আমাদের কোন বোন ছিল না। আম্মার কী শখ ছিল একটা কন্যা সন্তানের! তিনি আমায় আর ভাইয়াকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করতেন,’বলতো বাজান, ঘরের প্রদীপ কে? পুত্র সন্তান না কন্যা সন্তান?’ আমরা খানিক ভাবতাম। তারপর লোক মুখে শুনে আসা সহজ কথাটাই বলতাম। ‘পুত্র সন্তান।’ আম্মা তখন হেসে ফেলতেন। হেসে বলতেন,’ছেলে সন্তান ঘরের প্রদীপ নারে বাজান। ঘরের প্রদীপ হইলো কন্যা সন্তান।যেই ঘরে কন্যা সন্তান নাই সেই ঘর থাকে থমথইম্যা।আন্ধাইর। মনে হয় এইটা বুঝি ভূতের বাড়ি।গোরস্হান।’ আমরা তখন অবাক হয়ে আম্মার দিকে তাকাতাম।আর ভাবতাম আম্মা তো সত্যিই বলেছেন। আমাদের বাড়িটা কী থমথমে।রিনরিনে গলার কোন হাসি নাই,রাগ করার কিংবা আহ্লাদী আবদার করার মতো কেউ নাই আমাদের ঘরে। আহারে! আমাদের যদি একটা বোন থাকতো।
আম্মার তখন অনেক বয়স হয়েছে। আব্বা মারা গেছেন সেই কবে। ভাইয়ার বয়স এখন বিশ।আর আমার সতেরো। আম্মা হঠাৎ এক রাতে আমাদের দু ‘ভাইকে ডাকলেন। তারপর বললেন,’বাজানেরা আমার,এই ভূতের বাড়ি আর সহ্য হয় না আমার। আমি এই বাড়িটারে নাইচ মহল বানাইতে চাই। বাড়িতে কন্যা সন্তান আনবার চাই। আমার বড় পুত্র আনোয়াররে অতি শীঘ্রই বিয়া করাইবো আমি।তার জন্য ঘরে আনবো লক্ষ্মী একটা বউ। সেই বউয়ের দু’ পায়ে থাকবো রুপার নূপুর।বউ আমার খালি সারাদিন ঘরে আর উঠোনে হাঁটাহাঁটি করবো,দৌড়াইবো, হাসবো,গায়বো।সারা বাড়িটারে কানাই কানাই ভরাইয়া রাখবো।’ আম্মার কথা শুনে ভাইয়া খুব লজ্জা পায়। এবং মুচকি হেসে ওখান থেকে উঠে ঘরের দিকে চলে যায়। কিন্তু আমি বসে থাকি। আম্মার দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকি তার ভেতরের হাহাকার গুলো। আমার তখন কেবল মনে হতে থাকে তার নিজের কন্যা সন্তান হয়নি বলে তার ভেতর কতটা জখম।হয়তো ঘরে পুত্রবধূ এনে সেই জখম দূর করতে চাইছেন তিনি।
ভাইয়ার জন্য বউ আনা হয়েছে ঘরে। সেই বউকে আম্মা তার জীবনের সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে সাজিয়েছেন। গয়নাগাটি,দামী শাড়ি চুড়ি কোন কিছুর অভাব রাখেননি। এবং প্রথম দিন যখন ভাবীকে আনা হলো আমাদের বাড়িতে সেদিন রাতেই আম্মা ভাবীকে বললেন,’শেফালি, আমি কিন্তু মা তোমারে তুমি তুমি কইরা কখনো ডাকবো না। আমি ডাকবো তুই তুকারি কইরা। কারণ তোমারে আমি পুত্রবধূর মতো দেখবো না। আমি তোমারে দেখবো আমার ঘরের মাইয়ার মতন।’ ভাবীও সেদিন আম্মার আঁচল টেনে ধরে বলেছিলেন,’আপনাকেও আমি মায়ের মতো দেখবো।’
কিন্তু না ভাবী আম্মাকে মায়ের মতো দেখতে পারেননি। তিনি হলেন অসম্ভব বদ মেজাজি আর বদ স্বভাবের মহিলা। এই যে আম্মা তাকে অত গয়নাগাটি দিলেন সেইসব কিছু বিয়ের কদিন পরেই তিনি বিক্রি করে দিলেন। এবং এর যতো টাকা সবকিছু তার বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন গরীব মানুষদের কাছে যেন এইসব টাকা সুদে ঋণ দেয় তার ভাইয়েরা। আর ভাইয়াও কীভাবে যেন তার হাতের পুতুলে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। এখন আর ভাইয়া আম্মার কথা শুনে না।সে শুনে ভাবীর কথা। কিন্তু আম্মাকে আমি এ নিয়ে দুঃখ করতে দেখি না। মানুষ যদি কখনো তার কাছে জিজ্ঞেস করে,’ও বুজি, আপনের ছেলের বউ কেমন গো? আচার আচরণ তার কেমন?’ আম্মা তখন হেসে বলেন,’আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর শুকর।এমন লক্ষ্মী বউ লাখে মিলে না!’
কিন্তু বাস্তবতা হলো সেই লক্ষ্মী বউ ভুলেও কোনদিন আম্মার পাতে এক মুঠো ভাত তুলে দেয় না। চুলোয় গিয়ে ভাত শালুনের হাঁড়ি পাতিল চড়ায় না। সবকিছু অসুস্থ শরীর নিয়ে আম্মাই করেন। আমার যে তখন কী খারাপ লাগে! আম্মার কাছে গিয়ে তখন আমি তার হাতের কাজ কেড়ে নিতে চাই। কিন্তু আম্মা সেই কাজ ছাড়তে চান না। তিনি বলেন,’এইসব কাজ কী পুরুষ মাইনষের কাজ রে সানোয়ার? এইসব কাজ হইলো মাইয়া লোকের।’ mআমি তখন রাগী গলায় বলি,’মাইয়া মানুষ তো আনলাই দেখলাম, নবাবের বেটি!’ আম্মা তখন ধমক দেন আমায়। বলেন,’বড় ভাইয়ের বউ হইলো নিজের বড় বোনের সামিল।বড় বোনরে কী কেউ এমনে কথা বলে বেকুব? তাছাড়া আমার নিজের মেয়ে যদি থাকতো,সে যদি ঘরের কাম কাজ না করতো তখন তো আমারই করতে হয়তো কাম কাজ।বউমা তো অত বুঝে না।বয়স অল্প । যখন বুঝবো তখন দেখবি ঠিকই কাজ করবো।’
কিন্তু আম্মার এই স্বপ্ন অত সহজে পূরণ হয় না।ভাবী দিন দিন আরো অহংকারী হয়।আর আম্মার সাথে তার ব্যাবহার হতে থাকে আরো কদর্যময়। মাঝেমধ্যে আমি ভাবতে থাকি,একটা বৃদ্ধ মহিলা তাকে নিজের মেয়ের মতো আগলে রাখতে চাইছে আর সে নিজেকে কীভাবে গুটিয়ে নিচ্ছে দূরে।যেন আম্মার সত্যিই মেয়ে ভাগ্য নাই।থাকলে তো অনেক আগেই নিজের ঘর আলো করেই পেট থেকে বেরিয়ে আসতো মেয়ে সন্তান। আগে যেহেতু আসেনি এখন কী আর অন্যের মেয়ে তাকে নিজের মার মতো দেখবে! কিন্তু এ নিয়ে আম্মাকে একটুও কষ্ট পেতে দেখি না।এমনকি নিজের বড় ছেলেটাও যে তাকে দিব্যি ভুলে বসেছে এর জন্যও দু্ঃখ করেন না তিনি। আমি তার ধৈর্য্য দেখি। সীমাহীন ধৈর্য্য। মাঝেমধ্যে আমার খুব কান্না পায়। আমার নিজের জন্য নয়। আম্মার জন্য আম্মার আঁচলে ডুবে থেকে ঢুকরে কেঁদে উঠি। আম্মা তখন আমায় সান্ত্বনা দেন। আমার কপালে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন,’নিয়তির সাথে লড়াই করন যায় না রে বাজান। নিয়তির মালিক আল্লাহ পাক।’
সময় যেতে থাকে তার নিজের মতো করে।আর আমাদের সময় কাটে দুঃখে,কষ্টে।ভাবীর গহনা বেঁচা টাকার সুদ বেড়ে টাকার পাহাড় হয়। সেই টাকায় তার ভাইয়েরা জমি কিনে,গরু-ছাগল কিনে।এর মাঝে হঠাৎ একদিন ভাবীর বাবা মারা যান।এর কদিন পর তার মাও। তারপর হঠাৎ করে ভাইয়ার একটা এক্সিডেন্ট হয়। মোটরসাইকেলের সাথে একটা অটো রিকশার সংঘর্ষে তার বাঁ পাটা হারাতে হয়। ঠিক এই সময় ভাবী একটা কান্ড করে।পঙ্গু স্বামীর ঘর করবে না বলে আমাদের বাড়ি ছেড়ে সে বাপের বাড়ি চলে যায়। ভাইয়া পড়ে বিপদের অথৈ সাগরে। কিন্তু পৃথিবীতে যার মা আছে তার আবার কিসের বিপদ!আম্মা ভাইয়াকে বুকে আগলে নেন।মমতায় ভুলিয়ে দেন তার সব শোক, বিস্বাদ।
আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়ে ভাবী মস্ত ভুল করেছে। কারণ সে জানতো না তার বাবার অনুপস্থিতিতে তার ভাইগুলো নিজেদের স্ত্রীদের খেলার পুতুল হয়ে গেছে। স্ত্রীদের ইশারায় তারা ভাবীর সকল অর্থবিত্ত নিজেদের নামে করে নিয়েছে। আর ভাবীকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।তার বড় ভাই তো সোজাসাপ্টা বলেই দিলো,’নিজের জামাইরে খাইয়া এখন আসছস আমাদেরকে ফতুর করতে। সেই সুযোগ তোরে দেওয়া হইবো না। খারাপ মানুষের কোথাও জায়গা নাই।তোরে এই বাড়িত রাইখা বাড়িটারে আমরা ধ্বংস করতে দিতে পারি না।’
এমন দুঃস্বময়ে ভাবীর সত্যিই কোথাও যাওয়ার ছিল না।মাথায় তার আকাশ ভেঙ্গে পড়ে তখন। কিন্তু সে জানতো আমার মা কতটা উদার। অবশেষে সে এসে আমার মায়ের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে।আম্মা তাকে আগলে নেন বুকের ভেতর। কিন্তু ভাইয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারে না তাকে।বলে,’এ পাপিষ্ঠা।একে এই বাড়িতে ঠাঁয় দেয়া যাবে না।’
কিন্তু আম্মা যে অসম্ভব মায়াবতী।ভাবী যখন হাউমাউ করে কেঁদে উঠে তখন আম্মার চোখেও জল আসে। আম্মা তখন ভাবীকে বুকে টেনে নিয়ে বলেন,’সব হইলো নিয়তিরে মা।সব হইলো নিয়তি। এইখানে মানুষের কোন হাত নাই।’ ভাবী তখন আম্মার পায়ে পড়ে যায়। কেঁদেকেটে ক্ষমা চায়।বলে,’আপনি আমার মা। আমার সত্যিকারের মা।’ আম্মা তখন ভাইয়াকে বলেন,’কেউ অন্ধকার থেকে আলোর পথে আসতে চাইলে তারে আলো দিতে হয়।না দিলে পাপ হয় আনোয়ার।’
ভাইয়া কিছু বলতে চেয়েও আর বলতে পারে না তখন। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। কেন কাঁদে কে জানে! কিন্তু আমার কান্না আসে না। আমার কেবল মনে পড়তে থাকে আম্মার ধৈর্যের কথা।আর মনে পড়ে অহংকারের পর যে পতন আসে সেই পতনের কথা।আর আমি তখন মনে মনে বিরবির করে বলি,’হে আল্লাহ, তুমি আমায় অহংকারীদের দলে অন্তর্ভুক্ত করো না। মায়ের পায়ের নিচ থেকে তুলে নিও না।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক