুঝতে পারলো। আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, “আমার ওয়াইফের ব্যাপারে জানতে চাচ্ছেন?” আমি বিব্রত ভঙ্গিতে হাসলাম। যেই হাসির অর্থ- জানতে চাই যদি আপনি কিছু মনে না করেন।
“কী জানতে চান বলুন।” সে বেশ আন্তরিকতার সাথে বলল। চা-ওয়ালা লোকটাও আমার দিকে তাকালো। সেও সম্ভবত তাদের ঝগড়ার দৃশ্যটা দেখেছে। আমি বললাম, “আপনার স্ত্রীর রাগটা বোধহয় একটু বেশি। তাই না?”
“হ্যাঁ, একটু না ভাই। অনেক বেশি।” সে কথাটা বলল হাসিমুখে। যেন রাগী স্ত্রী পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার।
সে বলল, “ও অল্পতেই রেগে যায়। ছোট থেকে ছোট বিষয়েই হইচই শুরু করে দেয়। আপনি আবার অন্যকিছু ভেবে বসবেন না। এম্নিতে কিন্তু ওর মনটা খুব ভালো।” আমি বললাম, “নাহ্, আমি অন্যকিছু মনে করিনি।” আমাদের কথার মাঝখান দিয়ে সেই চা-ওয়ালা ঢুকে গেলো। পান খাওয়া দাঁত বের করে বলল, “সার, যদি কিছু মনে না করেন আমি একটা কথা কই।” অনুমতি পাওয়ার আশায় সে এক হাত সামান্য উঁচু করলো। লোকটি বলল, “জ্বি বলেন।”
চা-ওয়ালা বলল, “ঘটনা কী জানেন ভাইসাব। বউ বশে রাখা কিন্তুক সহজ কাজ না। বউ রাখতে হয় মাইরের উপর। যদিও ধর্মে মেয়ে মানুষের গায়ে হাত তোলা নিষেধ। কিন্তু কী আর করার! যেই অসুখের যেই চিকিৎসা। নিয়মমাফিক চড় থাপ্পড় না দিলে বউ আর বউ থাকে না। তাগো পাঙখা গজায়া যায়। আপনেরা শিক্ষিত্ মানুষ। আপনেরা কন- মাইরের দরকার আছে না নাই?” লোকটা বিরক্তি নিয়ে চা-ওয়ালার দিকে তাকালো। সেই এই জাতীয় কথাবার্তা শুনতে চাচ্ছে না। আমি তেমন একটা অবাক হলাম না। কারণ এক শ্রেণীর মানুষ এই জাতীয় কথাবার্তা অহরহই বলে থাকে। সেই শ্রেণীর মানুষের সংখ্যাও নেহায়েতই কম নয়। দ্রুত দাম মিটিয়ে চা-ওয়ালাকে বিদায় করা হলো। আমি বললাম, “আপনি বললেন যে আপনার স্ত্রী অল্পতেই রেগে যান। তখন আপনার স্ত্রীকে বলতে শুনলাম আপনি বাইরে রাত কাটান। এটা তো ছোটখাট কোন ঘটনা না। গুরুতর অভিযোগ। কোন স্ত্রীই এটা সহজ ভাবে নেবে না।”
“এটা আপনি ঠিক বলেছেন। তবে বাইরে রাত কাটাই- কথাটা খুবই বাজে শোনায়। ভাই, আমি একজন ডাক্তার। বিসিএস করা ডাক্তার। মাঝে মাঝেই রুগী দেখার জন্য আমি হাস্পাতালে থেকে যাই।”
লোকটির কথা শুনে কিছুটা অবাক হলাম। বিসিএস করা একজন ডাক্তার রোগী দেখার জন্য হাস্পাতালে থেকে যাচ্ছে এটা সহজে কারও বিশ্বাস হবে না। আমারও হলো না। কাজেই আমি আর কিছু বললাম না। সে এবারেও আমার মনের কথা বুঝে ফেললো। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনারা সবাই ভাবেন সরকারি ডাক্তাররা কোন কাজই করে না। হাস্পাতালে সময় না দিয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে সময় দেয়। কিন্তু সবাই এরকম না ভাই। দেশে সরকারি হাস্পাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য ক্লিনিকের সংখ্যা সব মিলিয়ে প্রায় সাতশো। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখেন ক’জন ডাক্তার ফাঁকি দিচ্ছে। কোন ইমার্জেন্সি রোগী থাকলে আমি বাসায় ঘুমাতে পারি না। হাস্পাতালে রোগীর কাছাকাছি থাকলে মনে শান্তি পাই।” স্বভাবতই তার কথায় আমি ভীষণ ভাবে লজ্জিত হলাম। আসলেই আমি এমনটাই ভেবেছিলাম। সরাসরি ভিন্ন প্রসঙ্গে গিয়ে বললাম, “ আপনাদের কি অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ ছিল?”
“কেন বলুন তো।”
“নাহ এম্নি জিজ্ঞেস করলাম। আপনাদের বয়সের ব্যাবধানটা একটু বেশিই মনে হলো। দু’জনের মনের মিল না হলে ঝগড়া হওয়াটাই তো স্বাভাবিক।” লোকটি মুচকি হেসে বলল, “হ্যাঁ, আমাদের অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ।” লক্ষ্য করলাম আমার এমন ধারালো কথাতেও সে একটুও অপ্রস্তুত বোধ করছে না। কোন ধরনের সঙ্কোচও নেই তার মধ্যে। আমি বললাম, “আপনি নিশ্চয়ই ভীষণ লজ্জা পেয়েছেন। এতগুলো মানুষের সামনে আপনার স্ত্রী আপনাকে এভাবে অপমান করলো।” সে স্বাভাবিক ভাবেই বলল, “ হ্যাঁ ভাই। কিন্তু কী আর করা। ওর রাগটা একটু বেশি।”
“তো আপনার স্ত্রী যে চলে গেলো আপনার খারাপ লাগছে না।”
“নাহ্। এখন লাগছে না।”
“কী বলেন। আপনি তাকে ভালোবাসেন না?”
“বাসবো না কেন? বাসি।”
“তাহলে বললেন যে খারাপ লাগছে না।”
“ও যতক্ষণ স্টেশনে ছিলো খারাপ লাগছিলো। এখন আর লাগছে না।”
“ভাই আপনার কথা বুঝতে পারছি না।” জবাবে সে কিছুই বলল না। মৃদু হাসলো শুধু। আমি বললাম,“আপনার শশুর বাড়ি কোথায়?”
“খুলনায়। জেলা শহরেই ওদের বাড়ি।”
“কী বলেন! এত দূরের পথ তাকে একা ছাড়াটা কি ঠিক হলো? আপনি সাথে গেলেই তো পারতেন।”
“নাহ ভাই। আমি ট্রেনে উঠলে ও আরও রেগে যেতো। এজন্যই সাহসে কুলালো না।”
হঠাৎ আমার চোখ গেল আকাশের দিকে। বৃষ্টি থেমে গিয়েছিলো। আবারও আকাশ কালো হয়ে আসছে। এবারে বৃষ্টি নামলে সহজে থামবে না। লোকটার দিকে তাকিয়ে বললাম, “আবারও বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে। আপনি এখনো বসে আছেন যে! বাসায় ফিরবেন না?”
“একলা ফিরবো না-কি। আপনার ভাবি আসুক। ওকে নিয়েই ফিরবো।” বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলল সে। আমি বললাম, “ভাবি ফিরে আসুক মানে? সে না চলে গেল। আপনিই তো ট্রেনে উঠিয়ে দিলেন।”
“হ্যাঁ দিয়েছি। প্রতিবারই দিই।”
“আমি আপনার কথা আসলেই বুঝতে পারছি না ভাই। সে কখন ফিরে আসবে।?”
সে বলল, “আচ্ছা শুনুন তাহলে। বুঝিয়ে বলছি। আপনাকে তো আগেই বলেছি আমার স্ত্রীর রাগ সামান্য বেশি হলেও সে মেয়ে হিসেবে যথেষ্ট ভালো। সে আমাকে কী পরিমাণ ভালোবাসে আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। সে তো রাগ করে ট্রেনে উঠে চলে গেলো। দেখলেন তো, শত চেষ্টা করেও ওর রাগ কমানো গেল না। কিন্তু ট্রেন ছাড়া মাত্রই ওর রাগ কমতে শুরু করবে। এখান থেকে প্রথম পড়বে সোনাপুর স্টেশন। সেই স্টেশনেই সে নেমে পড়বে। তারপর সিএনজি করে ফিরে আসবে।”
আমাকে আবারও অবাক হতে হলো। যেই মেয়েটা এতটা রাগারাগি করে চলে গেল সে এত সহজে ফিরে আসবে- কথাটা ঠিক মানতে পারলাম না আমি। আবার পুরোপুরি অবিশ্বাসও করতে পারছি না। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচালে দুলতে থাকলাম। “সে যে আসবেই আপনি এতটা শিওর হলেন কিভাবে?” “ভাই আমাদের বিয়ে হয়েছে ৫ বছর। সেই শুরু থেকেই সে প্রতিমাসেই ২-১ বার করে লাগেজ গুছিয়ে ফেলে। বাবার বাড়ি যাওয়ার জন্য রওনা হয়। আমি হাজার চেষ্টা করেও ওকে আটকাতে পারি না। প্রতিবারই আমাকেই তাকে স্টেশনে নিয়ে আসতে হয়। ওকে থামানোর জন্য আমি প্রতিবারই শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করি। কিন্তু লাভ হয় না।” আমার বিস্ময় সীমা ততক্ষণে অতিক্রম করে গেছে। আমি বললাম, “আর কতক্ষণ লাগবে তার আসতে?” লোকটা ঘড়ি দেখে বলল, “আর বেশি সময় নেই। ১০-১২ মিনিটের মধ্যেই চলে আসবে।” আমি বললাম, “আর আপনি তো জানেনই সে ফিরে আসবে। তাহলে তাকে আটকানোর জন্য এত চেষ্টা করেন কেন? আর এই যে প্রতিবার একই ঘটনা ঘটছে- আপনি বিরক্ত হন না?
“নাহ ভাই। আপনাকে তখন বললাম না যে ঝগড়ার ঐ মুহুর্তে আমার খারাপ লাগছিলো। সেটির কারণ হচ্ছে যতবার ও এভাবে চলে যায় ততবারই আমার মনে হয় ও হয়তো আর ফিরবে না। ট্রেনে উঠার সেই সময়টা তাই ভীষণ কষ্ট হয় আমার। কিন্তু ও চলে যাওয়ার পরই মনে হয় ও ফিরে আসবে। এই যে ও চলে গিয়ে আবার ফিরে আসে। মনে হয় ওকে আমি নতুন করে পাচ্ছি। আমার অপেক্ষা করতে খারাপ লাগে না ভাই।” আমার মনে হলো সে ঠিকই বলেছে। স্ত্রীর চলে যাওয়া এবং ফিরে আসার মাঝের এই অপেক্ষাটা তার কাছে আনন্দের। এই অপেক্ষা ফিরে পাওয়ার। জগতের মধুরতম অপেক্ষা সেটি। প্রিয়জনকে কাছে পাওয়া যেমন আনন্দের, প্রিয়জনের জন্য অপেক্ষা করাও আনন্দের। “অনেক ভালোবাসেন স্ত্রীকে?” হাসিমুখে বললাম আমি। লোকটা জবাব দিলো না। শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছে নিল। সে হয়তো এম্নিতে কখনো কাঁদে না। আমাকে কথাগুলো বলতে গিয়েই হয়তো তার চোখ ভিজে এসেছে।
সে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাই ওর আসার সময় হয়ে গেছে। আমি সামনে গিয়ে দাঁড়াই। সিএনজি থেকে নেমে আমাকে দেখতে না পেলেই রাগ করবে।” সে আর কোন কথা বলল না। তড়িঘড়ি করে সামনে এগুতে লাগলো। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম। হঠাৎ আমার মনে হলো লোকটার নাম জানা হয়নি। নাম জানা থাকলে কোন এক গল্পের আদলে এই ঘটনাটা খুব সুন্দর করে লেখা যেতো। আমিও লোকটার পিছুপিছু গেলাম। মেয়েটা আসলেই ফিরে আসবে কি-না এটা নিয়ে আমার মনে একটা ক্ষীণ সন্দেহ রয়ে গেছে। আমি কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে রইলাম। খুব বেশি কাছে গেলাম না। কারণ মেয়েটা যদি সত্যি সত্যিই ফিরে আসে তাহলে পরবর্তী মুহুর্তগুলো শুধুই তাদের দু’জনের হবে।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক