অদৃশ্য লালকার্ড

আজ আমার মনটা ভাল নেই।
আর্জেন্টিনা একনাগাড়ে তিনটা ফাইনাল হেরেছে। ইন্টারন্যাশনাল টুর্নামেন্টগুলোতে সিলভার মেডেল পাওয়ার হ্যাটট্রিক করল টিমটা। ইস! এই হ্যাটট্রিকটা যদি হারের না হয়ে গোলের হত? কোনো ম্যাচে?
তা কি হয় নি? এই ফাইনাল ম্যাচটার আগের ম্যাচগুলোয় আমি কি পারিনি জ্বলে উঠতে? পেরেছিলাম তো! আমেরিকার এগেইনস্টে হ্যাটট্রিকটা করলাম। এই টুর্নামেন্টের গোল্ডেন বল, গোল্ডেন বুট-দু’টোই তো আমার। শুধু কি তাই? আর্জেন্টিনার হয়ে তো এখন আমিই হায়েস্ট স্কোরার। স্যার বাতিস্তুতা যদি জানতেন, তবে কেমন হত তার রি-অ্যাকশন? তিনি কি খানিকটা কষ্ট পেতেন? নাকি খুশিই হতেন? কষ্ট হয়তো বা তিনি পেতেন না। উনি তো আর ডিয়েগো ম্যারাডোনার মত নন!
হ্যাঁ, ম্যারাডোনা। আমার ছোট্টবেলার আদর্শ। আমার মত আমার মাও ম্যারাডোনার ভক্ত ছিলেন। তার সাথে নাকি দেখা হয়েছিল ডিয়েগোর। তখন অবশ্য আমি খুবই ছোট। তিনি হাসতে হাসতে ডিয়েগোকে বলেছিলেন, “ডিয়েগো, আমি তোমার খেলার খুব বড় ভক্ত। আমার আশা, আমার ছেলেটাও বড় হয়ে তোমার মত হবে”।
তা কি হতে পেরেছি? আমার যে আর্জেন্টিনার হয়ে বড়ধরণের কোনো আন্তর্জাতিক অর্জন নেই। সেই ছোট্ট বিশ্বকাপ আর অলিম্পিকের মেডেল দিয়ে কতদিন ভক্তদের মোহজালে বেঁধে রাখব? আর্জেন্টিনার হয়ে অবশ্য ব্যক্তিগত অর্জন আমার কম নেই। প্রচুর ম্যান অব দ্যা ম্যাচ, গোল্ডেন বুটস, গোল্ডেন বলস-অনেক আছে, অনেক! বাট হোয়াট অ্যাবাউট আ গ্রুপ অ্যাচিভমেন্ট?
ডিয়েগো, ডিয়েগো, ডিয়েগো। আহ! আর্জেন্টিনার সর্বযুগের নায়ক। যেখানে যাই, সর্বদা তার নাম উচ্চারিত হতে থাকে। তিনিই আর্জেন্টাইনদের দেবতা। আর আমি? আমি যেন এক অভিশপ্ত দেবদূত, যে কিনা কখনোই পারবে না তার ভক্তদের তুষ্ট করতে।
বয়স তো কম হল না। এই তো, দশ বছর আগে আমি জয়েন করেছিলাম ন্যাশনাল টিমে। সম্ভবতঃ হাঙ্গেরির এগেইনস্টেই ডেব্যু হয়েছিল আমার। সেই ম্যাচে নামার কিছুক্ষণের মধ্যেই কার সাথে যেন ধাক্কা লাগল। পত্রপাঠ লালকার্ড। অভিষেক ম্যাচে সেই লাল কার্ড হয়তো বা শুধুমাত্র মাঠ ছেড়ে চলে যাবার সিগন্যাল ছিল না, হয়তো আমার সম্পূর্ণ শূন্য ফুটবল-জীবনের একটা ইঙ্গিত ছিল। হয়তো লাল টুকটুকে শক্ত কাগজের টুকরাটা আমাকে বলতে চাইছিল, “লিও, তুমি কখনই পারবে না আর্জেন্টিনার হয়ে কিছু অর্জন করতে। যখনই তুমি এগোবে, তখনই তোমার সামনে এক অদৃশ্য আমি হাজির হব। কেউ আমায় দেখতে পাবে না, এমনকি তোমার চোখও নয়। কিন্তু তোমার অন্তর্দৃষ্টি আমাকে দেখবে। দেখেই থেমে যাবে, যেমন করে তুমি এখন থেমে আছ”।
সেদিন কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমি থেমেই গিয়েছিলাম। আর আজ, আজ আমি যেন সম্পূর্ণ এক’শ বিশ মিনিটই থেমে ছিলাম। পায়ে পায়ে বল ঘুরেছে, শট নিতে পারিনি। যাকে পাস দিয়েছি, সে গোল করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারই বা কি করার? ঐ অদৃশ্য লালকার্ডটা যে শুধু আমাকে নয়, আমার সাথে আমার সমস্ত সতীর্থদের থামিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে। আর যারা থেমে থাকে না, এগিয়ে যেতে চায়, তাদের জোর করে বের করে দেয় মাঠের বাইরে। কারো হয়তো লিগামেন্ট ছিঁড়ে যায়, কারো হাঁটুর বাটিতে ধরে চিড়, কাউকে বা হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট ভোগায়। এ কেমন অভিশাপ? এ থেকে কে মুক্তি দেবে আমার দেশমাতৃকাকে?
এতক্ষণে বুঝেছি এর কারণ। এই অভিশাপ আর কেউ নয়, স্বয়ং আমি। বার্সেলোনার হয়ে হয়তো আমি শ্বেতশুভ্র পায়রা, কিন্তু আর্জেন্টিনার হয়ে আমি কদাকার কুৎসিত এক দাঁড়কাক। আমি হয়তো…হয়তো শকুনের চেয়েও অধম, যার ছায়ায় পর্যন্ত কারো অকল্যাণ ছাড়া কল্যাণ হয় না। আর্জেন্টিনার হয়ে প্রথম ম্যাচ খেলার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি বহিষ্কৃত হয়েছিলাম, তখনই হয়তো বা আমার কপালে অমঙ্গলের দূতের নামটা কোনো এক অদৃশ্য কালিতে লেখা হয়ে গিয়েছিল। কালিটা বেশ পাকা ছিল মনে হয়, নাহলে দশ বছর ধরে স্নান করছি, মুখ ধুচ্ছি, কিন্তু ওটা উঠে যাচ্ছে না কেন?
আর এক মুহূর্তও এই দলে নয়। যতক্ষণ আমি থাকব আর্জেন্টিনায়, ততক্ষণ আমার অভিশাপে অভিশপ্ত আর্জেন্টিনা যে কখনোই কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বিজয় লাভ করবে না। আমার সতীর্থরা, আমার ভক্তরা, আমার পূর্বসূরিরা যে কখনোই সুখের হাসি হাসতে পারবে না। আমি আর আমার ঐ অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে অদৃশ্য লালকার্ডটা দেখতে পারব না। আমি যত তাড়াতাড়ি চলে যাব, ততই আমার দেশমাতৃকার মঙ্গল হবে।
হ্যাঁ, আজ আমি হয়তো চলে যাচ্ছি, কিন্তু আমি আবার পুনর্জন্ম নেব। আবার মা আর্জেন্টিনার কোলে ফিরে আসব, সঙ্গে থাকবে একদল অন্তরঙ্গ সতীর্থ, যাদের সাথে আবার হইচই, আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠব আমি। তখন আর্জেন্টিনার হয়ে প্রথম ম্যাচ খেলতে গেলে আর কেউ আমাকে বহিষ্কার করতে পারবে না, কোনো ভুলত্রুটি করব না আমি। আর্জেন্টিনাকে দু’হাত ভরে সেই সবকিছু দেব যা সে আমার কাছ থেকে আশা করে। এই প্রতিজ্ঞা আমার সবার কাছে, বিশ্ব-ফুটবলের কাছে।
মা, মাগো, পারলে ক্ষমা করে দিও তোমার এই অধম ছেলেকে।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত