ওরা দরজার খিল লাগাতে ভুলে গেয়িছিল অথবা ভাবতেই পারেনি আমার হঠাৎ শরীর খারাপ করবে আর তাই আমি ডাক্তারের কাছে না গিয়ে বাসায় ফিরে আসবো এক ঘন্টার ভেতর।আর এসেই দরজায় টোকা না দিয়ে দরজায় ধাক্কা দিয়ে সোজা ঘরে প্রবেশ করবো!
এভাবে ঘরে প্রবেশ না করাই বোধহয় আমার জন্য ভালো ছিল। ছিঃ! এমন ভয়ানক কিংবা ঘৃণ্য দৃশ্য তো তখন আর দেখতে হতো না আমায়! আমার খুব বমি পাচ্ছে এখন। বিশ্বাস করুন, আপনার স্বামীও যদি আপনার প্র্যাগন্যান্সির সময় আপনার কোন কাজিনের সাথে শারীরিক সম্পর্কে নিবদ্ধ অবস্থায় আপনার চোখে পড়ে তখন আপনার কেমন লাগবে?
আমি এক ঘন্টা আগেও বিশ্বাস করতাম পৃথিবীতে আমার স্বামীর মতো লক্ষ্মী আরেকটি স্বামীও নেই।আজ আমার পেটের বাবুটার বয়স পাঁচ মাস সাতদিন। কদিন যাবৎ আমার ভালো ঘুম হচ্ছে না। শরীর দূর্বল লাগছে। কিছু খেতে টেতে পারছি না।মাথাও ধরে মাঝেমধ্যে।তাই রাতেই আমার স্বামী বাদল বললো,’কাল সকালেই তোমায় নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো।’ কিন্তু কী দূর্ভাগ্য! সকাল বেলা তার পেটে অসম্ভব ব্যথা।অসুধ খেয়েছে কিন্তু সারছে না। তবুও সে আমায় নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবে। আমি বললাম,’তোমার শরীর খারাপ। বিশ্রাম নেও। আমি একাই যেতে পারবো। বরং জুই বাসায় থাকুক। তোমার শরীর কখন কী হয় কে জানে!’
বাদল বললো,’এ তো সামান্য পেট ব্যথা। আমার মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও আমি তোমার হাত ধরে হাঁটতে পারবো।’
বাদল কতো ভালোবাসে আমায়!সকালে যখন একা একা ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঘরে শুইয়ে রেখে বের হচ্ছিলাম তখন বারবার আমার চোখ ভিজে উঠেছিল। বারবার কেবল মনে হচ্ছিল, পৃথিবীতে এমন লক্ষ্মী স্বামী আর কার আছে?
আর আমার বোনটাও কত ভালোবাসে আমায়। আমার জন্য কত মায়া তার। গতরাতে যখন সে আমার সাথে বিছানায় ঘুমুতে গেল তখন সে আমার গায়ে হাত রেখে বলল,’বুবু, আমার না খুব ভয় হয় তোমায় নিয়ে!’
আমি চমকে উঠে বললাম,’কী ভয় হয়?’ ‘বাচ্চা প্রসবের সময়টা খুব জটিল। মানুষ থাকে জন্ম মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে তখন। তোমরা ছাড়া তো আমার আর কেউ নাই!’
জুই প্রায় কেঁদেই ফেললো। আমি বললাম,’কাঁদে না বোন আমার কাঁদে না।এসব কোন ব্যাপার না এখন। আল্লাহ সহজ করে দিবেন।’ জুই তখন হাসলো। হেসে বললো,’তাই যেন হয় বুবু।’ এই জুই আমার ছোট খালার মেয়ে। ছোট খালা মারা যান জুইয়ের আট বছর বয়সে।তার বাবা এর আগেই গত হয়েছিলেন। খালার মৃত্যুর পর থেকেই জুই থাকতো আমার বাবা মার সাথে। প্র্যাগনেন্সির সময়গুলোতে একটা মেয়ের চলতে ফিরতে, ঘরের কাজ কর্ম করতে অনেক কষ্ট হয়। এই জন্য মা আমাদের বাসায় জুইকে পাঠিয়েছিলেন আমার কাজে সাহায্য করতে। কিন্তু আজ যা চোখে পড়লো এরচেয়ে বড় সাহায্য আর কীইবা হতে পারে আমার জন্য ওর!
আমার খুব ইচ্ছে করছিল বাদলের গায়ে একদলা থুথু ছিটিয়ে ফেলতে।জুইকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে এ বাড়ি থেকে বের করে দিতেও ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু তা আর করা হলো না। আমার তখন মনে হলো বাদলের গায়ে থুথু ফেললে বাদলকে আমার থুথুর চেয়েও বড় মনে করা হবে। আর জুঁইকে এ বাড়ি থেকে আমি কোন অধিকারে বের করে দিবো?এ বাড়ি কী আমার!
সেদিন খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। আমার মনে হলো আমি কিছুতেই আমার পেটের সন্তানকে এমন নিকৃষ্ট কোন পিতা উপহার দিতে চাই না। আমি চাই না আমার সন্তান তার পবিত্র চোখ দিয়ে এমন পাপী কোন পিতাকে দেখুক।তাই সেদিনই বাসা থেকে বের হয়ে বাবার বাড়ি চলে এলাম আমি। যদিও বাদল আমায় সরি বলেছিল,জুই এসে পায়ে পড়েছিল। কিন্তু এসব কিছুই আমার মন গলাতে পারেনি সেদিন। কারণ প্রত্যেকটি নারীই তার স্বামীকে দেখতে চায় পবিত্র রুপে। আমিও চেয়েছিলাম এমন। যতদিন তাকে পবিত্র জানতাম ততদিন তার সাথে ছিলাম আমি। এখন আর তার সাথে থেকে নিজেকে অপবিত্র করার কোন ইচ্ছাই আমার নাই। তারচেয়ে বাদলকে সুযোগ করে দেয়ায় ভালো। আমার অনুপস্থিতিতে সে জুঁইয়ের সাথে একান্ত নিরিবিলি সময় কাটাক।পারলে সংসার করুক।
হ্যা,সংসারই পেতেছিল বাদলের সাথে জুই। আর আমি আমার সন্তান প্রসবের পর সন্তান নিয়ে চলে গিয়েছিলাম বাড়ি থেকে অনেক দূরে। আমার ছেলে সন্তান হয়েছিল। তাকে নিয়েই আমার স্বপ্ন সাজিয়েছিলাম নতুন করে। ভেবেছিলাম আর কোনদিন বাদল কিংবা জুই আমার চোখের সামনে পরবে না। কিন্তু ওদের সংসারের তিন বছর পর পত্রিকার একটা নিউজের শিরোনাম পড়ে আমি চমকে উঠলাম। ‘কাজের মেয়ের সাথে অনৈতিক সম্পর্ক থাকায় স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন। স্ত্রী এখন কারাগারে।’ তারপর ছবি দেখে আমার গা শিউরে উঠলো। শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো কেমন! কারণ ওই স্বামী স্ত্রী দুজনকেই আমি চিনি। ওদের একজন আমার প্রাক্তন স্বামী বাদল আর অন্যজন আমার ছোট খালার মেয়ে জুই।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক