অসময়ের ভুল

অসময়ের ভুল
বাসের সিটের পেছনে দেয়া সিট নম্বরগুলো মুছে গেছে। টিকেট হাতে ঘুরছি। হঠাৎ এক পয়তাল্লিশোর্ধ ভদ্রলোক বললেন, “দেখি তোমার টিকেটটা।” আমি টিকেটটা বাড়িয়ে দিলাম। উনি সিট ছেড়ে উঠে আমাকে বসার জায়গা দিতে দিতে বললেন, “তোমার সিট আমার পাশেই, বসে পড়ো। ” বসার প্রায় সাথে সাথেই বাস ছেড়ে দিলো। এবার ভদ্রলোকের প্রশ্নের ফোয়ারা।
– কোথায় যাও? বেড়াতে?
– না, বাড়ি।
– এখানে আসছিলা কেন?
– কাজে।
– তোমার আব্বু আম্মু কি করে?
– দুজনই টিচার।
-আমি তোমাকে এতকিছু জিগ্যেস করি তুমি কিছু জানতে চাও না কেন?
এমন প্রশ্নে বিব্রত হলাম। আমতা আমতা করে বললাম, “না মানে রাস্তাঘাটে কারো সম্পর্কে খুব একটা আগ্রহ দেখাই না। ” উনি হেসে বললেন, তা বেশ। তুমি কোথায় নামবে?” জায়গার নাম বলতেই মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, ” এখনো অনেক দূর। অনেক গল্প করা যাবে!” এমন কথা শুনে আমি হতভম্ব। লোকটার কি ভিমরতিতে ধরেছে নাকি? আমি চুপ করে বসে আছি, উনিও চুপ।
খানিক বাদেই নিজের সেলফোনটা বের করে বললেন, “তুমি আমার ফোনটা ধরো তো!” আমি বেকুবের মত ফোনটা ধরে আছি। উনি মহা উৎসাহে বললেন, “গ্যালারিতে যাও ! ” গ্যালারিতে ছবিতে ভরা। প্রজাপতি, ধানের শীষ, পাখ-পাখালি আরও কত কি! উনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, “সব আমার তোলা!” আমি অবাক হলাম। ছবিগুলো সত্যিই চমৎকার। এত সুন্দর ছবি এই বাচাল গায়ে পড়া লোকটার তোলা ভাবতেই খারাপ লাগল। ফোনটা ফেরত দেয়ার জন্য হাত বাড়ালাম। ভদ্রলোক বললেন, “আরও ছবি আছে, দেখো!” অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটার পর একটা পিক দেখে যাচ্ছি। একটা বাচ্চা মেয়ে স্কুল ড্রেস পড়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ ফসকে প্রশ্ন করে ফেললাম, “ও কাঁদছিল কেন?”
– হাহাহা আর বোলো না। এটা আমার ছোট মেয়ে। সেদিন স্কুলে ওর প্রথম দিন ছিল। ওর ধারনা ছিল স্কুলে গেলেই ওকে ইঞ্জেকশন দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলবে! মেয়ের কান্ড! হাহাহা! আমি ছবি চেঞ্জ করছি। উনি বলে যাচ্ছেন।
– এটা আমার বউ। এই যে ছবিটা দেখছো এদিন ওকে নিয়ে আমি সারা শহর ঘুরে বেরিয়েছি। ওর যে কি আনন্দ হয়েছিল!
এটা? এটা আমার ছেলে। দেখো কি দুষ্টু! বলছি বাবা মুখ সোজা করে দাঁড়াও অথচ সে ভেংচি কেটে ছবি তুলেছে!
এই যে আমার বড় মেয়ে। একদম তোমার মত না? এই যে নীল শাড়ি পড়া ছবিটা দেখছো, এটা আমি ওকে কিনে দিয়েছিলাম। আমার মেয়ের  প্রথম শাড়ি পড়া। কি লাজুক! আমি ফোনটা ফেরত দিতে দিতে বললাম, “আপনার ফ্যামিলিটা অনেক সুন্দর। খুব সুখী মানুষ আপনি! ” ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললেন, “আমার গ্যালারি ভর্তি সুখ। জানো দিনে কতবার যে ছবিগুলোর সাথে কথা বলি! একা একা প্রশ্ন করি, একা একাই উত্তর দেই। কিন্তু যখন অন্য কাউকে ছবি দেখিয়ে ওদের কথা বলি তখন ওদেরকে জীবন্ত মনে হয়। মনে হয় এইতো সবাই আমার পাশে ঘুরঘুর করছে!
– ওদের থেকে অনেক দূরে থাকেন নাকি?
– অনেক দূরে। এপার আর পরপারের দূরত্ব।
– মানে?
– ওরা সবাই একসাথে রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে!
আমি স্তম্ভিত হয়ে থাকি। ভদ্রলোক বলতে থাকেন, “আমার কেউ নেই মা। বাসে, ট্রেনে যেখানে যাই, পাশে যে বসে তার সাথে বকবক করি। জানি বিরক্ত হয়, তবুও করি। আমার পরিবারের ছবি দেখাই, ওরা খানিক সময়ের জন্য জীবন্ত হয়ে ধরা দেয়। জানি তুমিও বিরক্ত হচ্ছো, তবুও করছি। এত কষ্ট নিয়ে বাঁচা যায় না মা। কথা বলব কার সাথে? আমার যে কেউ নেই!” আমার খুব করে বলতে ইচ্ছে করছিল আপনি যত খুশি কথা বলুন, কেউ না শুনুক আমি আপনার সব কথা শুনব। কিন্তু বিরক্তিভরা যে চোখের ছবি তাকে দেখিয়েছি, সে চোখে এখন সহানুভূতি বড্ড বেমানান।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত