আমি তিন ছেলের মা। সন্তান না বলে ছেলে বললাম কেন? ছেলের মা হতে গেলে নাকী ভাগ্য লাগে। আমার প্রথম সন্তান পিয়াস হবার পর ওর দাদি মানে আমার শাশুড়ী মা এমন টাই বলেছিলেন। বড় জায়ের দুই মেয়ে, মেজ জায়ের সন্তান নেই। বিয়ের এক বছরের মাথায় আমি পুত্র সন্তানের মা হলাম। বাড়ীতে হুলুস্থুল পড়ে গেল। আমার শাশুড়ী মা তার পৌত্রকে পেয়ে যেন জীবনের সবচাইতে মূল্যবান সম্পদ পেলেন। মা হবার আনন্দের চাইতেও উনার আনন্দ দেখে আমার চোখে জল এল। উনি আমার কান্না দেখে অবাক হয়ে বললেন, ও বৌমা কান্দ ক্যান তুমি খুশী হওনাই? আমি স্মিত হেসে মাথা নাড়লাম বললাম,আপনি কাঁদছেন যে! লজ্জা পেয়ে উনি চোখ মুছে বললেন,আনন্দে কান্দি গো বউ ভাবছিলাম বংশ রক্ষা মনে হয় হইবনা কপালটা বোধয় আমার এমনই। কিন্তু তুুমি আমারে অন্যদের মত নিরাশ করনাই।
এ কথা শুনে আমার বড় জা মুখ মলিন করে ছোট মেয়েটাকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, বিনা অপরাধেই বেচারী কষ্ট পায়। তার কি দোষ কন্যা সন্তান তো আর সে নিজে চেয়ে আনেনাই আর আনলেই বা কি? কি ফুটফুটে পরীর মত দুইটা মেয়ে তার সারাক্ষন বাড়িটা মাথায় করে রাখে। মেজ জা সপ্তাহ খানেক হল বাবার বাড়ী চলে গিয়েছে। কি জানি তাকে আবার কি শুনতে হত, আমার মেজ ভাসুর ভীষন ভাল মানুষ। নিঃসন্তান হওয়ায় নানান মানুষের নানান কথাকে উপেক্ষা করেও ভাবীকে পরম ভালবাসায় আগলে রেখেছেন এখনো। পিয়াসআমার বড় ছেলে,ও হবার পর ওর দাদা ভাই গরু জবাই দিল, বাড়ী বাড়ী মিষ্টি পাঠাল। যেন উৎসব লেগেছে বাড়ীতে। আমার ফুফু শাশুড়ী এসে বললেন, মিয়া ভাই তোমার আর চিন্তা নাই গো দেখ রাজপুত্তর আইসা পড়ছে। দ্যাখতেও তোমার মতই হইছে। হাইট্টা গেলে ব্যাবাক লোকে ফিরা তাকাইব। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বৌমা বয়স কালে তোমারে দেখার মানুষ চইলা আইছে।
যদিও পিয়াসের বাবা আর আমি একটা সুস্থ সন্তান পেয়েই খুশী ছিলাম। তবুও সবার কথায় কখনো কখনো আমার মনের ভেতরও সুর বাজতো আমি পুত্র সন্তানের মা! পিয়াস হবার দু বছর পর পলক এল, তার তিন বছরের মাথায় পাপন। পিয়াস এর দুষ্টুমী ছিল চরমে। দাদু বাড়ীর সবার আদরে আদরে যেন বাদর হয়ে উঠছিল ছেলেটা। কিছুই বলা যেতনা ছেলেকে, জোর করে খাওয়াতে পারতামনা কান্না করলেই শাশুড়ী মা কোলে নিয়ে চলে যেতেন,দুষ্টুমী করলে বকা দিয়েছি তো আমার শশুর মশাই সহ বাকীরা যেন আমাকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাতো। প্রয়োজন ছাড়া ছেলেটাকে কাছে পেতাম কম বাড়ী ভর্তি মানুষ সারাক্ষন কারো না কারো কোলে সে আছেই। তাতে অবশ্য আমি একটু ফুসরত পেতাম জিরাবার।
পলক হবার বছর খানেকের ভেতর ওর বাবা বদলী হয়ে গেল যশোর। তিনি আমাদের কে ছেড়ে এতদূরে একা থাতে চাইলেননা। ছেলের কথা ভেবে আমার শশুর শাশুড়ী সম্মতি দিলে।আমাদের কে যেতে হল। সেদিন পিয়াস, পলক কে নিয়ে ও বাড়ী থেকে চলে আসা টা এত সহজ ছিলনা। বাড়ীতে যেন শোক বয়ে গেল। কথা দিতে হল প্রতি মাসেই যাব। প্রথম প্রথম তিন মাসে একবার এরপর ছ’মাসে, একটা সময় সেটা বছরে একবার হয়ে গেল। পাপন যখন পেটে তখন বড় দুটোকে সামলাতে গিয়েই হিমশিম খেতাম। কোন কথাই শুনতোনা তারা আমার। এটা ফেলছে তো ওটা ভাংছে, এখন খাবেনা, ওটা খাবেনা,স্কুল যাবেনা… আমার তখন পাগোল প্রায় অবস্থা। হাইস্কুলে ওঠার পর থেকে এসব কমলেও ঠিকমত পড়াশোনা করছে কিনা,কাদের সাথে মিশছে, ওদেরকে ঠিকঠাক মানুষ করতে পারছি কিনা এমন নানান চিন্তায় আমার ঘুম হতনা। শুধু ভাবতাম ওরা কবে বড় হবে। আমিও একটু অবসর পাব।
নিশ্চিন্তে ঘুম দিব, পছন্দের গান শুনব, বই পড়ব, ওর বাবা আর আমি দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে বেড়াব আস্তে আস্তে ওরা বেড়ে উঠতে লাগল। সেই সাথে আমার নিঃসংগতা বাড়তে থাকল। ওরা যে যার ভার্সিটি, চাকরী নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। চাইলেও ওদেরকে ধরে রাখতে পারিনা ওদেরকে যে বড় হতে হবে। আর আমি সারাদিন বাড়ীতে একা। ছুটা বুয়া সব গুছিয়ে দিয়ে যায় আমি শুধু রান্নাটা করি।প্রেশার, ডায়াবেটিস সব বাঁধিয়ে ফেললাম। এদিকে সারা রাত ঠিক মত ঘুম না। কোন চিন্তা নাই, তাড়া নাই তবুও শুলেই আর আগের মত ঘুম পায়না। প্রিয় বই খুলে বসলেও পড়ার ধৈর্য্য থাকেনা এদিকে চোখ দুটো ও আর ভালো সাপোর্ট দেয়না।
পিয়াস এর বিয়ে দিলাম। বৌ আসল বাড়ীতে। বেশ কাটছিল দিনগুলো। পিয়াস আর মৌ এর হানিমুনে ওরা আমাদেকে নিয়ে যাবে বলে বায়না ধরল, তা কি হয়? ছেলে মেয়ে গুলা এত বোকা না, তাছাড়া আমার হাঁটুতে ব্যথা ওর বাবার হাঁপানি, শীতের ভেতর বের হয়ে আরেকটা ঝমেলা বাড়াবো ওদের। পাঠিয়ে দিলাম পিয়াস কে আর মৌকে। মৌ খুব মিষ্টি মেয়ে কিন্তু একটু গম্ভীর। একমাত্র সন্তান হওয়ায় একা থাকতে থাকতে মেয়েটা বোধয় কম কথা বলে অভ্যস্ত। ছ’ মাসের মাথায় পিয়াস স্কলারশিপ পেয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে গেল মৌকেও নিয়ে গেল। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয় মাত্র। পলকের পোস্টং ছিল চিটাগাং ও ও সংসার পাতল সেখানে। মাঝে মাঝে ফোন দিতাম কথা হত৷ ছুটিতে বাড়ী আসত এই যা। পাপন টাকে রাখলাম আমার কাছে ওকে কোথাও যেতে দিবনা। বেশ দেখে শুনে বৌ আনলাম। ভাবলাম এবার আমার দায়িত্ব শেষ।
সংসারের দায়িত্ব দিলাম ওকে। বেশ চলছিল সব। তবুও কোথায় যেন একটা অপূর্ণতা। ছোট বৌটা প্রায়ই বাড়ী যাবার জন্য বায়না করত একবার গেলে সহজে ফিরতনা। বলত মায়ের জন্য খারাপ লাগে। বেশীদিন না গেলেই দেখতাম মুখটা মলিন করে ঘুরে বেড়াচ্ছে কি আর করবে বেচারী বুড়ি শাশুড়ীর সাথে আর কিইবা গল্প করবে,পাপন তো সারাদিন থাকে হাসপাতালে। রাতে বাসায় আসে খায়দায় ঘুমায়,নাইট থাকলেতো কথাই নেই। এত ব্যস্ততা ছেলেটার দেখলে আমারই মায়া লাগে। ছোট বৌ মানে নিশি প্রেগন্যান্ট হবার পর থেকে বাবার বাড়ীতেই যেন স্থায়ী হয়ে গেল। পাপনের হাসপাতাল বাড়ী থেকে বেশ দূরে হওয়ায় সেও আলাদা বাসা নিয়ে চলে গেল। ছেলেটা সময়ই পায় এটুকু তাও যদি জার্নিতে চলে যায় তবে বৌ,বাচ্চাকে সময় দিবে কখন। ছেলেরা চাইতো আমরা ওদের সাথে গিয়ে থাকি। একটু একটু করে গড়ে তোলা আমার ৩০ বছরের সংসার চাইলে কি আর আমি তা ছেড়ে যেতে পারি?
না আমিও পারিনি ঠিক যেমন পারেননি আমার শাশুড়ী মা। আমরাও চেয়ে ছিলাম তিনি আমাদের কাছে থাকুক। কেন তিনি সেদিন রাজী হন নি সেটা এখন বুঝতে পারি। আমার শ্বশুর মারা যাবার পর তিনিও এমন একাকীত্বকে বরণ করে একসময় চলে যান আমাদের কে ছেড়ে। তার অতি স্নেহের পৌত্র পিয়াস তাকে শেষ দেখাও দেখতে আসতে পারেনি! নিয়মিত ফোনে কথা হত আমাদের ছেলেদের সাথে,বৌদের সাথে। এই সব ফরমাল কথা, কেমন আছি,কি করছি, কিছু লাগবে কিনা। কিছু সময় কথা বললেই যেন কথা ফুরিয়ে যেত অথচ এই আমারইতো বাকী সময়টা শুধু মনে হত কথা বলার কেউ নেই সেই আমিই আবার ওদের সাথে বলার জন্য কথা খুঁজে পেতামনা।
অথচ আমার বড় জা কে ফোন করলেই ফোন এনগেজড পেতাম। হয় পিয়ার সাথে না হয় পুতুলের সাথে কথা বলছে। মেয়েরা অফিস সংসারের ফাঁকে সময় বের করে ঠিকই মাকে মনে করত নিয়ম করে। বাড়ীতে আসবার সময় মায়ের পছন্দের কিছুনা কিছু কিনে আনত। ভাবি মুখে রাগ দেখালেও তার কথা শুনে ঠিক বুঝতাম মায়ের ভাললাগার প্রতি মেয়েদের আন্তরিকতা তাকে কতটা তৃপ্তি দিত। এখনকার মেয়েরা নিজেরা উপার্জন করে চাইলেই কত কিছু পারে আমাদের অবশ্য সে সুযোগ কমই হত।
ছুটিতে ছেলেরা আসত। ঘরটা যেন আমার স্বর্গ হয়ে উঠত তবে সেটা খুব কম সময়ের জন্যে শুধু এবাড়ীতেই পড়ে থাকলে হবে বৌদের ও তো একটু বাবার বাড়ী যাওয়া চাই। মেজ বৌ স্বর্ণাকে দেখতাম কেমন সুন্দর একটু পর পর ওর মাকে ফোন দিত। কি সুন্দর করে কথা বলত। ওর মাও ফোন দিচ্ছে যখন তখন বাহ্ দেখেই শান্তি। আমাকেও ওরা ভালবাসত, সম্মান করত, খেয়াল রাখত তবু কোথায় যেন একটা ফাঁক রয়েই যেত ঠিক যেমন ছেলেদের সাথে আমার! মা মেয়ের সম্পর্ক টা বুঝি মা ছেলের থেকে একটু বেশীই কাছের হয়?
আমার বিয়ে হয়ে যাবার পর আমার শুধু মনে হত আমি যদি ছেলে সন্তান হতাম পরিবারের হাল ধরতে পারতাম,বাবা মায়ের কাছে থাকতে পারতাম! তখনকার দিনেতো আর সবার হাতে হাতে ফোন ছিল না চাইলেও ও বাড়ীতে ফোন করে মন খুলে দুটো কথা বলতে পারতামনা। দীর্ঘ অপেক্ষার পর যখন বাবার বাড়িতে যেতাম আমারো ফিরতে মন চাইত না,ও বাড়ি থেকে কেউ এলে যেতে দিতে মন সায় দিত না, দীর্ঘ দুই যুগের বেশী সংসার করে এখনো অবচেতনে বাবার বাড়ীতে সেই অল্প বয়সের স্মৃতি গুলা হাতড়ে বেড়াই এই তো মা মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে, শরীর খারাপ হলে, খেতে না চাইলে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে, বাবা বারান্দা বসে আমাদের চার ভাইবোন কে পড়াচ্ছে, রাতে বাবা বাড়ীতে ফিরলে আমরা সবাই একসাথে খাবার খাচ্ছি,আমার বিয়ে সময় মা হাজারটা কাজের মাঝে বার বার দীর্ঘশ্বাস ফেলছে আর আমি মুখ ভার করে পুকুর ঘাটে বসে আছি…. প্রায়ই মনে হত ইস সেই দিনগুলা যদি ফিরে পেতাম পুরো একটা রাত মায়ের সাথে গল্প করে কাটিয়ে দিতে পারতাম!
ছুটি শেষে সবাই যখন ফিরে যেত আমি সেই তিন ছেলের মা আবারো একা নিঃসংগ হয়ে যাই। মন বেশী খারাপ করলে ফোন করি ওদেরকে বেশীর ভাগ সময়ই ওরা ব্যস্ত থাকে। নিজেদের ফোন দেবার সময় ওদের হয়না খুব একটা। দিন শেষে ওরা ভাল আছে এই ভেবেই রোজ নিশ্চিন্তে ঘুমতে যাই। ছেলেরা যখন ছোট তখন ওদের কাপড় কিনতে গিয়ে মেয়েদের জামা দেখে লোভ হত বটে তবে তক্ষুনি নিজের মনকে বুঝ দিতাম আমি তিন তিনটা পুত্র সন্তানের মা এমন কপাল কজনের হয়।
মৌ,স্বর্ণা, নিশি রা বিয়ের দিন মাকে ছেড়ে আসবার সময় যেমন কেঁদেছিল কই আমার ছেলেরা তো আমাকে ছেড়ে যাবার সময় কাঁদেনি নাকি আমি দেখতে পাইনি,আমাকে মিস করে বলেনি নাকি করলেও বলা হয়নি, আমার কাছে নিশির মত ছুটে আসেনি নাকি আসতে চাইলে সুযোগ হয়নি, আমাকে সকাল বিকাল স্বর্ণার মত ফোন দিয়ে জানতে চায়নি আমি নাস্তা করেছি কিনা, ঔষধ খেয়েছি কিনা নাকি জানার ইচ্ছা নিয়ে ফোন দিলেও জানতে চাওয়া হয়নি,আমার সাথেতো আমার ছেলেরা ফোন করে সারা দিনের জমানো কথা বলে হালকা হয়নি নাকি হতে চেয়েও আবেগটাকে বেসামাল হতে দেয়নি।
ইদানিং মাঝে মাঝেই মনে হয় আচ্ছা আমার যদি একটা মেয়ে থাকত স্বর্ণা, নিশি,মৌ এর মত অথবা আমার জায়ের মেয়ে পিয়া,পুতুলের মত তাহলে কি ওরা আমার নিঃসংগতা বুঝত,কখনো আমাকে বলত মা তোমার জন্য মন কেমন করছে, কেন আমাকে বিয়ে দিলে যদি তোমার কাছেই থেকে যেতে পারতাম, আমার সাথে রান্না ঘরে ঢুকে পিছু পিছু ঘুরত, হুট হাট এটা সেটা রান্না করতে গিয়ে নষ্ট করে গাল ফুলাতো,নিজের সব আবেগ অভিযোগ আমার কাছে জমা রাখত? এসব এলোমেলো ভেবে ভেবে প্রেশার, ডায়বেটিস বাড়িয়ে কি লাভ! আমিতো তিন পুত্র সন্তানের মা কত বিস্তৃত আমার সংসার হোক না বিচ্ছিন্ন। মনকে হেরে জেতে দেইনা দীর্ঘশ্বাস টা কে ভুল ভেবে লুকিয়ে ফেলি সচেতন মনে।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক