পনের দিনের বিবাহিতা লাইফে বাবার বাড়ীতে বরকে নিয়ে বেড়াতে এসেছি, আসলে ঠিক বেড়াতে নয়, বাবা ফোন দিয়ে জানালেন একটা জরূরী ফ্যামিলি মিটিং করবেন, আমরা যেন চলে আসি। আজ এই প্রথম এমন ঘটনা ঘটেছে যে বাবা ঘটা করে আমাদের সব ভাইবোনকে একত্রে করেছেন। দুইভাই আর ভাবীরা বাচ্চাসহ বাবা- মায়ের সাথে এবাড়িতে থাকে। দুপুরে সবাই একসাথে খেয়ে বিকেলে সবাই ড্রইংরুমে বসলাম। বাবা কিছুক্ষন পর আসলেন এবং মাকে পাশে নিয়ে বসলেন। খুব টেনশন হচ্ছে বাবা ঠিক কি বলতে পারেন।
হঠাৎ বাবা বলতে শুরু করলেন। শোন, তোমরা আমার সন্তান, জ্ঞান হবার পর থেকে হয়তো আমাকে ভাল মানুষ হিসেবেই জেনে এসেছো। আমিও চেষ্টা করেছি একজন আদর্শ বাবা হবার আর হয়তো কিছুটা পেরেছি যার ফলাফল আজ আমার প্রতিটা সন্তান সুসন্তান, উচ্চশিক্ষিত এবং যে যার মতো স্ট্যাব্লিসড। সবার ছোট রুমকী, তোমাকেও বিয়ে দিয়ে দিয়েছি, তুহিনের বৌ এলো তাও বছর পার হয়ে গেছে। সন্তানদের প্রতি এতটুকু দায়িত্ব অন্তত পালন করেছি। তবে আমি স্বামী হিসেবে মোটেও সাকসেস্ফুল নই বরং বিপরীতটাই বলতে পারো। বাবার কথা শুনে বাবাকে এবার থামানোর চেষ্টা করছেন মা কিন্তু বাবা মাকে বাঁধা দিয়ে বললেন, আজ আমাকে থামাতে চেয়ে কোনও লাভ হবেনা ফেরদৌসী। স্বামী হিসেবে বেলা শেষে হলেও অন্তত এখন আমি আমার দায়িত্ব কিছুটা পালন করতে চাই, আমি আমার সন্তানদের কাছে নিজের অন্যায় স্বীকার করতে চাই। আমরা ঠিক বুঝতেছিনা বাবা ঠিক কি বলতে চাইছেন।
বাবা আবার বলতে শুরু করলেন, আমি ছিলাম ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয় আর লেখাপড়ায় ভালো. আমি যখন ঢাকায় মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে বাড়ী গেলাম তখন আমার বাবা তাঁর এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের মেয়ের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেন। আমার নিজের যদিও কোনও পছন্দ ছিলনা কিন্তু মনে মনে ভাবতাম, আমি যাকে বিয়ে করবো সে খুব সুন্দরী হবে আর গায়ের রং টা ফর্সা হতেই হবে। কিন্তু মেয়ে দেখতে গিয়ে দেখলাম মেয়ে মোটেও ফর্সা নয় বরং তার উল্টো। আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যায় আর প্রচন্ড রাগ হয় আমার বাবার প্রতি কিন্তু বাবা অত্যন্ত রাগী ছিলেন তাই খুব ভয় পেতাম আর ভয়ে শেষ পর্যন্ত কিছু বলতে পারিনি।
এক সপ্তাহ বাদে আমাদের বিয়ে হয়ে যায়। তবে বিয়ে হলেও আমি সেই স্ত্রীকে মন থেকে মেনে নিতে পারিনি। সে বিভিন্ন ভাবে আমাকে খুশী করার চেষ্টা করতো কিন্তু আমি তাঁকে আমার সামনে দেখলেই বিরক্ত হতাম। অবশেষে আবার ঢাকা ফিরে এলাম আর একটা সরকারী চাকরীতে জয়েন করলাম। ভুল করেও স্ত্রীর কথা মনে হতোনা আমার।
আর এবার যেটা বলবো সেটা চরম লজ্জার তবুও আমি বলবো, নিজের পাপ স্বীকার আমি নিজের সন্তানদের কাছেও করবো, বলেই বাবা আবার শুরু করলো, চাকরী পাবার ছয়মাসের মধ্যে ঢাকায় আমি যে বাড়ীতে ভাড়া থাকি সেই বাড়ীর মেয়েকে ভাল লাগতে শুরু করে কারণ সেই মেয়ে খুব সুন্দরী। আমি এই ছয়মাসে একবারও গ্রামে যাইনি। সেই মেয়ের সাথে প্রায় প্রতিদিন বাড়ীর ছাদে কথা হতো এমনকি মনে মনে ভেবেও ফেলি কাউকে না জানিয়ে সেই মেয়েকে বিয়ে করে নেবো। কিন্তু হঠাৎ একদিন শুনি সেই মেয়ের হাসবেন্ড বিদেশ থেকে এসেছেন অথচ ওই মেয়ে এতদিন আমাকে একবারও বলেনি সে বিবাহিতা ছিল।
প্রচন্ড মানসিক কস্ট নিয়ে গ্রামে ফিরলাম কিন্তু নিজ স্ত্রীকে কোনোরকম সন্মান তো দিইনি বরং সামনে এলে মাঝেমাঝে দূরদূর করতাম আর সেই সুযোগটা আমার মা, বাড়ীর অন্য বৌরা নিতো। বাড়ীর দাদা, দাদীসহ বার, তের জনের লাকড়ির চুলায় রান্না সহ যাবতীয় কাজ ফেরদৌসীকে দিয়েই করানো হতো। আমি দু একবার আড়চোখে খেয়াল করতাম ওর হাতে ঠোসা পরে থাকতো পাটায় মশলা পেশার কারণে। সেই কাক ডাকা ভোরে উঠে বাড়ী, উঠোন ঝাড়ু দেয়া থেকে সবার জন্য জীবন বিলিয়ে দেয়াই যেন ওর নিত্যদিনকার রুটিন ছিল। তাতেও শান্তি ছিলনা, পান থেকে চুন খসলেই ওকে সবাই বিভিন্নভাবে হেনস্তা করতো। বাড়ীতে ওকে কেবল আমার বাবা ভালোবাসতেন।
যাহোক আমি ঢাকায় ফিরে আসি কিন্তু বাড়ীতে যাবার নাম পর্যন্ত করিনা। বাবা চিঠি পাঠালে কোনোরকম জবাব দিই। এভাবে হঠাৎ একদিন বাবার চিঠিতে জানতে পারলাম আমার একটা কন্যা জন্ম হয়েছে আর কন্যাটি দেখতে নাকি আমার মতোই। যাক আমার সন্তান অন্তত মায়ের মতো কালো তো হয়নি! আমি গ্রামে আসি। এভাবে আমার তিনটি সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। ততদিনে অবশ্য আগের মতো ফেরদৌসীকে অপমান না করলেও খুব যে ভালোবাসতাম সেটাও নয়।
এর মধ্যে হঠাৎ একবার একসিডেন্ট হয়ে আমার বাম পায়ের হাটু ভেঙে যায়। অনেকদিন ঢাকায় ট্রিটমেন্টের করার পর গ্রামে নিয়ে আসা হয়। সেসময় ফেরদৌসী আমাকে যেভাবে সেবা করে, ডাক্তাদের দেখানো নিয়মে ব্যায়াম করিয়ে আমাকে সুস্থ করে তোলে তাও পুরো সংসারের দায়িত্ব পালন করার পরও। আমি সেইসময় অবাক হয়ে ভাবী এ আমি কাকে পেলাম জীবনে! সুন্দর চেহারাই কি সব! রত্ন চিনতে এতো সময় লাগলো আমার! একটা সুন্দর মন পারে পুরো পৃথিবী আনন্দে ভরিয়ে দিতে। সেই প্রথম বিয়ের নয় বছর পর আমার চোখে ধরা পরলো পৃথিবীর সবথেকে সুন্দরী রমণী আমার ফেরদৌসী। তখন আমার অন্য ভাইয়ের বৌরা যখন ফেরদৌসীকে কাজের হুকুম করে, আমি একদিন বাঁধা দিয়ে চিৎকার করে বাড়ীর সবাইকে বলি, কেন আমার স্ত্রী সব কাজ করবে! অন্যদের মতো ও এই বাড়ীর বৌ। ওকে ওর যোগ্য সন্মান সবাইকে দিতে হবে।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ওকে আমি নয়টি বছর ধরে এতো অপমান করেছি, কস্ট দিয়েছি অথচ আমার সামনে তাঁকে কাঁদতে দেখিনি কখনও, হয়তো ভয়ে, হয়তো লুকিয়ে কেঁদেছে। কিন্তু সেদিন ফেরদৌসী চিৎকার করে কেঁদেছে আর বলেছে, তাঁর জীবনে যা চাওয়ার ছিল তা পেয়ে গেছে কারণ তাঁর স্বামী তাঁকে সকলের সামনে নিজের স্ত্রী বলে সন্মান দিয়েছে। সেদিন আমিও খুব কেঁদেছি। এমন একটা মেয়েকে আমি এতগুলো বছর এতো কস্ট দিয়েছি। ছয়মাস পর আমি আবার ঢাকায় ফিরে নতুন চাকরীতে জয়েন করি এবং ঠিক করি ফেরদৌসীকে আমার কাছে নিয়ে আসবো। কিন্তু বাঁধ সাধেন আমার মা। তিনি কিছুতেই ওকে আসতে দিলেননা। ও চলে এলে এতবড় সংসার সামলাবে কে! বাড়ীতে দাদা, দাদী, শ্বশুর, শ্বাশুড়ীর সেবা করবে কে?
এভাবে কেটে গেল আরও কয়েকটি বছর তবে তখন নিয়ম করে কদিন পর পর গ্রামে যেতাম আমার পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী রমণীকে দেখার তাগিদে হলেও। এর মধ্যে অবশ্য আমাদের ছোট মেয়ের জন্ম হয়। সিমকী , আমার বড় সন্তান তখন ক্লাশ নাইনে উঠেছে। মেয়েটি আমার খুব দ্রুত লম্বা আর সুন্দরী হয়ে যাওয়ায় গ্রামে রাখা বিপদজনক হয়ে ওঠে আর এটাকেই একটা সুযোগ বানিয়ে সেবার বাড়ীতে রীতিমতো ঝগড়া করেই তোমাদের সহ ফেরদৌসীকে নিয়ে ঢাকায় চলে আসি, আর সেদিনও আমাকে পূর্ণ সাপোর্ট দেন আমার আব্বা যার নয়নের মনি ছিল ফেরদৌসী।
চার সন্তানের লেখাপড়া, সংসার খরচ, বাড়ীতে টাকা পাঠিয়ে, কিছু টাকা ব্যাংকে গচ্ছিত রেখে কিছুই অবশিষ্ট থাকেনা যে যৌবনকালে তোমাদের আম্মাকে কোনওদিন ভাল একটা শাড়ী পর্যন্ত দিতে পেরেছি। তারপরও কোনোদিন কোনও অভিযোগ করেনি। বাবার মুখে মায়ের কষ্টের কথাগুলো শুনে আমরা সবাই কাঁদছি। এতোবছরে একটিবারের জন্যও মা কোনওদিন এসব কথা আমাদের বলেননি।
বাবা আবার বলা শুরু করলেন, বড় বৌমা, ছোট বৌমা, আমি তোমাদের দোষ দিচ্ছিনা। তোমাদের অধিকার আছে স্বাধীনভাবে বাঁচার তেমনি ফেরদৌসীরও। ও এখনও বাড়ীর সবার রান্না করে আর তোমরা সবাই যে যার ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যাস্ত। ছুটির দিনেও তোমরা নিজেদের মতো ঘুরে বেড়াও আর ফেরদৌসী সেই ঘরের কোনে বসে থাকে কিন্তু তারপরও বুঝতে পারি তোমরা বিরক্ত হও শ্বশুর, শ্বাশুড়ী নিয়ে সংসার করতে। তাই আমি চাই তোমরা আলাদা আলাদা বাসা নাও কারণ সেই এবিলিটি তোমাদের আছে আর সেটার চাইতেও বড় কথা, এই বয়সে এসে আবার ফেরদৌসীকে তোমাদের চোখের গরম মানতে হবে সেটা তো আমি মেনে নেবো না কিছুতেই। এবাড়িতে আমি আর তোমাদের মা থাকবো।
খুব অল্প টাকায় জমিটা কিনে রেখেছিলাম আর সেই টাকাটা ছিল তোমাদের মায়ের তাঁর বাবারবাড়ির দেয়া বিয়ের গয়না বিক্রির টাকা আর আমাদের জমানো কিছু টাকা। পেনশন পেয়ে তিনতলা বাড়িটা করলাম। বাড়িভাড়া বাবদ যেই টাকাটা আসবে সেটা আমাদের দুজনের জন্য ঢের। তোমাদের মাকে নিয়ে আমি তেমন ভাবেই থাকবো যেমনটা এ যুগের হাজবেন্ড ওয়াইফরা থাকে। তাঁকে নিয়ে রোজ ঘুরতে যাবো। শহর ঘুরাবো, সম্ভব হলে দেশের বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাবো আমার যতটুকু সামর্থ আছে তাঁর মধ্যেই। আমাদের প্রতি তোমাদের ফিন্যান্সিয়াল কোনও সাপোর্ট দিতে হবেনা শুধু মাসে অন্তত একটা শুক্রবার এবাড়িতে সবাই মিলে এসে আমাদের সাথে কাটিয়ে যাবে। সেটাও যদি না করো তাতেও আক্ষেপ থাকবেনা। ভেবে নিবো আমার সন্তানরা বিদেশ থাকে তাই চাইলেই দেখা করা সম্ভব নয়।
আমি এখন থেকে ঘরের কোনও কাজ ফেরদৌসীকে করতে দিবনা। কাজের মেয়ে থাকবে সেই সব কাজ করবে। আমরা জীবনের এই শেষ বেলাতে অন্তত একটু ভাল সময় কাটাবো নিজেদের মতো করে।
সব শুনে মা বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করলেন। ভাইয়ারাও বাঁধা দিতে চাইলেন। কিন্তু বাবা যেন এবার স্বার্থপর হয়ে গেলেন নিজের স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা নিজের মতো থাকার জন্য আর মা বাঁধা দিলেও তাঁর চোখ, মুখে কেমন স্বচ্ছ আলো যেন ছুঁয়ে যাচ্ছিল। অনেক বছরের না পাওয়া যেন এক নিমিশেই পেয়ে গেলেন। বাবা আবার বলতে শুরু করলেন, তোমাদের মাকে আমি যেদিন দেখতে যাই আজ হলো সেই বিশেষ দিন, আর তাই আমি তোমাদের মাকে নিয়ে আজ রেস্টুরেন্টে ডিনারে করবো। এই কথা শুনে মা যেন লজ্জায় তাকাতে পারছেন না কারও দিকে। শুধু মাথা নীচু করে বলছেন, আপনার দোহাই লাগে আপনি এই বয়সে এসব কিছু করতে যাবেননা, মানুষ হাসবে, টিটকারি দিবে।
বাবা বললেন, যে হাসার সে হাসবে। হাসলে হার্ট ভাল থাকে। তোমার আমার উছিলায় না হয় কিছু মানুষের হার্ট একটু পাকাপোক্ত হলো। বাবার কথায় এবার আমরা কেউ হাসি আটকে রাখতে পারলামনা। বাবা আবার বললেন, ঠিক এক সপ্তাহ পর আমাদের এনিভার্সারী আর জীবনে এই প্রথমবার আমি আমাদের এনিভার্সারী পালন করব তাও খুব আয়োজন করে। তোমাদের কিছুই করতে হবেনা শুধু ঐদিন প্রত্যেকে খুব ছোট্ট করে হলেও আমার ফেরদৌসীর জন্য এনিভার্সারী গিফ্ট নিয়ে এসো। বলেই বাবা বাচ্চাদের মতো কাঁদতে শুরু করলেন সাথে মা ও তবে এই কান্না আনন্দের, প্রাপ্তির।
গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক