একটি রিক্সাওয়ালার গল্প

একটি রিক্সাওয়ালার গল্প

সে অনেকদিন আগের কথা। তখন সবে বিয়ে হয়েছে। বিয়ের জন্যে এক হপ্তা ছুটি নিয়েছিলাম। ছুটি শেষ হতেই শুরু হল আমার কর্মময় জীবন। ছ’দিন অফিসে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি। আর তারপর প্রতি রবিবার চলো কোন না কোন আত্মীয়ের বাড়ি। গুরুজনদের কথা, বিয়ের পর নাকি সব আত্মীয়ের বাড়ি গিয়ে প্রণাম করে আসতে হয়। এটাই নিয়ম। সবার আশীর্বাদ না নিলে নাকি সংসার সুখের হয় না। তাই এ রবিবার গেলাম তারকেশ্বরে আমার পিসিমার বাড়ি, তো পরের রবিবার যাই বনগাঁয় পিসশাশুড়ীর বাড়ি। এইভাবেই দুমাস কাটিয়ে দিলাম। তারপর ভাবলাম এবারে ক্ষান্ত দিই। বর্ষাকাল এসে গেল। আমার নতুন বৌ হাঁ হাঁ করে উঠলো। তা কি করে হয়। তুমি তো কেবল ছোড়দিদুর বাড়ি গেছ। এখন বড়দিদু আর মেজদিদুর বাডি না গেলে, তাঁরা মনে কত কষ্ট পাবেন বলতো। মনে মনে ভাবি আমার কষ্টটা কেউ বোঝে না। কতদিন যে দুপুরে বিছানায় টানটান হয়ে শুতে পারিনি। যাই হোক, নতুন বৌ মনক্ষুন্ন হলে তো আমারই ক্ষতি।

তাই পরের রবিবার যাবার মনস্থ করলাম বড়দিদুর বাড়ি, নদীয়া জেলার নাকাশীপাড়ায়। ওই সাথেই ঘুরে আসবো মেজদিদুর বাড়ি। ওখান থেকে বেশী দূরে নয়, মাত্র তিন কিলোমিটার। ধর্মদা বলে একটা গ্রামে।
সকালেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে শিয়ালদা থেকে কৃষ্ণনগর লোকাল ধরে যখন নাকাশীপাড়ায় পৌঁছালাম তখন প্রায় সকাল দশটা। আদর-আপ্যায়ন সাংঘাতিক। পাড়া ঝেঁটিয়ে সব মেয়ে-বৌ-বুড়ি জামাই দেখতে এসেছে। তাদে্র কত রকম সরস মন্তব্য। লজ্জায় মুখ লাল হয়ে যায়। আইবুড়ো মেয়েগুলো গায়ে গা ঘেঁসে বসতে চায়। তাতেই তাদের আনন্দ। সবার কলকলিতে মুখরিত ঘর।

তারপর একসময় খাবার ডাক আসে। খেয়েদেয়ে উঠতে উঠতে বেলা তিনটে। এখনি ছুটতে হবে মেজদিদুর বাড়ি। আকাশের অবস্থা ভাল নয়। সকালে এক পশলা ভালোই বৃষ্টি হয়ে গেছে। এখন আবার তাড়াতাড়ি না বের হতে পারলে সন্ধ্যের মধ্যে কৃষ্ণনগর পৌঁছাতে পারবো না। ঐ বাড়িরই একটি ছেলে একটি রিক্সা ডেকে আনলো। চুক্তি হল, সে আমাদের ধর্মদা পৌঁছে আধঘণ্টা অপেক্ষা করবে, তারপর আমাদের সন্ধ্যের মধ্যে কৃষ্ণনগর স্টেশনে পৌঁছে দেবে।

ধর্মদা যখন পৌঁছালাম তখন টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। আর তারপরেই নামলো মুশলধারে। উৎকন্ঠা শুরু হল আমার। বাড়ী ফিরবো কি করে। অথচ আমাকে ফিরতেই হবে। কাল সকালে অফিস আছে। এখান থেকে কৃষ্ণনগর স্টেশন প্রায় পাঁচ’ছ মাইল। মাঝে পড়ে আবার ধূ ধূ মরুভূমির মতো ভূষণ্ডীর মাঠ। কোন বাড়িঘর দোকানপাট নেই। প্রায়ই ডাকাতি হয় ঐ এলাকায়। সাথে আবার নতুন বৌ। তাই এক ঘণ্টা পরে বৃষ্টি একটু থামতেই বেরিয়ে পড়ি। আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে। কিন্তু কোথায় আমার সেই রিক্সাওয়ালা। বুঝলাম আমার দেরী দেখে সে চলে গেছে। সন্ধ্যায় ভূষণ্ডীর মাঠ সে পেরোতে চায় না। মাথায় বাজ পড়ে আমার। বাড়ি ফিরবো কি করে? রাস্তায় তো কোন রিক্সাও তো দেখছি না। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে। হটাৎ কোথা থেকে একটা রিক্সা আমার সামনে হাজির। বৃষ্টির জন্যে রিক্সাওয়ালা বর্ষাতি দিয়ে নিজেকে ঢেকে রেখেছে।

–কোথায় যাবেন কর্তা?

আমি বলি কৃষ্ণনগর স্টেশন।

–আসেন।

কিন্তু সন্ধ্যের মধ্যে পৌঁছে দিতে পারবে তো? শুনেছি রাস্তাটা ভালো নয়। প্রায়ই খুন ডাকাতি হয়।
–চিন্তা করবেন না কর্তা। এই সুরুল মোল্লা থাকতে আপনার গায়ে কেউ হাত দিতে পারবে না। উঠে আসুন আপনারা।

অগত্যা উঠে বসি আমরা। রিক্সা চলতে শুরু করে। ঝড়ের বেগে রিক্সা চালায় সুরুল। চারিদিকে অন্ধকার নেমে আসে। আকাশ কালো মেঘে ঢাকা। হয়তো তাই এতো তাড়াতাড়ি মনে হয় অন্ধকার নেমেছে। ধূ ধূ ভূষন্ডীর মাঠ। কোন গাছপালা বা বাড়ীঘরের চিহ্ন মাত্র নেই ঐ এলাকায়। বেশ কিছুক্ষণ পর দূরে দেখা যায় টিমটিমে আলোর রেখা। ধড়ে প্রাণ ফিরে আসে। যাক বাবা নিরুপদ্রপে ভূষন্ডীর মাঠ পেরিয়ে লোকালয়ে ফিরে আসতে পেরেছি। আবার টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। একটা দোকানের আগে রিক্সাটা দাঁড় করে সুরুল মোল্লা বলে, ‘আপনারা এখানে নেমে যান কর্তা। এখান দুপা এগোলেই কৃষ্ণনগর স্টেশন”।

আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে রিক্সা থেকে নেমেই বৃষ্টির জন্যে দৌড়ে সামনের দোকানের শেডে আশ্র্য় নিই। তারপর ঘুরে রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া মেটাতে গিয়ে দেখি, রিক্সা সমেত সুরুল নেই। চেঁচিয়ে ডাকি সুরুল কোথায় গেলে। ভাড়াটা নিয়ে যাও।

দোকানদার বিষ্ময়ে আমার দিকে চেয়ে থাকে। বলে আপনারা কার রিক্সায় এসেছেন? সুরুলের? সে তো দশবারো বছর আগে ভূষণ্ডীর মাঠে খুন হয়েছিল। আপনারা তাকে পেলেন কোথায়?

আমি বলি সুরুলই তো তার রিক্সায় আমাদের এখানে পৌঁছে দিল। কিন্তু….আমার হাত-পা কাঁপতে থাকে।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত