বৃষ্টি, বিধাতার এক অপূর্ব সৃষ্টি আঁষাঢের এই অগ্রদূত।মুক্তো দানার ন্যয় খসে পড়ে কালো মেঘের বুক থেকে অবিরাম,
ঝরঝর…ঝরঝর!
তবে প্রকৃতি বদলেছে।ইদানিং আর আগের মত একটা অঞ্চল জুড়ে বৃষ্টি হয় না।
কেমন জানি ডোরাকাটা বৃষ্টি হয় আজকাল।সাদা ডোরায় যেই জায়গাগুলো পরে সেগুলোয় বর্ষন হয় না।শুধু কালো ডোরায় পরে যাওয়া স্থানগুলোতে দলবল নিয়ে হামলে পরে ঝুম বৃষ্টি!
ভাগ্যিস্ মহাখালী ফ্লাইওভারটা আজ কালো ডোরায় পরেছে।তাইতো কালো মেঘের সেনাগুলো;রাতের কালো আকাশটাকে আরোও মিশমিশে কালো করে দিতে জড়ো হয়েছে এদিকটায়।
তবে তীক্ষ্নবেগে যা ঝরছে সেগুলো কি আদৌ বৃষ্টি?
নাকি ক্ষুব্ধ প্রকৃতি সমানে থুথু ছিটিয়ে চলছে ঘুনে ধরা সমাজের গায়!
সে যাই হোক,
এই মুহূর্তে মহাখালী ফ্লাইওভারটার এক অংশে রেলিংয়ের কিনার ঘেঁষে,তথাকথিত অঝোর ধারার বৃষ্টিতে ভিজে চলেছে একজন বৃদ্ধ।
হ্যাঁ,৬৫ বছর বয়স্ক জাহাঙ্গীর চৌধুরিকে বৃদ্ধই বলা চলে।বয়সের ভারে তিনি যতটা না বৃদ্ধ হয়েছেন,শরীরের অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান রোগের ভার তাকে আরও কিছুটা বার্ধক্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
হাতের মুঁঠোয় ধরে থাকা লাঠিটা আরেকটু কষে ধরলেন জাহাঙ্গীর সাহেব।আকাশের পানে তোলা মুখমন্ডলের উপর শীতল বিন্দুগুলো পরতেই ছেলেবেলার কিছু স্মৃতি মনে পড়ে গেল।
তখন এইরকম ঝুম বৃষ্টি নামলেই প্রথম কাজ ছিল খালের পাড়ের বাছাইগুলোর দিকে ছুটে যাওয়া।
বাঁশের মাঁচার উপর বেত আর কাগজের ছাউনি দেয়া বাছাই গুলোর ভিতরে বসে পা দুটো ঝুলিয়ে দিতেন বাইরের দিকে।শরীর না ভিজিয়ে শুধুমাত্র পাগুলো ভেজানোর মজা কেবলমাত্র ঐ সময়টাতেই অনুধাবন করা যায়।
বন্ধু বান্ধব সহ পিচ্ছিল কাঁদার উপর ছেঁচড়ে চলাটা ভিষন প্রিয় ছিল।
সেগুলো অনেক কুট্টি বেলার গল্প।বড় বেলায় এসে যেগুলো জসীম ভাইয়ের দোকানের এলাচ দেওয়া দুধ চায়ের ধোঁয়ার ভীড়ে হারিয়ে গিয়েছিল।
বীপ..বীপ..!
সাঁই..করে ছুটে যাওয়া একটি গাড়ির,হাইড্রোক্লোরিক হর্নের আওয়াজে বাস্তবে ফিরলেন জাহাঙ্গীর সাহেব।আজ অনেকদিন পর বৃষ্টিতে কাকভেজা হতে ভালো লাগছে।অবিরত বর্ষনের কিন্নর ধ্বনি একজনের কথা বিশেষভাবে মনে করিয়ে দিচ্ছে।
জান্নাতুল আরা বেগম,তার জীবনচক্রের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গিনী।
কত বর্ষায় একত্রে হাতের বন্ধনীতে আবদ্ধ দুটি উষ্ণ হৃদয় সিক্ত হয়েছিল কোমল অমৃতধারায়।
সেও প্রায় ৩০ বত্সর আগের ঘটনা,যা এখন শুধুই ফ্রেমে বন্দি অতীত।
তাকে ছেঁয়ে থাকা ভালবাসার লাল আঁচলের ছাউনিটা ছিড়ে গেছে বহু বছর হল।
ছেলে মেয়ে দুটোকে নিয়ে সুখের নীড়ের ভারসাম্য একা হাতেই অনেকটা সময় জুড়ে সামলে চলেছেন তিনি।এরমাঝে ক্যালেন্ডারের বেশ কিছু পাতা উল্টে গেছে।
ছেলেকে মানুষ করেছেন।বিয়ে দিয়ে ঘরে পুত্রবধুও আনার পাঠও চুকে গেছে।
ছোট্ট মেয়েটা কড়ে আঙ্গুল ধরে হাঁটতে হাঁটতে,কখনো যে তার মেয়েরও কড়ে আঙ্গুল ছুয়ে অবসম্ভাবী পতন ঠেকানোর বয়স হয়ে গেছে; টেরই পাননি চৌধুরি সাহেব।
আর্দশ পিতার মোড়কে;বলিষ্ঠ কলুর বলদ।সংসার নামক জাঁতাকলে পিষতে পিষতে এমন বহু বিশেষনের তকমা গায়ে জড়িয়ে গেছে।
তবে একটা সময় সবাই,না উগরে ফেলতে পারা কাঁটায় পরিনত হয়।পুত্র আর পুত্রবধুর গলার কাঁটা হয়ে বেশ ভালই চলছিল যদি না মাঝপথে মরন ব্যাধিটা ব্যাগড়া দিতো।
তার প্রতি সকলের বিশ্বাসের যে রঙ্গীন পানীয়ের পাত্রটা ছিল,তাতে ফোঁটায় ফোঁটায় কালিমার কালো রং পড়ে এখন সেটা কদাকার কালো।
উপরওয়ালাকে বড্ড বেরসিক ভাবতেন জাহাঙ্গীর চৌধুরি।কিন্তু না,তিনিও রসিক।অতিমাত্রায় রসিক।না হলে জীবনের দারপ্রান্তে এসে এইচ.আই.ভি পজিটিভ হওয়ার মত প্রহসন তার সাথে তিনি কি করে ঘটালেন?
প্রথমটায় খুব বড় একটা ধাক্কা লেগেছিল তার বিবেকের গায়।
রিপোর্ট দেখে মনে প্রশ্ন জেগেছিল,কি করে?
অবশেষে স্মৃতি ধূসর পৃষ্টা ঘেঁটে বেড়ুলো বেশ কয়েক মাস আগে এক প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় একটি দূর্ভাগ্যজনক এক্সিডেন্ট,অতঃপর স্থানীয় সরকারি হাসপাতালে রক্ত গ্রহন।
ভুলটা আসলে কার?কাকে দুষবেন?
জানা নেই।
তবুও উঠে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন।কিন্তু তার অতি প্রিয়জনরাই তার পায়ের নীচের ভূগর্ভস্থ জীবনীশক্তির পাঁতগুলো এক এক করে সরিয়ে নিয়েছে।
বিদ্রুপের গলিত লাভাস্রোতে তাই আরও দ্রুত তলিয়ে গেছেন তিনি।
বোঝাতে যে চাননি তা না,চেয়েছিলেন।
কিন্তু মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে চলার দায়,ছেলের নাক দ্বিখন্ডিত হওয়া,বন্ধু পরিজনদের নাক সিঁটকনো-সবই মোটা ফ্রেমের চশমার ও পাশের চোখ জোড়ার;কর্নিয়া নামক বস্তুটিতে গিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে।
চরিত্র নামক সাদা রুমালটি বিশ্বাসের ডিটারজেন্ট পাউডার দিয়ে যতই পরিষ্কার রাখার প্রয়াশ করুন না কেন।একবার যদি কোন ছুঁতোয় সমাজ বোদ্ধাদের হাতে কলংকের কালো তুলিটি উঠে যায়,তবে তার থেকে আর নিস্তার খূঁজতে যাওয়াটাও নেহায়েত মূর্খতা।
এতে অবশ্য এতো অবাক হওয়ারও কিছু নেই।অনেকেই চায় অপরের শেষ নিঃশ্বাসের পূর্ববর্তি প্রতিটি শ্বাসই দীর্ঘশ্বাসে পরিনত হউক।
তবে তবুও কষ্ট হয়।মমতার ভঙ্গুর আয়নাটায় অবজ্ঞার জুতোর আঘাত পড়লে ব্যথা তো একটু লাগেই।
কি নিপুনতার সাথে-নাতনীকে বুকে জড়িয়ে ধরে রূপকথা শোনানো,ছেলে মেয়েগুলো মুখের হাসি,যোগ্য সম্মানের আশা অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে হাসপাতালের বেডে পড়ে থাকতে থাকতে,বাস্তব থেকে সুখস্বপ্নে পরিনত হয়ে গেছে!
মানুষের ভরসা এতটা ভঙ্গুর?
পৃথিবী মানুষগুলো নাকি আগের চেয়ে ঢের সচেতন হয়ে গেছে।
হবে হয়তো..!
তবে আফসোস্ একটাই আজও এইডস্ আক্রান্ত রোগীরা কুকুরই রয়ে গেল মানুষের কাতারে আর উঠে আসতে পারল না।
মনের আকাশটা আজ ঘোলাটে তাই চোখের বর্ষনটাও ঠেকানো যাচ্ছে না।
শেষপ্রান্তে এসে জীবন নতুন করে নতুন এক রং দেখালো জাহাঙ্গীর সাহেবকে।
অঝোর বর্ষনে যদি নতুন রংটা ধুয়ে মুছে যায়!
ফ্লাইওভারটায় দাড়িয়ে তাই ভিজে চলেছেন তিনি।
ঝাপিয়ে বৃষ্টি নেমেছে,আট দশ হাত দূরূত্বেও কিছু দেখা যাচ্ছে না।
অনেকক্ষন তো হয়ে গেল এখনো একটা গাড়ি ছুটে আসছে না কেন?
শুনেছেন এখানে নাকি গাড়ি গুলো বেশ দ্রুত ছুটে যায়।
এর থেকে হয়তো যে কোন একটা তাকে মুক্তি দিবে।
তাই হাসপালাতাল থেকে অনেক কষ্টে এসেছেন এখানটায়।
জীবনে অনেক কিছু করতে গিয়ে ধাক্কার প্রয়োজন হয়েছে।অবশেষে অসম্মান আর অবজ্ঞার সম্মিলিত ধাক্কাটা না হয় তাকে আত্মহননের দিকেই ঠেলে দিল।
আর যাই হোক,সমাজ তো তথাকথিত একটি বৃদ্ধ কীট থেকে মুক্তি পেল।
ক্ষতি কি..?