আমার ননদের বিয়ে হয়েছে মাত্র কয়দিন হল। আজ ওর শ্বশুরবাড়ি বেশ কিছু লোকজন নিয়ে দাওয়াতে এসেছে। আমি অনেকটা আশ্চর্য। যেখানে দেশের এমনকি আশেপাশের অবস্থা করুণ সেখানে উনাদের এত বিলাসিতার কারণ খোঁজে পেলাম না। দাওয়াত শেষে সবাইকে কাপড় চোপর সাথে আমার ননদের শ্বশুরালয়ে অনেক জিনিষপত্র সাথে দেওয়া হল। খাদ্যদ্রব্য সহ সব ই। যেখানে মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে না সেখানে আমাদের ঘরে উৎসব সরুপ মনে হচ্ছে। আমার শ্বশুর দাঁত খিলাল করে করে বেশ হাসি মুখে কার সাথে কথা বলছেন। বললেন, এখন ই তো সময় আমাদের যা আয় করার করতে হবে। এই বলে আমাকে ডেকে চায়ের কথা বললেন। আমি চা দিয়ে। রুমে এসে আদিবকে নাস্তার জন্য ডাক দিতে ই দেখলাম সে ল্যাপটপে এখনো বসে কাজ করছে। সেই ভোর উঠে কাজে লেগেছিল।
আমি অনেকটা রেগে বললাম, খাওয়াদাওয়া কি করা লাগবে না। সে একটু হেসে বলল আসছে। আমি রান্না ঘরে চলে গেলাম রাতের অনেকগুলো তরকারি ভাত রয়ে গেছে। এগুলো কিভাবে কাজে লাগানো যায় ভাবছি তখন ই আমার শাশুড়ি এসে বললেন এগুলো ফেলে দিতে বাসি হয়ে গেছে আর খাওয়া যাবে না। আমি ভাবলাম কাজের মেয়েকে দিয়ে দিব। তার আগে ই উনি সেগুলো ফেলে দিলেন। অনেক খারাপ লাগল এতগুলো খাবার এভাবে ফেলে দিলেন..! এই কয়দিনে আমার শ্বশুড়ের মেজাজ বেশ ফুরফুরে। হাতে অনেক টাকা পয়সা আসছে। ব্যবসার অনেক মাল স্টক করে রেখেছেন চড়া দামে বিক্রি করছেন। এসব দেখে কাউকে কিছু বলতে পারছি না। শেষে আদিবের কাছে গেলাম। সেও বলল ওসব বাবার কাজ কর্ম এসবে সে মাথা ঘামাতে চায় না।
আমার আর কিছু বলার নেই বলে চুপ হয়ে গেলাম। আর ভাবলাম মানুষ গুলো বুঝতে যেন দেরি না হয়ে যায়..! পরদিন সকালে সব কাজকর্ম শেষ করে দুপুরের সব রান্না করে রুমের মধ্যে বসে আছি। মাকে ফোন দিলাম। বাড়ির অবস্থা ভালো না বাবা মাকে বললাম যেন বাড়ি থেকে বের না হোন। কথা বলার মাঝে ই একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসছিল ১ম এভয়েড করলেও বার বার আসায় মাকে বললাম ফোন টা কাটতে। উনি ফোন কেটে দিলে আমি ফোন ধরতে ই অপর পাশ থেকে একটা পুরুষ কন্ঠ ভেঁসে আসল। যা শুনলাম মাথায় বাজ পড়ার মত অবস্থা। দৌড়ে বাবা মায়ের রুমে গেলাম। আদিবকে ব্যাংকে লেনদেন এর হিসাবে গরমিল করায় পুলিশ এরেস্ট করে নিয়েছে।
একথা শুনে সবাই ছুটে গেল সবাই। আদিবের ভাষ্যমতে সে সব হিসাবে ক্লিয়ার নোট দিয়েছে তারপরও কিভাবে এত টাকার কারচুপি কোথা থেকে হয়ে গেল সে নিজেও বুঝতে পারছে না। আমি আড়ালে আদিবকে বললাম আমাদের আগত সন্তানের কথা দিয়ে বলছি তুমি কিছু করনি তো.? সে আমার মাথায় হাত রেখে বলল সে কখনো এমন করার কথা চিন্তাও করতে পারে না। আমি কান্না করছিলাম। এমন অবস্থায় কি করা উচিত। হিসাবে কোটির মত হবে টাকা কারচুপি হয়েছে। ২/৩ দিন দৌড়াদৌড়ি করে কাজ হচ্ছে না অফিস আদালত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সব। বিকেলে এসব নিয়ে ঘরে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল সবাই নিরব। আমার ভাসুর উকিলের সাথে কথা বলতে গিয়ে ছিলেন। হঠাৎ দরজার সামনে আসতে ই পড়ে গেলেন।
সবাই ধরাধরি করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে দেখা গেল। উনার দু পা আর বাম হাত পুরো অবশ হয়ে গেছে প্যারালাইজ এর লক্ষণ। ডাক্তার নিশ্চিত করলেন প্যারালাইজড ই। আমার শ্বশুরেরর মাথায় হাত। চারদিকে অন্ধকার দেখছিলাম যেন সব। একজন চক্রান্তের শিকার হয়ে আটক আরেকজন বিছানায়। উন্নত চিকিৎসার জন্য বাইরে যাওয়ারও সুযোগ নেই। শ্বশুর কি করবেন না করবেন যেন হতভম্ব হয়ে গেলেন। কোনো দিকে কোনো কাজ ই যেন এগুচ্ছে না। টাকা আছে কিন্তু মানুষের অভাব সহযোগিতার অভাব। কাউকে ই ডেকে পাচ্ছিলেন না পাশে। বিকেলে এসবের মধ্য দিয়ে সময় যাচ্ছিল। হঠাৎ কারো কান্নার শব্দে তাকালাম। দেখলাম জায়নামাজে বসে সন্তানদের জন্য প্রাণ ভিক্ষা চাইছেন এক পিতা।
নিজের সব ভুলের মাশুল যেন সন্তানদের উপর আরোপ না হয় তার জন্য আল্লাহর কাছে অশ্রুসিক্ত নয়নে দু হাত তুলে বসে আছেন। এই দৃশ্যটা দেখে যেন আমিও আর থাকতে পারলাম না। মানুষ কোথায় ভুল করে আর আল্লাহ তা’লা কোথায় তার শোধ নেন তা কেউ বলতে পারে না। আর আল্লাহ জানেন কাকে কোথায় আঘাত করলে লাগবে। সবদিকে দৌড়াদৌড়ি করে অনেকটা ক্লান্ত। আদিব ফিরবে জামিনে। হাসপাতালে ভাই এরকম ই আছেন। সবাই ডাক দিলেন বাবা। ফোনে বললেন, যে অতিরিক্ত জিনিষ স্টক করে রাখা হয়েছিল তা যেন সুলব মূল্যে বিক্রির জন্য দোকানে নেওয়া হয়। আমরা সবাই দাড়িয়ে আছি। আমার শাশুড়ি চা বানানোর জন্য বললেন আমাকে। আমি যাব তখনি বাবা আটকে রাখলেন। কিন্তু কোনো কিছু ই বললেন না।
এভাবে বেশ সময় পার হলে এক এক করে সবাই যার যার ঘরে চলে গেল। সন্ধ্যার পর কাকে জানি খবর দেওয়া হল। বাবা তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বারান্দায় পায়চারি করছেন। কিরকম একটা অস্বস্তি হচ্ছিল মনে হয়। হঠাৎ আমার শাশুরির ডাকে গেলাম। দেখলাম বাবা বিছানায় কেমন জানি হা হুতাশ করছেন। মা মাথার কাছে বসা। বার বার বলছেন আসছে না কেন, কতক্ষণ আগে খবর দিলাম । কার জন্য এসব বলছেন ঠিক বুঝতে পারলাম না। শুধু বার বার একই কথা বলছিলেন। আর বললেন শেষ বারের মত ক্ষমা চাইতে পারব না নাকি আমার হাতে যে সময় নেই।
এসব বলতে বলতে হঠাৎ চুপ হয়ে গেলেন। আমরা সবাই যেন একরকম স্তব্ধ হয়ে গেছি। চোখের কোনে তখনও পানি ছিল বাবার। শেষে জানতে পারলাম আমার ভাসুরের সাথে মেয়েলি কোনো একটা গন্ডগোল ছিল একটা পরিবারের সেটা আমার শ্বশুর টাকা দিয়ে ধামাচাপা দেন। সেই পরিবারের কাছে নাকি ক্ষমা চাওয়ার জন্য কিন্তু পারেননি। আমাদের ভুলের মাত্রা পাপের মাত্রা এত যে শেষ পর্যন্ত সেই ভুলের ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ টুকু সৃষ্টিকর্তা দিতে নাও পারেন। আর এই ভুল ই হয়ত কাল হয়ে দাড়াতে পারে মানুষের জন্য…!! শেষ জীবনের আক্ষেপ যেন এটুকুতে রয়ে না যায়..!
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক