একজন কারাবন্দির আত্মকথা

একজন কারাবন্দির আত্মকথা

আজ রাতটা পেরোলেই আমার মুক্তি,এরপর থেকে আমি স্বাধীন।আমার কারা জিবনের অবসান ঘটতে আর মাত্র একটি রাত।আগামীকালের সূর্যটাই হবে আমার চৌদ্দ

বছর কারা জিবন অবসানের সূর্য,অপেক্ষা করছি নতুন একটি সূর্যদয়ের,নতুন একটি প্রভাতের,নতুন একটি দিনের।

মুক্তির অদম্য আনন্দে ও উত্তেজনায় আমার ঘুম আসছে না,চার দেয়ালের অন্ধকার কারাগারে শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছি।খুব করে ভাবছি অতীতের দিনগুলির কথা।
উহ!!মুক্তি!!!কি যে আনন্দ!?
মুক্তির আনন্দ একমাত্র সেই বুঝে যে আবদ্ধ অবস্থায় আছে,মুক্ত জিবনে এমন মুক্তির আনন্দ উপলব্দি করা অসম্ভব।
খুব মনে পড়ছে চৌদ্দ বছর আগের দিনগুলির কথা,আরো খুব মনে পড়ছে নেহার কথা,,নেহা নেহা নেহা।শুধুই নেহা,যার কারণে আমি কারাগারে,সেই নেহাটাকে খুব মনে পড়ছে।
চোখ দু’টি বুজে অতীতের স্মৃতিচারণ করতে লাগলাম,আজ থেকে চৌদ্দ বছর আগের স্মৃতি।
,
ফিরে দেখা চৌদ্দ বছর আগে,,,
গ্রামের দুরন্ত কিশোরি নেহা,চঞ্চল একটা মেয়ে।রুপে গুনে তার মতো মেয়ে পাঁচগ্রাম ঘুরে একটাও পাওয়া যাবে না।সেই নেহার সাথেই আমার সমন্ধ ঠিক হয়ে আছে ছোটবেলা থেকেই।
তাই তার সাথে আমার বেশ ভাব ছিল।প্রতিদিন সকালে সাইকেলে করে তাকে স্কুলে নিয়ে যেতাম এবং প্রতিদিন বিকালে তাকে সাইকেলে করে বাড়ি আনতাম।সবাই

আমাদের ব্যাপারে জানতো,তাই কেউ কিছু বলতো না।নেহা অনেক সুন্দর ছিলো বলে তার প্রতি অনেকেরই কুনজর ছিল।তাই তাকে সাবধানে চলাফেরা করতে হতো।
,
একদিন আমি এক আত্মীয় বাড়িতে চলে গিয়েছিলাম অগত্যা সেদিন নেহা কে একা একাই স্কুলে যেতে হয়েছিল।কিন্তু নেহা যা স্কুলে গেছে আর ফিরে না।বিকেল গড়িয়ে

সন্ধ্যা হয়,সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয় তবুও নেহার কোনো হদিস মিলে না।স্কুলের মাষ্টার কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন,”নেহা তো বিকেলে চলে গিয়েছে,”তাই সেদিন রাতে

তার বাবা তার সমস্ত আত্মীয় বাড়ি ও নেহার বান্ধবীদের বাড়িতে খোজ করেন।কিন্তু কেউ নেহার খোজ দিতে পারে না।পরদিন আমি বাড়ি ফিরে একথা শুনার পর নেহাকে অনেক জায়গায় খুজে বেড়িয়েছি কিন্তু কোথাও পাইনি।
,
তিন দিন পর নেহা যখন বাড়ি ফিরল তাকে খুব নার্ভাস দেখাচ্ছিল,তার এমন অবস্থায় সবাই চিন্তিত।তাকে দেখে সবাই বুঝতে পারে যে তাকে ধষর্ণ করা হয়েছে।গ্রামে

একটি অপবাদ রটে যায়।সবাই দলে দলে তাকে দেখতে আসে।নেহা কে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে,সে কিছুই বলে না,একটা আতংক তার চেহারায় বিরাজ করে।

আমি বিষয়টি বুঝতে পেরে অনেক বুঝিয়ে,কৌশল খাটিয়ে তার কাছে শুনেছি কে তাকে ধষর্ণ করেছে,সে তিন জনের নাম বলেছিল,আমাদের এলাকার চেয়ারম্যানের

ছেলে “আতিক ও তার দুই বন্ধু মিলে তাকে একটি ঘরে আটকে রেখে তিন দিন ধরে পালাক্রমে ধষর্ণ করেছে।”
চেয়ারম্যানের বখাটে ছেলে তাকে ধষর্ণ করেছে,বিচার পাবো কার কাছে?
তাই এ বিষয়টি তার পরিবার ভুলে যেতে লাগলো,কারণ তারা ততটা প্রভাবশালী ছিল না যে এর বিচার পাবে।কিন্তু গ্রামের মানুষ এ বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন রকম কটুক্তি করতে থাকে।মানুষের অপবাদ সহ্য না করতে পেরে নেহা গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে।
,
এই ঘটনার এক বছর পর সবাই বিষয়টি ভুলে গেলেও আমি ভুলে যাই নি।আমি অপেক্ষা করছিলাম কখন সুযোগ পাব,কখন এই ধষর্কদের উপযুক্ত শাস্তি দেব।অবশেষে একদিন আমি উপযুক্ত সুযোগ পেলাম।
.
নির্বাচনের আর মাত্র কয়েকদিন বাকি,চেয়ারম্যান বাড়িতে জনগণের জামাই আদর চলছে।দলে দলে লোকেরা চেয়ারম্যান বাড়িতে যাচ্ছে আর মিষ্টি,জিলাপি,বিড়ি

সিগারেট,চা,পান ইত্যাদি খেয়ে আসতেছে আর পোটলা পুরে নিয়ে আসতেছে।আমিও একদিন রাতে চেয়ারম্যান বাড়িতে গেলাম।

তখন রাত দু টা বাজে,গ্রামে নির্বাচনের সময় রাত দু টো কোনো ব্যাপারই ছিল না।সাধারণ জনগনের মতো চেয়ারম্যান বাড়িতে বসে বসে একটার পর একটা সিগারেট

শেষ করছিলাম আর অপেক্ষা করছিলাম কখন চেয়ারম্যানের ছেলেকে মারা যায়,অবশেষে সুযোগ পেয়েও গেলাম।
,
চেয়ারম্যানের কর্মীরা ও তার ছেলে সবাইকে বিদায় করে ঘুমোতে গেছে।তখন আমি চুপি চুপি চেয়ারম্যানের ছেলের দরজায় টোকা দিলাম।সে ঘুমঘুম ভাব নিয়ে দরজা

খোলার পর আমি সরাসরি তার রুমে ঢুকে গেলাম।সে জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালে,আমি লুকিয়ে রাখা চকচকে ছোরাটা বের করলাম।এরপর সে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
–কি চাও?
–তোর প্রাণ?
–মানে?
–মনে পড়ে নেহার কথা?যাকে তোরা ধষর্ণ করেছিলি!
–আমাকে মাফ করো ভাই,যত টাকা চাও আমি দেব।
–চুপ হারামি
,
এই বলে তার গলায় একটা কোপ দিলাম,সাথে সাথে সে মাটিতে পড়ে হাত পা ছোড়াছোড়ি করতে লাগল,তার গলা দিয়ে ঘড়গড় আওয়াজ বেরুতে লাগল,সমস্ত মেঝো

গরম রক্তের স্রোতে ভেসে যেতে লাগল।আমি একটা ঠোট বাকা করে হাসি দিয়ে যেই না দরজায় পা ফেলেছি তখনই কে যেন একটা চিঁৎকার দিয়ে পেছন থেকে আমাকে জাপটে ধরল।
এরপর চারপাশের ঘুমিয়ে থাকা মানুষগুলো উঠে এসে আমাকে ধরে ফেলল।এরপর যা হবার তাই হলো।পরদিন সকালে পুলিশ আসলো,আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেলো।
এরপর?
এরপর আর কি?
খুনের অপরাধে চৌদ্দ বছর কারাদন্ডে দন্ডিত হলাম।সেই থেকে জেলেই আছি,
,
এতক্ষণ অন্ধকার জেলের কামরায় শুয়ে শুয়ে এসবই ভাবছিলাম,ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই।

ঘুম ভেঙ্গে চোখ খুলে দেখি সকাল হয়ে গেছে,তার মানে আজ থেকে আমার মুক্তি হবে।তাই সব কারাবন্দিদের কাছ থেকে বিদায় নিতে লাগলাম,কিছুক্ষণ পর একজন

পুলিশ এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল জেল সুপারের কাছে।তিনি আমাকে কয়েকটি উপদেশ দিলেন অবশেষে আমার স্বাক্ষর নিয়ে আমাকে বিদায় দিলেন।
,
চৌদ্দ বছর পর কারা মুক্তির আনন্দে একটি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বাইরে এলাম।
বাইরে বেড়িয়ে সর্বপ্রথম যে পরিচিত মানুষটি চোখে পড়ল তিনি হলেন আমার বাবা।আমাকে নিয়ে যেতেই তিনি এসেছেন।
আমাকে দেখে বাবা তো মহাখুশি,মনে হচ্ছে তিনি এখনই বাচ্চা ছেলের মত ভ্যা ভ্যা করে কেদে দিবে,খুশিতে তার চোখ দুটো চিকচিক করে উঠলো,দৌড়ে গিয়ে বাবার পায়ে সালাম করে জাপটে ধরলাম,
বাবার অলক্ষ্যে কয়েক ফোটা আনন্দ অশ্রু মুছলাম,কিছুক্ষণ পর আমার অনুভব করলাম আমার ঘাড়ে যেন গরম জল পড়ছে,বুঝতে পারলাম বাবা কাদছে,বাবা ছেলের

এমন মিলনের দৃশ্যে চারপাশের মানুষ হা হয়ে তাকিয়ে আছে।অতঃপর বাবার সাথে কিছু কথা বলার পর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম,বাবা আমার গা ঘেষে বসেছে।হয়তো বহুদিন পর কাছে পেয়েছে তাই গা ঘেষে বসেছে।
,
অবশেষে গ্রামে পৌছে গেলাম তখন রাত ঘনিয়ে এসেছে,গ্রামের সবকিছু অচেনা লাগছিল,প্রাইমারি স্কুলটি আগের চেয়ে বড় হয়েছে,মসজিদটি দোতলা হয়েছে আরো

অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছিল।আমাদের বাড়িটিও আর আগের মত নেই।আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে বাবার পিছে পিছে বাড়িতে গেলাম।মা আমাকে দেখা মাত্রই জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেদে উঠলেন।মার কান্নার আওয়াজ শুনে পাড়া প্রতিবেশীরা চলে এলেন।
তারা আমাকে দেখে সবাই অবাকই হলেন।আমি কত বড় হয়ে গেছি!!!সেই বিশ বছর বয়ছে জেলে গিয়েছি আজ আমার বয়স চৌত্রিশ।মাঝখানে চৌদ্দ বছর আমাকে

অনেক বদলে দিয়েছে।তবে আমার নতুন করে বাচার কোনো ইচ্ছে নেই,যেমন আছি তেমনই থাকব।কারণ জিবনে একজনকেই ভালোবেসে ছিলাম,আমার মনে একজনকেই জায়গা দিয়েছি,সেখানে আর কারো জায়গা নেই।আমার মনে শুধু একটি মেয়েরই নাম লেখা থাকবে “নেহা”।
,
পরদিন সকালে নেহার কবরের সামনে দাড়িয়ে মনে মনে বলতে লাগলাম,

“অপেক্ষা করো নেহা,আমিও আসব তোমার কাছে কোনো একদিন।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত