বসে আছি রেজিস্ট্রি অফিসে।দীপ্ত আর আমি।আজ বিয়ের কাজটা শেষ করতেই হবে।দুবছর প্রেম করার পর বিয়ে হচ্ছে আমাদের।দীপ্ত কলেজের প্রফেসর আর আমি
ডেন্টিস্ট,বর্তমানে হাসপাতালে চাকরি করি।দীপ্ত গত একবছর ধরে বলছে বিয়ের কথা।আমিই এতোদিন রাজি হই নি।কারন তখন দীপ্ত আর আমি দুজনে আলাদা
জায়গাতে চাকরি করতাম।গতমাসে দীপ্ত পোস্টিং চেন্জ করে আমাদের এলাকাতে এসেছে।তাই অবশেষে রাজি হয়েছি।
দীপ্তর মাঝে কিছু খারাপ অভ্যাস আছে,তবুও ও কথা দিয়েছে ভালো হয়ে যাবে ও।
দুঘন্টা পর,,অবশেষে বিয়েটা সম্পন্ন হলো।আজ আমি কালো শাড়ি পরেছি,অবশ্য দীপ্তকেও কালো পাঞ্জাবী পরতে বাধ্য করেছি।দীপ্ত ঘোর আপত্তি জানিয়েছিলো এই ব্যাপারে,বলছিলো বিয়েতে সবাই লাল শাড়ি পরে,শেষে তুমি কি না,শোকের রং কালো কালারের শাড়ি পড়বে?এই শুভদিনে আমাকেও কালো পাঞ্জাবি পবারে?
–হুম।পরাবো।যা বলেছি তাই,ওই রক্তের রংয়ের শাড়ি মানে লাল শাড়ি আমি পরতে পারবো না।যা বলেছি তাই হবে।চুপ থাকো।
দীপ্ত আর তর্ক না করে চুপচাপ মেনে নিয়েছে।বিয়ের কাজ শেষ।বাসায় ফিরতে হবে।মানে দীপ্তর বাসায়।
–মিনি!তোমাকে কালো শাড়িতে কালোপরীর মতো লাগছে।শাড়িটা সুন্দর নাকি তুমি সুন্দর বুঝছি না।
–শাড়িটা সুন্দর,আমি না।খুশি তো?
–আরে না,তুমিই সুন্দর।তুমি যেমন শাড়িই পরো না কেনো তোমাকে সুন্দরই লাগবে।
–থাক!চাপা মারতে হবে না।
বুঝি তো।হুহ।যাও।
–কই যাবো?
–যেখানে খুশি যাও।
–আমার পরী তুমি।রাগ করছো?আজকের মতো দিনে?প্লিজ ভুল করেছি।প্লিজ?
–হয়েছে ঢং করতে হবে না।
দীপ্ত আর আমি বাসায় ফিরেছি।আমাদের রুমটা পুরোটা রজনীগন্ধা দিয়ে সাজানো।আমার প্রিয় ফুলের সুগন্ধে মনটা ভালো হয়ে গেলো।আজ ভরা পূর্নিমা।দীপ্তকে বলেছি আজ সারারাত বেলকনিতে বসে গল্প করবো।জীবনের গল্প,পছন্দ,অপছন
্দ,চাওয়া পাওয়ার গল্প।
ম্যারেজ রেজিস্ট্রি সার্টিফিকেট টা ভালো করে দেখলাম,,দীপ্ত চৌধুরী আর মাহামুদা মিনি।দুজনের জীবনটা একসুত্রে বাধা পড়েছে আজ।সবকিছুই ভালো হয়েছে তবে মনের ভিতর এক অজানা শঙ্কা কাজ করছে।
রাতে খাবার খেয়ে বেলকনিতে বসে পড়লাম দুজনে।
জোসনা রাত পুরো পৃথিবীকে আরো বেশি মায়াবী করে তুলেছে।তারপর রজনীগন্ধার প্রানকাড়া সুবাস,হালকা বাতাস আর নিস্তব্দ শহরটা যেনো আজ আমাদের দুজনেরই।দীপ্তর কাধে মাথা ঠেকিয়ে বসে রইলাম,,জীবনের অনেক গল্প যে বাকি।নিসঙ্গ জীবনের অনেক কথা শুনাতে চাই দীপ্তকে।
–দীপ্ত!তোমার কাছে জীবন মানে কি?
–এই প্রশ্নটা তোমাকে প্রথম যেদিন প্রপোজ করেছিলাম সেদিনও করেছিলে তবে সেদিন সঠিক উত্তর দিতে না পারলেও আজ ঠিকই দিবো।
আমার কাছে জীবন মানে তোমার হাত ধরে অনেকটা পথ পাড়ি দেওয়া,তোমার সঙ্গ পাওয়া,আমার জীবন মানে তোমার ঠোটের কোনে ফুটে ওঠা একচিলতে হাসি,তোমার সব ইচ্ছা পূরন করা,তোমাকে ভালো রাখা।
–এবার বলো তোমার কাছে জীবন মানে কি?
–আমার কাছে জীবন মানে দীপ্ত।
–আমি জানিনা তোমাকে কতোটা ভালোবাসতে পেরেছি,তবে তার থেকে বেশি ভালোবাসা তোমার কাছ থেকে পেয়েছি।আমি অনেক ভুলপথে চলেছি,তোমাকে কষ্ট দিয়েছি তবুও তুমি ছেড়ে যাও নি আমাকে,এতেই আমি ধন্য।
–একটা কথা দিবে
দীপ্ত?
–হুম।বলো।দিবো।
–যা ভুল করেছো মেনে নিয়েছি,এবার থেকে শুধু আমাকেই ভালোবাসো,প্লিজ।আমার খুব কষ্ট হয় তোমাকে আর কারো সাথে দেখলে।জানো,তুমি যখন আমার সামনে দিয়ে নিসা র সাথে ঘুরে বেড়াতে নিজেকে তখন মৃত মনে হতো।প্রচন্ড কষ্টে নিশ্বাসটা গলার কাছে আটকে আসতো।চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইতো তোমার সামনে।আমার এই কষ্ট কি তোমার কাছে ধরা পড়তো কখনো?
জানো!আমার একটা কথাই জানতে মন চাইতো,তুমি কেনো আমাকে ভালোবাসতে পারো নি,কেনো আমি বেঁচে থাকতে আমার চোখের সামনে নিসা র সাথে তুমি রিলেশন করলে!আমাকে রেখে।
আমিতো কোনো অন্যায় করি নি।তুমিই তো ভালোবাসতে শিখিয়েছিলে আমাকে।
বেচে থাকতে আর মৃত্যু যন্ত্রনা দিও না।সহ্য করতে পারি না।
নাজমুল না থাকলে হয়তো বিয়েটাও হতো না।
–হুম।আমি অনেক অন্যায় করেছি।পারলে ক্ষমা করে দিও।আর এমন হবেনা সোনা।আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি,আমার জীবনে কোনো নিসা র প্রয়োজন নেই।মিনি থাকলেই চলবে।থাকবে তো পাশে?
— হুম।অবশ্যই থাকবো।
চোখের পানি থামছে না আজ।চোখের সামনে সেই বিভীষিকাময় দিনগুলো ভেসে উঠছে।দীপ্ত আর নিসার কথা মনে পড়ছে।দীপ্ত কি পারবে নিজেকে বদলাতে?হয়তোবা পারবে।
দীপ্তর হাতটা শক্ত করে ধরে বসে রইলাম।অনেক গল্পে কেটে গেলো রাতটা।
নতুন একটা দিনের শুরু হয়েছে আমাদের জীবনে।সামনে অনেকটা পথ,দুজনে পাড়ি দিতে হবে।
সাতদিনের ছুটি নিয়েছি দুজনেই।দীপ্ত বললো কক্সবাজার যাবে ঘুরতে।আমার জার্নি করতে বড্ড কষ্ট হয়,তবুও দীপ্তর কথা ভেবে রাজি হলাম।
সুর্যদয়,সূর্যাস্ত দেখা,একসাথে ঘোরাঘুরি করা,কেনাকাটা করা,ছবি তোলা,সমুদ্রস্নান করা চলছিলো।
অবশেষে চারদিন পর ফিরে এসেছি আমরা।
দীপ্তর ছুটি শেষ,আমারো।
দীপ্ত ক্লাস নিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো,আর আমি রোগী দেখতে।সারাদিন পরিশ্রম করে বাসায় ফিরে ইদানিং দেখছি দীপ্ত তখনো বাসায় ফেরে নি।
ফিরছে নেই সন্ধ্যার পর।
কারন জিজ্ঞাসা করলে বলে কাজ ছিলো একটু।
এভাবে দিনগুলো ব্যাস্ততায় কেটে যাচ্ছে।
কেটে গেছে আটমাস এভাবে।
দীপ্ত আচকাল বড্ড দেরি করে বাসায় ফিরছে।কিছু জিজ্ঞেস করলে বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকায়।উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করে না।সারাদিনে দুচারটার বেশি কথা বলে না।আগে দুজনে এবসাথে খেতে বসতাম রাতে।এখন দীপ্ত চুপচাপ খেয়ে নেয়,কখনো জানতে চায় না আমি খেয়েছি কি না!
অথচ আগে না খেতে চাইলে দীপ্ত জোর করে খাইয়ে দিতো।
দীপ্ত খেতে বসেছে,চুপচাপ খাচ্ছে।আমি বেডরুমে চলে আসলাম।কষ্ট হচ্ছে খুব।এতো অবহেলা করছে কেনো ও?
বেলকনিতে বসে পড়লাম।আমার মনের সাথে তাল মিলিয়ে আকাশটাও মেঘলা আজ।যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে।
চোখের পানি অঝোরে ঝরছে।দীপ্ত বদলে গেলো কেনো!
হটাৎ দীপ্তর ফোনটা বেজে উঠতেই দৌড়ে রুমে আসলাম।
ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম নিসা!
কলটা রিসিভ করলাম,,
–কে?
–আপনি কে?
–আমি দীপ্তর ওয়াইফ।তুমি এখনো দীপ্তর সাথে কথা বলো?
–হুম বলি,আর বলবোও।কারন দীপ্ত তোমাকে না,আমাকে ভালোবাসে।তোমাকে বিয়ে করে ও ভুল করেছে।ডিভোর্স দিয়ে সেই ভুলটা সংশোধন করবে।
–তুমি আমার আর দীপ্তর মাঝে এসে আমাদের সম্পর্কটা শেষ করে দিয়েছিলে।তারপর যখন আবার যখন সব ঠিকঠাক হয়ে বিয়েটা হয়েছে তখন কেনো আবার আমাদের মাঝে আসছো?
–আসছি কারন দীপ্ত চায় আমাকে।তোমার কোনো প্রয়োজনই নেই দীপ্তর জীবনে।
— তুমি এসব বলার কে?
–আমি কে তা বুঝতেই পারবে।
কলটা কেটে যেতেই পাথরের মতো দাড়িয়ে রইলাম সেখানেই ফোনটা হাতে করে।পুরো পৃথিবীটা মিথ্যা মনে হচ্ছে আজ।কেনো এমন হলো,দীপ্তকি বদলাতে পারে নি তবে!
দীপ্ত যে নিজেকে বদলাতে পারে নি তার প্রমান নিসা র দৃঢ় ভাবে বলা কথাগুলোই।
দীপ্ত ফিরে এসে আমাকে ওর ফোন হাতে করে দাড়িয়ে থাকতে দেখে থমকে দাড়ালো।
— নিসা কল করেছিলো।তুমি নিসাকে ভালোবাসো?
— কি বলো এসব।আমি তোমাকেই ভালোবাসি।আর কথা নয় ঘুমোবো।
— তুমি আমাকে ছুয়ে কথা দিয়েছিলে আবার সেই পথে ফিরবে না,কষ্ট দিবে না আমাকে।
কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করে ছাদে চলে আসলাম।কতো দিন দীপ্তর সাথে ছাদে বসে গল্প করেছি।দীপ্ত হাজার বার ভালোবাসি বলেছে আমাকে,তবে কি সব মিথ্যা ছিলো।
আজ কান্না তো দুরে থাক,নিজেকেই সামলাতে পারছি না।চারিদিকে এতো জোসনা তবু আমার মনটা বিষন্নতার আধারে ডুবে গেলো আজ।এতো বড়ো পৃথিবীতে এই প্রথম নিজেকে বড্ড একা মনে হচ্ছে।নিজের বিশ্বাস,ভরসার উপর ঘৃণা লাগছে।আমার বিশ্বাস এতোটাই ঠুনকো ছিলো?
আজ সারা পৃথিবীর মানুষকে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে,,আমি বড্ড ঠকে গেছি ভালোবেসে,তোমরা কেউ কখনো কাউকে ভালোবেসো না,বিশ্বাস করো না।ঠকে যাবে।
ভালোবাসা বলে কিছু নেই পৃথিবীতে,সব ছলনা।
আমি একাকী মুখ লুকিয়ে কাঁদছি আর দীপ্ত হয়তো নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।
আজ দ্বিতীয় বারের মতো মৃত্যু হলো আমার।প্রথমবার মৃত্যু হয়েছিলো সেদিন,যেদিন আমার সাথে সম্পর্ক চলাকালীন নিসা র সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলো দীপ্ত।
ভালোবাসার প্রতি আজ ঘৃণা ছাড়া আর কিছু বেঁচে থাকলো না।
দীপ্ত আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করলো পুরোপুরি।আমার দিকে তাকায়ও না।আবারো আমার সামনে দিয়ে নিসার সাথে ঘুরে বেড়ায়।
প্রচন্ড যন্ত্রনা পাচ্ছি আমি আবারো।মরে যেতে ইচ্ছা হয় খুব।পারছি না আর।
মনে মনে দৃঢ় সংকল্প করলাম,
দীপ্ত হয় আমার হবে নাহলে কারো হবে না,ও ঠকাতে পারে না আমাকে,আমার বিশ্বাস,ভালোবাস
াকে।
কিছুতেই না।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে,দীপ্ত বাসায় ফেরে নি এখনো,অবশ্য ফিরলেও কি!কথা বলবে না আমার সাথে।
চুপচাপ অনেক পুরোনো একটা ডাইরি খুলে বসে পড়লাম,একটা ফোননাম্বার খুজতে হবে।
ডাইরির প্রায় শেষের দিকে অালো নামটা দেখে স্বস্তির নিশ্বাস পড়লো আমার।
ওর পুরো নাম অলোক ঝালা,তবে আমি আলো বলেই ডাকতাম।
প্রায় পাঁচবছর আগে আলোর সাথে আমার দেখা হয়েছিলো একটা ভার্সিটিতে।এক ছোটো বোনের এডমিশনের ব্যাপারে কথা বলার জন্য সাথে গিয়েছিলাম ভার্সিটিতে।তেমন কাউকেই চিনি না,হটাৎ কোথা থেকে একটা ছেলে এসে বললো আপনাদের কোনো হেল্প লাগবে?
আমি হ্যাঁ বলতেই নিজ দায়িত্বে সব কাজ করে দিলো।পরে চলে আসার সময় জানলাম উনার নাম অলোক ঝালা।ভার্সিটিতে একটা প্রয়োজনে এসেছে উনিও।উনিও এ ভার্সিটি থেকেই পড়াশুনা করেছেন।এখন বাবার বিজনেস দেখাশোনা করে।এক মাসী ছাড়া আর কেউ নেই।
ছেলেটা কথা বলেই চলেছে।
সেদিনের মতো কাজ শেষ করে অলোক ঝালা কে বিদায় জানিয়ে বাসায় ফিরলাম।
বাসায় এসে আমার সেই বোন(তামান্না) সে কি হাসি!
–আপু,ওই ভাইয়ার নামটা কি যেনো?অলোক ঝালা!হি হি।।
এমন নামও হয়?
— হয় রে সোনামনি।হাসি বন্ধ কর।নামটা তো ভালোই।
–আহারে!মুসলিম হলে দুলাভাই বানাতাম তাকে।।হি হি হি।।
–ওই চুপ করে,পড়াশুনা কর।বেশি জালাবি না।
— ওকে,যাও।
তার ঠিক পাঁচদিন পর বাসা থেকে বেরিয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছি,হটাৎ সামনে তাকিয়ে দেখি অলোক ঝালা।বাইকে করে আসছে এদিকে,আমাকে দেখে বাইক থামিয়ে চোখ কপালে তুলে ফেললো,,তুমি?
— হুম,আমি।
— অবশেষে দেখা হলো আবারো!তোমার মুখটা এই পাঁচদিনে একবারো ভুলতে পারি নি।
–মানে?
–কিছু না,,বন্ধু হতে পারি?
— মুখের উপর না বলতে পারলাম না।মাথা কাত করলাম,তাতেই সে হ্যাঁ ধরে নিলো।
তারপর থেকে বন্ধুত্ব হয়ে গেলো আমাদের।
পরে আলো সব বললো আমাকে,ও আসলে একজন মাফিয়া ডন।
কন্টাক্ট কিলার।
আন্ডারগ্রাউন্ড জগতের এক উচ্চপদের লোক সে।
আমি কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারি নি।তারপর কয়েকটা প্রমান দেখিয়েছিলো আমাকে।
তারপর অনেক চেষ্টা করেছি আলো কে ভালো পথে ফেরাতে।পারি নি।
একদিন আলো আমাকে প্রপোজ করে বসলো।
বললো আমার ভালোবাসা পেলেই সব ছেড়ে আসবে।
আমি আলো কে বন্ধু মনে করতাম।তাই ওকে বুঝিয়ে বললাম।ও জোর করে নি।তবে সেদিন থেকে আলোর মুখে কোনোদিন হাসি দেখি নি।
ছেলেটা কি সত্যি ভালোবাসতো আমাকে?
হয়তো বাসতো।
আজ পাঁচবছর পর আলোর ফোন নাম্বারটা দেখে আলোর মুখটা স্পষ্ট ভেসে উঠলো।
জানিনা নাম্বারটা খোলা আছে কি এখনো!কল তো দিয়ে দেখি।অবাক ব্যাপার একবারেই সাড়া পেলাম,
— কে বলছেন?আলো?
–কে আপনি?কাকে চান?
–অলোক ঝালা আছে?
— হুম আছে,তবে দাদা জরুরি মিটিংয়ে আছে।এখন কথা বলা যাবে না।
— অলোক কে বলেন মিনি কল করেছে।
ওপাশ থেকে কোনো কথা আসছে না,অপেক্ষা করছি আমি।
ত্রিশ সেকেন্ড পর সেই পরিচিত কন্ঠটা শুনতে পেলাম,,
— মিনি? তুমি?আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।জানো!তোমার জন্য এই সিমটা ফেলতে পারি নি।কেমন আছো?
— ওসব কথা পরে হবে।দেখা করতে পারবে?
— পারবো না মানে!তুমি বললে এখনি আসবো।
— না,কাল সকালে আসবে।ঠিকানাটা লিখে নাও।
টুকটাক কথা বলে রেখে দিলাম।
পরদিন সকাল,,
একটা পার্কে বসে আমি আর আলো বসে আছি।
কি কি করতে হবে আলোকে সব বলে দিলাম।আলো সব শুনে দীপ্তর উপর প্রচন্ড রেগে গেলো।বিদায় নেবার সময় আলোর চোখে পানি দেখলাম।তবে কি আলো এখনো,,!
সেদিন রাতে আর দীপ্ত বাসায় ফিরলো না।নিসা ও ফিরবে না।
সন্ধ্যার পর বেরিয়ে পড়লাম আমার গন্তব্যে।
আলোর একটা গোপন আস্তানাতে,দীপ্তকে একটা চেয়ারের সাথে বাধা আছে।হাত পা,মুখ সব বাধা।চোখদুটোও বাধা।
পাশে নিসা রো একই অবস্থা।
দীপ্তকে দেখে খুব কষ্ট হলো।
আলো দীপ্তর সামনে এসে বললো,,
— তুমি নিসা কে ভালোবাসো?
— হ্যাঁ বাসি,আপনি কে?কেনো আমাদের এখানে আসলেন?
— সোজা কথায় খুন করতে।কারন আমি একজন কিলার।খুন করা আমার পেশা।তোমার যেমন ভালোবাসার মানুষ বদলানো পেশা,তেমনই।
তা তোমার নাকি বিয়ে হয়েছিলো,বউকে ভালোবাসো না?
— না,বাসি না।
— তবে তাকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিয়ে কেনো করেছিলে?
–ভুল করেছিলাম।
–কথাগুলো কি প্রেমিকাকে শোনানোর জন্য বলছো!বুকে হাত রেখে বলতে পারো,,মিনিকে কখনো ভালোবাসো নি?
–জানি না আমি।
–নিসা কে বিয়ে করবে তুমি?আজ এখনি?
–আজ?কেনো?
–নিসাকে ভালোবাসো তাই।
দীপ্ত কোনো উত্তর করলো না আর।আমি পর্দার ওপাশে দাড়িয়ে চোখ মুছছি।
আলোর নাম্বারে ডায়াল করলাম,,
–ওদেরকে ছেড়ে দাও এবার।যা দেখতে চেয়েছিলাম,দেখেছি।
বাসায় ফিরে আসলাম।আলো কল করে জানালো ওদের ছেড়ে দিয়েছে।
–মিনি!আজো তোমাকে ভালোবাসি,জীবনে জড়াই নি কাউকে।পারি নি।
কোনো সমস্যা হলে বা সাহায্য লাগলে একবার মনে করিও।ছুটে যাবো সব ফেলে।
আমার লাগেজ গুছিয়ে নিলাম।দীপ্তর দেওয়া একটাকার জিনিসও সঙ্গে নিলাম না।গয়না,কাপড় সব রেখে দিলাম গুছিয়ে।শেষবারের মতো নিজের হাতে বাসাটা গোছালাম।
যেসব জিনিস আমার কেনা সেগুলোই নিলাম।এলবাম খুলে সব ছবিগুলো বের করে পুড়িয়ে দিলাম।বেডরুমের দেয়ালে আমাদের দুজনের তিনটা ছবি টানানো ছিলো।
নামিয়ে এনে ফ্লোরে আছাড় মেরে কাঁচ ভেঙে ফেললাম,তারপর আমার ছবিটা ছিড়ে নিয়ে টুকরো টুকরো করে ফেললাম।
অপেক্ষা করছি দীপ্তর ফেরার জন্য।হয়তো নিসা কে নিয়েই ফিরবে দীপ্ত।
প্রচন্ড কষ্টে চোখের পানিও বেঈমানি শুরু করেছে।
কলিংবেল বাজতেই দরজা খুলে দিলাম।
নাহ,দীপ্ত একা আজ।
হয়তো নিসা পরে আসবে,আমার বিদায়ের অপেক্ষায় আছে।
চুপচাপ ডিভোর্স পেপারে সই করে দিলাম।তবে সই করার সময় কয়েকফোটা পানি পড়লো কাগজের উপর।
দীপ্তর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম,
— সব বন্ধন থেকে মুক্ত আজ তুমি।জীবনটা নিজের পছন্দ মতো সাজিয়ে নিও।তোমার ঘৃণা,অবহেলা পাল্টে দিয়েছে আমাকে।
আরো কিছুদিন আগে যদি বলতে ভালোবাসো না তবে আগেই চলে যেতাম।
নিজের যত্ন নিও,আর ওষুধগুলো নিয়মমতো খাবে,ওই ড্রয়ারে ওষুধ খাবার নিয়মগুলো ভালো করে লেখা আছে।দেখে নিও।
শেষবারের মতো দীপ্ত হাতটা ধরে বললাম,
–কাল সকালে
ডিভোর্স লেটারটা সই করে পাঠিয়ে দিও।
আর ভালো থেকো।
বেরিয়ে পড়েছি দীপ্তর বাসা থেকে।আমার পুরোনো বাসাতে ফিরে এসেছি।
সব কিছুতে ময়লা জমেছে।ঝেড়েমুছে পরিষ্কার করে নিলাম।রাত বারোটা বাজে।
সেই পুরোনো বেলকনিতে বসে আছি।যেখানে বসে দীপ্তর সাথে ফোনে কথা বলতাম।
হটাৎ ফোনটা বেজে ওঠাতে চিন্তায় বাধা পড়লো।
দীপ্ত কল করেছে!
— কি?
— নিচে দাড়িয়ে আছি,গেটটা খোলো একবার কথা বলতে চাই।
সেই বেলকনিতে বসে আছি
আমি,পাশে দীপ্ত দাড়িয়ে।
দীপ্ত ডিভোর্স পেপারটা ছিড়ে টুকরো টুকরো করে বাইরে ফেলে দিলো।আমি কেনো জানি একটুও অবাক হলাম না।
— আমি নিসাকে চাইনা।তোমাকে চাই।প্লিজ ক্ষমা করো।তুমি চলে আসাতেই বুঝেছি তুমি ছাড়া চলবে না আমার।
— আমি আর তোমাকে চাই না।ভালোবাসা বলে কোনো জিনিসে বিশ্বাস নেই আমার।
— আমি জানি আমি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছি,তবুও তোমার কাছে এসেছি।ফিরিয়ে দিও না দয়া করে।মরে যাবো আমি।
দীপ্ত জোরে জোরে কাঁদছে।আমিও কাঁদছি তবে নিঃশব্দে।
মাঝরাতের নিরবতাকে ম্লান করে দীপ্তর কান্নার শব্দ আঘাত করছে আমার কানে।
আমি পাথরের মতো বসে আছি।নড়ছি না।দীপ্ত কেঁদেই চলেছে।চাঁদের একফালি জোসনা এসে পড়েছে দীপ্তর মুখের উপর।আজ অনেকদিন পর এতো কাছ থেকে এই মুখটাকে বড্ড মায়াবী লাগছে।
আমি অবাক হয়ে দেখছি দীপ্তকে।
থেকে থেকে কষ্টে কেঁপে উঠছে দীপ্ত।
ফোটায় ফোটায় পানি দীপ্তর গাল বেয়ে নিচে পড়ছে টুপটুপ করে।পানির সাথে সাথে কি ওর অন্যায়গুলোও ঝরে পড়ছে??
আমি তবুও পাথরের মূর্তির মতো বসে আছি,কোনো এক সকালের অপেক্ষায়,,,,,।
……………………………………..সমাপ্ত………………………………………